খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৫
আনিকা আয়াত
“বেচারা! কেনো যে শুধু শুধু চুমকির হাত ধরলি। দেখ এর পরিণাম কতটা ভয়ংকর হলো! ”
বলেই গম্ভীর কদমে দাঁড়াল অর্পণ। দুহাতের আঙুল ভাজ করে অলস ভঙ্গিতে কোমর বাঁকা করলো। স্টেজে দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
“ চুমকি…! আমি আসছি শীগ্রই। এই কুলা/ঙ্গারের জন্য তোমার মখমলের ন্যায় দেহের নৃত্য দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম চুমকি!
গটগট পায়ে হাঁটা ধরলো তৎক্ষনাৎ! হঠাৎ কি মনে করে, পেছন ঘুরে থমথমে মুখে বলে,
“যে আদর খেয়েছিস! আশা করি ৩ মাসের আগে বেড থেকে উঠতে পারবি না। যাই এবার আমি নিশ্চিন্তে আরামে বসে চুমকির কোমর দোলানো দেখে আসি। মেয়েটা আসলেই অসাধারণ। তুষিবের ভাষায় হালকার উপর গর্জিয়াছ! ”
সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরেও তৃধাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। পৃথা এবং সমুদ্র ভার্সিটির চারপাশ তন্নতন্ন খুঁজেও যখন পেল না আতংকে অর্পণকে জানাল। সে কয়েকবার কল করলো! মেয়েটার ফোনও বন্ধ। কিঞ্চিৎ ভাবুক হলো!
হঠাৎ কি মনে হতেই রিয়াদ স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে অকপটে প্রশ্ন করলো,
“ আপনি কি তৃধাকে দেখেছেন?”
রিয়াদ স্যার তাদের ভার্সিটির ইংলিশ ম্যাম কবিতার সঙ্গে কথা বলছিল। আচমকা অর্পণের কথায় ভরকে গেলো। আচমতা কেশে উঠে থতমত খেয়ে বলল,
“ তাকে কি আমার দেখা উচিৎ? ”
“ হ্যাঁ! আপনাকেই দেখা উচিৎ। লাস্ট যখন তৃধা-কে দেখা গেলো তখন আপনার নিকটেই ছিল। এরপর নিরুদ্দেশ! এবার বলুন কোথায় ও.”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অর্পণের গলা তীক্ষ্ণ! রিয়াদ স্যার বামহাত পকেটে গুঁজে টান টান হয়ে দাঁড়াল। তবে, তার চোখ-মুখের নার্ভাস, আতঙ্ক দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাচ্ছে। পাশেই কৌতূহল চোখে কবিতা ম্যাম তাকিয়ে! রিয়াদ স্যার একপলক তা লক্ষ্য করে গলা খাঁকড়ি দেয়। নম্র স্বরে বলল,
“ আই ডোন্ট নো! তোমার ফ্রেন্ড কোথায়। খুঁজে দেখো। বাসায় চলে যায় নি তো?”
