ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩৮
সারিকা হোসাইন
শরৎ কাল পেরিয়ে হেমন্তের আগমন হয়েছে আরো দুদিন আগে।সকল প্রখরতা অস্থিরতা দূর হয়ে প্রকৃতি কোমলতার ছোঁয়ায় নিজেকে উজাড় করেছে।কিছুদিন আগেও যেই সূর্যতাপ শরীরে ফোস্কার সৃষ্টি করতো তা এখন অনেকটাই মোলায়েম ।নেই কোনো ক্লান্তি নেই কোনো বিষাদ।তবুও কোথায় যেনো কি নেই!
শেরহামের ভুতুড়ে বিশাল ফ্ল্যাটে একটা কাউচে পায়ের উপর পা তুলে সমানে কপাল স্লাইড করে চলেছেন সুবহান শেখ।চোখে মুখে তার গভীর ক্রোধের ছাপ স্পষ্ট।নিজের ক্রোধ আয়ত্তে আনতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছেন প্রবীণ এই লোকটি।শেরহামের বলা প্রতিটি কথা যেনো তার শরীরে সুচের মতো ফুটেছে।বার বার অগ্নি স্ফুলিং যুক্ত পলক ঝাপটে নিজের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন তিনি।
“পপ্স যুবরাজকে বাঁচিয়ে রাখলে আমাদের পুরোটাই লস।এই কয় বছরে আমাদের আশেপাশের সকল মানুষকে টার্গেট করে মে*রে ফেলেছে ও।শেষ পর্যন্ত সিরাজকেও ছাড়েনি।কোনো ভাবেই আর ওর নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।আমি কিন্তু পাবলিক প্লেসে ওকে ঠুকে দেবো বলে দিলাম।
শেরহামের কথায় সুবহান শেখের ক্রোধ যেনো তরতর করে আরো হাজার গুণ বেড়ে গেলো।চট করে বসা থেকে উঠে ঠাস করে স্বশব্দে এক চ*ড় বসিয়ে দিলেন ছেলের ফর্সা গালে।সাথে সাথেই গালটা র*ক্ত*বর্ণ আকার ধারণ করলো।বা হাতের চারটা আঙুলের দাগ সেখানে সুস্পষ্ট।নিজের গাল চেপে ধরে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো শেরহাম।
ছেলের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন সুবহান শেখ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“খুব মাস্তান সেজেছো তাই না?যাকে ছোট থাকতেই কিছু করতে পারো নি তাকে তাকত ওয়ালা হবার সুযোগ দিয়েছো।এখন বলছো পাবলিক প্লেসে ঠুকে দেবে!ওই ছেলে কতো ধুরন্দর জানো না?নিজের প্রাণ খোয়াতে চাও নাকি?গ*র্দ*ভ কোথাকার।এহ এসেছে আমার লায়েক”!
নিজের বাবার থেকে এমন জঘন্য ভাবে অপমানিত হয়ে রাগে দুঃখে দুচোখ ফেটে জল এলো তার।ছোট থেকে এমন তুচ্ছ তচ্ছিল্য করে শেরহামকে কথা বলেন সুবহান শেখ।দিনে দিনে বিশ্রী আচরণের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে শুধু।অশ্রুসজল চোখে আহত দৃষ্টিতে নিজের জন্মদাতা পিতার দিকে চোখ তুলে তাকায় শেরহাম
“আমি কি সত্যিই তোমার ছেলে পপ্স?
“কেনো বিশ্বাস হচ্ছে না?বিশ্বাস না হলে নিজের ম*রা মাকে জিজ্ঞেস করো।
কথাটি বলেই ফিক করে হেসে ফেললেন সুবহান শেখ।সেই হাসির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শেরহাম।এরপর দাঁতে দাঁত পিষে সুবহান শেখ বলে উঠলেন
“জিজ্ঞেসটা করবে কি করে?নিজের মাকেও তো রা*ন্না করে খে*য়ে ফেলেছো।মানুষ খেকো কোথাকার”
কোথাও না কোথাও আজকে শেরহামের বড্ড অনুশোচনা হচ্ছে।কোনো সন্তানের সাথে বাবা হয়ে এমন আচরণ কেউ করতে পারে না।যুবরাজের যখন কোনো খুজ ছিলো না শেরহাম নিজের চোখে দেখেছে একমাত্র ছেলের অকুলতায় কতোটা কষ্ট পেয়েছিলেন সাদাফ শাহীর।ছেলেকে একবার বুকে টেনে নিতে পুরো দুনিয়া এক করতে চেয়েছিলেন।রেহানের বাবা মার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা সে নিজে চোখে দেখেছে।তাহলে তার বাবা এমন কেনো?
