কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১১
মিসরাতুল রহমান চৈতী
রাতুল ফোনটা কানে ধরে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চারপাশের সবকিছু যেন থেমে গেছে, কেবল বুকের ভেতর তীব্র শঙ্কার ঝড় বইছে।
— “চৈতীর স্কুলের সামনে ঝামেলা শুরু হয়েছে!”
এই একটি বাক্যই যথেষ্ট ছিল তার মাথার ভেতর বাজ পড়ানোর জন্য। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠলো। এক মুহূর্ত আগেও যেখানে সমাবেশের বিশৃঙ্খলা সামলাতে ব্যস্ত ছিল, এখন তার মাথায় একটাই চিন্তা—চৈতী!
— “কী বলছিস তুই? ঠিকঠাক বল! কী হচ্ছে ওখানে?”
রাতুলের গলা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কঠিন শোনালো।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে দ্রুত বলা হলো,
— “স্যার, কিছু বহিরাগত ছেলে এসেছে, স্কুলের গেটের সামনে জটলা করেছে। ওদের আচরণ সন্দেহজনক লাগছে। কিছু বলতে গেলে তেড়েফুঁড়ে আসে। কিছুক্ষণ আগেই এক মেয়ের দিকে ইঙ্গিত করে হাসাহাসি করছিল, তারপরই শুরু হলো ঝামেলা।”
রাতুল এক মুহূর্তও দেরি করলো না। পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করে বললো,
— “সবাই শান্ত থাকো, আমি আসছি!”
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নেতারা অবাক হয়ে তাকালো।
— “রাতুল সাহেব, আপনি এখন গেলে সমাবেশ…”
— “ওসব আমার দরকার নেই!”
সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলো রাতুল। তার দলের কিছু ঘনিষ্ঠ কর্মী তার পিছু নিলো।
গাড়ি স্টার্ট দিতেই ড্রাইভার জানতে চাইল, “স্যার, কোথায় যাবো?”
— “দ্রুত চৈতীর স্কুলের দিকে নিয়ে চলো!”
গাড়ি যেন বাতাসের গতিতে ছুটতে লাগলো। পুরো পথ রাতুলের মুখ শক্ত হয়ে রইলো। তার চোখ দুটো ধিকিধিকি আগুনের মত জ্বলছে। হাতের আঙুলগুলো শক্ত হয়ে স্টিয়ারিং হুইলের উপর চেপে আছে।
সে জানে, এই পরিস্থিতি হালকা কিছু নয়। রাজনীতির মাঠে তার অনেক শত্রু আছে, যারা কেবল রাজনৈতিকভাবে নয়, ব্যক্তিগতভাবেও তাকে আঘাত হানতে চাইবে। চৈতীকে ঘিরে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেটা হয়তো তার প্রতিপক্ষেরই কাজ!
“আমি থাকতে চৈতীর গায়ে কেউ হাত দেবে? ভাবতেও পারবে না!”— মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো রাতুল।
সমাবেশের ঝামেলাটা সামলে নিবে কেউনা কেউ তাই তার মাথায় এইসব নে আছে কেবল চৈতীর কথা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
স্কুলের গেটের সামনে উত্তেজনা বাড়ছিল। বেশ কয়েকজন ছেলে উচ্চস্বরে তর্ক করছিল, তারপর হুট করেই একে অপরের দিকে তেড়ে গেল। শুরু হয়ে গেল ধাক্কাধাক্কি।
“ওই! তুই কি বললি?”
“তোকে যা বলার বলছি! যা পারিস কর!”
ধাক্কাধাক্কির মাঝেই একজন ছেলের কলার চেপে ধরল আরেকজন। মুহূর্তে গেটের সামনে একেবারে গোলমাল শুরু হয়ে গেল। কিছু অভিভাবক ও স্কুলের গার্ডরা ছুটে এলো, কিন্তু ছেলেগুলো এতটাই রেগে ছিল যে, কারও কথাই শুনছিল না।
“ভাই, থামেন! স্কুলের সামনে এইসব ঠিক না!”— একজন গার্ড চিৎকার করল।
কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেছে। এক ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো, সে উঠে এসে সঙ্গে সঙ্গেই ঘুষি চালিয়ে দিল আরেকজনের মুখে! মুহূর্তেই রক্ত ঝরতে শুরু করল। কেউ একজন জোরে চিৎকার করে উঠল, আর পুরো জায়গাটা একদম উত্তপ্ত হয়ে গেল।
“ওই! একসাথে আসছে! পিছাইস না!”
