কালকুঠুরি পর্ব ৩৮
sumona khatun mollika
রাত ঢলেছে নিজ ধারায় । ঘরের মধ্যে একটা মোমবাতি জ্বলছে। বিদ্যুৎ নেই বেশ খানিকক্ষণ। মাহা রাতের নামাজ শেষে মাত্র উঠে দাড়িয়েছে। আবারো মাথা ঘুরে বমি চলে আসে। দৌড়ে গিয়ে বমি করে ফেলে৷ সামির বসে বসে ছবি আঁকাচ্ছিল৷
সেও হতবাক হয়ে যায়। মাহা ফেরত আসলে দুই হাতে গাল আকড়ে বলে,,
– কি হইছে তোমার? এই দিবা,, দিবা,, দিবাআ!
– উমম?
– শুনতে পাচ্ছোনা? গলা ফেড়ে ডাকছি? কি সমস্যা?
– তেমন কিছু না। মাথা টা ঘুরছে।
– সত্যি বলো? ডক্টরের ওষুধে কাজ হয়নি?
– না এমনি মাথাটা একটু ঘুরে উঠেছে।
– এখন ঠিকাছো?
– হ্যা। সরে দাড়ান গন্ধ আসছে আপনার গা দিয়ে ।
– জামা বদলে আসবো একটা শর্তে।
– কিসের শর্ত ফের?
– এই শাড়িটা পড়। সেদিন তো ভালো করে দেখতেই পারিনি শাড়িটা স্যুট করেছে কিনা? পড়। ত্যাড়ামি কোরোনা।
– আবারো সবুজ শাড়ি?
– সমস্যা কোথায়?
– আমি শাড়ি পড়তে পারিনা।
– আমি জানি । আমি সাহায্য করব। অত স্টাইল করতে বলছিনা যেভাবে সেভাবে পড়লেই হলো।
– পারবোনা। ঘুম ধরেছে ।
– ত্যাড়ামি কোরোনা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সামির নিজের জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। ইচ্ছে করে দেরি করে বের হয়৷ মাথা মুছতে মুছতে আয়নার দিকে চেয়ে রয়। টেনেটুনে মোটামুটি করে শাড়িটা পরেছে মাহা । সামির তোয়ালে টা ফেলে ধিরে ধিরে তার দিকে এগিয়ে যায় । গলার সোনার চেনটা খুলে দেয় । চুলের হাতখোপা ছেড়ে দেয়। হাতদুটো টেনে মোটা মোটা দুটো রুলি বালা পরিয়ে দেয়। মাহা তেমন একটা বাধা দেয় না। সামির তাকে টেনে নিয়ে বারান্দায় দাড়ায়।
– এভাবেই দাড়িয়ে থাকো । আমি ছবি তুলবো।
– কেন?
– কেন আবার? মন চাইছে,,, দাড়াও
কথাগুলো বলেই সামির নিজের ফোন বের করে নানান এঙ্গেল থেকে ছবি তুলল। মাহার বিরক্তি লাগলেও প্রকাশ করছিলনা। সামির বুঝেও না বোঝার ভান করছিল। সে শুধু এদিকে ঘোরো ওদিকে ফেরো বলে বলে তার ছবি তুলছিল ।
– হয়েছে? শেষ করুন। শরীর খারাপ লাগছে। ঘুমাবো।
– আচ্ছা যাও।
সামির বারান্দা তেই দাড়িয়ে গ্যালারি ওপেন করে নিজেই অবাক হলো। ইতিমধ্যেই ৭৩৮ টা ছবি তুলে ফেলেছে। অবাক কান্ড মাহাও এতখন কিছুই বলেনি। চুপচাপ সামিরের কথা শুনেছে। প্রথমে ভাবলো বেছে বেছে ডিলেট করবে কিন্তু রাত আড়াইটা পর্যন্ত ঘুরেও সে কোনো ছবি খুঁজে পেলনা যেটা ডিলিট করতে মঞ্চায়। তারপর ধিরে ধিরে ভেতরে গিয়ে ঘুমন্ত মাহার পাশে শুয়ে পরল। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে গাল টেনে নিঃশব্দে হাসলো হিহি করে। চুলটুল এলোমেলো হয়ে অদ্ভুত দেখা যাচ্ছে তাকে। সামিরো চুপচাপ ঘুমিয়ে গেল।
