কোন গোপনে মন ভেসেছে শেষ পর্ব 

কোন গোপনে মন ভেসেছে শেষ পর্ব 
মিসরাতুল রহমান চৈতী

রাত গভীর। চারদিকে ঘুমের নিস্তব্ধতা। চৈতী একা—নিঃসঙ্গ। বাহিরে বডিগার্ডরা পাহারায় থাকলেও তার মন যেন অসহায় এক পরিত্যক্ত দ্বীপ।
চোখে ঘুম নেই। সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণি দেখে যাচ্ছে শুধু। চোখ থেকে টুপটাপ করে ঝরছে পানি। নিজের মনকে বারবার প্রশ্ন করছে—
“আমি কি সত্যিই রাতুলকে ভালোবাসি না? না কি শুধুই ওর প্রতি এক অদ্ভুত মায়ার বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছি?”
রাতুল এখন জেলে। কেমন আছে, কেমন কাটছে তার দিন—সে কিছুই জানে না।
আসিফই এখন ওর একমাত্র ভরসা, সে-ই ছুটে বেড়াচ্ছে রাতুলকে মুক্ত করার জন্য।
চৈতী ধীরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পায়ে জুতো গলিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। সার্ভেন্টরা তখন গভীর ঘুমে। চৈতী সব বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিলো, যেন নিজের ভয়টাকে আলোয় গলিয়ে দিতে পারে।
সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াতে লাগলো সে। হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে গেলো একটা পুরনো ধাঁচের দরজার সামনে। দরজায় ঝোলানো একটা বড় তালা।

দরজাটা যেন অন্যরকম। অনেকটাই ভৌতিক, যেমনটা পুরনো সিনেমায় দেখা যায়—ছায়ায় মোড়ানো, ভয়ানক এক ইতিহাস চাপা পড়ে থাকে যার পেছনে।
তালার চাবি নেই… কোথায় আছে, তাও জানে না সে।
কিন্তু আজ তার মনে হচ্ছে, এই রুমে কিছু একটা আছে—অজানা, ভয়ানক কিছু!
চৈতী পা চালিয়ে একেবারে নিজের রুমে চলে গেলো। আলমারিতে ঘাটাঘাটি করতে করতে হঠাৎ সে পেয়ে গেলো একটা পুরনো লোহার বাক্স। বাক্সটা খুলতেই চোখে পড়ে একটা জং ধরা চাবি।
চাবিটা হাতে নিয়ে বুক ধড়ফড় করতে করতে সেই দরজার সামনে দাঁড়ালো সে।
হঠাৎ ঠোঁটে ভেসে এলো একটিই শব্দ—“বিসমিল্লাহ্”
চাবিটা তালায় ঢুকিয়ে ঘুরাতেই কড়াৎ করে খুলে গেলো দরজাটা।
চৈতীর চোখে পড়লো না কিছু—রুমের ভিতর একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। যেন কেউ অন্ধকারটা ধরে এনে ওই ঘরে বন্দী করে রেখেছে!
সে হাতড়ে হাতড়ে সুইচ বোর্ড খুঁজলো…
বুঝে গেলো—এই রুমে পা রাখা মানেই নিজের ভেতরের সাহসকে শেষবারের মতো চ্যালেঞ্জ জানানো।
হাত পেয়ে গেলো বোর্ড—ক্লিক!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

টিক…
টিক…
টিক… ক্লিক!
আলো জ্বলে উঠলো—আর এক মুহূর্তেই চৈতীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো।
রুমের চারপাশে যেন মৃত্যুর থাবা আঁকা। দেওয়ালের একেক পাশে লাল রক্তের ছোপ।
কোথাও হাতের ছাপ, আবার কোথাও বড় বড় আঁচড়ের দাগ। যেন কেউ জীবন্ত কারো শরীর টেনে এনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলো এখানে!
একটা কোণে পড়ে আছে কালো কাচের বোতল—ভেতরে যেন হাড়গোড়ের মতো কিছু ভাসছে।
দেয়ালের মাঝখানে একটা পোট্রেট—কিন্তু মুখ নেই! কেউ যেন ছবিটার মুখটুকু ছুরি দিয়ে কেটে ফেলেছে!
মেঝেতে ধুলো জমে থাকা জায়গায় একেবারে টাটকা রক্তের মতো লাল রঙ ছড়িয়ে আছে।
চৈতীর মনে হলো—এই রুম কেবল একটি রুম নয়, বরং একটা নিষিদ্ধ অতীত, যেখানে কোনোদিন আলো ঢোকেনি… আর ঢুকলে তা আর ফিরে আসতে পারেনি।
চারপাশের বাতাসও যেন কেমন ঘন হয়ে উঠছে…
তার পেছনে কে যেন নিঃশ্বাস ফেলছে…

