এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ১৪
তানিশা সুলতানা
অর্ণব নামক পুরুষটির প্রতি খুব বাজে ভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে তন্নি নামক বোকারানী। সর্বক্ষণ মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করে পছন্দের পুরুষটির অবয়ন। আঁখিদ্বয় ভিজে ওঠে কারণ ছাড়াই। প্রচন্ড তৃষ্ণা পায় তাকে দেখার। একটুখানি তার কন্ঠস্বর শোনার আকুলতাও বড্ড পীড়া দেয়। তবে এই অনুভূতি স্বীকার করতে নারাজ তন্নি। কাউকে জানতে দিতেও চায় না। কেউ শুনলে নিশ্চয় ছি ছি করবে?
কোথায় অর্ণব কোথায় সে?
আর অর্ণব শুনলে বাজে মেয়ে ভাবতেও দ্বিধাবোধ করবে না হয়ত।
অথৈ জানলে বন্ধুত্ব নষ্ট করে দিবে কি?
খেতে খেতে গভীর ভাবনায় বিভোর তন্নি। ভাতের থালায় আঙুল নারছে। মুখে বেশ কিছুখন আগে ভাত পুরেছে সেগুলোই এখনো রয়ে গিয়েছে।
নজর এড়ায় না অর্ণব। ভ্রু কুচকে তাকায় তন্নির মুখপানে। আঁখি ভর্তি টইটুম্বুর করছে পানি। যখন তখন গাল বেয়ে গড়াবে। কিন্তু কান্না করার কারণ বুঝতে পারে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অথৈ এবং আর্থি তাদের মতো গল্পের আসর জমিয়েছে। আশা বেগম ছেলেমেয়েদের খেতে দিয়ে প্রস্থান করেছেন। ঢেড় কাজ বাকি তার। নিধি ওদের সাথে তাল মেলাচ্ছে। ওদের গল্পের টপিক হচ্ছে আর্থিকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। পছন্দ হলেই পাকা কথা ফাইনাল করে যাবে। পাত্রকে অবশ্য আর্থি আগে থেকেই চেনে।
অর্ণব নিজের পা দ্বারা তন্নির পা চেপে ধরে। চমকায় তন্নি। আঁখি পল্লব বড় বড় করে তাকায় অর্ণবের পানে।
অর্ণব চাপা স্বরে সুধায়
“কি হয়েছে? খাচ্ছো না কেনো?
তন্নি আলগোছে মুখের ভাত গিলে ফেলে। পরপরই বড় করে লোকমা তুলে মুখে। বা হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয়। খাবার গলায় আটকায়। পানির গ্লাস তুলে ঠকঠক করে পুরো গ্লাস ফাঁকা করে ফেলে।
বাঁকা হাসে অর্ণব। পা ঘসতে থাকে তন্নির পায়ে। কেঁপে ওঠে তন্নি। অস্বস্তিতে মাথা নুয়িয়ে পড়ে।
রিনরিনিয়ে বলে
“খাচ্ছি তো
পা সরান।
অর্ণব নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। জবাব দেয় না।
নিধিকে পৌঁছে দিতে গিয়েছে অর্ণব। পাশাপাশিই বাড়ি। তবুও নিধি জেদ ধরেছে অর্ণবের সাথে যাবে। তার ভয় করে রাস্তায়। অগত্য বাধ্য হয়েই নিধিকে নিয়ে বের হয়েছে।
তন্নির খারাপ লাগে। জেলাস হয়। আঁখিতে অশ্রুরা ভিড় জমায়।
নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত তন্নি। এতো কান্না কেনো পাবে? অর্ণব তো তার প্রেমিক নয়। সে যা খুশি করুক।
“তন্নি কাল সকাল সকাল আসবি কিন্তু তুই। তোকে ছাড়া আমার ভাল্লাগে না।
অথৈ তন্নির কাঁধে মাথা রেখে ফোন দেখতে দেখতে বলে।
“আচ্ছা আসবো
মুহুর্তেই অথৈ সোজা হয়ে বসে। ফোনখানা তন্নির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে
“ দেখ তন্নি সাগর ভাইয়া কি কিউট পিকচার আপলোড দিয়েছে। ভাই এই ছেলে আমাকে পাগল করে দিবে।
হাসে তন্নি। দেখে সাগরের ফটো। অথৈ আলগোছে কয়েকবার চুমু খেয়ে নেয়। মারাক্তক পছন্দ করে সে সাগরকে। কথাটা অজানা নয় তন্নির। ক্লাস এইট এ থাকতেই অথৈ জানিয়েছে মনের খবর প্রিয় সইকে।
তখনই তন্নির মনে উদয় হয়। তারও যদি ফেসবুক থাকে তাহলে সেও অর্ণবের ফটো দেখতে পাবে।
তন্নি নিজের ফোন অথৈয়ের নিকট দিয়ে আবদার করে
“ আমাকে ফেসবুক খুলে দে।
বেজায় খুশি হয় অথৈ। মুহুর্তেই লেগে পড়ে ফেসবুক খোলার কার্যক্রমে। তন্নিও মনোযোগ সহিত দেখতে থাকে কিভাবে কি করছে অথৈ।
