কালকুঠুরি পর্ব ৩১

কালকুঠুরি পর্ব ৩১
sumona khatun mollika

সিকান্দার বাড়িতে কেমন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সিভান ইতির সাথে নিজের ঘরে বসে খেলছে। ইনায়া প্রাইভেট পড়তে গেছে৷
নুসরাত নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে । সাথি জরিনাকে কাজে সাহায্য করছে। রাহা মেয়ে টা সারাদিন খায় ঘুমায় আর হঠাৎ হটাৎ কোথায় যেন যায়। সেদিকে এদের কারো নজর নেই। সাফিন বরাবরি নিজের কাজে ব্যাস্ত থাকে। সালার সিকান্দার বেশিরভাগ সময় রাগিব দেওয়ান এর ক্লাবেই কাটায়।

ভার্সিটিতে গোলমাল,, সামির সিকান্দার কোথায় গুম হয়ে গেল! কমিশনারের ছেলে কে কি আসলেই সামির সিকান্দার খুন করেছে? যদি তা নাই-ই হয় পুলিশ কেন সামির সিকান্দার কে খুঁজছে? আর ছেলেগুলো কেই বা মারলো কারা। ?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এসব এখন ভার্সিটির টপ নিউজ! এত ভয়াবহ খুন হয়েছে কিন্তু মিডিয়াতে খবর দেয়া হয়নি। রনি বা শায়েখের মৃত্যুর তো ধামাচাপা পরে যাচ্ছে এইসকল টপিক উঠে আসায় ।
বসে বসে এসবই চিন্তা করছিল মাহবুব উদ্দিন। একজন হাবিলদার তাকে উদ্দেশ্য করে বিনয়ী স্বরেবলল,,
– স্যার চা খাবেন? মাথা ছাড়বে। টেনশন ও কমবে।
– নিয়াসেন।

দুকাপ চা এনে মাহবুব উদ্দিন এর সামনে বসলো হাবিলদার। মাহবুব উদ্দিন এর দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে মাহবুব উদ্দিন বলল,,
– হাবিলদার সাব,,,
– স্যার?
– আপনার মনে হয় না এইযে এই ঘটনাগুলো,, এইসবের মাঝে মেয়র সাফিন সিকান্দার আর এমপি তামিম খন্দকার বড্ড নিস্তব্ধ!?

– জ্বে স্যার। তারা এই বিষয়ে খুব বেছে কথা বলেন। নির্বাচন সভাপতি রাগিব দেওয়ান এর তো টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না । মেয়র সাহেব কোনো জায়গায় মুখ খুলছেন না শুধু একটা মাত্র জায়গা ছাড়া,
– সামির সিকান্দার এর কোনো দোষ নেই। এটা প্রমাণের সময় তাইতো?
– জ্বে স্যার।
– আচ্ছা হাবিলদার সাব,, এই সিকান্দার পরিবারটা সম্পর্কে যদি ধারণা অর্জন করতে চাই বিষয়টা কেমন হয় বলুন তো? মানে কিসের ব্যাবসা? আয়ের উৎস? পারিবারিক সম্পর্ক গুলো??

– একদম ভালো হয়না স্যার। অরা এক নামে খুনি বংশ! সালার সিকান্দার থেকে নয় তার বাপ দাদার আমল থেকেই এরা রাজনীতিতে যুক্ত । এমনভাবে খুন করে সহজে প্রমাণ ছাড়েনা।
– উপরমহল থেকে যদি সার্চ ওয়ারেন্ট পাঠায়?
-কোনোদিনও পাঠাবেনা। স্বয়ং কমিশনার সাহেব, ডিআইজি , এমপি সব ওদের দাবার গুটি। টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে সক্কলকে।
– সামান্য ব্যাবসা করেও এত টাকা পায় কোথায়? নিঃসন্দেহে অবৈধ ব্যাবসা আছে!

