এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৯

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৯
Yasira Abisha

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরাদ ফিরে এলো।
ইরাদের পরনে হালকা বেগুনি রঙের শার্ট, হাত গুটানো, চুলগুলো এলোমেলো হলেও তাতে একটা অন্যরকম সৌন্দর্য আছে।
রুহি ওর দিকে তাকাতেই ইরাদের চোখের কোণে হালকা এক মিষ্টি হাসি খেলে গেল।
“তাহলে রেডি?”
রুহি এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। ইরাদের কণ্ঠে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, শুধু একটা সহজাত স্বাভাবিকতা।
“হুম…” আস্তে বলল ও।

ইরাদ গাড়িটা পার্কিংয়ে রাখতে না রাখতেই আনাই খুশিতে লাফিয়ে নামতে চাইল।
“আব্বু, আব্বু! আম্মু, দেখো তো! কত সুন্দর জায়গা!!”
রুহি গাড়ি থেকে নেমেই অবাক হয়ে চারপাশটা দেখতে লাগল।
বিকেলের সোনালি রোদে জায়গাটা একদম মায়াময় লাগছে।
চারপাশে সারি সারি গাছ, মাঝে একটা বড় লেক। বাতাসটা হালকা, গায়ে লাগলেই যেন মন জুড়িয়ে যায়।
কোথাও কোথাও কাঠের বেঞ্চ রাখা, কিছুটা দূরে একটা ছোট কফিশপের মতো আছে।
“বাহ! এত সুন্দর জায়গা!” রুহি বিস্মিত স্বরে বলল।
ইরাদ এক গাল হাসল, “পছন্দ হয়েছে?”
রুহি চোখ ছোট করে তাকাল, “আপনি কি ভাবছেন, আমি আনাইয়ের মতো লাফিয়ে আনন্দ করব?”
ইরাদ ঠান্ডা গলায় বলল, “করতে পারো, দেখতে মন্দ লাগবে না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুহি চমকে তাকাল।
এই লোকটা…! এই লোকটা কি ইরাদ স্যার?
আনাই হাসতে হাসতে বলল, “আম্মু, তুমিও লাফাও না! আমি তোমার সাথে খেলব!”
রুহি এক মুহূর্তের জন্য কথা হারিয়ে ফেলল।
আর ইরাদ?
সে শুধু মৃদু হাসল।
একটু বিশেষ সময়…
ওরা লেকের ধারে বসে আছে।
আনাই হঠাৎই বলল, “আব্বু, আম্মু! আমি ঐ ফুলগুলো আনতে যাব!”
কিছুটা দূরে নীলচে-বেগুনি ফুল ফুটে আছে।
ইরাদ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “একদম না, বেশি দূরে যাওয়া যাবে না।”
আনাই মুখ ফুলিয়ে বলল, “একটু! খুব বেশি না! আম্মু, তুমি বলো না!”
রুহি ওর চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “আচ্ছা, কিন্তু সাবধানে যেও, ঠিক আছে?”
আনাই খুশিতে মাথা নাড়িয়ে দৌড়ে গেল, তবে চোখের আড়াল হলো না।
রুহি আর ইরাদ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল।
রুহি আর ইরাদ কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল।
হঠাৎ ইরাদ বলল, “তুমি কি সবসময় এত কথা বলো?”
রুহি অবাক হয়ে তাকাল, “মানে?”

“মানে, আমি ভাবছিলাম, এই দু’মিনিট তুমি চুপচাপ বসে আছো। এটা তো তোমার স্বভাবের সঙ্গে যায় না।”
রুহি একটু লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, “আপনার কি মনে হয়, আমি শুধু কথা বলতেই ভালোবাসি?”
ইরাদ মৃদু হাসল, “হুঁ। তবে আজ তোমার চুপ থাকাটাও ভালো লাগছে।”
রুহি কিছু বলার জন্য মুখ খুলল, কিন্তু তখনই একটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে ওর চুল উড়িয়ে দিলো।
ওর কয়েকটা চুল মুখের সামনে এসে পড়ল, আর তখনই—
ইরাদের হাতটা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে রুহির গাল ছুঁয়ে চুল সরিয়ে দিলো।
রুহি এক মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল।
ইরাদের আঙুলের স্পর্শ হালকা, কিন্তু এতটাই গভীর যে ওর বুকের ভেতর কেমন যেন শিহরণ খেলে গেল।
রুহি দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো।

