খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ২৪
আনিকা আয়াত
চারপাশে রং-বেরঙের লাইট, ঝাড়বাতি দিয়ে সাজসজ্জায় আলোকিত তৃধার বাংলো বাড়ি। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে আসলেও বুঝার উপায় নেই এখন দিন নাকি রাত! লাইটের তীব্র আলোয় ঝকমকে প্যান্ডেল। স্টেজে তৃধাকে হলুদের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। সামনে ইয়া বড় কেকটা কেটে কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই হইহট্টগোল শুরু করে যায়। ওরা কেক খাচ্ছে কম, কাড়াকাড়ি করছে বেশী। একে অপরকে কেক লাগাচ্ছে সমস্ত মুখে।
হলুদ পাখি তৃধা চারপাশের মিষ্টি মুহূর্ত দেখে হাঁসতে হাঁসতে পেট চেপে ধরে । পৃথা সুযোগ পেতেই কেক হাতে মাখা মাখা করে দৌঁড়ে গেলো। সামনের সমুদ্রের মুখশ্রী তে দুহাত ভরা কেক লাগিয়ে দিতেই চিৎকার শুরু হয়। এই মুহুর্তের জন্যই হয়তো তৃধার কিশোরী কাজিন গুলো অপেক্ষায় ছিলো। ওরাও হইচই বাঁধিয়ে দল বেঁধে গেলো সমুদ্রের কাছে। বেচারা আকস্মিক ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায়। কস্মিনকালেও ভাবেনি, এভাবে একদিন রমণীগণের ভীরে সে অসহায় ফিল করবে। এক হুলুস্থুল কান্ডে সমুদ্র দৌঁড়ে পালাতে যেতেই খপ করে ধরে ফেললো ওরা। সারা মুখে, পাঞ্জাবি, সমস্ত দেহে যে যেখানে পাড়লো কেক লাগিয়ে দিতে হামলে পড়লো। বেচারা নিজেকে এই কঠিন মুহূর্তে বাঁচা তে না পেরে হতাশ হয়ে গাল ফুলায়। চিৎকার করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আল্লাহ আমাকে রক্ষা করো! কথা দিচ্ছি এই নারীজাতি থেকে ১০০ ফুট দূরে থাকবো।”
চারপাশে কিশোরীদের খিলখিল ধ্বনি ভেসে আসে উচ্চস্বরে। সমুদ্র এখানে আসার পর থেকে কম জ্বালায় নি সবাইকে। প্রতিশোধ তো নেওয়ার-ই হতো। প্রতিটি মেয়ের সঙ্গে ফ্লার্ট করে অতিষ্ঠ বানিয়ে ফেলেছে ওদের। এই সুযোগে সবাই উচিৎ শিক্ষা দিলো অসভ্যটাকে।
পৃথা গালের কেক টিস্যু দিয়ে মুছে ওয়াশরুমের নিকট যায়। শাড়িটাও হইচই করার মাঝে এলোমেলো হয়েছে। আঁচল ঠিকঠাক করার সময় হঠাৎ-ই শিহাব হুড়মুড়িয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। আয়নার সামনে আঁচল ঠিক করা পৃথা ভরকালো। শিহাব আশপাশ সচেতন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফটাফট হাত থেকে একটি তাজা লাল গোলাপ বের করলো। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকা পৃথার কানে টুপ করে গুঁজে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“ এবার পরিপূর্ণ লাগছে পৃথা। যাচ্ছি.. ”
বলেই আগের মতোই দৌঁড় দিয়ে চলে যায়। বাম হাত আনমনেই কানে গুঁজে রাখা গোলাপ স্পর্শ করে ফিক করে হেঁসে ফেললো পৃথা,
“ পা*গল একটা..!”
খাওয়া দাওয়ার আয়োজন শুরু হলো কিছুক্ষণ বাদেই। কিন্তু অর্পণের কোনো খুঁজ না পাওয়ায় তৃধা চারপাশ উঁকি দিলো। তবুও অর্পণের দর্শন পেলো না। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলেও আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে কল করলো। অর্পণ আসবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল,
“ আসছি..! জরুরী কাজ পড়ে গিয়েছিল। গায়ে হলুদ লাগিয়েছিস? পৃথা ওরা তো হেব্বি এনজয় করছে। মেসেঞ্জার গ্রুপে শুধু এখন ওরা আর ওরাই। ”
তৃধা গাল ফুলালো। স্টেজের কর্ণারে গিয়ে বক্সের সাউন্ড এর জন্য উচ্চস্বরে বলল,
“ ঠিক আছে জলদি আয়। ওরা তাহলে আসলো না? থাক সমস্যা নেই। তুই এলেই চলবে!”