– তা তো জানিনা স্যার, কিন্তু অরা যেমন বংশীয় খুনি তেমন বংশীয় বড়লোক। জমিদারের বংশ। বিষয়সম্পত্তির অভাব নাই।
– আপনি বেশ ভালোই জানেন দেখছি সিকান্দার দের বিষয়ে ।
– জ্বে স্যার অনেক বছর ধরে আছিতো। আপনের আগে যে ইন্সপেক্টর ছিল ওনারেতো ওরাই মাডার করছিল। কমিশনারের সাহায্যে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিছিল।
– আর কি কি জানেন?
– এর বেশি আর কিছু জানিনা।
মাহবুব উদ্দিন বুঝলো জানলেও হাবিলদার তা বলতে চাইছেনা। মুখ খুললে বিপদ আবশ্যক৷ তাই সেও আর তাকে জোর করলনা৷ তাছাড়া হাবিলদার বয়সে বড় তার সাথে জবরদস্তি বিষয় টা যায়না ।
স্মৃতি চত্বরের কাছে দাড়িয়ে আছে সিয়াম। সাথে কাশেম আর সামনে মুহিব ভেজা বেড়ালোর ন্যায় মাথা নুইয়ে দাড়িয়ে। সিয়াম সোজা জিজ্ঞেস করল,,

– সামির কোথায় গেছে তোদের দুজনের কে জানিস?
কাশেম মাথা নেড়ে বলল,,
– আমি খালি জানি ভাই পলাইছে কোনদিক গেছে তাও জানিনা৷
মুহিব নিরুত্তর ! সিযাম জিজ্ঞেস করল,,
– তোর জানার কথা না তবুও বল কিছু জানিস?
– না ভাই।
– এমন মেয়ে মানুষের মতো মাথা নোয়াই কতা বলিস কেন? চোখের দিকে তাকিয়ে মদ্যের মতো কথা বলবি।
তোর বোনের বিয়ে হয়েছে কিনা?
– জ্বি।
– কেমন আত্মীয় একটু খবরও দিস নি। তোর বাপকে গিয়ে বলবি,, সামির সিকান্দার তোর বিয়া ঠিক করছে। সে ফিরে আসলেই তোর বিয়ে। পাত্রী কে তা আমি ঠিক জানিনা। ও না পালালে আজি জানা যেত।
বুঝেছিস কি বলেছি?
মুহিব মাথা নেড়ে হ্যা জানালে সিয়াম স্হান ত্যাগ করে। ইনায়া আর মেধা এগিয়ে গিয়ে কাশেমকে জিজ্ঞেস করে,,

– সামির গুম হয়েছে ঠিকাছে। মাহাকে নিয়ে যাওয়ার কি দরকার ছিল?
ইনায়া চুপ করে দাড়িয়ে রইল। কামেম গাড় চুলকে জবাব দিল,,
– আরে তার বউ সে নিয়ে যাবে না রেখে যাবে তার বিষয় ।
– কিন্তু মাহার তো পরীক্ষা !
– সে যাই হোক গা। সামান্য পরীক্ষায় তো! রিপিট দেবে,, সমস্যা নাই।
– মুহিব ভাই,, আপনার মন খারাপ কেন?
– সেটা তোমার দেখার বিষয় নয় শ্যামা । তুমি আজ আবার ভার্সিটি কেন এসেছ চলো তোমাদের বাড়ি নামিয়ে দি।
ইনায়া একবার মুহিবের দিকে তাকালো। বড্ড অবাক হতে হয় ছেলেটাকে দেকে। খুবই ঠান্ডা স্বভাবের ছেলে। কখনো গোলমালও করতে দেখা যায় না। তবুও পুরো ঘটনায় সে মোড় গোরানো পয়েন্ট মাহার চাচাতো ভাই৷ যেকিনা ভালোবেসে পেলে পুষেও মাহাকে পেলনা। তবুও তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। মেধা আজকাল ভার্সিটি আসা কমিয়েছে। তার বাবা কড়া নির্দেশ দিয়েছেন কলেজ থেকে সোজা বাড়ি ফিরতে। ইনায়ার বাহানায় তাও চলে আসে মাঝেমধ্যে ।
ইনায়া বেশ ভালোই বোঝে মেধার মূল লক্ষ্য কাশেম হালদার । কাশেম মেদাকে সাইডে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,,

