খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৫
আনিকা আয়াত
“ খুব তৃষ্ণা পেয়েছে? কি যন্ত্রণার কথা! তবে, আমার পেট থেকে পানি বের করে নাও। এরপর ঢকঢক করে খেয়ে ফেলো। ”
চৈতী বিরক্তে চোখ-মুখ কুঁচকে বসে রইলো। ভ্রু জোড়ার ভাজ গভীর। কিছুদূর যাওয়ার পর অর্পণ লাফ দিয়ে নেমে যায়। ভাড়া মিটিয়ে পেছন ঘুরে হাঁটা দেওয়ার মাঝেই সে চমকে তাকালো। রিকশাওয়ালা মামাকে উচ্চস্বরে ডেকে থামাতে বলে, এগিয়ে গেলো। চৈতী কৌতুহলবশত পেছন ঘুরে তাকায়। অর্পণ তৎক্ষনাৎ দৌঁড়ে এসে চৈতীর পাশে দাঁড়াল। লম্বা শ্বাস ফেলে রিকশার চাকায় আটকে পড়া চৈতীর ওড়না ছাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটির কোলে রাখলো আলতো করে। মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
“ বিরক্তিকর নারী জাতি। সামান্য ওড়না সামলাতে পারো না। দুদিন পর যখন বিয়ে হবে স্বামী সামলাবে কিভাবে? চারদিন পর যখন গাদা গাদা বাচ্চা ডাউনলোড করবে তখন সেগুলো সামলাতে পারবে? যতসব! আরেকটু হলেই পটল তুলতে। তখন দোষ কার হতো? আলবাত আমার। সবাই অভিযোগ করতো, এক রিকশায় বসেও আমি কেনো তোমার খেয়াল রাখলাম না? এমনিতেই আমার উপর মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। তুমি দেখছি, আরোও দু ধাপ বাড়িয়ে দিতে চাও।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরিবারের সঙ্গে একসাথে বসে স্নিগ্ধা ব্রেকফাস্ট করছে। আজ মাত্র দুটি ক্লাস, তেমন তাড়াহুড়ো নেই। খাওয়ার মাঝে বাবার সাথে টুকটাক খুশগল্পে মেটে উঠেছে দুই বোন। মিষ্টি পরোটা ছিঁড়ে স্নিগ্ধার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“ আম্মুকে বলবো? ”
স্নিগ্ধা রাগান্বিত চোখে শাসায়,
“ পড়া বাদ দিয়ে, রাতে চুপিচুপি চিরকুট লেখা ঘুঁচিয়ে দিবো। ”
মুহুর্তেই চুপসে যায় মিষ্টি। ভয়ে দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে ফাটা বেলুনের মতো পানছেঁ মুখ করে বলল
“ বলিস না আপু। তোর আম্মু জানলে, আমার মতো অবলা, অসহায়, নিষ্পাপ বাচ্চাকে বাসা থেকে বের করে দিবে। ”
“ নাটকবাজ মহিলা ”
মিষ্টি ভেংচি কাটলো। কিছুসময় পর স্নিগ্ধা খাওয়া সেরে উঠে যাওয়ার সময় আয়েশা জামান পেছন ডাকে,
“ ভার্সিটি যাবি? রাস্তাঘাটে- ভার্সিটির ভেতর কোনো সমস্যা হয়না তো? সব ঠিকঠাক? যদি কোনো বখাটে কিছু বলে তৎক্ষনাৎ আমাকে কল করবি। ”
“ কোনো প্রবলেম নেই আম্মু। ”
