কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১১
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
অদূরে মানুষের কোলাহল,হাসি-ঠাট্টা,মৃদূমন্দ গানের শব্দ__ সব মিলিয়ে উৎসবের এক প্রগাঢ় আবহে মুড়ে ছিল সেন্টার। সেই সব থমকে বসল ইয়াসিরের ছুটে আসা প্রশ্নে।
এখন নিশ্চুপ চারিপাশ!
পিনপতনের শব্দও যেন নেই। বিয়ে করা বউকে বলছে,আপনি কে? এ কেমন প্রহসন!
তুশির বুকের কম্পন সুনামির মতো তীব্র। কাছে এসে কান পাতলেই শুনতে পারবে যে কেউ। দুহাতে শক্ত করে শাড়ির পাড় খামচে রাখল মেয়েটা। পিঠের হাড়ে একটা সূক্ষ্ণ ঘামের ধারা কলকল করে নামছে।
ইচ্ছে করছে এক ছুটে পালিয়ে যেতে।
কিন্তু মাজহারের তখনকার বলা কথা, ওসব মনে পড়লেই তো গুলিয়ে যাচ্ছে সব। যদি সত্যিই অমন হয়! দাদিকে কে দেখবে? ওই মানুষটা ছাড়া এই সাতকূলে তো তুশির কেউ নেই।
বাবা-মা কাউকে তুশি দেখেনি। দেখলেও মুখটা মনে নেই। তুশির কাছে দাদিই বাবা,দাদিই মা।
দাদিকে ভালো রাখার লোভেই তো পা দিলো এই ফাঁদে। কিন্তু কে বাঁচাবে ওকে এখন? গরীবদের বিপদ হলে কেউ আসে বাঁচাতে?
এদিকে মাজহারের অবস্থা দুরূহ হয়ে পড়ল।
ইয়াসিরের কথায়,কপালের ঘাম বেড়েছে। হাত তুলে মুছলেন সেটুকু। হাসার চেষ্টা করে বললেন,
“ এ আবার কেমন কথা, ও তোমার স্ত্রী। আমাদের মেয়ে,তুশি।”
ইয়াসির তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। তার কণ্ঠ দৃঢ়,
“ না। উনি তুশি নন। এটা ওনার গলা নয়। কে আপনি? ঘোমটা সরান।”
তুশি খরখরে ঠোঁট জিভে ডোবাল।
আরও শক্ত করে ঘোমটা চেপে ধরতেই,ইয়াসিরের সন্দেহ এবার বিশ্বাসে রূপ নেয়। অপেক্ষায় সে রইল না।
শরীরের সব জোর খাটিয়ে এক টান মেরে ঘোমটা খুলে ফেলল। তুশির ধরে রাখা শক্তি,কাজেই দিলো না তাতে। ছলকে ওঠা বুক নিয়ে মুখ তুলল মেয়েটা।
চোখ খিচে জিভ কাটলেন মাজহার। এই রে,শেষ রক্ষে হলো না।
পরিচিত কনের জায়গায় তুশির অচেনা মুখটা দেখেই চমকে উঠল সবাই।
রেহনূমা আর্তনাদ করে বললেন ,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ এ কী,এ মেয়ে কে?”
ইয়াসিরের শক্ত আদল কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। থমকে গেল তীক্ষ্ণ চোখ। ঘামে চটচট করা একটা মেয়েলি ফরসা চেহারা উন্মুক্ত তার সামনে। যে মেয়েটাকে কদিন আগেই সে জেলে ভরল ওয়ালেট চুরির দ্বায়ে। সে এখন তারই পাশে বউ সেজে বসে?
ইয়াসির নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। অস্ফুট আওড়াল,
“ তুমি!”
তুশি ঢোক গিলল। আস্তেধীরে উঠে দাঁড়াল কোনোরকম। চোখের কোণ তুলে মাজহারকে দেখল এক পল। চিন্তায় ফ্যাসফ্যাস করছেন লোকটা। চোখের মণি অস্থির।
তুশির মাথায় সব বুদ্ধি-সুদ্ধি প্যাচ বেধে গেছে। এই মুহুর্তে কী করবে,কী করা উচিত জানে না। কী উত্তরই বা দেবে সবাইকে? কেউ কি বিশ্বাস করবে ওর কথা ! গরীবদের কেউ বিশ্বাস করে কখনো!