চৈতী ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো—কিন্তু পেছনে কেউ নেই।
তবু মনে হলো, কেউ আছে।
কেউ যে খুব ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে…
চৈতীর চোখ এবার পড়ে পাশের আরেকটি দরজার দিকে।
রক্তেভেজা দেয়াল থেকে চোখ সরিয়ে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে গেলো সেই দরজার কাছে।
কাঁপতে থাকা হাত তুলে ধীরে ধীরে ঠেলে দিলো দরজাটি—
কৃশশশ…
একটা কর্কশ শব্দ তুলে খুলে গেলো দরজা।
ভেতরে ঢুকতেই চৈতীর শরীর গুলিয়ে উঠলো।
একটা ছোটখাটো সিক্রেট রুম—তবে সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছিলো ঠিক যেনো কোনো গোপন ডেন।
কোণের টেবিলের উপর ছড়ানো মদের বোতল, আধখালি গ্লাস, সিগারেটের ছাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
মেঝেতে কিছু ভাঙা গ্লাসের টুকরো আর ছিটানো কিছু লালচে দাগ।
চৈতীর ভ্রু কুঁচকে এলো।

“এইসব… এইসব কালকের মতোই টাটকা দেখাচ্ছে! কিন্তু এখানে আসতে পারে কে?”
গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠলো কিছু। কেমন একটা অজানা আতঙ্কে তার নিঃশ্বাস আটকে এলো।
তার চোখ এবার টেবিলের এক পাশে রাখা বুকশেলফের দিকে গেলো।
সেখানে বেশ কিছু ফাইল অগোছালোভাবে রাখা।
এক সাইডে একদম পরিপাটি, পরিষ্কার ফাইল, অন্যদিকে ছেঁড়া, ধুলিমাখা, পুরনো ফাইলের স্তূপ।
চৈতী ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে গেলো বুকশেলফটার সামনে।
হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো একটি পুরনো ফাইল।
ধূলি উড়ে উঠলো—চোখ-মুখ ঢেকে চোখ রগড়ে নিয়ে নিচে ফ্লোরে বসে পড়লো সে।
তার হাত কাঁপছে। চোখ স্থির হয়ে গেছে ফাইলের কভার পাতার দিকে তাকিয়ে।
একটা ছেঁড়া কাগজে হাতে লেখা কয়েকটি লাইন—
আর নীচে আঁচড়ানো এক নাম—
“রাতুল আহমেদ খান – ফাইল: গোপন ১৩/বি”
চৈতীর ঠোঁট শুকিয়ে এলো।
হৃদস্পন্দন যেন হঠাৎ দ্বিগুণ গতিতে চলতে শুরু করলো…
চৈতীর কাঁপা হাতে খোলা ফাইলটার পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখ আটকে গেলো এক ভয়ংকর সত্যের পাতায়।
প্রথমেই বড় করে লেখা—

“রাতুল আহম্মেদ: অপরাধমূলক কার্যক্রমের বিস্তারিত রিপোর্ট।”
চোখের পাতা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো চৈতীর।
লাইন বাই লাইন পড়তে শুরু করলো সে—
খুন, গুম, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, ড্রাগ পাচার, আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রে জড়িত থাকা, পুলিশের একাধিক কেসে সন্দেহভাজন…
একটা একটা করে পৃষ্ঠার উপর ছড়ানো ছবিগুলো তাক লাগিয়ে দিচ্ছিলো।
কারো হাতে দড়ি বাঁধা, কেউ অজ্ঞান অবস্থায় মেঝেতে পড়ে, কারো মুখ রক্তমাখা।
সব ছবির নিচে লেখা—
“Target Eliminated – Suspect: R.A. ”
চৈতী যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলো।
এগিয়ে গেলো আরেকটু—
আর তখনই সে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
ফাইলের মাঝামাঝি জায়গায়, একটা কালো কাগজের ফ্রেমে গুঁজে রাখা একটা ছবি।
ছবির নিচে লেখা—

“মিসেল রহমান – হত্যা তারিখ: ১৭ আগস্ট – অভিযুক্ত: রাতুল আহমেদ খান”
চৈতীর হাত থেকে ফাইল পড়ে গেলো।
চোখ ফেটে অঝোরে পানি ঝরতে লাগলো।
সে ধীরে ধীরে নিচু হয়ে পড়লো ফাইলটার পাশে, কাঁপা কাঁপা হাতে ছবিটায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললো ফিসফিস করে—
“বাবা…!”
চৈতীর গলা ধরে এলো।
এই ছবিটা… এই মানুষটা… এই ‘মিসেল রহমান’ তার বাবা!
আর সেই মানুষটার প্রাণ নিয়েছে যে লোকটাকে নিয়ে সে এতদিন মায়া বুনে চলেছিলো—রাতুল!
চৈতীর চোখে তখন কোনো দ্বিধা নেই।
ভালবাসা, টান, আবেগ—সব এক ঝটকায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
একটা আগুন জ্বলছে তার চোখে।
একটা প্রতিজ্ঞা জন্ম নিচ্ছে তার বুকে।
চৈতী এবার হাত বাড়ালো পাশের ফাইলগুলোর দিকে, যেগুলো ছিলো তুলনামূলক পরিষ্কার ও গুছানো।
ফাইল খুলে চোখ রাখতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
একটা তালিকা—

সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো কিছু নাম, বয়স, অবস্থান, আর পাশে বড় করে লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা “Transfer Date: 15 April”
মানে— আর মাত্র দুই দিন পর এই মেয়েগুলো পাচার হয়ে যাবে!
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো চৈতীর।
এইসব নাম… কয়েকটা নাম চেনা চেনা লাগছে ওর।
তারা কেউ ওর আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলো, কেউ এসেছিলো চৈতীর স্বপ্নের “পুনর্বাসন প্রকল্পে”।
সবারই জীবন বদলের আশায় বুক বেঁধেছিলো…
কিন্তু বাস্তবটা—এই নরকে ঠেলে দেওয়ার নীলনকশা!
চৈতী চোখ বন্ধ করলো।
তার ভিতরটা কাঁপছে।
বিশ্বাসঘাতকতা… এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা!
রাতুল, যার জন্য সে কাঁদতো, প্রার্থনা করতো, তার মুক্তির জন্য নির্ঘুম রাত কাটাতো—
সে-ই কিনা ছিলো এই ঘৃণ্য চক্রের মূল হোতা!
চৈতীর মনে পড়তে লাগলো—
রাতুলের প্রতিটা কথা, প্রতিটা ছোঁয়া, প্রতিটা প্রতিশ্রুতি—সবই ছিলো অভিনয়।
মেয়েদের জন্য গড়ে তোলা ‘নতুন বাসস্থান’, ‘পতিতালয় মুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন’, ‘নারী স্বাধীনতার নামে সভা-সেমিনার’—সবই ছিলো এক ভয়ংকর প্রতারণার মুখোশ।
চৈতীর মাথাটা যেন ঘুরে উঠলো।

সে দেয়ালে হেলে পড়লো, হাত দিয়ে বুক চেপে ধরলো।
এই জীবনে সে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না… কাউকেই না।
তার চোখ এখন শুধুই প্রতিশোধ দেখে।
“এই নাটকের শেষ দৃশ্য আমি লিখবো…
আর এইবার রক্ত দিয়ে লেখা হবে।”
মাথা নিচু করে, ভাঙা ভাঙা পায়ে চৈতী উঠে দাঁড়ালো।
চোখে জল, কিন্তু মুখে এক অজানা দৃঢ়তা।
এগিয়ে গেলো পাশে থাকা টেবিলটার দিকে।
একটা একটা করে ড্রয়ার খুলতে লাগলো, গভীর মনোযোগে খুঁজছে যেন কোনো লুকোনো সিক্রেট।
প্রথম দুটো ড্রয়ারে তেমন কিছু না।
কিন্তু শেষ ড্রয়ারটা…
খুলতেই চোখে পড়লো একটা পুরনো চামড়ার বাঁধাই করা ডায়েরি।
হাত কাঁপতে কাঁপতে চৈতী সেটি তুলে নিলো।
হাতের তালুর ঘামে ভিজে উঠছে মলাটটা।
ডায়েরিটা খুলতেই চোখ আটকে গেলো প্রথম পাতায়—
সেই পরিচিত হাতের লেখা,
আর তাতে লেখা কিছু লাইন—
“চৈতী…

“তুই যখন প্রথম এসেছিলি এই বাড়িতে, তোর চুলে ছিল গন্ধ মেহেদির, চোখে ছিল এক অচেনা ভয় আর ভেতরে ছিল হাজারটা প্রশ্ন।
কিন্তু জানিস চৈতী, তোকে দেখেই আমি প্রথমবারের মতো থেমে গেছিলাম।
আমার ভিতরের হিংস্রতা, আমার কুৎসিত অতীত—সব চাপা পড়ে গেছিল তোর একটা হাসিতে।
তুই যখন খাবার নিয়ে চুপচাপ এসে রাখতি, আমি অকারণে রেগে উঠতাম—
কিন্তু আসলে আমি তোকে ভয় পেতাম।
কারণ তুই ছিলি আলোর মতো, আর আমি অন্ধকারে জন্মানো মানুষ।
তোর গলায় যখন আমার নামটা ‘সাহস করে’ শুনেছিলাম—রাতুল…
তখন মনে হয়েছিল, আমি এই নামে নতুন করে জন্ম নিতে চাই।
তোর কাছে আমি ভালো মানুষ হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম, জানিস?”_
“তুই যখন কেঁদে ফেলতিস, আমি অন্ধকারে বসে শুনতাম।
আমার গায়ে হাত তুলে তুই যদি রেগে যেতিস—
আমি মুখ ফিরিয়ে ফেলতাম, কারণ আমি জানতাম, তোর রাগে কোনো ভয় নেই।
এই পাপের রাজ্যে শুধু একটাই শান্তি ছিল—
তোর মুখ।
তুই ঘুমিয়ে থাকলে আমি চুপচাপ বসে থাকতাম পাশে।
তুই কখনো টেরও পাসনি,
কিন্তু তোর পায়ের পায়ের চুড়ির শব্দই আমার জন্য বেঁচে থাকার গান হয়ে উঠেছিল।”_
চৈতীর চোখে জল টলটল করে উঠছিল।
ভেতরের একধরনের মমতা ছড়িয়ে পড়ছিল পুরো শরীরে।
ডায়েরির প্রতিটা লাইনে যেন ছিল অপূর্ণ ভালোবাসার স্বাদ।
কিন্তু…

