খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৫(২)
আনিকা আয়াত
কয়েকদিন ধরেই এক টানা অসহনীয় ঠান্ডা পড়েছে। কম্বলেও শীত মানাচ্ছে না। সকাল থেকে প্রায় ১২ টা পর্যন্ত কুয়াশায় ছেয়ে থাকে। প্রকৃতি হেমন্তকে বিদায় জানিয়েছে গুটিকয়েক দিন আগে। নবীন বরণের পর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন! এই উষ্ণ শীতল আবহওয়ায় চৈতী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! তার ছোট্ট গায়ে জড়িয়ে রাখা গ্রাম থেকে নিয়ে আসা মায়ের কম্বল। মেয়েটা সেটা মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। কম্বল বাদেও এছাড়া বাকি দুটো কাঁথা আছে! নেহাৎ তার মা বুদ্ধি করে সঙ্গে দিয়েছিল শীতের কাপড়চোপড়। নাহলে কি যে বিপদ হতো। কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় বাবা তাকে একটা শাল কিনে দিয়েছিল, এটাও নিয়ে এসেছে।
চৈতী দীর্ঘক্ষণ পর ঘুম থেকে উঠল। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে ছুটে চললো টিউশনে! আজ ছুটির দিন। এ বছর শেষের দিকে! কিছু দিনের ভেতর বিদায় জানাবে জানাবে ভাব। খ্রিস্টানদের বড়দিন উপলক্ষে ভার্সিটি অফ আজকে। তাই আপাতত চৈতীর তাড়াহুড়ো নেই বললেই চলে। মেয়েটা দ্রুত স্টুডেন্টের বাসায় উপস্থিত হয়ে ঘন্টাখানেক পড়ালো। আগের মাসের বেতন আঁটকে থাকায় আজ চৈতীকে দুমাসের টাকাই দিয়ে দিল। চৈতী খুশিও হলো ভীষণ। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঝটপট টিউশন শেষে বিকাশের দোকানে গিয়ে কল করল বাড়িতে। আরিফা বেগম ওপাশ থেকে আহ্লাদী আটখানা হয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ চৈতী! মায়ের কথা মনে পড়ে না? বাড়িত আইবি না?”
“ এখন যাইতে পারমু না আম্মা। কেমন আছো?”
তৎক্ষণাৎ ওপাশে মায়ের ব্যাকুল কণ্ঠ শুনা গেলো,
“ তোরে ছাড়া আমরা ভালো থাকি কেমনে? ক্যান যে এতদূর পড়তে দিলাম। তোর আব্বা গম্ভীর হইয়া থাকে। ঠিক মতো খায়না, কাজে মন দেয়না। সারাক্ষণ শুধু তুই! সামনা সামনি কিছু না কইলেও আমি বুঝি, মেয়েটার লাইগ্গা ওনার বুক ফাঁইটা যায়। ”
চৈতী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাবার মতো তারও যে ভীষণ মনে পড়ে। কিন্তু সময় পায় কই?
“ আব্বা কি বাড়িতেই?”
“ না ক্ষ্যাতে গেছে গরু নিয়া। তার কি বিশ্রাম নেওয়ার সময় আছে? সারাদিন কাজ কাজ কইরা জীবনটাই শেষ কইরা দিল। ”
চৈতীর হৃদয় জ্বলে উঠে। ছোট করে বলল,
“ আব্বারে কইবা, আমি কাজ করতে নিষেধ করছি।”
“ পা-গল মাইয়া আমার। কাজ না করলে খামু কি?”
মৃদু হেঁসে আরিফা বেগম চুপ করে রইলো। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তার মা কান্না গিলে ফেলে জিজ্ঞেস করে,
“ আইবি কবে? আমাগো কথা মনে পড়ে না?”
“ পড়ে মা! সময় নাই এখন। কয়দিন পর যামু। ”
টুকটাক কথা শেষে চৈতী জানতে চাইলো,
“ সায়মন কই গেছে মা?”
আরিফা বেগম সায়মনকে ডেকে দিলো। চৈতী দ্রুত বলল,
“ বিকাশে ৩ হাজার টাকা পাঠাইতাছি সায়মন। আম্মারে আড়াই হাজার দিবি। বাকি ৫০০ দিয়া তুই নিজে বাজার থেকে সুন্দর দেইখা আব্বারে লুঙ্গি কিনা দিবি। এই মাসে বেশী টাকা দিতে পারলাম না। পরের মাসে তোরে আর মা-রে দিমু। ঠিক আছে? বুঝছস কি বললাম?”
সায়মন বোনের কথায় সহমত পোষণ করে বলল,
“ বুঝছি আপু। তুই টাকা পাইলি কই? ”
“ এসব জানতে হবেনা। ঠিকমতো পড়াশোনা করবি। আব্বার কাজে সাহায্য করবি। আমি জানি বাড়িতে আইসা না শুনি তুই ত্যাড়ামি করছস! তাইলে কিন্তু ভালো হবো না। আম্মা-আব্বার কষ্ট আমরা দুইজন না দেখলে আর কে দেখবে বল?”
