কালকুঠুরি পর্ব ৪০
sumona khatun mollika
জুন,২০২৪
নতুন ইন্সপেক্টর জোভান, রাজপাড়া থানা, রিপোর্টিং স্যার।
স্যার, এসব থামাচ্ছেন না কেন? সামির সিকান্দার আবারো এক ভয়াবহ খুন করেছে। সে এভাবে পুরো রাজশাহী মৃত্যু ঘাটে পরিনত করে দেবে।
ইন্সপেক্টর জোভানকে থানার ওসি নিহাল দত্ত চোখ বড়বড় করে দেখে বললেন,,,
” তুমি তাকে ধরে এনেছ? ”
” জ্বি স্যার । আমরা তার এক চেলাকে স্বহস্তে ২ কেজি ইয়*বা সমেত ধরেছি। ছেলেটার নাম লেমন। এবং সে বেশ কয়েক বছর ধরে সামির সিকান্দার এর দাসস! তার সাক্ষী তেই আমরা সামির সিকান্দার কে অ্যারেস্ট করে এনেছি ”
” ওহহ, শিট**! বলদ কোথাকার! তোমার বাড়িতে ফোন দাও দ্রুত দ্রুত দ্রুত! ”
জোভান ফোন আনলক করে দেখল বাড়ি থেকে শখানেক মিসড কল। হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে পোন করতেই ওপাশ থেকে তার স্ত্রী চেচিয়ে উঠলো,
” কে বা কারা যেন এসে মা আর খুকিদেরকে তুলে নিয়ে গেছে ”
নিহাল দত্ত ফোন কেড়ে নিয়ে বলল,,
” মেডাম, মাথা ঠান্ডা করুন। তাদের মধ্যে কাওকে পেলে, হ্যালো? হ্যালো?”
” কাশেম হালদার বলচি নিহাল! ”
” ছোট ভাই, ইনি নতুন এসেছে জানতোনা। ওনাদের ছেড়ে দাও। আমি এখনি সামির সিকান্দার কে বাড়ি পৌছে দিয়াসছি ”
” ভেরি গুড ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কাশেম ফোন রেখে দিতেই নিহাল দত্ত ক্ষেপে গিয়ে বললেন,,
– সমস্ত রিপোর্ট চেক না করে কাকে ধরে এনেছ জানো, যার জন্য সকল আইন নিষিদ্ধ । তাততাড়ি চলো, নাহয় লাশ পরতে সময় লাগবে না।
জোভান মাত্র পনের দিন হয় জয়েন করেছে। তাই তার সকল তথ্য জানা নেই। সামির সিকান্দার কে কেও ধরতে পারেনা তাকে যে ধরার চেষ্টা করে তার হাতদুটো আজীবনের জন্য নামিয়ে দেওয়া হয়। নিহাল দত্ত হুড়পাড় করে শেলের দড়জা খুলে সামনে বসা সামির সিকান্দার কে বলল,,
– ক্ষমা করবেন ভাই। নতুন তাই ভুল করে ফেলেছে। দযা করে কারো ক্ষতি করবেন না। প্লিজ।
সামির ঘাড় নেড়ে একবার নিহাল দত্তের দিকে তাকালো,, কোনো রিয়েকশন নেই।
” ফোন লাগাও। ”
” জ্বি ভাই ”
” হ্যালো? ”
” কাইশসা? ”
” জ্বে ভাই। আপনে কই। অরা ছাড়ছে? ”
” আমি দুদিন থাকব এখানে। ”
” কিন…. ”
” আমি দুদিন থাকব এখানে। ”
” জ্বি ”
কল কাট করে সামির নিজের লাল শার্ট টা খুলে ওসির দিকে ছুড়ে মারে। সে সেটা ক্যাচ করে সবাইকে বাইরে বের হতে বলে।। সামির গলা উচিয়ে বলে,,
” তালা মেরে যেও ”
” জ্বি। ”
নিহাল দত্ত বাহিরে এসে জোভানকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করে বলল,,
– সে বড্ড গম্ভীর । তাকে ধরাছোঁয়া নিষিদ্ধ। যে বা যারাই তাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করে , তার দলের ছেলেরা তাদের মেরে পদ্মায় ভাসিয়ে দেয়।
– এরাতো তবে ভয়ানক আতঙ্কবাদী স্যার। সঙ্গেই ড্রাগস ডিলার। উপরমহল থেকে কোনো নাড়াচাড়া হয় না?
– এর ওপরে আরেকজন আছে। এমপি সাফিন সিকান্দার। সামির নিজের হয়ে কোনোদিনও সাফাই গায়না। সাফিন আর তার দলের ছেলেরাই সব সামলে নেয়। উপরমহল কি বলছ, রাজশাহীর বাইরেই যায়না খবরাখবর। তাছাড়া, কমিশনার, ডিআইজি সকলে ওদের দলে । তবে আশ্চর্যের বিষয় কি জানো? সামির সিকান্দার আগের থেকে আরো ভয়ানক খুনি হয়েছে। তবে আগে টাকার বদলে যে কাউকে মারানো গেলেও এখন সে নারী আর শিশুর দিকে হাত তোলেনা। তবে তাদের যে পরিমাণ ক্ষতি করে তার চেয়ে মৃত্যু ভালো।
– আমার বউ বাচ্চাকে মেরে দেবে নাতো স্যার?
– মারবে না।
– এ কি মানসিক ভাবে অসুস্থ স্যার?
– তাতো জানিনা। তবে একদম ভয়াবহ সাইলেন্ট কিলার। সবাই জানে সেই খুন করেছে তবে, কোনো প্রমাণ বের করা যায় না।
২দিন নিজ মন মতো জেলখানায় থেকে সামির নিজে নিজেই বাড়ি ফিরে যায়।
সামির নিজের ঘরে বসে নিজের খাতায় কি যেন আঁকাআকি করছে। পেজটা ছিড়ে ফেলে আবারো পেন্সিল ঘষতে লাগলো খাতায়। আজ বহুদিন পরে কাশেম দেয়াল টপকে এসেছে সামিরের ঘরে। সামির এখন আর বারান্দা টপকায় না। দড়জাই ব্যাবহার করে। কাশেম বলে,,
– ভাই,, ভার্সিটিতে গোলমাল বাঁধেছে। ঢাকা থেকে খবর আইসেছে কোটা আন্দোলন এর জন্যে।ক্যাম্পাসে ছুঁড়া চুড়ি রা বেশ আলোচনা সমালোচনা শুরু করেছে। দন্দতো লাগলো বলে। এ বিষয়ে কিছু কইবেন না?