পাতা উল্টাতেই লেখা ছিল—
_”ঈদের পার্টির দিন—
আমি বুঝেছিলাম, তুই আমার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিস।
তোকে একরকম নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম।
আমি জানতাম তুই সহজে আমার কাছে নিজেকে সঁপে দিবি না।
তাই…
আমি নাহিদ হাসানকে বলেছিলাম, তোর সফট ড্রিঙ্কে মিশিয়ে দিতে কিছু…
শুধু একটু ঘুম নয়, ছিল উত্তেজক ঔষধও।
আমি চেয়েছিলাম, তুই সেদিন আর নিজের নিয়ন্ত্রণে না থাকিস।
তোকে ছোঁয়ার জন্য নয়,
শুধু যেন তুই আমার হয়ে যাও… অন্তত শরীর দিয়ে।
আমি জানি এটা পাপ ছিল।

কিন্তু আমি তো তোর চোখে ভালোবাসা পাইনি,
তাই শরীরটা দখল করে তোর মনে জায়গা করে নিতে চেয়েছিলাম।”_
চৈতী ডায়েরিটা হাতে নিয়ে কিছু সময় চুপ করে বসে থাকলো।
তারপর ধপ করে ফেলে দিলো মেঝেতে।
সে বুঝে গেলো—ভালোবাসার আড়ালেই ছিল সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।
“সে কি সত্যিই ভালোবেসেছিলো আমাকে?
নাকি সেটাও একটা নিখুঁত সাজানো ফাঁদ?”
চৈতী হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মেঝেতে।
দু’হাতে মুখ ঢেকে একটানা কাঁদতে লাগলো।
ভালোবাসা, বিশ্বাস, স্বপ্ন—সব যেন এক ভয়ঙ্কর পরিহাস হয়ে গেছিলো এই ডায়েরির পাতায়।
চৈতী আবার কাঁদতে কাঁদতে হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো ডায়েরিটা।
চোখের জল মুছতে মুছতে পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎই তার চোখ আটকে গেলো শেষদিকের একটা পাতায়।
সেইখানে একটা ভাঁজ করা ছোট নোট… আলাদা করে রাখা, খুব গোপনে।
চৈতী ধীরে ধীরে সেই কাগজটা খুললো।

একটা ঠিকানা।
নিচে লেখা — “পুরনো ডেরার জন্য, জরুরি কন্ট্যাক্ট”
তাতেই আবার শুরু হলো চৈতীর মাথার ভেতর ঝড়।
রাতুল সত্যি জেলে আছে তো?
নাকি সবটাই একটা সাজানো ‘আই ওয়াশ’?
চৈতী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো।
চোখে এখন আর জল নেই, ছিল কেবল আগুন।
“এইসব উত্তর আমাকে জানতেই হবে। আর কাউকে বিশ্বাস করবো না। কাউকে না।”
ঠিকানাটা তুলে নিলো পকেটে।
নিজেই সিদ্ধান্ত নিলো—সে একাই যাবে এই ডেরায়। এখনই, এই রাতেই।
চৈতী সেই রহস্যময় রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো।
চুপচাপ বোরকাটা গায়ে জড়িয়ে নিলো।
তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিজের চোখে চোখ রাখলো।
তারপর…

ওয়াশরুমের জানালার কাঁচ গুলো একটা একটা করে খুলে ফেললো নিঃশব্দে।
একটা ব্যাগে ভরে রাখলো কাঁচগুলো—যেন কেউ বুঝতেই না পারে জানালাটা খোলা।
সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সে ধীরে ধীরে জানালার ফ্রেমে পা রাখলো।
মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে গেল জানালা দিয়ে।
চারপাশ নিস্তব্ধ।
ঘুমন্ত শহরের বুক চিরে সে একা একা অন্ধকারে হাঁটতে লাগলো।
কিন্তু প্রশ্ন উঠলো মনে—
“এতো রাতে আমি ওখানে যাবো কীভাবে?”
পা থেমে গেল এক মুহূর্ত।
চৈতী তাকিয়ে থাকলো ফাঁকা রাস্তার দিকে।
হাওয়া বইছে কাঁধ ছুঁয়ে।
তার অবচেতন মন বললো,
“এইখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।”
সে আর দেরি করলো না।
দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলো অজানা গন্তব্যের দিকে।
কারণ এবার শুধু সত্য জানার লড়াই না,
এবার তার নিজেকে প্রমাণ করার লড়াই।
চৈতী হাঁটছে। একা, নিঃসঙ্গ, নির্ভীক।

গভীর রাত, চারপাশে নিঃস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের চিৎকার।
সেই শব্দে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তবুও থামে না চৈতী।
হাঁটছে… যেন এক অনন্ত অন্ধকারে প্রবেশ করছে ধীরে ধীরে।
এই রাতে, এই রাস্তায় কেউ থাকে না—এ কথা জানে সে।
তবু আজ ভয় তার পথ আটকাতে পারছে না।
পায়ের নিচে খচখচ শব্দ তুলে শুকনো পাতাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে।
শরীরটা ক্লান্ত, প্রায় কাহিল।
চোখের পাতা ভারী, পা যেন আর উঠতে চায় না।
তবুও থামছে না চৈতী।
তার চোখে এখন জ্বলছে একটাই অঙ্গীকার—সত্য জানতে হবে, নিজের চোখে দেখতে হবে সেই ভয়ঙ্কর মুখোশের নিচে লুকিয়ে থাকা রাতুলকে।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছে চৈতী। শরীর প্রায় জবড়ে গেছে ক্লান্তিতে। হঠাৎ, একটা ঝাপসা আলোয় চোখ আটকে গেলো।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আসিফ।

