খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৯
আনিকা আয়াত
“ চুমকি কে বাধ্য মেয়ের মতো ভার্সিটিতে দেখতে চাই!”
বলেই অর্পণ ভ্রু উপর নিচ করলো। স্নিগ্ধার এমনিতেই রাগ আকাশ ছুঁয়েছে। এবার ছেলেটার মুখে চৈতীর নাম শুনে কপালে তিন ভাঁজ ফুটে উঠলো। জ্বলন্ত চোখে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
“ অসভ্য! চৈতী কেনো আপনার কথা শুনবে? একদম আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না। ”
“ তাহলে কি ঠোঁট গলাবো?” বলেই অর্পণ চোখ টিপ মারলো। মিষ্টি খিলখিল করে হেঁসে বোনের হাত চেপে ধরে। তুষিব আর রনি খুব কষ্টে আঁটকে রেখেছে তাদের হাঁসি। স্নিগ্ধা রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তেড়ে গিয়ে শাসিয়ে কিছু বলতে উদ্ধৃত হতেই পেছন থেকে একটি নমনীয় কণ্ঠ ভেসে আসে,
“ সিঁড়ির মাঝখানে তোমরা জটলা পাকিয়ে কি করছ? এত বড় বাসায় আর জায়গা পাওনি?”
স্নিগ্ধা তেজি রূপ থেমে পানির মতো ঠান্ডা হয়ে গেলো। পেছন ঘুরে নজর গেলো, তৃষ্ণা এবং অর্ণবের দিকে। অর্পণ হনহনিয়ে তার ভাইয়ের গা ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল,
“ তুই নাকি এই অভদ্র মেয়ের সাথে ইটিসপিটিস করছিস? দেখ ভাই! আমি কিন্তু মোটেও তোদের এই ইটিসপিটিসের রাজি নই। দুনিয়ায় এত এত ভদ্র, সুন্দর মেয়ে থাকতে তুই কেনো একেই পছন্দ করলি? এই অসভ্য মেয়েকে কস্মিনকালেও ভাবী মানতে পারবো না। চরম অসভ্য মেয়েটা। সাবধান করছি, ওকে ছেড়ে দে। নয়তো সমস্যা হবে। ”
তাদের কথা কেউ শুনতে না পারলেও স্নিগ্ধা চট করে অনুমান করলো, তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। সে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। অর্ণব নড়েচড়ে গলা খাঁকড়ি দিয়ে, এক পলক চোরা চোখে স্নিগ্ধার মুখশ্রী দেখে নেয়। এরপর অর্পণের থেকেও নিচু কণ্ঠে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। ওর সাথে আমার ওসবের মতো ব্যাপার নেই। ”
“ দেখ অর্ণবের বাচ্চা। একদম প্যাচিয়ে কথা বলবি না। আমার ধারণা কখন-ও মিথ্যে হয়না। তুই প্রতিদিন ছাঁদে কেনো যাস? ওই পেঁচি মুখীকে দেখতে মন উতলা হয় তাই না? আগে তো দেখিনি ভরসন্ধ্যায় নিয়ম করে ছাঁদে যেতে!”
