এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৪
Yasira Abisha
রুহি দরজার সামনে স্থির দাঁড়িয়ে। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না।
যে ইরাদ আহসান, যাকে সে চিনেছে কড়া, আত্মভিমানী, কোল্ড-হার্টেড একজন মানুষ হিসেবে, সে-ই আজ দাঁড়িয়ে আছে তার দোরগোড়ায়।
সেই ইরাদ, যে তাকে হাসপাতালে দেখেও না দেখার ভান করে, আজ নিজেই এসেছে রুহির বাড়িতে।
রুহির চিন্তার বাঁধন ছিঁড়ে ইরাদ আবার বলল, “আমাকে সাহায্য করুন, রুহি। আমার মেয়ে আপনাকে ছাড়া বাঁচতে পারছে না।”
রুহি এক মুহূর্ত ইরাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
এই প্রথমবার সে অনুভব করল, ইরাদের সেই কঠোর দৃষ্টির আড়ালে একটা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত বাবা লুকিয়ে আছে।
তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আপনি ভিতরে আসুন, স্যার।”
রুহির বাসাটা ছোট, কিন্তু অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরা।
সাদা-ধূসর দেয়ালে মৃদু নীল আবহ, জানালার পর্দাগুলো হালকা ভেসে যাচ্ছে শীতল বাতাসে।
ঘরের একপাশে রাখা কাঠের বুকশেলফ, সেখানে সারি সারি বই, কিছু রঙিন ছোট্ট শোপিস।
ঘরজুড়ে একটা মিষ্টি গন্ধ—হয়তো ল্যাভেন্ডার বা স্যান্ডেলউডের।
শেলফের পাশে রাখা একটা ছোট সোফা, তার সামনেই কাঁচের সেন্টার টেবিল।
টেবিলের ওপর একটা খোলা বই আর তার পাশে রাখা সাদা কাপের কফি—যেন ঠিক এই মুহূর্তেও কেউ এক চুমুক নিয়ে বইয়ে ডুবে গিয়েছিল।
রুহির পুরো বাসাটাই এক ধরনের উষ্ণতা ছড়ায়, যেন এখানে এলে বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্টগুলোও আস্তে আস্তে গলে যায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইরাদ নীরবে বসে রইল।
সে এমন পরিবেশে অভ্যস্ত নয়।
তার জীবনজুড়ে শুধু হাসপাতালের করিডোর, রোগীদের ধূসর মুখ আর নিখুঁত ডিসিপ্লিন।
কিন্তু এখানে? এখানে যেন সময়ের গতি মন্থর হয়ে গেছে।
রুহি জিজ্ঞাসা করল, “স্যার, চা না কফি?”
ইরাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “এক গ্লাস পানি দিবেন।”
রুহি মাথা নেড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
তার হাত কাপে না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে।
কী অদ্ভুত!
এই মানুষটাকে সে কখনো কল্পনাও করেনি তার ঘরে বসে থাকতে দেখবে। ইরাদকে সবসময় খুব রহস্যময় লাগে রুহির কাছে।
যদিও ইরাদ শুধু পানি চাইলো তবে রুহি এক কাপ কফি তৈরী করলো সাথে এবং কফির কাপ হাতে নিয়ে এসে বসল।
ইরাদ পানিটা এক ঢোকে পান করলো এবং ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল,
“আমার মেয়ে আনাই মাত্র পাঁচ বছর বয়সী। ওর মা নেই।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরাদ আবার বলল,
“ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওর একমাত্র ভরসা ছিল আমি। কিন্তু এখন ও আপনাকে দেখার পর থেকে আমি ওকে আর সামলাতে পারছি না।”
ইরাদ চোখ নামিয়ে ফেলল, যেন নিজের দুর্বলতা স্বীকার করতে চাচ্ছিল না।
“ও খাওয়া-দাওয়া করছে না, সারাদিন শুধু কান্না করছে। গতকাল থেকে খুব জ্বর। ডাক্তার বলছে, স্ট্রেসের কারণে হচ্ছে। আমি জানি, এটা অন্য কিছু নয়। ওর শুধু একটা জিনিস চাই—আপনি।”
রুহি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
বাচ্চাটার মুখটা মনে পড়ে গেল।
সেদিন অফিসে একবারের জন্য তাকে মা বলে ডেকেছিল আনাই।
সেই একবারেই রুহির হৃদয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হয়েছিল, যা আজও মুছে যায়নি।
একটা ছোট্ট শিশু মায়ের আদর না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে—এটা ভাবতেই রুহির বুকটা হাহাকার করে উঠল।
ইরাদ কফির কাপটা নামিয়ে রেখে সরাসরি রুহির দিকে তাকাল।
“মিস রুহি, আপনি কি আজকে আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন?”