একটা কালো গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছে।
চৈতীর বুকের ভেতর ধক করে উঠলো—রাতুলের ডান হাত বলো, বাম হাত বলো—সবই তো আসিফ।
আর আসিফ জানবে না এমন কিছু?
এটা কি আদৌ সম্ভব?
এক মুহূর্তও দেরি করলো না চৈতী।
সাত-পাঁচ না ভেবে, দু’চোখ বন্ধ করে এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে।
চারপাশে কেউ নেই—চুপিচুপি গিয়ে গাড়ির পিছনের ঢেঁকির ভেতরে উঠে পড়লো।
যা হবে, তা পরে দেখা যাবে—আগে তো গন্তব্যে পৌঁছাক!
আসিফ তখনো কথা বলছে। গলার স্বর নিচু, মুখ থমথমে।
মিনিট পাঁচেক পর সে গাড়িতে ফিরে এলো।
কোনো কিছু টের না পেয়েই চালু করলো ইঞ্জিন।
গাড়িটা গর্জে উঠে ছুটে চললো অজানা এক ঠিকানার দিকে…
আর ঢেঁকির ভেতরে লুকিয়ে থাকা চৈতীর চোখে তখনো ঘুরছে সেই ডায়েরির পাতাগুলো,
রক্তমাখা দেওয়াল,
আর বাবা—মিসেল রহমানের নির্মম মৃত্যু।

আসিফের গাড়িটা এসে থামলো এক পুরোনো, জরাজীর্ণ বাড়ির সামনে।
চারপাশে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে, নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো সে।
চৈতী এক মুহূর্তও দেরি করলো না।
আস্তে করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো—সজাগ, সতর্ক, কিন্তু দৃঢ়।
রাস্তার পাশে লাগানো সোডিয়াম বাতির হলুদ আলোয়, বাড়িটা দেখতে যেন ভয়ংকর কোনো ভূতের প্রাসাদের মতো লাগছে।
চৈতী একবার গভীর শ্বাস নিলো।
“নিজেকে শক্ত কর চৈতী… এখন পেছানোর সময় না!”
বাড়ির মূল দরজাটা আধখোলা, আর এই সুযোগে নিঃশব্দে সে ভিতরে পা রাখলো।
ভেতরে নিস্তব্ধতা—কেবল দূর থেকে ভেসে আসছে ফিসফিস করা কিছু গলার আওয়াজ।
চোখ গেলো সিঁড়ির দিকে।

সিঁড়ির ধাপে ধাপে ধুলোর স্তর, কিন্তু তবুও সাবধানে পা ফেলে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগলো চৈতী।
প্রতিটি ধাপে তার নিঃশ্বাস যেন ভারি হয়ে উঠছে।
চারপাশ নিস্তব্ধ, এমনকি তার পায়ের শব্দটাও যেন বাতাসে গায়েব হয়ে যাচ্ছে।
উপরে পৌঁছেই কিছু মানুষের কণ্ঠস্বর কানে এলো—
স্পষ্ট না, কিন্তু বেশ গম্ভীর আর চিন্তিত।
আরও এক কদম এগোতেই, চোখ আটকে গেলো এক রুমের দরজার ফাঁকে—
সেই ফাঁক দিয়ে বেরুচ্ছে ফিকে হলুদ আলো।
একটা টেবিল ল্যাম্প কিংবা ছাদবাতি—ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
চৈতীর বুকের ভিতর ধুকপুকানি বাড়ছে।
“এই আলো, এই কণ্ঠস্বর—সব কিছুর মধ্যে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর কোনো সত্য…”
হঠাৎ—

পেছন থেকে একটা শক্ত হাত চৈতীর বাহু চেপে ধরলো।
চৈতী চমকে তাকালো।
একজন রাগী চেহারার লোক দাঁড়িয়ে—চোখে সন্দেহের ঝিলিক।
“এইটা তো বাইরের কেউ…!”
লোকটা চৈতীর কথা শোনার সুযোগ না দিয়েই শক্ত হাতে টেনে নিয়ে গেলো পাশের ঘরে।
রুমের ভিতর আরো কয়েকজন পুরুষ দাঁড়িয়ে। তাদের মাঝখানে সোফায় বসে আছেন রাতুল—একদম ঠান্ডা চোখ, নির্লিপ্ত মুখ।
লোকটা চৈতীকে ঠেলে দিয়ে বলল,
“বস, এই মাইয়াডা বাইরে দাঁইড়ায় দাঁইড়ায় আপনার সব কথা শুনছিলো।”
রুমে এক মুহূর্তের নীরবতা।
রাতুল কোনো চমক দেখাল না, কোনো প্রশ্ন করলো না।
শুধু ঠাণ্ডা, গভীর দৃষ্টিতে চৈতীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
চৈতীর বুকের ভিতর ছাঁৎ করে উঠলো।
তবুও তার মুখে বিস্ময়ের ছিটেফোঁটা নেই।

