কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৭ (২)
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
খোলা জানলা গলে এক ঝাঁক সোনালী রোদ এসে মেঝের বুকে বসেছে। সেই আঁচে তপ্ত ঘরদোর। মারবেল ফ্লোরে বুটের খটখটে শব্দ তুলে ইয়াসির সোজা তুশিকে খাটে এনে বসাল। মেয়েটার চোখ জুড়ে তখন অপার বিস্ময়ের মেলা ! ইয়াসিরের ঠান্ডা, নির্লিপ্ত চেহারায় বড়ো আশ্চর্য বনে চেয়ে রইল সে।
তুশি স্বপ্নেও ভাবেনি, মানুষটা ওকে সাহায্য করবে। গভীর সমুদ্রে জেগে ওঠা টুকরো দ্বীপের মতো আশ্রয় হবে এক্ষুনি।
ইয়াসির কোনো কথা বলল না। একটা প্রশ্নও করল না ওকে। বিদীর্ণ নীরবতার ঝুলি ভেঙে ড্রয়ার খুলল টেবিলের। সাদা ফাস্ট-এইড বাক্সটা নিয়ে ফের বসল সামনে। তুশির রক্তে ভেজা চুলগুলো লেপটে ছিল গালে। কপালের ক্ষত অর্ধেক ঢেকে গেছে তাতে।
ইয়াসির সময় নিলো। যেন ভাবল কিছু। পরপরই নিসঙ্কোচ আঙুলগুলো চালিয়ে চুল নিয়ে গুঁজে দিলো কানে। সঙ্গে সঙ্গে তুশির বুকের ভেতর কিছু একটা দুম করে লাগল। কোনো হাতুড়ির ঘা,কিংবা কুঠারের কোপ? হবে কিছু একটা।
ইয়াসির তুলোয় অ্যান্টিসেপ্টিক লাগিয়ে চেপে ধরল ক্ষততে। মেয়েটা সামান্য নড়ে উঠল ব্যথায়। অথচ টাঁ-টু শব্দ নেই। মূক দৃষ্টি অচল তার। অচল জিভের ডগা।
ইয়াসির নিঃশব্দ,নিশ্চুপ। ভীষণ স্বাভাবিক তার চেহারা। রক্তাক্ত কাউকে সাহায্য করা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়! কিন্তু খুব কাছাকাছি বসে থাকা মনোযোগী, নিঁখুত,আর অদ্ভুত যত্নশীল মানুষটাতে জাগতিক সমস্ত নিবেশন ঢেলে দিলো তুশি। এতটা মুখোমুখি, কাছাকাছি বসে ইয়াসিরকে আরো ভালো করে দেখল সে। তীক্ষ্ণ গড়নের মাঝে দুটো চিকণ চোখ। আহামরি দৃঢ় চোয়াল। স্থূল ভ্রুয়ের সাথে সোজা,ধারালো নাকের ডগা। নিটোল ওষ্ঠপুট ঈষৎ লাল,সামান্য উঁচু-নিচু। ঠিক নিচের ঠোঁটের ডান দিকে,ছোট্ট একটা তিল।
তুশির নজর বিঁধল ইয়াসিরের চোখের দিকে। খুব গভীর আর রহস্যময় ওরা। অন্ধকার রাতের মতো কালো দুটো মণি। বাঁকা,কালো পাপড়িগুলো কেমন আশ্চর্য রকম আকর্ষণীয়।
হঠাৎ চোখ তুলল ইয়াসির। ঠাড় চাউনিতে তুশি থতমত খেল। নজর সরাল এদিক-সেদিক। ইয়াসির ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করল। তার স্পর্শে সুরক্ষা ব্যতীত ভিন্ন কিছু নেই।
খুব সাবলীল শুধাল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ব্যথা করছে?”
” দুপাশে মাথা নাড়ল তুশি। বোঝাল,করছে।
” করারই কথা! তোমার জায়গায় ইউশা হলে এতক্ষণে দুবার সেন্সলেস হয়ে যেতো।”
তুশি চুপ। ইয়াসিরের নজর পড়ল ওর পায়ের দিকে। ফরসা গোড়ালি ফুলে একাকার। সেখানে নিজের ঠান্ডা হাত ছোঁয়াতেই ছিটকে উঠল মেয়েটা। ইয়াসির ওর মুখের দিকে ফিরল। চোখমুখ কুঁচকে বসা তুশি প্রমাণ দিলো,কী সাংঘাতিক লেগেছে পায়ে! শ্বাস ফেলল ইয়াসির। ফোন বের করে কল করল কাউকে।
তুশির হঠাৎ গা গুলিয়ে এলো। টের পেলো কান,মাথা,চোখ সব ঝাপ্সা হয়ে এসছে। ঠোঁট নেড়ে বলল,
” একটু পানি খাব।”
সহসা উঠে এলো ইয়াসির। জগ থেকে পানি ঢালল গ্লাসে। তুশি আধশোয়া বসে। ইয়াসির গ্লাস এগিয়ে দিলে, কাঁপা হাতটা বাড়াল সে। শীর্ণ আঙুলের ঠকঠকানি দেখে ভ্রু বাঁকায় মানুষটা। গ্লাস ধরার আগেই,ঢলে পড়তে গেল তুশি। হতবুদ্ধি ইয়াসির, ঝট করে এক হাত দিয়ে ধরে ফেলল ওকে। একটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো তুলতুলে শরীর এসে মিশল তার বুকের ভেতর। ঠিক বক্ষভাগের মাঝখানে মাথা ঠেসে পড়ে রইল তুশি।
ইয়াসির চমকে গেছে । অবাক হয়েছে। পরপরইগাল চাপড়ে ডাকল,
“ এই চোর,এই মেয়ে?”
