কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৩

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৩
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

তুশির দুষ্টুমির হাসিটা আর নেই। ওটুকু ধীরে ধীরে উবে গেছে হাওয়ায়। ইয়াসিরের কোলে থাকার মাঝে,তার গালের এক পাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শক্তপোক্ত ঐ চিবুক দেখে মেয়েটার দৃষ্টিরা বদলায়। বদলায় তার তাকানোর ভাষা। টানা টানা চোখ মেলে অভিভূতের ন্যায় চেয়ে রইল তুশি। যাতে বিমোহ,মুগ্ধতা আর অদ্ভুত এক সম্মোহ মিশে। মনের মধ্যে তখন অন্য এক ছন্দ! অচেনা এক উল্লাস। যার মানে তুশি জানে না। শুধু মূহুর্তটাকে বুকের এক কোণে রেখে দিতে সামনের পুরুষ পানে সে হাঁ করে রইল। বাতাসের তালে তালে অন্তঃপটে শির তুলল মিতালির নব্য সেই সুর,

“ নিশা লাগিল রে,
বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে।
হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে,
হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রেএএএ,নিশা লাগিল রে। বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে।
হাসন জানের রূপটা দেখি,
ফাল দি ফাল দি ওঠে।
ছিঁড়া-বাড়া হাসন রাজার,বুকের মাঝে ফোটে।
নিশা লাগিল রে,বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে।”
তুশির বিমুগ্ধতায় ডুবে মরার মাঝেই আচমকা কোল থেকে ওকে ছুড়ে ফেলল ইয়াসির। উড়ো পাতার মতো তুলতুলে বিছানার ওপর গিয়ে ছিটকে পড়ল মেয়েটা। হুশ এলো,ফিরল হকচকিয়ে। ইয়াসির বুকের সাথে দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়াল। ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ নিজেকে খুব চালাক ভাবো তাই না!”
তুশির চোখেমুখে বিস্ময়। ভড়কেছে খুব! প্রকট নেত্রে বলল,
“ কী করেছি আমি? এভাবে ফেললেন,কোমরের হাড় নড়ে গেল তো! উফ মা!”
ইয়াসির ধমকে বলল,
“ একদম চুপ। ছিচকে চোর একটা! ভেবেছিলে তোমার অ্যাক্টিং আমি বুঝতে পারিনি? ব্যথা লাগার নাটক হচ্ছিল?”
তুশির মুখ চুপসে গেল। জ্বিভ চলে এলো দাঁতের নিচে। এই রে,বিটকেলটা তার মানে ধরে ফেলেছে? মিনমিন করে বলল,

“ কী বলছেন! আমি কেন নাটক করব? আমার তো সত্যিই ব্যথা লেগেছিল।”
ফের রুক্ষ গলায় ধমকাল ইয়াসির,
“ আই সেইড শাট আপ।”
তুশির রুহু উড়ে গেল। শিরদাঁড়া সোজা হলো মুহূর্তে।
ইয়াসির বলল,
“ নেহাৎ মা তোমায় পছন্দ করেন বলে তখন সবার সামনে কিছু বলিনি। চাইনি ওনার সামনে তুমি ছোটো হও। আচ্ছা,তোমার লজ্জা করে না এসব করতে? একটু বিবেকেও বাঁধে না?”
তুশির চেহারায় মেঘ। ও কি এসব ইচ্ছে করে করেছে? ঐ পেত্নিটাকে ইয়াসিরের বুক থেকে সরানোর জন্যেইতো!
মাথা নুইয়ে বলল,

“ আর করব না। সরি!”
ইয়াসির ফোস করে শ্বাস ফেলল। বলল,
“ সেটা তোমার জন্যেই ভালো হবে। আর ভুলবশত যদি করেও ফেলো,আমি তো আছি। ভবিষ্যতে কখনো যদি দেখেছি কোনো কিছু নিয়ে কারো ইমোশন কে কাজে লাগিয়ে এভাবে মিথ্যে বলেছ,একেবারে কানের নিচে মারব। ইয়াসির আবরারের মার তো খাওনি এখনো, একবার খেলে সারাজীবন মনে থাকবে।”
তুশির বুক লাফাচ্ছে। ধড়ফড় ধড়ফড় করছে কেমন । চোখের সামনে ভেসে উঠছে অতীতের সেই দৃশ্য। রুস্তমের ছেলে রুহানের পেটের তলায় হাঁটু দিয়ে একের পর এক প্রহারগুলো ভাবতেই ওর মাথা চক্কর দিলো। হড়বড়িয়ে বলল,

