কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪৯

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪৯
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

ইউশার কথা কোনো কথা নয়,ছিল বিনা মেঘে প্রকট ভারি বজ্রপাতের শব্দ।
হতবিহ্বল সকলে চমকে উঠল। ফুরিয়ে গেল কথার বান।
আর তুশি? মূহুর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে পড়ল সে। চোখের সামনে এক চোট কম্পনে দোল খেল ধরণী। ফাঁকা ঠোঁটে, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মেয়েটা। অয়ন নিজেও কিছু হকচকিয়ে গেছে। কথাটা ইউশা দুম করে এভাবে বলে বসবে বোঝেনি। ও বললে এক রকম! কিন্তু হঠাৎ এসব শুনে বাড়ির লোক কে কীভাবে নেবে,কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে অয়ন জানে না। আর তুশি,ওই বা কী ভাবল?

অয়ন উদগ্রীব নয়ন ঘুরিয়ে তুশির পানে চাইল। মেয়েটার বিমূর্ত নজর তখনো ইউশার মুখে আটকে। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে সদরের চৌকাঠে দাঁড়ানো দীর্ঘদেহী সার্থকে দেখল অয়ন। তার চোখেও একইরকম বিস্ময়, ততোধিক অবিশ্বাস!
হয়ত আশাই করেনি, যে মেয়েটাকে অশিক্ষিত আর চোর বলে ও নিজের যোগ্যই ভাবে না,সেই মেয়েকেই ছোটো ভাই অয়ন মন দিয়ে বসবে। মাথা নুইয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছেলেটা। প্রস্তুতি নিলো একের পর এক কথার ঝড় ছুটে আসার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই স্তম্ভিত পরিবেশের রেশ কাটতে সময় লাগল খুব। বড়োরা ধাতস্থ হলেন বেগ পুহিয়ে। বারেবার বিমূঢ় নয়ন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন নিজেদের। এমনকি সেই তালিকা থেকে রোকসানা,আইরিন, হাসনা কেউ বাদ গেলেন না। মিন্তুটা অবধি ড্যাবড্যাব করে অয়নকেই দেখল।
ইউশার বুক কাঁপছে। হাঁসফাঁস লাগছে বড্ড। রুদ্ধ শ্বাসে মেয়েটা চিবুক নুইয়ে গাট হয়ে রইল। ও জানে এখন ওর দিকেই চেয়ে আছে তুশি । হয়ত বিস্ময়ের তোড়ে মাটিতে থুবড়ে পড়েছে বেচারি। ইউশা এখন ওই চোখে চোখ মেলাতে পারবে না, কিছুতেই না।
এই সব নীরবতা কাটিয়ে
তনিমাই মুখ খুললেন প্রথমে। থেমে থেমে বললেন,

“ অয়ন, অয়ন তুশিকে পছন্দ করে মানে! কী বলছিস ইউশা?”
মেয়েটা জিভে ঠোঁট ভেজাল। কণ্ঠস্বর পাথরের ন্যায় শক্ত করে বলল,
“ সত্যি বলছি। অয়ন ভাই সেই শুরু থেকে তুশিকে বিয়ে করতে চায়। শুধু মেজো ভাইয়া আর তুশির ডিভোর্সের জন্য অপেক্ষা করছিল। বিশ্বাস নাহলে ভাইয়া তো সামনেই বসে আছে, জিজ্ঞেস করে দেখো।”
শওকত অবাক হয়ে বললেন,
“ অয়ন,এসব সত্যি?”
ছেলেটা সময় নিলো না। নিসংকোচে বলল,
“ জি!”

সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের তলায় ঠোঁট চেপে ঢোক গিলল ইউশা। কোলের ওপর রাখা শীর্ণ হাত থরথর করল। অথচ আঙুলে আঙুল মিশিয়ে স্তম্ভ বনে রইল সে। বুকটা ছিড়ে গেল,টান পড়ল নিঃশ্বাসে। কিন্তু মেদূর চিবুকের কাঠিন্যতা দেখে কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারল না। একটুও না!
আর সার্থ, তার বিহ্বলতার সীমা সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেল আজ। মাথার অচল নিউরন,আর অক্ষিকূটে দপদপ করা আগুন নিয়ে অয়নের দিকে হতবাক বনে চেয়ে রইল সে।
তার মানে ওই ঠিক? অয়নের তবে এজন্যেই তুশির প্রতি এত আগ্রহ!
এবার যেন সার্থর কাছে দুইয়ে দুইয়ে মিলে চার হয়ে গেল। সবটা স্পষ্ট রূপে ভাসল চোখের সামনে। সেই হাসপাতালে প্রথম দিন ওর থেকে তুশিকে টেনে নিয়ে অয়নের কোলে তোলা,বাগানে ফুলের আদান-প্রদান থেকে শুরু করে সবটা,সবটা ভেবে ভেবে সার্থর মনে হলো এক্ষুনি চোখের এই তপ্ত অনলে আস্ত পৃথিবীকে ও ভস্ম করতে পারবে।

আচমকা ইউশার হাত টেনে চেয়ার থেকে দাঁড় করাল তুশি। ঘোর ভেঙে নড়েচড়ে তাকাল সবাই। কারো কিছু বলার অপেক্ষা না করেই তুশি টেনেটুনে মেয়েটাকে নিজের সাথে নিয়ে গেল কোথাও। সকলে বিভ্রান্ত হয়,কপালে ভাঁজ পড়ে। অয়নও একইরকম ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে সে পথে। শুধু ইউশার মাঝে এর কিচ্ছুটি দেখা গেল না। এতটুকুও চমকায়নি সে। বরং কলের পুতুলের মতো কদম ফেলে তুশির সাথে সাথে হাঁটল।
রেহণুমা আঁচল তুলে কপালের ঘাম মুছলেন। অস্থির চোখে দেখলেন স্বামীকে। সকাল থেকে একের পর এক কাণ্ডে দুজনেই দিশাহারা প্রায়। মেয়েটাকে নিয়ে কোত্থেকে যে কী ঘটছে,কিছুই বুঝতে পারছেন না। এখন আবার দুবোন মিলে কোথায় চলে গেল?
এদিকে ঘরের দোর আটকেই চ্যাঁচিয়ে উঠল তুশি,

“ তুমি কি পাগল হয়ে গেছো ইউশা? ওসব কী বলছিলে ওখানে? অয়ন ভাই,অয়ন ভাই কেন আমাকে পছন্দ করবেন? তোমরা তো দুজন দুজনকে ভালোবাসো তাই না!”
ইউশার ঠোঁট ভরে হাসল। বলল,
“ না,তুশি। তুমি ভুল জানো। অয়ন ভাই আমাকে কখনো ভালোবাসেননি। ওনার মন জুড়ে শুধু তুমি আছ।”
“ ফাজলামোর একটা সীমা আছে, ইউশা। তোমার মনে হচ্ছে এখন ইয়ার্কি করার সময়? আমি সেই অবস্থাতেই নেই। ভেতর ভেতর আমি ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছি ইউশা। একটু বোঝো প্লিজ! দয়া করে এই নিষ্ঠুর মজা গুলো আমার সাথে কোরো না এখন,প্লিজ কোরো না!”
তুশির কণ্ঠ বুজে গেল। এতক্ষণ জোর করে আটকে রাখা চোখের জলটাও গড়িয়ে পড়ল গালে। ইউশা উদ্বেগ নিয়ে বলল,

“ তুশি, আমি কেন মজা করব? আমি সত্যি বলছি,আমাদের জন্মদিনের দিনই অয়ন ভাই নিজে আমাকে বলেছেন উনি তোমাকে ভালোবাসেন।”
তুশি থ বনে গেল। মূঢ়ের ন্যায় আওড়াল,
“ কীহ?”
“ হ্যাঁ, উনি তোমাকে খুব ভালোবাসেন তুশি। খুব ভালোবাসেন। ভেতর ভেতর উনি পাগল তোমার জন্যে।”
তুশি পুরোটা গুলিয়ে ফেলল। ব্রক্ষ্মাণ্ডের সব সত্যি-মিথ্যে জট পাকাল শূন্যের ন্যায়। কাঁপা গলায় বলল,
“ তাহলে যে আমি এতদিন জানতাম তুমি আর অয়ন ভাই দুজন দুজন কে ভালোবাসো!”
ইউশা কাষ্ঠ হেসে বলল,