বলেই অর্ণবের মাথায় গাট্টি মারলো। তার সাথে কথার জালে ফেঁসে যাচ্ছে বুঝতে পেরে অর্ণব সোজা হয়ে দাঁড়ায়। গায়ের শার্ট ঠিকঠাক করে তেজি কণ্ঠে বলল,
“ এক মুহুর্তে বেরিয়ে যা বাসা থেকে। সময় নষ্ট করলে, জেলে পুড়ে দিবো। ”
“ বা/ল করবি আমার!” বলেই অর্পণ ডানহাতের বুড়োআঙুল দেখিয়ে মুখ মুচড়ে হনহনিয়ে চলে গেলো নিচে। তার পেছন পেছন হাঁসতে হাঁসতে নামলো তুষিব এবং রনি।
স্নিগ্ধাকেও তৃষ্ণা একটু আগেই জোর করে টেনেটুনে বাসার ভেতর নিয়ে গেছে। তাই মেয়েটি তাদের কথা শুনতে পায়নি। যদি শুনতে পেতো, তাহলে হয়তো কপালে দুঃখ ছিলো দুইভাইয়ের। অর্ণব দীর্ঘশ্বাস থেকে বাসায় ঢুকে পায়েল শেখের সাথে কথা বললো। কিছুক্ষণ পর রুমে প্রবেশ করে দেখলো, তিনজনের চঞ্চলতার কত কথা। কত গল্প। একে অপরের সাথে হাঁসতে হাঁসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। মুখ থেকে হাঁসি সরছেই না। কিসের এতো হাঁসি তাদের? হঠাৎ অর্ণবের চোখ আটকালো, স্নিগ্ধার মুখে। মেয়েটার মন খোলা স্নিগ্ধ হাঁসি দেখে মৃদু হাঁসলো অর্ণব। দরজায় ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে পায়ের উপর পা তুলে, বুকে আড়াআড়ি ভাবে হাত গুঁজে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে।
ভোরের আলো ফুটার সঙ্গে সঙ্গে পায়েল শেখ বিছানা ছাড়ে। জামিল শেখ-এর জন্য ঝটপট সকালের নাস্তা বানিয়ে তৃষ্ণাকে ডেকে তুলে কলেজে যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়। মেয়েটার সকাল সাড়ে ৭ টায় প্রাইভেট। পরীক্ষার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। তৃষ্ণা কাঁচা ঘুম ভেঙে চোখ-মুখ কুঁচকে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে বসলো। ততক্ষণে অর্ণবও উঠে পড়েছে। আর্মিতে জব করায় তার জীবনটা এক সঠিক নিয়মাবলীর মাঝে পেরিয়ে যাচ্ছে। পায়েল শেখ সবাইকে নাস্তা রেডি করে দিয়ে নিজেও বসলো। অর্পণের রুমের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
“ অর্পণ উঠে নি? রাতে বাসায় ফিরেছে কয়টায়?”
অর্ণব হাতের পরোটা ছিঁড়ে হালকা সবজি নিয়ে মুখে পুঁড়লো। খেতে খেতে বলল,
“ রাত ১২ টার পরেই..”
“ গেইট খুলে দিয়েছে কে? ” তেজি কণ্ঠে গর্জে উঠে জামিল শেখ -এর দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালো। গলায় একরাশ তেজ মিশিয়ে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ তুমি খুলে দিয়েছ? আর কতবার বলবো ছেলেকে একটু মানুষ বানাও। প্রশ্রয় পেতে পেতে মাথায় উঠছে। আসলে দোষ তো আমার ছেলের নয়, তুমিই আসল ক্রিমিনাল! ”
“ আম্মু এসব কথা পরে বলা যাবে। চুপচাপ শান্ত হয়ে খেতে বসো।” নাস্তা করে অতন্ত্য নম্র স্বরে বলল অর্ণব। পায়েল শেখ তেতে উঠে। অর্পণের দরজার পানে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,
“ নবাব জাদা উঠবি না তুই? ঝাড়ু নিয়ে আসবো? কাজের লোক পেয়েছিস সবাই। সারাক্ষণ খাটিয়েও মারিস, এখন টেনশনে ফেলেও মারছিস। নিত্যদিন ঝুট-ঝামেলা পাকিয়ে আসিস। এত রাতে বাইরে কি কাজ থাকে তোর? এই তোর বাপ যতদিন মুখে কুলুপ এঁটে রাখবে আমি তোকে মানুষ বানাতে পারবো না৷ বাঁদর হয়েছিস। সুন্দরবনের বাঁদর। বাঁদর বাপের বাঁদর ছেলে। ”
জামিল শেখ বউয়ের কথা আর হজম করতে না পেরে, খাওয়ার মাঝে কেশে উঠলো। গলায় পরোটা আঁটকে যাওয়ায় ঘনঘন শ্বাস ফেললো। পায়েল শেখ বিরক্ত হয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। জামিল শেখ সম্পূর্ণ পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
“ খাওয়ার সময় তোমার মুখ বন্ধ থাকে না? আমাকে হাইপার করে তুল কেনো? আরেকটু হলেই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ”