“ না না আর করব না তো। বললাম তো করব না। তাও এমন ভয় দেখাচ্ছেন কেন?”
ইয়াসির আর কিছু বলল না। ঘুরে যেতে নিলেই,আচমকা ডেকে উঠল ও।
“ শুনুন সার!”
দাঁত চেপে পিছু ফিরল ইয়াসির।
“ কথাটা সার নয়, স্যার। তোমার প্রোনান্সিয়েশন এরকম কেন?”
তুশি ঠোঁট টিপে রইল। তার জিভ নিশপিশ করছে খুব। ইয়াসিরের স্বর ভারি,
“ ডেকেছ কেন?”
“ ইয়ে,বলছিলাম যে,আপনি গিয়ে গোসল করে নিন না!”
ও কপাল কুঁচকে বলল,
“ কেনো?”
তুশির কণ্ঠে উদ্বেগ,

“ ওই পেত… ইয়ে ওই আইরিন আপনাকে জড়িয়ে ধরল যে তখন।”
“ তো?”
“ হু? না মানে ওর গায়ে টিকটিকি ঢুকেছিল। ও আপনাকে ধরল। এখন আপনার গায়েও তো লেগে গেল,তাই। আপনার ভালোর জন্যেই বলছি। টেল ফর ইওওর গুড সার!”
ইয়াসির মুখের ওপর বলল,
“ আমার ভালো তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো। ডাফার!”
মানুষটা বেরিয়ে গেছে। তুশির আমাবস্যায় ছেঁয়ে থাকা মুখশ্রীতে এক পল ফিরেও চায়নি। মেয়েটা বুক ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলল। দুঃখে,শোকে একাকার হওয়া শ্বাস। বিড়বিড় করে বলল,
“ আমি না ভাবলে কে ভাববে?”

পরেরদিন….
সন্ধ্যে থেকে জিভের খসখসে ভাব কমাতে জয়নব পান নিয়ে বসলেন। বয়স বাড়লে মুখে রুচি থাকে না। হাত-পা চলে না। দাঁতেও বিশেষ জোর নেই। ছাচুনিতে পান সুপারি ফেলে জয়নব এক বার স্বামীর ছবিটাকে দেখলেন। পৃথিবীর প্রতি এখন আর ওনার তেমন মায়া নেই। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়েছে,যে যার জীবনে সুখী। এবার দুচোখ বোজা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
জয়নব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এর মাঝেই ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলো আইরিন। উচ্ছ্বল স্বরে ডাকল,
“ নানু!”
বৃদ্ধা মুখ তুলে চাইলেন। দুগাল হেসে ডাকলেন,
“ এসো নানু, ভেতরে এসো।”
আইরিন ঢুকল ঘরে। স্ফূর্ত কদমে নানুর সামনে এসে বসল। জয়নব শুধালেন,
“ বড়ো বউমা হালিম রেধেছে, খেয়েছ?”
“ হ্যাঁ খেয়েই এলাম। তুমি এই ভর সন্ধ্যে বেলা পান নিয়ে বসেছ কেন?”
“ মুখটায় কেমন অরুচি ধরেছে। কিছুই খেতে পারি না। তাই ভাবলাম,জীবনে আছেই এটা, এটাই খাই।”
আইরিন হেসে বলল,

“ মানুষের পান সাজানোর কৌটোও এত সুন্দর হয়,তোমার কাছে না দেখলে বুঝতামই না।”
“ আমার আর কী? এটাতো তোমার নানাভাই…”
আইরিন আটকে দিলো,
“ জানি জানি। নানাভাই আসামে ঘুরতে গিয়ে তোমার জন্যে নিয়ে এসেছিল। এটা আর সাথে একটা বড়ো গয়নার বাক্স৷ তাই তো?”
জয়নব অবাক চোখে বললেন,
“ ওমা,তোমার দেখি সব মনে আছে।”
“ থাকবে না? যখনই রুমে আসি তখনই এই এক গল্প শোনাও। নানাভাই পানের কৌটো দিয়ে বলেছিলেন,জয়া বুড়ো হয়ে এটাতে আমরা একসাথে পান খাব। দেখে ভালো লাগল তাই তোমার জন্য নিয়ে এলাম। তাই তো?”
হেসে ফেললেন জয়নব৷
আইরিন চুপ করে গেল। কিছু একটা ভেবে বলল,