“এইখানে ও থাকবে—এটাই তো স্বাভাবিক…”
মনেই যেন অনেক আগেই এই উত্তরটা জেনে গিয়েছিলো সে।”
রাতুল ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো চৈতীর দিকে। ঠান্ডা, মাপা গলায় বললো,
“সবাই চলে যাও।”
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সকলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
রাতুল সামনে আসতেই চৈতী এক পা পিছিয়ে গেলো। চোখে তীব্র ঘৃণা, গলায় কাঁপা কাঁপা আওয়াজ—
“ছুঁবেন না আমায়। অপবিত্র করবেন না আমাকে…”
রাতুল থেমে দাঁড়ালো। কণ্ঠটা শান্ত, কিন্তু ভারী—
“এইখানে কি করছো তুমি?”
চৈতীর চোখে আগুন জ্বলে উঠলো।
“আপনার জঘন্য রূপ দেখতে এসেছি, এমপি রাতুল আহাম্মেদ!”
রাতুল ঠোঁট চেপে শক্তভাবে বললো,
“দেখো চৈতী, তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো।”
আর এক মুহূর্তও নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না চৈতী।

দ্রুত এগিয়ে এসে দুই হাতে চেপে ধরলো রাতুলের পাঞ্জাবির কলার। দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠলো—
“আর কত নিচে নামবেন আপনি? আমার বাবার খুনি!”
রাতুল যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো। এই কথাটা শুনতে সে প্রস্তুত ছিলো না।
ধীরে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো—
“কে… তোমার বাবা?”
চৈতীর চোখে জল, তবু কণ্ঠ অটল—
“মিসেল রহমান!”
এই নামটা যেন এক ঝটকায় সব কেঁপে দিলো রাতুলের ভিতর। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ… তারপর ধাতস্থ হয়ে আবার প্রশ্ন ছুড়লো,
“তুমি ওই রুমে গিয়েছিলে কেন? তাও আমার অনুমতি ছাড়া?”
চৈতী ঠান্ডা হাসলো।
“বেশ করেছি গিয়েছি, একশোবার যাবো। ভাগ্যিস গিয়েছিলাম—তাই তো আপনার কুকর্ম দেখতে পারলাম। ছিঃ, একটা মানুষ এতটা জঘন্য হয় কীভাবে!”
কথাটা বলে একদলা থুতু ছুড়ে দিলো রাতুলের মুখে।
ঘরে গুমোট নীরবতা নেমে এলো।
রাতুলের চোখে হঠাৎই অদ্ভুত আগুন জ্বলে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে চৈতীকে টেনে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো।
চৈতী কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাতুল তার দিকে এগিয়ে এলো। শরীরের ভার দিয়ে তাকে চেপে ধরলো বিছানায়।
চৈতীর হিজাবটা জোরে টেনে খুলে ফেলে দিলো পাশে। দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরলো বিছানার গদির সঙ্গে।
চৈতীর শরীর কাঁপছে। আতঙ্ক, ক্ষোভ, লজ্জা আর ঘৃণায় তার চোখ জ্বলছে। সে ছটফট করলো, কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

“ছাড়ুন! একটুও অধিকার নেই আপনার আমার গায়ে হাত তোলার!”
রাতুলের মুখ কাছে এনে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি যা জানো… তার চেয়েও অনেক ভয়ঙ্কর আমি, চৈতী।”
রাতুলের চোখে তীব্র এক জেদ। মুহূর্তের মধ্যে সে চৈতীর ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো—নিষ্ঠুর, জোরপূর্বক।
চৈতী ছটফট করলো, শরীরটা বাঁকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করলো, কিন্তু রাতুল একটুও দমে গেলো না।
তার হাত দুটো এখনো চৈতীর কবজি চেপে ধরে রেখেছে।
চৈতীর চোখে পানি, ঘৃণা, অপমান সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। সে গলা ফাটিয়ে বলতে চায়—“এই অধিকার আপনার নেই!”
কিন্তু শব্দগুলো যেন গলায় আটকে গেলো। শুধু নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠছে তার।
রাতুল একটু পর চৈতীর ঠোঁট থেকে মুখ সরিয়ে নিলো।
চৈতীর চোখ জ্বলজ্বল করছে রাগে, অপমানে। সে ধাক্কা দিয়ে রাতুলকে দূরে সরিয়ে দিয়ে গর্জে উঠলো,
— “আপনাকে আমি একদিন মেরে ফেলবো!”
রাতুল ঠান্ডা গলায় হেসে বললো,
— “বেশ তো, ফেলো। কে তোমাকে বাঁধা দিচ্ছে?”
চৈতী চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল,

— “আমি থাকবো না এই পাপের রাজ্যে। আমি এখান থেকে চলে যাবো… চিরদিনের মতো।”
রাতুল এবার গম্ভীর স্বরে বললো,
— “আমার সত্যিটা জেনে, ঘৃণা করে হলেও… তোকেই আমার পাশে থাকতে হবে, চৈতী। তুই থাকতে বাধ্য।”
চৈতী পা পিছিয়ে গেলো, গলা শক্ত করে বললো,
— “কখনো না। কখনো না, এমপি রাতুল আহাম্মেদ। আমি মরে গেলেও আপনার মতো নোংরা মানুষের পাশে থাকবো না।”
চৈতীর গাল দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো। চোখ দুটোতে আগুন জ্বলছিলো, কণ্ঠটা ছিলো গলায় চাপা হুমকির মতো।