“ সেটা তো আমিও ভাবতাম। আমিও ভাবতাম অয়ন ভাই বোধ হয় আমাকেই ভালোবাসেন। কিন্তু আমাদের ভাবনা তো আর সব সময় সত্যি হয় না। তাই এটাও হলো না।”
মেয়েটা যত স্বাভাবিক ভাবে বলল,তার চেয়েও হাজারগুণ বেশি ধাক্কা খেল তুশি। মাথাটা এলোমেলো হয়ে পড়ল ওর। বুকে শ্বাস উঠল। ফ্যাসফ্যাস করল হাঁপানি রোগীদের মতো। অশান্ত চোখমুখ ঘুরিয়ে তাকাল দ্বিগবিদিক। ইউশা নিজেই বলল,
“ সেজন্যেই তো আমি চাইছি অয়ন ভাইয়ের সাথে তোমার বিয়ে হোক। খুব সুখের একটা সংসার হোক তোমাদে….”

মাঝপথেই চেঁচিয়ে উঠল তুশি। দুহাত দিয়ে কান চেপে আর্তনাদ করে বলল,
“ চুপ করো ইউশা,চুপ করো। ছিহ,ছি ছি এসব শোনাও পাপ, শোনাও পাপ।”
ইউশা উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,
“ কেন পাপ? কীসের পাপ?
তুশি, অয়ন ভাইকে বিয়ে করাতে কোনো পাপ নেই,কোনো অন্যায় নেই। আমি ওনাকে চিনি,আমি জানি উনি কেমন! উনি সত্যিই নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাকে খুব ভালো রাখবেন।”
তুশি রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
“ ইউশা! আর একবারও তুমি এসব মুখেও আনবে না। আমার ঘেন্না করছে শুনতে। আমি শুনতে চাই না এসব। থামো তুমি,থামো প্লিজ থামো।”

ইউশা তাও দমে গেল না। গলায় একইরকম জোর নিয়ে বলল,
“ শুনতে তোমাকে হবে তুশি। কেন শুনবে না? কার জন্যে শুনবে না? মেজো ভাইয়ার জন্য? যার কাছে তোমার আবেগ,তোমার অনুভূতির এক ফোঁটাও মূল্য নেই। যে তোমাকে মানুষই ভাবে না। যে তোমার চোখের সামনে দিয়ে আরেকটা মেয়েকে নির্লজ্জের মতো বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল তার জন্যে অয়ন ভাইকে কেন দূরে সরিয়ে রাখবে? মেজো ভাইয়া তোমার ভালোবাসার কদর করবে না তুশি। ভাইয়া জানেই না ভালোবাসা কী!”
“ সেটা ওনার ব্যাপার। ওনার নিজস্ব ব্যাপার। কে আমাকে ভালোবাসে,কে বাসে না তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি শুধু ঐ একজনকেই ভালোবাসি,ইউশা। উনি বাসলেও বাসি,না বাসলেও বাসি। তাকে ছাড়া আমি কাউকে কোনোদিন আমার জীবনে জড়াব না। কোনোদিন না।”

“ কিন্তু , এটা তো হবে না তুশি। অন্তত আমি থাকতে হবে না। তোমাকে আমি একটু একটু করে বিরহের আগুনে পুড়ে মরতে দেখতে পারব না। যদি ভাইয়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে,তুমিও পারবে। ফুপি বলছিল না,মেজো ভাইয়া ডিজার্ভ বেটার? এখন আমি বলছি
ইউ ডিজার্ভ বেটার তুশি। আর সেদিক থেকে অয়ন ভাই বেস্ট। ওনার মতো ছেলে লাখে একটা। মাথার মুকুট বানিয়ে রাখবেন তোমাকে।”
তুশি তুচ্ছ হেসে বলল,