“ আচ্ছা নানু,তুমি না আমাকে তোমার গয়না দেখাতে চেয়েছিলে? এখন দেখাবে?”
জয়নব ভ্রু বাঁকালেন,
“ কী ব্যাপার বলো তো নানু! এমনিতে তো না ডাকলে বুড়ির কাছে আসো না। আজ হঠাৎ নিজে থেকে এলে,আবার গয়নাও দেখতে চাইছ।”
“ তেমন কিছু না। মাম্মা তো সকালের ফ্লাইটে উঠে গেছে। এলেই আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে। এখানে আসতে আসতে আবার এক দু মাস! তাই ভাবলাম তোমার সাথে গল্প করে যাই। আর এখানে আসা থেকে তুমি কতবার বলেছিলে,গয়না দেখাবে। আমিই এটা ওটার ছুতো দিয়ে দেখিনি। তাই আর কি!”
মাথা নাড়লেন জয়নব।
“ আচ্ছা আচ্ছা। তা ভালোই হয়েছে। মরার আগে সবাইকে ভাগ করে দিতে হবে না? দাঁড়াও দেখাই।”
বৃদ্ধা উঠতে নিলেই ও আটকাল।

“ আহা,তুমি উঠছো কেন? চাবি কোথায় আমাকে বলো,আমি নিয়ে আসছি।”
জয়নব প্রসন্ন হেসে বললেন,
“ কত লক্ষ্মী আমার নানু! যাও,ওই ড্রয়ারে চাবি আছে। একদম বড়ো সাইজেরটা দিয়ে খুলবে।”
আইরিন তাজ্জব হয়ে বলল,
“ ওই ড্রয়ারে?
এরকম খোলামেলা জায়গায় কেউ চাবি রাখে নানু? আলমারিতে তোমার কত দামি দামি গয়না! কেউ নিয়ে গেলে?”
“ কে নেবে? নিজেদের বাড়ি,সবাই নিজের মানুষ।”
“ সবাই নিজেদের? রেশমী, তুশি ওরা কি বাড়ির কেউ?”
“ কী যে বলো! রেশমী কত পুরোনো কাজের লোক। কত বছর ধরে আছে এখানে। কোনোদিন একটা জিনিস এদিক থেকে ওদিক করেনি। আর তুশি,ও তো বাড়ির বউ। বাড়ির বউ কি এসব করে?”
আইরিনের শরীরটা জ্বলে গেল। চোখ বুজে সামলাল নিজেকে৷ আলমারিতে হাত দিতে দিতে নরম করল স্বর। বলল,
“ বউ কাকে বলছো? ওকে ভাইয়া বউ মানে নাকি! আর যত যাই হোক,ও কিন্তু একটা চোর নানু। চোরদের স্বভাব কখনো যায় না।”

জয়নব কথা বাড়ালেন না। আইরিন আলমারি খুলে চৌকশ বাক্সটা বের করে আনল। বিছানার ওপর রেখে বলল,
“ অনেক ভারি!”
“ পাথরের তো!”
“ এজন্যেই এত সুন্দর! একদম পুরোনো রাজাদের সিন্দুকের মতো লাগছে। নানাভাইয়ের পছন্দ আছে নানু।”
জয়নব হাসলেন। আইরিনের চেহারায় আজ অন্যরকম দ্যুতি৷ জ্বলজ্বল করছে তারার মতো। এত খুশি কেন কে জানে! জয়নব বাক্স খুললেন। স্বর্ণের তৈরি একেকটা ভারি গহনা দেখেই, আইরিনের মুখ চকচক করে উঠল। নানুর দাদা সে আমলের জমিদার ছিলেন। নানুই তাদের এক মাত্র নাতনি। সেই হিসেবে গয়না এত চোখ ধাঁধানো! ও বলেই ফেলল,
“ বাপরে,এত গয়না!”
জয়নব বললেন,
“ আরও ছিল। দুই ছেলের বউ,তোমার মা সবাইকে দিয়ে দিয়ে এ কটা আছে। এগুলোও সব নাতনি আর নাতবউদের ভাগ করে দিয়ে যাব।”
আইরিনের মুখ ঝলকায়। নাতনির তালিকায় ও আছে। আবার যদি ইয়াসিরের বউ হয়,তাহলে তো ওদিক থেকেও পাবে।
জয়নব বললেন,