অর্পণ মৃদু হাঁসলো। বলল,
“ আসছি!”
বলেই কল রেখে দিলো। তৃধা হোয়াটসঅ্যাপ চেক করতেই চোখ আটকালো, রিয়াদ স্যারের পাঠানো হ্যান্ডসাম, মুগ্ধকর প্রতিটি ছবির উপর। সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবীতে কি শুভ্র লাগছে। ছবিগুলো দেখে তার গলা শুঁকিয়ে আসে। বেহায়ার মতো জুম করে আগাগোড়া দেখে হালকা ঢোক গিললো। স্যারের শক্তপোক্ত দেহ! অদ্ভুত চোখ দুটি এবং দাঁড়ির মাঝে লুকিয়ে থাকা চিকন ঠোঁটে নজর বুলিয়ে ফট করে লিখলো,
“ আমার সুদর্শন পুরুষ। ওই পাতলা সুইট ঠোঁট দুটি আমার।”
লিখেই লজ্জা পাওয়ার ইমোজি দিলো। এবার সত্যি সত্যি লজ্জা পাচ্ছে সে। মুখে হাত চেপে ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো।
তৎক্ষনাৎ রিয়াদ স্যার মেসেজ করলো,
“ নিজের মখমলের ন্যায় হ/ট ঠোঁট দুটি সাবধানে রেখো তৃধা পাখি। নইলে, হিংস্র আদরে অচিরেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এই মেয়েটার পা থেকে মাথা আগাগোড়া সবই যে আমার। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে আদর করবো। বাঁধা দিলে দ্বিগুণ জাপ্টে ধরবো।”
লজ্জায় আড়ষ্ট হলো সে। রিয়াদ স্যার কে যখন সে সাজগোছ করার পর হলুদের ছবিগুলো দিয়েছিল। তখনও লজ্জা মূলক টেক্সট লিখে,
“ জলন্ত আ/গুন! তৃধা নামক হট আগু/নে নির্দ্বিধায় ঝাপ দিতেও রাজি।”
তৃধা ক্ষেপেছিল খুব। রাগান্বিত ইমোজি দিতেই টুপ করে মেসেজ আসে,
“ মাত্র আজকের রাতটুকু তৃধা! শীগ্রই আসছি তৃধা নামক অশান্ত, অস্থির ঝাল মরিচ টেস্ট করতে..! আমার সান্নিধ্যে এলেই অশান্ত তৃধা তখন টুপ করেই শান্ত হয়ে যাবে। ”
তৃধা প্রতিত্তোরে ইমোজি দেওয়া ছাড়া উপায় পায় না।
এবারও লজ্জায় নাকের পাটা কাঁপলো ওর। গরম হয়ে উঠা কান দিয়ে ধুঁয়া বের হতেই মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
“ চুপ করুন। হলুদ শেষে আরোও ছবি পাঠাবেন।”
রিয়াদ স্যার লিখলো,
“ ফাইনালি হিসেব মতে কাল আমাদের বাসর রাত তৃধা পাখি। আজকের রাত তৃধার। কাল সম্পূর্ণ রাত রিয়াদ মাহমুদের! এক কিঞ্চিৎ ও রেহাই দেবো না। সব শোধে আসলে ফেরত নেবো। এই শক্ত যুবক কে স্বইচ্ছায় উস্কে দেওয়া ও ঘায়েল করার শাস্তি তুমি হাড়ে হাড়ে কাল টের পাবে। রূপের জালে আমাকে দূর থেকে অস্থির করার প্রতিটি হিসেব কড়ায়গণ্ডায় হবে সোনা।”
তৃধার হাত কাঁপা শুরু হয়ে যায়। সে রিপ্লাই দেওয়ার মাঝেই খাওয়ার জন্য তাড়া দেওয়া শুরু করে তার মেঝফুপা। তৃধা ব্যস্ত হাতে রাগান্বিত ইমোজি সেন্ড করেই দৌঁড়ে পালালো। তার হাত-পা কাঁপছে। এই বজ্জাত লোকের সঙ্গে কিভাবে সংসার করবে ও? ইশশ! কি অসভ্য কথা বলে ইদানীং! লজ্জায় মাথা কাটা পড়ে!