– কি বলব?
– কেমন কথা যে কি বলবেন? আপনি কি দলের দিকে থাকবেন ভাই?
– জানিনা ।
– কিন্তু সাফিন ভাই জীবনেও ছাত্রদের পক্ষ নিবনা। আমি খালি ভাবতাছি এইযে এরা এত বাড়াবাড়ি করতাছে,, মাইরা দিলে শখ মিটবো। কেন জানি মনে হইতাছে এসব লিয়া বড়সড় ঝামেলা লাইগা যাইবো। তারওপর আরেকটা খবর আছে ভাই। কালকুঠুরির মাইয়াডি নাকি আর মাইর খাওয়ার ভয়ও করেনা। গত তিনমাস ধরে একটা বেডারেও ঢুকতে নেয়নাই৷
– মজা করার ইচ্ছে নাই।
– মজা না ভাই সত্যি । আপনি তো আর খবর রাখেন না। রাগিব দেওয়ান আর সাফিন ভাইতো দেশের বাইরে। তবে লেমন আর মারিয়া আপা গেছিলো,, যাইয়া দেখে দাসগুলা মাইয়াদের কথা শুনতেছে। জিগাইছে কি হইছে অরা কয় মাইযাডি নাকি তাদের ঠেঙায়ছে।
– কি বলিস!
– হ ভাই। শুনলাম অরা যারা পড়াশোনাই জানেনা হেরাও কোটা আন্দোলন ঘিরে কথা বলতাছে।
– বাইরে যায়?
– যায়। লাল গলির বাইরেও যায় তবে কাওরে কযনা যে হেরা কালকুঠুরির মাইয়া। এই ইয়া বড় বড় হাতার পোশাক পরে তারা কুঠুরির পোড়া চিহ্ন দেখা যায় না ।
– ভার্সিটিতে কি হইছে?
– কোটার কাছে মেধা ডুবে যাচ্ছে । পরীক্ষা দিয়ে যথেষ্ট নাম্বার পেয়েও অনেকে চান্স পায়না। এত কষ্ট করে পড়া, খরচ সব বৃথা যায়। কিন্তু অন্য দিকে যাগের কোটা আছে,, হেরা নাম্বার কম পাইলেও কোটার টানে ঠিক উঠে যায় । আন্দোলন আন্দোলন রবই উঠছে ঢাকায় । ভার্সিটির প্রিন্সিপাল বা ভাইস প্রিন্সিপাল কেও কিন্তু এ ব্যাপারে টু শব্দও করতাছে না। । সতভাবে যদি বিবেচনা করে বলি,, তবে কোটা তুলে দেয়াটাই যুক্তিগত ভাই।
– আন্দোলনে যাচ্ছিস?
– আপনে যেদিকে আমিও সেদিকে।
সামির কিছুই বললনা। হাতের ইশারায় কাশেমকে চলে যেতে নির্দেশ দেয় ।
একটুপর সিভান ঢোকে ঘরে৷ সে এখন এক সুদর্শন তরুণে পরিণতি পেয়েছে। সে ঢুকে সোজা বিছানায় গিয়ে বসে।
-এ কাকা কি আকালে? দেখাও আমায়,,
-দেখানো যাবেনা।
-বুঝেছি কাকি সুন্দরীর ছবি। আমায় কেন দেখাওনা?
– কারণ অয় পর্দা করে৷ কাওরে চেহারা দেখায়না। অর চেহারা দেখার অধিকার শুধু আমার।
সিভান কেমন একটু ব্যাথিত হাসি হাসে। সামির ধিরে ধিরে উঠে বিছানায় গিয়ে সিভানের পায়ের ওপর মাথা রেখে বলে,,
– আমার কপালে সুখ কেন সয়না সিভু? আমি বাবা হতাম। আমার একটা ডুপ্লিকেট কপি থাকতো। হয়তো আমার মতো দেখতে হতো। তবে আমি কখনো তাকে সামির সিকান্দার এর জীবন দিতাম না। আমি সেই সুযোগটুকুও পাইনি।
– এ কাকা,, দক্ষিণ পাড়ার মুলবির ছুড়িটার কথা মনে আছে ? হেব্বি দেখতে৷ বাবা ওকে তোমার জন্য ঠিক করেছে।দেশে আসলেই বিয়া। আরে তোমারই ভার্সিটিতে পড়ে। তিথি নাম।
– কি জন্য ঠিক করেছে?
– তোমার সাথে বিয়ের জন্য।
-আমি কি অবিবাহিত?
-পুরুষ মাইষের ৪ টা বিয়ে করা যায়৷
-আমার ১টাই ৪টার সমান।।
সিভান কিছুখন চুপ করে রইলো। সামির তার ভাব বুঝে নিজেই জবাব দিল,,
– কোন সাহসে সে কথা বলছিস,, আমার চড়ওয়ালী চড়িয়ে দাঁত খুলে নেবে আমার।
– কাকা,, কাকি সুন্দরী,,,
– চোপ বাঙ্গির নাতি, ও একদম ঠিকাছে। ও রোজ আসে, আমাকে বকে, গাল পারে, চড় মারে কিন্তু, কিন্তু দিনশেষে আবারো চলে যায়।
সামির ছাদে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে ঢকঢক করে বিয়ার গিলতে থাকে। সিভান মুখ বেকিয়ে চলে যায়। সামিরের খেয়াল হয় মেঝেতে রাখা হাতটায় কারো আলতো ছোঁয়া। চোখমুখ গুলিয়ে ওঠে। সামির কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,,
– ২ দিন শশুড়বাড়িতে থেকে এলাম। তুমি এলেনা কেন?
– কে বলেছে আপনাকে ওখানে গিয়ে থাকতে?
সামিরের কল্পনায় মাহা তার পাশে গিয়ে বসে। সামির বামহাতে তার গাল ছুঁয়ে দিলে মাহা আবারো আগের মতো স্বরে বলে,,
– ছিঃ গন্ধ আসছে সরে বসুন।
– তুমি গন্ধ পাও? তবে আমি তোমার গন্ধ পাইনা চড়ওয়ালী। গন্ধহীন এ-ই জগৎ এ বেঁচে থাকা দায় হয়ে গেছে।
– বেচে আছেন কেন? আমাকে মনে করেন?
– “” আমি মরে গেলে আপনার চড় খাবে কে চড়ওয়ালী “”!