সৈয়দ পরিবার কিংকর্তব্যবিমুঢ়! বিস্ময়ে পাথর বনেছেন শওকত আলী। সাইফুল বললেন,
“ ভাইজান,এ মেয়ে তো সে মেয়ে নয়। এ তো আরেক মেয়ে। এ কোথা থেকে এলো?”
তুশি মিনসে চেহারায় চারপাশে দেখছে। সেন্টার ভরতি মানুষ সবাই ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। এতগুলো প্রশ্নবিদ্ধ, তীক্ষ্ণ চাউনির নিশানা হয়ে ফোস করে শ্বাস ফেলল মেয়েটা। আচমকা কনুই টেনে নিজের দিকে ঘোরাল ইয়াসির। আঁতকে উঠল তুশি।
চোখে চোখ পড়তেই,
প্রশ্ন ছুড়ল সে,
“ এসবের মানে কী? তুমি এখানে কী করে এসেছ? কে এনেছে তোমায়?”
রেহনূমা অবাক হয়ে বললেন,
“ তুই মেয়েটাকে চিনিস,সার্থ?”
সবার সাথে সাথে মাজহারও সমান বিস্মিত হলেন। পাত্র এই মেয়েকে কী করে চিনল? ইয়াসির প্রশ্নের
জবাব দিলো না। কটমটিয়ে শুধাল,
“ আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে! আন্সার মি। এখানে কী কোরছো তুমি?”
এক চিৎকারে রুহুটা উড়ে গেল তুশির। কেঁপে উঠল একটু।
কনে তুশির বাবা মুখ লোকানোর জায়গা পাচ্ছেন না। পাত্রপক্ষের সামনে দাঁড়ানোর জো নেই। বিড়বিড় করলেন হতাশ গলায়,
“ এটারই ভয় পাচ্ছিলাম।”
ঠিক তখনই খোঁজ পড়ল তার। ডাকছেন শওকত আলী,
“ এহসান সাহেব,কোথায় আপনি? এদিকে আসুন। এই কেউ মেয়ের বাবাকে ডাকুন তো।”
ডাকতে হোলো না। লম্বা পায়ের ছোটো ছোটো কদম ফেলে গিয়ে দাঁড়ালেন এহসান। মাঝে ক্ষিপ্ত চোখে শ্যালককে দেখে নিলেন এক পল। পরপর
ভীষণ বিনয়ে বললেন,
“ জি বেয়াই সাহেব,কী হয়েছে?”
সাইফুল রেগেমেগে বললেন,
“ কী হয়েছে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না? এই মেয়েটি কে? কোত্থেকে এলো?
আপনার মেয়ের জায়গায় অন্য এক মেয়ে বসেছে,আপনাদের কোনো হুশ-জ্ঞান নেই?”
ভদ্রলোক এমন ভাবে চাইলেন, যেন আকাশ থেকে পড়েছেন এক্ষুনি। তুশির পানে চোখ বুলিয়ে বললেন,
“ ও মাই গুডনেস! এই মেয়ে কে? আর আমার মেয়ে কোথায়! আমি তো এসবের কিছুই জানিনা।”
সবার কপাল বেঁকে গেল।
তুশি চেয়ে রইল বিরক্ত চোখে। আচ্ছা নাটকবাজ লোক তো! ফটাকসে বলে দিলো এসবের কিছুই জানে না? অথচ একটু আগেই তো মেয়ে ভেগেছে শুনে বুকে হাত দিয়ে চিতপটাং হয়ে পড়েছিল।
ইউশার স্বর মৃদূ।
“ আম্মু,ওনাকে জিজ্ঞেস করো না ভাবি কোথায়! কনের কস্টিউম পরে যখন বসেছেন,উনি নিশ্চয়ই জানবেন ভাবির কথা।”
রেহনূমাকে জিজ্ঞেস করতে হোলো না। তুশি শুনতে পেয়েছে। রাখ-ঢাকহীন ফটাফট বলে দিলো,
“ আপনার ভাবি অন্য ছেলে নিয়ে ভেগে গেছে।”
এ কথা কোনো কথা ছিল না, ছিল বড়োসড়ো বাজ আছড়ে পড়ার শব্দ। রেহনূমা হতবাক হয়ে বললেন,
“ মেয়ে ভেগে গেছে মানে? তুমি কী করে জানলে! তুমি মেয়ের কে হও?”