তুশির জবাব নেই। নেতিয়ে পড়া ঘাড় দেখে জ্ঞান হারিয়েছে বুঝল ইয়াসির। তারশক্তপোক্ত চেহারায় উদ্বেগ এলো কিছু। অস্থির চিত্তে আশেপাশে চাইল একবার। সেসময় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আইরিন। মুখ জুড়ে আমাবস্যা তার। বিমর্ষ চোখে চেয়ে রইল ইয়াসিরের বুকে থাকা তুশির দিকে। ওকে দেখতেই প্রশ্ন ছুড়ল মানুষটা,
“ ও ছোটো মায়ের ঘরে কী করছিল?”
আইরিনের বুক ধড়ফড় করে উঠল। হঠাৎ প্রশ্নবানে ভড়কাল আরও। ঢোক গিলে বলল,
“ আমি মানে,আমি জানি না।”
ইয়াসির দ্বিতীয় কিছু বলল না। বুক থেকে সরিয়ে তুশিকে শুইয়ে দিলো বালিশে। আইরিনের গা জ্বলে গেল তাতে। একে, পরিকল্পনা পণ্ড হওয়া,তারওপর এসব! ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ বুকে ঠেসে দাঁত কিড়মিড় করে চলে গেল সে।
ইয়াসির ডাক্তার ডেকে এনেছে। মাঝবয়সি মহিলা তিনি। তনিমার খুব ভালো বন্ধু! দুজন একই কলেজে পড়তেন। ভদ্রমহিলা ততক্ষণে স্কুল থেকে ফিরেছেন । তুশির জ্ঞান আসেনি এখনো। মেয়েটার অবস্থা দেখেই,তনিমা খুব উদ্বীগ্ন হয়ে পড়লেন। গায়ে হাত রাখতেই আঁতকে উঠলেন পরের দফায়। তুশির জ্বর উঠেছে। পুড়ে যাচ্ছে শরীর। ঘরে তখন চারজন মোট।
ইয়াসির এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তনিমা তুশির মাথার কাছে বসেছেন। ভদ্রমহিলা নিজের মতো পরীক্ষা করলেন পা-টাকে। বললেন,
“ আমার মনে হচ্ছে ফ্রাকচার হয়নি। অন্তত গোড়ালির ফোলাভাব দেখে যা বুঝতে পারছি আর কী! আজকের দিনটা দেখ,পেইন কিলার খেয়ে ব্যথা কমে কিনা! না কমলে একটা এক্সরে করাতে হবে। আর মাথার কাটা দাগ অত গভীর নয়। সেলাইয়ের দরকার হবে না। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি,সময় মতো খাওয়ালেই হবে।”
তনিমা বললেন,
“ কিন্তু অনেক রক্ত বের হয়েছে তো। জামাকাপড়ের কী অবস্থা দেখেছিস!”
” সমস্যা নেই । মাঝেমধ্যে অল্প কাটলেও রক্ত বেশি আসে। চিন্তা করিস না। তবে হ্যাঁ,মেয়েটার চোখমুখ দেখে আমার বেশ দূর্বল মনে হচ্ছে। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করে না? কী ইয়াসির,স্ত্রীর দিকে খেয়াল-টেয়াল রাখো?”
তনিমার মুখ শুকিয়ে গেল। বিয়ের সময় ফারজানা লণ্ডনে ছিলেন। তাই ঘটনার আদ্যপ্রান্ত কিচ্ছু জানে না। তুশিকে ইয়াসিরের ঘরে দেখে বউ ভেবে নিয়েছেন তিনি। অবশ্য ভুল তো কিছু ভাবেননি। তুশি তো ওর স্ত্রীই। কিন্তু ছেলেটা যে ওকে বউয়ের চোখে দেখে না।
কথাটায় আবার কিছু বলে না বসে! শঙ্কিত নয়ন ঘুরিয়ে ছেলেকে এক পল দেখলেন তিনি। অথচ ইয়াসির কিছু বলল না। দুহাত বুকে গুঁজে চুপ করে রইল।
তুশি নড়ে উঠল হঠাৎ। একটু একটু করে আলাদা হলো চোখের দীঘল-কালো পাপড়িগুলো। অস্ফুট গোঙানি শুনে তনিমা খুব ব্যতিব্যস্ত হলেন। চুলে হাত বুলিয়ে ডাকলেন,
” তুশি,তুশি?”