সায়মনের বয়স অল্প। এ বয়সে বেপরোয়া জেদি হলেও বাবা-মায়ের ব্যাপারে খুব স্ট্রিট! সে বোনকে আশ্বস্ত করল, তার মতোই ভালো মানুষ হয়ে উঠবে। চৈতীকে সে খুব মিস করছে। বোনের সঙ্গে ঝগড়া না করতে পেরে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না। ভালো লাগছে না। চৈতী হেঁসে টাকা পাঠিয়ে দিলো। সামনে একটা রিকশা নিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে মৃদু হাঁসে। জীবনের সমীকরণ মেলানোর ভীষণ কঠিন। মাঝে মাঝে এ সমীকরণ মেলাতে মেলাতেই সময় শেষ হয়ে যায়।
চৈতী রিকশা নিয়ে হলে ফিরার পথে খেয়াল করলো রাস্তায় ঝামেলা করছে কয়েকটি ছেলে। আশেপাশের সবাই কৌতুহল চোখে তাকিয়ে আছে। সেও তীক্ষ্ণ নয়নে পরখ করতেই একটি পরিচিত মুখ দৃশ্যমান হলো। মেয়েটার দৃষ্টি আরোও প্রখর হলো। সে সুক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে আনমনে বলল,
“ তুষিব?”
কয়েকটি ছেলে একে অপরকে টেনে হিঁচড়ে মা/রছে। একজন আঘাত করলে ওপর পক্ষ উল্টো আঘাত করছে। তুষিবও পা*গলা ঘোড়ার মতো এলোপাতাড়ি মা/রছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের থামানোর চেষ্টা করলো আশেপাশের লোকজন। তবুও ওরা থামবার পাত্র নয়। তেড়ে গেলো একে অপরের নিকট। সেকেন্ডের মাঝে রাস্তায় ভীর হওয়ায় রিকশা-গাড়িও ব্যাপক জ্যামে পড়ল। চৈতী কৌতুহল, বিস্মিত নয়নে ছোট্ট তুষিবকে দেখতে থাকে। বয়সই বা কত? সারাক্ষণ অর্পণের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। যদি পড়ালেখা করতো, তাহলে কলেজে পড়তো। প্রায় মিনিট ১০ এক পর অনেক কষ্টে ঝামেলা মিটে। কিন্তু তুষিবের চোখ থেকে জ্বালা নিভে না। সে এতো লোকের ভীরে পারে না, সামনের ছেলেটাকে পুঁতে ফেলতে। শাসিয়ে কিছু অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলে হাঁটা শুরু করলো। চৈতীর রিকশার সামনে এসেই তার ভয়ংকর শক্ত মুখের বদলখানি রাতারাতি পাল্টে হাঁসি হাঁসি হয়ে গেলো। দাঁত কেলিয়ে লম্বা সালাম দিলো চৈতীকে। মেয়েটা তার ব্যবহারে হতবিহ্বল! অবাক নয়নে দেখার মাঝেই তুষিব তার পাশের খালি জায়গায় টপ করে বসে পড়লো। আশেপাশের সকলের দৃষ্টি নিক্ষেপ হলো তখন তাদের দিকে। চৈতী পড়লো, বেকায়দায়। বিরক্তে চোখ-মুখ শক্ত হলো। বলল,
“ নামো তুষিব। অন্য রিকশায় যাও।”
“ নাহ। এ্যাই মামা! আপনি চলেন। ”
রিকশা মামার উদ্দেশ্যে এ কথা বলেই। হঠাৎ আশেপাশের সকলের কৌতুহল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তেঁতে উঠে। রুক্ষ গলায় বলল,
“ এইভাবে তাকায় আছেন ক্যা? এইডা আমার আপু লাগে। অন্য কোনো ব্যাপার নাই। সবাই নিজেদের কাম করেন মিয়া। মা/রার সময় তো ঠিকই টাইনা ছাড়াইলেন। এখনও বইসা আছেন কিল্লাইগ্গা?”
রিকশা চলতে শুরু করেছে। তুষিবের মুখ থেকেও আজ হরহরিয়ে খই ফুটছে। কথায় কথায় এ্যাই আপু বলছে। অথবা দুষ্টুমি করে সিনিয়র আপু। সব গুলোই অহেতুক কথাবার্তা। চৈতী ভেতরে ভেতরে রেগে ফেটে পড়লেও, নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে ছেলেটার বকবকানি । তুষিব অনেক কথা বলে, হঠাৎ বেকুবের মতো বলল,
“ ভাবী অর্পণ ভাইরে আপনার কেমন লাগে? সত্যি কইবেন। যদি ভালো লাগে নিশ্চিন্তে আমারে ছোট ভাই মনে কইরা কইতে পারেন। আমি সেটিং করায় দিমু। দেহেন, এই প্রথম আপনারে ভাল্লাগছে ভাবী হিসাবে। তাই শুধুমাত্র আপনারে জিজ্ঞেস করতাছি। সোজাসুজি কইয়া দেন।“
চৈতী হা হয়ে গেলো। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সে খেঁকিয়ে উঠে,
“ অসভ্য। এতক্ষণ যা নয় তা বলেছ। এখন ফা-লতু কথা বের হচ্ছে মুখ থেকে? নামো বলছি। এই মুহুর্তে নামো।”
তুষিব চোখ বড় বড় করলো। অবাকের সুরে বলল,
“ মানে কি ভাবী? আমি আবার কি ফা*লতু কথা বললাম। আমার যতদূর মনে পড়ে, সবগুলাই দরকারী কথা। আপনি শুধু শুধু হাইপার হচ্ছেন।”
“ তুমি কি নামবে? নাকি আমি নামবো?”
দাঁতে দাঁত শক্ত করে বলল চৈতী। তুষিব আশ্চর্য হয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো। বলল,
“ অর্পণ ভাই যদি জানে আপনি আমার কথায় রাগ কইরা নাইমা গেছেন তাইলে, আমার মাথা নড়া করবো। নাহ বাবা! এত রিস্কে যাইতে চাইনা। আপনি থাকেন। তবে..”
