ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩১
সারিকা হোসাইন
দিনের সূর্ষ অস্তমিত হয়ে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে কিছুক্ষন আগেই।জাহাজের ভো ভো শব্দ আর সমুদ্রের কলকল ধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ কর্ণপাত হচ্ছে না।থেকে থেকে জাহাজের ভেতর থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে।জাহাজের কেবিনে সেরকম শীত অনুভূত হচ্ছে না।তবে বাইরে হালকা শরীর শিউরে উঠার মতো ঠান্ডা।পুরোটা আকাশ থালার মতো বড় রুপালি চাঁদ আর তারার ঝিকিমিকি তে পরিপূর্ণ।অনেক দূরে কয়েকটা মাছ ধরা জাহাজের ক্ষীন আলোর ঝলকানি চোখে লাগছে।
রেহানকে নিয়ে জাহাজের পপ ডেকে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে যুবরাজ।যুবরাজের হাতে ম্যাগানের দামি ফোন খানা ধরা।তাতে মেয়েটির হাস্যজল একটি ওয়ালপেপার।এতোক্ষন রেহান যুবরাজের থেকে খুটিয়ে খুটিয়ে সব ঘটনা শুনে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু।
“”তেইক দ্যা কপি”
জাহাজের ভেতরে থাকা কোরিয়ান ছেলেটা দুই হাতে দুটো কফি মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে যুবরাজের উদ্দেশ্যে কথাটি বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
ছেলেটির নাম পার্ক সোক, ছেলেটি খুবই অমায়িক।জাহাজে এসেছে পর্যন্ত ছেলেটি রেহান আর যুবরাজের জন্য অনেক করেছে।ছেলেটির বয়স আর কতই বা হবে বাইশ কি তেইশ।কিন্তু কাজের বেলায় সে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকেও হার মানাবে।
পার্ক সোক এর কন্ঠ শুনেই রেহান দুই হাতের আজলায় তার মুখ ঢেকে ফেললো।এই দৃশ্য দেখে যুবরাজের হৃদয় মুষড়ে উঠলো।রেহান অপ্রস্তুত হয়েছে ভেবে পার্ক সোক এর থেকে কফির মগ দুটো নিয়ে তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে বিদায় করে দিতে চাইলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যুবরাজের হাতে একটা কফির মগ দিয়ে পার্ক সোক রেহানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রেহানের হাত টেনে মুখ থেকে সরিয়ে কফি মগ টি রেহানের হাতে দিতে দিতে ভাঙা ইংরেজি আর কোরিয়ান মিলিয়ে বলে উঠলো
“প্লিজ দোন্ত হাইড ইউর ফেস,কিসের লজ্জা তোমার?মনের সৌন্দর্যের কাছে বাহ্যিক সৌন্দর্য যে বড্ড ঠুনকো।মরে গেলে কিছুদিন বাদেই তোমার চেহারা মানুষ ভুলে যাবে।কিন্তু তোমার আচরণ,উদারতা,ভালো ব্যাবহার সবকিছু আজীবন মনে রাখবে।তোমাকে তো মোটেও আমার কাছে কুৎসিত লাগছে না।বরং তোমাকে দেখে আমার হিংসে হচ্ছে যে,কেনো গড আমাকে তোমার মত করে সৃষ্টি করলো না”
এক দমে কথা গুলো বলে রেহানের মুখের পানে অধীর আগ্রহ নিয়ে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রইলো পার্ক সোক।
ছেলেটির মুখের এমন সুন্দর অর্থপূর্ণ কথায় রেহান তার আরেকটা হাত মুখ থেকে সরিয়ে ছেলেটির মুখের দিকে দৃষ্টি দিলো।
এরপর কফি মগে চুমুক দিয়ে নিজের চোখ ঠোঁট আর পুরো মুখমন্ডলে হাত বুলালো।
আফসোস এর সুর নিয়ে রেহান ধীর কন্ঠে বলে উঠলো
“আমার ঝলসানো মোটা বিকৃত যেই ঠোঁট দুটো দেখতে পাচ্ছ এটা মোটেও এমন ছিলো না।এই হাড্ডিসার গাল গুলো ছিলো চকচকে মসৃন।আর চোখ টা……