“ আমার শাশুড়ী মা বিয়ের সময় আমাকে একটা বড়ো সীতাহার দিয়েছিলেন। আমি ঠিক করেছিলাম,আমার বংশে যে প্রথম নাতি আসবে? তার বউকে সেটা উপহার দেবো। সায়ন দাদুভাই তো নেই। সে হিসেবে এখন সার্থ দাদুভাইয়ের বউই পা….”
বলতে বলতে থামলেন তিনি। ধীর হাতের গতিটা বেড়ে গেল হঠাৎ। বাক্সের সমস্ত গয়নায় এক পল সতর্ক চোখ বোলালেন। আর্তনাদ করে বললেন,
“ এ কী,সীতাহারটা কোথায়?”
আইরিন এটা-ওটা নাড়ছিল। মুখ তুলল চকিতে। জিজ্ঞেস করল,

“ কোনটা? যেটার কথা বললে মাত্র?”
“ হ্যাঁ। এখানেই তো ছিল। নেই কেন?”
“ নেই! সব গয়না ঢেলে দেখো তো।”
অস্থির হাতে বাক্স উল্টে দিলেন জয়নব। সমস্ত গয়না ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখে ছটফট করে উঠলেন,
“ নেই তো। হায় আল্লাহ,কী হলো? কই গেল? কোথায় পড়ল?”
প্রৌঢ়া উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলেন। অত বড়ো হার! বংশের ঐতিহ্য! আইরিন এদিক-সেদিক দেখে বলল,
“ দেখেছ,আমি বলেছিলাম। আরো রাখো এখানে ওখানে চাবি।”
“ কিন্তু…”
“ কীসের কিন্তু। পুরো ঘরটা আগে খুঁজে দেখি দাঁড়াও।”

শওকত অনেক দিন পর নিচে নেমেছেন। শরীর এখন মোটামুটি ভালো। সোফায় পিঠ হেলে বসতেই চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হলো তুশি। ভদ্রলোক চোখ তুলে চাইলেন। হাসলেন ওকে দেখে। জিজ্ঞেস করলেন,
“ তুই বানিয়েছিস?”
তুশি মাথা নাড়ল দুপাশে। সরল স্বীকারোক্তি দিলো,
“ আমি চা বানাতে পারি না।”
শওকত কাপ হাতে নিলেন৷ কণ্ঠে হতাশা,
“ কী পারিস তাহলে?”
“ খেতে পারি। বস্তির টঙে বসে বসে অনেক চা খেতাম। একদিনে চার কাপ চাও খেয়েছি জানেন।” বলেই তুশি গর্বের হাসি হাসল। শওকত মাথা নাড়লেন। বুকে দীর্ঘশ্বাস। বললেন,
“ চা বানানোটা একটু শিখে নিস বুঝলি,মা। আমিও এত চা প্রিয় মানুষ,যখন তখন চাইলেই তনিমা খ্যাক করে ওঠে। তুই বানাতে পারলে, অন্তত এই বাবাটা একটু ঠিকঠাক খেতে পারবে।”
তুশি ফের মাথা নাড়ল। কিছু বলতেই যাচ্ছিল,আচমকা ওপর থেকে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বের হলো আইরিন।
“ বড়ো মামা,বড়ো মামি, ছোটো মামি…. কে কোথায় আছো?”