তবে বলেই একটু থামলো তুষিব। দাঁত কেলিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
“ তবে আমার কথাগুলো ভেবে দেখবেন। আপনি ভাবী হইলে আমার খুব ভাল্লাগবো। মাঝে মধ্যে আপনার হাতের রান্না খাওয়া যাইবো। তবে, আপনি বাদে বাকি সবাই আমার প্রেমিকা। ”
চৈতী চোয়াল শক্ত করে চোখ গরম করলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ ফা-জিল ছেলে। ইচ্ছে করছে, ঠাডিয়ে চড় মা/রি। শুধু এ শহরে নতুন বলে ছেড়ে দিলাম। আমাদের গ্রামে থাকলে, তোকে সহ ওই অর্পণকেও গলা টিপে খু//ন করতাম। বেয়াদব ছেলে। ”
বলেই চৈতী ঘনঘন শ্বাস ফেললো। সামনে ব্যস্ত নগরীর রাস্তাঘাটে চেয়ে নিজের চাপা রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। মনে মনে চাইলো, অর্পণ দূরে থাকুন। ওই ছেলেটা যে অদ্ভুত! কিন্তু তবুও..তবুও কেনো বেহায়া মন তার কথা শুনলে, হেঁসে উঠে! তাকে দূর থেকে একঝলক দেখলে, খুশির দোলা লাগে.? কেনো হয় এসব? আজকাল এসব উদ্ভব প্রশ্নের উত্তর মেলানোও দুষ্কর!
অর্ণবের ছুটি শেষের দিকে। আর মাত্র সপ্তাহ খানিক পর চলে যাবে সিলেটে। দেখতে দেখতে সময় গুলো চোখের পলকেই চলে গেলো। পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে খুব একটা খারাপ যায়নি। সকাল থেকে পায়েল শেখ বিভিন্ন রকম পিঠা বানালেন। অর্ণব অল্প খেয়ে তৃষ্ণা -কে নিয়ে কোচিং -এ চলে গেলো। প্রায় দু ঘন্টা পর বাসায় এসে দেখল, এখনও অর্পণ উঠে নি। উঠবে কিভাবে? ঘুমিয়েছে রাত তিনটায়। তৃষ্ণা চিৎকার চেঁচামেচি করে ভাইয়ের ঘুম ভাঙাল। এই ঠান্ডায় কম্বল মুড়ি দেওয়া অর্পণের দেহ থেকে টেনে হিঁচড়ে কম্বল সরাতে গিয়ে শ-খানিক গালিও খেলো। তবুও মেয়েটা দমল না। অর্পণের ঝাঁঝাল গলা, রাগী দৃষ্টি সব উপেক্ষা করে উল্টো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ তুমি ৫ সেকেন্ডের ভেতরে না উঠলে, আমি ফ্রিজের পানিতে চুবানি খাওয়াবো৷ ”
অর্পণ কটমট করে তাকিয়ে কম্বল শক্ত হাতে টান দিলো। কিন্তু মেয়েটা এমনভাবে তার উপর চেপে বসে আছে ব্যর্থ হলো সে। রাগে গজগজ করতে করতে উঠে যেতে যেতে বলল,
“ সব ক’টা কে টিপে মে/রে ফেলবো। ”
“ তোমার বিয়ের পর তৃষ্ণা আর বিরক্ত করবে না। তখন কি ভাবী-র উপর রেগেও তাকে মা/র্ডার করবে?”
“ করবো। ”
অর্পণের কাঠ কাঠ গলা শুনে খিলখিল করে হেঁসে ফেললো তৃষ্ণা। অর্ণব ড্রয়িংরুম থেকে সবই দেখছিল। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিয়ৎক্ষণ পরেই অর্পণ চেয়ারে বসে তার উদ্দ্যেশে জিজ্ঞেস করল,
“ বউ কি অন্য ছেলের সঙ্গে ভেগে গেছে? ”
অর্ণব ভ্রু কুঁচকালো। না বুঝার মতো করে বলল,
“ কি বললি? ”
“ বললাম এ বাসায় লাল টুকটুকে একটি মিষ্টি বউ চঞ্চল পায়ে ঘুরঘুর করলে কেমন হয়?”