অর্পণের কুঁচকে যাওয়া কপাল আরোও গভীর হলো। রিয়াদ স্যারের হাঁসফাঁস করা নিঃশ্বাস! আনাচন ভয়, নার্ভাস সব লক্ষ্য করে অর্পণ ধারালো সুচের মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু হিসেব কষলো। রিয়াদ স্যার কখনও অর্পণের সামনে অস্বস্তি তে পড়তো না। কিন্তু তৃধার মুখটাই ভেসে উঠছে। মেয়েটার বন্ধু সামনের যুবক এজন্যই যত অস্বস্তি । তার ব্যকুল হৃদয় বলছে ছেলেটা মনের কথা পড়তে জানে। সব ধরে ফেললো নাকি? একজন ভার্সিটির গম্ভীর স্যার হয়েও কিভাবে আজ ওই বাচ্চা মেয়ের কাছে সে এলোমেলো হলো? নিজের কঠিন হৃদয়কে ধমাতে পারলো না! ছি! লজ্জার ব্যাপার! এখন জানা জানি হলে মুখ দেখাতে পারবে? চাকরিও চলে যেতে পারে। সবাই কানাঘোঁষা করবে, একজন কঠিন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন স্যার পুঁচকে একটা মেয়ের সাথে ইটিস পিটিস করেছে। এসব ভাবতেই এই প্রথম দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করল রিয়াদ স্যার। ২৯ বছরে কখনও এতটা বাজে পরিস্থিতিতে সে পড়েনি। আজ এক নিমেষেই সব উল্টো পাল্টা হয়ে গেল। কি ভেবেছিল আর কি করে ফেললো তৃধার সঙ্গে। মেয়েটা তাকে কি ভাবছে কে জানে? হয়তো চরিত্রহীন ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার কি দোষ? মেয়েটাই তো প্রতিনিয়ত তার রূপ, চঞ্চলতা দিয়ে বশ করে ফেলেছে তাকে। তবে, আর নয়! এবার একটা ফয়সালা করতে হবে। তার মানসম্মান, চাকরি যাওয়ার আগেই।
রিয়াদ স্যার লম্বা শ্বাস নিলো। আজ সে সামনের চতুর যুবকটির চোখে চোখ রেখে তাকাতে ব্যর্থ হলো। বেশ কিছুক্ষণ পর এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,
“ কি দেখছ?”
“ কিছু না। ” বলেই অর্পণ পিছু ঘুরে বন্ধুদের নিকট গেল। রিয়াদ স্যার হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেলে পাশ ঘুরতেই কবিতার কথার জালে ফেঁসে যায়,
“ স্যার! তৃধা আপনার কি হয়?”
হকচকিয়ে উঠে বেচারা। মস্তিষ্ক ঠান্ডা রেখে বুদ্ধিমান রিয়াদ স্যার কৌশলে বলল,
“ ছাত্রী। ”
“ শুধুই ছাত্রী?”
“ জি! কেনো? অন্য কিছু হওয়ার কথা ছিল?”
কবিতা ম্যাম উষ্কখুষ্ক করে মৃদু হাঁসলো। সে ভেবেছিলো অন্যকিছু। রিয়াদ স্যার বুঝতে পেরে মনে মনে হাঁসে। ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগে বলল,
“ অন্য কিছু হতেই কতক্ষণ? তাই না মিস?”
কবিতা হতভম্ব হয়ে গেল যেনো। অবাকের ন্যায় তাকিয়ে রইলো স্যারের দিকে। অথচ স্যার নির্বিকার! প্রতিবারের ন্যায় থমথমে মুখে গাড়িতে উঠছে।
অর্পণের কথা অনুযায়ী পৃথা বাসায় কল করলো মেয়েটার। তৃধার মা অমায়িক হেঁসে শুধালো, মেয়ে সন্ধ্যার আগেই বাসায় উপস্থিত! তবে, আজকে কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করল, বাসায় ফিরার পর থেকেই দরজা বন্ধ করে বসে আছে। খাওয়া নেই দাওয়া নেই। হাজার ডাকলেও দরজা খুলেনি। শুধু জানিয়েছে, মাথা ব্যথা করছে। সে অসুস্থ! অতিরিক্ত সুখে পাগ-ল হয়ে যাচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেও, বলেনি সেই সুখের নাম কি! তবে, মেয়েটার মাথা ব্যথার কারণে আর বিরক্ত করেনি।