– আমিতো নেই সামির সিকান্দার !
– কিন্তু আমিযে তোমায় বড্ড কঠোরভাবে অনুভব করি ডিপজলের মা।
– শত্রু হিসেবে আমি কতটা ভাগ্যবতী দেখুন। বিরোধী পক্ষ আমায় হারিয়ে …
– দিশেহারা হয়ে গেছে।। হুমম হেসে নাও, হেসে নাও। আমার অবস্থায় হাসার জন্যেইতো তোমার আগমন ছিল।
মাহা গাল টেনে হাসলো। সামির পাশের থেকে গিটার তুলে নিয়ে টুংটাং করে ভাঙা গলায় ,,
Tere Jaane Ka Gam
Aur Na Aane Ka Gam
Phir Zamaane Ka Gam
Kya Karein?
Raah Dekhe Nazar
Raat Bhar Jaag Kar
Par Teri To Khabar Na Mile
Bahot Aayi Gayi Yaadein
Magar Iss Baar Tum hi Aana
Iraade Fir Se Jaane Ke Nahi Laana
Tum Hi Aana
২০১৮ সাল শেষের দিকে প্রায়। চারদিকে শীতের বেশ ধাক্কা। রাজশাহী উত্তরাঞ্চলীয় হওয়ায় বেশশীত পরে সেখানে।
ইতমধ্যেই লেপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। শীতের দিনে এমনিতেই ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে হয় না তবে মাহা ঠিক নামাজের ডাক শুনে ভোরবেলাতেই খোদার ইবাদতে মশগুল হয়ে গেছে।
নামাজ শেষে দেখে আজকে সামির সিকান্দার বড় শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। আজকি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে না? আবারো গিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পরে। ঘুমের ঘোরেই সামির মাহাকে জড়িয়ে ধরে। মাহা খপ করে চোখ এটে নেয় । সামির হাতিয়ে হাতিয়ে লেপটা মাহার গায়ে আবার তুলে দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। মাহা চোখ খুলে তাকায় , বড্ড সুক্ষ চোখে সামিরের চেহারার গঠন বর্ণনা পরিদর্শন করে।
মনে মনে ভাবে,, সৃষ্টিকর্তা মানুষ বানানোর জন্য মাটি চেয়েছিলেন,, কোনো ফেরেশতা আনতে পারেনি। হযরত আজরাইল আঃ মাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। সামির সিকান্দার কে কোন ধাঁচের মাটি দিয়ে গড়েছিলেন খোদা তায়ালাই ভালো জানেন। ২ রকম মাটি দিয়ে গড়েছিলেন সম্ভবত ।
রঙটা একটু চাপা তবে দেখতে খারাপ না। বাঁশির মতো খাড়া নাকদুটো বড্ড সুন্দর দেখায়।
কখনো ধরা দেয় জঘন্য , খারাপ, রাক্ষস রূপে। আবার কখনো কখনো ধরা দেয় স্বাভাবিক, সুন্দর, নরম এক মানুষ রূপে৷ সামির সিকান্দার, আপনি কি অন্যদের মতো হতে পারতেন না?
তাহলে আমারো একটা সরল সংসার হতো। বেশি কিছু তো চাইনি। শুধু সরল স্বাভাবিক জীবন। সেই সংসারে সঙ্গী নাহয় আপনি হতেন। তবে এই আপনার রূপ স্বামী হিসেবে অযোগ্য সামির সিকান্দার। ।
সামির স্বপ্নে দেখছে,
সে আর মাহা রামচন্ডিপুরের সেই নানির বাড়ির শাপলা বিলের ধারে দাড়িয়ে । মাহা লাল চুড়িদার পরে দাড়িয়ে আছে মুখে সুন্দর হাসি। রোদের ঝলকে মাহার চোখমুখ ঝকঝক করছে। সামির একগুচ্ছ শুভ্র নির্মল শাপলা তুলে এনে মাহার সামনে দাড়ালো। লুঙ্গির খুট খুলতে খুলতে বলল,,
– ওভাবে কি দেখছ?
– আপনাকে।
– আমাকে দেখার তুমি কে?
মাহা গাল টেনে হেসে কোন একটা হিন্দি গানের দুই চরণ শুনিয়ে দেয়,,
Main gudia ban jaaungi
Mere sath tu khelte rehna
Kabhi baaho main jhula jhulana
Kabhi dil se laga lena
Mehbooba main teri mehbooba
Mehbooba main teri mehboob
– তাই নাকি?
মাহা মাথা নেড়ে হ্যা জানায় । চারপাশে নরম বাতাসে মাহার চুলগুলো বাতাসে ভাসতে থাকে,, সামির তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,
– হাআহ,,, জীবন সুন্দর। শুধু মানিয়ে নিতে হয় তাইনা ডিপজলের মা?
সামির?, সামির….. এই সামির….
টপটিপ করে চোখ খুলল সামির একি শান্ত শুভ্র পরিবেশ তার আলো ছায়ায় ঘেরা ঘর কি করে হয়ে গেল! সামনে মাহার জায়গায় সাথি কি করে চলে এলো!
– এভাবে কি দেখছিস?
– আরে শালার বাঙ্গিমারা জিন্দেগী! ওটা স্বপ্ন ছিল!
-কি?
– বাল! স্বপ্নের মইদ্দে বাঙ্গি ক্ষেতে ঘুরতে গেছিলাম। যাবি?
-শখ নাই।
– তাইলে আইসেছিস ক্যান?
– তুই এখানে গরুর মতো পরে পরে ঘুমাচ্ছিস? বাড়িতে পুলিশ এসেছে।
– আমি জানতাম শশুড় মশাই আসিবেন। জামাই আদর করিবেন । সারাটা রাত লেট করিয়াছেন এই কতো।
– কি যা তা বলছিস?
– সর তো যা সর। আমি যাচ্ছি। ঘুমের থেকে উঠাতেই ভজন শুরু করছে। যা।
নিচে পুরো হল ভর্তি পুলিশ। সব সশস্ত্র, সাফিন সিকান্দার বাড়িতে নেই। সালার সিকান্দার ও না। নিশ্চয়ই কালকুঠুরি২ এ গেছে ।
মাহবুব উদ্দিন বেশ কিছু সময় ধরে মাহার সাথে কথা বলছে।
” কেমন আছেন মাহাদিবা? ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো?”