সকলের তৃপ্তি ভরে, খাওয়ার পাট চুকাতেই অর্পণের আগমন ঘটলো তৃধার হলুদ সন্ধ্যায়। বাইক থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকল কিশোরী রমণী হা করে চেয়ে রইলো। হলুদ পাঞ্জাবীটি আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে গায়ের সঙ্গে। তৃধার কাজিন রা দূরে থেকে খেয়াল করেই হা হুতাশ শুরু করে। বেহায়া নজরে তাকিয়ে বলাবলি শুরু করলো নিজেদের মধ্যে। একেক জনের একেক রকম কৌতুহল। অর্পণ চোখের সানগ্লাস খুলে পাঞ্জাবীর কলারে ঝুলিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেললো। ওকে দেখতেই তৃধা স্টেজে বসে মুখ ভেংচি কাঁটছে। ওই ব্যাটা সেই সন্ধ্যার সময় থেকে আসছেই। অবশেষে! এখন সময় হলো আসার? রাগে গা পিত্তি জ্বলে উঠলো।
বন্ধুকে দেখে শিহাব, সমুদ্র ও হামিম হই-হ্যালো’র শব্দে দৌঁড়ে গেলো। দুপাশ থেকে জাপ্টে ধরে শিহাব বলল,
“ এতক্ষণে সময় হলো?”
অর্পণ টাল সামলাতে না পেয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি করে বলল,
“ দূরে যা। সমুদ্র শা/লা আমার ভার্জিন দেহে হাত লাগাবি না। অপবিত্র হবে। ”
সমুদ্রের মুখটা চুপসে গেলো। সামনে চেয়ে দেখলো, শিহাব ওরা হাঁসছে। তৎক্ষনাৎ রাগে গর্জে উঠে অর্পণের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে অর্পণ হাঁটু দিয়ে ওর পেটে লাত্থি মেরে বলল,
“ ছাড় সমুদ্র। বেশী বাড়াবাড়ি করলে একদম পুঁতে ফেলবো।”
“ নাহ! আগে সুন্দর করে বল, সমুদ্র আমায় ছাড়ো প্লিজ! এভাবে সকলের সামনে জড়িয়ে ধরে মানসম্মান নষ্ট করো না। সবাই দেখছে।”
বলেই হাতের বাঁধন আরোও দৃঢ় করলো সমুদ্র! শক্ত করে জড়িয়ে রাখা সমুদ্রের হাত অনেক ধস্তাধস্তি করেও সরাতে পারলো না। অর্পণের রাগ তরতর করে বাড়ে! বিরক্ত হয়ে, কিয়ৎক্ষণের মাঝেই রণমুর্তি ধারন করলো। পৃথা দৌঁড়ে এসে ওদের দেখে হাঁসছে। অর্পণ তৎক্ষণাৎ সমুদ্রের বিশেষ জায়গায় রাগে ফুঁসে উঠে জোরে লাত্থি মা/রতেই “ ও মা গো! ম/রে গেলাম আল্লাহ। আমার বংশের বাতি নিভায় দিলো হা;রামজাদা। ”
বলেই ছিটকে দূরে সরে আহাজারি করতে থাকে। পেন্ডেলে উপস্থিত থাকা সবাই উচ্চস্বরে পেট ফাটা হাঁসি হাঁসে। দূরে লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের দেখতে থাকা রমণীগণ লজ্জায় লাজুক ভঙ্গিতে হাঁসলো। অর্পণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ নেক্সট টাইম আমাকে স্পর্শ করলে একদম টাটা বাই বাই করবো। বাপের জন্মেও আব্বা” ডাক শুনতে পারবি না শা/লা। ”
শিহাব বেচারা কে ধরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ খুব বেশী লেগেছে? আহারে!”
“ ঠান্ডা পানি ঢাল। ব্যথা কমে যাবে।” বলেই পৃথা মুখে হাত চেপে খিলখিল করে হাঁসলো। সমুদ্র প্রতিত্তোরে কটমট করে তাকায়।
“ দূর হ। শয়*তান!”