বাড়িময় তার হাকডাকে তটস্থ হলো সকলে। জয়নবকে ধরে ধরে নামছে আইরিন। গতিবেগ উল্কার ন্যায়। তনিমা,রেহনূমা ছুটে এলেন । ইউশা,মিন্তু ঘর থেকে বের হলো দৌড়ে। বসার ঘরটা নিমিষেই মানুষে ভরে গেল। শওকত বললেন,
“ কী হয়েছে আইরিন!”
জয়নবের অস্থির মুখটা দেখে উদ্বীগ্ন হয়ে পড়লেন তনিমা। কাছে গিয়ে বললেন,
“ এ কী! আম্মা, এমন লাগছে কেন আপনাকে? কিছু হয়েছে?”
আইরিন জয়নবকে চেয়ারে বসাল। বৃদ্ধা ফ্যাসফ্যাসে গলায় জানালেন,
“ সীতাহারটা পাচ্ছি না বউ মা। বাক্সে নেই।”
এক ঘোষণায় আঁতকে উঠল সবাই। রেহনূমার কণ্ঠে আর্তনাদ,
“ কী বলছেন? বাক্সে নেই মানে,কোথায় যাবে? অত বড়ো হার। অত ভরি স্বর্ণ। কোথায় হাওয়া হয়ে গেল?”
অয়ন এলো একটু বাদে। হুলস্থূল গতির ব্রেক কষল ঠিক তুশির পাশে দাঁড়াতেই। ব্যগ্র কণ্ঠে শুধাল,
“ কী ব্যাপার, কী হয়েছে? আইরিন,অমন চ্যাঁচালি কেন?”
উত্তর দিলেন তনিমা,

“ আম্মার গয়নার বাক্স থেকে সীতাহার নাকি গায়েব হয়ে গেছে।”
জয়নব বিচলিত আওড়ালেন,
“ কখনো তো এমন কিছু হয়নি। সব তো ঠিকঠাকই থাকে। আজ হঠাৎ এসব কী করে ঘটল কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
অয়ন বলল,
“ এক মিনিট, এক মিনিট! দিদুনের বাক্স তো আলমারিতে থাকে। আলমারি খুলে হার কে নেবে ? এ বাড়িতে বাইরের কে আছে? একটা আস্ত হার এমনি এমনি বাক্স থেকে উধাও হয়ে গেল,আশ্চর্য!”
আইরিন বলল,
“ আহা ভাইয়া,এত আশ্চর্য হচ্ছো কেন? হার তো আর নিজে নিজে উধাও হয়নি। নিশ্চয়ই কেউ উধাও করেছে।”
বলতে বলতে তার নজর ঘুরে এলো তুশির থেকে। ইউশার চোখে পড়ল সেটা। মেজাজ খারাপ করে বলল,
“ কী বলতে চাইছো তুমি,আপু?”

“ আমি কী বলব? যা বলার সেতো নানুই বলছে। আগে কখনো নানুর হার টার এমন হারিয়েছে? আজকে হারাল। কেন? কার জন্যে? সেটাকি তোমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে ইউশা?”
রেহনূমা মাথা নেড়ে বললেন,
“ আমারো মনে হচ্ছে হার চুরি গেছে। এটাতো অসম্ভব কিছু না,আপা। সাত ভরি স্বর্নের হার! আর আম্মা যেমন চাবি এখানে ওখানে রাখে। মাঝেমধ্যে তো ভুলেও যায় চাবির কথা। কিন্তু কে নেবে হারটা? বাড়িতে তো বাইরের লোক কেউ আসেইনি।”
তুশির চোখ কপালে উঠল। সাত ভরি স্বর্ণ? কিন্তু কে করল এই কাজ? যেখানে স্বয়ং ওর মতো চোর উপস্থিত ,সেখানে নতুন চোরের আমদানি হলো কী করে? ও তো নিজেও এখন আর এসব চুরি-টুরি করে না। শওকত বললেন,
“ কিন্তু তা কী করে হয়? আম্মা সারাক্ষণ ঘরে থাকে। বাইরের লোকজনও খুব একটা বাড়িতে আসেনি। রাতের বেলা যে কেউ এসে চুরি করবে তারও উপায় নেই। এত কড়া সিকিউরিটি থাকে গেইটে।”
আইরিন বলল,

“ মামা, বাইরে থেকে চোর আসবে কেন? চোর তো আমাদের ঘরেই আছে। এই যে,মেহরিন রহমান তুশি! কারওয়ানের নামকরা ছিচকে চোর। ওর কথা সবাই ভুলে গিয়েছ?”
তুশি বিস্ফোরিত চোখে চাইল। অয়ন সাথে সাথে বলল,
“ আইরিন,কী ধরণের কথা এসব?”
“ তাহলে আর কী বলব? ও চোর নয়? নাকি ও কোনোদিন চুরি করেনি? কদিন আগে তুমিও না বললে ভাইয়া,ও তোমারও মানিব্যাগ নিয়ে গেছিল। তবে?”
ইউশা বলল,

