এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৫

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৫
Yasira Abisha

রাত প্রায় বারোটা। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। শুধু দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাজিয়া খালা রাতের রান্না সেরে সন্ধ্যার পরই নিজের বাড়িতে চলে গেছেন, কারণ তার ছেলেমেয়েরা বেড়াতে এসেছে। ইরাদের বাবা-মাও দেশের বাইরে। এখন এই বিশাল বাড়িতে মাত্র তিনজন—ইরাদ, রুহি, আর ছোট্ট আনাই।
ইরাদ ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে আনাইয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। একটুখানি ফাঁকা রাখা দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। আলো ম্লান হয়ে এসেছে, শুধু জানালার পর্দা থেকে আসা চাঁদের মায়াবী আলোতে ঘরটা স্নিগ্ধ লাগছে।
শিশিরছোঁয়া ঘুমন্ত রাতের মতো শান্ত রুহির মুখটা। পাশে আনাই, ছোট্ট হাতে ওর শাড়ির আঁচল আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। ওদের দুজনকে এভাবে দেখে ইরাদের মনে হয়—এ যেন এক পরির গল্পের দৃশ্য!

রুহিকে দেখে কখনো কখনো মনে হয়, সে যেন স্বপ্নের মতো। অবিশ্বাস্য রকমের শান্ত, ধৈর্যশীল, আর নিখুঁত এক মা হয়ে উঠেছে আনাইয়ের জন্য। আনাইও ওকে নিজের মা বলেই মনে করে।
কিন্তু… কেন যেন ইরাদের মনে হতে থাকে, শুধু আনাইয়ের জন্য নয়, রুহি আরও বেশি কিছু হয়ে উঠছে তার জীবনে…
ঠিক তখনই রুহির ঘুম ভেঙে যায়। খুব মৃদু পায়ের শব্দে সে বুঝতে পারে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ খুলে ইরাদকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য চমকে ওঠে, তারপর ধীর কণ্ঠে বলে,
— “কিছু বলবেন, স্যার?”
ইরাদ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,
— “আপনি রাতের খাবার খাননি। চলুন।”
রুহি চোখ ঘুরিয়ে আনাইয়ের দিকে তাকায়। মেয়েটা ওর গায়ের সাথে লেপ্টে আছে, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।
ইরাদ লক্ষ্য করে, রুহির চোখে ক্লান্তি। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপের পরও এই মেয়েটা আনাইকে যত্ন করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হয়নি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “আপনি না খেলে সুস্থ থাকবেন কীভাবে? আনাই আপনাকে চাইবে তো, তাই না?”
এই কথায় রুহি আর না বলতে পারে না। আনাইকে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
ডাইনিং টেবিলে দু’জন। বাড়িটা এত বড়, অথচ এখন কেমন খালি লাগছে।
ইরাদ নিজে রুহির জন্য খাবার সাজিয়ে দেয়, আর রুহি চুপচাপ তাকিয়ে দেখে।
— “আপনার তো খেতে দেরি হয়ে গেছে,” ইরাদ বলে।
— “এটা নতুন কিছু না,” রুহি হালকা হেসে বলে।
— “কেন? আপনি কি সবসময় নিজের যত্ন নেন না?”
রুহি একটু থামে। তারপর বলে,
— “অভ্যাস নেই। অনেক আগে থেকেই।”
ইরাদ বুঝতে পারে, এই ‘অনেক আগে’ বলার পেছনে অনেক গল্প আছে।
খাওয়ার সময় ইরাদ আস্তে আস্তে বলে,
— “আনাই খুব শক্ত মেয়ে, কিন্তু ভেতরে ভীষণ নরম। ওর মা চলে যাওয়ার পর আমি কখনো বুঝিনি, একটা ছোট্ট মেয়ে এতটা শূন্যতা অনুভব করতে পারে।”
রুহি নীরবে শোনে।

