কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৪ (২)
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
একটা তোষক,বালিশ আর কাঁথা দেয়া হয়েছে তুশির ঘুমোনোর জন্যে। সেসব ফ্লোরে সুন্দর করে বিছিয়েছে সে। আপাতত রাতটা কাটুক! দিনের আলোতে ঘরটাকে আরেকটু ঝালাই করবে না হয়। তবে তুশির বিপত্তি বাধল অন্য কিছুতে। রাতে পরার জন্য তনিমা একটি সুতির শাড়ি পাঠিয়েছেন। যেটা রুম ঝাড়তে এসে মাত্রই দিয়ে গেছে রেশমী। আর সেই শাড়ি নিয়ে হতাশ চিত্তে বসে আছে তুশি। এসব কী ও পরতে পারে? কোনদিক দিয়ে কয় প্যাঁচ দেয়,সেটাই জানে না। এমনিতেই এমন ভারি লেহেঙ্গা পরে কতবার যে হোচট খেতে ধরল তার হিসেব নেই। তুশি শাড়িটা উল্টেপাল্টে দেখে রেখে দিলো আবার। এ বাড়িতে কি কেউ শার্ট-প্যান্ট পরে না? ওকে নাহয় ওসব একটা কিছু দিতো। তা না!
মেয়েটা ফোস করে শ্বাস ফেলল। সবই কপালের দোষ! এখন এই লেহেঙ্গা পরে কীভাবে ঘুমাবে? গা যেভাবে কুটকুট করছে ,সারারাত কাটাবে কী করে তুশি?
তক্ষুনি মনে পড়ল ইউশার কথা। ও তো বলেছিল,কিছু দরকার পড়লে রুমে যেতে। ত্রস্ত উঠে দাঁড়াল তুশি।
চটপটে হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। বসার ঘরে নিভু নিভু ডিমবাতি জ্বলছে। সবুজাভ আলোতে স্পষ্ট সব। তুশি পা টিপে টিপে সিঁড়ির পথ ধরল।
এ বাড়িতে এখন অবধি তার আতঙ্ক দুজন। একজনকে অবশ্য তুশির অতটা গায়ে লাগছে না। কিন্তু দ্বিতীয় জন!
বাপ্রেহ…
তুশি হিসেব করে করে ঠিক বা দিকের দুটো রুম পরে এসে থেমেছে।
বুকখানায় অল্পস্বল্প দুরুদুরু ভাব। মন দিয়ে চাইছে,
এটা যেন ইউশার ঘরই হয়। ভুল করে কারো ঘরের দরজা পেটালে,ওকেই না পিটিয়ে রুটি বানিয়ে ফেলে।
তুশি দোয়া পড়ে আস্তে আস্তে টোকা দিলো দরজায়। পাছে বেশি শব্দ না হয়।
ওপাশ থেকে খুব দ্রুত খুলল সেটা। ঘুম ঘুম চোখে বেরিয়েছে ইউশা। ওকে দেখেই বলল,
“ তুমি!”
ঠোঁট ফুলিয়ে স্বস্তির শ্বাস ঝাড়ল তুশি। যাক,ঠিক ঘরেই এসেছে তাহলে। তৎপর হাওয়ার বেগে ভেতরে ঢুকল সে । ধৈর্যহীন বলল,
“ ইউ হেবিং শার্ট প্যান্ট? লং বিপদে পড়ে কামিং। আই…”
মাঝপথেই থামিয়ে দিলো ইউশা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ দাঁড়াও,দাঁড়াও। আমি বাংলা বুঝি। তুমি বাংলায় বলো তুশি,কোনো সমস্যা নেই।”
তুশি একটু লজ্জা পেলো। মাথা চুলকে বলল,
“ আসলে এগুলো পরে শুতে পারছি না। একটা শার্ট-প্যান্ট কিছু দাও না থাকলে।”
ইউশা ব্যথিত চোখে চাইল।
“ আমার কাছে ওসব নেই। আমি শুধু চুড়িদার পরি। নেবে?”