তার কণ্ঠে অনুরোধের চেয়ে বেশি কিছু ছিল—একটা আশা, একটা ভরসা, একটা আত্মসমর্পণ।
রুহি কিছুক্ষণ চুপ রইল।
তার ভিতরে যেন দুইটা কণ্ঠ যুদ্ধ করছে।
একটা কণ্ঠ বলছে, “তুমি কেন এই ঝামেলায় জড়াবে? তুমি তো আনাইয়ের মা নও!”
অন্য কণ্ঠ বলছে, “ও একটা ছোট্ট শিশু! মায়ের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে! তুমি কি পারবে না ওর জন্য একটু সময় দিতে?”
কিন্তু আসলে উত্তরটা সে জানত।
তার মনে হচ্ছিল, এই প্রশ্নটা যেন সে অনেকদিন ধরে শোনার অপেক্ষায় ছিল।
সে হাসল না, কাঁদলও না, শুধু মাথা নিচু করে এক মুহূর্ত ভাবল।
তারপর ধীরে ধীরে বলল, “চলুন, ইরাদ স্যার। আমি আনাইয়ের কাছে যাবো।”
ইরাদের মুখটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল।
আজ অনেকদিন পর সে যেন বুকের ভেতরটা একটু হালকা অনুভব করল।
রুহির মনে কেমন যেন এক অজানা উচ্ছ্বাস কাজ করল।
আজ আবার আনাইকে দেখবে সে।
আবার সেই ছোট্ট মুখটা, সেই চাহনি…
আর আজ প্রথমবার, ইরাদের মুখেও একটা স্বস্তির ছায়া দেখল সে অহনা যাওয়ার পর।
বিকেল গড়িয়ে তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে গেছে, রুহি কিছুক্ষণের ভেতর তৈরি হয়ে এলো আনাইকে দেখতে যাওয়ার জন্য
ইরাদ গাড়ি চালাচ্ছে, আর রুহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।
আজ বেশ ফাঁকা রাস্তা,
দ্রুত গাড়ি চলছে আর রাস্তার বাতিগুলো একটার পর একটা পেছনে পড়ে যাচ্ছে।
আজ রুহির মন শান্ত নয়।
বাচ্চাটাকে সে একদিনই দেখেছে, অথচ মনে হচ্ছে, আনাই যেন ওরই কিছু।
ওর মায়াবি চোখের সেই চাহনি, ছোট্ট হাতে আঁকড়ে ধরা…
সেই একবারের ডাক—”আম্মু!”
এত গভীর টান কেন অনুভব করছে সে?
ঘন্টা খানিক সময়ের মধ্যে তারা পৌছে গেলো,
ইরাদ আহসানের বিশাল বাড়িটা রাতের অন্ধকারেও এক অভিজাত শৈলীতে দাঁড়িয়ে আছে।
সাদা মার্বেলের ছিমছাম রাস্তা ধরে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশাল বাগান, যেখানে দুর্লভ সব ফুল ফুটে আছে।
বাড়ির স্থাপত্যে এক রাজকীয় ছোঁয়া—উচ্চ ছাদ, ঝুলন্ত ঝাড়বাতি, সোনালি কাঠের কাজ করা দরজা।
সব কিছু নিখুঁত, দামি, অথচ শীতল।
এখানে বিলাসিতা আছে, কিন্তু প্রাণ নেই।
আনাইয়ের ছোট্ট পায়ের শব্দ, তার হাসি-ঠাট্টা ছাড়া এই বাড়ি যেন একটা শূন্য অট্টালিকা।
এ বাড়ি ইরাদের, কিন্তু তার জীবনের উষ্ণতা হয়তো এখানেই থমকে গেছে…
কলিং বেল বাজতেই দরজা খুললেন রাজিয়া খালা, সেই সাথে সে বিস্ময়ে থমকে গেলেন।
তাঁর চোখ আটকে গেল রুহির মুখে।
“হায় আল্লাহ! অহনা আম্মা?”
রুহি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
“খালা উনি মিস রুহি আমাদের হসপিটালের নিউট্রিশনিস্ট, আনাইয়ের জন্য এসছেন।”
বলে উঠে ইরাদ।
রাজিয়া খালা দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন।
কিন্তু তাঁর চোখের গভীরে স্পষ্ট অবিশ্বাস আর বিস্ময়ের ছায়া।
ওনার মনে পড়ে গেল, কতদিন আগে ঠিক এমন এক মেয়েকে এই বাড়ির বউ হিসেবে কল্পনা করেছিলেন।
অহনা তো ছিল বিদ্রোহী,
আর এই মেয়ে?