আরও কয়েকজন দৌড়ে এসে তাদের দলে যোগ দিল। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটা দল হয়ে গেল, এবং একে অপরের দিকে ঘুষি-লাথি চালাতে শুরু করল। স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী আর কয়েকজন অভিভাবক আতঙ্কে গেটের ভেতরে সরে গেল।
চৈতী তখন ক্লাস থেকে বের হচ্ছিল। গেটের সামনে মারামারির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়াল। কিছু মেয়েও পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল, সবাই চুপ হয়ে গেছে।
ঠিক সেই সময় রাতুলের গাড়িটা গেটের সামনে এসে থামল। গাড়ির দরজা খুলেই রাতুল নামল, চোখেমুখে স্পষ্ট রাগ। তার সাথের কয়েকজন গার্ডও দ্রুত বের হয়ে এলো।
রাতুল একবার পুরো পরিস্থিতি স্ক্যান করল, তারপর গর্জে উঠল,
“এইখানে কি হচ্ছে? থামো!”
কিন্তু ছেলেগুলো তখনও একে অপরের দিকে হামলে পড়ছে। একজনের নাক ফেটে গেছে, অন্যজনের ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে।
রাতুল এগিয়ে গিয়ে একটা ছেলেকে কলার ধরে সরিয়ে দিল। এত জোরে ধাক্কা দিল যে সে গিয়ে গেটের পাশের রডে আঘাত পেল।
“আরেকজন যদি হাত তোলে, হাত ভেঙে দেব!”— রাতুলের গলা ভয়ানক কঠিন হয়ে উঠল।
তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ছেলেগুলো একে একে থেমে গেল। কেউ কেউ ফোঁপাচ্ছিল, কেউ মুখে হাত দিয়ে রক্ত মুছছিল।
রাতুল একবার চোখ ঘুরিয়ে চৈতীর দিকে তাকাল। চৈতী তখন হতভম্ব হয়ে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখে ভয় আর অবিশ্বাসের ছাপ।
“গাড়িতে ওঠো,”— রাতুল শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল।
চৈতী এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে গাড়ির দিকে এগোল।
রাতুল তখনও জায়গাটা ছেড়ে যায়নি। সে কয়েকজন ছেলেকে একদৃষ্টিতে দেখে বলল,
“স্কুলের সামনে এ ধরনের কিছু আর একবার দেখলে, খবর আছে! বোঝা গেছে?”
কেউ কিছু বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
রাতুল দাঁড়িয়ে আরও কয়েক সেকেন্ড তাদের দেখে নিল, তারপর গাড়ির দরজা খুলে উঠতে যাবে ঠিক তখনই—
“ধাম!”
পিছন থেকে কেউ ভারী কিছু দিয়ে রাতুলের মাথায় আঘাত করল!
রাতুলের দেহ এক মুহূর্তের জন্য হোঁচট খেল, মাথার পাশে হাত চেপে ধরল। তারপর ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরল। তার চোখ দুটো রক্তিম হয়ে উঠেছে, গভীর, ভয়ঙ্কর।
চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ নড়ছে না, কেউ কিছু বলছে না।
রাতুল এবার এক পা সামনে বাড়াল—
“ধাম!”
আরেকটা শক্ত আঘাত!
এইবার ওর দেহ সরাসরি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল! সাদা পাঞ্জাবির বুক বরাবর গভীর লাল রক্তের দাগ ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে নিথর হয়ে পড়ে আছে রাতুল। চারপাশে হট্টগোল, চিৎকার, দৌড়াদৌড়ি—সবকিছু যেন মুহূর্তেই থমকে গেছে।
চৈতী গাড়ি থেকে ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে রাতুলের পাশে বসে পড়লো। কাঁপা হাতে রাতুলের মাথাটা তুলে নিজের কোলে রাখলো।
তার শ্বাস যেন আটকে আসছে, গলা শুকিয়ে গেছে। কাঁপা কণ্ঠে ডাক দিলো—
“এমপি আহম্মেদ!”