তুশি কাঁধ উঁচায়,
“ আমি কী হব? আমি এদের জন্মে দেখেছি না কি। আমিতো একটু বিনে পয়সায় খেতে এসেছিলাম। শালার কচুকাটা কেসে ফেসে গেছি তারপর।”
কথাবার্তার ধরণ শুনে মুখ কুঁচকালেন তিনি। কোনো ভালো ঘরের মেয়ে তো এভাবে কথা বলে না। এ নির্ঘাত কোনো বস্তি বাড়ির মেয়ে!
অয়ন খাবারের এখানটায় ছিল। মিন্তু আর সে খেতে বসেছে সবার আগে। হাত ধোয়ার সময় গুঞ্জন শুনল,কনে পালটে গেছে। তড়িঘড়ি করে স্টেজ রুমে এসেই, চমকে গেল ছেলেটা। ত্রস্ত পায়ে এসে দাঁড়াল ওদের পাশে।
তুশিকে ভালো করে দেখল কিছু পল। কণ্ঠে বিভ্রম নিয়ে বলল,
“ ইনি সেই চোর মেয়েটা না,ভাইয়া! ওই যে সেদিন আমার মানিব্যাগ চুরি করল?
এই মেয়ে এখানে কী করছে?”
ইয়াসির চুপ। থম ধরে দাঁড়িয়ে সে। সুঠাম দেহ প্রস্তরসম। নড়ল না,কথাও বলল না।
কিন্তু বোম পড়ল বাকিদের মাথায়।
রেহনূমা বিস্ময়াহতের ন্যায় বললেন,
“ চোর! এ মেয়ে চোর! এ চোর এখানে ঢুকল কী করে?”
তুশির কণ্ঠে বিরক্তি। চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ দেখুন,চোর চোর করবেন না। সম্মানে লাগে। পকেট মারা আর চোর কি এক?”
ইয়াসির চোখ বুজে দম ছাড়ল। খেই হারিয়ে ধমক দিলো কষে ,
“ যাস্ট শাট আপ। তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তার জবাব দাও। তুমি এখানে এলে কী করে? কার সাহায্যে বসেছো এখানে?”
মাজহারের চোখ কপাল ছুঁলো। ইয়াসিরের তীক্ষ্ণতায় আরেকদফা হতবাক তিনি।
হাত দিয়ে ফের চকচকে কপাল মুছলেন। না না,তুশি কিছু বলার আগেই গুটি তাকে সাজাতে হবে। রয়েসয়ে মুখ খুললেন,
“ আমি। আমি ওকে এখানে বসিয়েছিলাম।”
তিরের মতো সবার চাউনি এসে আছড়ে পড়ল তার ওপর।
শওকত আশ্চর্য হয়ে বললেন,
“ আপনি ! মানে? আপনি কি আমাদের সাথে ফাজলামো করছেন? এহসান ভাই! আপনার শ্যালক কী উল্টোপাল্টা বলছে এসব? ”
এহসান সাহেব লজ্জায় মাথা তুলতে পারছেন না। রাগও হচ্ছে খুব। মাজহারের গালে কষিয়ে একটা চড় বসালে শান্তি পেতেন! কী দরকার ছিল ওর এত বেশি বোঝার! এখন কীভাবে সামাল দেবেন এসব?
মাজহার দুপা ফেলে শওকতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বড়ো নরম গলায় বললেন,
“ আমি যা সত্যি সেটাই বলছি বেয়াই সাহেব। আচ্ছা, লেট মি এক্সপ্লেইন। আসলে তখন হুট করে খবর পেলাম তুশি পার্লার থেকে পালিয়ে গেছে। ও এই বিয়ে করবে না। ওদিকে আপনারাও চলে এলেন। দুলাভাইও প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল৷ সব মিলিয়ে আমার মাথা কাজ করছিল না। সেসময় এই মেয়েটার সাথে দেখা হয়। কাকতালীয়ভাবে ওর নামও তুশি। তো,আমি ভাবলাম কিছুক্ষণের জন্যে মেয়েটাকে বউ সাজিয়ে স্টেজে বসিয়ে পরিস্থিতিটা সামলাব। এর মধ্যে আমাদের মেয়েকে খুঁজে পেলেই…”
রেহনূমা কথা কেড়ে নিলেন,
“ খুঁজে পেলে মানে? আপনি কী ভেবেছিলেন,আপনাদের পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে খুঁজে এনে আবার আমাদের ছেলের ঘাড়ে গছাবেন? খুব চালাকি তাই না!”