অর্পণ আশপাশ তাকিয়ে সমস্ত আয়োজন পরখ করে তৃধার বাবার নিকট গেলো। পরিবারের মানুষদের সঙ্গে ভালোই ভাব তার। অর্পণকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্থ হয়ে পড়েন তারা। রমণীগণ সেখানে গিয়ে ভীর জমায়। তৃধার মা স্পেশাল ভাবে খেতে দিলেন। অর্পণ কথা বাড়ালো না। তার সত্যি ক্ষিদে পেয়েছে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে স্টেজে উঠে।
এতক্ষণের অশান্ত, উশৃংখল পরিবেশ অবশ্য তৃধার ডাকে হালকা হলো। অর্পণ তার পাশে বসতেই চিল্লিয়ে বলল,
“ আমার সাথে দেখা না করেই খাদকের মতো খাওয়া শুরু করে দিলি? ফ্রেন্ডের থেকে বিরিয়ানি দামী।”
“ অফকোর্স! বিরিয়ানি অলওয়েজ মাই হার্ট! ”
রেগে তৃধা তেড়ে আসে। অর্পণের চুল ধরে হিসহিসে বলল,
“ কু*ত্তা।”
অর্পণ বাঁকা হেঁসে মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে গাল টিপে দিলো।
“ মাশাল্লাহ তৃধা! সুন্দরী বান্ধবীর কুনজর না লাগুক! সুখী হ বেস্টি!”
মৃদু হেঁসে তৃধা গাল ফুলিয়ে নরম হওয়া শুরু করে। সেই সুযোগে, টেবিল থেকে একটি মিষ্টি হাতে নিলো অর্পণ। তৃধার মুখের নিকট ধরে বলল,
“ খাও বন্ধু। আজই শেষ ফ্রেন্ডের হাতে কিছু খাওয়া। এরপর শুধু স্বামীর আদর-সোহাগ খেয়েই পেট ভরাতে হবে। বেচারী শত বাঁধা দিলেও এক বিন্দুও নিস্তার নেই। গাল ফুলাচ্ছিস? একদিন ঠিক অর্পণের কথা মনে পড়বে। মিলিয়ে দেখিস। সেই দিন বেশী দেরী নয়!”
“ শয়*তান। চুপ কর বলছি..!”
“ ওকে চুপ। এবার হা কর।”
চুপচাপ খেয়ে নিলো তৃধা। তৎক্ষনাৎ স্টেজ কাঁপিয়ে উঠে পড়লো সবাই। শিহাব গিটার বাজাতেই চারপাশে করতালির শব্দে ঝড় বয়ে যায়। মাইকে সামনে চিৎকার করে শিহাব সুরে সুরে বলল,
“ আইজ তৃধার গায়ে হলুদ
কাইল তৃধার বিয়া
পরশু তৃধা যাইতা গিয়া
ঢাক ঢোল বাজাইয়া…”
গান শুনে তৎক্ষনাৎ চারপাশ থেকে হাঁসির শব্দ শুরু হলো। হাঁসতে হাঁসতে গড়াগড়ি খেতেই শিহাবও ফিক করে হেঁসে উঠলো। পৃথা ওর পিঠে চাপ্পড় মে/রে বলল,“ ওসব লেইম মা/র্কা গান কে গাইতে বলেছে? ”
“ এটাই বেস্ট! গায়ে হলুদ! গায়ে হলুদ ফিল আসে।” বলেই অর্পণ উঠে দাঁড়ায়। তৃধা বসে থেকেই চেঁচিয়ে উঠে,
“ হিন্দি গান ধর..”
কিন্তু শিহাব নাছোড়বান্দা। ওই গানটাই গাইবে। রাগত্ব তৃধার চিৎকার চেঁচামেচিতে অবশেষে অর্পণ, সমুদ্র এবং শিহাব গেয়ে উঠে স্টেজ কাঁপিয়ে।
– “আজ কি রাত, হোনা হ্যায় ক্যা
পানা হ্যায় ক্যা, খোনা হ্যায় ক্যা
আজ কি রাত, হোনা হ্যায় ক্যা
পানা হ্যায় ক্যা, খোনা হ্যায় ক্যা
জারা দেখলো, ইশারা
ইশক করনে কা মৌকা হ্যায়..”