কই এতো দিন পর দেশে ফিরেও তো সে শেরহাম কে একটি বারের জন্য বুকে টানলো না।কিন্তু শেরহাম তো চায় তার বাবা তাকে শক্ত হাতে বুকে চেপে ধরুক।মাথায় মমতার হাত বুলাক।
যুবরাজ নিজের মনের স্বাধীনতা মতো সমস্ত জায়গায় বিচরণ করতে পারে।আর সে?
সে তো সুবহান শেখের হুকুম ছাড়া খাবার পর্যন্ত খেতে পারেনা।
তবে কি দিনে দিনে সে তার বাবার কলের পুতুলে পরিণত হয়েছে?
আর ভাবতে পারেনা শেরহাম।
নিজের দুঃখ কষ্ট লুকিয়ে অনুরোধের স্বরে বলে উঠে
“পপ্স আমি একবার রাজ্যকে দেখতে চাই।আমাকে বাড়ির বাইরে যাবার একটু অনুমতি দাও প্লিজ।আজ ষোল দিন ধরে আমি এই বাড়ির চার দেয়ালে বন্দি।আমার প্রাণ টা যে ছটফট করছে পপ্স”
ছেলের দিকে ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন সুবহান শেখ
“পরের বউয়ের জন্য কিসের এতো উতলা তোমার?
সুবহান শেখের মুখ থেকে পরের বউ শব্দটি শেরহামের মস্তিষ্ক নাড়িয়ে দিলো।সমস্ত কিছু ভুলে বোকা মানবের ন্যায় কিঞ্চিৎ মুখ ফাঁকা করে অবুঝের ন্যায় শুধালো
“পরের বউ মানে?
হুইস্কির বোতলের সিল খুলতে খুলতে সুবহান শেখ বলে উঠলো
“যুবরাজ ওই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে,কিন্তু বিয়ে করে বউ নিয়ে কোথায় গেছে এটা কেউ জানেনা”
এবার আর শেরহাম তার উপচে উঠা অশ্রু বিন্দুকে ধরে রাখতে পারল না।দুই কদম সুবহান শেখের দিকে এগিয়ে হুইস্কির বোতল কেড়ে নিয়ে আহত কন্ঠে শুধালো
“বিয়ের কথা তুমি জানতে?
সুবহান শেখ বাজখাই গলায় বলে উঠলেন
“হ্যা জানতাম তো”
“তাহলে আমাকে একটা বার জানানোর প্রয়োজন ও মনে করলে না তুমি?
“তোমাকে জানিয়ে কি হবে?যুবরাজের সামনে যেতে যেচে ম*রা*র জন্য?”
“তুমি চাইলেই তো বিয়েটা আটকাতে পারতে পপ্স!