পরেরদিন ভোরবেলা ,, ইনায়া আর সিভান ওপর থেকে নামছে। ইনায়া সিভানকে বলে,,,
-চল একটা খেলা খেলি,, মাহা যখন এদিক দিয়ে যাবে,, আমরা ভাউ করে সারপ্রাইজ দেব।
-না ইনু,, সারপ্রাইজ এর বদলে কাকি সুন্দরী যদি ভয় পেয়ে যায় তাহলে? আর সিঁড়ি থেকে পড়েও যেতে পারে। কাকা জানে মেরে দেবে। চলো এখান থেকে ।
ইনায়া বড্ড হতাশ হয়। এই সিভান দেখতে বলদ কিন্তু ভিষণ স্মার্ট ! ব্রেকফাস্ট শেষে সে সোজা ক্লাবের দিকে চলে যায়। সামিরের আসতে এখনো দেরি হবে। হয়তো ঘুম থেকে ওঠেইনি এখনো। উদ্দেশ্য মতো প্রথমেই তার দেখা হয় সোমার সাথে । সোমাকে সবটা বললে সোমা বলে, রাগিবকে এই বিষয় এ জ্বালানোর কি প্রয়োজন, আমি আর তুমিই সামলে নেব। কি করতে হবে আমি বলছি,, সোমার বলা পুরো প্ল্যানটা ইনায়া বড্ড মন দিয়ে শোনে তারপর তার লোমকূপ দাড়িয়ে যায়! ঢোক গিলে বলে,,,
– কিন্তু আপু , এতে তো বাচ্চাটার ক্ষতি হবে।
-হোক! সমস্যা নাই তো। ওটা শুধু সামিরের বাচ্চা নয়, ওতে মাহার অংশ রয়েছে। ভুলে কি করে গেলে। মাহা না থাকবে বাচ্চা না থাকবে দুজনার কোনো কানেকশন !
– ঠিকাছে। তবুও একবার রাগিব ভাইরে জিজ্ঞেস করলে মনে হয় ভালো হতো। বড্ড রিস্কি ব্যাপার!
-কোনো দরকার নেইত। ও মানাই করবে কারণ সামির যদি জেনে যায়!
– জানবেনা বলছ?
– বলছি।
– ঠিকাছে।
সিয়াম বাড়িতে ঢুকেই নুসরাতের হাত দরে হইহই শুরে করে দেয় । দীর্ঘ চেষ্টার পরে তার ভিসা ইস্যু হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী সপ্তাহে তারা মালয়েশিয়ায় রওনা করবে। এতদিনের ঝামেলা ছিল নুসরাতের পাসপোর্ট নিয়ে । এখন সব সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। খবরটাতে সবাই খুশি হলেও সিভানের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। একজন একজন করে মনে হয় এভাবেই বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে।
সামিরের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। গলা উচিয়ে নুসরাত কে বলে,,
– এ বাল চুপ করেন তো! সকাল সকাল বাঙ্গিমারা চেচামেচি লাগাইছে।
– এটা সকাল নয়, দুপুর ১২ টা।
– ওই হইলো। চাঙ্গে যাবেন ভালো কথা ভ্যাবানির কি আছে?
– তুমি বুঝবেনা চেচানোর কি আছে! বসে বসে তোমার বাঙ্গির জুস গেল ।
সামির চোখমুখ বেকিয়ে বসে থাকে। কাশেমের কল এলে বেরিয়ে যায়। কাশেম তার উজ্জ্বল চেহারা দেখে বলে,,
– ভাইকি আগেই টাল্লি খাইছেন গা?
– হেট শালা ! ছুঁইই নাই?
– তাইলে কোডিন গিলছেন?
– না। কেন বলত?