– এই শ্যামা, তোমার বাপটা এমন খচ্চর কেন?
– কেন কি হয়েছে?
– তোমার বাড়ি গেছিলাম কালকে। সে আমাকে একপ্রকার তেড়ে বের করে দিয়েছে।
– কেন গিয়েছিলেন?
– মাহাদিবা ভাবির কিছু ইনফো দরকার।
– কিসের ইনফো আর কেন দরকার?
– আরে ভাই তো ভাবিকে না জানিয়ে নিয়ে চলে গেছে। সাথে ফোনটাও নেয়নাই। এখর রিপিট এক্সাম এর জন্য তো দরখাস্ত করতে হবে। ইনফো কই পাবো।
– তারজন্য আমার বাড়ি নয় মাহার বাড়ি যেতে হতো।
– ওই সময় মনে ছিলনা।
– ঠিকাছে। আমি আসছি।
– এই শোনো,,,

মেধা ঘুরে দাড়াতেই কাশেম আচমকা চুক করে মেধার গালে একটা চুমু দিয়ে এমন স্পিডে দৌড় লাগালো যেন পেছনে কুকুর ধাওয়া করেছে। মাহা আহাম্মক ভাবে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
ইনায়া মুখ চেপে হাসতে থাকলো। মেধার শ্যামলা গালদুটো লজ্জায় লাল টমাটো হয়ে গেল।ইনায়ার হাত ধরে একপ্রকার দৌড়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করল।
বেলা ঢলেছে, পশ্চিম আকাশে পাখিরা কিচিরমিচির করছে। মাহা বড্ড কষ্টে নিজের হাসিটা চেপে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামির সিকান্দার কে ধান চাষে লাগিয়ে দিয়েছে বুড়ো। প্রথমে সামির কিছুতেই নামবেনা তো নামবেইনা। পেছনে পেছনে গালাগাল করে বুড়োর চৌদ্দ গুষ্টি ধুয়ে দিয়েছে৷ তবে মাহা বলেছে কেমন পুরুষ দেখান দেখি,, কেমন কর্মের ক্ষমতা আপনার!
কি করে নিজেকে আটকে রাখে! বুড়ো তাকে দেখিয়ে দিচ্ছে সে সেই অনুযায়ী চারা রোপন করছে। সামির প্রকাশ করছেনা তবে এসব এক অন্য রকম মজার কাজ । মাজায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে বলল,,

– বাহ বুড়ো এতো বড্ড কঠোর কাজ! এই বয়সেও এত কাজ করো কি করে?
– করতে হয় রে বাপ। ছোড়াছুড়ি দুটো তো কেও দেখেনা। নিজের কথা বাদ। আমার বুড়ি টাকে তো দেখতে হবে। তার তো এই দরিয়ায় তার সোয়ামী বাদে কেও নাই।
– খুব ভালোবাসো মনে হচ্ছে বুড়িটাকে? কচি চুড়ির সাথে বিয়ে দেব করবে?
– না রে বাপ। আমার বুড়িই আমার জন্যি যথেষ্ট । তারে ভালোবেসে এই জনম আরামসে পার কইরে দিলেম৷।
– হাপিয়ে ওঠোনা দায়িত্ব পালন করতে করতে?? ।
– যারে ভালোবাসা যায় তার জন্য কোনো কর্মেই ক্লান্তি লাগেনা। জানো বাপ দিন শেষে যহন যাইযা বসি আমার বুড়িডার মুখের হাসি এক আকাশ সমান ক্লান্তি নামায়ে দেয়। কত ঝগড়াঝাটি করছি জীবনে! মারপিটও বাদ যায়নাই। তবুও দেখ আমারা দুইডা একলগেই জিন্দেগী পার কইরা দিছি। কারণ আমরা একজন অন্য জনরে ভালোবাসি।
– বাপরে জৈব যৌগের কঠিন চ্যাপ্টারো এসবের চে সোজা। তবে কামডা কিন্তু বেশ কষ্টের বুড়ো৷ রোদ বাওয়ের মইদ্যে কত কষ্টে কাম করো।
বুড়ো হালকা একটু হাসলো। সামির হাতের চারাগুলো রেখে মাহার দিকে এগিয়ে গেল।