বলেই ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাপা পিঠায় কামর বসালো অর্পণ। তার কথায় অর্ণবের ভুরু আরোও কুঁচকে গেলো। থমথমে মুখে বলল,
“ মানে? বিয়ে করবি তুই? বড় ভাইকে রেখে এখন বউ ঘরে তুলবি? দেখ অর্পণ! আমি তোর বড়।তোর উচিৎ আমার পর বিয়ে করা।”
অর্পণ খাওয়ার মাঝেই খুক খুক করে কেশে উঠল। তৎক্ষনাৎ তার পিঠে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মে/রে স্বাভাবিক করল ছেলেটা। বলল,
“ বিয়ে করবি সমস্যা নেই। কিন্তু আগে নিজের পায়ে দাঁড়া।”
অর্পণ খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রাগে মাথা গরম হচ্ছে তার। সে কখন বলল বিয়ে করতে চায়? ও তো চেয়েছিল অর্ণবের সেটিং করতে। অসহ্য! এ বলদ ছেলে কিছুই বুঝেনা। অর্পণ তেড়ে গেলো।
“ আমি কি তোর পায়ে দাঁড়িয়ে আছি? জলজ্যান্ত দুইটা পা চোখে দেখিস না? বা/ল। কে তোকে ওসব চাকরি দিল? সাধারণ নল্যাজ বলতে নেই। ”
অর্ণব হকচকিয়ে উঠে। আমতা আমতা করে মৃদু হাঁসার চেষ্টা করে বলল,
“ চাকরি-টা তোর শ্বশুর দেয়নি নিশ্চয়ই। ”
“ অর্ণবের বাচ্চা! মটকা গরম করবি না। তুই জলদি ফুট এখান থেকে। শা/লা বাটপার! ”
বলেই অর্পণ চেয়ার থেকে কালো টি-শার্ট হাতে তুলেই বেরিয়ে গেলো। মনে মনে হাঁসলো অর্ণব। ধীর পায়ে রুমে যেতেই মনে পড়লো ছাঁদের ফুলগাছ গুলোর কথা। জলদি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছাঁদে প্রবেশ করলো। তৎক্ষনাৎ চোখ আটকে গেলো সামনের সদ্য গোসল করা রমনীর সতেজ মুখ খানার পানে। মেয়েটা পেছন ঘুরে খোলা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছছে। পাশেই কাপড় মেলে দিচ্ছে মিষ্টি! প্রতি বারের মতো এবারও স্নিগ্ধা-কে এ রূপে দেখে বুকের ভেতরের যন্ত্র-টা লাফিয়ে উঠল। আনমনে একপা একপা করে এগিয়ে ঠিক তার পেছনে দাঁড়াল।
মিষ্টি খেয়াল করলো তার চাহনি। তৎক্ষনাৎ চট করেই বুঝতে পেরে খিলখিল করে হেঁসে বলল,
“ ভাইয়া আপনি? আচ্ছা থাকুন থাকুন! আমি তৃষ্ণা আপুর কাছে যাচ্ছি। ”
পরক্ষণেই থতমত খেলো বেচারা। স্নিগ্ধাও মিষ্টির কথায় তার পেছন ঘুরে মুখোমুখি হলো। ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“ মিষ্টি চলে যাচ্ছ কেনো? থাকো না। আমি-ই টবে পানি দিয়ে চলে যাবো। তোমরা রোদ পোহাও। ”
মিষ্টি শুনলোই না তার কথা। নাচতে নাচতে চলে গেলো নিচে। স্নিগ্ধা ঘাড় ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ ছাঁদে চোখ বুলিয়ে নিল। এরপর বাঁকা চোখে বলল,
“ এই রোদেও আপনি ঘামছেন অর্ণব শেখ। ”
চট করে অজান্তেই হাত চলে গেলো কপালে, গালে। পরক্ষণেই কপাল কুঁচকে গেলো। সামনে তাকাতেই দেখল স্নিগ্ধা হেঁসে লুটোপুটি খাচ্ছে। নিজের বোকামী বুঝতে পেরে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। মেয়েটা বড্ড দুষ্ট! কেমন বোকা বানিয়ে দিলো। কপালে ঘামের অস্তিত্ব ও পায়নি সে। চোখের চশমা নাকের ডগায় ঠেলতেই স্নিগ্ধা হাত বাড়িয়ে চট করে চশমা খুলে নিয়ে বলল,
“ এভাবেই থাকুন। ভালো দেখাচ্ছে। ”
অর্ণব প্রথমে হতভম্ব হলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“ আপনার কি ধারণা? আমি চশমা ছাড়া চোখে দেখি না? ”
স্নিগ্ধা কোমর বাঁকা করে রেঙিলে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উত্তর দিলো,
“ একদম নয়। তবে, চশমা ছাড়া আপনাদের দুইভাই-কে আমি আলাদা করতে পারবো না। কি একটা বাজে পরিস্থিতি। যদি হঠাৎ আপনি চশমা ছাড়া আমার কাছে আসেন। এরপর আমি ভুল করে অর্পণ ভেবে উলটাপালটা কিছু করি তখন? ছিহ ছিহ!”
বলেই স্নিগ্ধা জিহ্ব কাটলো। অর্ণবের মুখটা কালো হয়ে যায়। সে অবাক নয়নে মেয়েটাকে পরখ করে ভাবলো অনেক কিছুই। তার মানে কি স্নিগ্ধা অর্পণকে ভালোবাসে? হৃদয়ে ছটফটিয়ে উঠলো বন্দী পাখিটা। হাঁসফাঁস করে আজ ভয়াবহ এক কথা জিজ্ঞেস করেই ফেললো ,
“ উল্টোপাল্টা মানে? আপনি কি অর্পণকে ভালোবাসেন?”
