কালকুঠুরি পর্ব ৪৪
sumona khatun mollika
সময় এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম স্রোত। আমার কাছে মনে হয় নদীর ঢেউএর চেয়ে সময় আরো বড় বেইমান। আর সামির সিকান্দার সে শুধু জীবন শেষের অপেক্ষায় ।
অপেক্ষায় অপেক্ষমান
সময় তবুও বহমান,
যদি ফিরে তাকাও আবার পেছন পথে
অতীত হারিয়েছে সময়ের নিশীথ রথে।
তবুও বাতাসে রয়ে যায় হাহাকার , পাপের ছায়া, ভয়াবহতা, স্তব্ধতা ,, অপেক্ষা।
৩ বছর পর……..
২০২১, অক্টোবর
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তার ঘেঁষে চকচকা কালো বাইক ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। ছাত্রছাত্রীরা সবাই দৌড়াদৌড়ি করে যে যার গন্তব্যে ছুটছে। বাইক থেকে নেমে এলো লাল কালো চেক শার্ট,চেস্ট কোর্ট, রঙচটা জিন্সের প্যান্ট পড়া, সানগ্লাস চোখে গলায় কালো টাই পরিহিত এক নতুন সামির সিকান্দার । হেলমেট বাইকের সাথে ঝুলিয়ে রেখে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে সোজা কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট এর ল্যাবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ছাত্র ছাত্রী সকলের নজর তার দিকে ,, কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট এর দেয়ালে দেয়ালে যেন সামির সিকান্দার এর নাম লেখা থাকে। ফার্স্ট ইয়ারের একদল ছাত্রী জনতা বলাবলি করছে,,
– আজকে আমাদের হ্যান্ডসাম প্রফেসর ভালোমতো বাঁশ দিয়ে দেবে।
– স্যার কি সবসময়ই সিরিয়াস মুডে থাকে?
– সিরিয়াস মানে? মাডারের মুডে থাকে। একদম যেদিন ধরবে পুরা ক্লাসরুমে সবার মধ্যে বিনা হারপিকে চকচকে করে ঘষে দেবে৷
– ছোট বাচ্চাদের মতো মারে নাকি?
– চ্যাহ নারে বোকা,, ওনার মুখ দিয়ে সর্বদা মধুর বাণী ঝরে। একদম বাঙ্গি ক্ষেতের মধু।
– গালায় নাকি রে?
– এক্কের দিলপে চাক্কু! তবে জানিস, স্যার না মনে হয় ছন্নছাড়া টাইপ,,
– কেন?
– সে মাঝেমধ্যে লুঙ্গি পড়ে ক্লাস নিতে চলে আসে। তবে ওডাতেও স্যাররে যা ঝাক্কাস লাগেনা,, একটু শ্যামলা তবে হেব্বি হ্যান্ডসাম । বহুত বেটির ক্রাশ।
– হ্যা দেখলাম তো।
– উমম স্যারকে দেখে মনে কি বাজে জানিস?
~ছেলে তোর প্রেমে পড়ার কারণ
তোর শ্যামলা শ্যামলা বরণ
শ্যামলা গালের কালো দাড়ি ভাল্লাগে ।
– তুই পারিসও,, বুইড়া একটা ব্যাটা,, তাছাড়া তার আচরণ নাকি বখাটেদের মতো?
– চুপ করত! বুইড়া,, ট্যালেন্ট কত জানিস? বয়সও বেশিনা খুব টেনে থার্টি প্লাস হবে।
– বলদ মনে হয়?
– তুই দেখছি কিছুই জানিস না,, আরে ভার্সিটিতে যারা মাত্রাতিরিক্ত ট্যালেন্ট হয় , সিজিপিএ হাইপ হয়, ওরাই পরবর্তী তে টিচার পদে চান্স পায়। প্রফেসর সামির সিকান্দার ভিরান এর সিজিপিএ ছিল চারে চার। সবচেয়ে টপ ট্যালেন্টেড স্টুডেন্ট ছিল ।
– তুই কি করে জানিস?
-বাহির জেলা থেকে এসেছিস তো ,, আমরা রাজশাহীর এমন কেউ নেই যে সিকান্দারদের কাওকে চিনিনা। এমপি আবু সাফিন সিকান্দার,, তার ছোট ভাই মেয়র সিয়াম সিকান্দার আর তারচে ছোটটা প্রফেসর সামির সিকান্দার ভিরান।
স্যার বড্ড রসিক তবে যখন সিরিয়াস তখন হেব্বি হারামি। কানে কানে শোন আরেকটা কথা,,
মেয়েটা কান এগিয়ে দিতেই অন্য জন বলল,,
– সে কিন্তু ভয়ানক খুনি,, নাজানি কতগুলো খুন করেছে। এমনি ভয়ানক সবাই জানে সেই খুনি কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই।
– পুলিশ?