মেয়েটা নিভু চোখে চাইল। ফারজানা প্রশ্ন করলেন সাথে সাথে,
“ এখন কেমন লাগছে তোমার?”
গলার স্থেটোস্কোপ আর চেহারার অভিব্যক্তিতে তুশি বুঝল ইনি ডাক্তার। ঠোঁট নাড়ল দূর্বলের মতো,
“ মাথা ঘুরছে।”
ভদ্রমহিলা কিছু একটা ভাবলেন। শুধালেন পরপরই,
“ বমি পাচ্ছে?”
লাস্ট সাইকেল মিস করেছিলে কবে?”
ইয়াসিরের কপাল বেঁকে গেল। তনিমা জিভ কাটলেন আলগোছে। এই রে! ফারজানা কতদূর চলে গেছে! মিনমিন করে বললেন,
” আরে,ওসব কোনো ব্যাপার নয়।”
ভদ্রমহিলা হাসলেন,
“ পেশেন্টের মুখ থেকেই শুনি না। তুমি বলো তো মামুনি!”
তুশি শেষেরটুকু বোঝেনি। নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল,
“ আমার তো সাইকেল নেই।”
ভদ্রমহিলা ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। তাকালেন হতভম্ব চোখে। তনিমা হতাশ চিত্তে মাথা নোয়ালেন হাতের ওপর।
ইয়াসির মুখ খুলল এতক্ষণে। খুব ধীর অথচ গম্ভীর শোনাল কথাগুলো,
” এরকম কিছু নয়। আপনি এসব প্রশ্ন বাদ দিয়ে চেক-আপ করুন।”
ফারজানা, তনিমার দিকে চাইলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সামান্য হাসলেন রমণী। বললেন,
” না মানে,বিয়ের তো এক মাসও হয়নি। তার আরকি!”
” ওহ,আচ্ছা। ঠিক আছে, আমি তো পেইন কিলার দিয়েছি। এখন ব্যথার ওপর ডিপেন্ডেড সবকিছু। অনেক সময় ফোলা ভাব বেশি হলে সারতে সপ্তাহখানেক লাগে। তবে ব্যথা বাড়তে থাকলে অবশ্যই হাসপাতালে আসিস। এক্সরে করে দেখব। আর ব্যথার জন্যে জ্বর এসেছে,ওষুধ খেলে কমে যাবে। এখন তাহলে আসি?”
ঘাড় নাড়লেন তনিমা। ফারজানা চারকোণা কালো ব্যাগটা তুলে উঠে দাঁড়ালেন। মুচকি হেসে বললেন,
“ ছেলের বউ কিন্তু খুব সুন্দর হয়েছে তনি। ইয়াসিরও দেখতে ভালো। নাতি-নাতনির রূপে তো তুই ঝলসে যাবি রে।”
ইয়াসির চ সূচক শব্দ করল। মহাবিরক্ত হয়ে শ্বাস ফেলল চোখ বুজে। তনিমা খুব অসহায় চিত্তে হাসলেন। উত্তরে কী বলবেন,বুঝতে পারছেন না। ফারজানা আরো কিছু বলতে চাইলেন হয়ত। তবে প্রসঙ্গ কাটাতে ইয়াসির এগিয়ে এলো। হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলল,
“ আপনি আসুন আমার সাথে।”
ওরা যেতেই তুশি বলল,
” কোন সাইকেলের কথা বলল, বলুন তো!”
তনিমা অস্বস্তি গিলে বললেন,
” ওসব বুঝতে হবে না। তুমি বলো তো,তোমার শরীর দূর্বল কেন? খাও না ঠিক করে?”
” খাই তো। একটু চিন্তায় আছি, তাই হয়ত।”
“ এত কীসের চিন্তা তোমার? কবে বাড়ি যাবে ভাবছো?”
মুখ কালো করে মাথা নাড়ল তুশি। তনিমা গাল ছুঁয়ে বললেন,
” নিশ্চয়ই যাবে। ওসব নিয়ে ভেবো না। ইয়াসিরের রাগ পড়লেই দেখবে ও তোমাকে নিয়ে যাবে।”
এমনি সময় ইয়াসিরের কথায় ভেংচি কাটা তুশি, আজ আর যুক্তিতর্কে গেল না। বসে রইল চুপ করে। তনিমা নরম গলায় শুধালেন,
” ছোটোর ঘরে গিয়েছিলে কেন? তাও আবার ওয়াশরুমে!” ও বলল,
“ পরিষ্কার করতে।”
অবাক হলেন তিনি,” পরিষ্কার করতে! কে বলেছে পরিষ্কারের কথা?”