পায়েল শেখ জেনো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তিনি উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠতেই অর্ণব থামিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ঘুমকাতুরে মুখে হাজির হয় অর্পণ। এলোমেলো পা ফেলে ডাইনিং টেবিলের সামনে বুকে আড়াআড়ি ভাবে হাত গুঁজে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ দুটি ফুলেফেঁপে উঠেছে। মাথার কাঁকের বাসার মতো চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারামুখে। পায়েল শেখ টেবিলে বামহাতে ঠাস করে শব্দ করে উঠে দাঁড়াল। অর্পণের চুলগুলো জোরে টেনে তিরিক্ষি মেজাজে বলল,
“ গুন্ডা -মাস্তান হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস? এসব বাউলের বাসা নিয়ে আমার সামনে আসবি না। এই মুহুর্তে অর্ণবের মতো চুলগুলো কেটে বাসায় ঢুকবি। নয়তো আজ থেকে তোর এই বাসা চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ। কাঁকের বাসা, হাতের ফিতে এসব নিয়ে আমার পরিপাটি বাসায় তোর জায়গা নেই। ভদ্র লোকের বাসায় ভদ্র ছেলে হয়ে থাকতে হবে। ”
অর্ণব হাত মুছে মায়ের পাশে দাঁড়াল। অর্পনকে ছাড়িয়ে পায়েল শেখকে ধরে শান্ত হয়ে বলল। কিন্তু অর্পণের মাথা এমনিতেই গরম ছিল। তার শখের চুলে হাত বাড়িয়েছে! আবার কি বললো? কেটে ফেলতে। কখনোই সম্ভব নয়। তার চুলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলো? কাঁকের বাসা বলে অপমান? এই চুলগুলোর পেছনে কত শ্রম, কত টাকা খরচ হয় তার ধারণা আছে? মুহূর্তেই ছেলেটা রেগে গরম চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“ চুল নিয়ে একটা কথাও সহ্য করবো। বাড়ি ছাড়া হবো, তবুও চুল ছাড়তে পারবো না। ওকে ফাইন আমি এই মুহুর্তে বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কিন্তু… ”
বলেই একটু থামলো অর্পণ। বাঁকা হেঁসে মায়ের নিকট একদম ঝুঁকে গা ঝাড়া দিয়ে দুষ্টুমির ছলে বলল,
“ কিন্তু..! আমি গভীর রাতেই ফিরে আসবো। আমার বাসায়! আমার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে! বাই আম্মু। ”
সেকেন্ডের ব্যবধানেই একপ্রকার দৌঁড়ে বাসা ত্যাগ করলো। অর্ণব হতাশার শ্বাস ফেলে কপাল চাপড়াচ্ছে। তবে, পায়েল শেখের মাথায় ধপধপ করে আগুন জ্বলে উঠে। সে অর্পণের পিছু পিছু তেড়ে গিয়ে বলল,
“ শয়-তানের বাচ্চা। বাসায় আয় একবার। হাড়-গোড় ভেঙে হসপিটালে পাঠিয়ে দিবো। ”
তৃষ্ণা খিলখিল করে হেঁসে উঠল। জামিল শেখও ছেলের কান্ডে মৃদু হেঁসে রুমে চলে যায়। কিন্তু অর্ণব যেতে পারলো না। পায়েল শেখের নিকট দাঁড়িয়ে স্বান্তনা দিলো। একদিন ঠিক অর্পণের বুদ্ধি হবে। এসবেও যখন পায়েল শেখ শান্ত হলেন না তখন কি মনে করে অর্ণব তাকে নিচে নিয়ে গেলো। কলিং বেল বাজায়, আয়েশা জামান স্নিগ্ধাকে উচ্চস্বরে ডাকলো। এই সকাল সকাল আবার কে আসলো? স্নিগ্ধা তখন ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। সে এলোমেলো চুল, গায়ের টি-শার্ট পড়া অবস্থায় বিছানার পাশ থেকে একটি পাতলা উড়না নিয়েই দৌঁড়ে দরজা খুলল। তৎক্ষনাৎ সামনে পড়ল, সুদর্শন যুবককে৷ স্নিগ্ধা একটু নড়েচড়ে মুখের সামনের চুলগুলো কানে গুঁজে বলল,
“ আন্টি ভেতরে আসুন। ”
পায়েল শেখ মুখ ফুলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। কিন্তু অর্ণব? দরজা খুলার পর থেকেই এই সামনের ভয়ানক নারীকে সদ্য ঘুম থেকে উঠা রূপে দেখে, তার হৃদয় থমকে গেছে। আগের ন্যায় ঠাই দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধার দিকে। মেয়েটার ঘুমন্ত কণ্ঠ, মুখশ্রী, এলেমেলো চুলে এই প্রথম দেখায় তার গলা শুঁকিয়ে আসলো। হতভম্ব! হতবিহ্বল চোখে আগাগোড়া পরখ করে হঠাৎ চোখ পড়ল, মেয়েটির উদাম গলায়। দম যেনো বন্ধ হয়ে এলো তার।
“ খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে কেনো? ভেতর আসুন। কি আশ্চর্য! কখন থেকে ডাকছি। কেনো জবাবই নেই! কানা নাকি আপনি? ”
স্নিগ্ধার কণ্ঠে হুঁশ ফিরলো অর্ণবের। তৎক্ষনাৎ সে নিজের কল্পনা মনে করে লজ্জা পেলো। ছি! এতক্ষণ বুঝি এভাবেই বেহায়ার মতো তাকিয়ে দেখছিল? ছেলেটা মাথা নত করে এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। একটু নড়েচড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“ আজ নয়। অন্যদিন ভেতরে যাবো। আসি!”
