ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব ২৬
দিশা মনি
দৃঢ়তা মিষ্টিদের বাসার মধ্যে সোফায় বসেছিল। বসে কিছু কথা ভাবছিল এমন সময় হঠাৎ করে কলিং বেল বেজে ওঠে। দৃঢ়তা গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই দেখতে পায় ললিতা চৌধুরীকে৷ অবাক স্বরে বলে ওঠে,
“আপনি!”
“হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। ভেতরে আসতে বলবে না?”
দৃঢ়তা বলে,
“জ্বি, আসুন। কি বলবেন, বলুন।”
ললিতা চৌধুরী ভেতরে প্রবেশ করে কাদো কাদো সুরে বলেন,
“তুমি চলে আসার পর আমার সংসারটা পুরো ভেসে গেছে দৃঢ়তা। তুমি সত্যিই আমাদের পরিবারের জন্য সেরা ছিলে। তুমি চলে আসার পর সব এলেমেলো হয়ে গেছে। জানি না, কোন কুক্ষণে আম্মা ঐ মোহনা মেয়েটাকে আমাদের বাড়ির বউ করে এনেছিল। ও আমাদের হারমাশ একদম জ্বালিয়ে খেয়ে নিচ্ছে। আমার ছেলেটাও ওর সাথে সুখী না। আমার ছেলেটাকে কি পরিমাণ মানসিক টর্চার করেছে তা বলার বাইরে।”
দৃঢ়তা শক্ত কন্ঠে বলে,
“এসব আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার-আপনারাই সামলে নিন। আমাকে এসব কেন বলছেন?”
ললিতা চৌধুরী অপমান বোধ করেন। তবুও শান্ত থেকে বলেন,
“আমি জানি তুমি ভীষণ রেগে যাচ্ছ। আর তোমার রাগ করাটাই স্বাভাবিক কিন্তু…”
“ভুল ভাবছেন আপনি। আমি রাগ করছি না। যা সত্য তাই বলছি৷ আপনি বোধহয় এখানে আমাকে আপনাদের পারিবারিক কেচ্ছা শোনাতে এসেছেন কিন্তু আমি সেসব শুনতে আগ্রহী নই সো এক্সকিউজ মি।”
“আমি জানি, তোমার সাথে আমি, আমরা সবাই অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু আমার ছেলে..জাবির ও সত্যি তোমায় ভালোবাসে। তাই আমি তোমার কাছে অনুরোধ করছি তুমি দয়া করে ফিরে চলো আমাদের বাড়িতে।আমরা সবাই তোমাকে বাড়ির বউয়ের মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলব।”
“না। ঐ বাড়িতে আমি আর ফিরবো না। আর না তো আমার আপনাদের দেয়া বউয়ের মর্যাদার প্রয়োজন। আমি এখন যেমন আছি তেমনি ভালো আছি। ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময়েই আমি শপথ নিয়েছিলাম যে আর জীবনেও ঐ বাড়ির চৌকাঠ মারাব না। আমার সেই কথা আমি রাখবো।”
বলেই দৃঢ়তা চলে আসতে নেয়। এমন সময় হঠাৎ করে ললিতা চৌধুরী তার পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“আমি তোমায় পায়ে পড়ছি..”
দৃঢ়তার মন হঠাৎ নরম হয় ললিতা চৌধুরীর এই আচরণে। সে ললিতা চৌধুরীকে পা থেকে টেনে তুলে বলে,
“ছি ছি! এসব কি করছেন আপনি। আপনি আমার গুরুজন। এভাবে পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?”
“আমার কথাটা রাখো দৃঢ়তা মা। তোমার সাথে যা যা অন্যায় হয়েছে তা তো আমি বদলাতে পারব না কিন্তু..”
এমন সময় ললিতা চৌধুরীর ফোন বেজে ওঠে। জাবির ফোন করেছে। ললিতা চৌধুরী ফোনটা রিসিভ করতেই জাবির বলে ওঠে,
“তুমি দৃঢ়তার সাথে কথা বলেছ আম্মু? ও ফিরবে তো আবার?”
“হ্যাঁ..মানে.. ”
“ওহ বুঝতে পেরেছি। ও রাজি হয়নি তাই না? আম্মু তুমি শুধু ওকে একবার হাসপাতালে আসতে বলো। আমি ওর সাথে শুধু একবার মুখোমুখি হয়ে কথা বলতে চাই। ওকে বলো, এরপর আর কখনো ওর মুখোমুখি হবো না।”
ললিতা চৌধুরী ফোনটা রেখে আবারো দৃঢ়তার পায়ের কাছে বসতে যায় তখন দৃঢ়তা তাকে আটকে বলে,
“আন্টি প্লিজ..এবার আমার খারাপ লাগছে।”
“জাবির শুধু একবার তোমার সাথে দেখা করতে চায়। তুমি একটু চলো প্লিজ…”
এমন সময় মিষ্টিও সেখানে চলে আসে। দৃঢ়তা বলে,
“বেশ, চলুন। আমি যাচ্ছি।”
মিষ্টি দৃঢ়তাকে বলে,
“তুমি যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছ ভেবেচিন্তে নিচ্ছ তো দৃঢ়তা? এনাদের অতীতের করা কর্মগুলোর পরেও তুমি এনাদের বিশ্বাস করতে চাও?”