— “তুই যতদিন বাঁচবি, ততদিন আমার সাথেই থাকতে হবে। ততদিন আমার ছোঁয়া মেনে নিতে হবে… সে ঘৃণা করেই হোক, বা ভালোবেসে।”
চৈতীর চোখ ছলছল করছে, কিন্তু ভেতরের আগুন নিভেনি। তবু সে মুখ ফিরিয়ে নিলো, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক ফুঁড়ে।
বোরকাটা টেনে ধরলো। কাপড়টা কাঁধ থেকে পড়ে গেলো নিচে। চৈতী হতবাক, কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
— “আপনি… আপনি এমনটা করতে পারেন না…”
রাতুল চোখে একরোখা দৃষ্টি নিয়ে বললো,
— “তুই যা দেখছিস, সবটাই উপরের মুখোশ… আমার ভিতরের আগুনটা তোকে ছুঁয়েই যাবে, চৈতী…।”
চৈতী এক ধাক্কায় পেছনে সরে গেলো। চোখে ঘৃণা, কণ্ঠে ঝাঁঝ,

— “আপনি যতটা ভয়ংকর, তার চেয়ে অনেক বেশিই নোংরা… আমি আপনাকে মানুষ ভাবতেই ভুল করেছি।”
হঠাৎ রাতুল চৈতীকে টেনে নিজের দিকে নিয়ে এলো। কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই তার মুখটা চেপে ধরলো চৈতীর গলায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল চৈতীর, আতঙ্কে তার চোখ বড় হয়ে উঠেছিল।
— “ছাড়ুন আমাকে… দূরে যান…” চৈতী ধাক্কা দিতে থাকলো, প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো।
কিন্তু রাতুলের চোখে ছিল অন্য রকম এক উন্মাদনা, যেন কিছুতেই থামবে না সে।
— “তুই পালাতে পারবি না চৈতী… আমি তোর রক্তে মিশে আছি…”
চৈতী আবারও জোরে ধাক্কা দিয়ে বললো,
— “আপনার ছোঁয়াও আমার জন্য অভিশাপ… আমাকে একা থাকতে দিন…”
রাতুল এক মুহূর্ত চেয়ে থাকলো চৈতীর দিকে, তারপর হঠাৎই তাকে ছেড়ে দিল। কিন্তু স্বস্তির ফুরসত পেল না চৈতী। চোখের পলকে তার হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেলে খাটে ফেলে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।
কিছুক্ষণ পর নিচ থেকে এক প্যাকেট খাবার নিয়ে ফিরে এলো। দরজা বন্ধ করে, ধীরে ধীরে এগিয়ে এল চৈতীর দিকে। খাটে বসিয়ে দিল তাকে, শুয়ে থাকা চৈতী অসহায়ভাবে হাত-পা ছুটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে।
রাতুল ঠান্ডা গলায় বললো, খাবারের প্যাকেট খুলতে খুলতে—

— “ওতো ছটফট করে লাভ নেই চৈতী। তুমি কখনোই মুক্তি পাবে না। সো, চুপচাপ খেয়ে নাও।”
চৈতী মুখ ফিরিয়ে নেয়, স্পষ্টতই জানিয়ে দেয়—সে খাবে না।
রাতুলের চোখে রাগের ঝলক দেখা যায়। ক্ষেপে গিয়ে এক ঝটকায় চৈতীর গাল দুটো চেপে ধরে।
তারপর শক্ত হাতে খাবার তুলে জোর করে ঠেলে দেয় তার মুখে।
চৈতীর গাল বেয়ে নেমে আসে নীরব অশ্রু। অপমান, কষ্ট আর অসহায়তায় ভেসে যাচ্ছে তার চোখ দুটো…
পানির বোতলটা হাতে তুলে চৈতীর সামনে আনলো রাতুল। জোর করেই কিছুটা পানি খাইয়ে দিল তাকে। তারপর নিজের রুমাল দিয়ে চৈতীর মুখটা মুছে দিতে দিতে নিচু গলায় বললো,
— “চুপচাপ শুয়ে পড়ো, আমি একটু পরে আসছি।”
চৈতী ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়। তীব্র ঘৃণায় কেঁপে ওঠে তার কণ্ঠ,
— “কখনো না! আমি আপনার সাথে থাকবো না! শোয়ার তো প্রশ্নই আসে না! আপনি আমার বাবার খুনি… ছি… আপনাকে ছুঁয়েও ঘৃণা লাগে!”