তুশি চোখ ঝাপটাল। মাথা ঝাঁকাল পরপর,
“ আচ্ছা, যা আছে তাই দাও।”
“ বোসো।”
ইউশা কাবার্ডের কাছে যায়। ততক্ষণে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সারা ঘরে চোখ বোলায় তুশি। কত সুন্দর একেকটা আসবাব! ঝকঝকে,ফকফকে! এত্ত বড়ো ড্রেসিং টেবিল? সাজগোজের কত জিনিস! কত আলো!
ঠিক সিনেমার নায়িকাদের মতো ঘর। ইস,তুশি তো বাস্তবে এসব কোনোদিন দেখেনি। ওর চোখ পড়ল বিছানার দিকে। আগাগোড়া সাদা বালিশ-চাদরে মোড়ানো সব। কোথাও একটু দাগের ছিঁটেফোঁটাও নেই।
তুশি এক কোণে বসল। নরম তোষক দেবে গেল একটু!
মেয়েটা মজা পেলো তাতে। আবদার ছুড়ল তৎক্ষনাৎ,
“ কী নরম! আমি এখানে একটু শোব গো?”
ইউশা তখন জামাকাপড় খুঁজছে। ছুড়ে দিলো ব্যস্ত গলায়,
“ হ্যাঁ, শোও না।”
তুশি সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। হাত পা ছড়িয়ে বলল,
“ কী আরাম! এটা খাট না তুলো? এখানে শুলে আমি এক টানা চার মাস ঘুমোতে পারব।”
ইউশা হাসল মাথা নেড়ে। এগিয়ে এসে ওর মাথার কাছে বসল। তুশি দুম করে উঠে পড়ল হঠাৎ।
ঠোঁট উলটে বলল,
“ না থাক,শোবো না। বেশি শুলে যেতে ইচ্ছে করবে না। তোমার মা দেখে নিলে আবার তোমাকেই বকবে।”
ইউশার হাসিটা মুছে গেল অমনি। মন খারাপও হলো খুব! মা আসলেই এই একটা ব্যাপারে খুব বাড়াবাড়ি করছেন। কী এমন হতো তুশিকে ওর সাথে থাকতে দিলে? কিন্তু ওসব কথা তুলল না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে এগিয়ে দিলো জামাটা,
“ তুমি তো আমার থেকে লম্বা,দেখো এটা ঠিকঠাক হয় কী না!”
তুশি হাতে নিলো। কালো রঙের জামা উল্টেপাল্টে বলল,
“ এতো জামা আর পাজামা। তুমি যে বললে চুড়িদার? চুড়ি কোথায়?”
বোকা বোকা কথাটায় শব্দ করে হেসে উঠল ইউশা। হাত দিয়ে গালটা টেনে দিলো ওর।
“ ইউ আর সো সুইট,তুশি!”
তুশি হাসল। সুইট মানে ও জানে। ইউশা বলল,
“ যাও, পরে এসো।”
“ এখানে না। একবারে ঘরে গিয়ে পরব।”
“ তুমি খেয়েছ?”
মাথা নাড়ল সে,
“ হ্যাঁ। বদ পুলিশের মা খেতে দিয়েছে।”
“ উহুম,এভাবে বলতে নেই। উনি তোমার শাশুড়ী হন।”
তুশির চেহারায় অনীহা। মুখ বাঁকাতেই,ইউশা চোখ প্রকট করল,
“ এমন করছো কেন বোকা মেয়ে? তোমার কিন্তু এখন বিয়ে হয়ে গেছে। আর বিয়ের পর একটা মেয়ের কাছে স্বামী, শ্বশুরবাড়ি এরাই সব, বুঝেছ।”
তুশি চুপ। তার চোখেমুখে বিরক্তি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইউশা।
“ এখন যাই বলি তোমার মাথায় ঢুকবে না। কিন্তু মনে রেখ,বাইরের দুনিয়ার কাছে তুমি সার্থ ভাইয়ার স্ত্রী।
তোমার নামের সাথে ও জুড়ে গেছে,তুশি। এই জুড়ে যাওয়া কেউ চাইলেও অস্বীকার করতে পারবে না।”
তুশি আগের পরের সব কথা বাদ দিয়ে,ফট করে শুধাল,
“ সার্থ কে?”