অর্ণবের বোকা বোকা কথায় মেয়েটা শব্দ করে হেঁসে উঠে। যেনো মজার কোনো জোকস করেছে সামনের যুবক। যা দেখে রাগে গা পিত্তি জ্বলে উঠল অর্ণবের। সে দ্রুত জায়গা ত্যাগ করে টবের নিকট গেলো। হঠাৎ তার পরিবর্তনে স্নিগ্ধা বিস্মিত হলো। চশমা হাতে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে অর্ণবের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ আরেহ! রেগে যাচ্ছেন নাকি? আমার কথা না শুনেই হাইপার হচ্ছেন? আপনি ভাবলেন কিভাবে ওই অর্পণ কু/ত্তাকে আমি ভালোবাসবো? ইয়াক ছিঃ! ওকে আমি পারলে, ঝামা ঘঁষে দেই। শা/লা কু/ত্তা একটা। সুখের জীবনটা ন/রক বানিয়ে দিল।”
টবে পানি দেওয়া অর্ণবের হাত থেমে গেলো। ঘাড় বাঁকিয়ে স্নিগ্ধার শক্ত চাহনি দেখে দাঁতে দাঁত চাপলো সে। বলল,
“ স্নিগ্ধা! কার কাছে কি বদনাম করছেন? ভুলে যাবেন না অর্পণ আমার ভাই। ”
বলেই বিরক্ত চোখ – মুখে দূরে সরে গেলো অর্ণব। স্নিগ্ধা পড়লো মহা বিপদে। মনে মনে কয়েকশো গালি দিলো নিজেকে। এ কার কাছে কি বললো সে? জমজ ভাইয়ের নামে তার কাছেই বাজে কথা? যতই হোক অর্পণ তার মায়ের পেটের আপন ভাই। আর সে দূরের কেউ। স্নিগ্ধা অপরাধবোধে গাইগুই শুরু করে। তার কি দোষ? লোকটাই কেনো এই সুন্দর মুহূর্তে ওই অসভ্য ছেলের কথা বলে মাথা গরম করে দিলো। মেয়েটা এগিয়ে গেলো। ঝটপট বিনাবাক্যে ঝুঁকে গাছে পানি দেওয়া লম্বা, সুদর্শন পুরুষকে চশমা পরিয়ে দিল। অর্ণব অবাক চোখে তাকাল। বলল,
“ কি করলেন স্নিগ্ধা?”
বোকা স্নিগ্ধা জানতেও পারলো না এই ভরদুপুরে একজন আর্মির কতবড় সর্বনাশ করে ফেলেছে। মেয়েটার সরলতায় এক অজানা অনুভূতি তে বশীভূত হলো সে। স্নিগ্ধাও লজ্জা পেলো একটু আগের ব্যাপারটা বুঝতে পেরে। লজ্জায় পেছন ঘুরে সিঁড়ির পানে পা বাড়াতেই একটি শক্ত কণ্ঠ তাকে আঁটকে দিলো,
“ স্নিগ্ধা সামনের রবিবারে সিলেট চলে যাচ্ছি। ছুটি শেষের দিকে। আপনি কি আমাকে মিস করবেন?”
বলেই অর্ণব উত্তরের অপেক্ষায় সামনে তাকিয়ে রইলো। আকস্মিক কথায় স্নিগ্ধা চমকে তাকায়। স্তব্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ কি? চলে যাবেন মানে?”
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধীর পায়ে মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“ আমাকে এবার যেতে হবে স্নিগ্ধা। মিস করবো ভীষণ। এই কয়েকমাসের প্রতিটি দিনগুলো। আপনার সঙ্গে কাটানোর প্রতিটি মুহুর্ত স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। আপনি আমার কাছে স্পেশাল হয়ে উঠেছেন। ”
স্নিগ্ধা পাথরের মতো ঠাই দাঁড়িয়ে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সত্যি অর্ণব চলে যাবে। হঠাৎ করেই কান্না পাচ্ছে খুব। ভেতরের কান্নাগুলো হালকা ঢোক গিলে রয়ে সয়ে বলল,
“ সত্যি চলে যাবেন?”
অর্ণব মৃদু হাঁসলো। আচমকাই মেয়েটার নাক টিপে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ হ্যাঁ! তবে, আপনি স্বরণ করলে চলে আসার চিন্তা ভাবনা করতে পারি। ”
“ আমার কথায়? আমি কি স্পেশাল? ”
স্নিগ্ধা অবাক কণ্ঠ। অর্ণব হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকাল। মেয়েটার দৃষ্টি আরোও প্রখর হয়। জিজ্ঞেস করলো,
“ আসলেই? ”
“ হ্যাঁ। ”
“ যদি বলি থেকে যান।”
মুহূর্তেই থমকে গেলো বেচারা। হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,
“ এখন সম্ভব নয়। ”
স্নিগ্ধা অনুভব করলো তার পা দুটো ঠান্ডা হয়ে আসছে। এত রোদের মাঝেও কাঁপতে শুরু করলো। নিজের মনের বিরুদ্ধে আজ যেতে পারলো না। পা*গলামি কণ্ঠে শুধালো,
“ আপনি আসলেই চলে যাচ্ছেন?”
অর্ণব চোখ বন্ধ করে নেয়। তারও যে হঠাৎ কষ্ট অনুভব হচ্ছে। মাথা ঝাঁকাতেই স্নিগ্ধা দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। উচ্চস্বরে বলল,
“ আমার যদি আটকানোর অধিকার থাকতো এই সন্ধিক্ষণে আপনাকে কখনও আমি যেতে দিতাম না। ভালো থাকবেন।”
অর্ণব বিস্মিত নয়নে চট করে তাকাল। মেয়েটার এই কথায় কি ছিল? এভাবে বুকের ভেতর কষ্ট হচ্ছে কেনো? এই কতগুলো দিন প্রতিটি মুহুর্ত সবই তার কাছে স্পেশাল। সেদিন সন্ধ্যার রিকশায় পাশাপাশি বসে আসা সব-ই যেনো মধুর। অর্ণব আকাশের পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে করলো সেদিন কার মিষ্টি মুহূর্ত। তার কথায় প্রথমে মেয়েটা ভরকে গেলেও পরক্ষণেই সামলে নিয়েছিল। মৃদু হেঁসে বাড়িয়ে দেওয়া স্যুট নির্দ্বিধায় গায়ে জড়িয়েও নেয়। প্রচন্ড ঠান্ডায় অর্ণবের স্যুট না নিয়েও উপায় ছিল না৷ দেখা যেত, বাসায় যেতে যেতেই সে শীতে জমে গেছে। তাই গায়ে চেপে ধরে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“ কখন এসেছেন?”