চৈতীর শরীরে হালকা জ্বরের আভাস। তাহিয়া না থাকলে সত্যি তার যে কি হতো! ভাবতেই গায়ের সমস্ত লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। ওইদিনের ট্রমা ও ঘন্টা ঘরে গোসল করার ফলে গায়ের তাপমাত্রা আজ একশো দুই! রাতের ঝিঁঝি পোকার ডাকে বারান্দায় চাদর জড়িয়ে বসে রইলো সে। মন নেই ভালো! কেমন বিষণ্ণ লাগছে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে ওর!
সামনের চাঁদের আলোয় চারপাশ ফকফকে পরিস্কার! চৈতী আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ আগে অর্পণ তাকে কল করেছিল! তৃধার বিয়ের কথা তুলতেই সে সাফ সাফ জানায়, ওসব অনুষ্ঠানে যাওয়ার মতো মানসিক শক্তি তার নেই।শারীরিক ভাবেও দূর্বল সে। মনের ভুলেও যেনো, ওসব কথা না তুলে।
আশ্চর্যজনক ভাবে হলেও সত্যি চুপচাপ অর্পণ কল রেখে দেয়। মেয়েটা কল্পনাও করেনি, ওই ত্যাড়া লোক এক কথাতেই মানবে। রাতের খাবার খেয়ে সে মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করে বিছানায় টিকতে পারেনি। বাধ্য হলে এই কনকনে ঠান্ডায় বারান্দায় বসলো। গায়ে এমনিতেই জ্বর! তার উপর ভয়ংকর ঠান্ডায় ঠকঠক করে কেঁপে ওঠে তার শুষ্ক ঠোঁট। গায়ের শাল জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো। সম্পূর্ণ রুক্ষ মুখশ্রী তে ছুঁয়ে যায় অসীম ধারায় বয়ে চলা শীতল হাওয়া।
তৎক্ষনাৎ তাহিয়া ডাকতে ডাকতে রুমে আসে। বারান্দায় চৈতীর গলা পেয়ে বলল,
“ হোস্টেলের দারোয়ান মামা তোমাকে ডাকছে!”
চৈতীর কপাল কুঁচকে যায়। সে ধীর পায়ে এগিয়ে জবাব দিলো,
“ কেনো?”
তাহিয়া তাকে ধরে বিছানার নিকট আনতেই আঁতকে উঠল। কপাল, গলা স্পর্শ করে হা হুতাশ সুরে বলল,
“ আল্লাহ! তোমার গা তো জমে যাচ্ছে। তার মধ্যে ভীষণ জ্বর! পা*গল মেয়ে! জ্বরের শরীর নিয়ে কেউ খোলা বারান্দায় যায়?”
চৈতী ইতিউতি করে বসলো বিছানায়। জানতে চাইলো,
“ দারোয়ান মামা কেনো ডেকেছে?”
“ চলো দেখি।”
বলেই নিজের সোয়েটার পড়িয়ে খোলা চুলগুলো খোঁপা করে দিলো। এরপর চাদর জড়িয়ে দিলেও দেখলো, চৈতী মাত্রাতিরিক্ত কাঁপছে। হাত-পা ভয়ংকর ঠান্ডা! মেয়েটার চোখ দুটি উল্টে বেরিয়ে আসতেই ভয় পেলো তাহিয়া,
“ সে কি! এমন করছো কেনো?”
“ শী— শীত লাগে। ”
তাহিয়া নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হাতে মালিশ করতে করতে কি মনে হতেই দৌঁড়ে গেলো আলনার নিকট। সেখানে ঝুলতে থাকা মোটা জ্যাকেট টা হাতে তুলে নেয়। মোটা, বড় সাইজের জ্যাকেট তৎক্ষনাৎ ছোট্ট মিনি চৈতীকে পড়িয়ে বলল,
“ এবার ঠান্ডার বাপও লাগবে না।”
“ উনার টা আমি কেনো পড়বো? নষ্ট হবে আপু। রেখে দিন। কাল দিয়ে দিতে হবে।”
বলেই জ্যাকেট ঢুকে পড়া চৈতী খুলার চেষ্টা করে । এত বড় জ্যাকেটে চৈতীর মতো দুইজন ঢুকতে পারবে! তাহিয়া গরম চোখে তাকিয়ে থামিয়ে দিলো ওকে। এরপর ধরে হুড়মুড়িয়ে নিচে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ চুপচাপ চল তো। ”
অসুস্থ, জ্বরে আক্রান্ত চৈতী গেইটের নিকট খুব কষ্টে গেলো। দারোয়ান মামা পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে বলল,
“ তুমি-ই চৈতী?”