ইউশার কণ্ঠে ক্লান্তি,
“ ভাইয়ার ডাক নাম সার্থ।”
তুশি নাক সিটকে ভাবল,
“ সার্থ না রেখে স্বার্থপর রাখলেই পারতো। জাহিল পুলিশের সাথে এটাই তো ভালো মানাচ্ছে।”
তাকে ভাবুক দেখে উরুর ওপর হাত রাখল ইউশা,
“ কী ভাবছো?”
“ হুঁ? না,কিছু না। তুমি বলো কী বলছিলে?”
“ আমি যাই বলি,তুমি কি আদৌ বুঝতে পারছো?”
তুশি উঠে দাঁড়াল।
“ নাহ। ওসব আমার বুঝে কাজ নেই। এসব বিয়ে-ফিয়ে দিয়ে কী করব? ছোট্ট একটা জীবন,খাব দাবো ঘুমাবো আর চুরি….”
থামল। জিভ কেটে বলল,
“ না,চুরি করব না। ওসব করা ভালো না।”
ইউশা বলল,
“ থাক, কথা ঘোরাতে হবে না। কী বলতে যাচ্ছিলে আমি খুব ভালো করে জানি। তবে একটা কথা বলে দেই, এটা কিন্তু পুলিশের বাড়ি। বড়ো চাচ্চুও আর্মির বড়ো অফিসার ছিলেন। এমন বাড়িতে ভুলেও এসব হাত সাফাইয়ের চিন্তা করতে যেও না। নিজেই বিপদে পড়বে।”
তুশি মাথা নাড়ল,
“ ওকে থ্যাংকু।”
ইউশা উঠে আসে। আলতো করে হাতদুটো মুঠোয় নিতেই অবাক চোখে চাইল ও। মেয়েটা ভীষণ নরম গলায় বলল,
“ তুমি একদম মন খারাপ কোরো না,তুশি। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। ভাইয়া একদিন তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসবেন। তোমাদের একটা সুখের সংসার হবে। আমার মন বলছে,হবেই।”
তুশির ভ্রু কুঁচকে এলো নাটকীয় দশায়৷ নাক-মুখ গুটিয়ে গেল সাথে৷ হাতটা ছাড়িয়ে নিলো ত্রস্ত। জিভ বার করে ঠোঁট বিকৃত করে বলল,
“ উউউওয়াক,ওয়াক।”
ভড়কে গেল ইউশা। ব্যতিব্যস্ত আওড়াল,
“ তোমার কি বমি পাচ্ছে?”
তুশি মুখের ওপর বলে দেয়,
“ পাচ্ছে। তোমার কথা শুনে পাচ্ছে। এসব কেউ বলে? ছিঃ আমি যাই। ঘুমাব।”
তারপর বেরিয়ে গেল। পেছনে হতভম্বের ন্যায় চেয়ে রইল ইউশা। বিড়বিড় করে ভাবল,
“ আমি খারাপ কী বললাম?”
তুশি হাঁটতে হাঁটতে একটা লম্বা হাই তুলল। হঠাৎ চোখ পড়ল ডান পাশের কোনো এক ঘরে। দরজা অল্প ভেজানো। ঝুলন্ত পর্দার উড়ে চলার ফাঁকে সোজাসুজি বিছানা দেখা যাচ্ছে। পাশের ছোটো টেবিলে ল্যাম্পশেড জ্বালানো।
তুশি মাথা নামিয়ে উঁকি দিলো ভেতরে। ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে ইয়াসির। ও চোখ নাঁচিয়ে ভাবল,
“ ওওও বদ পুলিশের ঘর তাহলে এটা?”