“কেনো আটকাবো?তোমাকে কি এখানে প্রেম আর বিয়ে করতে পাঠিয়েছি?কান খুলে ভালো করে শুনে রাখো।এসব প্রেম ভালোবাসা আর বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে সাদাফ শাহীরের পুরো পরিবার শেষ করে দাও।তোমার মত পাগল ছাগলের আবার বিয়ে কিসের?ভুলে যেওনা তুমি একজন ন*র*খাদক।তোমার কাছে কোনো মানুষ সেফ না”
“আমি রাজ্যকে মনের গভীর থেকে ফিল করি পপ্স”
“ওসব ফিল টিল কিছুই না।ওগুলো আবেগ।এসব আবেগ বাদ দিয়ে যুবরাজ কোথায় আছে সেটা খুঁজে বের করো যাও।
বড় বড় শাল আর হরতকি গাছের সমারোহে ঘেরা যুবরাজের অভিজাত্যে ভরা সাদা রঙের বাংলোটি।বাংলোর সামনের দিকটায় বিশাল এক গার্ডেন এরিয়া।সেখানে দেশি বিদেশি নাম না জানা হরেক রকমের ফুল।যেমন তার সৌন্দর্য তেমন তার সুবাস।গার্ডেন এরিয়ার কাঠের বেঞ্চিতে বসলে সুবাসিত সমীরণ আর পাখির মিষ্টি ডাকে মনে এক অনিন্দ্য প্রশান্তি মিলে।
এই কয়েকটা দিন বাংলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই কেটে গিয়েছে রাজ্যের।কিন্তু অত্যন্ত অবাকের বিষয় এতো বড় বিশাল বাড়িতে না আছে কাজের লোক না আছে রাঁধুনি।তবুও সময় মতো সব কিছু গুছানো থাকে পরিপাটি করে।টেবিল ভর্তি থরে থরে সাজানো থাকে বাহারি সুগন্ধি যুক্ত মজাদার খাবার।এগুলো কখন রান্না হয় ,কে রান্না করে তার কিছুই জানে না রাজ্য।
ডাইন ইন টেবিলে যুবরাজকে বহু বার জিজ্ঞেস করলেও খুব কৌশলে সব কিছু এড়িয়ে গিয়েছে সে।
বাড়িটির গার্ডেন এরিয়া পর্যন্তই রাজ্যের চলাফেরা করার শেষ সীমানা।অদূরে বিশাল লোহার গেট টার কাছে যাওয়া খুব কঠিন করে নিষেধ দিয়েছে যুবরাজ।
এদিকে রাজ্যের ছুটিও শেষ।আগামি কাল থেকে তাকে ডিউটি জয়েন করতে হবে।এই বাড়ির রহস্য আর যুবরাজের রহস্য দুই ই রাজ্যের মস্তিষ্কে খুব করে গেঁথে গেলো।
“বেইব,একটু পরে সন্ধ্যা নামবে।এখনো ঘরে যাচ্ছ না কেনো?
আকস্মিক যুবরাজের কন্ঠ পেয়ে কিছুটা হকচকিয়ে উঠে রাজ্য।আজকাল সবকিছুতেই সে একটু বেশি ই সন্দেহ করছে।এটা কি মনের ভুল নাকি নাকি কোনো রোগ তা সে জানে না ।কিন্তু তার মনে প্রানে চাওয়া যুবরাজ আর তার মধ্যে কখনো কোনো সন্দেহের কাটা যুক্ত গাছের যেনো জন্ম না হয়।
যুবরাজ রাজ্যকে পেছন থেকে শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে কাঁধে থুতনি রেখে আবেশ মেশানো কন্ঠে শুধালো
“আজকের রাত ই শেষ রাত আমার রাজত্বে তোমার”
কথাটি শুনেই ধক করে উঠলো রাজ্যের বুক।না চাইতেও মন ভার হয়ে দুই চোখ ছল ছল করে উঠলো।মুখে অনেক কিছুই বলতে চাইলো কিন্তু বোবা কান্না শক্ত হাতে তার গলা চেপে সেই কান্না রোধ করে ফেললো।
নিজের দিকে রাজ্যকে ঘুরিয়ে যুবরাজ আহত কন্ঠে শুধালো
“আমাকে ছাড়া থাকতে তোমার কি অনেক কষ্ট হবে?
টলটলে চোখে যুবরাজের গোলকধাঁধার ন্যায় বাদামি চোখের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো রাজ্য।
“একটা মানুষ এতোটা কঠিন হৃদয়ের কি করে হতে পারে?
রাজ্যকে আর কোনো চোখের ভাষা পড়তে না দিয়ে নিজের বলিষ্ঠ কাঁধে তুলো নিলো যুবরাজ।
এরপর বাংলোর দিকে হাঁটা দিলো।
“বাইরে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে,তোমার যে ঠান্ডার প্রবলেম আছে সেটা ভুলে গেছো?