দৃঢ়তা বলে,
“আপু আমার মনে হচ্ছে ওনারা যথেষ্ট অনুতপ্ত। আর তাছাড়া, উনি তো বেশি কিছু চাইছেন না শুধু এটাই চাইছেন যে আমি যেন হাসপাতালে গিয়ে মিস্টার জাবির চৌধুরীর সাথে একবার কথা বলি। এটা কোন কঠিন ব্যাপার না, আমার জন্য। আমি বরং গিয়ে কথা বলে আসি।”
বলেই দৃঢ়তা রওনা দেয় ললিতা চৌধুরীর সাথে। মিষ্টি ভাবে,
“দৃঢ়তা এটা কি করলো? না জানি এনারা আবার হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কিভাবে ওর ব্রেনওয়াশ করে। আমাকে কিছু করতে হবে।”
মিষ্টি এবার নিজের ফোন বের করে ইউভানের নাম্বারে একটা কল করে। ইউভান ফোনটা রিসিভ করতেই তাকে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে ইউভান বলে,
“ঠিক আছে, চিন্তা করবেন না আপু। আমি দেখছি কি করা যায়।”
মোহনা জাবিরকে তার খাবার ওষুধগুলো দিতে এসেছে। এদিকে জাবির মোহনাকে দেখেই রাগী স্বরে বলে ওঠে,
“আপনি কি করছেন এখানে? আপনাকে আমি বলেছি না আমার ত্রীসীমানায় না আসতে।”
মোহনা বলে,
“দেখুন, আমি নিজের ইচ্ছায় আসিনি। আপনার এই ওষুধ গুলো দিতেই আসা। এগুলো খেয়ে নিন।”
“খাব না। আপনার হাতে ওষুধ খাওয়া মানে বিষ খাওয়ার সমান। এসব ওষুধ নিয়ে দূর হন আমার সামনে থেকে।”
“এই যে শুনুন, একদম এসব ফালতু জেদ করবেন না। খেতে বলছি ভালোয় ভালোয় খেয়ে নিন। নাহলে কিভাবে খাওয়াতে হয় সেটা আমার জানা আছে।”
“খাবো না, দেখি আপনি কি করেন।”
মোহনার মাথায় জেদ চেপে যায়। সে জোরপূর্বক জাবিরের মুখে ওষুধ খাইয়ে দিতে যায় এমন সময় দৃঢ়তা ললিতা চৌধুরীর সাথে সেখানে চলে আসে এবং মোহনাকে এভাবে দেখে বলে ওঠে,
“কি করছেন কি এটা আপনি?”
মোহনা থেমে গিয়ে পিছন ফিরে তাকায়। দৃঢ়তাকে দেখে অবাক হয়৷ দৃঢ়তা বলে ওঠে,
“একজন অসুস্থ মানুষের সাথে কেউ এমন আচরণ করে? আপনার কি মিনিমাম সেন্সটুকুও নেই?”
ললিতা চৌধুরী এই সুযোগ বুঝে বলেন,
“তাহলেই বুঝতে পারছ তো দৃঢ়তা, এই মেয়েটা আমার অসুস্থ ছেলের সাথেই কেমন আচরণ করছে। তাহলে ও যখন সুস্থ ছিল তখন কিভাবে টর্চার করত আমার ছেলের উপর।”
মোহনা বলে ওঠে,
“আমি ওনাকে ওষুধ খাওয়াচ্ছিলাম উনি খেতে চাইছিল না আর তাই..”
দৃঢ়তা এগিয়ে গিয়ে বলে,
“এভাবে কেউ ওষুধ খাওয়ায়? ওষুধটা আমার হাতে দিন। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
মোহনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই জাবির বলে,
“হ্যাঁ, দৃঢ়তা। তুমি আমায় ওষুধ খাইয়ে দাও। তুমি না খাইয়ে দিলে আমি খাবো না। আর এখন আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে ভরসাও করি না।”
মোহনা আর তাই কিছু বলল না। কারণ জাবিরের এখন ওষুধটা খাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। দৃঢ়তাও অগত্যা জাবিরকে ওষুধটা খাইয়ে দিলো। দৃশ্যটা দেখে মোহনার ভীষণ খারাপ লাগলো। এদিকে ললিতা চৌধুরী মনে মনে বললেন,
“এই মোহনা এতদিন আমাদের অনেক জ্বালিয়েছে৷ এবার ওর জ্বলার পালা।”
দৃঢ়তা ওষুধটুকু খাইয়ে দিয়ে জাবিরের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এখন আপনার যা বলার জলদি বলুন। আমাকে আবার ফিরতে হবে।”
জাবির দৃঢ়তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“ফিরবে মানে কি? কোথাও যাবে না তুমি। তোমাকে আমার সাথে ঢাকায় যেতে হবে।”
“এসব কি বলছেন আপনি? আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। হাতটা ছাড়ুন আমায়।”
“তোমায় যেতেই হবে নাহলে আমি..”
বলেই জাবির হসপিটাল বেডের সামনে থাকা একটা ধারালো কাচি হাতে তুলে নেয়৷ দৃঢ়তা বলে ওঠে,
“এটা কি করছেন! ফেলুন ওটা।”
ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব ২৫
“নাহ, তুমি আগে বলো আমার সাথে ঢাকায় ফিরবে। নাহলে কিন্তু আমি নিজেকে এবার সত্যি শেষ করে দেবো। আর তুমি জানো আমি কোন মজা করছি না। এর আগেও আমি বেলকনি থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলাম তাই এবারো নিজেকে শেষ করতে অসুবিধা হবে না।”
দৃঢ়তা কিছু বলছিল না। জাবির এবার কাচিটা দিয়ে হাতে সামান্য চাপ দিতেই রক্ত বের হতে শুরু করে যা দেখে দৃঢ়তা ভয়ে ভয়ে বলে ওঠে,
“আমি আপনার সাথে ঢাকা ফিরে যেতে রাজি আছি। প্লিজ নিজের আর কোন ক্ষতি করবেন না।”
ইউভান কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল দৃঢ়তার বলা কথাটা শুনেই তার পা জোড়া থমকে গেল।