“ আমি সাথে যাই? একা ছাড়তে আমি ভয় পাই স্নিগ্ধা। বিপদ কিন্তু বলে কয়ে আসে না।”
স্নিগ্ধা তার মাকে ভরসা দিলো সে একাই যেতে পারবে । কোনো প্রবলেম হচ্ছে না। তার বাবা মইনুল হোসেন হেঁসে ফেলে মা- মেয়ের কান্ডে। দ্রুত অফিসের জন্য রেডি হয়ে বলল,
“ তোমার মেয়ে এখনও ছোট নেই। তাছাড়া এ বাসার মালিক এম.পি। উনার ছেলেটাও স্নিগ্ধার ভার্সিটিতেই পড়ে। একসময় পরিচয় করিয়ে দিবো। বিপদের কথা আসলেই বলা যায়না। ছেলেটা পাশে থাকলে, চিন্তা নেই। শুনেছি যথেষ্ট সাহসী। এলাকা একাই কাঁপিয়ে বেড়ায়। যদি সমস্যায় পড়িস ছোট্ট করে কল দিবি। আমি এম.পি জামিল শেখকে ফোন করে জানাবো।”
স্নিগ্ধা বাবার কথায় ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। তার বুঝা শেষ, অর্পণ শেখ – এর কথাই মইনুল হোসেন বলছেন। যদি বাবা জানলো, ছেলেটা কত প্রকার অসভ্য, বেয়াদব তাহলে হয়তো নিজের মেয়েকে ওই ছেলের কথা বলতো না। পাশে থাকার কথা তো অনেক দূরের ব্যাপার। অথচ, বাবা কিনা তাকে আবার পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছে? মনে মনে ভেংচি কাটলো মেয়েটি। তার আম্মু যদি গুণাক্ষরে টের পায় অর্পণ শেখই ওই মালিকের ছেলে! তাহলে সর্বনাশ। স্নিগ্ধাকে ভার্সিটি যাওয়াই বন্ধ করবে। সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রেডি হয়ে। কিন্তু আয়েশা জামান খুশি হয়েছে স্বামীর কথায়। তিবি স্বামীর সামনে এগিয়ে গিয়ে হাঁসি মুখে বলল,
“ আগে বলে নি কেনো? নাম কি ছেলেটার? নিশ্চয়ই খুব শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে। আমার মেয়েটাকে দেখে শুনে রাখতে পারবে। তুমি বরং ছেলেটাকে একদিন ডাকো। আমি কথা বলে, স্নিগ্ধার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো। যাতে, মেয়েটার কোনো সমস্যা হলে, সে জানায়।
স্নিগ্ধা চোখ-মুখ কুঁচকে দরজার লক খুলে বলল,
“ আসছি আম্মু। ”
আয়েশা জামান হেঁসে বিদায় দিলো। মিষ্টি ঝটপট রেডি হয়ে বাবাকে বলল,
“ আমাকে ৪০০ টাকা দাও বাবা।”
“ তুই এতো টাকা দিয়ে কি করবি?” আয়েশা জামান রাগান্বিত গলায় বলল।
মিষ্টি হালকা ঢোক গিলে বাবার দিকে অসহায় চোখে তাকায়। মইনুল হোসেন হাঁসলো। মেয়ের কাঁধ জরিয়ে ধরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনবে। চলো মা আমরা এবার যাই।”
আয়েশা জামান বিরক্ত হলো। মিষ্টি বাবার সাথে রিকশায় উঠে ফিসফিস করে বলল,
“ বাবা। তুমি এতো গুড ফাদার কেনো? জানো আম্মু কিভাবে তাকিয়েছিলো? রাক্ষ\সীর মতো!”