তুশি আরেকটু গলা নামাল পুরো ঘরের নকশা বুঝতে। কিন্তু ল্যাম্পশেডের অল্প আলোতে বিশেষ কিছু ঠাওর করা যাচ্ছে না। শুধু ল্যাপটপের সাদাটে প্রভা সরাসরি এসে পড়ছে ইয়াসিরের গৌড় বর্ণ মুখে। সে মানুষ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কাজ করায় ব্যস্ত । কী হলো কে জানে! কেন যেন ইউশার কথাটা মনে পড়ল তুশির।
“ ভাইয়া তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসবেন। তোমাদের ভীষণ সুখের একটা ঘর হবে দেখো।”
মেয়েটার গা গুলিয়ে এলো ফের। যেন ভেতর থেকে বমি ঠেলে আসতে চাইছে। তুশি ভালোবাসার অতশত বোঝে না। তবে বোঝে ,ইয়াসিরের ভালোবাসা মানে ওর বমির সমান। এই মুহুর্তে একটা সুনামি আসায় যদি পুরো পৃথিবী লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়? আর তাতে যদি শুধুমাত্র ইয়াসির বেঁচে থাকে? তাও এই বদের ভালোবাসা ওর কোনো দরকার নেই।
রাতে তুশির ভালো ঘুম হয়নি। এত মশা! ও তো মশারি ছাড়া ঘুমোতেই পারে না। তারওপর ইদুরের অত্যাচার। একবার এদিক থেকে ছোটে তো অন্যবার ওদিক থেকে এদিক। সব মিলিয়ে এক ফোঁটাও এক করেনি চোখদুটো।
কখনো আবার দাদির চিন্তায় বুক শুকিয়ে বসেছে। কখনো নিজের শোকে কপাল চাপড়েছে তুশি। সেই
কাকভোরে ঘুম এলো একটু! অথচ ঠিক ঘন্টাখানেকের মাথায়, এক দলা পানির ঝাপ্টা আচমকা উড়ে পড়ল মুখে।
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল তুশি। ভিজে চুপচুপে শরীরের পানে হকচকিয়ে চাইল।
ছাদ কি ফুটো হয়ে গেছে? বৃষ্টি পড়ছে কোত্থেকে?
তক্ষুনি কর্কশ কণ্ঠে বলল কেউ,
“ এই যে মহারানী, ঘুম ভাঙল আপনার?”
তুশি তৎপর পাশ ফিরে চাইল। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রেহণুমা। অন্য হাতে একটা জগ। ওটার পানিই মেরেছিলেন মুখে। ও ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তেতে বলল,
“ ইউ মাই মুখে ওয়াটার ছুড়লেন কেন? হু গিভিং দিস সাহস?”
রেহণূমা দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
“ বাবাহ,আমার সাহস নিয়ে কথা বলছো? সার্থকে ডাকব নাকি!”
তুশি নিভে গেল। চুপসে যাওয়া ভেজা মুখটা মুছল হাত তুলে। রেহনূমা ঠোঁট টিপে হাসলেন। পরপর গম্ভীর গলায় বললেন,
“ তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে এসো। নাস্তা বানাতে হবে।”
তুশির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কণ্ঠ শৃঙ্গে নিয়ে বলল,
“ নাস্তা বানাব,আমি?”
“ জি হ্যাঁ, আপনি। সার্থ কাল কি বলেছিল ভুলে গেছেন, মহারাণী? সবাই খেয়ে বের হবে। তাড়াতাড়ি এসে উদ্ধার করুন আমাকে।”
রেহনূমা চলে গেলেন। তুশির লালচে ঠোঁট চূড়ায় উঠে বসল।
দুঃখী দুঃখী মুখ করে ভাবল,
“ নাস্তা বানান করতেই পারি না। আবার বানিয়ে খাওয়াতেও হবে?”
ঘরের বাইরে থেকে হুঙ্কার এলো তক্ষুনি,
“ কী হলো? আরেক জগ পানি আনব নাকি?”