সব শুনে ওরা শান্ত হলো। আন্টির কথায় তৃধার সুখ কেউ বুঝতে না পারলেও অর্পণ, পৃথা চট করেই বুঝে ফেলেছে। সেই সঙ্গে মিটি মিটি হাঁসি সরছেই না ঠোঁট থেকে। পৃথা সুযোগে আছে মেয়েটার মুখোমুখি হওয়ার। নিশ্চয়ই বড়সড় কান্ড ঘটেছে! যা লজ্জাবতী লাজুকলতা সহ্য করতে না পেরে পালিয়েছে। কিন্তু কি সেই কান্ড? ভেবেই পৃথা ওষ্ঠ কামড়ে হাঁসল।
কন্সার্ট শেষ হওয়ার আগেই স্নিগ্ধা ওদের বিদায় দিয়ে বেরিয়ে আসলো। বাইরে হাজার মানুষের ভীরে হাঁটতে কষ্ট হলো বেশ! পা টিপে টিপে আসার সময় হঠাৎ কারো সঙ্গে ধাক্কা লাগে। সঙ্গে সঙ্গে কোনো কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু তৎক্ষনাৎ সমুদ্র এসে ধরে ফেললো তাকে। হাত শক্ত করে চেপে ধরে এত ভীর ঠেলে বাইরে নিয়ে আসে। গেইটের বাইরে এসে সমুদ্র গালভরে হেঁসে কিছু বলার আগেই স্নিগ্ধা হাত ছাড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ লিমিটে ক্রস করেছেন লাফাঙ্গার দল।”
“ ওমাহ! এত চ্যাত দেখাও কেনো? আমি উল্টো তোমাকে হ্যল্প করলাম। ”
অতন্ত্য দুঃখী মুখে বলল সমুদ্র। স্নিগ্ধা মুখ ঝাপটা মে/রে বলল,
“ কে বলেছে সাহায্য করতে? আমি কি ছোট্ট খুঁকি?”
“ না তুমি আমার স্নিগ্ধু বেবি।”
“ চুপ। আর একটা ফাউল কথা বললে দাঁত ফেলে দিবো।”
সমুদ্র অবাক হলো। মুখ হা করে জিজ্ঞেস করল,
“ কিভাবে ফেলবে? আমার ঠোঁটে কঠিন দন্ত বসিয়ে ল? এতই পাওয়ার তোমার ইঁদুরে দাঁতে? ”
মুহূর্তেই গর্জে উঠে স্নিগ্ধা। রক্তিম চোখে হিসহিসিয়ে বলল,
“ আয় তবে একটা টাইট দন্ত চুম্বন এঁকে দেখিয়ে দেই। তোর ওই জলহস্তী বিশ্রী হাঁসি দেখলেই আমার দেহ জ্বলে যাচ্ছে। ”
বলেই স্নিগ্ধা দাঁত কিড়মিড় করলো। অবশ্য সামনের অভদ্র ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার মুড নেই আপাতত। সে দ্রুত পেছন ঘুরতেই কেউ একজন রসিয়ে রসিয়ে বলল,
“ আজকাল সমুদ্র কে লুকিয়ে লুকিয়ে চুমু খাওয়া হচ্ছে? এসব কি সুন্দরী? দিনদিন চরম অসভ্য হচ্ছ! পড়াশোনা বাদে প্রেম-পিরিতি? তবে যাই বলো! সমুদ্র ছেলেটা লয়াল!”
তড়িৎ সামনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় স্নিগ্ধা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ না জেনে এসব বলবেন না। আপনার বন্ধুই আগে শুরু করেছে।”
সমুদ্র ঘোর প্রতিবাদ জানালো। অর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ বিশ্বাস কর! তুই সঠিক সময় না আসলে আজ কি যে হত। স্নিগ্ধা আমাকে ভার্সিটির পেছনে নিতে চেয়েছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে না করি! তুই তো জানিস আমি সোজা শান্ত ছেলে। ওসব বাজে কাজ করিনা। অথচ দেখ! আমার মতো বোকা ছেলেকে পটিয়ে স্নিগ্ধা জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে চায়। তুই বল ভালোবাসা কি জোরজবরদস্তির জিনিস? মেয়েটা বড্ড অবুঝ! সব সত্যি বলছি..! প্লিজ অর্পণ বিশ্বাস কর!”