মাজহারের কাছে যুতসই জবাব নেই। মাথাটা নুইয়ে নিলেন দোষীর মতো। শওকত ক্ষেপে বললেন,
“ সব বুঝলাম,আপনার সব কথা মেনে নিলাম আমি। কিন্তু তাই বলে নিজেদের পরিস্থিতি সামলাতে আপনারা একটা অন্য মেয়েকে বউ সাজিয়ে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দিলেন? এটাতো রীতিমতো যোচ্চুরি মাজহার সাহেব।
আপনি জানেন,আমি চাইলে এক্ষুনি এই ঠকবাজির জন্যে আপনাদের নামে মামলা করতে পারি?”
সাইফুল বললেন,
“ চাইলে কী ভাইজান, আপনি থানায় ফোন করুন। আমিও দেখি এরা কোথায় যায়।”
এহসান সাহেব এলাকার সম্মানীয় লোক। লোকজন তাকে সালাম দিয়ে চলে। সেখানে আজ এই কাণ্ডে সব ধুলোয় মিশে যাচ্ছে।
বিগড়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি। কিছু একটা করা জরুরি। মাজহারকে দিয়ে তো কাজের কাজ হয় না।
ভদ্রলোক গলার শ্লেষা কাটালেন। হাত জোড় করে বললেন,
“ বেয়াই সাহেব, দয়া করে মাথা ঠান্ডা করুন। দেখুন, আমি সত্যিই এসবের কিছুই জানতাম না। আমার শ্যালকও বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা এমন হয়ে যাবে।”
সাইফুল দুই ভ্রু উঁচালেন,
“ বুঝতে পারেনি? কেন,আপনার শ্যালক কি কচি খোকা! সে জেনেশুনে কনের জায়গায় কাকে না কাকে বসিয়ে দিয়েছে,আর আপনি বলছেন সে বুঝতে পারেনি! বাহ বাহ,কী হাস্যকর ব্যাপার। এটা কত বড়ো জঘন্য অপরাধ আপনি জানেন?”
টিনটিন-বাবলু চেয়ারের পেছনে লুকিয়েছে। তুশিকে দেখেই ওদের চোখ শৃঙ্গ ছাপিয়ে গেল। ওস্তাদ বউ সাজে,তাও জামাইয়ের পাশে? এর মানে কি ওস্তাদের বিয়ে হয়ে গেল?দুজন উৎসুক চোখে ঘটনা দেখল কিছুক্ষণ।
টিনটিন বলল,
“ ওস্তাদের বিয়া হইয়া গেছে, বাবলু। দাদিরে খবর দিই ল।”
“ আয় আয়।”
দুটোতে চড়ুইয়ের মতো ছুটে গেল ফের। ওস্তাদ বিয়ে খেতে এসে,বিয়ে করে নিলো? এ তো ভারি সর্বনাশের কথা।
তুশির ঘোমটার পাড় থেকে সুতো বেরিয়ে এসেছে। সেটা নিয়ে আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে সবাইকে দেখছে ও। এরা ঝগড়ায় ব্যস্ত! ওর তো আর কোনো কাজ নেই এখানে। সব জানাজানি হয়ে গেছে। এখন ওকে টাকাটা দিয়ে বিদেয় করলে হতো না? ওদিকে টিনটিন বাবলুটাও তো ওর অপেক্ষায় বসে আছে রাস্তায়।
তুশি গাল চুলকে ইয়াসিরকে দেখল আরেকবার।
এত বাকবিতণ্ডার মাঝেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে সে। মাঝে ওকে দুটো ধমক দিলো,আর বিশেষ কথা নেই।
চোখজোড়া ফ্লোরে। চিবুকের ধার মটমট করলেও,নড়ছে-চড়ছে না। তুশি দ্বিধায় পড়ল ওর ভাবমূর্তি নিয়ে। বদ পুলিশটার মনে যে কী চলছে, কী করে বুঝবে ও?