তুশি তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো বাইরে।
রান্নাঘরে এসেই ঠোঁটটা সরে বসল দুদিক। রান্নাঘরও এত বড়ো হয়! মাগো মা!
বস্তিতে ওদের শোবার ঘরটা তো এর অর্ধেকও হবে না। সত্যি বাবা, বড়োলোকদের বিরাট কারবার! ইস,রাতে তুশিকে এখানে শুতে দিলেও হতো!
রেশমী বটিতে আলু কুচোচ্ছে। তার মুখে কালকের চিন্তার লেশমাত্র নেই। রেহণূমা বলেছেন, ওকে বিদেয় করা হবে না। এত বছর ধরে কাজ করছে বাড়িতে,একটু আন্তরিকতা তো প্রাপ্য। তবে অন্য যে ছুটা বুয়া ছিল তাদের আজকেই ছাড়িয়ে দেবেন তিনি।
তনিমা রান্নাঘরেই ছিলেন। তুশিকে দেখে বললেন,
“ এ কী! তুমি এখানে কেন?”
রেহনূমা জানালেন,
“ ও আজকে সকালের নাস্তা বানাবে।”
চ সূচক শব্দ করলেন তিনি,
“ উফ,কী শুরু করেছিস ছোটো? সার্থ বলল আর তুইও লেগে পড়লি?”
“ আপা শোনো, তুমি এসবের মাঝে এসো না। তুমি অতিরিক্ত মহান। সার্থ যা করছে তাতো ভুল নয়। এই মেয়ের আসলেই একটা চরম শিক্ষা দরকার। তুমি যাও তো আপা। ঘরে যাও। আজকে তোমার এখানে কোনো কাজ নেই। নাস্তা হয়ে গেলে আমি তোমাকে খেতে ডাকব।”
“ কিন্তু…”
“ কোনো কিন্তু না, যাও যাও।”
রেহনূমা ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিলেন ওনাকে। যেতে যেতে তুশিকে নিবিড় চোখে দেখলেন তনিমা। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে তুশি। ফ্যালফ্যাল করে দেখছে চারপাশ। ভদ্রমহিলা এক চোট শ্বাস ফেলে ভাবলেন,
“ এত বড়ো মেয়ে! কাজবাজ তো কিছু জানার কথা। হয়ত খুব একটা অসুবিধা হবে না।”
রেহনূমা ময়দার বৈয়ম এগিয়ে দিলেন।
হুকুম ছুড়লেন হাস্যহীন,
“ নাও, আটা মাখো। সবার জন্যে পরোটা হবে।”
তুশির সরল প্রশ্ন,
“ কোথায় মাখব?”
বিরক্ত চোখে চাইলেন তিনি,
“ আমার মাথায় মাখো।”
তুশি গলা উঁচিয়ে মাথাটা দেখল এক বার।
নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল,
“ মাথায় মাখলে চুলে লেগে যাবে না?”
রেহনূমা তাজ্জব। হতভম্ব নেত্রে রেশমীর মুখখানা দেখলেন। কাজ বাদ দিয়ে সেও অদ্ভুত চোখে চেয়ে। পরপরই
রেগেমেগে বললেন,
“ ফাজলামো করছো আমার সাথে? জীবনে পরোটা বানাওনি?”
তুশি ঘাড় নাড়ল দুদিকে।
“ না।”
“ কী করেছ তাহলে,শুনি?”
জবাব এলো ফটাফট,
“ খেয়েছি,ঘুমিয়েছি আর পকেট মেরেছি।”
নাক কুঁচকে নিলেন রেহনূমা,
“ ইস,লজ্জাও নেই! আবার মুখ মেলে বলছে এসব। যাও, একটা বাটি নিয়ে এসো।”
তুশি গাঁইগুঁই করল না। চুপচাপ একটা ছোট্ট পিরিচ নিয়ে বাড়িয়ে দিলো সামনে।
কপালে টাস করে চড় মারলেন রেহনূমা।
“ এটা দিয়ে কী হবে? এতটুকুতে কি এত মানুষের জন্যে ময়দা গোলা যায়?”