– তাইলে মেকাপ করছেন? গালডি এমন লাল লাল হয়া আছে ক্যান?
– এমনেই।
– বুঝছি প্রেমের রঙে ধরেছে। ঘরে পরীর মতো বউ রাইখা আবার কার প্রেমে পরছেন?
সামিরের মেজাজ এবার খানিকটা চটে গেল। চেহারার রঙ বদলে বলল,,
– চল ডিউটি চল।
– এই কাম করতে আর ভাল্লাগে না ভাই!
– ট্যাকা গুলা বুকচার মধ্যে ভরতে তো হেব্বি লাগে।
– তাতো ঠিকি কইছেন ভাই।
– চল!
দড়জা ভিড়িয়ে দিয়ে সাফিন একটা চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসল। রাহা তার পিছে দাড়িয়ে । সালার সিকান্দার সামনে বসে। সালার সিকান্দার চোখের চশমা এটে সাফিনের দিকে তাকালো।
– সামনে জাতীয় নির্বাচন,, সামিরের সাথে আলাদা কথা বলা দরকার।
– এত তাড়া কিসের উপরমহল হুকুম দিক। তারপর নাহলে বিস্ফোরণ গটানো যাবে ।
– উহহু! কোনো প্রকার গ্যান্জাম চলবেনা। নেক্সট টার্গেট তামিম খন্দকার ! গোলমাল নট এলাউড! একদম স্মুথ ভাবে তাকে ধাক্কা মেরে দিতে হবে। তারপর এমপির কুরসি আমার!
– তাহলে সামিরকে কি দরকার?
– দরকার আছে,, শুধু তাকেই নয় এক এক করে আরো অনেককে সরাতে হবে। সে হোক পাপি বা নিরীহ।
– কেন?
– মুভি ট্রেইলার দেখে এলাম ছাদে,, পানি, আগুনকে জড়িয়ে ধরছে,, আগুন নিভে যাওয়ায় আগেই সব পুরিয়ে ছাই বানাতে হবে।
– বুঝলাম না?
– সামিরের বিশ্শাল বড় পিছুটান সৃষ্টি হয়েছে।
– ওই ছুড়ি? ওকেও সালাম দিয়ে দেব।
– উহু! সজল মরেছিল কারণ তার ভেতরে ছোট্ট সাফিন সিকান্দার এর জন্য অঢেল ভালোবাসা ছিল । কিন্তু সামির সিকান্দার এর তা নেই। কিভাবে জানি জানো? কারণ,, আমি নিজ হাতে সেই মাটির পাত্রের গড়ন গড়েছি। সুতরাং তার সেপ আমারি সবচে ভালো জানা। পয়দা তোমার কিন্তু রক্ত কিন্তু এখান থেকে শুরু নয়। ভুলে যেওনা তোমার দাদারা সব রাজপ্রাসাদের জনদরদী রাজা!
– আমরাতো ডাকাত?
– একদম।
– তবে এখন উপায়? আর করণীয়?
– এক ঢিলে দুটো পাখির একটাকে উড়িয়ে দিতে হবে। আর অপর টাকে মারতে হবে।
– কিভাবে?
– ব্যাঙের পিছে সাপ ছেড়ে দাও, সাপকে বাজ তুলে নিয়ে যাবে।
– বুঝে গেছি। কিন্তু সিয়ামরা আগে পার হোক ।। ঝামেলা শেষ হোক।
সাফিন মাথা নাড়ায়। রাহা চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। অর্থাৎ কাল যে ছায়া সরে গেছিল সেটা ছিল সাফিন সিকান্দার
ইনায়া মাহার সাথে আবার অস্বাভাবিক আচরণ করছে। হুট করে রেগে গেছিলো হুট করে আজ আবার আগের মতো হয়ে গেছে। মাহা সেটা বেশ খেয়াল করেছে। আর সে এটাও জানতে পেরেছে, মাহার রিপোর্ট কার্ড ইনায়া সরিয়েছে। কুব বেশি জানার কিছু নেই তবে, মাহা নিজের প্রেগনেন্সি শিওর করতে পেরেছে। মাহা খুব চিন্তায় পরে যায়। সবাই এখন বাচ্চাটার পেছনে উঠে পরে লাগবে, কি করা যায়! সামির সিকান্দার কে বলে দেব?