– কমিশনার থেকে শুরু করে হাবিলদার সব্বাই ওদের দলের।
-একে দেখে ক্রাশ খাওয়ার সাহস কে করে ভাই?
-আরে দুরু, ক্রাশইতো,, তাছাড়া তার চোখদুটো এমনিই মায়াবী । সেই সেই সেই৷ শোন ক্লাসে চুপ থাকবি।
-উমমম
ল্যাবের ভেতরে খা খা নিস্তব্ধতা, সবার নজর সামির সিকান্দার এর দিকে। সে হাতের ইশারা করে একটা ছেলেকে দাড় করিয়ে বলে,,
– বলো,, কারো কোনো রিপোর্ট? সমস্যা? নাহলে আজকের লেকচার শুরু হবে।
পেছন থেকে এক ছেলে হাত তুলে নিজের জ্ঞান প্রমাণের চেষ্টায় একটা প্রশ্ন ছুড়ে মারলে সামির ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,,
– স্ট্যান্ড আপ,, এটা ক্লাসরুম নাকি কোনো বাঙ্গির ক্ষেত? মানে হোয়াট দা হেক? পড়া মারাও টু-এ আর প্রশ্ন মারাচ্ছ ক্লাস সেভেনের? ডিজগাস্টিং !
আসলে ছেলেটা এমনও কোনো কঠিন প্রশ্ন করেনি। যেটা অনার্স লেবেল হিসেবে একটু বেশি হয়ে যায়। কিন্তু তাকেতো প্রমাণ রাখতে হবে সে সামির সিকান্দার ! ছেলেটাকে ক্লাস থেকে বেরি করে দিল সামির। তারপর মাইকের সামনে দাড়িয়ে বলল,
– আজকের টপিকটা ইম্পর্টেন্ট। নোট ডাউন করবি সব। বিষ বানানো শিখব আইজ Molecular Modelling and Drug Design,,,
সামির যতখন লেকচার দিল কেও টু শব্দও করলোনা। যদি নিঃশ্বাস এর শব্দও ফেলে সে সেটাকেই ইস্যু বানিয়ে বিনা ডিটারজেন্ট পাউডার এ সব হোয়াইট করে দেবে।
ক্লাস শেষে সামির হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে আসে৷ সম্ভবত বৃষ্টি পড়বে। আকাশের মেঘগুলো যথাসাধ্য মারামারি করে ঝড়াড় ধান্দায় আছে। চারপাশে স্তব্ধতা। জনতার উপস্হিতি কম হঠাৎ করে সামিরের চোখ আটকে যায় এক ছোট্ট বাচ্চার দিকে,,
কি অদ্ভুত! বাচ্চাটির পড়নে বোরখা আর বেবি হিজাব। ভার্সিটির স্মৃতি স্তম্ভের কাছে দৌড়ে দৌড়ে সে একটা বেড়ালের সাথে খুনসুটি করছে। বেড়ালটি হয়ত তার পোষা মনেতো হচ্ছে তাইই।
দৌড়ে সে সামিরের কাছ ঘেঁষে যেতেই সামির তার দিকেই ঘুরে তাকালো। মুখ দিয়ে না বেরোলেও মন দিয়ে বেরিয়ে গেল “ইয়া মারহাবা ”
বাচ্চাটার হাত থেকে একটা পুঁতির ব্রেসলেট খুলে যায়। সামির সেটা তুলে বাচ্চাটাকে ঠিক সেই উৎকণ্ঠা নিয়ে পিছু ডাকে যেভাবে আরেকজনকে ডেকেছিল,,,
– ও,,, ও বোরখাওয়ালী বেবি??
দুই নয় তিন নয় এক ডাকেই বাচ্চাটা ঘুরে তাকায় । ফোলা ফোলা গাল টেনে দাত কেলিয়ে হাসে। বয়স সিয়েরার মতোই হবে। সে ওখানেই দাড়িয়ে রইল সামির নিজেই এগিয়ে গিয়েকাছে টেনে জিজ্ঞেস করল,,
– তোর নাম কিরে বিল্লু??
বাচ্চাটার দিক থেকে আটকা আটকা আওয়াজ এলো,,
– তিহ,,, তিতহ,, তিতিন।
– তোর নাম নাম তিতিন?
– না।
– তবে?? কার নাম?
– ও তিতিন। আম,, আমি,, থামহ,, থামহা থিকাদদাল বুমি।
– উমম? হেহেহ, তোম নাম বমি? কে রেখেছে বমি? হাহাহাহা।
অচেনা মানুষ কে এভাবে হাসতে দেখে বাচ্চাটা ভয় পেয়ে যায় । টুসটুসি গোলাপি আভার ঠোঁট ফুলিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে,,, সামির ইতস্তত হয়ে তার নাকে আঙুল ছুঁইয়ে বলে,,
– এ,, এ,, এ,,, কান্দস ক্যা? কাঁদিসনা। তোকে বাঙ্গি খাওয়াবো। খাবি?