রাতুলের মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে, ঠান্ডা গলায় বলে,
— “এত ছি ছি করার কিছু নেই, চৈতী। তুমি আমার নিকাহ করা স্ত্রী। তোমার সাথে থাকা আমার বৈধ অধিকার।”
চৈতীর চোখে আগুন জ্বলে ওঠে, গলার কাঁপন স্পষ্ট:
— “আমি এই নিকাহ মানি না! একদম মানি না! আপনি আমার কাছে হারাম… হারাম আপনি!”
রাতুল ড্রয়ার থেকে একটা স্কচটেপ বের করে চৈতীর মুখে লাগিয়ে দিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বললো,
— “একদম পারফেক্ট। এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো।”
চৈতী “হুম হুম হুম” শব্দ করে প্রতিবাদ জানাতে থাকে।
রাতুল ঠোঁট কামড়ে হেসে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
একটি অন্য কক্ষে রাতুল, নাহিদ, ও কাদের আলোচনা করছে।
নাহিদ বললো,
— “রাতুল, চৈতী এখানে এলো কী করে? এখন তো ঝামেলা হয়ে যাবে।”
রাতুল গম্ভীর স্বরে বললো,
— “এটা আপনার ভাবার বিষয় না। আমি বুঝে নেবো। আপনি বরং কাজে মন দিন।”
কাদের যোগ করলো,

— “ভালো হয়েছে দেলোয়ার জেলে নেই। নইলে সমস্যা হতো।”
রাতুল ম্যাপে চোখ রেখে বলে,
— “শুনুন, এই ম্যাপে যেসব জায়গায় মার্ক করা হয়েছে, সেখানে আমাদের লোকজন প্রস্তুত। কাজটা খুবই সোজা—আমরা মালগুলো নৌকায় তুলে দেব, বাকি দায়িত্ব ওদের। আমরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে কাজ করবো।”
ওরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
রাতুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কক্ষে যায়—যেখানে আছে চৈতী।
রুমে ঢুকেই দেখে, চৈতী হাত-পা বাঁধন খুলতে চেষ্টা করছে।
রাতুল ধীরে বলে,
— “শুধু শুধু এনার্জি অপচয় করো না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো।”
চৈতী মাথা নাড়িয়ে প্রতিবাদ করে।
রাতুল কোমরে হাত দিয়ে বললো,

— “সমস্যাটা কী তোমার, চৈতী? চুপচাপ থাকো, না হলে আমাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
রাতুল দরজা লক করে দিয়ে চৈতীর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়।
চৈতী মুখ থেকে স্কচটেপ টেনে খুলে দিয়ে রেগে গিয়ে টি-টেবিলে লাথি মারে।
চিৎকার করে বলে ওঠে,
— “এই রাতুল আহম্মেদ, আপনি কি ভেবেছেন আমি আমার বাবার খুনির সাথে থাকবো? একজন পাপিষ্ঠ, জঘন্য মানুষের কথা শুনবো? কখনো না! প্রয়োজন হলে নিজেকে শেষ করে দেব, কিন্তু আপনার সাথে নয়!”
রাতুল কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই বাইরে থেকে আসিফ চিৎকার করে বলে,
— “ভাই, সর্বনাশ! শিহাব চৌধুরী এসে গেছে তার পুরো দল নিয়ে!”
রাতুল বিস্ময়ে বলে,
— “কি?!”
— “হ্যাঁ ভাই, তাড়াতাড়ি চলেন!”
রাতুল চৈতীর দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলে,
— “খবরদার, এক পা যদি এই ঘর থেকে বাইরে ফেলো, ভালো হবে না!”
এই কথা বলে সে রুম লক করে বেরিয়ে যায়।
বাইরে দুই দল মুখোমুখি—শিহাব চৌধুরী আর রাতুল।
রাতুল বললো,

— “আপনারা এখানে কেন? এই জায়গার খবর পেলেন কীভাবে?”
শিহাব চৌধুরী ঠান্ডা স্বরে বললো,
— “আমি আমার শত্রুদের খবর রাখতে জানি।”
এরপর কথা না বাড়িয়ে, শিহাব পিস্তল বের করে গুলি শুরু করে।
দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র গুলিবিনিময় হয়।
শিহাবের লোকেরা বাড়ি ঘিরে ফেলে। হঠাৎ একটি গুলি জানালা ভেদ করে চৈতীর পেটে এসে লাগে।
সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে—রক্তাক্ত, নিস্তেজ।
অন্যদিকে, রাতুলের বুকেও গুলি লাগে।
তবু ছুটে চলে যায় চৈতীর রুমে।
দরজার লক খুলে ঢুকে চৈতীর গোঙানি শুনে এগিয়ে যায়।
দেখে—চৈতী রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
রাতুল হাঁটু গেড়ে বসে চৈতীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৪৩

— “চৈত্ররাঙা… আমি হয়তো ভালো মানুষ হতে পারিনি, কিন্তু আমার ভালোবাসাটা খাঁটি ছিলো। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে জড়িয়ে মৃত্যুবরণ করতে—আমার সেই ইচ্ছেটা হয়তো পূর্ণ হলো। তবে চেয়েছিলাম তুমি আমার আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকো… সেটা হলো না।”
চৈতীর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
দুজন একসাথে কালেমা পড়ে।
ধীরে ধীরে চোখ বুজে যায় তাদের…
তারা আর কোনো ডাকে সাড়া দেবে না।
আর কোনোদিন রাতুল বলবে না—“চৈত্ররাঙা”…

সমাপ্ত