বেলা গড়ায়। মাহার পরীক্ষা আজ মাত্র শেষ হয়েছে। আজ সামিরের কোনো দিশা নেই৷ মাহার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। শিওর সে আবারো কোনো কুকির্তি করতে গেছে। হয়ত ড্রাগ ডিলেই গেছে। এসব কি কোনোভাবে আটকানো যায়না?
রিক্সাওয়ালা বলে,,, রিক্সা খারাপ হয়ে গেছে ভাবিজান সামনে যেতে পারবেনা। অন্য রিকশা ধরেন।
মাহা রিকশা থেকে নেমে যায় । উল্টো ঘুরে দাড়াতেই ওপাশ থেকে দৈড়ে আসা এক মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে আটকে যায়। ভারি সুশ্রী রূপ তার। বগবগা ফর্সা মেয়েটা। মেয়ে টা তাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,,
– আপনি সামির সিকান্দার এর বউ না?
মাহা কিছুখন চুপ করে থাকে। কি আজব ব্যাপার যেই দেখে সেই বলে,, সামির সিকান্দার এর বউনা?
মাহার খুব বিরক্ত লাগত। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই তেমন কিছু মনে হয় না । গুনে গুনে দশটা মাস পেরিয়ে গেছে সেই দুর্ঘটনার আজো বুকটা কেঁপে ওঠে। কিভাবে মানুষ জন তাকে অপমান করেছিল৷ সামির সিকান্দার এর প্রতি ঘৃণার মাত্রা যখন কমতে শুরু করে তখনি দুইটা কান্ড ঘটে এক সামির আবারো কোনো পাপ কাজে বেরিয়ে যায় নাহলে দুই মাহার সেইদিনকার ঘটনা মনে পরে। মেয়েটা হাত নাড়িয়ে বলল,,
– আপু??
– জ্বি! আপনি কিভাবে চেনেন?
– বর্ণনাতে চিনি। শুনেছিলাম তার বউয়ের চোখজোরা নাকি ভারি সুন্দর । ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ বাদে সব কালো পোশাকে ঢাকা থাকে। আপনিও ঠিক তেমনই।
– কালো পোশাক তো আরো অনেকে পরে।
– পরে। কিন্তু এই গলিতে কেও পরেনা।
মাহা খেয়াল করে সে যেখানে দাড়িয়ে আছে, হাতের ডান পাশে লাল গলির রাস্তা । কি মনে হয়ে মাহা বলে,,,
– তোমাদের বাহিরে আসার অনুমতি আছে?
– হ্যা৷
– তাহলে তোমরা পালাওনা কেন?
– কারণ আছে৷ আপনার মতো পর্দা করার বড্ড শখ ছিল আমার।
– করোনা কেন?
মেয়েটা কেমন একটা তুচ্ছ হাসি দিয়ে বলল,,
– বেশ্য*র আবার পর্দা!