সবাই যেখানে তর্কে লিপ্ত,সেখানে এনার হুঁ-হ্যাঁও নেই। একেই বলে যার বিয়ে তার হুশ নেই,পাড়া-পড়শীর ঘুম নেই। যার বউ ভেগে গেল সে তো চুপ করে আছে। বাকিদের এত মাথা ব্যথা কীসের? তোরাও চুপ থাক না।
তুশির টাকাটারও যে কী হবে! এত কাহিনীর মধ্যে চাইবে কী করে!
ও এদিক ওদিক চেয়ে মুক্তাকে খুঁজল। কোত্থাও নেই মেয়েটা। সুযোগ বুঝে পালিয়েছে মনে হয়। তার টনক নড়ল মাজহারের কথায়।
বলছে,
“ দেখুন, আপনারা কিন্তু আমার পুরো কথা না শুনেই সিনক্রিয়েট করছেন। আমি শুধুমাত্র পরিস্থিতিটা সামলাতেই মেয়েটাকে এখানে বসিয়েছিলাম ঠিকই,কিন্তু আমি চাইনি বিয়ে হয়ে যাক। যখন এখানে কাজী আসে,আমি কিন্তু স্টেজে এসেছিলামই বিয়ে আটকানোর জন্যে। সবার আড়ালে বারবার এই মেয়েকে ইশারা করেছি নেমে আসতে। কিন্তু মেয়েটাই ইচ্ছে করে নামেনি। আমি কী করতাম বলুন।”
তুশি নিস্পন্দ হয়ে পড়ল৷ ঠোঁট ফাঁকা করে আওড়াল,
“ কীহ?”
তার ঐ অল্প আর্তনাদ মাজহার কানে নিলেন না। একটু ফিরলেনও না ওর দিকে। নিজের মতো বললেন,
“ আমার সাথে ওর কথা হয়েছিল শুধু বউ সেজে বসবে এখানে। সেজন্যে আমি ওকে দশ হাজার টাকা দেবো। আর ওই সময়টায় আমাদের তুশিকে খুঁজে আনব আমরা। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ওকে পাওয়া যায়নি। তবে
এই মেয়ে প্রচণ্ড ধূর্ত আর লোভী!
ও যখন বুঝেছে আপনারা সম্ভ্রান্ত, বড়ো পরিবার থেকে এসেছেন,হয়ত লোভে পড়ে আর উঠে আসেনি৷ আমিও দুলাভাইয়ের সম্মানের কথা ভেবে সবার সামনে টা-টু শব্দ করতে পারিনি। এখন আপনারা যদি মনে করেন এটা আমার অন্যায়,তাহলে যা শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেব।”
তার কথা শেষ হলো,সহসা গর্জে উঠল তুশি।
“ এই, এত বড়ো মিথ্যে কথা? ব্যাটা এক ঘুষি মারব সোজা ডাই হয়ে যাবি। আমি বিয়ে করতে চেয়ে…”
এহসান চ্যাঁচিয়ে উঠলেন,
“ তুমি চুপ করো মেয়ে। অস্বীকার করতে পারবে,তুমি এখানে টাকার লোভে বউ সেজে বসোনি?”
তুশির স্পষ্ট জবাব,
“ হ্যাঁ বসেছি।
কিন্তু আপনার শালা…”
এবারেও কথা টেনে নিলেন তিনি,
“ ব্যাস! আর কোনো কথা নেই। যার যা জানার ছিল জেনে গেছে।”
“ কথা নেই মানে, আপনি বললেই হোলো কথা নেই? আমাকে বলা হয়েছিল এখানে বসলে দশ হাজার টাকা দেবে। তারপর তো কাজী আসা মাত্র আমি চলে গেলাম বিয়ে করব না বলে। উনিই তো বললেন বিয়ে করে নিতে। তাহলে আরো টাকা দেবে। পরে বিয়ে শেষ হলে আমি আমার মতো বাড়ি চলে যাব। কী, এমন কথা হয়নি?”
বিমুঢ় কতগুলো চোখ আটকে রইল তুশিতে। ইয়াসির মুখ না তুললেও,হাত মুঠো হলো তার।
রেহনূমা স্তম্ভিতের ন্যায় হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলেন। গোল চোখে আপাদমস্তক দেখলেন তুশির। এ কেমন মেয়ে! টাকা বাড়িয়ে দেবে বলে অচেনা একজনকে বিয়ে করে ফেলল?