চৈতী একপলক তাহিয়া কে দেখে জবাব দেয়,
“ জি মামা। কিছু বলবেন?”
“ হ। তোমার সাথে দেখা করতে আইছে।”
বলেই গেইট থেকে অল্প দূরে অন্ধকারে ছোট্ট অগ্নিশিখা জ্বলতে থাকা স্থান – টি দেখিয়ে দিলো। সেখান থেকে মৃদু আগু/নের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কখনও সেটা জ্বলে উঠছে, ফের হালকা হচ্ছে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে থেমে যায়৷ চৈতী কৌতুহল বশত গেইটের বাইরে উঁকি দিয়ে বলল,
“ কে? ”
নেই কোনো সারাশব্দ। শুধু নিশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। দারোয়ান মামা তাড়া দেয়,
“ দ্রুত যাও দেহি। সময় কম। কেউ দেখলে, আমি ফাঁই/সা যামু। পাঁচ মিনিটের ভেতর কথা শেষ করো।”
“ কিন্তু কে এসেছে মামা? মহিলা হোস্টেলে রাতে এসব তো এলাউ নয়। সব জেনে শুনে এসব করছেন? মেয়েদের বিপদ হলে দ্বায় ভার আপনি নিবেন?”
বলেই তাহিয়া টেনে ভেতরে আনলো চৈতীকে।বেচারী ফ্যাল ফ্যাল করে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য হোস্টেলে প্রবেশ করতেই দারোয়ান মামা বিরক্ত হলেন। চুপচাপ চেয়ারে বসে চেঁচিয়ে বললেন,
“ যাগো জন্য করি চোরি! হেতি কয় চোর! কাহিনী ডা একবারে তেমন হইছে!”
বলেই গেইটের বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ডাকলো,
“ ওই মামা! তোমার জন্য আমি কট খাইতে পারুম না। সামনে আহো!”
পেছনের ছায়া টা মৃদু আলোয় নড়েচড়ে উঠে। ছোট্ট আগু/নের ফুল্কি টা তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসছে। চৈতী পেছন ঘুরে তীক্ষ্ণ চোখে খেয়াল করলো ধীরে ধীরে সেই অবয়ব টি স্পষ্ট হয়ে অন্ধকার থেকে বের হচ্ছে। তৎক্ষনাৎ মেয়েটি বিস্ময়কর কণ্ঠে বলল,
“ অর্পণ! এত রাতে আপনি এখানে?”
তার চমকানো স্বরে কোনো ভাবান্তর হলো না সেই ব্যক্তির। হাতের জলন্ত সিগা/রেটে শেষ বারের মতো লম্বা ভাবে সুখের টান দিলো। এক ঝটকায় নিচে ফেলে পা পিষিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় স্তব্ধ হওয়া নারীটির দিকে। নাক মুখ নিয়ে গলগল করে ধুঁয়া ছেড়ে ভুরু নাঁচায়। এগিয়ে গায়ের পাঞ্জাবী টেনেটুনে ঠিকঠাক করলো। হাতা গুটাতে গুটাতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ২৩ (২)
“ আমার প্রিয় জ্যাকেট দখল করা বিশেষ সেই সুন্দরী নারীকে একপালক চাঁদনি রাতে চুপিচুপি দেখতে আসলাম! দেখতে আসলাম, সে কতটা ভাগ্যবতী! যার গায়ে এই প্রথমবারের মতো অর্পণ শেখ এর প্রিয় জিনিস জায়গা পেয়েছে! যাকে এক নজর দেখতে আবার এই নির্জন নিস্তব্ধ রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে মহিলা হোস্টেলের নিকট এসেছে। শেষমেষ দারোয়ান মামাকে হাত করেছে! এসব কি ছোটোখাটো কথা? অবিশ্বাস্য, বিস্ময়কর ঘটনা নয় কি? ”