কথা শেষ করার আগেই রেহানের গলা ধরে এলো।অনেক কিছুই বলতে চাইলো কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা আর মনোকষ্টে কিছুই বলতে পারলো না।পাতা হীন পাপড়ি হীন চোখ দুটো দিয়ে ক্রমাগত জলের ফোয়ারা ঝরতে লাগলো শুধু।
রেহানের কান্না দেখে পার্ক সোক তার ওয়ালেট থেকে একটি ছবি বের করে রেহানের সামনে ধরলো।
চেহারা টা জঘন্য ভাবে নষ্ট হওয়া আর মাথার চুল গুলো পর্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে রয়েছে।নাক,চোখ মুখ কিছুই অনুমান করা যাচ্ছে না।যুবরাজ জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে ছেলেটির দিকে তাকাতেই ছেলেটি সিক্ত আবেগ জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো
“সে আমার বোন” সো হি” গতো বছর নিউ ইয়ারের সময় বাজি ফুটাতে গিয়ে কাপড়ে আগুন ধরে সে এভাবেই বিশ্রী ভাবে পুড়ে গিয়েছিলো।আমার পরিবার অত্যন্ত দরিদ্র।এজন্য আমরা তাকে ভালোকরে চিকিৎসা করাতে পারিনি।কিন্তু আমরা সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যেনো অলৌকিক ভাবে সে ভালো হয়ে উঠে।কিন্তু দরিদ্র মানুষের কপাল কি আর এতো ভালো হয়?
সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রার্থনা শুনেননি।এবার জাহাজে আসার আগে আমার বোন এই দুনিয়া ত্যাগ করেছে।কিন্তু আমি আমার পরিবার কেউ তাকে আজো ভুলতে পারিনি।কারন সে মনের দিক থেকে ছিলো সৎ,ভালো,উদার আর তার হৃদয় ছিলো মানুষকে নিদারুণ ভালোবেসে যাবার মতো পরিপূর্ণ।আমরা সবসময় চাইতাম তার চেহারা বিকৃত হয়েছে তো কি হয়েছে তবুও সে বেঁচে থাক।কিন্তু সে থাকে নি।
কথা গুলো বলতে বলতে ছেলেটি হুহু করে কেঁদে উঠলো।ছেলেটির কান্নায় যুবরাজের চোখ ভিজে উঠলো।দ্রুত হাতে নিজের চোখ মুছে ছেলেটিকে শান্তনার বাণী ছুড়ে আপাতত শান্ত করতে চাইল।সাগরের গর্জনে আর শূন্য নীলাকাশে পার্ক সোক আর রেহানের কান্না মিলেমিশে বিলীন হয়ে গেলো নিমিষেই।শুধু সাক্ষী হিসেবে রেখে দিলো দূর আকাশের চাঁদ আর যুবরাজকে।
মাস খানিক গড়িয়ে গিয়েছে যুবরাজের কোনো খুজ পাত্তা নেই।শেরহাম তার ঢাকার বাড়িতে এসে পুরো শহর চষে বেরিয়ে যুবরাজকে খুঁজে চলেছে।নিজের টাকার পাওয়ার খাটিয়ে বিমানবন্দরে পর্যন্ত খুজ নিয়েছে।যুবরাজের ছবি দেখিয়ে মানুষ লাগিয়ে খুজা হয়েছে শহর থেকে গ্রামান্তরে।কিন্তু ফলাফল শূন্য।নিজের গায়ের কোট রাগের তোড়ে মেঝেতে আছাড় মেরে হুইস্কির বোতল নিয়ে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়লো শেরহাম ।হুইস্কির বোতলের ক্যাপ খুলে সেগুলো ঢকঢক করে গলায় চালান দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো
“আমাকে ডজ দিয়ে তুই বড্ড ভুল করে ফেললি স্কাউনড্রেল।পাতাল থেকে হলেও তোকে খুঁজে বের করব আমি।তুই আমার আজকের শিকার নস।যেদিন তোর জন্ম হয়েছে না চাইতেও সেদিন থেকেই তুই আমার শিকার হয়েছিস।তোকে বারবার শেষ করতে যেয়েও করতে পারছি না।এই ব্যার্থতা এতো সহজে আমি মানব না”
আরো কিছু ধীর কন্ঠে বির বির করতে করতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো শেরহাম।অনেক চোর পুলিশ খেলেছে সে।এবার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন।খুব ক্লান্ত লাগছে, খুব।
কিন্তু চাইলেই কি সুখনিদ্রায় ডুব দেয়া যায়?যার জন্মই শয়তানের আতুর ঘরে তার আবার শান্তি কিসের?