এ যেন এক রহস্যময় শান্ত নদী…
রাজিয়া খালা হেসে বললেন, “আসুন মা, আনাই আপনাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।”
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই একটা দুর্বল কণ্ঠ কানে এলো—
“বাবা… মা আসছে তো?”
রুহির বুক কেঁপে উঠল।
আনাই বিছানায় শুয়ে আছে, গায়ে কম্বল জড়ানো।
মুখটা কেমন ফ্যাকাশে, কপালের ওপর তাপমাত্রার ছাপ স্পষ্ট।
ওর চোখ দুটো ক্লান্ত, কিন্তু ভেতরে একটা অপেক্ষা জমে আছে।
রুহিকে দেখতেই আনাই ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করল।
“আম্মু…”
রুহি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না।
দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আনাইকে নিজের বুকে টেনে নিল।
“আম্মু, তুমি এলে?”
রুহির কণ্ঠ আটকে গেল।
সে শুধু আনাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
ইরাদ পাশ থেকে তাকিয়ে শুধু দেখছে নিরব দর্শকের মতো।
ইরাদ একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকটা হেলান দিয়ে দরজার কাছে। যে মেয়ে ও বলতে পাগল আজকে ওকে রেখে রুহির কাছে চোখ বন্ধ করে জড়িয়ে আছে।
এই দৃশ্যটা ওর কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।
রুহির চোখে-মুখে মাতৃত্বের একটা উষ্ণ ছাপ, আনাইয়ের মুখে প্রশান্তি।
এমনভাবে দু’জনকে জড়িয়ে থাকতে দেখে ইরাদের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে ওর ভেতর থেকে…
অহনা…
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, “আনাই, কেমন লাগছে এখন মা?”
আনাই মুখটা একটু উপরের দিকে তুলে বলল,
“ভালো… আম্মু এসেছে তো!”
রুহি ধীরে ধীরে আনাইয়ের চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “এখন থেকে ভালো থাকতে হবে, তাই না?”
আনাই মাথা নাড়ল, ছোট্ট হাতে রুহির হাত চেপে ধরল।
“আম্মু তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ?”
“যাবো না মামণী!”
এই বলে রুহি আনাইকে কোলে তুলে নিলো,
রুহির হাতে আনাই খাবার খেয়ে, ওর কোলেই ঘুমিয়ে গেলো।
আজ রুহির পরনে একটা নীল শাড়ি, হালকা রুপোলি কাজ করা।
চোখে সামান্য কাজল, ঠোঁটে মৃদু হাসি।
অন্যরকম লাগছে ওকে।
ইরাদ তাকিয়ে রইল।
এ কি সেই মেয়ে, যাকে সে এতদিন উপেক্ষা করেছে? রুহিকে উপেক্ষা করতে তার কষ্ট হয় এমনিতেই।
তবে কেন মনে হচ্ছে, এই রুহিকে সে আগে কখনো দেখেনি? একটা মেয়ে যার কিছুই না আনাই সে কেনো এতটা মমতাময়ী আচরণ করছে? অহনার প্রতিও তো ইরাদ পুনরায় আটকে গেছিলো আনাইয়ের জন্যই… নাহয় এতো ভালোবাসার পরেও যখন ক্যারিয়ারের দোহাই দিয়ে অহনা বিদেশে পাড়ি জমায় ইরাদ ভেবেছিলো আর এসব নিয়ে ভাববে না বরং ভুলে যাবে অহনাকে।
আজকে এতো বছর পর একই চেহারার মেয়ে রুহি ইরাদের তাকে দেখে কেনো এমন অস্থির লাগছে?
তার চেহারায় একটা অদ্ভুত প্রশান্তি, অথচ গভীরে লুকিয়ে আছে এক অজানা কষ্ট।
ইরাদ ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল।
রাতের হালকা বাতাস তার চুলের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরের অস্থিরতাকে প্রশমিত করতে পারছে না।
তার হাত ধীরে ধীরে রেলিংয়ের ওপর রাখা, চোখ সামনে অথচ মন এলোমেলো।
সে কি আবারও দুর্বল হয়ে পড়ছে?
রুহিকে দেখে, আনাইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা দেখে…
কেন এত প্রশ্ন জাগছে মনে?
কেন মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা শুধু আনাইয়ের জন্যই নয়—
এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৩
তার নিজের জীবনেও কোনো একভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে?
অহনার পরে বা আগে সে কখনোই দুর্বল হয়নি, কাউকে জীবনে প্রবেশ করতে দেয়নি।
তাহলে আজ কেন বুকের ভেতর এক অজানা অনুভূতির স্রোত বইছে?