কালকুঠুরি পর্ব ৩৫
sumona khatun mollika
বেশ কিছুখন নিরবতা কাটার পরে মাহা বলে,,
– কিছু বলছেন না কেন?
– ভাবছি। তুমি আবার আমার ওপর সমবেদনা দেখাতে গিয়ে উল্টে যাবে নাতো?
– আমাকে আপনার এতই দুর্বল মনে হয়?
– একদম না।
– তাহলে বলুন। আমি জানতে ইচ্ছুক।
সামির আকাশের দিকে তাকিয়ে মাহাকে তার অতীত শোনাতে লাগল।
– আমার মায়ের নাম ভানুমতী শিকদার। নানা সালাম শিকদার নানি নিরুপমা শিকদার, মামা ভুবন শিকদার। রামচন্ডিপুর এর মাঝামাঝি ছিল তাদের আবাস। তেমন আহামরি বড়লোক না হলেও কোনোকিছুর অভাব ছিলনা। মধ্যবিত্ত বলা যায়…….
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভানু, বাবা মায়ের বড্ড শখের সন্তান ছিল। যুবতী বয়সে রাজশাহীতে পড়াশোনা করত। ভানু আর তার দুই বান্ধবী মিলে এক বাড়িতে ভাড়া থাকত। বিশাল বড় বাড়ি আবাস মোটামুটি কয়েকজনের। স্হান? কালকুঠুরির পাশে ছিয়াত্তর নাম্বার বাড়িটা।
তখন সে এলাকায় মানুষের বাস ছিল মোটামুটি । তবে সেটা বদনাম গলির মোড়। হবেনাই বা কেন? সেখানে যে কুঠুরির মেয়েদের পা পরে। নানা অনেক মানা করেছিলেন কিন্তু মা বলেছিল, তাতে কি হয়েছে? ওই রাস্তা বাড়ির পেছন সাইডে। কোনো সমস্যা হবেনা। মনের বিরুদ্ধে গিয়েও নানা থাকতে দিলেন কারণ সেটা কলেজ থেকে কাছে এবং আর কোনো বাসা পাওয়াও যাচ্ছিল না যথেষ্ট টাকার ভেতরে।
বেশ তুখর স্টুডেন্ট ছিল ভানু। সবসময় ফার্স্ট গার্ল। কলেজে থাকতে এক সুদর্শন পুরুষের প্রেমে পরে যায় । তার নাম ছিল ওবায়দুল কবির। দেখতে মোটামুটি সুন্দর ছিল। বঙ্গবন্ধু কাট মুচ ছিল। পাতলা চিকন কালো চশমা পরতো।
দেখে মনে হতো আবাল কিচ্ছু বোঝেনা। নিষ্পাপ । কারণ ওইযে কথায় আছে ট্যালেন্ট ছেলেরা ইনোসেন্ট টাইপ হয়। সেরমি কিছু আরকি। তো মি. ওবায়দুল কবির , সে অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাতোনা। তার একমাত্র পছন্দ ছিল সুন্দরী ভানুমতী শিকদার। স্টুডেন্ট ভালো, ছেলে ভদ্র। সামান্য বিড়ি সিগারেট পর্যন্ত খায়না । মেয়ে দের দিকে বিশেষ দরকার ছাড়া তাকায় না। এই গুণগুলো ভানুমতীর খুব ভালো লেগে যায়।
একদিন বৃষ্টির মধ্যে দুজন কলেজ ক্যাম্পাসে দাড়িয়ে ছিল । ওবায়দুল তখন ছাউনির ভেতর এতগুলো মেয়ে দেখে নিজে দুরে সরে দাড়ায়। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। সবাই এটা নিয়ে হাসাহাসি করছে তখনি ভানুমতী তার মাথায় ছাতা ধরে। পছন্দের মানুষকে এত সামনে থেকে দেখে তার সর্বাঙ্গ দুলে ওঠে। নিঃসন্দেহে ভানুর চোখ ছিল যে কারো হৃদয় খান করার মতো ক্ষমতাবান। ওবায়দুল এর বেলায়ও তাই হলো। এমন পরিস্হিতিতে পরল যে একদৃষ্টে তাকিয়েই রইল একে অপরের দিকে।
দুদিন আর কারো দেখা নেই। তারপর একদিন সোমবারে, সিটি লাইব্রেরি তে তাদের আবার দেখা হয়। দুজনে একে অপরের সামনাসামনি বসে বই পড়ছিল । পড়ছিল ঠিক বলা যায় না। দুজনের কারোরি পড়া হচ্ছে না। হঠাৎ ওবায়দুল নিজে থেকে জিজ্ঞেস করল,,
– তুমি কি রোজ এখানে আসো?
সামিরের মা সামিরের মতই ত্যাড়া জবাব,
– বোকা নাকি? রোজ কিভাবে আসবো খোলাইতো থাকে ৩ দিন। সোম, মঙ্গল, বুধ।
-ওহ হ্যা তা-ইতো।
– হুমম, তুমিকি রোজ আসো?
– হ্যা।
– আবারো ভুল উত্তর, রোজ কিভাবে আসো খোলাইতো থাকে তিনদিন।
– হ্যা ওই তিন দিনই।
ভানু খিলখিল করে হেসে ফেলল। ওবায়দুল তার দিকে তাকিয়ে রইল। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর৷ ওবায়দুল সাহস করে ভানুর বইয়ের ভেতরে একটা চিরকুট রেখে দেয়। ঘুরেফিরে তিনদিন পরে সেটা ভানুর হাতে পরে। ভানুর মুখটা ঝলমলে হয়ে ওঠে। তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দেয় না। তবে ভানুর নিজেরো তো তাকে পছন্দ ছিল। কথায় কথায় একদিন ভানু ওবায়দুল কে জিজ্ঞেস করে,, তুমি আমাকে সত্যি পছন্দ করো?