শেরহাম ঘুমে তলানির সাথে সাথেই পকেটে থাকা ফোনটি বিকট শব্দে বাজতে লাগলো।ইচ্ছে থাকা সত্তেও সে ঘুমাতে পারলো না।নিভে যাওয়া কন্ঠে অস্ফুট বিশ্রী গালাগাল করে স্ক্রিনে নিজের বাপের নম্বর দেখে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে এলো তার।এক প্রকার বাধ্য হয়েই ফোন রিসিভ করে বললো
“হাই পপস”
“কি খবর ওই দিকের?শু*য়োর টার দেখা পেলে?
“নো, কোথায় গিয়েছে জানিনা।হয়তো ম*রে টরে গিয়েছে।বেঁচে থাকলে তো বাপের কাছেই ফিরত তাই না?।”
“কি বলছো যা তা!ইডিয়ট টা তার বাপের মতো কৈ মাছের প্রাণ পেয়েছে।এতো সহজে ম*র*বে না।মরে গিয়েছে সেই খুশিতে বসে বসে না ঘুমিয়ে চিরুনি তল্লাশি করো।অকর্মার ঢেকি কোথাকার”
শেরহামের নিভে যাওয়া রাগ এবার চিরবিড়িয়ে উঠে মস্তক ছেয়ে গেলো।নিজের বাবাকে বিশ্রী এক গালি দিয়ে হুংকার দিয়ে উঠলো
“তুই এসে মাতব্বরি করে যা না বুড়ো ভাম।বয়স তো কম হলো না এখনো অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালাচ্ছিস।আমার কাজ আমাকেই করতে দে শা*লীর ব্যাটা।ফোন দিয়ে আর এক বার বিরক্ত করলে তোর বউয়ের মতো তোর ও হাল করবো।ফোন রাখ”
শেরহামের কণ্ঠস্বরে বেশ করে কেঁপে উঠলো সুবহান শেখ।ছেলেকে আয়ত্তে আনতে কন্ঠে মধু ঢেলে আদুরে স্বরে বুলি আওড়ালো।কিন্তু শেরহাম সেসবে কান না দিয়ে আরো ভয়ংকর বিশ্রী গালি দিয়ে ফোন কেটে দিলো।
চোখের পলকে কেটে গিয়েছে দুটো মাস,এই দুই মাসে ঘটে গিয়েছে অনেক ঘটনা।কিছু ঘটনা জানা কিছু অজানা।ম্যাকের সহায়তায় রেহানকে নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় আসতে সক্ষম হয়েছে যুবরাজ।এখানেই রয়েছে ডক্টর নিকোলাস এর ঠিকানা দেয়া সেই প্লাস্টিক সার্জন।এবার রেহানের চেহারা বদল হবে।আবার রেহান কোনো প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর অস্বস্তি ছাড়াই প্রকাশ্যে মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে।যুবরাজের যেনো আর খুশি ধরছে না।কিন্তু রেহানের মনে ভয়ের শেষ নেই।তার চেহারা চিনে ফেলে শেরহাম যদি আবার তার উপর নৃশংসতা চালায় তখন?