অর্ণবের দৃষ্টি তখনও তার দিকে। সে ওভাবেই শাড়ি পরিহিতা রমনীর পানে তাকিয়ে জবাব দিয়েছিল,
“ অনেকক্ষণ আগেই। ”
স্নিগ্ধা চুপ করে রইলো। কথা বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলো না। অর্ণব দীর্ঘক্ষণ পর নিজেই নিরবতা ভেঙে বলল,
“ আপনি কি ক্লান্ত? চাইলে আমার কাঁধে মাথা রাখতে পারেন। ”
কথাটি শুনা মাত্রই লজ্জায় স্নিগ্ধা মস্তক নত করে ছিল। লোকটা ইদানীং যা তা বলে ফেলে। তৎক্ষনাৎ শুনা যায় পাশ থেকে হাঁসির শব্দ। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। হঠাৎ-ই অর্ণব নিজেই দুজনের দূরত্ব ঘুচিয়ে স্নিগ্ধার মাথা আগলে নিলো তার বুকে। মেয়েটা লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। মাথা শক্ত করে একটু পিছিয়ে বলল,
“ কি করছেন? পা-গল হয়ে গেলেন? ”
“ মাঝে মধ্যে পা*গল হলে দোষ কি? রাখুন না কাঁধে মাথা।”
বলেই অর্ণব তার মাথা কাঁধে রাখলো। মেয়েটা অদ্ভুত শিহরণে হাঁসফাঁস করে উঠে। কিছু বলতে যেতেই ছেলেটা তার চিবুকে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,
“ নড়বেন না। এভাবেই থাকুন। ”
স্নিগ্ধা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। বাকি পথ সেভাবে এসেই গেইট থেকে অল্প দূরে মাথা সরিয়ে নেয়। রিকশা থেকে নামতেই অর্ণব কোমল গলায় জানতে চায়,
“ স্নিগ্ধা! ভীষণ ভালোবেসেছেন কখনও? অথবা এখনও কাউকে বাসেন?”
তৎক্ষনাৎ মেয়েটা হেঁসে উঠেছিল। ঝিরিঝিরি কণ্ঠে হরবরিয়ে বলেছিল,
“ বয়ফ্রেন্ড এর কথা বলছেন? আমার জন্য সে তো স্বপ্নের ব্যাপার! আমার আম্মুর মতো তীক্ষ্ণ, চতুর মহিলা যার আছে তার জীবনে প্রেম নামক বাক্য না থাকাই স্বাভাবিক। ওসব ভয়ংকর ব্যাপারে আমি আগেও ছিলাম না এখনও নেই। ভবিষ্যতে থাকবো কিনা সন্দেহ। যদি আম্মু বলে, তাহলে থাকতে পারি। ”
বলেই মেয়েটা দৌঁড়ের উপর চলে গেলো ফ্ল্যাটে। অর্ণব হা করে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা তবে এতই মায়ের শাসনে শাসিত!
ঘটনা গুলো মনে করে স্নিগ্ধা দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠল। আজ এই মুহুর্তে এসে তার বুকের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। যতবারই মনে হচ্ছে, অর্ণব বেশী দিন এখানে নেই। চলে যাবে দূরে। ততবারই বেহায়া মনটা কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ অনুভূতির নাম কি দিবে সে? অচেনা, অজানা কারো জন্য কষ্ট লাগলে তাকে কি বলে? হাজার ভেবেও উত্তর খুঁজে পেলো না স্নিগ্ধা। ডুকরে উঠে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদল এই প্রথম অচেনা এক যুবকের জন্য যার সঙ্গে তিনমাসেরও কম সময়ের পরিচয়৷ তার জন্য আজকাল মনটা বড্ড পুড়ছে। কেনো তাকে মিস করবে সে? কোন অধিকারে? তাদের কি অধিকার দেওয়া-নেওয়ার মতো সম্পর্ক হয়েছে.? কই স্নিগ্ধার নো তেমন কিছু মনে হয়না! অর্ণব তো তাকে আশা দেয়নি। তবুও এ কষ্টের নাম কি দিবে সে? কেনো পুড়ছে হৃদয়? প্রিয় একটি জিনিস দূরে গেলে যেমন খরার মতো তৃষ্ণা পায় তারও ঠিক সেই অনুভূতি হচ্ছে! মেয়েটা নাকের পানি চোখের পানি এই প্রথম এক করলো।
সন্ধ্যার আগ মুহুর্ত! অর্পণ খোলা আকাশের নিচে একটি মার্কেটের সামনের টংয়ে দোকানে বসে চা খাচ্ছে। পাশেই তুষিব! ছেলেটার চোখ-মুখ অস্বাভাবিক! অর্পণ সকালের ঘটনা জানতে পেরেই কয়েক দফা ঝেড়েছে। প্রথমত অহেতুক রাগে ঝামেলা সৃষ্টি। দ্বিতীয়ত চৈতীকে ডাইরেক্ট ভাবী পর্যন্ত বানিয়ে ফেললো? তুষিব গালি খেয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। অপেক্ষা করছে, অর্পণের মুখ থেকে আরোও হাজার খানেক গা/লি শুনার জন্য। পুরো তিন কাপ চা শেষ করে সি*গারেট ধরালো অর্পণ। লম্বা টান নিয়ে উঠে পড়ল। দুহাত পকেটে গুঁজে হনহনিয়ে সামনে যেতে যেতে বলল,
“ খুব মাস্তান হয়েছিস? কিছু হলেই ঝামেলা করছিস। সমস্যা কি?”