তুশি ঠোঁট গোল করে বলল,
“ ওওও, গুলতে হবে? তাহলে বালতি নিয়ে আসি?”
ভদ্রমহিলা আশ্চর্য চোখে বললেন,
“ বালতি! বালতিতে ময়দা গুলব? অ্যাই মেয়ে, তুমি কি পাগল না শেয়ানা? যাও,বড়ো একটা গামলা নিয়ে এসো। ওই শেল্ফে রাখা আছে দ্যাখো।”
তুশি মাথা নাড়ল। খুঁজে খুঁজে এনে দিলো একটা। রেহনূমা ময়দা ঢাললেন তাতে। জলের জগটা ওর পাশে দেখে বললেন,
“ এবার এর মধ্যে পানি দাও।”
তুশি মাথা ঝাঁকায়। জগটা তুলেই পুরোটা পানি ভকভক করে ঢেলে দেয় ভেতরে। রেহনূমা আর্তনাদ করে উঠলেন,
“ এমা, এটা কী করলে?”
তুশির কণ্ঠে অবোধ ভাব,
“ আপনিই না বললেন পানি দিতে?”
“ এতটা দিতে বলেছি?”
“ কতটা তাও তো বলেননি।”
রেহনূমায় মাথায় হাত দিলেন। হাহুতাশ করে বললেন,
“ হায় হায়! এই মেয়েকে দিয়ে আমি কী কাজ করাব? এত দেখি কাজে একেবারেই লবডঙ্কা!”
এতক্ষণের কাণ্ডকারখানায় তিতিবিরক্ত রেশমী। কাজ ফেলে
উঠে দাঁড়াল সহসা।
“ খালা, আমনে আমারে দেন। এই মাইয়া কিছু পারে না।”
রেহনূমা গোঁ ধরে বললেন,
“ পারে না বললেই হবে? ওকে দিয়েই করাব আমি।”
“ তাইলে আইজ আর খাওন লাগব না। এটটু পর না সবাই বাইর হইব?”
ভদ্রমহিলার তেজি চোখ নিভে গেল। পক্ষান্তরে ততোটাই চকচকিয়ে উঠল তুশি। যাক,ওর তাহলে আর নাস্তা বানাতে হবে না। এই ফাঁকে বরং রুমে গিয়ে আরেকটু ঘুমানো যাবে।
রেহনূমা তক্ষুনি বললেন,
“ ঠিক আছে যাও, তুমি গিয়ে সিঁড়ি গুলো মুছে ফেলো। বসার ঘরটাও মুছবে।”
তুশির চোখ কপালে। হতবাক আওড়াল,
“ আমি ঘর মুছব?”
পরপরই ফুঁসে উঠল মেয়েটা,
“ ইউ জানেন হু মি? মি ইজ তুশি। বস্তির ওয়ান সেলবিরিটি তুশিকে দিয়ে ইউ হোম মোছাবেন?”
রেহনূমা কটমটিয়ে চাইলেন,
“ যাবে? না সার্থকে ডাকব?”
তুশির সদ্য তোলা ফণাটা ফের নেমে গেল। ঠোঁট উলটে বলল,
“ যাচ্ছি।”
“ ওয়াশরুম থেকে লাল বালতিটা নিয়ে যাও। সুন্দর করে মুছবে। একটু ময়লাও যেন না থাকে।”
তুশি ভেঙচি কাটল। বসার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ওয়াশরুমে ঢুকে ট্যাপ ছাড়ল পানির। রাগে ওর মাথা ফেটে যাচ্ছে। দাঁত চেপে বিড়বিড় করল,
“ বদ পুলিশের বাচ্চা! বাড়িতে নিয়ে এসে যৌথ প্রচেষ্টায় অত্যাচার করছিস তো! শালা তোর প্যান্টের ভেতর পিঁপড়া ঢুকুক। কামড়াতে কামড়াতে তোর বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা শেষ করে দিক, শালা।”
বড়োসড়ো বালতিটায় অর্ধেক পানি ভরে টানতে টানতে নিয়ে এলো তুশি। বসার ঘরে তখন কেউ নেই। অমনি একটা বুদ্ধির আলো জ্বলজ্বল করে উঠল মাথায়। এই ফাঁকে ভেগে গেলে কেমন হয়! কেউ দেখবেও না,জানবেও না।
তুশি চারপাশটা দেখেই ছুটে গেল সদর দরজার কাছে। ছিটকিনি নামিয়ে হাতলটা টানল অনেক বার। নাহ,খুলছে না। ও সব ভাবে টানল। বসে,দাঁড়িয়ে, কাত হয়ে। গায়ের পুরো জোর খাটালেও দরজা খোলার নাম নেই। এত শক্ত কেন?