“ তুমি কী ভাবছো,তোমার কথার জালে জড়িয়ে আমি হ্যাঁ বলে দেবো? বিটকেল বিয়ে করছে বলে,আমিও বিয়ে করব? আমার ভালোবাসা এত ঠুনকো নয় ইউশা। আমি মরে গেলেও বিয়ে করব না। তাও যাকে আমার বোন নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে সেই অয়ন ভাইকে বিয়ে তো দূর,ওনার দিকে ওই নজরে তাকাতেও আমার গা ঘিনঘিন করবে।”
ইউশা চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ ওহো, আবার সেই এক কথা। আমি ভালোবাসতাম তুশি! অয়ন ভাইকে ভালোবাসতাম আমি। সেসব এখন অতীত। যেদিন আমি শুনেছি উনি তোমাকে ভালোবাসেন,সেদিন থেকেই আমি ওনাকে ভুলে গেছি বিশ্বাস করো। এখন আর ওনার প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই।”
তুশি ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,

“ তাই নাকি!
আমার চোখের দিকে চেয়ে বলো তো,তুমি অয়ন ভাইকে ভালোবাসো না।”
ইউশা ঠোঁট টেনে হাসল। তুশির চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
“ আমি ওনাকে ভালোবাসি না।”
“ মিথ্যে কথা। তুমি মিথ্যে বলবে,আর আমি মেনে নেব! নাচতে নাচতে গিয়ে বলব আমি বিয়েতে রাজি? তুশি এত নির্বোধ নয়।”
“ তুশি,কেন এমন করছো? বলছি তো আমি ওনাকে ভালোবাসি না। আর সব থেকে বড়ো কথা চাচ্চু তো চাইছেন তোমাকে আবার বিয়ে দিতে। ছেলেও খুঁজতে চাইছেন। তাহলে সেই ছেলেটা অয়ন ভাই হলে দোষ কোথায়?”

“ বাবা চেয়েছেন, কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত বলিনি। জীবনে আমি একবার কবুল বলে ফেলেছি ইউশা,দ্বিতীয় বার অন্য কারো জন্য বলব না।”
ইউশা থামল। দু সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
“ এর মানে তুমি অয়ন ভাইকে বিয়ে করবে না?”
তুশির কথায় অটল জেদ,
“ কোনো দিন না,কোনো দিন না।”
“ এটাই তোমার শেষ কথা?”
“ হ্যাঁ!”
ইউশা চিবুক শক্ত করে বলল,

“ বেশ,তবে তুমিও আমার শেষ কথা শুনে রাখো তুশি। বিয়ে তোমার অয়ন ভাইকেই করতে হবে।”
তুশি অনীহায় মুখ ফিরিয়ে নিলো।
ও ফের বলল,
“ আর তা যদি নাহয়,তাহলে আমি নিজের সাথে একটা উল্টোপাল্টা কিছু ঘটিয়ে ফেলব।” আঁতকে উঠল তুশি। মুখের রক্তটা মুছে গেল তার।
অস্ফূটে আওড়াল,
“ ইউশা!”
ইউশা মিইয়ে গেল না। একইরকম কাঠ গলায় বলল,
“ হয় আমি সুইসাইড করব,না হয় আমি এই বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাব। হারিয়ে যাব সারাজীবনের জন্য। আর কেউ কোনোদিন আমায় কোত্থাও খুঁজে পাবে না তুশি। কেউ দেখতে পাবে না আমায়। আমি মরে গেলেও না।”

তুশির পায়ের জমিন সরে গেল। চুরমার হয়ে আকাশটা ভাঙল মাথার ওপর। নিথর বনে বলল,
“ ইউশা! কী বলছো এসব?”
জেদে ইউশা জ্ঞানশূন্য আজ। কেমন পাষণ্ডের ন্যায় বলল,
“ তাহলে বলো, বলো তুমি অয়ন ভাইকে বিয়ে করবে, বলো। নাহলে কথা দিচ্ছি, আমি সত্যি সত্যি সব শেষ করে দেবো তুশি। সব শেষ করে দেবো।”
তুশি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চেয়ে রইল কিছুপল। টের পেলো ভূপৃষ্ঠের মাটিটা ঠকঠক করে নড়ছে। ভূমিকম্প ছুটেছে বুঝি? সব কিছু এমন কাঁপছে,দুলছে কেন তবে? কেন মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুরে লুটিয়ে পড়বে ও?
ইউশা যেন খুব কঠিন সেজেছে আজ। একটুও দয়ামায়া, কোমলতা কিচ্ছু যেন নেই। এই ইউশাকে তো ও চেনে না।