বলেই অর্ণব একপ্রকার পালিয়ে চলে গেলো নিজের ফ্ল্যাটে। স্নিগ্ধা সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। সুদর্শন ছেলেটাকে দেখে লজ্জা লজ্জা মুখে কিঞ্চিৎ হাঁসলো। সুঠাম, শক্তপোক্ত দেহটা লুকিয়ে ছিলো টি-শার্ট এবং টাওজারে। ছেলেটার মুখটাও কেমন লাল হয়ে উঠেছিল। ভেবেই হেঁসে ফেললো স্নিগ্ধা। ছেলেটা এত ভদ্র কেনো? অর্পণের মতো অভদ্র হলেই পারতো। আয়েশা জামানের ডাকে তৎক্ষনাৎ স্নিগ্ধা দরজা আটকে দিলো। পায়েল শেখের সাথে অল্প কথা বলার সময় আয়েশা জামান বলল,
“ অর্ণব এসেছিল?”
“ হ্যাঁ!”
“ ছেলেটা ভীষণ ভালো। ”
“ ভাবী! কি বলবো দুঃখের কথা। অর্পণ কেনো যে উশৃংখল, বেয়াদব হলো। ছোটবেলা থেকেই অবাধ্য, একরোখা, জেদি ছেলে ছিলো। ভেবেছিলাম বড় হয়ে ভালো হবে। কিন্তু আমার ভাবনা মাটিতে কব/র দিয়ে ও আরোও অবাধ্য হয়ে উঠল। ”
পায়েল শেখ আফসোসের শ্বাস ফেলে আটকে রাখা কান্না গিলে ফেললো। স্নিগ্ধা মুখ মুচড়ে ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে,
“ লাফাঙ্গা অর্পণ। আল্লাহ ভালো জানেন, ওই শয়তান কার মতো হয়েছে। ওর পরিবারের কেউ তো অসভ্য নয়। ভদ্র পরিবারে অভদ্র হলো কিভাবে? যতসব। আন্টি কিভাবে সহ্য করে লাফাঙ্গাকে। ”
আয়েশা জামান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পায়েল শেখ কে ভরসা দিয়ে বলল,
“ চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। স্নিগ্ধা নাস্তা করে ভার্সিটি যা। মিষ্টিকে ডেকে তুল। ”
স্নিগ্ধা মায়ের আদেশে হেলেদুলে হেঁটে রুমে চলে যায়। আয়েশা জামান গল্প জমিয়ে ফেলে পায়েল শেখের সাথে।
কিছুদিন আগে যখন অর্পণ দের বাসায় দাওয়াত ছিলো, ওইদিন রাতে অর্ণবকে দেখে তিনি চমকে উঠেন। স্নিগ্ধার দিকে তরিত্বগতিতে তাকায়। মেয়েটির মুখে নেই কোনো অবাকের লেশ! বরং নির্বিকার ভাবে মিষ্টিকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালো তৃষ্ণার সাথে। আয়েশা জামানের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে অনেক প্রশ্ন! এই বখাটে, অভদ্র ছেলেটা এখানে কি করছে? তাও পায়েল শেখকে হাতে হাতে রান্নার কাজে সাহায্য করছে। আয়েশা জামানের মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি হয়। তিনি আশপাশে নজর বুলিয়ে পাথরের মতো বসে রইলো।
তার দুই মেয়েকে নিয়ে যার ভয়ে অন্য বাসায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই ছেলেই এখন তার সামনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিভাবে সম্ভব? তবে কি ছেলেটা এ বাসার কেউ? কিন্তু ওইদিন কার বেশ বুসা একদম উল্টো! সেই চুল, অভদ্রতা কিছুই লক্ষ্য করা গেলো না। পায়েল শেখ-এর সাথেও কেমন ফ্রেন্ডলি হেঁসে হেঁসে কাজ করছে। বিনয়ী, নম্র, ভদ্র আচরণ যার সন্তপর্ণে! আয়েশা জামান দ্বিধায় পড়ে যায়। তৎক্ষনাৎ অর্ণব এক গাল হেঁসে জিজ্ঞেস করে,
“ আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আমি এ বাসার বড় ছেলে।”
আয়েশা জামানের আশ্চর্যের মাঝে এই কথাটুকু যেনো ছিলো আরেক দফা চমকানোর জন্য যথেষ্ট। তিনি তীক্ষ্ণ চোখে অর্ণবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে সন্দিহান চোখে বলল,
“ রাস্তায় গুন্ডামী করে বেড়াও তুমি কি সেই ছেলে?”
