কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৫

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৫
মিসরাতুল রহমান চৈতী

আজ শুক্রবার। সারা শহরজুড়ে এক শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের ঢল নেমেছে। সেই ভিড়ের মাঝেই রাতুলও নামাজ আদায় করতে বের হলো।
চৈতী ঘরে একা। জানালার পর্দা হালকা দুলছে বাতাসে। সে এক কোণে বসে বই খুলে পড়ছে। চারপাশের নিস্তব্ধতার মাঝে শুধু পাতার খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছে।
বাইরে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে, আর ঘরের ভেতরে চৈতী।
কিছুক্ষণের জন্য সে বইটা বন্ধ করে রাখলো। জানালার দিকে তাকিয়ে, আজানের সুরের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললো। আজ, শুক্রবারের এই স্নিগ্ধ পরিবেশে, তার মন যেন অন্য এক জগতে চলে গিয়েছিল—একটা নতুন পথ, নতুন শান্তির সন্ধানে।

শাওয়ার নিতে হবে, তাই চৈতী ধীরে পায়ে আলমারির কাছে এগিয়ে গেলো। আলমারি খুলতেই একপাশে রাখা ফাইলটি হঠাৎ করে মেঝেতে টুপ করে পড়ে গেলো। চৈতী কিছুটা অবাক হয়ে ফাইলটা তুলে নিলো।
ফাইলটি খুলে চৈতী দেখতে লাগলো। একসময়, একটি জায়গায় গিয়ে তার চোখ আটকে গেলো। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো তারপর দ্রুত ফাইলটি বন্ধ করে আবার আলমারিতে রেখে দিলো। চোখের কোণে একটু ভ্রু কুঁচকে, কিন্তু সে কোনো মন্তব্য না করে শাওয়ার নিতে চলে গেলো।
শাওয়ার শেষে চৈতী বের হয়ে ভেজা জামাকাপড় বেলকনিতে মেলে দিয়ে, ধীরে ধীরে রুমে ফিরে এলো। এক কোণে জায়নামাজ বিছিয়ে, শান্তভাবে নামাজ পড়তে শুরু করলো। তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে যেন এক ধরনের তৃপ্তি, আর নামাজে তার মন যেন পূর্ণ একাগ্রতায় ডুবে গেছে।
নামাজ শেষে চৈতী ধীরে ধীরে মোনাজাত শুরু করলো। তবে কিছুক্ষণ পরই, তার মন পাথরের মতো ভারী হয়ে উঠলো। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে সব কিছু মনের গভীর থেকে খুলে বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তার অশ্রু যেন আত্মার প্রতিটি ক্ষত ভরিয়ে দিতে চাইছিলো, আর হৃদয়ের সব দুঃখ, কষ্ট একসাথে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জায়নামাজ গুছিয়ে রাখতে গিয়ে রাতুল সবে মাত্র রুমে ঢুকলো। রুমে ঢুকতেই চৈতী এক হাতে জায়নামাজের কোণ ধরলো, আর অন্য হাতে রাতুলের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলো। তার চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে, যেন একেবারে রক্তে ভরা, অদ্ভুত এক আগুনের মতো জ্বলছে। রাতুল স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, চৈতীর এমন অবস্থায় তাকে কিছু বলতে সাহস হচ্ছিলো না। চৈতীর মুখে কোনো শব্দ না উঠলেও তার চোখের ভাষা স্পষ্ট, এক ধরনের অশান্তি, এক ধরনের অসন্তুষ্টি যেন ঝলকিয়ে উঠছে।
চৈতী ক্রোধে অস্থির হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “আমি জানতাম আপনি খারাপ, পাপিষ্ঠ, কিন্তু এতো বড় পাপিষ্ঠ, তা কখনোই ভাবিনি! আপনি তো শয়তানের গুরু ঠাকুর!”
রাতুল স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকাল, কিছুটা ধাক্কা খেয়ে বললো, “কি হচ্ছে, চৈতী? এইটা কোন ধরনের অসভ্যতা? আমি তোমার স্বামী, হইনি কি?”

চৈতী তীব্র চোখে তাকিয়ে, গর্জে উঠে উত্তর দিলো, “আপনি স্বামী নন, আপনি আসামী!” লজ্জা করলো না এতো গুলো মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে আপনি ড্রাগস,, চোরাকারবার এ যুক্ত ছি ছি নিজে তো অনেক আগেই কলঙ্কিত হয়েছে আমায় কেন করলেন আমায় কেন জড়ালেন কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো
চৈতী মুখে প্রচণ্ড তিক্ততা নিয়ে বললো, “লজ্জা করলো না? এতো মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে আপনি ড্রাগস, চোরাকারবারে যুক্ত—ছি ছি! নিজে তো অনেক আগেই কলঙ্কিত হয়েছেন, আমায় কেন করলেন? আমায় কেন জড়ালেন?” কাঁদতে কাঁদতে চৈতী মেঝেতে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো, যেন তার হৃদয় থেকে একটানা কষ্ট বের হয়ে যাচ্ছে, তার চোখে অশ্রু আর গলার আওয়াজে এক ধরনের ভাঙনের শব্দ।
চকিত নয়নে রাতুল চৈতী পানে তাকালো। তার মনে হলো, কী বলবে সে? সত্য কখনো চাপা থাকে না; দিনের আলোর মতো এক সময় তা প্রকাশ পায়। চৈতীর চোখে এক নতুন ঘৃণা ফুটে উঠলো, যেন তার প্রতি সমস্ত অবিশ্বাস এবং ক্ষোভের ধাপ বেড়ে গেছে।

নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছু মুহূর্ত নিয়েছিল রাতুল। তারপর, চৈতীকে সহস্র শক্তি দিয়ে তুলে দাঁড় করাতে এগিয়ে গেলো। কিন্তু চৈতী যেন এক অসম্ভব দৃঢ়তায়, এক অভূতপূর্ব শক্তির মাধ্যমে সরে গেলো। নিজে থেকেই দাঁড়িয়ে, চোখে অন্ধকারের রাগ, মুখে তীব্র সংকল্পের ছাপ নিয়ে সে বললো, “আপনি আমাকে ধরবেন না। যদি আপনি আমাকে একবার ছুঁয়ে দেখেন, আমি নিজেকে শেষ করে দিবো।”
রাতুল চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর নিঃশব্দে, কিন্তু গভীরভাবে বললো, “বেশ, ধরবো না। তবে, আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না। শরীর তো এক পাষণ্ডও ছুঁতে পারে, কিন্তু মন—ক’জন সেই মন ছুঁতে পারে? আমি হয়তো তোমার মন ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষায় থাকবো, সেই অদৃশ্য, নরম প্রান্তে।”
চৈতী শ্বাস কেটে, ঠোঁট চেপে বললো, “এই স্বপ্ন কখনো পূর্ণ হবে না।”
রাতুল ধীরগম্ভীর অথচ দৃঢ় সুরে উত্তর দিলো, “তবুও, আমি বলবো—বাঁধবো তোমার সাথে আমি আমার জীবন, যত যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই আমাকে যেতে হোক না কেন।”
রাতুল বলতে লাগলো–

আমাকে রেখে দিয়ো, তোমার জীবনের এক নিবৃত্ত অধ্যায়ে,
ঘৃণা আর অবহেলায়, যেমন বইয়ের পৃষ্ঠায় জমে থাকা ধূলোর মতো,
অযত্নে, শুকিয়ে যাওয়া ফুলের পাপড়ি,
যেগুলো আর কখনো কোনো জীবন্ত রঙে ফোটে না।
আমাকে রেখে দিয়ো, তোমার উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায়,
যেখানে আমার অস্তিত্ব যেন একটি অমীমাংসিত গল্প,
অথচ, আমার থেকে যাওয়ার ইচ্ছে কখনোই পূর্ণ হবে না।
এ যেন এক না পাওয়ার কষ্ট,
যেটা শুধু হৃদয়ের গভীরে তীব্রভাবে চেপে ধরে রাখে,
আর সেই একই সময়ে— এক অসম্ভব আকুলতায়,
আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই।
তত দিন, যত দিন আমি তোমার পাতায় পাতায় অব্যক্ত,
তোমার গল্পে থেকেও— এক অনন্ত অপেক্ষায় চুপচাপ,
তোমার কাছে হারিয়ে যাইনি,
তবে আমি রয়েছি, তোমার হৃদয়ের কোণে।

রাতুল কবিতাটি বলে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর, কোনো কথা না বলে বারান্দায় চলে গেলো। সেখানে গিয়ে তার বেড সিস্টেমের দোলনায় বসে পড়ে। একটু পর, ধপাস করে শুয়ে পড়লো, যেন এক বুক ভার নিয়ে। দোষটা তার ছিল না, তার নিয়তি। তার কোনদিনও ইচ্ছা ছিল না পাপের পথে পা রাখা, কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আজকের জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। পরিবারে সম্পর্কের সূত্রে সে এক পাপের জালে আটকে পড়েছে। এখন সে মুক্তি চায়, কিন্তু সে জানে, একবার এই চোরাবালিতে আটকে গেলে, সহজে তার পিছুটান ছাড়ানো যায় না।
রাতুল চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো, যেন নিজের সমস্ত চিন্তা ও কষ্ট একত্রিত করে মনে মনে গুছিয়ে নিতে চায়। তার মনের ভিতর এক অদৃশ্য চাপ, এক কঠিন দ্বন্দ্ব চলছে। তার পরিবারে এসে সে একবার যে পথে পা রেখেছে, তা আর সহজে ছেড়ে যাওয়ার নয়। সেই অন্ধকারে হারিয়ে গেছে তার জীবন, আর তার চোখে এখন শুধুই একটি নিঃসঙ্গতা, যা তাকে ভিতরে ভিতরে ধ্বংস করছে।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৪

কিন্তু রাতুল চায় কিছু একটা বদলাতে। এই চোরাবালির গহ্বরে আটকে গিয়েও, সে জানে যে মুক্তির একমাত্র পথ নিজের ইচ্ছা শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। সে নিজের ভেতরের শক্তি আর আত্মবিশ্বাসে বিশ্বাস রাখে, যে কখনো না কখনো, একদিন, এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে।
শুধু তখনই তার সত্যিকারের মুক্তি আসবে—নিজেকে ফিরে পাওয়া, নিজের কৃতকর্মের দায় মেটানো, আর যারা তাকে প্রিয়জন হিসেবে জানে, তাদের সামনে এক নতুন জীবনের সূচনা।
এখন সময় এসেছে, রাতুল নিজের এক নতুন যাত্রা শুরু করবে, এই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৬