ফেসবুকের প্রোফাইলে তন্নির একখানা ফটো দিয়ে দেয় অথৈ। তন্নি বারণ করলেও শোনে না। অতঃপর কোথা থেকে মেসেজ দিতে হবে, কিভাবে পোস্ট করতে হবে, কিভাবে ভিডিও দেখতে হবে। সব বুঝিয়ে দেয়। তন্নিও আয়ত্ত করে নেয় সবটা।
আশা বেগম ডাকে তন্নিকে। জানায় তার বাবা এসেছে। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দৌড়ে বাবার নিকট যায় তন্নি। ঢেড় জানে এক মিনিটও বসবে না তার বাবা। হলোও তাই। তন্নি যেতেই তন্নির হাত ধরে আশা বেগমের থেকে বিদায় নেয়। আশা বেগম আবদার রাখে কালকে তন্নি এবং তামিমকে আসতে দিতে। তারেক রহমান পৌঁছে দিবে বলে বেরিয়ে পড়ে।
অটো নিয়েই এসেছিলো তারেক। মেয়েকে নিয়ে অটোতে বসে পড়ে। বাবার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেয় তন্নি।
তারেক মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শুধায়
“খারাপ লাগছে?
“একটুখানি
“ বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
প্রতিত্তোরে তন্নি কিছু বলে না।
রাত বারোটা বেজে আটচল্লিশ মিনিট। বই পড়া শেষ করে ফোন ঘাটছে তন্নি। ফেসবুকের নিউজফিড ঘাটতে ঘাটতে হাসছে। ভীষণ মজার মজার পোস্ট সামনে পড়ছে। কয়েক ঘন্টায় সে ফেসবুকে আসক্ত হয়ে গিয়েছে। অথৈয়ের সাথেও চ্যাটিং করেছে বেশ কিছুখন। সাগর মেসেজ দিচ্ছে। সে তন্নির ফটো দেখেই চিনেছে এবং সাথে সাথেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছে। বোকা তন্নি এক্সেপ্ট করে নিয়েছে। অবশ্য যেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিচ্ছে তাকেই এক্সেপ্ট করছে। তন্নি সাগরকে রিপ্লাই দিতে যাবে ঠিক সেই মুহুর্তে ফোন কেঁপে ওঠে। “চিনি না” নাম্বার থেকে কল এসেছে। থমকায় তন্নি। খুশিও হয় বটে। আবার ভয়ও পায়। বুক টিপটিপ করতে থাকে। জিভ দ্বারা ওষ্ঠ ভিজিয়ে কল রিসিভ করে।
“বাইরে এসো
অর্ণবের গম্ভীর কন্ঠস্বরে কেঁপে ওঠে তন্নির স্বত্তা। লোকটা কি রেগে আছে?
“এ…এখন
“আমি ওয়েট করছি। পাঁচ মিনিট দিলাম। না আসলে সিনক্রিয়েট করবো। তোমার উকিল বাপের সাথে ঝগড়া করবো।
কল কেটে দেয় অর্ণব৷ চিন্তিত হয়ে পড়ে তন্নি। দাঁত দ্বারা নখ কাটতে থাকে। কিভাবে যাবে বাইরে? বাবা মা যদি দেখে ফেলে মে রেই দিবে তন্নিকে।
ভাবতে ভাবতে আধঘন্টা কাটিয়ে দেয় তন্নি। অতঃপর চুল গুলো শক্ত করে খোঁপা বেঁধে ফোনটা বুকে চেপে ধীর গতিতে দরজা খুলে বের হয়। সামনের গেইট খুলে বের হলে ধরা পড়ার চান্স থাকবে। তাই বাড়ির পেছনের দিকে যায় তন্নি। বাবা মায়ের রুমে নজর বুলিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে।
অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে মেইন রোডে দেখা যাচ্ছে এক খানা জিপ গাড়ি। সোডিয়ামের আলোতে চকচক করছে জিপখানা। তন্নি ঢেড় বুঝতে পারে এই গাড়িতেই রয়েছে নিষ্ঠুর মানব। সময় বিলম্ব না করে দৌড়ে গাড়ির নিকট পৌঁছায়৷ অর্ণব গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। তন্নি ভীতি নয়নে অর্ণবের থেকে খানিকটা দুরুত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। এখনো বুক টিপটিপ করছে তার। হাত পায়ে মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে। পানির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে।
অর্ণব সিগারেটে শেষ টান দিয়ে জমিনে ফেলে। পা দ্বারা পিষে দেয় সিগারেটের বাকি অংশ। অতঃপর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তন্নির পানে।
অর্ণবের চাহনিতে তন্নি মাথা নুয়িয়ে ফেলে। ফোন খানা শক্ত করে ধরে।
“এতোখন লাগে আসতে? জামাই ছাড়ছিলো না? আদর খাচ্ছিলি ইডিয়েট?