তুশির জবাব চটপট,”উনিই বলে গেছেন,আমাকে দিয়ে ধুয়ে রাখতে।”
ইয়াসির ঘরে ঢুকেছে তখনই। শেষ কথা কানে এলো তার। প্রশ্ন করল সাথে সাথে,
” কথাটা কি তোমাকে আইরিন বলেছে?”
তুশি ফিরে চাইল তড়িৎ বেগে। ওপর-নিচে মাথা নেড়ে বলল,
“ মেঝেটা খুব পিচ্ছিল! পা রাখতে গেলাম,আর অমনি ফসকে গেল। এত ব্যথা পেয়েছি!”
ইয়াসির এসব শুনল না। চ্যাঁচিয়ে উঠল আচমকা,
“ আইরিন,আইরিন!”
অমন দরাজ স্বরে ঘাবড়ে গেল তুশি। তনিমা মিইয়ে এলেন আশঙ্কায়। আস্তে করে বললেন,
” থাক ইয়াসির, ছেড়ে দে। কিছু বলিস না।”
ইয়াসির শুনবে কিনা বোঝা গেল না। তার চৌকশ চোয়ালের দৃঢ়তায় দ্বিধায় ভুগল তুশি। আইরিন ঘরে গিয়ে গুম মেরে বসেছিল। হঠাৎ ডাকে ছুটে এলো মিনিটে।
” জি ভাইয়া,ডাকছিলেন?”
” ছোটো মা তোমাকে বলেছে,ওকে দিয়ে ওয়াশরুম ক্লিন করানোর কথা?”
আইরিন ঘাবড়ে গেল। ফ্যাকাশে হলো মুখখানা। হ্যাঁ, না যাই বলবে তাতেই বিপদ। তাও মাথা নাড়ল কোনোরকম।
ইয়াসির ভ্রু উঁচাল,
“তাই? ফোন করে দেখব ছোটো মাকে?”
আইরিন ঢোক গিলল।
তার অগোছালো চাউনি আর ঘনঘন জিভে ঠোঁট চোবানোর দশা,সূক্ষ্ম চোখে মাপল ইয়াসির। পুরু কণ্ঠে বলল,
” মিথ্যে বলেছিলে,তাই তো?”
আইরিন চুপ। কাঁপছে সে।
” ফ্লোরে কী মেখেছিলে?”
উত্তর এলো না। ইয়াসির চিৎকার করে উঠল,
” কী মেখেছিলে?”
মেঘের মতো গর্জন শুনে কেঁপে উঠল আইরিন। হড়বড়িয়ে বলল,
” সা সাবান। সাবান।”
তুশির ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেল। সাবান মাখা ছিল মেঝেতে? সেজন্যেই অমন করে আছাড় খেল ও? তনিমা স্তম্ভিত হয়ে বললেন,
“ আইরিন! তুমি ওয়াশরুমে সাবান মেখে এসেছিলে? তুশিকে ফেলার জন্যে? কী আশ্চর্য, কেন করেছ এমন!”
আইরিন নিরুত্তর। ভয়ডরে জবুথবু। চোখের কোণ তুলে বুঝতে চাইল ইয়াসিরের অভিব্যক্তি।
খুব ঠান্ডা চোখে চেয়ে সে। এমন নিষ্পৃহতা দেখে দ্বিগুণ শঙ্কায় চুপসে এলো মেয়েটা। ইয়াসির শান্ত,অথচ কড়া গলায় বলল,
“ আমি মেয়েদের গায়ে হাত দিই না। নাহলে এক থাপ্পড়ে তোমার গাল থেকে মাড়ি আলাদা করে ফেলতাম।”
আইরিনের কান্না পেয়ে গেল। একটা সামান্য কাজের মেয়ের জন্যে ইয়াসির ভাই এভাবে বলতে পারলেন? ও আবার বলল,
” নিশ্চয়ই ওইদিনের প্রতিশোধ নিতে এটা করেছিলে? তুমি নিজে বুঝতে পারছো তুমি কী করেছ? তোমার জন্যে একটা মেয়ের মাথা ফেটেছে,পা মচকেছে। ভেঙেও যেতে পারতো। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি তোমাকে ঘাড় ধরে বাড়ির বাইরে ফেলে আসি। শুধুমাত্র ফুপির জন্যে করলাম না। কিন্তু পরেরবার এমন কিছু করতে যেও না, আইরিন। আমার দ্বিতীয় রূপ দেখবে তখন। দিস ইজ ইয়র লাস্ট ওয়ার্নিং!”
“ আমি মানে আমি..”