— “আপনার আনাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা মনে আছে, স্যার?”
ইরাদ স্মিত হেসে বলে,
— “যখন সে আপনাকে মা বলে ফেলেছিল?”
রুহির ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যায়।
— “সত্যি বলতে, সেই দিন থেকেই আনাই আমাকে ভোলেনি।”
ইরাদ এবার একটু গম্ভীর হয়।
— “শুধু আনাই কেন, রুহি? আপনাকে কি কেউ ভুলতে পারে?”
রুহি চুপ হয়ে যায়। ইরাদের কণ্ঠে আজ কেমন যেন একটা ভিন্ন আবেগ, ভিন্ন আবেদন।
রুহি খাওয়া শেষ করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
ইরাদ লক্ষ্য করল, ওর চোখে এখনো ক্লান্তির ছাপ। সারাদিনের ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
রুহি হাত ধুয়ে আসতেই বলল,

“স্যার আমার এখন বাড়ি ফেরা উচিত”
“আপনি কি এখনই চলে যাবেন?”
রুহি একটু ইতস্তত করল।
“হ্যাঁ, স্যার। আমার তো বাড়ি যাওয়া দরকার রাত হয়েছে বেশ…”
ইরাদ একটু থেমে বলল,
“আপনার যদি কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকে, আজ রাতটা এখানেই থাকুন।”
রুহি চমকে তাকাল।
এই বাড়িতে থাকা?
কিন্তু মুহূর্তেই মনে হলো, সত্যিই তো, বাসায় তো কেউ নেই। আর আনাইকে একা ফেলে যেতেও মন চাইছে না।
সে একটু ভেবে বলল, “আচ্ছা স্যার, থাকবো।”
ইরাদের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির আভাস এল, তবে সেটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।
সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনার রাতের পোশাকের জন্য কিছু নিয়ে আসছি।”

কিছুক্ষণ পর, ইরাদ একটা নতুন অরেঞ্জ টি-শার্ট আর ট্রাউজার এনে রুহির হাতে দিল।
রুহি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই ইরাদ বলল,
” পরতে পারবেন তো?”
রুহি কিছু বলল না, শুধু মাথা নেড়ে পোশাকগুলো নিলো।
(অহনার জন্য কিনেছিলাম, কিন্তু সে তো নেই…)
কথাটা মুখে ফুটল না, কেবল মনে মনে বলল ইরাদ।
অদ্ভুত একটা শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরল।

আনাইয়ের ঘরের ব্যালকনিতে এসে বসল ইরাদ আর রুহি।
রাত গভীর, চারদিকে শুধু শহরের আলো ঝলমলে নীরবতা।
আনাই বিছানায় শুয়ে, নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে পড়ছে।
তবে তার ছোট্ট হাতটা এখনো রুহির হাতের দিকে বাড়িয়ে আছে, যেন ঘুমের মধ্যেও মাকে ছাড়তে চাচ্ছে না।
ইরাদ চুপচাপ তাকিয়ে ছিল মেয়ের দিকে।
“ওকে দেখলে ঘুম আসে না। ভয় লাগে, যদি জ্বর বেড়ে যায়… যদি আবার জেগে উঠে মাকে খোঁজে…”
রুহি আস্তে আস্তে বলল,
“বাচ্চারা মাকে হারানোর ভয়টা সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে না। বিশেষ করে আনাইয়ের মতো একটা শিশু… যার পৃথিবী শুধু বাবা আর মা।”
ইরাদ মাথা নিচু করল।
রুহি একটু হেসে বলল,

