কালকুঠুরি পর্ব ৪৪ (২)

কালকুঠুরি পর্ব ৪৪ (২)
sumona khatun mollika

সাথি, এখন সিকান্দার দের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। ইতি বাড়িতে বেশিরভাগ সময় সিয়েরার সাথে থাকে। সামির তাদের খুব একটা সময় দেয়না। সিভান কিছু বলবে চেয়েও বলেনা।
সে বেশ ভালোই জানে কিছু বলতে গেলেই সামির রেগে যাবে চিল্লা পাল্লা করবে । তবে সিয়েরা বাচ্চাটা তার কাকার বেশ ভক্ত। সিয়ামের মতো চুপচাপ ।

সুফি বেগম মারা গেছেন এইতো কিছুদিন। দিগন্তে সূর্য ঢলে যায় যায় অবস্থা । চারপাশের আকাশটা রক্তিম হলুদ আভা ধারণ করে আছে।
সিভান কে সাফিন আজ খুব বকাঝকা করেছে । স্কুল থেকে রিপোর্ট এসেছে সিভান ৩ সাবজেক্টে ফেল করেছে। সামির সন্ধ্যার দিকে একবার সিভানের ঘরে যায় ,,
বইখাতা পরে আছে আর সে বসে বসে গেমস কেলছে। সামির তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বিছানার ওপর ছুড়ে মারে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– তুই নাকি ডাব্বা মেরেছিস?
– উমমম।
– কটায়?
– তিন।
– কি প্রাউডলি বলছে লজ্জা লাগছেনা? আমাকে দেখ,, পয়দায়িশি টপার! আর ইউ ডাব্বাওয়ালা।
– দেখলাম,, কি লাভ হলো? পাশ হলো?
– মুখ কম চালা। গ্রামারে ফেল মেরেচিস? তাও মাত্র ২ পেয়ে? এই ২ নাম্বারটাও পাওয়ার কি দরকার ছিল?
– শখ করে, ভালোবেসে দিয়েছে।
– বইতো ছুয়েও দেখিস বলে মনে হয় না। বলত গ্রামার কি?

– যারা গ্রামে থাকে তাদের গ্রামার বলে। বাংলাদেশ এর গ্রামবাসীরা হলো বাংলা গ্রামার যারা বিদেশের গ্রামে থাকে অরা ইংরেজি গ্রামার।
– ওরেশ শাল্লা ,, কি লজিক! মাইরি
– তোমার মতো,, ড্যাশ ভাঙ্গা !
– কি বলছিস তুই আবার বল?
– বললাম কিছুনা।
– নাটক মারানি বন্ধ কর। পড়াশোনা কর,,

সিভান একটু সিনেমাটিক করে চুলগুলো নেড়ে বলে,,
– আহা,, নাটকের জন্য কাকা সেরা রেহ! কি বলত কাকা পুলিশে ধরলে দুই ঘা আর প্রেমে পড়লে আঠেরো ঘা! আমি প্রেমে পরেছি।
– উমম কি কি কি?? তুই যার এই এক কড় সমান সাইজ কার প্রেমে পরেছিস?
– কেন দেখতে পাচ্ছনা? এইযে ফোন,, এই ফোনটার সাথে আমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। একদম পিওর! কোনো স্বার্থ নাই। তাছাড়া
ভালোবাসা যেখানে পিওর বাঁশ সেখানে শিওর।

– টাট্টি কম মার। এসকল নাটক আমার থেকেই শিখেছিস।
– ব্যাঙ!
– তুই আমাকে ভেঙাচ্চিস!
বলেই সামির সিভানকে কাতুকুতু দিতে লাগলো। তাদের সাথে ইতি আর সিযেরাও যোগ দেয় । বাড়িতে যতখন থাকে বাচ্চাদের সাথেই যা একটু কথা হয়। চাইলেও প্রকাশ করতে পারেনা। সামির সিকান্দার ও একজন মানুষ । তার বুকের বাপাশেও কিছু একটা আছে। প্রকাশ করলে চলবে কেন? কখনো মদ খেয়ে টাল হয়ে পরে থাকলেও কেও নাই দেখার। যে দুজন দেখত তারা কেউ নেই। একজনতো স্বার্থের জন্য দেখত। তবে আরেকজন? তারও কি স্বার্থ ছিল এই প্রশ্নটা করার আগেই সে সামিরকে অবজ্ঞা করে চলে গেছে।

দিন চলে যায় দুঃখরা মনের ভেতরেই চাপা রযে যায়। সামির সিকান্দার বরাবরই একটা কথা বলে,, সবসময়ই হাসিখুশি থাকব। আমি খারাপ আর খারাপের কখনো কোনো কিছুতেই খারাপ লাগেনা। বাচ্চাদের সাথে দুষ্টুমি করতে করতে বেলা ঢলে যায় । সামিরের ফোনে একটা নাম্বার থেকে কল ঢোকে, , মাহার চাচা মফিদ উদ্দিন ।
সিভানের রুম থেকে বেরিয়ে সামির কল ব্যাক করল,,