ক্লাস শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। আজ অর্পণ আসেনি ভার্সিটি। তুষিবকে মে/রে ব্যথা দেওয়ায় ছেলেটা হসপিটালে। সেখানেই অর্পণ তাকে দেখতে গেছে। কালকে তো কম ঝামেলা হয়নি! আশিকের নাক-মুখ ফাটিয়ে বাইক আর তুষিবকে নিয়ে তবেই ফিরেছে সে। কোনো বাঁধা মানতে রাজি নয়।
অর্পণ ছাড়া বন্ধুমহলও কেমন জেনো নিস্তব্ধ! কোথাও হাঁসি নেই মজা নেই। চারপাশ শূন্য শূন্য! ছেলেটাকে ছাড়া যেনো জমেই না। প্রতিদিন মাঠে এসেই ভাবসাব নিয়ে বসে থাকে। অথচ আজ চারপাশ গুমোট ভাব। সমুদ্র, পৃথা সহ শিহাব ওরা ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও বিরক্ত মুখে ক্লাস করছে। বিরক্ত চোখে সমুদ্র হামিমের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো। কিন্তু সকলের বিরক্তের মাঝেও তৃধা একমাত্র মেয়ে। যে খুব গভীর মনোযোগে রিয়াদ স্যারের প্যারা নামক ক্লাস করছে। কারণ, এই স্যারের প্রতিই সে যে ভীষণ দূর্বল।
পৃথার পাশে বসেই মেয়েটি গালে হাত দিয়ে এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। চারপাশের দিনদুনিয়ায় তার খেয়াল নেই। সামনের সুদর্শন স্যারের দিকে দৃষ্টিপাত করা। ডান হাতের আঙুলের মাঝে কলম গুঁজে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে টপিক বুঝিয়ে চলছে কমবয়সী স্যার। এই লোকটির কথার স্টাইল! চোখ-মুখের ভাব ভঙ্গি স্টাইল দেখে যে কেউ পিছলে পড়বে। ফর্মাল পোশাকেও এতো সুদর্শন লাগতে পারে? এই একটি ক্লাসের জন্যই তৃধা সকাল সকাল উঠে ভার্সিটি আসে। লোকটির ভেতর একজন আদর্শ স্বামীর সকল গুণ-ই বিদ্যমান। তৃধা নিজের অজান্তেই রিয়াদ নামক স্যারকে অনেক আগেই মন দিয়ে দিয়েছে। সেই থেকেই একটু একটু করে ভালোবাসা। তার আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই পৃথা কনুই দিয়ে গুঁতা দিলো। ফিসফিস করে বলল,
“ কি ভাবছিস? স্যার কিন্তু খেয়াল করছে। তোকে ডাকছে তৃধা। ”
তৃধার কান পর্যন্ত এই কথা পৌঁছালে তো? সে অপলক নয়নে আছে সামনে। আপাতত সে স্যারকে নিয়ে কোনো বেহায়া কল্পনায় বিভোর! এদিকে রিয়াদ স্যারের নিস্তব্ধতায় পুরো ক্লাস নিস্তেজ হয়ে গেছে। তিনি বুকে দু হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটিকে দেখছে। কিছুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে থাকলেও এবার কাছে এসে বলল,
“ স্ট্যান্ড আপ!”
তৃধা গালে হাত রেখেই আনমনে বলল,
“ স্যার! আপনি এতো সুদর্শন কেনো? খাবার তালিকায় কি কি রাখেন? আমাকে কিছু টিপস দেওয়া যাবে? কথা দিচ্ছি খুব দ্রুত আপনার পাশের বালিশ দখল করেই নিবো।”
তার কথায় পুরো ক্লাস হেঁসে উঠে। সমুদ্র এবং হামিম হু হু করে হেঁসে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়লো। তৎক্ষনাৎ রিয়াদ স্যার গরম চোখে তাকিয়ে ওদের চুপ করিয়ে দেয়। পৃথা বলদ বান্ধবীর কান্ডে রেগে গেলো। এসব কি বলছে সে? বুদ্ধি কি লুপ পেয়েছে? স্যারের সামনে নির্লজ্জের মতো বেফাঁস কথাবার্তা বলছে! সে ভয়ে হালকা ঢোক গিলে মেয়েটির বাহুতে জোরে ধাক্কা দেয়। তৃধা এবার হকচকিয়ে উঠে। পাশ ফিরে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
“ ক্লাস শেষ? চকলেট স্যার চলে গেছে? ”
বলেই সামনে ঘুরে তার চক্ষু চারাগাছ। ভয়ে শিউরে ওঠে তৃধা। স্বয়ং রিয়াদ স্যার বিস্ফোরণ দৃষ্টিতে তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে যেনো। মনে হচ্ছে, ওই দুই আঁখি দিয়েই তৃধাকে ধ্বংস করবে। তৃধা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে হাঁসার চেষ্টা করলো।
“ সরি স্যার! আসলে.. আসলে..আমি!”