“জ্বি ভালো। ”
“অনেকদিন পর দেখা হলো। আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় সেই বিয়ের এলাহি কান্ডের পর থেকে। ”
” বলুন ”
“আপনি সেদিন বলেছিলেন আপনি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন। কি কারণে একটা অনাথ মেয়ে কে ভালোবেসেছিলেন, নাকি শুধুই সমবেদনা দেখাতে? ”
মাহাবুব উদ্দিন গাল টেনে হেসে ফেলল।
“হাসছেন যে? ”
“ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়া যায় না । তবে আমি মুখে সেদিন বললেও আমি আপনাকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করি মনে পরে,,,? একন এক বৃষ্টির দিনে আপনি আপনার এক সিনিয়র কে ছাতা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন? তার চাপ দাড়ি ছিল, ঢিলাঢালা পোশাক পড়তো। তারপর থেকে বেশ কয়েকদিন যাবত ওই সিনিয়র আপনার পিছু নিত। আপনার এক বান্ধবীর সাথে দক্ষিণ পাড়ায় প্রাইভেট পড়তেন। ”
” হুমম ”
” ভালো করে দৃষ্টি মেলে দেখুন আমার যদি চাপ দাড়ি থাকতো একটু বড়বড় চুল থাকতো,,? ”
” তারমানে আপনি? ”
” আপনার পিছু করা সিনিয়র ”
মাহা আসলেই চমকিত হয়েছে। তার প্রথমে মনে হতো হয়ত সিয়াম সিকান্দার । পরে নিশ্চিত হয় সিয়াম নয়। তারপর আর সে বিষয়ে ঘাটেনি। ওপর থেকে ধূসর রঙা গেন্জি পরতে পরতে সামির বলে উঠলো,,
” পিছু নিয়েও লাভ হয়নি ছক্কাতো আমিই মেরেছি ”
” চলে আসুন সামির সিকান্দার, আপনাকেই নিতে এসেছি। ”
” চলুন আমিও সেজেগুজে তৈরি হয়ে এসেছি। ”
” আপনার ওয়াইফকে সাজাবেন না? ”
” কেন? ”
“ঘটনাস্থলে কিন্তু আপনার স্ত্রী ও ছিল। ”
” হাসালেন শশুড়মশাই ”
মাহবুব উদ্দিন ও তাল মিলিয়ে হাসলো। সামির দুই হাত এগিয়ে দিলে তার হাতে হ্যান্ডকাফ পরাতে পরাতে মাহবুব উদ্দিন বললো,,
– এবারে একটু লং জার্নি জামাইজি। ভুলবশত একটা প্রমাণ ফেলে এসেছেন ।
– ঘড়িটা এক ভদ্রলোকের। ফেরত দিয়েন শশুড় আব্বা।
– কার বলতে পারেন?
– আরেক সিকান্দার এর। সজল সিকান্দার । মেরেছে বহুত আগে। জন্মের আগে। ওই শালার জন্যই দুনিয়ায় ফাইসসা গেছি।
– ফেরত দিয়ে দেব সমস্যা নাই।
– দিবার কোনো দোষ নাই।
– জানি।
– তাইলে..
– সে নিজেই যেতে চায় । আপনাকে ধরাও আনুষ্ঠানিকতা। সেইতো দুদিন পরেই ফিরে আসবেন। কষ্ট করে নাটকগুলো করতে হয় আমাদের।
– পরের বছর স্টার জলসায় ইন্টারভিউ দিয়েন। টিকবেন শিওর।
– জ্বি দোযা রাখবেন এখন যাওযা যাক?
– নিশ্চয়ই৷
মাহা পিছু ডেকে বলল,,
– সামির সিকান্দার?
– বলো দিবা?
– আমিও সঙ্গে যাব। আমিও অপরাধী। আমাকেও অ্যারেস্ট করতে বলুন।
– আমার হাত অপরাধী তাই হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়েছে। তোমারকি চোখে লাগাবে?
– কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে যাব। আপনি আমার জন্য অপরাধ করেছেন। একা সব দায়ভার নেবেন কেন?
– কারণ আমি তোমার স্বামী !
কথাটা বলতেই হলরুম পুরো নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। সামির সিকান্দার অন্য সব সাধারণ মানুষ দের মতো কণ্ঠে নিজেকে মাহাদিবা ফারনাজ মাহার স্বামী দাবি করছে। নিরবতা ভেঙে সামির আবারো বলল,,
– হওয়ার চেষ্টা করছি।
এইকথাটায় আর কারো হোক না হোক মাহার কেমন বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। ” হওয়ার চেষ্টা করছি! ”
কথাটার ওজন কিন্তু কম নয়। মাহা পিছন ফেরে আবারো ডাকে,,
– শুনুন , আমায় নিয়ে যান।
সামির বা মাহবুব উদ্দিন কেও তার কথা শোনে না। সিভান মাহার হাত ধরে দাড়িয়ে রইল। ইতি অবুঝ। মামাই, মামাই বলে কাঁদছে । মাহার তখন কেন যেন মনে হলো তার পেটের ভেতরেও কিছু একটা নড়াচড়া করল। সাড়ে ৩মাস হয়েছে। পেটটা হালকা হালকা একটু উঠি উঠি। ডান হাতটা পেটে ধরে মাহা তাকিয়ে দেখতে লাগল পুলিশের গাড়িতে উঠে সামির সিকান্দার কে সঙ্গে করে নিয়ে গেল একঝাঁক পুলিশের দল।
বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে দাড়িয়ে রইল মাহা সিভান হাত টেনে বলল,,
-কাকি সুন্দরী?
– উমমম?
– পেট ব্যাথা?
– না সিভান। এমনি।
– তোমার কি কাকার জন্য চিন্তা হচ্ছে?
– না। অন্য কারো জন্য চিন্তা হচ্ছে সিভান।
– কার জন্য ?
মাহা কোনো জবাব দিলোনা। সিভানো জোর করলোনা ম তির মনে হলো সামিরের জন্যই মাহার মনটা খারাপ।
-চিন্তা কোরোনা কাকি সুন্দরী বাবা ফেরত আসলেই কাকা ছাড়া পেয়ে যাবে।
-ঠিকাছে। ভেতরে চলো।
তবে এবার সামির কে এরেস্ট করায় কেও একজন যেন বড্ড খুশি হলো। ইনায়ার চোখে মুখে ঝলকানি দিয়ে উঠলো ক্রুর হাসি। দৌড়ে গিয়ে সোজা কল লাগালো সোমাকে।
-হ্যালো?”