– কি সমস্যা?
– রুবেল ডেকেছে।কল তোলোনা কেন? তোমারে কি মাঝেমইদ্যে কুত্তায় কামড়ায়? না ভূতে ধরে? আজকে তোমাকে চাপাই যেতে হবে। ক্লাবে এসো।
সামির কিছু না বলে কল কাট করে দোয়
নিজের ঘরে গিয়ে গোসল সেরে বাইরে বেরিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় । শরীরের জায়গায় জায়গায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু পানিতে বিছানার কিছু অংশ ভিজে ওঠে। চোখদুটো বুজতেই আগের একটা কাহিনী মনে পরে মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখা দেয় ।
সেদিন সামির বাহির থেকে এসে গোসল টোসল করে বিছানার ওপর এভাবেই শুয়ে পরেছিল। মাহা নামাজ শেসে উঠে বলে,,

– মানে বুঝলামনা, আপনি জামাকাপড় নিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারেন না? গামছা পরে ভেজা গায়েই বেরিয়ে আসেন কেন?
– তুমি বুঝবানা এইযে গাযে ফোডা ফোডা পানি লাইগা থাকে বাতাস লাগলে হেব্বি লাগে। সুরসুরি,,
– বিরক্তিকর ! নিউমোনিয়া হয়ে মরে যাবেন।
– আচ্ছুহ!! হা.. হা.. হাচ্ছুহহ! তোমার বদদোয়া এক্কের পয়েন্ট মতো লাাআা আচ্ছুহ!!
– কথা পয়েন্টে লাগাটা ফ্যাক্ট না। এভাবে ভিজে থাকলে এমনিই জ্বর এসে যাবে। আর দোহাই খোদার দয়া করে জামাকাপড় পড়ে আসুন।
– আরেএ! কিসব বাঙ্গিমারা কথা! আমিতো আর ল্যাআ…. আই মিন ফাক্কা হয়ে নেই। যন্ত্রপাতি সব ঢাকাইতো আছে।
– সরুন,, বিছানা ভিজে যাচ্ছে !

সামির ঠ্যাটার মতো ওভাবেই পরে থাকে। মাহা বিছানা ঝাড়া ঝাড়ু নিয়ে এসে বলে,,
– সরবেন, না সিক্সার মেরে দেব!
– হাাা ইরিম্মা কি ডেন্জারাস মহিলা, ওমাগো কেও বাঁচাও গো আমার বউ আমারে মারতে চায়! আমি কই বউ লাবিউ লাবিউ, বউ কয় কিক ইউ ব্লাস্ট ইউ, এ্যাাা,,
সামিরের ন্যাকা নাটক দেখে মাহার বেশ হাসি পায়। চেষ্টা করেও লুকাতে পারেনা। কোনো আওয়াজ না করে গাল টেনে হেসে ফেলে। সামির ঝট করে লাফ মেরে উঠে বসে বলে,,

– ইয়া মারহাবা,, হেসেছেতো ফেঁসেছে! কি ব্যাপার সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোয়ামির কথা শুনে তুমি হাসছো গো মেয়ে ?? something something??
মাহা নিজের কাজে মন দেয় । সামির পিছে পিছে হাঁটতে হাঁটতে বলে,,
– বলোনা সামথিং সামথিং??
– চ্যাহ,, সরে দাড়ান,, নাথিং নাথিং।

সামির ঝট করে আলনা থেকে তার নীল লুঙ্গি টা টেনে পরে মাহাকে পেছন থেকে টেনে ধরে,, মাহা জবরদস্তি নিজেকে ছাড়াতে চেযেও পারেনা। সামির বাহাতে ফোনে গান চালু করে জবরদস্তি মাহাকে নাচাতে থাকে। নাচতো বলেনা ওটাকে মাহা ছুটতে চাইছে সামির টান মেরে আবারো নিজের ভেতরে টেনে নিচ্ছে । শুধু শোনা যাচ্ছে রুম থেকে ভেসে আসছে গান,,,

Main mera dil aur tum ho yahaa
Phir kyun ho palke jhukaye waha
Tumsa haseen pehle dekha naii
Tum isse pehle the jaane kahaan
Jeene laga hoon pehle se jiyaada
Pehle se jiyaada tumpe maarrne lagaa
Hooo oo ooo….. 💝

মাহা সেদিন একটু সময় হেসেছিল । তবে সেই হাসিটা সম্ভবত মন থেকে ছিল। কেন তা সামিরের জানা নেই।
সামির নিজের চোখের কোনায় ভেজা অনুভূতি হতেই ওপরের সিলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে নিস্তরঙ্গ গলায় বলে,,
– তুমি কি ভাবতে পারো, তুমি কতটা ভয়ঙ্করী। নরকের আগুনের মতো ভয়ংকর তোমার অভ্যাস।
আগুনে ধাক্কা দিয়ে কি করে নিজে ধোয়াশা হয়ে গেলে পানি সুন্দরী !!