“আম্মু!!”
আনাইয়ের কণ্ঠ শুনেই রুহি উঠে দাঁড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ওর কান যে একদম লাল হয়ে গেছে, সেটা বুঝতে পারছে খুব ভালোভাবেই।
আর ইরাদ?
সে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল।
ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলা করছে, যা ও নিজেও লুকাতে পারেনি…

একটা অদ্ভুত সন্ধ্যা
বিকেল নেমে এসেছে। নরম রোদ্দুর, হালকা ঠাণ্ডা বাতাস, আকাশে লালচে আভা।
ইরাদ আনাইয়ের ছোট্ট হাত ধরে হাঁটছে, আর পাশে রুহি। আশেপাশের মানুষজন হয়তো ভাবছে, এটা একটা সুখী পরিবার।
রুহির মনে হলো, এই মুহূর্তটা যেন কেমন স্বপ্নের মতো।
আনাই একদম ছটফট করছে। “আমরা এখনই ঘুড়ি ওড়াবো!”
“ঘুড়ি কি এমনি এমনি উড়বে?” ইরাদ হাসল, “আগে কিনতে হবে তো!”
ওরা রাস্তার পাশের ছোট্ট দোকান থেকে রঙিন ঘুড়ি কিনল। আনাই গোলাপি আর সাদা রঙের একটা ঘুড়ি নিল, তাতে ছোট্ট করে ওর নাম লেখা।

“আব্বু, এটা তুমি উড়াবে, আমি সুতা ধরে রাখবো!”
“আর আম্মু?” ইরাদ আস্তে বলল।
রুহি চমকে তাকালো।
ইরাদ এত স্বাভাবিকভাবে কথাটা বলল, যেন এটা বলা ওর অভ্যাস হয়ে গেছে। যেন এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
রুহি আনাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আমিও সাহায্য করবো, মা।”
বিকেলের শান্ত নরম আলোয়…
ঘুড়িটা বাতাসে উড়তে শুরু করল। রুহি আর আনাই সুতা ধরে আছে, আর ইরাদ চালাচ্ছে।
একটা সময়, রুহির হাত ইরাদের হাতে লেগে গেল।
এক মুহূর্তের জন্য দুজনেই থেমে গেল।
রুহি দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। ইরাদ একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার ঘুড়িতে মন দিল, কিন্তু তার মধ্যেও একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করছিল।
ওর ভেতর কেমন যেন একটা অদ্ভুত অস্থিরতা বাড়তে লাগল।
এই অদ্ভুত সম্পর্কটা ঠিক কী?

এই মেয়েটা তো অহনা নয়। কিন্তু কেন যেন বারবার ওর দিকে তাকালে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়।
ও কি… অহনাকে ভুলে যাচ্ছে?
নাকি… রুহির জন্য অন্য কিছু অনুভব করছে?
ইরাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, রঙিন ঘুড়িটা ওপরে উঠছে।
সন্ধ্যার সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়ে ইরাদ যখন বাসায় ফিরল, তখন বেশ ক্লান্ত ছিল। আনাই ঘুমিয়ে পড়েছে, রুহিকেও ইরাদ তার বাড়িতে দিয়ে এসেছে।
ইরাদ শুয়ে পড়ল। ঘুম আসতে সময় লাগল না।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ও হঠাৎ চমকে উঠে বসল!
একটা বিভীষিকাময় স্বপ্ন…..
রাতের অন্ধকারে একটা রাস্তা। তীব্র হেডলাইটের আলো। ব্রেকের বিকট শব্দ। একটা গা ছমছমে নীরবতা।
তারপর…
রক্ত।
ইরাদ শ্বাস নিতে পারছিল না। ওর বুকের ভেতর ধকধক করছিল।