-আপু? সমির ভাইকে পুলিশ নিয়ে গেছে।
-কি বলো?
-হ্যা। সাফিন ভাই আজ বিকেলে ঢাকা যাবে। এটাই সেরা সুযোগ।
-ওরা পরশুদিন ফিরবে, তাহলে আগামী কালকেই খেলা শেষ করে দেব। আমি রাগিবকে জানাচ্ছি। তুমি টোপ রেডি রেখ।
– ওই, সোমা আপা, আজকে তুমি চলে যেও। আমি আজ রাগিব ভাইয়ের সাথে থাকতে পারবোনা। সামির ভাই কাশেম ভাইকে পাহারায় বসিয়ে গেছে।
– হাআহ! ঠিকাছে।
সামির চৌদ্দ শিকের ওপারে বসে বসে মনের আনন্দে গান গাইছে,৷
উলালা উলালা, উলালা উলালা, তুহে মেরি জিন্দেগীইই ছুনানা ছুনা না….
” কি ব্যাপার সামির সিকান্দার? মন বড্ড ফুরফুরে মনে হচ্ছে? ”
” আববব, শশুড় মশাই, ধরুণ আমি যদি ভালো হয়ে যাই, এসব খুন খারাবি, হারামিগিরি ছেরেদি তবে আমারে ঠিক কতডা সাজা নিতে হবে? ”
” আপনার জন্য ফাঁসির আদেশ ও যথেষ্ট নয় সামির সিকান্দার ”
“কথাতো ঠিকি। তবে আমার মন ফুরফুরা থাকলেও আপনারে একটা হেব্বি নিুজ দি, আপনের কইলজাডা ব্যাঙের মতো দুপ কইরা উঠবো ”
” দিন, একটু অনুভব করি, ব্যাঙের মতো লাফালাফি করা হৃৎপিণ্ডের ”
” আমি বাপ হব ”
” এ্যা? হাহাহ হাহাহা হাহা হাহা ”
” মেনি মাইনষের মতো হাসেন ক্যান? ”
” আপনি? হবেন বাবা? আমার বড্ড হাসি পাচ্ছে সামির সিকান্দার । ক্ষমা করবেন। আপনি জানেন বাবা কাকে বলে? কি তার মূল্য? ”
মাহবুব উদ্দিন কে চমকে দিয়ে সামির ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
– জানিনা জন্যই জিজ্ঞেস করছি ইন্সপেক্টর। আমার বাপ থেকেও নাই। আমি কখনো বাপ মা মানে বুঝিনি। আমারে একটু বলবেন বাপ হতে কি লাগে?
মাহবুব উদ্দিন ঢকডক করে বোতল থেকে পানি খেয়ে মাথা ঝাঁকি দিয়ে বলল,
– নিউজ শুনেতো হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয়নি। তবে আপনার এই কথাটা শুনে গ্যারেন্টি আমার হৃৎপিণ্ড ব্যাঙের মতো লাফিয়ে বাম থেকে ডানে চলে এসেছে। ।
– নাটক কম কর। বালরে জিগাইছি ধ্যাত।
– আপনার যে বমি মার্কা ভাষা! শুনলেই তো বমি চলে আসে! এমন ভাষা নিয়ে বাপ হওয়ার চিন্তা করেন!
– একটা বুড়িও বলেছিল তোর মুখের ভাষায় আল্লাহর লানত পরুক!
– পরার আগেই শুধরে নিন। দেখুন সামির, আমি বাবা হারিয়েছি অনেক আগে। বাবা হওয়া হয়ত সহজ কর্ম নয়। শুনেছি একজন বাবাকে পাহাড়ের মতো কঠোর হতে হয়। বট গাছের মতো ছাতা হতে হয়। সুসন্তান গড়ে তুলতে একজন আদর্শ বাবার বিকল্প নেই। বাকি নিজে যদি বাবা হই, তখন জানবো।
সামির বাকা করে একটু হাসে।
রাতের বেলা, আজ আর মাহার ঘুম ধরছেনা। পেটটা একটু যন্ত্রণা করছে। মাহা লেপের ভেতরেই পেটে হাত রেখে বলল,,
– তুমি জানো সোনা,, তুমি যে ধিরে ধিরে বড় হচ্ছো আমি বুঝতে পারছি। তুমি কি বুঝতে পারো? মায়ের কত কষ্ট ? জানো তোমার মা রূপকথার সেই বেচারি রাজকুমারী। যাকে তার বাবা, মা, আত্মীয় স্বজন সবাই ছেড়ে গেছে। নাহ, তোমার মা রাজকুমারী ও হতে পারবেনা। কারণ প্রত্যেক রাজকুমারীর গল্পে একটা রাজকুমার থাকে। আর তোমার মাযের কপালে কোনো রাজকুমার ও জোটেনি। জুটেছে এক বর্বর, নির্যাতক পশু। তবে তুমি বিশ্বাস করো তুমি কি শুনতে পেয়েছ তখন সে বলেছে, সে চেষ্টা করছে। বাবা ফিরে এলে তাকে তোমার ব্যাপারে বলে দেব কেমন?
মাহা বোধহয় কথাগুলো মন থেকে বলেনি। পরক্ষণেই নিজে নিজেই চিন্তা করল,, সে যেগুলো বলল,, সেগুলো কেন বলল, কোন যুক্তি তে কোন কারণে বলল! সামির তার সাথে অন্যায় করেছে।
সে চাইলে তাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করতে পারতো। ভালোবেসেও চেষ্টা করতে পারত কিন্তু সে অহেতুক তাকে কলঙ্কিত করেছে। রুমাশা মেয়েটাকে মেরেছে। তার দোষে কতগুলি মেয়ে স্বামী হারিয়েছে, বাবা, ভাই, ছেলে হারিয়েছে । যুব সমাজে ড্রাগস নামের বিষ ছড়িয়েছে। তাকে কি এত সহজেই ক্ষমা করা যায়!
এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে মাহা ঘুমের কোলে ঢলে যায় ।
সকালবেলা নামাজের পর চেষ্টা করেও মাহা ঘুমাতে পারছেনা। বসে বসে কুরআন শরীফ পড়ছে। পড়তে পড়তে বেলা হয়ে গেছে তবুও আর ক্লান্তি ধরেনি। সকাল ৮ টা কি সাড়ে ৮টা নাগাদ ইনায়া আজ ভালো মনেই এসে বলে,,
– আমি বাইরে যাচ্ছি। মা, আপা সিভান আর ইতি কে নিয়ে মার্কেটে গেছে। তুমি বাড়িতে সাবধানে থেক।
– আচ্ছা এসো।
মাহার কেমন মনটা কু ডাকছিল । অস্হিরতা যাচ্ছে না। মনে হলো একবার হসপিটাল থেকে ঘুরে আসা যায় । তবে বাড়িতে তো কেও নেই। তখনি আগমন হয় সাফিনের। তাকে কিছু না জানিয়ে মাহা বেরিয়ে যায়। সাফিন তাকে যেতে দেখেও কিচু বলেনা। তার কাজ বর্তমানে সামির কে ছাড়িয়ে আনা। মনে মনে বড্ড খুশি সে। একটা টার্গেট পূর্ণ হয়ে গেছে। এবার আর তার রাস্তা কেও আটকাতে পারবেনা। পরেরবার নিশ্চয়ই সে ভোটে বিজেতা হবে। এবং তৎকালীন এমপির অবর্তমানে তাকেই বসানো হবে এটাসে দু’শ পার্সেন্ট শিওর। একটু রয়ে সয়ে রাহার সাথে জরুরি বিষয়ে কিছু কথা বলে সাফিন সামিরকে ছাড়িয়ে আনতে যায়।
এদিকে মাহা হাসপাতালে আর ঢুকতে পারেনি তার আগেই তার ফোনে কল আসে ইনায়ার।
– হ্যালো?
– মাহা, আপু, বাঁচাও আমাকে। ওরা,, ও,, ওরা আমাকে ধরে ফেলবে। আমাকে বাঁচাও ।
-কি হয়েছে ইনায়া? তুমি ঠিকাছো ? তুমি কোথায়?
– আমি পালিয়ে এসে #কালকুঠুরি তে আশ্রয় নিয়েছি.. আমাকে বাঁচাও । আমি,, আমি ২১৮ নং শেলে লুকিয়েছি। ওরা আমাকে পেয়ে গেলে জানিনা কি করবে। তুমি দ্রুত এসো আমাকে বাঁচাও।
-হ্যালো?? হ্যালোও?? ইনায়াআ, হ্যালো?
– হে খোদা রহম করো।
সিটি হসপিটাল থেকে লালগলি কাছে হয়। এখন যদি সিকান্দার বাড়ি যেতে হয় তবে তাকে লাল গলি পেরিয়ে যেতে হবে।৷ পথে অনেকবার অন্যদের ফোন করেছে মাহা কেও ফোন তুলছেনা । তুলবে কি করে ইনায়া চালাকি করে সাথি আর সুফি বেগমের ফোন বাড়িতে রেখে দিয়েছে। ল্যান্ডলাইনের তার কেটে দিয়েছে। সাফিন এর নাম্বার মাহার কাছে নেই। সালার সিকান্দার কল তুলে বললো,
-আমি যাচ্ছি তুমিও এসো।
মাহা জোরে হেঁটে কালকুঠুরি পর্যন্ত পৌছে যায় । একবার দৃষ্টি মেলে তাকায় কালকুঠুরি টা যেন আজ একটু বেশিই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। দিনেরবেলা কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে কুয়াশা ঘেরা এক কালো পাহাড়! মাথার ওপরের মসজিদের মতো গম্বুজ টা পুরোই কুয়াশার চাদরে ঢাকা। ভেতরে পা রাখতেই প্রথমে দাড়িয়ে আয়তুল কুরসি পরে বুকে আর পেটে ফু দিল। তবে পেছন থেকে রিটো চেচিয়ে চেচিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। কিন্তু মাহা তা গ্রাহ্য করলোনা।
স্রষ্টার কি অদ্ভুত সৃষ্টি! রিটো ঠিক ঝড়ের গতিতে দৌড়ে থানায় পৌঁছে বাইরে থেকে হাক পারতে লাগল। সামির তখনো শেলের ওপারে। তার হাঁক থামাতে পুলিশ রাও ব্যার্থ। সামির বলছে তাকে ভেতরে আসতে দিতে। কিন্তু মাহমুব উদ্দিন তা গ্রাহ্য করছে না। বেশ কিছুসময় পর সামিরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সাপিনের সঙ্গে বাড়ি ফিরে দিবা দিবা করে চেচাতে থাকে কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ নেই। সিভান বলে,,
– কাকি সুন্দরী হসপিটাল এ গেছে। জরিনা বলল।
হসপিটাল! সামিরের কপাল কুচকে আসে। কোনো সমস্যা হয়নি তো। দৌড়ে হসপিটাল এ চলে যায়। পুরো সিটি হসপিটাল তন্ন তন্ন করে খুজেও কোথাও পায়না মাহাকে।
বাইরের এক ফলের দোকানী তাকে ডেকে বলে,,
– সামির বাবা? বউমাও এসেছিল কিন্তু চিন্তিত হতে হতে ফিরে গেছে।
– চিন্তিত হয়ে ফিরে গেছে?
– হ বারবার কারে যেন ফোন করতাছিল।
সামির নিজের ফোনটা বের করে বারবার কল করে কিন্তু রিং হয়না।
আবারো রিটো ছুটে আসে । ততখনে সামিরের ফোনে কল ঢুকে কাশেমের
– ভাই, কালকুঠুরি তে আগুন ধরেছে।
– তো আমি কি করবো?
– ইয়ে, ভাই,, ভাবি, কাল..
সামির হাতের ফোনটা ফেলে দ্রুত দৌড়াতে শুরু করে । একদৌড়ে পৌছে যায় কালকুঠুরি। কুয়াশা ভেদ করে দাউদাউ করে জ্বলা কালকুঠুরির দিকে তাকিয়ে রয়। সেখানে তখন অনেক লোকের উপস্হিতি।
২ ঘন্টা আগে,,
মাহা ইনায়া আর সালার সিকান্দার কে খুঁজতে খুঁজতে ওপরতালায় চলে যায় । গিয়ে দেখে ২১৮ নং শেলে শুধু ২ জন নয়। আরো কয়জন। ইনায়া, সালার, রাগিব, সোমা, সোনালী ।
মাহা চোখ কুটিয়ে জিজ্ঞেস করে,,
– ওরা চলে গেছে? তুমি ঠিকাছো তো ইনায়া?
– সরে দাড়া, ছুবি না আমায়।
– কি বলছ তুমি?
– চুপপ! কেউটে সাপ কোথাকার! তুই আমার থেকে আমার ভালোবাসা কেরেছিস, আমার জীবন ছিনিয়ে নিয়েছিস! এখন এসেছিস দরদ দেখাতে?