ভূমি বিছার ওপর বসে। পড়নে একটা সবুজ রঙা জামা। সামনে তিতিন বসে । দুজনের কেউই কম কিউট না। সে তিতিনের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করছে, তাকে শ্যুট করার। তিতিন পরে যাওয়ার নাটক করছে। ভূমি মুখ দিয়ে শব্দ করছে,,
– টিশশ!!
আর তিতিন পরে যাওয়ার ভান করছে। যেন সেও জ্যান্ত মানুষের বাচ্চা। কিছুসময় খেলার পরে আর ভাল্লাগছে না। বিছানা থেকে নেমে টুকটুক করে বারান্দায় চলে গেল । যেন কারো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। সেতু পেছন থেকে বলল,,

– ভূমি?? ওখানে কি করছ মা?
– কিতু না।
– ঘরেই থাক কেমন আমি চট করে যাচ্ছি আর আসছি।
– আততা।
সেতু চলে গেলে ভূমি মন খারাপ করে তিতিনের সাথে খেলতে থাকে। হঠাৎই একটা মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে,,
– ও সেতু বাড়িতে কি ভূমি আছে??
সঙ্গে সঙ্গে ভূমি ঝড়ের গতিতে দড়জার দিকে এগিয়ে যায় । দড়জার কাছে ক্রিম কালারের বোরখা পরা নিকাব বাঁধা জোড়া ভুরুর এক নারী দাড়িয়ে আছে। গাল ফুলিয়ে ভূমি রাগ দেখালে সে নিজেই এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,,

– আমার থামহা থিকাদদাল বুমি টা কি লাগ কলেচে? মা?
– উমমম
– আআ,, আম্মু খুব পচা,, দেরি হয়ে গেছে সরি মা।
– ইটা কি?
– ইটা,,, ইটা হলো আমার মায়ের জন্য একটা গিফ্ট!
– দাও দাও দাও।
– উমমম,, কিন্তু আমিতো রেগে আছি।
– কেনু?

– আম্মুকে সালাম দিয়েছ??
– উ,, আত.. আতথালা মলাইকুম.
– ওয়ালাইকুম আস সালাম, ধরো,,
মায়ের হাত থেকে ক,খ এর বই পেয়ে সে খুবই খুশি। বইটা হাতেনিয়ে বিছানায় উঠে বসে রইল। তিতিনও তার গা ঘেঁষে বসে রইল।

জামাকাপড় বদলে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়াতেই দৃশ্যমান হলো তার চেহারা । সে আর কেউ নয় সামির সিকান্দার কে নিঃস্ব করে আসা মাহাদিবা ফারনাজ মাহা। চেহারাটা ঠিকই আছে তবে গলার কাছে কিছুটা অংশ পোড়ার দাগ রয়ে গেছে ।

চাদের আলোয় পুরো ঘর চকচক করছে। রাতের খাওয়া শেষে মাহা ভূমিকে নিয়ে বারান্দায় বসে ছিল। সেতু বসে বসে মোবাইল দেখছে মাহা একটা বই হাতে কিসের যেন দোয়া পরছিল,,
ভূমি তার কোলে হেলান দিয়ে বসে,,

– আম্মু?
– সোনা মা?
– উইযে,,, তুমি,,
আকাশের তারার দিকে ইশারা করে ভূমি বলে,,
ওইযেএএ,, মাহা তাকে কোলে তুলে আকাশের দিকে ইশারা করে,,
– ওইযে ওটা ভূমি,, এটা মা আর এটা সেত..
– নাআ। আব্বু।

সেতু তাদের দিকে তাকালে মাহাও তার দিকে ঘুরে তাকায় । মাহা ভূমির কথায় মনোযোগ না দিয়ে অন্য কথা তুলে ভুলিয়ে ভালিয়ে দাকে নামিয়ে দেয় । রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সেতু জিজ্ঞেস করে,,
– আপাজান? আপনে কি ফেরত যাবেন না?
– তোমার ভাইজান বিয়ে করেনি?
– না। কন না আপাজান ,, ভূমি কতবার জিগায় আব্বু কই?
– জানিনা । যাও ঘুমাও গিয়ে ।
– হাাহ। আচ্ছা ।

কালকুঠুরি পর্ব ৪৪

মাহা তিতিনের দিকে ইশারা করতেই তিতিন তার কোলে চড়ে বসে। মাহা তার সর্বাঙ্গে আঙুল বুলিয়ে আদর করে দেয় । আস্তে করে বলে,,
– কেন যাব ফেরত? কেন?

কালকুঠুরি পর্ব ৪৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here