রিয়াদ স্যার দরজা দেখিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
“ এই মুহুর্তে বেরিয়ে যাও।”
তৃধা চো/রা চোখে একবার স্যারকে পরখ করে মনে মনে ভেংচি কাটলো। এক ঝটকায় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। রিয়াদ গায়ের শার্ট ঠিকঠাক করে কর্কশ গলায় বলল,
“ এভরিবডি! আর কেউ আছো? ক্লাস করতে না চাইলে বেরিয়ে যেতে পারো।”
স্যারের কথা বলতে দেরী কিন্তু সমুদ্র, হামিম, শিহাব, আবিদ এবং পৃথার বেরিয়ে যেতে দেরী নেই। যার যার ব্যাগ হাতে নিয়ে চোখের ইশারায় দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। হঠাৎ হুল্লোড়ে রিয়াদ স্যার হকচকিয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ আপনারাও যান। এখনও বসে আছেন কেনো?
ক্লান্ত বিকেল। চৈতী আধ খসে পড়া হোস্টেলের এক ছোট্ট রুমে টেবিলে বসে পড়ছে। তার রুমমেট তাহিরা অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। দুজনের সারাদিনে দেখা হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। চৈতী ক্লাস শেষে দুপুরে এসে নাস্তা করে একটু ঘুমায়। বিকেলে উঠে ফিজিক্স সল্ভ করে। তাহিরার আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়। মেয়েটা ছোটখাটো জব করে। রাতে দুজনেই পড়াশোনায় বিভোর। কথা বলবে কখন? চৈতীর পড়ার মাঝেই তাহিরা এলো। কাঁধের ভারী ব্যাগ ক্লান্ত হাতে টেবিলে রেখে গোসলে যায়। প্রতিদিন এই মেয়েটার পরিশ্রম দেখতে চৈতীর খারাপ লাগে। তাহিরাও তো বড় বোনের মতো। সে হতাশার শ্বাস ফেলে পড়ায় মনোযোগ দেয়। পরক্ষণেই তার ফোন বেজে উঠে। চৈতী উঁকি দিয়ে খেয়াল করলো, শ্রাবণের কল। রিসিভ করে বলল,
“ কি হয়েছে? ”
শ্রাবণ চাপা সুরে জবাব দেয়,
“ নিচে আয়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। আমি অপেক্ষা করছি!”
“ মানে? তুই মেয়েদের হোস্টেলের নিচে কি করিস? চলে যা।”
চৈতীর চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত হলো শ্রাবণ। জোর গলায় বলল,
“ তুই আসবি নাকি আমি ভেতরে যাবো?”
“ এ্যাই সাবধান। একদম ভেতরে ঢুকার সাহস করবি না।”
“ তাহলে নিচে আয়। অপেক্ষা করছি।”
চৈতী রেগে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে নিচে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ শ্রাবণের বাচ্চা। কেনো সবসময় বিরক্ত করিস।”
চৈতী গায়ের কাপড় কোনোমতে চেঞ্জ করেই বাইরে বেরুলো। কোমরের নিচ পর্যন্ত বাঁধা চুলগুলো ছেড়ে দেওয়ায় অবাধ্য হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। গেইট থেকে বেরিয়ে শ্রাবণের দিকে তাকাল। ছেলেটা দাঁত কপাটি বের করে, এদিকেই চেয়ে আছে। চৈতী তেড়ে গিয়ে বলল,
“ এই বিকেল বেলা কিসের গুরুত্ব আলোচনা? কালকে বলা যেত না। ”
শ্রাবণ গায়ের টি-শার্ট টেনেটুনে ঠিক করে, মাথার চুল পেছনে ঠেলে দেয়। ওষ্ঠ প্রসারিত করে চৈতীর নিকটে যায়। চৈতীর হাত খপ করে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“ এই পরিশ্রান্ত বিকেলে একটু প্রেমিকা নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু তুই তো জানিস! আমার ওসব প্রেমিকার ব্যাপার স্যাপার নেই। তাই তোকে নিয়েই বেরুচ্ছি। প্রেমিকা না থাকুক বান্ধুবী আছে এই বলেই সান্ত্বনা দিবো।”