“ করছি।”
সমুদ্র খুশিতে গদগদ হয়ে অর্পণকে জরিয়ে ধরতেই এক ঝটকায় তাকে দূরে ফেলে দিল। হিসহিসিয়ে বলল,
“ একদম গা ঘেঁষে দাঁড়াবি না। দূরে থাক অসভ্য! ”
স্নিগ্ধার চোখ বড় বড় করলো। রাগে গা পিত্তি জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তার। সে সমুদ্রের একের পর এক মিথ্যে কথা শুনে চুপ থাকতে পারলো না। এর মাঝে অর্পণ সব জেনেও নিজের বন্ধুকে সাপোর্ট করছে? অবশ্য করবেই না কেনো? সে তো নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড! মেয়েটা রাগে ক্রোধে ফোঁসফোঁস করল। তেড়ে গিয়ে বলল,
“ সমুদ্রের বাচ্চা! সারাদিন কি করিস আমি কি জানিনা? আস্ত বদলোক একটা। এখন আমাকে নিয়ে বাজে বকছিস। তোর নামে কমপ্ল্যান করবো! ”
“ তুমি বললে আমি আজীবন তোমার সঙ্গে জে/ল খাটতেও রাজী। তুমি কাঁদবে আর আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে হাঁসবো। তোমার গালে টপাটপ কয়েকটা চুমু খেলেও মন্দ হবে না। ”
লজ্জায় গাল দুটো লাল হলো স্নিগ্ধার। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই ছেলেটা দেখছি তার থেকেও একশ কাঠি উপরে বেয়াদব। লুচু! অর্পণ অনেক কষ্ট করে হাঁসি থামিয়ে রেখে এবার অধর কামড়ে ফিকফিক করে হাঁসল। গম্ভীর কণ্ঠে স্নিগ্ধাকে বলল,
“ এত হাইপার হচ্ছ কেনো সুন্দরী! লজ্জায় দেখছি গাল দুটো টমেটো হয়েছে! সমুদ্র কিন্তু ভদ্র ছেলে! খুব আদরে রখবে! ভেবে দেখতে পারো। যদি ঠিক মনে হয় লজ্জা পাবেনা। সোজা সুজি আমাকে জানাবে। আমি ঠিকঠাক করে দিবো। ”
বলেই থামল সে। একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“ এবার বাসায় যাও চুপচাপ। ফিডার খাওয়া বাচ্চাদের এখনও এত সাহস হয়নি যে, আমাদের কারো নামে কমপ্ল্যান করবে.!”
বলেই অর্পণ সমুদ্র কে লাত্থাতে লাত্থাতে নিয়ে গেল। এই ছেলের বেয়াদবি ভারী এনজয় করেছে সে। মেয়েটাকে একদম মটকে দিয়েছে। মুখটা যা হয়েছিল স্নিগ্ধার।
স্নিগ্ধা রাগে গজগজ করতে করতে রিকশায় উঠে। পাশে যে একটা ছেলে তার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল গেইটে সে খেয়াল নেই। সে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে। বেশ সময় গড়ালো। তবুও মেয়েটার নড়চড় নেই। দিব্যি ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। আশেপাশে যাই ঘটুক তার মনে চলছে অর্পণের অসভ্যতা! রাতের শীতল বাতাসে মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তবুও দুহাত আড়াআড়ি করে বুকে গুঁজে ঠান্ডাকে হারানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্যের কোঠায়! পাশের যুবকটির চোখে কোনো কিছুই আড়াল হলো না। সে নিষ্প্রভ নজরে সবই লক্ষ্য করছে। মাঝে মাঝে নিশ্চুপে হাঁসছে। বাইরের সোডিয়াম আলোয় রমনীর মুখ যতটা গম্ভীর ততটাই শীতল। হঠাৎ করেই গায়ের স্যুট খুলে ফেললো। স্নিগ্ধার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রতি বারের ন্যায় চমৎকার ভঙ্গিতে বলল,
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৪
“ স্নিগ্ধা.! বাইরে অনেক ঠান্ডা বাতাস। আপনি ঠান্ডায় রীতিমতো কাঁপছেন। আপনার ঠোঁট দুটি তিরতির করে কাঁপছে। হাতের লোম গুলোও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মিস! এটা গায়ে পড়ুন। শীত কম লাগবে। আরাম পাবেন। ”