মাহা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সোনালী আর সোমা মিলে তাকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলল।
– ছেড়ে দাও আমাকে,,
– অসম্ভব! ,,, তোর পেটের বাচ্চার দাদা হবো আমি? উহু। সামির সিকান্দার কে আমি পেলেছি, আমার পোষা কুকুরকে তুই বশ করার চেষ্টা করেছিস! ভরপাই দিবিনা?
– আপনারা আমার সাথে এমন কেন করছেন? দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।
রাগিব দেওযান এক টানে নিকাব ছিড়ে দিয়ে বলল,,
– দয়া ? আমরা দয়া করতে জানিনা সুন্দরী। তোমার ওপর আমার কত্ত আগ্রহ জানো? আমার কাছে তোমার দাম জানো? ৩০ লাখ,, ৩০ লাখ টাকার বদলে তোমার সওদা করেছিলাম। শালার বাই*চো* ছো মেরে ছক্কা মেরে দিছে।
– তাতে আমার দোষটা কোথায়? আমার সাথে এমনটা করবেন না। দয়া করে কটা দিনের জন্য হলেও ছেড়ে দিন। নিষ্পাপ জানটার কি দোষ?
– দোষ তোর,, তুই সামির সিকান্দার এর বাচ্চাকে পেটে ধরেছিস, এটা সামির সিকান্দার এর কতবড় সর্বনাশ করবে তুই জানিস? হতেও পারে সামির শুধরে যায়! সামির শুধরে যাওয়া মানে আমাদের ধ্বংস।
– ইনায়া, ইনায়াআমি তোমার পায়ে পরি আমাকে ছেড়ে দাও। আমি এখন এই মুহূর্তে এখান থেকে নিখোঁজ হয়ে যাবো। কোনোদিন ও ফিরে আসবোনা। ভুলবশত ও না। আমার বাচ্চাটাকে বাঁচতে দাও।
সোমা গিয়ে মাহার চুলের মুঠি ধরে বলে,,
-তোমাকে ছাড়া যাবেনা মামুণি। আর এই বাচ্চা? অসম্ভব। রক্তের টানের চে বড় কিছুই হয়না। এই টানাটানি খেলায় তোমার দলে এই বাচ্চাই একাই একশ জনের সমান।
– না,, না,, আমার এতবড় সর্বনাশ কোরোনা। ওর বাপকে অন্তত জানতে দাও। ওর বাবা এখনো জানতেই পারলোনা। আমি,, আমি শুধু দেখতে চাই আমার বাচ্চাটা সুস্থ । আমি,, আমি,, সামির সিকান্দার রে ছেড়ে চলে যাব।
সোনালী এগিয়ে গিয়ে বলল,,
– সমির না জানলেও ক্ষতি নেই। তোমার জন্য ওর জীবন থেমে থাকবেনা।
– অন্তত তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে দিন, সে বলেছে সে আমার স্বামী হওয়ার চেষ্টা করবে। সেই দায়ভার থেকে আমি তাকে জানাতে চাই সে বাবা হতো।
– সম্ভব নয় সুন্দরী।
রাগিব দেওয়ান গায়ে নোংরা স্পর্শ দিতেই পুরো কালকুঠুরি কাঁপিয়ে মাহা চিৎকার করে ওঠে,,
– না, খবরদার ছুবিনা আমায়, সেই অধিকার একমাত্র সেই বেইমানের। নাআ,, সামির সিকান্দার! কোথায় আপনি, ওরা আপনার বাচ্চাকে মেরে দিচ্ছে ছিনিয়ে নিচ্ছে আপনার শিকার, আআআ!
তার চিৎকারে রাগিব সহ সকলের কানে ধাপা ধরে যাচ্ছে ! রাগিব তার গলা টিপে ধরে হিংস্র স্বরে চুপ করতে বলে। ইনায়া মাহার দিকে বন্দুক তাক করতেই হঠাৎ দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে চারপাশে। কালো রুমালে ঢাকা এক অদ্ভুত মানব গুলি মেরে সোনালী আর রাগিব দেওয়ারকে মেরে দেয় । সালার সিকান্দার, ইনায়া আর সোমা কোনোমতে বাইরে বেরিয়ে আসে। তবে ওই ছেলেটিকে আর মাহাকে নিয়ে বের হতে দেখা যায় না। আগুনের ফুলকি বাতাসের গতিতে পুরো কালকুঠুরি তে ছড়িয়ে যায়।
ইনায়া আর সালার সিকান্দার এমভাবে বাইরে মিশে যায় জেন তারা জানেইনা এখানে কি হয়েছে। মাহার হাহাকারগুলো বারি কেতে থাকে দেয়ালে দেয়ালে,,
-কেও বাঁচাও আমাকে, আমার নিষ্পাপ সন্তানের দিকে চেয়ে কেও বাঁচাও ! সামির সিকান্দাররর!
আর কোনো আওয়াজ আসেনা। সব শুনসান
প্রায় ৪০ মিনিট পরে আগুন নিভেছে,, সামির যতখনে এসেছে আগুনের মাত্রা তখন খুবই কম৷ সামির দৌড়ে আগুন উপেক্ষা করে দুইতলার শেল ২১৮ তে চলে যায় । কযেকটা কাচের বোতল আর ধারালো অস্ত্র নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
সামি ধপ করে বসে পরে পায়ের কাছে একটা নকল সোনার রুলি বালা। মাহা সবসময় পরে থাকতো। সামির কম্পিত হাতে বালাটি তুলে নিয়ে দেখতে লাগলো। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরল অবাধ্য অশ্রু ধারা। হঠাৎ করে সামির পাগলের মতো হাসতে লাগল। এক একাই বিরূপ করতে লাগলো,,
– হেহে শুয়োরের বাচ্চা ইয়ারকি মারছে,৷ এটা হতে পারেনা। এসব ইয়ার্কি। মজা এসব। স্বপ্ন এসব। একটু পরি ভেঙে যাবে।
সামির অসংখ্য বার নিজেকে চিমটি কাটতে থাকে। সেকি,, ঘুম ভাঙেনা ক্যান । এটা কে? এটা দিবা নয়, আমার দিবা এমন কালো নয়, এমন কুৎসিত নয়। ও অনেক অনেক অনেক সুন্দর। এমননা ও,, কাইশসা, এরা কারা,, এই এই মেয়ে টা কে??