তুষিব তড়িৎ তার পিছু নিলো। মার্কেটে প্রবেশ করতে করতে জবাব দেয়,
“ সরি ভাই! আমার মাথা গরম কইরা দিছিল। ওই বাঙ্গীর পোলা গো সাবধান করছিলাম। ”
তৎক্ষনাৎ তার দিকে এক জোড়া রাগান্বিত ধারালো চোখ নিক্ষেপ হলো। মুহূর্তেই বেচারা তুষিব চুপসে যায়। হুডি-তে হাত ঢুকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“ সরি ভাই। ভুল হইয়া গেছে।”
“ তোরে আমি চুপ থাকতে কইছি না !এত কথা কস ক্যা? এমনিতেই কিন্তু মেজাজ খারাপ কইরা দিছস!”
অত্যন্ত ঝাঁঝাল গলায় কথাটি বলেই অর্পণ দোতলায় উঠে যায়। তুষিব ভয়ে ভয়ে সামনে এগুলো। আশেপাশের সুন্দরী মেয়েদের দেখে তার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মুহূর্তেই মন খারাপ সব নিমেষেই পালিয়ে গেলো। মুখে ফুটে উঠলো, মিষ্টি হাঁসি! কিন্তু সেই হাঁসি বেশীক্ষণ টিকলো না! অল্প সংখ্যক সিঙ্গেল মেয়ে মার্কেটে থাকলেও তার থেকে তিনগুণ অসভ্য মেয়েগুলো বয়ফ্রেন্ড নিয়ে গলাগলি ধরে হাঁটছে। এটা-সেটা দেখছে। তুষিবের গা পিত্তি জ্বলে উঠে এসব ন্যাকামো দেখে। মুখ মুচড়ে মনে মনে অভিশাপ দিতেও ভুললো না। এদের চরম মাত্রায় ব্রেকআপ হলেই সে সবচেয়ে বেশী খুশি হবে। কেননা, এই দেশে কোটি কোটি মেয়ে থাকতে, একটি মেয়েও তার হলো না। যদি একবার হয়ে যায়, সে দেখিয়ে দেবে ভালোবাসার ঝাল, মিষ্টি, টক সবগুলোর ডোজ কত প্রকার ও কি কি! তুষিব ভেংচি কেটে চারপাশে কাপড় দেখা শুরু করে দিল। অবশ্য এ কথা ভুল বলা হলো। সে কাপড় দেখছে কম! সিঙ্গেল মেয়েদের আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করছে বেশী!
শীতের কাপড় খুবই সামান্য চৈতীর। শ্রাবণ কাল-ই ঢাকার বাইরে বড় বোনের বাসায় গিয়েছে। এর মধ্যেই জিনিয়া হঠাৎ আজ দুপুরে চৈতীকে জানালো, বিকেলে বের হবে। কিন্তু চৈতীর প্রতিদিন দুপুরে ঘুমানোর স্বভাব। পড়াশোনা করে, খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার ফলে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল সে। ঠিক সন্ধ্যার আগে মনে পড়তেই তৎক্ষনাৎ জিনিয়াকে কল করেই বেরিয়ে পড়লো। মার্কেটে প্রবেশ করে, চৈতী শুধু তার সঙ্গে সঙ্গে কাপড়চোপড় দেখতে লাগলো। শীতের চাদর কিনে একটি ব্রেসলেট দেখতে দেখতে জিনিয়া বলল,
“ চৈতী! আয় এটা কিনি।”
মেয়েটার কথা তার কান পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা সন্দেহ! চৈতীর সম্পূর্ণ ধ্যাণ- জ্ঞান ছিলো একটা কুর্তির উপর! হাতের কাজে সিম্পল ডিজাইন করা লাল হলুদ রঙের কুর্তি! সে আলতো হাতে ছুইয়ে দেখছে। গভীর মনোযোগ সেখানেই। জিনিয়ার দ্বিতীয় ডাকে তার ঘোর কেটে যায়। চমকানো স্বরে বলল,
“ কি বললি?”
জিনিয়া কপাল কুঁচকে তার নিকট দাঁড়ালো। কুর্তি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ এটা পছন্দ হয়েছে? কিনবি?”
চৈতীর মুখটা তৎক্ষনাৎ চুমসে গেলো। সে পার্স ব্যাগ হাতে নিয়ে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে আমতা আমতা করে বলল,
“ পরে কিনবো। তুই জলদি কি কিনবি কিনে নে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফিরতে হবে না?”