কোত্থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো তখনই। তুশি ঘাবড়ে গেল। ফিরে চাইল গোল চোখে। আইরিন নিচে নামছে। হাসতে হাসতে বলল,
“ পালানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। ওটা লক করা।”
ব্যস,তুশির সমস্ত জারিজুরি শেষ। হাওয়া ছেড়ে দেওয়া বেলুনের মতো নেতিয়ে এলো মুখটা। আইরিন এসে সোফায় বসল।
বলল কর্কশ গলায়,
“ সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে,কাজ করো যাও। ঘরটা মুছে তারপর আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যাবে।”
তুশি বিরক্ত হলেও রা করল না। চুপচাপ বালতির ভেতর ন্যাকরা ডুবিয়ে মোছা শুরু করল। আইরিন চোখ ছোট করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। মেয়েটাকে জ্বালানোর একটা দারুণ বুদ্ধি পেতেই উঠে গেল কোথাও।
ফিরে এলো সেকেন্ড কয়েকে। পায়ে বাইরে পরার জুতো।
বিশাল বড়ো ড্রয়িংরুমের মেঝেতে ঝিলমিল করছে জল। দু হাঁটু গেড়ে মনোযোগ দিয়ে মুছছিল তুশি। আইরিন ক্রুর হাসল।
যে জায়গাটা সবে মাত্র মুছেছে তুশি,সেই চকচকে টাইলসে জুতো পরা পা দিয়ে হেঁটে গেল তারপর।
জুতোর ভারী শব্দের সাথে মুহুর্তে কাদামাটির ছাপ বসল তাতে৷ আইরিন কিছু দূর গিয়ে থামল। ডাকল ওকে,
“ এই যে, এদিকটা মোছো।”
তুশি ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। সদ্য পরিষ্কার করা মেঝেতে গোটা গোটা জুতোর ছাপ! আকাশ থেকে পড়ল মেয়েটা।
“ এ বাবা,এসব কে কর…”
বলতে গিয়ে চোখ পড়ল আইরিনের পায়ে। সাথে মিটিমিটি হাসছে সে। তুশির মেজাজ চটে গেল।
নাক ফুলিয়ে বলল,
“ এত কষ্ট করে মুছলাম,আর তুমি ইচ্ছে করে নোংরা করলে?”
আইরিন বুকের সাথে দুহাত বেঁধে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণ জ্বলজ্বল করছে চতুরতায়,
“ হ্যাঁ। আসলে আমি তো রাজকুমারী, নোংরা মেঝেতে আমার পরিষ্কার পা ফেলতে ইচ্ছে করে না।”
তুশি আর কিছু বলল না। বাধ্যের ন্যায় এসে আবার মুছল জায়গাটা। কিন্তু আইরিন দমেনি। সঙ্গে সঙ্গে আবার কয়েক পা হেঁটে গেল সে। ফের জুতোর চিহ্ন দগদগে দাগ তুলল সেথায়।
তুশি চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। খুব কষ্টে ঠান্ডা রাখল নিজেকে। আবার হাত ছড়িয়ে মুছল ওটুকু। কিন্তু আবার জুতো পরে হেঁটে গেল আইরিন। এবার আর চুপ থাকা গেল না। দুম করে উঠে দাঁড়াল তুশি। কটমটিয়ে বলল,
“ কী শুরু করেছ তুমি? ঘর ময়লা করছো কেন?”