কাশেম মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইল।
– এই শালা,, বল এটাকে? বল নাহলে আমি তোকে মেরে দেব।।
-ভা.. ভাবি।
– চোপপ! আমার সাথে মষ্করা করেনা কাশেম ব্যাপারটা সিরিয়াস। বোঝার চেষ্টা কর।। ও,, প্রেগনেন্ট। তুই চাচা হবি কাশেম৷
কাশেম ডুকরে কেঁদে ওঠে। সামির ধপ করে জ্বলে প্রায় ছাই হয়ে যাওয়া দেহটা ছুতেই তার কেমন পুরো শরীর ঝাকি দিয়ে ওঠে।
পোড়া লাশটা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে,,
– তুই আমাকে এত বড় শাস্তি দিসনা দিবা। আমি সইতে পারবনা। কথা বল,, কেও তোল ওকে। দিবাআ।
পোড়া লাশটা থেকে আওয়াজ আসেনা। সব শুনশান! হাতের বালা দুটোর একটা গলে গেছে একটা রয়ে গেছে। তবে দেহটা এমনভাবে ঝলসে গেছে শনাক্ত করার কোনো উপায় নাই। সামির কান্না ভাঙা গলায় আওড়ালো,,
– তোমায় কোনোদিন ক্ষমা করবোনা দিবা। আমি যতই খারাপ হইনা কেন তুমি আমায় বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছ। তোমায় কোনোদিনও ক্ষমা করবনা দিবা। ।
বাদ যোহর দুপুর ৩ টা,,,
সবাই মাহাকে মাটি দিতে গেলেও সামির গেলনা। ঘরে বসে গোগ্রাসে কোডিন* যুক্ত ড্রাগস গিলতে লাগল। । ইনায়া দৌড়ে আটকানোর চেষ্টা করলেও সামির বাধা মানেনি। কাশেম এসেছে । সে কিছু একটা বলতেই সামির নিচে নেমে গেল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ঠিক যেমনটা বর্ষ আগে সজল সিকান্দার কে দেখাচ্ছিল। বিনা নোটিশে সে সোজা গিয়ে নিচে দাড়িয়ে সাথিকে হুকুম করে বাচ্চাদের ভেতরে নিয়ে যেতে।
সাথির যেতেই যতটুকু দেরি৷ সামির টেবিল থেকে চাকু তুলে সোজা সালার সিকান্দার এর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। সালার সিকান্দার ওই বয়সেও কম শক্তিশালী নয় ,, দু চার ঘা হাতাহাতি হয়েছে। তারপর সামির তাকে একদম কাত করে ফেলেছে। গলা টিপে ধরে সামির বলে,,
– নষ্টার বে*ন্মা তোর রক্তের দাম নাই থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে। আমার কাছে আমার রক্তের অসীম দাম আছে। তুই আমার বউবাচ্চাকে মেরেছিস তোকে ছেড়ে দেব অসম্ভব!
কেউ তাকে আটকাচ্ছে না। সাতির অসংখ্য বার আঘাত করে সালার সিকান্দারকে হত্যা করেছে। সামনে দাড়িয়ে ইনায়া । থরথর করে কাপছে । সালার সিকান্দার কাঁপতে কাঁপতে শেষ হয়ে গেলে সামির উঠে গিয়ে ইনায়ার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সুফি বেগম তার হাত পায়ে ধরে আকুতি করতে থাকে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ।
সামির ছুড়িটা ছুড়ে ফেলে চাচিকে উঠিয়ে বলে,,
– কার জন্য কাঁদছো চাচি? কার জন্য ? এক বেশ**র জন্য ! তুমি জানো চাচি,, তোমার কষ্ট করে জন্ম দেওয়া এই মেয়ে কতবড় চরিত্রহীন? কেদনা চাচি, এর চরিত্র কালকুঠুরির মেয়েদের চেয়েও নিচচ! ”
গলা ফেড়ে চিৎকার করে বলল,,
– এ একটা নষ্ট* মেয়ে । প্রতিশোধের বদলে নিজের সতিত্ব বিসর্জন দিয়েছে ও। তুমি জানো ও কার সাথে মিলে আমার না হওয়া বাচ্চা, বউকে মেরেছে? রাগিব দেওয়ান!
হ চাচি রাগিব দেওয়ান যার সাথে কাজ করতে হলে শরীর দেওয়া বাধ্যতামূলক! আরে কালকুঠুরির মেয়ে গুলো কে তো জোর করে তাদের অস্তিত্ব সতিত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাদের যদি খারাপ বলা হয়, তাহলে একে তুমি কি বলবে চাচি যে মেয়ে নিজের শরীর বেঁচে এসেছে। আরে কালকুঠুরির মেয়েরা তাও টাকা পায়, এতো বিনামূল্যে নিজেকে বিক্রি করে এসেছে। কুঠুরিতে থাকার যোগ্যতাও এর নেই।
চাচি আর কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ সরে দাড়ালেন। সামির ইনায়ার ওড়না পেচিয়ে ফাসের মতো ধরে তাকে টানতে টানতে রান্না ঘরের দিকে নিয়ে গেল দেশলাই জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল ইনায়ার গায়ে। সে এক ফোটাও ছটফট করলনা শুধু বলল,,
” আপনাকে পাওয়ার নেশায় আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম সামির ভাই, তবুও আমি আপনাকে ভালোবাসি । ”
চাচি অজ্ঞান হয়ে যায়। কাশেম আর বাকিরা ধরাধরি করে ওপরে নিয়ে যায় । একটুপর ওপরতলা থেকে নিচে তাকিয়ে সকলে যেন স্ট্যাচু হয়ে যায় । সামির পিছনে ঘুরতেই দেখে এক দুনিয়া কাঁপানো দৃশ্য।
তার প্রিয় আদরের ভাতিজা সিভান সিকান্দার তার দিকে বন্দুক তাক করে দাড়িয়ে । পেছনে বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে সাফিন সিকান্দার। ততখনে সামিরের এলার্জি ধরে গেছে।
সামির হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পরতে পরতে ভাঙা গলায় বলে,,
কালকুঠুরি পর্ব ৩৯
শালা সজল তো এমনি বলে মরেনি,
~আমি কত জনে কত কি দিলাম,,
যাইবার কালে একজনারো দেখা নাপাইলাম
আার সঙ্গের সাথী কেও হলোনা রেএ
রইবোনা আর বেশি দিন তোদের মাঝারে
হায়রে ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারেএএ..