“আপনিও তো কিছুদিন ধরে ঘুমাচ্ছেন না, তাই না?”
ইরাদ ভ্রু কুঁচকালো,
“আপনি কিভাবে বুঝলেন?”
“বাবারা যখন সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন থাকে, তখন তাদের চোখেই তা লেখা থাকে।”
ইরাদ কিছু বলল না।
হালকা বাতাস বইছিল, রুহির চুলগুলো একটু একটু উড়ে আসছিল মুখের সামনে।
রুহির চোখ আনাইয়ের দিকে, কিন্তু ইরাদ তাকিয়ে ছিল রুহির দিকে।
“রুহি, আপনি কেন একা?”
ইরাদের সরাসরি প্রশ্নে রুহি এক মুহূর্ত চুপ থেকে তাকাল ওর দিকে।
“যদিও এটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন, তবুও জানতে ইচ্ছে হলো। আপনার ওয়ার্ক প্রোফাইলেও তো দেখলাম, আপনি সিঙ্গেল। বিয়ে নিয়ে ভাবছেন না?”
রুহি একটুখানি ম্লান হাসল।
“না, স্যার। বিয়ে নিয়ে ভাবছি না।”
“কেন?”

ইরাদের কণ্ঠে কৌতূহল, কিন্তু কেমন যেন নরম একটা ভাবও ছিল।
রুহি এবার চোখ নামিয়ে নিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে বলল—
“ভেবেছিলাম, স্যার। একসময় খুব ভেবেছিলাম।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রুহির ঠোঁটের কোণে।
“কিন্তু আমি আর সেই রুহি নেই। যে মেয়েটা ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখেছিল একটা সুন্দর সংসারের, ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে সারাজীবন পাশে থাকার—সেই মেয়েটা আজ কোথাও নেই।”
ইরাদ চুপচাপ শুনছিল।
“আমি যখন ছোট ছিলাম, সবাই বলত, আমি আর আফান একসঙ্গে সুন্দর একটা দম্পতি হবো।”
“আমিও তাই বিশ্বাস করতাম। ছোটবেলা থেকে আমরা একসঙ্গে ছিলাম, ও ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমি জানতাম, ও আমায় ভালোবাসে, আমিও ওকে।”

রুহির গলা একটু কাঁপল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল।
“কিন্তু… ভালোবাসা কি আসলেই এতটা সহজ? নাকি আমরা শুধু গল্পের মতো কল্পনা করি?”
ইরাদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রুহির দিকে।
“যখন জানলাম, আফান আমারই কাজিনের সঙ্গে প্রেম করছে… যখন দেখলাম, আমার আপন মানুষটাই আমাকে ফাঁকি দিয়ে অন্য কারও কাছে চলে গেল…”
রুহি তিক্ত হেসে বলল,
“সেদিন বুঝলাম, ভালোবাসা শুধু মিষ্টি কথায় গড়া একটা স্বপ্ন নয়, বরং এক কঠিন বাস্তবতা।”
“ও শুধু আমার প্রেমিক ছিল না, আমার আপনজন ছিল।”
“আমি শুধু ভালোবাসা হারাইনি, আমি আমার বিশ্বাসও হারিয়েছি।”
ইরাদ এবার সত্যিই স্তব্ধ হয়ে গেল।
রুহি নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আফান আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু আমি এখনও সেই শূন্যতার মধ্যে আটকে আছি।”
“আমি জানি না, কখনও সেই বিশ্বাস ফিরে আসবে কি না।”
একটা নীরবতা নেমে এল।
ইরাদ ধীরে ধীরে বলল,

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৪

“আপনার ভেতরে এখনও কষ্টটা রয়ে গেছে, তাই না?”
রুহি মুখ তুলে তাকাল ইরাদের চোখে।
“হয়তো, স্যার। কিছু কষ্ট থেকে যায়, সারাজীবন… শুধুই সহ্য করার জন্য।”
ইরাদ এবার সত্যিই বুঝতে পারল,
এই মেয়েটা কেবল একজন প্রতারিত প্রেমিকা নয়—সে একজন প্রতারিত মানুষ, যে নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে।
রুহির এই শূন্যতা কি কখনো পূরণ হবে?
কেউ কি কখনো ওর পাশে সত্যিকারের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াবে?

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৬