মাহা তার কথা শুনে বোঝে মনে মনে বড্ড ব্যাথিত সে। মাহা দু সেকেন্ড কিছু ভেবে বলে,,
– আমি তোমাদের কুঠিরির মেয়েদের সাথে দেখা করতে চাই। আমায় তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো৷
– নানা আপু। আপনি এই অন্ধকার কুঠুরিতে যাবেন না। তার অভিশাপ খুব খারাপ।
– আমি সৃষ্টি কর্তায় বিশ্বাসী। আমার কিছু হবেনা চলো।
– কিন্তু সামির সিকান্দার সেটা মোটেও পছন্দ করবেনা।
– আমার ব্যাপার। শুনেছি সোমবার তোমাদের ছুটি থাকে? আজতো সোমবার । চলো,,
মেয়েটা আর কোনো কথা বলেনা মাহাআগে আগে হাঁটতে থাকে। তারপর মেয়েটাও তার তালে তাল মেলায়। যেতে যেতে পথে জানা যায় , মেয়েটার নাম লামু। তার বাড়ি সুদূর বরিশালে। বাবা- মা কেও নেই। চাচার কাছে তাকে পালা বোঝা হয়ে যাচ্ছিল। চাচি সহ্য করতে পারতোনা। চাচির ভাই সালার সিকান্দার এর পরিচিত । যেহেতু তখন একদম যুবতী ছিল, মেলা দেখাতে নেয়ার নাম করে চাচি তার ভাইয়ের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে এই কালকুঠুরি তে বেঁচে দিয়েছিল। এবং তার প্রথম জম ছিল সাফিন সিকান্দার ।
মাহার চোখমুখ গুলিয়ে ওঠে ঘৃণায়। টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে তারা কালকুঠুরি পেরিয়ে কালকুঠুরি ২ এ পৌঁছে যায়। সেখানকার ছোটবড় সকলে তাদের অদ্ভুত নজরে দেখতে থাকে। দৌড়ে আসে রামিশা মেয়ে টা।
– সেকিগো? তুমি আবার এসেছ?
পর্দার ওতে ঢাকা মাহার চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে কয়েকজন হাসাহাসি করছে। তারা ভেবেছে মাহা নতুন শিকার। তখন লামু মেয়ে টা গলা উচিয়ে বলল,,,
– হাসাহাসি বন্ধ করো সবাই। এ কোনো সাধারণ মানুষ না। এ সামির সিকান্দার এর বউ।
কথাটা বলতেই জনতা তাদের ঘিরে ধরে যেন কোনো সেলিব্রেটি। মাহার ফোন বাজে। নুসরাত ফোন করেছে। মাহা এখনো বাড়ি ফেরেনি তাই। মাহা জবাব দেয় তার ফিরতে দেরি হবে।
নুসরাত উল্টে কোনো জবাব চায়না।
মাহাকে ঘিরে সবাই তাকে আপাদমস্তক দেখতে থাকে। একদম কালো রঙের কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট দুটি চোখ। বাকিনেই হাত দুটোও। মাহা জিজ্ঞেস করে,,
– আপনারা এখানে আমার ছোট বড় সবাই আছেন। আপনাদের সবার উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন সুযোগ পেয়েও পালান না কেন?
লামু মাথার ঘোমটা ফেলে লম্বা বেনি দুলিয়ে সামনে দাড়িয়ে জবাব দেয়,,
– কোথায়? কোথায় পালাবো! মেজিস্টিস সাহেবা? আপনাকে আমরা চিনি। সব জানি। খবরা খবরও জানি। কিন্তু আপনি আমাদের চেনেন? হ্যা চেনেন। এক পরিচয়ে। এরা সব কালকুঠুরির পতিতা। বাইরেও আমাদের একি পরিচয় ,, এরা কালকুঠুরির মেয়ে । এক একজন বেশ্যা!
– তারাকি মানুষ নয়?