যুবরাজের কাছে এতো কিছু ভাবার সময় নেই।তার একটাই চাওয়া রেহান তার চেহারা ফিরে পাবে,রেহান ভালোভাবে এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকবে এবং সব শেষে সে তার বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবে!রেহান ভালো থাকলে তার মনের মানুষটাও ভালো থাকবে।কিন্তু রেহানের কিছু হয়ে গেলে মেয়েটা কি সহ্য করতে পারবে?
হসপিটালের ওয়েটিং চেয়ারে বসে যুবরাজ এক মনে ভেবে চলেছে এই কথা গুলো।এই মুহূর্তে তার অনেক টাকার প্রয়োজন।
“পাপার সাথে কথা বলে টাকা ম্যানেজ করতে গেলে শেরহাম ঠিক আমাকে ধরে ফেলবে সেই সাথে পাপার ও কিছু একটা হতে পারে।নিজের একাউন্ট ও ফ্রিজ হয়ে আছে।ম্যাগানের গহনা বিক্রির টাকা দিয়েই আপাতত কাজ চালাতে হবে।আর ম্যাকের কাছে কিছু সাহায্য চাইলে ম্যাক কখনো না করতে পারবে না।আগে রেহানের সার্জারি হোক।সবকিছু পরে গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখা যাবে।
চিন্তাভাবনা শেষ না হতেই ডক্টর এর এটেন্ডেন্স যুবরাজের নাম ধরে হাক ছাড়লো।সাথে সাথেই যুবরাজ রেহানকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
ডক্টর নিকোলাস এর কার্ড আর একটা হ্যান্ড রাইটিং চিঠি ডক্টর কিম এর দিকে এগিয়ে দিতেই ভদ্রলোক সহাস্যে যুবরাজ আর রেহানের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেন।এরপর যুবরাজের থেকে সবকিছু হিস্টোরি শুনলেন।
যুবরাজ আর রেহান দুজন মিলে সুন্দর করে গুছিয়ে কেস হিস্টোরি জানিয়ে ডক্টর এর চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ডক্টর কিম কিছুক্ষন মৌন থেকে বলে উঠলেন
“দেখুন ডক্টর রেহান আপনার ফেস নাইনটি সিক্স পার্সেন্ট ই ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে।আপনার আগের চেহারা ফিরে পাবার আর কোনো সম্ভাবনা নেই।তবে এটুকু বলতে পারি আমি আপনার চেহারা রিপেয়ার করতে পারবো।
ডক্টর এর কথা শুনে যুবরাজ আর রেহান খুব চিন্তিত হলো।তবুও যুবরাজ হাল ছাড়বার পাত্র নয়।সে ডক্টর এর হাত চেপে ধরে বলে উঠলো।
“আই ওয়ান্ট টু সি হিম এজ এ হ্যান্ডসাম ম্যান ডক্টর”
ডক্টর যুবরাজকে আশ্বস্ত করে বলে উঠলো
আ উইল ট্রাই মাই বেস্ট ডক্টর ইউভি,বাট ইউ হ্যাভ টু ওয়াইট ফর সিক্স মান্থ”
ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩০
আজকে রেহানের অপারেশন এর দিন।যুবরাজ বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে।বেশ সময় নিয়ে রেহানের অস্ত্রোপচার হবে।শুধু তাই নয় মৃত কোষ আর ড্যামেজ ত্বক সরিয়ে স্থায়ী স্কিন গ্রাফটিং করতে হবে।রেহানের আগের চেহারার সাথে মিলিয়েই কাজ করা হবে।কিন্তু কতটুকু সাকসেস হবেন তা ডক্টর জানে না।তবুও যুবরাজ একটা আইডিয়া দিয়েছে যাতে চেহারা টা তার আইডিয়া অনুযায়ী হয়।
ডক্টর ওটি তে ঢুকতেই যুবরাজ মনে মনে বলে উঠলো
“তোকে আমি কোনো ভাবেই জিততে দেবো না শেরহাম ফাইয়াজ।তোকে আমি মূল সমেত উপড়ে ফেলবো।খুব শীঘ্রই দেখা হবে তোর আর আমার।আমি তোর থেকেও ভয়ঙ্কর ভাবে ব্যাক করবো।