কোনো কথা না বলে রাজ্য যুবরাজের পিঠে মাথা রেখে চোখ বুঝে ফেললো।সেই সাথে খসে পড়লো দু ফোটা উষ্ণ জল।কঠিন হৃদয়ের যুবরাজ সেটা বুঝেও বুঝলো না।
কিছুক্ষন বাদে নিজেদের বেড রুমে এসে বিছানার উপর পরম যত্নে রাজ্যকে বসিয়ে দিল যুবরাজ।এরপর রাজ্যের তুলতুলে ফোলা ফোলা গালে নিজের বৃহৎ উষ্ণ হাতের স্পর্শ দিয়ে বলে উঠলো
“যদি কখনো আমি হারিয়ে যাই তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে বউ?
যুবরাজের আজকের কথা গুলো বেশ ধুয়াশা লাগছে রাজ্যের কাছে।খুবই রহস্য মানব ঠেকছে যুবরাজকে।এ’কদিন যুবরাজের উষ্ণ ভালোবাসায় সব ভুলে বসেছিলো রাজ্য।তবে আজ যুবরাজ বার বার এসব কি বলছে তাকে?
“সে কেনো হারাবে?আর কোথায় হারাবে?
আর ভাবতে পারে না রাজ্য।সে যুবরাজের হাতের থাবায় নিজের কাঁপা কাঁপা দুই হাত মিলিয়ে বলে উঠে
“আপনাকে বড্ড অচেনা লাগছে মিস্টার শেইমলেস।আমার যে অনেক ভয় করছে!
রাজ্যের আহত দৃষ্টির পানে তাকিয়ে খানিক মেপে হাসে যুবরাজ।এরপর মেঝেতে হাটু মুড়ে বসে রাজ্যের পা জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা রেখে আবেশে চোখ বুঝে ফেলে।
“আমি মানুষ হিসেবে খুবই খারাপ ,পুলিশে ধরলে আমার ফাঁ*সি হবে আর ধরা না পড়লে অন্য কারো হাতে একদিন না একদিন ঠিক আমার মৃত্যু হবে।”
“আপনি কি এমন করেছেন যে আপনাকে পুলিশ ধরবে?
অবাক সিক্ত নয়নে কথাটি নিভু নিভু কন্ঠে যুবরাজকে জিজ্ঞেস করে রাজ্য।
“আমি মানুষ খু*ন করেছি!তাও দুই একজন কে নয় পুরো তিনশত সাতন্ন জন মানুষকে”
শক্ত কন্ঠে কথা গুলো বলে মাথা তুলে রাজ্যের মুখোমুখি বসে যুবরাজ।
যুবরাজের এহেন কথায় রাজ্য যেনো নিজের শ্বাস টাও নিতে ভুলে গেছে।এসব কি শুনছে সে?নিজের কানকেও বিশ্বাস করা দুষ্কর হয়ে উঠলো নিমিষেই।
নির্বাক রাজ্যের ফাঁকা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো যুবরাজ।।এরপর ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি এনে পুনরায় বলে উঠলো
“কিন্তু আমি আত্মসমর্পণ করবো না।না আমি ধরা দেবো না তুমি আমাকে ধরতে পারবে”
কথাটি বলেই হাতে থাকা স্কচটেপ দিয়ে রাজ্যের হাত পিছ মোড়া করে বেঁধে ফেললো যুবরাজ।
এরপর একটা কালো কাপড়ে চোখ বাঁধতে বাঁধতে বলে উঠলো
“আম রিয়েলি সরি জান।এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।আমার রাজ্যে তোমাকে বেশিদিন রানী করে রাখতে পারলাম না।
ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩৭
তুমি আমাকে যা খুশি তাই ভাবতে পারো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।”
যুবরাজের কাজে কোনো প্রকার বাধা প্রদান করলো না রাজ্য।শুধু আহত কন্ঠে বলে উঠলো
“আপনাকে আমি ভালোবাসি যুবরাজ।আপনি মার্ডারার ,টেরোরিস্ট যাই হোন তাতে আমার কিছুই আসে যায় না।সবচেয়ে বড় কথা আপনি আমার হাজব্যান্ড”