কষে ধমক ছুড়ল ইয়াসির,
” চুপ। আমার সামনে থেকে যাও। কী হোলো? যাও।”
অপমানে জর্জরিত আইরিন প্রত্যুত্তরে গেল না। টলমল চোখে একবার তুশির দিকে চাইল। পৃথিবীর সবটুকু উষ্ণতা অক্ষিকূটে এসে ভিড়ল অমনি। দাঁত পিষে ভাবল,
” তোমার জন্যে আজ আমাকে এত্তগুলো কথা শুনতে হোলো। এত অপমান,এত অপমান আমি ভুলব না তুশি। এর দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেবো, আই সোয়্যার এর দ্বিগুণ পাবে তুমি।”
তনিমার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। খুব আক্ষেপ করে বললেন,
” আইরিনটা এমন কী করে হোলো বল তো সার্থ? ও তো এমন ছিল না। হঠাৎ তুশির পেছনে পড়ল কেন এভাবে?”
তুশি নিজেই বিভ্রান্ত। জ্বর,ব্যথা সব ভুলে গেছে বিস্ময়ের তোড়ে। আইরিনের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছিল, যে এমন করতে হবে!
মেয়েটা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। চোখ দুটো ঘুরে আসে ইয়াসিরের ওপর। মনে পড়ে ওকে কোলে নেয়ার দৃশ্য। মাথায় ওষুধ লাগানোর চিত্রপট। সেই পকেটমার,ছেলেদের হাবভাবে ঘুরে বেড়ানো তুশি কি লজ্জা পেলো? ওসব স্পষ্ট না হলেও,ইয়াসির তাকাতেই চট করে নজর নামিয়ে আনল সে।
তনিমা উশখুশ করছেন কিছু বলতে। ইয়াসির কাবার্ডে হাত দিয়েছে। কালকের ফাইলটা ভুলে রেখে গিয়েছিল। ওটা নিতে এসেই ঘটে গেল এসব! ভদ্রমহিলা ছেলেকে দেখলেন কিছু পল। রয়েসয়ে বললেন,
” বলছিলাম কী সার্থ,তুশি তো অসুস্থ। আবার পায়েও ব্যথা। এই সময় ওপর নিচ টানাহেঁচড়া না করে তোর ঘরেই বরং থাকুক!”
ঝট করে ফিরল ইয়াসির। ভীষণ তাজ্জব হয়ে বলল
“ আমার ঘরে কেন থাকবে? এটা কি হাসপাতাল নাকি!”
চাউনি আর কথায় তনিমা গুলিয়ে ফেললেন সব।
” না মানে,অসুস্থ দেখে বললাম। স্টোর রুমে তো থাকার পরিবেশ নেই। না আছে একটা খাট,না কিছু। সুস্থ মানুষই থাকতে পারে না,ঠিক করে। সেখানে ও…”
ইয়াসির একটু চুপ থেকে বলল,
” সে ব্যবস্থা আমি করছি। কিন্তু এই চোরের জায়গা আমার ঘরে নেই।”
তুশির নাকের ডগা ফুলল এতক্ষণে। আবার চোর চোর করছে? ব্যাটা তোর ঘরে থাকতে চায় কে!
তনিমা হতাশ হলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এক চোট। ভেবেছিলেন,এই সুযোগে তুশিকে রেখে যাবেন এ ঘরে। দুটোতে একই কামরায় থাকলে,নিশ্চয়ই মন বিনিময় হোতো! মুখ ভার করে বললেন,
“ থাক। তোর তাহলে কিছু করতে হবে না। একটু কষ্ট করে নামো তো তুশি,আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
তুশির এই বিষয়ে মাথা ব্যথা নেই। শরীরের নিস্তেজ হয়ে আসা টের পাচ্ছে সে। মাথা টনটন করছে ব্যথায়। নিশ্চুপ মেয়েটা দূর্বল দেহটা নিয়ে নামতে যায়। ফ্লোরে এক পা ছোঁয়াতেই, মাথা চক্কর কাটে। ফের পড়তে গেলে ধড়ফড়িয়ে এসে ধরল ইয়াসির। আবার সেই ঘনিষ্ঠ হলো দুজন।
তুশি থমকাল,তাকাল চোখ তুলে। সন্ধি হলো এক জোড়া নিষ্প্রাণ চাউনির সাথে। ইয়াসির ফোস করে শ্বাস ঝাড়ল। বুঝল,সে ছাড়া হবে না। তারপর একটু আগের মতোই চট করে কোলে তুলল আবার।
তুশি নির্বাক চোখে চেয়ে। ইয়াসির হঠাৎ এমন করে ছোঁয়াতে কোথাও কিছু হচ্ছে কীনা কে জানে! তবে বকবক করা মেয়েটার কথার বানে বাধ পড়েছে আজ। এই যে তুশি বাকবিতণ্ডায় যাচ্ছে না। টু শব্দ করছে না।
শুধু চুপটি করে বিস্ময়াভিভূতের মতো ইয়াসিরের দিকে চেয়ে আছে। মানুষটা সোজা বেরিয়ে এলো। পিছু পিছু এলেন তনিমাও। তার ঠোঁটে চাপা হাসি। মন তো বলছে,এরা একদিন এক হবে। কিন্তু সেই দিনটা কবে আসবে সেটাই জানা নেই।
ইয়াসির, তুশিকে নিয়ে ইউশার ঘরে ঢুকেছে। সেই একইরকম খাটে বসিয়ে ফিরতেই, তনিমা বললেন,
“ এখানে আনলি যে!”