– না মেজিস্টিস সাহেবা তারা মানুষ নয় তারা চরিত্রহীন, তারা বেশ্যা। তাদের মানুষ বলা যায় না। দেখতে পাচ্ছেন আমাদের? আমরা সবাই কিন্তু জোর করে ধরে আনা নই। ওদিকে দেখুন ,,
ইশারা করতেই নারীরা সরে গেলে একদল শিশুকন্যা দেখা দেয়। কি অদ্ভুত তাদের মুখশ্রী। মায়াপরী একেকজন৷ লামুর বয়স মাহা থেকে সামান্য একটু কম। হয়তো ৩, ৪ মাসের। সে বাচ্চাগুলো দিকে ইশারা করে বলে,,,
– দেখুন এদের এরা পয়দায়িশি বেশ্যা। সর্বচ্চ চৌদ্দ কি পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত এরা এদের সতিত্ব ধরে রাখতে পারে। এদের কোনো বাবা হয়না। এদের কোনো বংশ পরিচয় হয়না। জিজ্ঞেস করুন এখানে কোনো পুত্র নেই কেন? শুধু কন্যা শিশু কেন? কারণ পুত্র শিশুদের মানুষ কেনে। নারীর দাম এ সমাজে এতই নিচ, যে তাদেরকে মাগনা দিলেও কেও নিতে চায়না। কতগুলো মেয়ে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে অপরিপক্ক বয়েসে গর্ভধারণের জন্য । এদের মধ্যে অনেকে অনাথ । ৷ কিন্তু তাদের রেখে দেয়া হয়েছে কারণ তারা চাঁদের মতো ঝকঝকে রূপ নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে । আর যারা কালো বা শ্যামলা, তাদের ঠাই হয়েছে কোথায় জানেন? কালকুঠুরির মৃতডোবাতে। সেই ডোবাতে ওই বাচ্চাগুলো কে জীবিত ফেলে আসা হয়। যেই ডোবাতে ভয়াবহ আসামি দের স্হান হয় সেই ডোবাতে নিষ্পাপ ফুলের পাপড়ি গুলোও ঠাই পায়।
মাহার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। যতটা ভয়ানক সে ভেবেছিল তার চেয়ে কয়েকগুণ বারিয়ে ভয়াবহ আর নৃশংস সিকান্দার রা। লামু বলে,,
– আরেকটা প্রশ্ন আপনি করবেন জানি। ঠিকনা?
– বয়স্করা কোথায় যায়?
– হ্যা এটাই। বয়স্ক রা। আমরা বয়স্ক হওয়ার অধিকার রাখিনা । মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্যি কিছু নেই। তবে কার মৃত্যু কবে হবে কেও জানেনা তাইনা মেজিস্টিস সাহেবা? আমরা জানি। আমাদের মৃত্যু দিবস আমরা জানি। আমাদের মৃত্যু হবে ঠিক যার যার ৪০ তম জন্মদিনের রাতে। সেদিন সোমবার রবিবার কিচ্ছু গ্রাহ্য করা হবেনা। পূর্ণিমা অমাবস্যা কিচ্ছু মান্য করা হবেনা। সেদিনি হবে আমাদের মৃত্যু দিবস।
মাহা থমকে যায়। মানে এরা শুধু ৪০ বছর বয়েস পর্যন্ত বাচতে পারবে!
– জানেন মেজিস্টিস সাহেবা,, আমরা কালকুঠুরির মেয়ে বলে,, মৃত্যু পথেও কেও আমাদের সাহায্য করে না৷ আমাদের জন্য ঔষধালয় এর দোরও খোলা থাকে না। জানতে চান ওরা আমাদের চেনে কিকরে? কারণ আমাদের সবার হাতে,, এই দেখুন এমন দাগ আছে। কিসের দাগ জানেন? গরম রড পুড়িয়ে ঠেসে ধরা হয়। দাগ হয়ে গেলে ছেড়ে দেওযা হয়৷ ওই শিশুদের ও তাই। যার দরুন সামির সিকান্দার আমাদের একটা দোকান লাল গলির মোড়েই বসিয়ে দিলেন। কেও পাত্তা না দিলেও সে অগ্রাহ্য করেনি। কারণ, যদি অসুস্থ হয়ে মরতে থাকি, ব্যাবসার কি হবে? লালবাতি,
আমাদের বলছেন হাসিখুশি? আমাদের মুখ হাসে বুক ফাটে। চোখের তরল গড়ায় না। হৃদয়ের রক্ত গড়ায়। আমাদের বাঁচানোর কেও নেই। কারণ আমরা বেশ্যা। আমরা মানুষ নই মেজিস্টিস সাহেবা।
– কে বলেছে কেও নেই? মানুষের সবচে বড় শক্তি মানসিক শক্তি। তোমরা একজোট হলেই কিন্তু সমস্যা দাপটের সাথে মোকাবিলা করতে পারো।
-কিন্তু কোনো সাহারা নেই । নেই কোনো উছিলা।
-ছিলনা। এখন থাকবে। আর দুটো বছর তোমাদের কষ্ট করতে হবে। পারবেনা? আমি বাঁচাবো তোমাদের। ফিরিয়ে দেব স্বাভাবিক জীবন।
কয়েকজন বেযাদবের মতো হাসলো। তবে রুমাশা এগিয়ে গিয়ে মাহার হাত ধরে বলল,,
-আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। করব অপেক্ষা । তুমি আমাদের সত্যি স্বাভাবিক জীবন দিতে পারবে? তোমার মতো এই সুন্দর কালো কাপড় পড়ার অধিকার সৃষ্টি করে দিতে পারবে?