একটু বেশিই গম্ভীর শোনালো অর্ণবের কন্ঠস্বর। ভুমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে তন্নি। পিছিয়ে যায় দু পা। ওষ্ঠদ্বয় হালকা কেঁপে ওঠে। ঢেড় জানতো লোকটা এমন লাগাম ছাড়া কথা বলবে। এই জন্যই রাত দুপুরে ডেকেছে। পাষাণ কি না?
অর্ণব দু পা এগিয়ে আসে তন্নির দিকে।
বিলাই আঁখি পল্লব ছোট ছোট করে শুধায়
“ফেসবুক লাগবে তোর? ছেলেদের সাথে কথা বলতে হবে?
চট করে অর্ণবের মুখ পানে তাকায় তন্নি। রাগের কারণ উপলব্ধি করে মুহুর্তেই বলে
“আমি ডিলিট করে দিচ্ছি ফেসবুক। সরি আম
বাকিটা শেষ করতে পারে না তন্নি। অর্ণব তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে স্ব জোরে আঘাত করে পিচ ঢালা রাস্তায়। মুহুর্তেই বিকট শব্দ কয়েক খন্ড হয়ে যায় কুড়ি হাজার টাকার ফোন। দুই হাতে কান চেপে কয়েক পা পিছিয়ে যায় তন্নি। ভয়ে আত্না কেঁপে উঠেছে তার। মৃদু কাঁপছে শরীর। দুই গাল বেয়ে কয়েকটা ফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ে। ভাঙা ফোনের দিকে নজর পড়তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
“আ…আমার ফোন
নিচু হয়ে ফোনের ভাঙা অংশ তুলতে যেতেই অর্ণব তন্নিকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে। তন্নির মাথা খানা অর্ণবের বুকে চেপে ধরে।
“অতিরিক্ত পাকনা তুই।
তোর ফোন লাগবে না।
ধীর গলায় বলে অর্ণব৷ তন্নি বোধহয় শুনতে পেলো না। সে কান্নাকাটিতে বড়ই ব্যস্ত। অর্ণবের শার্ট ভিজে যাচ্ছে তন্নির চোখের পানিতে।
বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে থামে তন্নি। অর্ণবের থেকে সরে আসতে চায়। অর্ণবও ছেড়ে দেয়।
মাথা নিচু করে দাঁড়ায় তন্নি। এখনো ফুঁপিয়ে যাচ্ছে।
“আমি ছাড়া অন্য কোনো ছেলের সাথে কথা বললে জা নে মে রে দিবো তোকে।
হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয় তন্নি। একটু সাহস বাড়িয়ে বলে
“আ…..আপনি নিধি আপুর সাথে কথা বলেন।
অর্ণব ভ্রু কুচকে তাকায়
“তো?
এবার তন্নি বিপাকে পড়ে। কি বলবে? দৃষ্টি ঘোড়াতে থাকে এদিক ওদিক। হাত দ্বারা হাত ঘসে। কান্না থেমে গেছে।
“আমি নিধির সাথে কথা বলবো, তাকে বিয়ে করবো, বাচ্চা দিবো।
বাট তুই কোনো ছেলের সাথে কথা বলবি না। ইটস মাই অর্ডার।
অভিমানে বুক ভাড়ি হয়ে আসে তন্নির। রাস্তা হতে কুড়িয়ে নেয় ভাঙা ফোনের টুকরো। তা হতে উদ্ধার করে সীম এবং ম্যামরি। অতঃপর
“আসছি
বলেই চলে যেতে নিলে অর্ণব হাত ধরে ফেলে। সামনে দাঁড় করায়।
“ আমি যেতে বলি নি।
“বাবা রাতে কয়েকবার আমার রুমে যায়। গিয়ে যদি আমাকে না দেখে? তখন?
“ বলবি
এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ১৩
হবু জামাইয়ের সাথে রোমাঞ্চ করতে গিয়েছিলাম।
তন্নি চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। মনে মনে কয়েকবার অভস্য শব্দটা আওড়ায়।
অর্ণব নজর বুলায় মায়াবতীর সত্তায়। পিংক কালার টিশার্ট এবং কালো প্লাজু পড়নে। তাড়াহুড়োয় বোধহয় ওড়না আনতে ভুলে গিয়েছে। এই রূপে কখনোই দেখা হয় নি মেয়েটিকে।