“ আইরিন আপু,তুমি থামবে? তুশিকে তুমি পছন্দ করো না বেশ ভালো কথা,তাই বলে বাড়িতে যা ঘটবে তা ওর ওপর চাপিয়ে দেবে কেন?”
“ আমি কেন চাপিয়ে দেবো? যা সত্যিই তাই বললাম। আচ্ছা ছোটো মামি,তুমি অন্তত ভেবে দেখো আমি ঠিক বলছি কিনা। যে মেয়ে রাস্তায় রাস্তায় পকেট কেটে বেড়াত,সে নানুর অমন ভারি সীতাহার দেখলে লোভ সামলাতে পারবে? আর গয়নার বাক্সের মধ্যে তো ওটাই সবচেয়ে দামি হার ছিল তাই না?”
রেহনূমা সহসা সুর পালটে ফেললেন। ঘাড় নেড়ে বললেন,
“তাইত। আপা, ওতো কিছু ভুল বলেনি।”
“ কী বলছিস ছোটো,তোর কি মাথাটা গেছে? তুশি কেন চুরি করবে? ও আমার ছেলের বউ।”
আইরিন বলল,
“ বউ! ও নিজেকে বউ ভাবে? এ মেয়ে একটা বস্তি থেকে উঠে এসেছে। ওসব বস্তির ছোটোলোকরা কি কখনো ভালো হয় নাকি?”
শওকত চাপা কণ্ঠে ধমকালেন,

“ আইরিন, হচ্ছে কী? সম্পর্কে ও তোমার বড়ো ভাইয়ের বউ।”
“ ভাই তো আর মানে না, মামা। তাহলে আমি কেন মানব?”
তুশি হতভম্ব হয়ে সব কথা শুনছিল। গোটা ব্যাপারটা ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ও তো জয়নবের ঘরের চৌকাঠেও আজ অবধি যায়নি। চুরি করবে কখন? জয়নব অধৈর্য হয়ে বললেন,
“ বড়ো বউমা, তোমরা হারটা খোঁজার ব্যবস্থা করো। ওটা আমার শাশুড়ীর স্মৃতি। এত বছর আগলে রাখলাম,এখন না পেলে… “
তনিমা গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ আম্মা, আপনি শান্ত হোন। হার পাওয়া যাবে। আমরা দেখছি, সবাই দেখছি।”
অয়ন বলল,
“ দিদুনের ঘরটা একবার ভালো করে খুঁজে দেখলে হতো না?”
ইউশা সজোরে মাথা ঝাঁকাল। সেও এক মত।
আইরিন বলল,

“ নানুর ঘর আমি দেখেই এসেছি। কোথাও হার নেই৷ আমি বলছি ভাইয়া শোনো,এই হার তুশিই চুরি করেছে।”
তুশি গর্জে উঠল অমনি,
“ পেত্নির বাচ্চা,একদম আমাকে চোর বলবে না। মেরে মুখ ভেঙে দেবো কিন্তু।”
আইরিন হতবাক হয়ে বলল,
“ শুনেছ ছোটো মামি,ভাষা শুনেছ ওর? জংলী কোথাকার! ওই চুরি করেছে আম শিয়র। ওর ঘর তল্লাশি করলেই হার পাওয়া যাবে।”
ইউশা চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ আইরিন আপু তুমি কী শুরু করেছ? তুশি তো সারাদিন নিচেই থাকে। ও কি দিদুনের ঘরে যায়? তাহলে কখন চুরি করবে?”
“ সেটা ওই চোরকেই জিজ্ঞেস করে দ্যাখো,ওই ভালো বলতে পারবে।”
তুশি কটমট করে বলল,