“ থাকুক।”
চলেই যাচ্ছিল সে। দরজা অবধি গিয়ে ফিরল আবার। বলল,
“ মতিকে দিয়ে ওষুধ আনিও। পড়াশোনা জানে না। ভুলভাল খেয়ে ফেলবে। ইউশাকে বলবে দেখেশুনে খাওয়াতে।আর এই মুহুর্তে একে দিয়ে কাজ করানোর দরকার নেই। ”
ইয়াসির বেরিয়ে গেল। কোথাও তার টিকিটাও নেই। অথচ চেয়ে রইল তুশি। যতদূর চোখ যায়,দেখল সে। পরপরই হুশ পেয়ে সরাল নজর। মাথা রাখল বালিশে। তনিমা গায়ে কাঁথা টেনে দিলেন। চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,
“ তুমি বিশ্রাম নাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি। কেমন?”
বিকেল নাগাদ এক ভ্যান ভরতি করে কিছু মালপত্র এলো সৈয়দ ভবনের দোরগোড়ায়। শওকত বাড়ি ফিরেছেন মাত্রই। এত ফার্নিচার দেখে কিছু বিভ্রান্ত হলেন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখলেন,তনিমা নিজ দায়িত্বে লোক দিয়ে সেসব স্টোর রুমে ঢোকাচ্ছে। প্রশ্ন ছুড়লেন তিনি,
“ কী এসব? কে পাঠাল?”
তনিমার মুখ হাসিহাসি খুব! বললেন,
“ সার্থ পাঠিয়েছে। তুশির ঘরের জন্যে।” অমনিচেহারা টানটান করে ফেললেন শওকত। কৌতূহল মিলিয়ে মুখায়বে বিরক্তি এসে ভিড়ল। অতীষ্ঠ আওড়ালেন,
“ আদিখ্যেতা। বউ মানে না,আবার তার জন্যে জিনিসপত্র কেনে। পুলিশে চাকরি না করে রাজনীতি করলেই পারতো। যত্তসব!”
অহেতুক চোটপাট করে চলে গেলেন তিনি। তনিমা মাথা নাড়লেন দুপাশে। কেন যে সবাই এত রুষ্ট মেয়েটার প্রতি! মানুষ হয়ে মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করলে কী এমন হয়?
তুশির ঘরের জন্যে একটা খাট,একটা ছোটোখাটো ওয়ারড্রব,আর একটা টেবিল কিনেছে ইয়াসির। লোকজন এসে সেসব ঠিকঠাক করিয়ে দিলো। রেশমীকে সাথে নিয়ে ঘরটা নতুন করে ঝাড়মোছ করালেন তনিমা। ময়লার আস্তরণে জমে থাকা রুম বসবাসের দারুণ জায়গা হোলো নিমিষে। তুশি এখন ঘরেই। ইউশা আর তনিমা দুজন ধরে ধরে খুব সাবধানে নামিয়েছে মেয়েটাকে।
ঘরের চেহারা দেখে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠেছে তার। ততোধিক অবাক হোলো এসব ইয়াসিরের কিনে দেয়া শুনে। তার ঐ হতবাক দৃষ্টি হয়ত বুঝে ফেলল ইউশা। মাথা ঝঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,
“ দেখলে? ভাইয়া তোমার জন্যে আনিয়েছে। আমার কী মনে হয় জানো? ভাইয়ার এখন তোমাকে নিয়ে সামথিং সামথিং হয়।”
” সামথিং সামথিং কী?”
ইউশা ফিসফিস করল,
” অয়ন ভাইয়ের জন্যে আমার মাঝে যেটা হয়? সেটা।”
তুশি ফোস করে শ্বাস ফেলল। তার নীরস মুখ দেখে ইউশা বলল,
” মাথা ব্যথা করছে?”
” না,একটু পায়ে…”
ও কথা কেড়ে নিলো,
” পা ব্যথা? আচ্ছা দাঁড়াও,আমি একটু তেল গরম করে আনি। মালিশ করে দিলে আরাম পাবে। এরপর তোমার ওষুধও আছে।”
তুশিকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না। দুরন্ত পায়ে ছুটে গেল মেয়েটা।
কক্ষের ছোট্ট জানলা ছাপিয়ে বাইরে চাইল তুশি। অন্ধকার চেপে বসা আকাশে দাদির মুখটা ভেসে উঠল হঠাৎ। মেয়েটার বুক হুহু করে অমনি। কতদিন দাদিকে দেখে না! দাদির হাতে খায় না। এই যে আজ ওর মাথা ফেটে গেল, দাদি থাকলে কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিতো নিশ্চয়ই?