– পারবো ।
– তবে আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।
বাকিরাও একজন একজন করে বলতে লাগল,, আমরাও করব আপনার অপেক্ষা । মাহা সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে পা বারালো।
আগামীকাল মঙ্গলবার সিয়াম আর নুসরাত ঢাকা যাবে। পরশু বিদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। মাহা নুসরাতের ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে বলে,,
-ভালো থেকো আবার জানিনা কবে দেখা হবে।
নুসরাতও ইমোশনাল হয়ে তার সাথে মনের সুখের দুঃখের কটা কথা বলে ঘুমিয়ে যায়। ঘরে আসতেই দেখে সামির টেবিলে বসে আছে ।
– কিসের গিবত করছিলে দুইযা মিলে? শশুড়িরা তো কবে পটল তুলেছে। দিবা,,
-হুমমম?
– দেখত কেমন হয়েছে?
-এটাকি আমার চিত্র একেছেন? খুবই জঘন্য হয়েছে। ঠিক আপনার মতোই।
– আগ বারিয়ে সুরসুরি দিচ্ছ কেন? কুত্তা কামড়াইছে?
– আপনি কি ভেবেছেন বলুন তো? একটা শাড়ি পড়ে নিলাম দুটো কথা শুনলাম, একটু মায়া দেখালাম তার মানেকি আমি সব ভুলে গেছি?
সামির খাতাটা ছুড়ে ফেলে ধিরে ধিরে মাহার দিকে এগিয়ে গিয়ে গিয়ে কোমর পেচিয়ে ধরে কানের কাছে মুখ দিয়ে বলে,,
– আমাকে উত্তেজিত কোরোনা দিবা। তোমার কথায় আমার রাগ হচ্ছে না চুলকানি হচ্ছে ।
-আমার জবান আমি কি বলব না বলব আপনার পারমিশন নেবনা।
সামির মাহার দিকে সুক্ষ চোখে তাকায়। মাহা বুকের ওপর ধাক্কা মেরে তাকে সরিয়ে দেয়।
– যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারেন। আমার কোনো মুড নেই আপনার সাথে ঝগড়া করার।
-তোমার কি হয়েছে?
– আপনার কি হয়েছে? আপনার কিন্তু স্যালেন্ডার করার কথা ছিল। আপনি কথা রাখেননি। একটা কথা রাখবেন? আমাকে তালাক দিন। আমি আপনার সাথে থাকতে পারছিনা। আপনার প্রতিটি কথাও আমার বিষাক্ত মনে হয় ।
কালকুঠুরি পর্ব ৩৭
সামির এবার মাহার গলা টিপে ধরে বলে,,
– কখনো না। কি মনে করেছিস আমি তোর দেওয়ানা দিলওয়ালা হয়ে গেছি? জীবনেওনা। তালাক তাইতো? এত সহজে তোকে ছেড়ে দিলে হবেনা। সুতোয় বাধা জীবন ছেড়ে পালাবি কোথায় !
সামির রেগেমেগে বেরিয়ে যায়। মাহা কাদেনা একটুও না । বারান্দায় দাড়িয়ে ভাবতে থাকে যেভাবেই হোক তাকে আর দুই বছরের মধ্যে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। অনার্সের পর সোজা বিসিএস এ এপ্লাই করতে হবে। তারপর সরাসরি আইনবিভাগে।