মাজহার বিরোধাভাস করলেন চড়া গলায়,
“ না। মিথ্যে বলছে এই মেয়ে। গা বাঁচাচ্ছে নিজের। আমি কেন এসব বলব? ওর সাথে ইয়াসিরের বিয়ে হলে আমার কী লাভ! শওকত সাহেব,দুলাভাই আপনারা কেউ একে বিশ্বাস করবেন না। লোভের বশে বিয়ে করে নিয়েছে,আর দোষ দিচ্ছে আমাকে। এসব বস্তির মেয়েরা কেমন হয় তাতো জানেনই। থার্ডক্লাস! এরা পিঠ বাঁচাতে যা খুশি বলতে পারে। “
তুশি দাঁত পিষে ধরল। হাতখানা নিশপিশ করছে খুব! মাজহারকে মেরে মাটিতে গেড়ে দিতে পারলে ভিজতো কলিজাটা। কত বড়ো ধরিবাজ! মুখের ওপর সব অস্বীকার করে ফেলল?
রেহনূমা নাক সিটকে বললেন,
“ এ মেয়ে বস্তিতে থাকে? শেষে কী না একটা বস্তির মেয়ের সাথে আমাদের সার্থের বিয়ে হোলো! ”
শওকত বললেন,
“ কীসের বিয়ে? এটা কোনো বিয়ে হোলো? এই বিয়ে টিয়ে বাদ। চলো সবাই। আর এহসান সাহেব,এর ফল আপনি ভুগবেন। আপনার শ্যালক যেটা করেছে, আমি কিন্তু ব্যাপারটা এমনি এমনি ছেড়ে দেবো না। এর শেষ দেখে তবে ছাড়ব। সবাই চলো!”
ক্ষুব্ধ মেজাজের তুশি হাঁপ ছাড়ল এবার। ভদ্রলোকের ‘চলো সবাই’ কথাটা ওর পছন্দ হয়েছে। যাক, সবাই গেলেই ভালো। সেন্টার খালি হবে। সেও টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। সাথে মনে মনে পণ করল,আর কোনোদিন ফ্রিতে খাওয়ার আশায় এসব সেন্টারে ঢুকবে না। ঢুকবে কি,পাশই মাড়াবে না কখনো ।
সৈয়দ বাড়ির লোকজন যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। এহসান সাহেব তখনো সাফাই গাইতে মরিয়া।
“ আমার কথাটা শুনুন শওকত ভাই,একবার শুনুন প্লিজ!”
এমন হাজারখানেক অনুরোধ তার।
ভদ্রলোকের স্ত্রীও অদূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছটফট করছেন খুব। পুরো সেন্টারের সবাই তামাশা দেখতে ব্যস্ত । শওকত সাহেবের চলন-বলনে প্রতাপ। কানেই নিলেন না কথা।
সবাইকে নিয়ে রওনা করবেন যখনই,আচমকা মুখ খুলল ইয়াসির,
“ এক সেকেন্ড।”
থামল সবাই। তুশির কপাল বেঁকে গেল। এর আবার কী হয়েছে? শুভ কাজে আটকাচ্ছে কেন?
তুরন্ত,ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে চাইল ইয়াসির।
বাজপাখির মতো এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখের নিশানায়,বুকটা ছলকে উঠল মেয়ের। এমন করে তাকাচ্ছে কেন? কী করবে!
ইয়াসির ঠিক মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। ছুরির মতো চোখে চোখ রাখতে পারল না তুশি। অগোছালো পাতা ফেলে মাথা নামিয়ে নিলো নিচে।
সহসা তপ্ত কণ্ঠের নিরেট প্রশ্ন ছুটে এলো কানে,
“ তাহলে তুমি টাকার লোভে বিয়ে করেছ, তাইতো?”
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১০
তুশি বিভ্রান্তিতে লুটোপুটি খায়। এতক্ষণ তো বলল যা বলার। আবার এসব কথা কেন? ও উত্তর দিলো না।
আঙুলের ডগায় অস্থিরতা,আর বক্ষভাগের ঢিপঢিপ শব্দের মাঝেই, হাতটা খপ করে চেপে ধরল ইয়াসির। মেয়েটা চমকে গেল,ভয় পেলো। হকচকিয়ে তাকাল এবার। রুক্ষ, শক্ত আঙুল দেবে বসল ওর
ফরসা, পেলব ত্বকে। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ইয়াসির,
“ বিয়ে যখন করলেই, এবার যে সংসারও করতে হবে। চলো।”