তুশি উদাস চিত্তে হাসল। ও কখনো কাঁদে না। যত ঝড় আসুক,বিপদ হোক তুশি আর পাঁচটা মেয়ের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে চোখের জল ফেলেনি। মন খারাপ হয়েছে,মাথা বিগড়ে গেছে,কিন্তু নাকের জলে চোখের জলে হয়নি। তুশি শেষ কেঁদেছিল ছোটোবেলায়। যেদিন স্কুল থেকে ওর নাম কাটিয়ে দিলো দাদি। তারপর থেকে তুশি খুব শক্ত একটা পাথর হোলো। গায়ে যতই ঠোকা লাগুক,চোখে জল আর আসে না।
অয়ন বাড়ি ফিরল সবে। ঘেমে-নেয়ে ক্লান্ত সে। কনুইয়ের ভাঁজে সফেদ এপ্রোন ঝুলিয়ে চৌকাঠ মাড়াতেই,সামনে পড়ল ইউশা। ওড়না দিয়ে গরম তেলের বাটি ধরে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। সঙ্গে সঙ্গে ডাকল সে,
“ ইউশা!”
বসার ঘর ফাঁকা তখন। অয়নের ভরাট,জমাট স্বর নিস্তব্ধতায় প্রতিধ্বনি হোলো। চমকে ফিরল মেয়েটা। পুরুষালি প্রিয় মুখটা দেখেই হাসি ফুটল ঠোঁটে।
” ওহ তুমি! কখন এলে?”
“ এসেছি দু ঘন্টা হবে। এতক্ষণ বসে বসে ঘুমোচ্ছিলাম। দেখিসনি?”
ইউশা ঠোঁট উল্টাল,
“ এভাবে বোলছো কেন?”
“ হাতে কী?”
“ গরম তেল।”
“ কেন?”
“ তুশির পা মচকে গেছে। মালিশ করে দেবো।”
অয়নের কপালে ভাঁজ পড়ল। চাইছিল,জিজ্ঞেস করবে না। মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো তাও,
“ কী করে হয়েছে?”
ইউশার কণ্ঠে উদ্বেগ,
“ ওয়াশরুমে পা পিছলে পড়ে গেছে৷ মাথাও ফেটেছে জানো।”
অয়ন নিচের ঠোঁট কামড়াল। একবার ভাবল,পড়লে পড়েছে। ওর কী?
পরেরবার ভাবল,ও তো ডাক্তার। শিশুবিদ হোক, যাই হোক ডাক্তার তো! মনুষ্যত্বের খাতিরেও একবার কি দেখে আসা উচিত নয়?
ছোটো করে বলল,
“ দেখি, চল।”
ইউশা খুশি হয়ে গেল। সদ্য ফোটা কামিনীর মতো নিষ্কলুষ হাসল সে। অয়ন সামনে হেঁটে যায়। আর মানুষটার চওড়া পিঠ দেখে দেখে পা বাড়ায় সে।
তুশির ব্যথা না কমলেও,মনে আনন্দ। নরম খাটে কোমল গদি,জামাকাপড় রাখার জায়গা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরে সব আছে এখন। খাটের শক্ত কাঠে পিঠ মিলিয়ে বসে,চারপাশ দেখছিল সে। এর মাঝেই ঢুকল অয়ন।
এক টুকরো সাদা আলোতে ফরসা মেয়েটার ওপর সরাসরি নজর পড়ল তার। বুকের কোথাও একটা বিদ্যুৎ স্ফুরণ হোলো। এ যেন তীব্র শব্দে আছড়ে পড়া বাজ। খুব অস্থিরতা জেঁকে বসল ঘাড়ে৷
ইউশা বলল,
“ তুশি,ভাইয়া এসেছেন তোমাকে দেখতে।”
তুশি ফিরল এদিকে। অয়নকে দেখেই ঝলমল করে উঠল। ব্যস্ত হয়ে বলতে গেল,
“ ভেতরে আ..।”
অথচ শরীরটা নাড়াতেই ব্যথা পেলো ফের। ছোট্ট একটু নিনাদ বেরিয়ে এলো ঠোঁটফুড়ে৷
অয়ন লম্বা পায়ে এগিয়ে এলো অমনি। দাঁড়াল ঠিক মুখোমুখি। তুশির চোখের দিকে না চেয়ে, সোজা পায়ে ফেলল নজর।
“ বেশ ফুলেছে। ডাক্তার দেখিয়েছিল?”
“ হ্যাঁ, ফারজানা আন্টি এসেছিলেন। পেইন কিলার দিলো। এরপরেও ব্যথা বাড়লে এক্সরে।”
“ ওষুধ খাইয়েছিস?”
“ হ্যাঁ।”
অয়ন কপালের দিক চাইল এবার। ব্যান্ডেজ দেখে বলল,
“ তুই ব্যান্ডেজ করেছিস?”