জিনিয়ার কুঁচকে যাওয়া ভ্রু আরোও গভীর হলো। চৈতীর অস্বস্তি ভরা মুখখানায় পলনহীন তাকিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“ আমি বুঝতে পেরেছি তোর হাতে টাকা নেই। আমার কাছ থেকে নে।”
চৈতী আবারোও গায়ে জড়িয়ে এপাশ ওপাশ করে সামনের আয়নায় তাকিয়ে দেখছিলো সেই ড্রেস! কিন্তু জিনিয়ার কথায় মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
“ চুপ কর তো। এত জরুরি প্রয়োজন হয়নি। যে, এখন-ই কিনতে হবে। ”
বলেই চৈতী ড্রেস যথাস্থানে রেখে, তার হাত ধরে গটগট পায়ে এগিয়ে গেলো কসমেটিকস এর দোকানের দিকে। কিন্তু হাঁটার মাঝে একবার পেছন ঘুরে পলকহীন তাকিয়ে রইলো সেই হ্যাঙ্গারে ঝুলে থাকা কুর্তির দিকে! দূর থেকে এ দৃশ্য পরখ করলে, বুঝা যাবে যেনো, মেয়েটাকে সে ডাকছে!
অর্পণ ব্যস্তপায়ে হেঁটে যাচ্ছিল থার্ড ফ্লোরে! কিন্তু মাঝপথেই একটি চিরচেনা কণ্ঠ শুনে আপনা আপনি-ই তার পা থেমে যায়। দূরে দাঁড়িয়ে কথোপকথন করা দুই বান্ধবীর দিকে কৌতুহল চোখে তাকাল। কি নিয়ে এত কথা তাদের? যদিও মেয়েদের ব্যাপার নিয়ে কোনো কালেই তার বিশেষ আগ্রহ নেই। কিন্তু আজ কেনো জানি, অজান্তেই ওদের নিয়ে আকর্ষণ জাগলো হৃদয়ে। শুনতে ইচ্ছে হলো, তাদের ছোট ছোট কথাগুলো। অর্পণ সম্পূর্ণ না শুনলেও জিনিয়ার শেষ কথা শুনেছে। মনে মনে বিভিন্ন ভাবনাও উঁকি দিয়েছে। তারা অন্যদিকে যাওয়ার পরেই সে চট করে সেই স্থানে অবস্থান করলো। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজার মাঝেই চোখ আটকালো, চৈতীর হাতে থাকা এই কুর্তির দিকে। আনমনেই অর্পণও হাত বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁইয়ে দিল। তৎক্ষনাৎ কানে আসে তুষিবের ব্যাকুল কণ্ঠ,
“ ভাই.! আন্টি কল দিছে। কথা কইবো।”
তুষিবের কথায় কুর্তী থেকে ঝটপট হাত সরালো। তড়িৎ গতিতে পেছন ঘুরে, ফোন হাতে নিয়ে অর্পণ কানে তুলে হ্যালো” বলতেই পায়েল শেখ আদেশের সুরে বলল,
“ তুমি মার্কেটে অর্পণ? ”
অর্পণ সটান হয়ে দাঁড়ায়। কণ্ঠে একরাশ গম্ভীর ঢেলে উত্তর দিলো,
“ জি। কিছু বলবে?”
“ হ্যাঁ তৃষ্ণার জন্য মেডিসিন আনতে হবে। আমি হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠাচ্ছি। আসার সময় মনে করে আনিস! আর জেনো চিল্লাতে না হয়। ”
অর্পণ কল কেটে দিলো। তুষিবকে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে সেই ছবি স্যান্ড করে কিনতে পাঠালো। অর্পণ নিজের জন্য তিনটা টি-শার্ট দেখে ট্রায়াল রুমে যায়। আয়নায় আঁটসাঁট হয়ে লেগে থাকা নতুন টি-শার্ট এর দিকে তাকিয়ে চোখ-মুখ গম্ভীর করলো। দাঁড়ি -তে ভরা চোয়ালে কিয়ৎক্ষণ তর্জনী ঘঁষে অধর বাঁকিয়ে হাঁসলো। দেখতে আহামরি সুন্দর না লাগলেও, খারাপ লাগছে না। কিছুদিন চালিয়ে দেওয়া যাবে। মাথার কুঁকড়ানো চুলগুলো বাঁহাতে পেছনে ঠেলে দিতেই আবারোও তা এলিয়ে পড়লো কপাল জুড়ে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো সে! ট্রায়াল রুম থেকে দুটি টি-শার্ট সিলেক্ট করে বেরিয়ে এলো। এরপর হুডি, টাওজার পছন্দ করে বিল পে করার জন্য এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে যেতেই হঠাৎ কাঁধের সঙ্গে আঘাত লেগে পড়ে গেলো সেই লাল হলুদ কুর্তি।
অর্পণ পরক্ষণেই থেমে গেলো। কপাল কিঞ্চিৎ করে নিচে পড়া থাকা কাপড়ে তাকিয়ে রইলো। হাতের হুডি এবং টাওজার নিয়ে বসে পড়লো সেখানেই। হালকা ঝুঁকে কি মনে হতেই কুর্তিটা উঠিয়ে নেয়। চারপাশে সুক্ষ্ম চোখে পলক ফেলে নিয়ে নিলো নিজের সাথে। বিল পে করার সময় হলো মহা ঝামেলা! ক্যাশ টাকা আছে মাত্র ৪ হাজার! বিল হলো, ৫ হাজার ৩শ! অর্পণ চিন্তায় পড়ে গেলো। কিছুসময় মস্তিষ্ক খাটাতেই মনে পড়ল কার্ডের কথা। মৃদু হেঁসে সামনের ব্যক্তিকে বলল,
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৫
“ কার্ড দিচ্ছি। আপনি সবগুলো প্যাক করে দিন। এই কুর্তি আলাদা প্যাক করবেন।”
“ ম্যামের জন্য? ”
গদগদ কণ্ঠে বলেই মেয়েটি মিটিমিটি হেঁসে বিল পে করে দেয়!