“ ঠিক আছে। তোমার মুখ যখন এত চুলকাচ্ছে,তখন চলো,আমার ঘর দেখে আসবে। কিন্তু যদি হার না পাওয়া যায়,তখন তুশির মারের হাত থেকে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না বলে দিলাম। এমন থাপ্পড় মারব,একেবারে সারাজীবনের মতো কানা হয়ে যাবে।”
তনিমা মৃদূ স্বরে শাসালেন,
“ আহ তুশি, হচ্ছে কী? কী কথা এসব!’’
রেহনূমা বললেন,
“ আপা চলো,ঘরটা দেখে আসি ওর।”
তনিমা জায়গা ছেড়ে নড়লেন না। তুশির ঘর তল্লাশি মানে ওকে অপমান করা। অয়ন দুই গাল ফুলিয়ে বিরক্ত শ্বাস ফেলল। আইরিনের সবেতে বাড়াবাড়ি, সাথে আবার ছোটো মা জুটেছে! আরেহ,মেয়েটা আগে যা ছিল,ছিল। এখন তো পড়াশোনা করছে,আদব কায়দা শিখছে। এখনো ওসব নিয়ে খোঁচা দিতে হবে?
তুশি রেহনূমাকে বলল,
“ আপনি যান। গিয়ে সব ভালো করে দেখে আসুন। আমি তো জানিই কিছু পাওয়া যাবে না। এই পেত্নি শুধু শুধু ইঁদুরের মতো চ্যাঁচাচ্ছে।”
আইরিন ফুঁসে উঠল,

“ মুখ সামলে কথা বলো তুশি।”
রেহনূমা অতীষ্ঠ। বাকিরাও তাই। আইরিনকে থামাতে ওর হাত ধরে টানলেন তিনি,
“ তুমি এসো, আমার সাথে এসো। এসব অশান্তি আর ভালো লাগে না। ওর ঘর দেখে এলেই তো ল্যাটা চুকে যাবে,তাই না। এসো।”
আইরিন সাপের মতো ফোসফোস করতে পা বাড়াল। ভ্রুক্ষেপহীন তুশি ভেংচি কাটল ফের। তনিমা নীরস শ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন দুপাশে। জয়নবের চিন্তিত মুখ শুষ্ক প্রায়। কত পুরোনো হার! কখনো এমন হলো না। কোন শনি যে নামল ঘরে।
ইউশা ঘামছে। আড়চোখে সে তুশির প্রজ্জ্বল মুখখানা দেখল। মেয়েটার হাত সাফাইয়ের সমস্যা আছে সত্যি। কিন্তু, তাই বলে দিদুনের হার তো আর নেবে না। নাকি নিয়েছে?
ও ফিসফিস করে বলল,

“ তুশি, সত্যিই তুমি কিছু করোনি তো?”
তুশি মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল,
“ আরে নাহ। আমি ভালো হয়ে গেছি।”
ইউশা ঘাড় দোলায়। স্বস্তির শ্বাস ফেলে হাসে। নাহ,ওর তাহলে বুঝতে ভুল হয়নি। তারপর কিছু সময় কাটল। ঘরের ইট-কাঠের বাঁকে থমথমে নীরবতা নেমেছে। কারো মুখে কথা নেই। অস্বস্তি আর অপ্রতিভ সকলে। তুশির ঘর তল্লাশির ব্যাপারে তাদের জোরদার আপত্তিটা মুখশ্রীতে স্পষ্ট। ঠিক সেই সময় স্টোর রুম হতে চ্যাঁচিয়ে উঠলেন রেহনূমা,
“ আপায়ায়া….”

নিভন্ত সবাই চমকে উঠল। চকিতে ছুটে গেল একেকজন। তুশির কপালে ভাঁজ বসেছে। ঘরে কি হাতি-ঘোড়া রেখে এসেছিল? এমন চ্যাঁচালো কেন? ইউশার পিছু পিছু চৌকাঠে এসে থামল সেও। দৌড়ে আসা মানুষগুলো দোরগোড়ায় স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে। সকলের থমকে থাকা চাউনি অনুসরণ করে ঘরের ভেতর চাইল তুশি। গোটা আকাশটা মাথার ওপর ভেঙে পড়ল সহসা। বিছানার তোষকের এক কোণা উল্টানো। রেহনূমা পাশেই দাঁড়িয়ে। হাতে ঝুলছে স্বর্ণে বাঁধানো লম্বা সীতাহার। তুশির বক্ষস্থল ছ্যাৎ করে উঠল। মুখের রক্ত শুকিয়ে সাদা হলো নিমিষে।আইরিন বলল,
“ এবার কী বলবে,তুশি? চুরি না করলে হার তোমার বিছানার নিচে এলো কী করে?”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২২

তুশি উত্তর দিতে পারল না।বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ মেয়েটা। ইউশা করুণ চোখে ফিরে চায়। বিমর্ষ গলায় বলে,
“ তুমি সত্যিই চুরি করেছ তুশি? আমার এত বিশ্বাস,ভালোবাসার তবে এই দাম দিলে!”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৪