তুশি টলমলে চোখে এক পা, এক পা করে পিছিয়ে যায়। তারপর ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে। দুহাতে মুখ ঢেকে হুহু করে ওঠে। কান্নায়,কান্নায় বেজে যায় কথারা। হাহাকার করে বলে,
“ কেন তোমরা সবাই মিলে আমার সাথে এমন করছো ইউশা? কেন! আমি কী ক্ষতি করেছি তোমাদের? সহ্য করতে করতে খুব ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি আমি। এর থেকে তো আমার সেই বস্তির টিনের ঘরটাই ভালো ছিল। অন্তত দিন শেষে একটু শান্তি, একটু স্বস্তি নিয়ে ঘুমাতে পেরেছি সেখানে। আর এখন! এখন এই ইটপাথরের চার-দেওয়ালে হাঁসফাঁস করে মরছি আমি। প্রতিটা দিন,প্রতিটা মূহুর্ত জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি। আমি আর পারছি না নিতে,আর পারছি না।”

ইউশা দুই হাঁটুমুড়ে ওর পায়ের কাছে বসল। হাতদুটো মুঠোয় ধরে বলল,
“ পারবে তুশি,পারতে তোমাকে হবেই। তুমি কিন্তু মোটেও নরম তুশি নও। তুমি সেই তুশি যে কখনো কাঁদে না। যে পাথরের মতো শক্ত, যার কোনোকিচ্ছুতে ভয় নেই। তুশি তুমি
ভাইয়াকে দেখিয়ে দাও, তুমিও কোনো ফ্যালনা নও। বুঝিয়ে দাও ভাইয়া তোমাকে প্রত্যাখান করে কী দামি জিনিস হারিয়েছে। ভাইয়ার ভুলটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দাও তুশি। আর সেজন্যে অয়ন ভাই বেস্ট চয়েজ ফর ইউ। কেবল উনিই তোমাকে তোমার সঠিক মূল্যায়নটা করবেন। তোমরা এক হলে সারাটাজীবন আনন্দে থাকবে,তুশি। মিলিয়ে নিও আমার কথা।”

তুশি ভেজা, নিশ্চল চোখে চাইল। নিভু স্বরে শুধাল,
“ আর তুমি! তোমার কী হবে?”
ইউশার চেহারা বদলে যায়। অথচ হাসল সে। কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
“ আমার আবার কী হবে? আমিও কোনো হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেলব।”
“ পারবে?”
ইউশা চোখ নামাল। ঠোঁট জিভে ভিজিয়ে শ্বাস নিলো আস্তে। বলল,
“ পারব না কেন? যখন করব,তখন দেখতেই পাবে। আচ্ছা এসব ছাড়ো,তুমি আমাকে কথা দাও অয়ন ভাইকে বিয়ে করবে। কথা দাও।”

হাতের তালু পাতল মেয়েটা। তুশি বিরস চোখে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল শুধু। ইউশা তাগিদ দেয়,
“ কথা দাও তুশি। নাহলে আমি কিন্তু…”
“ হুমকি দিতে হবে না। চলো…”
ঠান্ডা উত্তর ছুড়ে দিয়ে বসা থেকে দাঁড়াল তুশি। পা জোড়া টেনেটুনে হাঁটাও ধরল সাথে। ইউশার ঠোঁটে হাসি ফুটল অমনি। উঠেই, দ্রুত পায়ে পিছু নিলো ওর।
বসার ঘরে আলোচনা চলছিল। বোঝা গেল সকলেরই এক দফা কথাবার্তা শেষ। বরং
ওদের দেখেই তটস্থ হয়ে চাইলেন তারা। তুশি চুপচাপ এসে দাঁড়াল। পাশে থামল ইউশা। একবার চেয়ে চেয়ে দেখল উৎসুক মানুষগুলোকে।
রেহণূমা অধৈর্য চিত্তে বললেন,
“ কী হয়েছে তোদের? কী কথা বললি এতক্ষণ?”
ইউশার জবাব তৈরি। ফটাফট বলল,