অর্ণব প্রতিত্তোরে মিষ্টি করে হাঁসলো। পায়েল শেখকে গিয়ে বলতেই তিনি মুখে বিতৃষ্ণা, অসন্তুষ্ট করে জানালো অর্পণের জমজ অর্ণব। স্নিগ্ধাও মাকে বুঝিয়ে বলেন। তিনি এসব শুনে যেনো, হতভম্ব হয়ে যায়। অবাকের চরম মাত্রায় পৌঁছে থমথমে মুখে বসে থাকে। খাওয়া দাওয়া শেষে অর্পণ যখন বাসায় ফিরল আয়েশা জামান চমকে উঠে।মনে পড়ে, এই তো সেই ছেলে। অর্পণ বাঁকা হেঁসে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে রুমে চলে যায়। মেয়েটা কটমট করে তাকায় মায়ের নজর লুকিয়ে। সেই থেকে আয়েশা জামান অনেক ঘটনা শুনেছে পায়েল শেখ -এর কাছে।
ভার্সিটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের তুমুল ব্যস্ততায় সময় যাচ্ছে। প্রিন্সিপালের নির্দেশ অনুযায়ী ফাস্ট ইয়ার দের আর মাত্র চারদিন পর নবীন বরণ অনুষ্ঠান। প্রতিটি ব্যাচ-ই আশায় থাকে, এই দিনটির জন্য। নতুন জায়গা, নতুন ভার্সিটিকে তারা যেমন বরণ করে নিয়েছে। স্যার রাও তাদের ফুলের শুভেচ্ছা জানিয়ে বরণ করে নিবে। অনুষ্ঠান ঘনিয়ে আসায় ক্লাসে কেউ মন দিতে পারছে না। সবার মনে অস্থির, উত্তেজনা কাজ করছে। মেয়েরা গ্রুপ ভাগ করে আলোচনা করছে, কিভাবে সেজে আসা যায়। ছেলেরা প্ল্যান করছে, নাচ-গানের। এই মুহুর্তে কারো মনেই পড়াশোনার ইচ্ছে নেই। অবাধ্য মনটা ছটফট করছে, অনুষ্ঠানের জন্য। চৈতী, জিনিয়া এবং শ্রাবণ ক্লাসে হইচই বাধিয়ে দিয়েছে কিভাবে ওই দিনটা উপভোগ করা যায়। ভার্সিটির প্রথম অনুষ্ঠানের কথা ভেবেই উত্তেজনায় চৈতীর পড়াও মন বসছে না। স্নিগ্ধাকে নিয়ে প্ল্যান শুরু করবে চুটিয়ে। জিনিয়া ওদের মাথায় একটি কুবুদ্ধি ঢুকিয়ে দিয়েছে। তা বুঝতে পেরে চৈতী এবং স্নিগ্ধাকে পায় কে? শ্রাবণ তো খুশিতে বাহবা দিচ্ছে জিনিয়াকে। একই শাড়ি পরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া অসাধারণ এক দৃশ্য। সবাই হা করে তাকিয়ে শুধু ওদের-ই দেখবে।
অর্পণকে প্রিন্সিপাল দ্বায়িত্ব দিয়েছে সব কিছু ভালোভাবে ব্যবস্থা করার জন্য। কোথায় প্যান্ডেল সাজানো হবে সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছে। এই নিয়েই ছেলেটা ভীষণ ব্যস্ত! শিহাব, হামিম কিছু ছেলেদের নিয়ে গানের প্রাকটিস করছে। তৃধা, পৃথা প্রতি বছর ধামাকা কিছু করে। দুজনেই নাচে পটু। সে বিষয়েই ক্লাসে বসে আলোচনা করছিল সবাই। অর্পণ বুদ্ধি দিচ্ছিল কিভাবে কোমর দুলিয়ে মেয়েদের মতো নাচা যায়। সমুদ্র তা শুনে রেগেমেগে বোম। অর্পণ নিজের চেয়ারে বসে অল্প কোমর নাচিয়েও দেখালো। সবাই তৎক্ষনাৎ উচ্চস্বরে