কোনো সাড়া নেই। রাতুলের চোখ বোজা, ঠোঁট ফ্যাকাশে। চৈতীর বুকের ভেতর শূন্যতা নেমে এলো।
চারপাশের কোলাহলের মাঝেও সময় যেন থমকে গেল…
চৈতীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। হাতের তালুতে রাতুলের উষ্ণ রক্ত জমাট বাঁধছে। শ্বাস আটকে আসছে তার, কণ্ঠ আটকে গেছে কেঁপে ওঠা ঠোঁটে।
“রাতুল! চোখ খুলো! প্লিজ, চোখ খুলো!”
তার কণ্ঠস্বরে ভয় আর আকুতি একসাথে মিশে আছে, কিন্তু কোনো উত্তর নেই। রাতুলের নিথর দেহ তার কোলে এলিয়ে আছে, নিস্তেজ, রক্তে ভেজা!
চারপাশে হৈচৈ চলছে, কেউ চিৎকার করছে, কেউ দৌড়ে যাচ্ছে। স্কুলের গার্ড, শিক্ষক, অভিভাবক—সবাই শোরগোল করছে, কিন্তু চৈতীর কানে কিছু ঢুকছে না। সে কেবল রাতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
ঠিক তখনই রাতুলের দলের কিছু লোক ছুটে এলো।
“স্যার!”
তারা দ্রুত রাতুলকে তুলতে গেল, কিন্তু চৈতী তাদের থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমরা এম্বুলেন্স ডাকো! এক্ষুনি ডাকো!”
কেউ একজন ইতোমধ্যে ফোনে কথা বলছে,
“হ্যালো! এম্বুলেন্স পাঠান! জরুরি! আমাদের এমপি সাহেব আহত হয়েছেন!”
একটা কালো গাড়ি দ্রুত ব্রেক কষে দাঁড়ালো। দরজা খুলে দুজন লোক বেরিয়ে এলো, তাদের চোখের দৃষ্টি শীতল, উদ্দেশ্য খারাপ বোঝাই যাচ্ছে।
চৈতী তাদের দেখে মুহূর্তের জন্য বোঝার চেষ্টা করলো, কিন্তু মাথার ভেতর তখন শুধু একটাই চিন্তা—রাতুল!
একজন এগিয়ে এসে বলল,
“একে আমাদের সাথে নিতে হবে!”
চৈতী মুহূর্তেই রাগে ফেটে পড়ল,
“তোমরা কে? পিছিয়ে যাও!”
লোকটা একটুও বিচলিত হলো না, বরং চোখ সরাসরি চৈতীর দিকে রেখে বলল,
“এই অবস্থায় বেশি কথা বলো না, মিসেস চৈতী। তুমি তো জানো না, কার সাথে লড়াই করছো!”
চৈতীর গায়ের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
কিন্তু তার চোখের জল আর ভয় একসাথে যেন এক প্রবল রাগে রূপ নিলো।
সে ধীর কণ্ঠে বলল,
“তোমরা যদি এক কদম এগোও, আমি শপথ করে বলছি, এই জায়গায় একটাও সুস্থ শরীর নিয়ে বের হতে পারবে না!”
লোকটা চোখ সরু করে তাকাল, যেন সে চৈতীর সাহসের পরিমাণ মাপছে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। কয়েকটা বাইক এসে দাঁড়ালো, সাথে আরো কিছু কালো গাড়ি।
লোকটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো, তারপর ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আজকের মতো ছেড়ে দিলাম, মিসেস চৈতী। কিন্তু এই খেলা তো মাত্র শুরু হলো!”
বলে সে গাড়ির দিকে ফিরে গেল।
চৈতী শক্তভাবে রাতুলকে ধরে রইলো, তার চোখে ভয় নেই, কিন্তু ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ এগিয়ে এলো, সাথে রাতুলের দলের কিছু লোক।
“স্যারকে গাড়িতে তোলেন, আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি!”
চৈতী কিছু না বলে মাথা ঝাঁকালো।
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১০
রাতুলের নিস্তেজ দেহ গাড়ির মধ্যে তোলা হলো, চৈতীও সাথে উঠে বসল। গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই সে শক্ত করে রাতুলের হাত ধরলো।
তার চোখের জল এবার আর ধরে রাখা সম্ভব হলো না। গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চললো হাসপাতালের দিকে।