চৈতী ভ্রু কিঞ্চিৎ করে শ্রাবণের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। হাঁটা থামিয়ে মেকি রাগ দেখালো,
“ একদম চালাকি করবি না শ্রাবণ। ইদানিং আমি লক্ষ্য করছি, তুই জেনো কিভাবে কথা বলিস। আমার লেইট হলে হাঁসফাঁস করিস! এসব কেনো করিস? জিনিয়ার ব্যাপারে তো দেখিনা। যদি ভেবে থাকিস আমাদের সম্পর্ক ফ্রেন্ডের থেকেও বেশী কিছু হবে তাহলে ভুল। ”
একরাশ কষ্ট চেপে ধরলো শ্রাবণকে। সে তো প্রথম দিন থেকেই এই মেয়ের মায়ার পড়ে গেছে। একটু একটু করে কাছে আসতে চাইছিল। কিন্তু চৈতী চায় না? মনে মনে বিষাদের ছায়া গ্রাস করলো। খেয়াল করে, চৈতী রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে। সে মলিন হাঁসলো। চৈতীর মাথায় টুকা দিয়ে বলল,
“ ধুর ছাগল। বেস্ট ফ্রেন্ডের থেকে বেশী কিছু মানে? এ কেমন কথা! এসব আমি বলেছি? এখানে আসার কারণ, নীলক্ষেত যেতে হবে একটু। কিন্তু কাকে নিয়ে যাব জিনিয়া, হিমু ব্যস্ত! তাই তোর কাছে এসেছি। আর এই বলদ চৈত্র যা তা ভাবছে। ”
চৈতীর মন বলছিলো, ছেলেটা তাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখে। ক্লাসে, আড্ডায় কেমন মুগ্ধ নয়নে তাকায়। অথচ, জিনিয়া আর হিমুর ক্ষেত্রে উল্টো। তাই চৈতী সন্দেহ করেছিল শ্রাবণের হৃদয়ের কল্পনা। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না? সে সন্দিহান চোখে বলল,
“ সত্যি তো? ”
শ্রাবণ মাথা ঝাঁকালো। চৈতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ রিকশা ডাক।”
কিছুক্ষণ বাদেই নীলক্ষেত আসার পর শ্রাবণ কিছু পুরোনো বই কিনলো। চৈতীর পছন্দের লেখক হুমায়ুন আহমেদ। সে লাইব্রেরির বইগুলো হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে। হাতে টাকা থাকলে, বেশ কয়েকটা উন্যাস কেনা যেতো। শ্রাবণ হঠাৎ তার সামনে ” মেমসাহেব ” বইটি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ এটা তোর।”
চৈতী বিস্ময়ে বইখানা হাতে নেয়। অবাকের সুরে বলল,
“ কিন্তু কেনো?”
“ বই পড়ুয়া মানুষকে বই উপহার দেওয়ার মাঝেও শান্তি আছে। এটা সম্পূর্ণ পড়ে রিভিউ দিস।”
চৈতী মৃদু হাঁসলো। বই গিফট পেয়ে তার হৃদয় প্রফুল্ল হয়। শ্রাবণের থেকে বই ব্যাতিত অন্য কিছু হলে, সে কখনোই নিতো না। চৈতী হাতের বইটা উল্টেপাল্টে দেখে আনমনেই হাঁসলো। শ্রাবণ একটু দূরে একটি বইয়ের পেইজ দেখছে। চৈতী শ্রাবণের নিকট দাঁড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,
“ সরি! মন খারাপ করেছিস। তাই না?”
“ ধুর পা*গল।”
আজ ক্যান্টিনে তুমুল বেগে হইহট্টগোল শুরু হয়েছে। শিহাব গিটার হাতে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গলা ছেড়ে গান গাইছে। সামনের টেবিলে কয়েক প্লেট সিঙ্গাড়া, সমুসা আর কফি! গানের মাঝে হামিম টেবিলে শব্দ তুলে বলল,
“ অর্পণ আসেনা কেনো?”
তৎক্ষনাৎ গান থামিয়ে দিলো সবাই। পৃথা হেঁসে বলল,
“ দাঁড়া কল করছি।”
পৃথার কলে অর্পণ জানালো সে গেইটের কাছে। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই হবে। সমুদ্র কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“ আমার জানকে দেখতে পাচ্ছি না। সে কি আজ ভার্সিটি আসে নি?”