– কি হলো? ক্লান্তি ধরে গেছে? গরমে ঘেমেতো অস্হির হয়ে গেছেন দেখছি মরে টরে যাবেন নাকি আবার! আমাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে মরবেন কিন্তু।
– চোপ বাঙ্গি! খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে ! এসব কাজ এরা করে কি করে! ওফফ!
– কারণটা খুব সোজা। এই মাটির বুকেও প্রেম আছে!
বুড়ি গিয়ে বুড়োর ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছে। বুড়ো হাসিমুখে বুড়ির সাথে কিছু কথা বলছে। বুড়ি মাটি নেড়ে কি যেন দেখছে।
সামিরের একটা গান মনে পরতেই সে সোজা মাহার হাত ধরে টেনে জোর পূর্বক নাচিয়ে গাইতে ধরলো,,

~ এই মাটির বুকেও প্রেম আছে
স্বপ্ন সেত বুঝবেএ
এই মাটির বুকেও প্রেম আছে স্বপ্ন সেত বুঝবে!
আমার ভালোবাসা জিতবে,,
রাতেরবেলা খাবার শেষে মাহা বুড়িকে থালা ধুতে সাহায্য করে ঘরে এসে দেখে সামির একটা অফ হোয়াইট কাগজে কলম দিয়ে দাগাদাগি করছে। মাহা পেছন থেকে দাড়িয়ে দেখল সামির ছবি আঁকাচ্ছে।
– কাগজ কলম কই পেলেন?
– এখানেই ছিল, হয়তো বুড়োটার ছেলে বা মেয়ের হবে। ভেতরে কয়টা লেখা আছে।
– কি আঁকাচ্ছেন দেখি,,,
মাহা উবু হয়ে দেখল তখন যে বুড়ি বুড়োর ঘাম মুছে দিচ্ছিল সামির সেই দৃশ্যের ছবি আঁকিয়েছে।

– বাহ খুব সুন্দর হয়েছে।
– নো ধন্যযোগ।
– আমি এতে কয়টা আর্ট এড করতে চাই।
– তুমি নষ্ট করে ফেলবে।
– আরে সরুন বলছি করবনা নষ্ট ।
সামির উঠে যেতেই মাহা কলম দিয়ে চারপাশে কটা গাছপালা আর আকাশে পাখি একে দিল। সামির জানালার ধারে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে আছে।
মোমবাতির আলো মাহার চেহারার ওপরে পরতেই সামিরের একজনের কথা মনে পরে যায় । সেই ব্যাক্তিও এভাবে বসে লেখালেখি করত। তার মুখের ওপরে মোমবাতির আলো পরে চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করত।
সামির সেখান থেকে বেরিয়ে বাহিরে বসে চাদের দিকে তাকিয়ে রইল। মাহা তাকে বাইরে যেতে দেখেও আটকালোনা। নিজেও পিছে পিছে গিয়ে পেছনে দাড়ালো। সামির ইশারায় তাকে বসতে বলল।

কালকুঠুরি পর্ব ৩০

– চলে এলেন যে,, বাইরে কার সাথে থাকবেন?
– বেতরেই যাব রে বাল। ভাল্লাগছেনা।
– কেন? পেটে মদ পরেনি তাই?
– না।
– তাহলে??
– এমনিতেই। চলো ভেতরে চলো। আমরা কুব সম্ভব কাল বা পরশুদিন রওনা দেব। পরিস্থিতি শিওর ঠান্ডা হয়ে গেছে।
– গিয়ে সোজা স্যালেন্ডার করে দেবেন। আর নাহলে আমাকে এখানে রেখে যাবেন। বলুন করবেন তো স্যালেন্ডার?
– করব।
সামিরের জবাব শুনে মাহার চার দুনিয়া গুরতে লাগল। সামির সিকান্দার বলে গেল স্যালেন্ডার করবে!
দেখাই যাবে বলে নিজেকে আশ্বস্ত করে ঘরে চলে গেল মাহা।

কালকুঠুরি পর্ব ৩২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here