“ আসলে মা, তুশি তো নিজেও অয়ন ভাইয়ের কথাটা জানতো না, তাই একটু চমকে গিয়েছিল। সেজন্যেই আমাকে আলাদা করে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে। আমি ওকে সবটা আমার মতো করে বুঝিয়ে দিয়েছি।”
এক কথায় মেনে নিলেন সবাই।
শওকত গলা ঝেরে বললেন,
“ তুশি মা,এতক্ষণ ধরে আমরা এ নিয়েই আলোচনা করছিলাম । ইউশাই ঠিক।
অয়ন তোকে শুধু পছন্দই করে না, বিয়েও করতে চায়। আগে হলে এক রকম,কিন্তু এখন তো আর তোর কোনো পিছুটান নেই। আর সাইফুল রেহণূমা, এবং আমরা বাকিরা আমাদের কারোরই এতে কোনো আপত্তি নেই।”
শেষ লাইনটা ফের ছেলের দিকে চেয়ে চেয়ে বললেন তিনি।
তারপর জয়নবকে শুধালেন,

“ কী আম্মা,তুমি কী বলো?”
“ আমি আর কী বলব? অয়ন চাইছে, এবার তুশিও চাইলে বন্দোবস্ত করো।”
বৃদ্ধা আড়চোখে সার্থর দিকে তাকালেন। সে মানব একটা জ্বলজ্যান্ত মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন,
“ কী দাদুভাই,এখনো গেলে না যে? এই তো বললে তাড়া আছে।”
উল্টোপাশের মানুষটা নিশ্চুপ। সময় গেলেও জবাব এলো না৷ ক্ষুরধার চোখ দুটো তাক করে তুশির পানে চেয়ে রইল উলটে।
মেয়েটার চোখ মেঝেতে। অনুভূতিশূন্যের ন্যায় সাদাটে মুখখানা। অয়ন দুরুদুরু বুক আর অস্থির চিত্তে বারবার তুশিকেই দেখছিল। ও জানে না,ইউশা আর তুশির কী কথা হয়েছে! ইউশা পেরেছে তো ওকে মানাতে! তুশি রাজি হবে তো?
তখন তনিমা এসে তুশির পাশে দাঁড়ালেন।
মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“ বল মা, আজ শুধু তোর কথা বল। তুই কী চাস? বিয়ে করবি অয়নকে?”
তুশি এক ফোঁটা নড়ল না। চোখের পাতা ফেলল না। মুখের চামড়া সরল না। কেবল জড়ের ন্যায় আওড়াল,
“ তোমরা যা ভালো বোঝো, তাই করো।”
সার্থর একটা পা পিছিয়ে গেল একটু। মাথার ওপর উত্তাল সমুদ্র ভয়াবহ তাণ্ডব নিয়ে আছড়ে পড়ল বোধ হয়। তার তীক্ষ্ণ চোখের মনি দুটো এমন কাঁপল কেন নাহলে?
অন্যদিকে,
ঠোঁটে ফুলিয়ে এতক্ষণের রুদ্ধ শ্বাসটুকু ছাড়ল অয়ন। ভেতরকার দানবীয় পাথরটা বুক হতে নেমে গেল সহসা। মুচকি হেসে বলল,

“ তুমি ভেবো না তুশি, আমি তোমাকে সব সময় তোমার প্রাপ্য সম্মান দেবো। ওয়ার্ল্ড বেস্ট হাজবেন্ড হয়ে দেখাব তোমাকে।”
তুশি জবাব দিলো না। একবার তাকালও না মুখ তুলে। বরং এমন ভাবে রইল যেন শুনতেই পায়নি। অথচ চট করে সার্থ চোখ বুজে ফেলল। কানের গর্তে পোড়া লোহার পিণ্ড ঢুকিয়ে দেয়ার অনুভূতি হলো হয়ত! পরপরই লম্বা পায়ে ঘুরে বেরিয়ে গেল সে। যাওয়ার সময় হাত দিয়ে সদরের দরজা এমন ভাবে চাপাল শব্দ হলো ধড়াম করে। মেঝেটা কাঁপল। ঝিম করে উঠল ঘরের দেওয়াল। টেবিলের কাচের বাসন-কোসন ঝনঝন করল এক চোট। গ্লাসের ভরা পানিটা অবধি ঢেউয়ের মতো ছলকে পড়ল চারপাশে। অথচ কেউ কিচ্ছু বলল না। সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কারোরই এখানে কিছু করার নেই।
আইরিনের মনে চাঁদ উঠেছে। সামনের চিকণ চুলটা আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে মিটিমিটি হাসল সে। প্রফুল্ল চিত্তে ভাবল,

“ এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি রে ভাই। একবার যদি বস্তিটার বিয়ে হয়ে যায়,তাহলে আমার পথে আর কোনো বাধাই থাকবে না!”
ইউশা উচ্ছ্বসিত হয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল তুশিকে। স্ফূর্ত কণ্ঠে বলল,
“ আমি খুব খুশি হয়েছি তুশি, খুব খুশি আমি।”
হইহই করে বোনের মাথাতেও চুমু খেল সে। তুশি চুপ। কেবল নির্বাক বনে রইল। রেহণূমা হেসে বললেন,
“ আচ্ছা আচ্ছা, অনেক হয়েছে। এবার সবাই খেতে বসো তো। এসবের চক্করে এখন পর্যন্ত কারো প্লেটের দানাপানি নড়েনি। ”
ইউশা বলল,

“ মা, আমি এখন আর খাব না। আমার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।”
“ এখন আবার ক্লাস কীসের? কাল রাতেই না বললি আজ ক্লাস-ফ্লাস নেই।”
ইউশা আমতা-আমতা করে বলল,
“ আরে, ইউনিভার্সিটির কোনো ঠিক আছে নাকি। হুটহাট ক্লাস জুড়ে দেয়। আমি যাই মা,তৈরি হই। নাহলে দেরি হয়ে যাবে।”
কেউ আর আটকাল না। ঘরের পথে রওনা করল মেয়েটা।
এক পা এগোতে গিয়েও থামল একটু । হালকা ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল আড়াআড়ি বসা অয়নকে। সেই মানুষের ঠোঁটে আজ চকচকে হাসি। থইথই আনন্দ সারা মুখে। হঠাৎই সে তাকাল। চোখ সরানোর সময়টা ইউশা পেলো না এবার। না চাইতেও চোখাচোখি হলো তাই। অয়নের হাসি বাড়ল আরো। কৃতজ্ঞতায় ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে বলল,

“ থ্যাংকিউ!”
ইউশা হাসল না,প্রানহীন বিষণ্ণ নয়ন মেলে চেয়ে রইল শুধু। ভেতরটা তার দুমড়েমুচড়ে গেল বৈশাখে তেড়ে আসা বন্যার মতো। হৃদয় তোলপাড় করে কান্না পেলো খুব। ব্যর্থ প্রেমের গল্পটা করুণ সুর তুলে বলল,
“ কী করে বলব তোমায়,
আসলে মন কী যে চায়,
কেন সে পালিয়ে বেড়ায় তোমার থেকেই…
তুমি জানতে পারোনি,কত গল্প পুড়ে যায়।
তুমি চিনতেই পারোনি আমাকে হায়….”

ইউশা চোখ সরিয়ে আনল। ঠোঁট চেপে শ্বাস নিয়ে পা বাড়াল আবার। তার প্রস্থান পথে নিস্পন্দ নয়নে এক যোগে চেয়ে রইল তুশি। ইউশা হাঁটছে ঠিকই,কিন্তু ও স্পষ্ট বুঝল মেয়েটার পা চালানোর শক্তি নেই। থামছে,হাঁটছে, হিঁচড়ে নিচ্ছে শরীরটা। এই কদম তুশির চেনা।

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪৮

সার্থর থেকে একেকটা আঘাত পেলে ও ঠিক এইভাবে হাঁটতো। তুশি মাথা নুইয়ে ফিচেল হাসল। ভাবল,
“ কষ্ট পেও না ইউশা,একটুও কষ্ট পেও না তুমি। তুশি কারো থেকে তার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিতে শেখেনি। তোমার অয়ন ভাই তোমার ছিল,তোমারই থাকবে। ওনাকে আমি তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেবো, ইউশা। আর এটা আমার নিজের কাছে নিজের ওয়াদা রইল!”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৫০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here