আইরিনের স্বর রুক্ষ। চিঁবিয়ে চিঁবিয়ে বলল,
“ সে কৈফিয়ত কী তোমাকে দিতে হবে? এটা আমাদের বাড়ি। জুতো পরব কী পরব না,সেসব আমি বুঝব। আমি মালকিন, আর তুমি কাজের মেয়ে। যতবার ময়লা করব ততবার মুছবে।”
তুশির মুখটা থম মেরে গেল। ঘোর অমানিশায় ছেঁয়ে এলো সবটা। পরপরই ঠোঁট বেকিয়ে হাসল সে। ওই হাসার মানে আইরিন বোঝেনি। ততক্ষণে তার নজরে পড়ল তকতকে সিঁড়িটা। তুশি একটু আগেই মুছেছে এসব। ও ঝটপট কয়েক পা এগোলো নোংরা করবে বলে, আচমকা পিছু ডাকল তুশি,
“ এই যে, রাজকুমারী!”
আইরিন থামে,ফিরে চায়।
তুরন্ত, নোংরা জল ভর্তি বালতিটা তুলেই ঝপাৎ করে ওর গায়ে ঢেলে দিলো তুশি। মেয়েটা হকচকাল, স্তব্ধ হলো। জড়বুদ্ধির ন্যায় নিজেকে দেখল এক বার। সারা শরীর ময়লা পানি দিয়ে চুপচুপে দশা। এতক্ষণ তুশি যে জল দিয়ে ঘর মুছেছে? সেই সবটা তার শরীরে। তুশি দুহাত ঝেড়ে বলল,
“ নাও,তোমার পরিষ্কার পায়ের মতো শরীরটাও পরিষ্কার করে দিলাম। আশা করছি আত্মাটাও ধুয়ে যাবে এবার।”
হুশ ফিরতেই
আর্তনাদ করে উঠল আইরিন,
“ এটা কী করলে! আমার চুল,আমার জামা!”
হু হা করে হেসে উঠল তুশি। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,
“ আমার পেছনে লাগা? আমি কি জিনিস তুমি জানো? মজা বোঝো এখন। ”
আইরিন চিড়বিড় করে উঠল। চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ ছোটোলোক, অসভ্য মেয়ে কোথাকার। তোমাকে আমি..”
বলতে বলতে তেড়ে এলোও কয়েক পা।
তক্ষুনি ছুটে এলো এক নিম্নভার স্বর,
“ কী হচ্ছে এখানে?”
তড়িৎ থামল সে। থামল তুশির হাসিটাও। ইয়াসিরকে দেখেই গুটিয়ে গেল একটু।
সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষটা।
আইরিন নালিশ করার একটা জব্বর সুযোগ পেলো। ত্রস্তবেগে গিয়েই থামল ওর সামনে।
কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল,
“ দেখুন না ভাইয়া, এই বস্তির মেয়েটা আমাকে নোংরা জল দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে। আমার জামাকাপড়ের কী অবস্থা করেছে একবার দেখুন।”
ইয়াসির এক পল চেয়েই চোখ সরিয়ে ফেলল। আইরিনের গায়ে টু পিসের গেঞ্জি সেট। ভিজে যাওয়ায় একদম শরীরে সেটে গেছে।
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৪
পরপর ঠান্ডা নজর তাক করে তুশির দিকে ফিরল সে। তড়িৎ মাথা নুইয়ে নিলো মেয়েটা। ভেতর ভেতর শঙ্কা জাগল খুব! শাঁকচূন্নীটা বোধ হয় বদ পুলিশের বোন-টোন হবে। এই রে, পুলিশের বোনের গায়ে নোংরা জল ছেটাল?এ নিয়ে এখন আবার ওকে কোনো শাস্তি না দিলেই হয়!