“ওটা আবার সেই রাতের মতো…”
ওর হাতের তালুতে ঘাম জমেছে।
সেই রাত… যখন একটা রোড অ্যাক্সিডেন্ট ওর জীবন পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল।
কিন্তু ঠিক তখনই ফোনটা বাজল।
ইরাদ দ্রুত ফোনটা তুলল। স্ক্রিনে হাসপাতালের নাম ভাসছে।
“ইরাদ স্যার, আপনি দ্রুত আসতে পারবেন?” ওপাশ থেকে নার্সের চিন্তিত কণ্ঠ।
“কি হয়েছে?” ইরাদ ধীরে জিজ্ঞেস করল, যদিও তার মনে হচ্ছিল, উত্তরটা ভালো হবে না।
“একটা বড় ইমার্জেন্সি কেস এসেছে, স্যার। চট্টগ্রামে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। মাল্টিপল ইনজুরড পেশেন্ট। হাসপাতালের একটা মেডিকেল টিম পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু আমাদের বেস্ট ডাক্টর আর সার্জন দরকার।”
ইরাদ চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য।

তারপর ধীরে বলল, “আমি আসছি।”
গাড়িতে ওঠার আগে ওর মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগের কথা।
সেদিনও এমনই এক ফোন এসেছিল, আর ও ছুটে গিয়েছিল… কিন্তু ফিরতে হয়েছিল শূন্য হাতে।
তাদের আর ফিরিয়ে আনা যায়নি।
আজকের এই ডাকটা কি আবার সেই অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে? নাকি এইবার… ও পারবে কাউকে বাঁচাতে?
ইরাদ গভীর শ্বাস নিল।
গাড়ি স্টার্ট দিল, আর রাতের আঁধারে ছুটে চলল হাসপাতালের দিকে…
রাত তখন প্রায় এগারোটা।
রুহি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে ঘন অন্ধকার, মাঝে মাঝে হালকা বাতাস বইছে।
ইরাদ স্যার ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে, কিন্তু কেন জানি আজ একা একা কেমন লাগছে। আনাই নেই, চারপাশ কেমন ফাঁকা লাগছে।
ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল।

“হ্যালো?”
“রুহি ম্যাম, ইমারজেন্সি চিটাগং যেতে হবে, আমাদের পুরো টিম কে, বেস্ট মেডিকেল সাপোর্ট দরকার। আমাদের গাইড করবেন ইরাদ স্যার। উনিও এক্সিডেন্ট কেসের জন্য চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। ”
রুহি চমকে উঠল।
“কি? কখন যেতে হবে?”
“এখনই, স্যার রওনা দিয়েছেন। মেডিকেল টিমও প্রস্তুত হচ্ছে।”
রুহির বুকের মধ্যে ধক করে উঠল।
ইরাদকে ফোন করলো রুহি,
তাৎক্ষণিকভাবে ও ইরাদকে ফোন দিল।
দুইবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরল ইরাদ।
“হ্যালো?”
“স্যার, আপনি যাচ্ছেন?”

ইরাদের কণ্ঠ ছিল স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি। “হ্যাঁ, জরুরি কেস এসেছে। আমাকে যেতে হবে।”
রুহি একটু থেমে বলল, “আচ্ছা, আনাই কার কাছে থাকবে?”
ইরাদ তখনও গাড়ি চালাচ্ছিল, সামনের রাস্তার দিকে মনোযোগ দিয়েই বলল, “মা বাবা এসেছেন, কিছুখন আগে পৌঁছেছেন। আনাইকে ওনারা দেখবে, সঙ্গে রাজিয়া খালাও আছে।”
রুহি একটু নিশ্চিন্ত হলো, কিন্তু পরক্ষণেই একটা চিন্তা মাথায় এলো।
“আমাকে তো যেতে হবে, তাই না?”
ইরাদ তখন একটু হাসল।

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৮

“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
“তাহলে… আমি কীভাবে যাব?”
ইরাদ শান্ত গলায় বলল, “আমি আপনাকে পিক করছি।”

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১০