“ না, আমি তো ক্লাসে ছিলাম।”
“ প্রেসক্রিপশন কোথায়?”
মাঝখানে তুশি বলল,
“ আপনি দাঁড়িয়ে কেন,বসুন না!”
এত ভালো কথাতেও চটে গেল অয়ন। চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ তুমি চুপ করো।”
মেয়েটা হতভম্ব হয়। ঠোঁট উলটে ইউশার পানে চায় এক বার। কী করেছে ও? কাল সেধে কফি খাওয়ানো লোক,অহেতুক এমন ধমকাল কেন?
ইউশার চোখেও প্রশ্ন। অয়ন ভাই তো মেজাজি মানুষ নন। ধমক-টমক ওনার সাথে যায় না। কী হোলো হঠাৎ? কিন্তু ওসব জিজ্ঞেস করতে পারল না। তার দোনামনার মাঝেই শক্ত গলায় শুধাল অয়ন,
“ প্রেসক্রিপশান কোথায়?”
ইউশা চোখ দিয়ে দেখাল,ওইতো টেবিলে। অয়ন গিয়ে হাতে তুলল সেটা। হুট করে পাতলা কাগজের ওপর দিয়ে তুশির দিকে চাইল সে। কেন চাইল জানে না! তবে খুব দু সেকেন্ড নিষ্পলক মেয়েটাকে দেখল অয়ন। কোকড়া চুল ছেড়ে রাখা। মাথায় ব্যান্ডেজ। একটা বাচ্চার মতো ঠোঁট উলটে বসে আছে। কী নিষ্পাপ,ললিত সুন্দর মুখ! গোধূলির মতো নির্মল,অথবা বকুলের ন্যায় স্নিগ্ধ! হবে কিছু একটা!
পরপরই সে চোখ সরাল। যেন হুশ এসেছে এক্ষুনি। গলা ঝেড়ে বলল,
“ সব ঠিকঠাক আছে। তাও কোনো সমস্যা হলে আমি আছি, ডাকিস।”
মাথা নাড়ল ইউশা,
“ আচ্ছা। আমি তো আজ রাতে ওর সাথে ঘুমাব। তোমার কিছু লাগলে আমাকে বলবে হ্যাঁ? ফোন করলেও হবে।”
মেয়েটা আশায় ছিল স্বায় দেবে অয়ন। বলবে হয়ত,তোকেই তো ডাকব। তুই ছাড়া কে আছে আমার?
কিন্তু হোলো না এমন। বরং রুক্ষ স্বরে বলল সে,
“ আমার কিছু দরকার নেই।”
তারপর হনহনে পায়ে ঘর ছাড়ল অয়ন। ইউশা আহত হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিড়বিড় করল মনে মনে,
“ তোমার নেই। আমার তো আছে। আর আমার তোমাকেই দরকার অয়ন ভাই। দিয়ে দাও না!”
তুশি হাতটা টানল তখনই। তেল পড়ে যাবে ভেবে,ধড়ফড়িয়ে বাটিটাকে আরো চেপে ধরল ইউশা। ধপ করে বসে পড়ল সামনে। গোল চোখে বলল,
“ কী হয়েছে?”
“ তোমার এই ভাইকে বিটকেলটার ভূতে ধরেছে। আমাকে কীভাবে ধমক দিলে দেখলে? আমি আর কক্ষনো কারো প্রশংসাই করব না।”
“ বাইরে থেকে ফিরেছে তো,বোধ হয় মেজাজ ঠিক নেই। ভাইয়া এমনিতে খুবই নরম মানুষ।”
তারপর চপল পায়ে গিয়ে ঘরের দোর দিলো ইউশা। সামনে এসে ফিসফিস করল,
“ আমি যে অয়ন ভাইকে পছন্দ করি,কাউকে বলোনি তো?”
“ না। কাকে বলব?”
গদগদ হয়ে পড়ল সে,
” থ্যাংক ইউ! বাড়িতে কেউ কিন্তু কিচ্ছু জানে না। আগে অনার্সটা শেষ করি তারপর এ নিয়ে উঠেপড়ে লাগব।”
” আচ্ছা।”
ইউশা ভ্রু গোছায়,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৭
“ তোমার কি হয়েছে বলো তো,আজ কেমন কেমন লাগছে। শরীর বেশি খারাপ বুঝি? কিন্তু জ্বর তো নেমে গেছে। তাহলে?”
তুশি উত্তর দিতে পারল না। ও নিজেই জানে না,ওর কী হয়েছে? শুধু টের পাচ্ছে অন্তঃপুরের কোথাও একটা গোল হয়ে ঘুরছে কিছু। যার অনুভূতি লাভার ন্যায় তপ্ত,আবার হিমের মতো শীতল। কখনো আবার পাথরসম ভারী। কিন্তু কী এটা?