ক্লাস কাঁপিয়ে হেঁসে উঠে। তৃধা সমুদ্রের গায়ের উপর পড়ে জোরে জোরে হাঁসছে। তাদের আড্ডার মাঝেই ক্লাসে গম্ভীর, রাগী এবং কঠোর রিয়াদ স্যার প্রবেশ করে। মুহুর্তেই পুরো ক্লাস চুপ হয়ে যায়। তৃধাও হাঁসিও যেনো ফোঁস করে পালিয়ে গেছে। সে আড়চোখে সামনের স্যারকে দেখে মাথা নত করে রাখল। সবাই ভদ্রতার ন্যায় নিরবতা পালন করলেও অর্পণ চেয়ারে ঠাস মেরে বসে রইলো।
রিয়াদ স্যার চুপচাপ টপিক নিয়ে আলোচনা শুরু করে। তৃধা কেনো জানি আগের মতো বেহায়াপনা করতে পারেনা। ওইদিনের পর থেকে সে লক্ষ্য করেছে, রিয়াদ স্যার সুযোগ পেলেই তাকে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখে। এমন কঠিন প্রশ্ন ধরে, তৃধার দাঁত খুলে যায়। বেচারী বুঝতে পারেনা কেনো স্যার এমন করে? ইচ্ছে করে নাকি তার উপর বিরক্ত হয়ে? একবার অবশ্য পৃথা এবং শিহাব জানিয়েছে, রিয়াদ স্যারও পড়ার সময় তোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যময় হাঁসে। তাদের ধারণা স্যারও তৃধার প্রেমে পিছলে গেছে। এখন শুধু দুজনে পিছলে পিছলে বিয়ে করতে পারলেই হলো।
তৃধা ওদের কথা শুনে নিজেও কনফিউজড। সারাক্ষণ স্যারের ভাবভঙ্গি বুঝার চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ক্লাসেই যা পড়ার ফাঁকে কথা হয়। এছাড়া এই বদমাশ স্যারকে দেখাও যায়না। তৃধাও চান্স পায়না কথা বলার। যদি স্যার তাকে অন্য নজরেই দেখে, তাহলে বলে না কেনো? তৃধা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। মলিন মুখে সামনে তাকিয়ে রিয়াদ স্যারের পড়ার স্টাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। এতো সুন্দর করেও কেউ পড়াতে জানে? মনে মনে তৃধার কষ্ট হলো। স্যার কেনো তাকে পাত্তা দেয়না? মুখ ফুলিয়ে এক ধ্যাণে স্যারকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে। ওসব টপিক যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ রিয়াদ স্যার থেমে যায়। ভ্রু কিঞ্চিৎ করে এগিয়ে এলো। তৃধার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সরু চোখে বলে উঠে,
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৮
“ এ্যাই মেয়ে দাঁড়াও।”
হকচকিয়ে উঠে তৃধা। চটপট জানতে চায়, “ কেনো? কি হয়েছে স্যার? কি করেছি? বিশ্বাস করুন আমি আপনার দিকে অসভ্য নজরে তাকাই নি! উল্টাপাল্টা কল্পনাও করিনি। শুধু আপনার ওই ঠোঁট জোড়ার দিকে অজান্তেই চোখ যাচ্ছিল। ক্ষমা করবেন, তবে আমার মস্তিষ্ক এবং দৃষ্টি খারাপ করতে না চাইলে, কাল থেকে আপনি মাস্ক পড়ে ক্লাসে আসবেন। ”