শিহাব তৎক্ষনাৎ উচ্চস্বরে হেঁসে উঠে। তৃধা তেড়ে গিয়ে সমুদ্রের চুল টেনে বলল,
“ জান মানে? ওই মেয়েটা কে? সত্যি করে বল। ”
সমুদ্র খুশিতে গদগদ হয়ে স্নিগ্ধার কথা বলতে চাইলো। ওর দিকে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাকি বন্ধুগণ। কিন্তু সমুদ্রকে সম্পূর্ণ থামিয়ে সেখানে অর্পণ উপস্থিত হয়। কাঁধের খালি ব্যাগ ছুঁড়ে মে/রে বলল,
“ কিরে ছাগলের দল? আমাকে রেখেই ভ্যা ভ্যা করছিস?”
মুহুর্তেই সবাই খুশিতে দৌঁড়ে গেলো। অর্পণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল,
“ শা/লা। বাসায় কি বউ রেখে আসিস? এতো দেরী হয়।”
হঠাৎ আকস্মিক কান্ডে অর্পণ চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। এদের এই একটাই সমস্যা! কিছু হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে রেগে সবার হাত থেকে নিজেকে ছাড়ালো। টেবিল থেকে ব্যাগ কাঁধে চেপে বলল,
“ বউ থাকলে ভার্সিটি আসতাম? তোদের ছাগলামি সহ্য করতাম? সারাটি মুহুর্ত বউয়ের আঁচলে নিচে ঘাপটি মে/রে শুয়ে থাকতাম শা/লা। ”
কথা বলেই ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে মাঠের কাছে আসলো। তার পিছু পিছু আসছে ছাগলের দল।
চৈতী ক্লাসে যাওয়ার জন্য হনহনিয়ে যাচ্ছিল। তার হাঁটার মাঝে উচ্চস্বরে নাম ধরে তাকলো কেউ। তৎক্ষনাৎ চৈতী দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ঘুরে দেখলো স্নিগ্ধা নামের মেয়েটি। সে না চাইতেও দাঁড়াল। স্নিগ্ধা চৈতীর পাশে এসে বলল,
“ কখন এসেছ? হিমু কোথায়? কালকে আমার বই নিয়েছিল। ”
চৈতী কথা বলতে বলতে ক্লাসে চলে যায়। জিনিয়া অপেক্ষা করছিল তার জন্য। চৈতীকে দেখে দৌঁড়ে এসে বলল,
“ তোর জন্য টিউশন পেয়েছি দোস্ত। শ্রাবণ খুঁজে দিয়েছে। ”
ক্লাস শেষে চৈতী জিনিয়াকে বিদায় দিয়ে হোস্টেলের পথে হাঁটছিলো। হঠাৎ সেখানে অর্পণের বাইক দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। ছেলেটি তুষিবের সাথে কি নিয়ে যেনো আলোচনায় বিভোর। আশেপাশে তাকানোর সময় নেই। কয়েক সেকেন্ড পর চৈতী নিজেকে সামলে মাথা নত রেখে আবারোও হাঁটা দিলো। অর্পণকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ ছেলেটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“ এই চুমকি শুনো।”
তৎক্ষনাৎ চৈতীর পা থমকে যায়। সে বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে স্থির হয়ে রইলো। যেনো এক পাও নড়াতে পারছে না। সে মিনমিন করে বলল,
“ চৈতী আমার নাম।”
“ ওই হলো একটা। ”
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৪
অর্পণ ঘোলা চোখে বাইক থেকে নামলো। ধীর পায়ে এগিয়ে চৈতীর দিকে ঝুঁকে গলা খাঁকড়ি দিলো। চৈতীর হৃৎস্পন্দনের মাত্রাও বেঘাতিক। অনবরত লাফাচ্ছে। মেয়েটি ভয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলে। অর্পণ শেখ কেনো এখানে দাঁড়িয়ে আছে? তার সাথে কিসের কথা? অর্পণ ফিসফিস করে বলল,
“ অনুতপ্ত হচ্ছি। ”
চৈতী হতভম্ব হয়ে তাকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে বিস্মিত নয়নে জানতে চাইলো,
“ কিসের জন্য?”
অর্পণ সোজাসাপটা উত্তর দিলো,
“ কালকে অনুমতি ব্যাতিত তোমাকে স্পর্শ করার জন্য। তাও দুই-দুই বার। বাহুতে ব্যথা পেয়েছ? ”