– আমি তোমাকে পছন্দ নয় ভালোবাসি ভানু ।
– তাহলে ঠিকাছে । আমিও তোমাকে পছন্দ করি। কিন্তু আগে রাবিতে চান্স পেতে হবে। আর মাত্র কিছুদিন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার তারপর ভর্তি পরীক্ষা,, তারপর কোথায় হয় না হয়,, পড়াশোনা টা ঠিক রাখতে গেলে এদিকটা কম রাখতে হবে বুঝেছ? এমনিও তুমি ওমন না। তবুও অন্য মেযের দিকে তাকাবেনা।
– তুমি কেমন জেন সবার থেকে আলাদা ভানু।
– কেন?
-এইযে সাহসী, উদ্যোগী, সাথে মায়াবী ও ।
– ধন্যবাদ । যাও এখন নিজের কাজে যাও।
– বলছি ভানু??
– আবার কি হলো?
– আমরাকি মাঝেমধ্যে দেখা করতে পারিনা?
– প্রতিদিন বিকেলে ৫ টার সময় , বাইরের স্টলের সামনে।
– আচ্ছা।
তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা একে অপরকে ভিষণ ভালোবেসে ফেলে। ভানু তার সমস্ত নির্ভরতা ওবায়দুল এর ওপর ছেড়ে দেয়। দুজনের দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। সৌভাগ্যক্রমে দুজনেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যায়।
ভার্সিটির প্রথম দিন ভানুর দেখা হয় তখনকার সেরা বখাটে তৎকালীন নবনির্বাচিত মেয়র আবু সালার সিকান্দার এর ছোট ভাই আবু সজল সিকান্দার এর সাথে।
সজলের ইশারায় কয়েকজন মেয়ে এসে তাকে ডেকে নিয়ে যায়।
সজল ভানুকে নরমালি তার নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করে । ভানুও সরলভাবে উত্তর দেয়। সজলের সঙ্গে দাড়িয়ে থাকা ছোট্ট সাফিন বলে,,
– এ কাকা, তুমি অরে কিছু বললা না ক্যান?
– কি বলব ব্যাটা?
– অন্য গরে জালাও যেদিনি আসি ওদিনি দেখি জ্বালাও। অরে জ্বালাইলা না কেন?
– আমি হের প্রেমে পইরা গেছিগা! অরে বিয়া কইরা বউ বানামু। বউরে কেউ জ্বালায় নাকি?
– জ্বালায় না?
– না।
তারপর বেশ কিছুদিন ধরে সজল ভানুর পিছু নেয়। কিন্তু সজল ছিল সামিরের মতো বখাটে! তবে এত ডানপিটে না। ভার্সিটির সবাই তাকে ভদ্রলোক বলেি জানতো। কারণটা খুবি সোজা। তার শয়তানি কোনোদিনো বাইরে আসেনা। সালার সিকান্দার আসতে দেয়না ।
সজল ভানুকে পছন্দ করে এটা ওবায়দুল খুব ভালো করে বোঝে। এর কারণে মাঝেমধ্যেই ভানু আর ওবায়দুল এর ঝগড়া লেগে থাকে।
একদিন সন্ধ্যা বেলা সজল মাতাল হয়ে থাকা সালার সিকান্দার কে আনতে গিয়েছিল ।
তখন সে বেশ সুদক্ষ চোখে দেখতে পায় ওবায়দুল কবির
কালকুঠুরি থেকে বের হচ্ছে । সজল জানতো ওবায়দুল ভানুর প্রেমিক। নিশ্চয়ই এতে ঘাপলা আছে।
সে সোজা সালার সিকান্দার কে জিজ্ঞেস করে,,
– ভাই, এই ওবায়দুল কাউয়া এখানে কি করতে এসেছিল? একে চেনো কি করে?
– চিনিনা। সে একটা রিপোর্ট করতে এসেছিল। আরে মেয়রের কাছে মানুষ আসবে এটাই স্বাভাবিক। সবাইযে কালকুঠুরির সালারের কাছে আসবে এটাতো ভাবা অনুচিত ছোটন।
– ওহ। আচ্ছা ভাই শোনো, আমার একটা ছুড়িরে খুব মনে ধরছে। এনে দেওনা। মেল্লা সুন্দরী দেখতে। ভদ্র সভ্য।
– তাই নাকি? নাম কি? কিসে পড়ে?
– ভানুমতী শিকদার। আমাদের ভার্সিটিতে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
– ঠিকাছে দেখব। বাড়ি যা।
সজল সেখান থেকে বাড়ি চলে যায়। কিছুদিন পর, ভার্সিটি গিয়ে শোনে বানু অসুস্থ। সেদিন সাথে দুটো মেয়ে বান্ধবী নিয়ে ভানুকে দেখতে যায় । সঙ্গে সাফিনও ছিল। ততদিনে সজলের সাথে ভানুর মোটামুটি ভালো সম্পর্ক। সাফিনকেও আদর করত ভানু।
কালকুঠুরি পর্ব ৩৩
ভানুর বেশ ভালোই যত্ন করে সজল। মনে মনে ভাবে, ওবায়দুল একবারো দেখতেতো এলোই না। একটাবার খবরো নিলনা। ভানু যখন ঘুমিয়ে গেছে সাফিনও তার কোলের মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে যায়। সজল মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রয়। দনুকের মতো বাকা ক্লান্ত শরীর এলিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পরে।
ঘুম যখন ভাঙে ওবায়দুল সামনে দাড়িয়ে। তখন কিছু না বলে সে সোজা চলে যায়। সজলকে মোটামুটি ভয় পায় বলা যায়। সেজন্য কিছু বলার সাহস করেনা।