– না,,
-তাইলে আর কি,, কান্দেক।
-এ্যাআ,, মা,,,,,, উমমমম,, উমমমম,, মাআআ,,
– এই চোপ ম্যা ম্যা করছিস কেন? আমি তরে বকছি? কান্দিস না।
বাচ্চাটা তার নাদুস নুদুস হাত বাড়িয়ে সামিরের প্রশস্ত বুকে একটা চড় ছুড়ে হাত পা নাচিয়ে কাঁদতে লাগলো । সামির হতবাক হয়ে বলল,,
– বাঙ্গির বাচ্চার সাহস কতো আমারে মারে।
-আরে আজব আপনি বাচ্চাকে বকছেন কেন?
এক মেয়েলী কণ্ঠে সামির ঘুরে তাকিয়ে,,
– আরেএ??
– সামির ভাইজান?
– সেতু না ??
– জ্বি ভাই ।
– তারমানে এটা সামহা?
– আপনার মনে আছে?
– থাকবেনা কেন এটাইতো প্রথম জীব যে আমার বুকে লাত্থি মেরেছিলো।
সেতু একটু হাসলো। সামহা দৌড়ে তার কোলে উঠে ঘাড়ের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলে সেতু তাকে শান্তনা দেয় । বিড়াল টা পায়ের নিচেই গাইগুই করতে থাকে।
সামির জিজ্ঞেস করে,,
– বড্ড রাগী হয়েছে মনে হয় ।
– কেন?
– আজো আমাকে চড় মারলো একটু আগে।
– তুমি ভাইজানকে চড় মেরেছ?
সামহা মাথা নেড়ে না জানালো।
– এত শয়তানের নানি, আবার পড়ে আছে বোরখা। মিছে কথা কয়।
– তুমি মিততে কতা বল,,
– হাআআহ,,
সেতু গাল টেনে হাসতে হাসতে বাচ্চাটাকে চুপ করালো। কোলের থেকে নামিয়ে দিতেই সে আবারো বিড়াল তিতিনের সাথে খেলতে আরম্ভ করে। সামির জিজ্ঞেস করে,,
– এই বদমাশের ডিব্বাটাকে বোরখা পরায় রাইখেছিস ক্যান ¿
– ওর মা এখন থেকে অভ্যাস করাতে চায় । শুধু বাইরে আসার সময়েই পরে। যখন রেগে যায় হিজব টেনে খুলে মাটিতে গড়াগড়ি করে। বড্ড দুষ..
– এক মিনিট। ওর মা মানে??
সেতু এবার তব্দা খেয়ে যায়। আমতাআমতা করে জবাব করে,
– মানে আমিই। আমি ওর মা চাই বড় হয়ে পর্দা করুক এই যা।
– ওহহ। আচ্ছা আসছি। শয়তানের নানিটাকে ধরে রেখ কার জানি চুল ছিড়ে দেয় আবার।
– জ্বি ভাইজান।
– আসি হ্যা?
– জ্বি ।
সামির হাঁটতে হাঁটতে বাইকে চড়ে চলে যায় সেতু জোরে করে হাফ ছেড়ে ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে ধরে ভূমি বলে ডাক দেয় ,,
– কি করছ,, বেড়ালকে কেও কামড় দেয়?
– ইটা বিলাল না তু, ইটা তিত,তিতিন।
-হ্যা মানচি তিতিন কিন্তু তুমি তিতিনকে কামড় দেবে কেন?
– আলে,, ও যে আমাকে তামল দিল
– তার জন্য তুমিও ওকে তামল,, ইইই কামড় দেবে?
– উমমম।
– দুষ্ট একটা, বাড়ি চলো,, আরে বাবারে,, হিজাবটা ঢিলা হয়ে গেছেগো আমার মায়ের।
– উমমম।
ভূমি একবার পেচন ঘুরে সামিরকে নাই দেখে জিজ্ঞেস করে,,
– মিমি? উটা তে?
– ওটা?? ওটা ভূত। চরো চলো চলো,, তিতিন এসো এসো,,
কালকুঠুরি পর্ব ৪৩
ভূমিকে কোলে তুলে একটা অজানা ঠিকানায় চলে আসে। দড়জা খুলতেই দেখা মেলে অন্য এক যুবতী নারীর । ভূমি দৌড়ে তার কোলে চড়ে তাকেও মিমি বলে ডেকে ওঠে। মেয়েটি তাকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে যায় ।
