চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৮
ইশরাত জাহান জেরিন
“সামনের শুক্রবারই তাহলে বিয়ের দিন ঠিক করি?”
ফারাজ অভ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, “আগেই বলে রাখছি, বিয়ের পরও কিন্তু বউ নিয়ে আমার চোখের সামনেই থাকবে। ফারাজ যেখানে, অভ্র সেখানেই।”
অভ্র মৃদু হেসে উত্তর দিল, “আপনাকে ছাড়া কোথাও যাওয়ার কথা শুধু মুখে আনা নয়, চিন্তাতেও আসে না।”
হঠাৎ আয়েশা মাঝখান থেকে বলে উঠল, “আমার থেকেও মনে হয় ফারাজ আব্বাকেই বেশি ভালোবাসেন!”
অভ্র আয়েশার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল, “তাই মনে হলো?”
“হুম,” আয়েশা নিচু গলায় বলল।
“তাহলে হয়তো তাই। ফারাজ ভাই আর আমার সম্পর্কটা গাছ-শেকড়ের মতো। শেকড় উপড়ে ফেললে যেমন গাছ বাঁচে না, তেমনই ফারাজ ভাই ছাড়া আমি মৃত।”
আয়েশা জানে না কেন এমন কথাতেও তার মনে এক বিন্দু খারাপ লাগছে না। বরং যেন একটা শান্তির ঢেউ বইছে ভেতরে। তার মনের গভীরে একটা কণ্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে, “এই মানুষটাকে যদি একবার ভালোবাসা যায় তাহলে হয়তো সে প্রাণও দিয়ে দেবে। এই মানুষটাকে না ভালোবেসে থাকা সত্যিই অসম্ভব।”
নিশুতি রাত। বৃষ্টির স্নিগ্ধতায় জেগে থাকা আরাম ছড়িয়ে আছে চারপাশে। গরমে ক্লান্ত শহর মৃদু শীতল বাতাসে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। সেই নিঃশ্বাসের মাঝে আয়েশার চোখে ঘুম নেই। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো ভাবনা। এই বিয়ে কি সত্যিই হবে? সে কি প্রস্তুত এমন এক জীবনের জন্য যেখানে কেউ নিঃস্বার্থভাবে তাকে ভালোবাসবে? আয়েশার জীবনে ভালোবাসা অপ্রাপ্তির মতো। অথচ আজ অভ্রর চোখে সেই ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। বিশ্বাস হচ্ছে না কিছু।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সেই রাতে আয়েশার আর ঘুম আসে নি। বিয়ে হবে তার? সে কি কখনও এও ভেবেছিল? তার মতো মেয়েকেউ কেউ কি ভালোবাসবে? আয়েশা বার বার এপাশ-ওপাশ হয়। তার দাদি পাশেই ঘুমাচ্ছে। বাহিরে তখন বৃষ্টি নেমেছে। সারাদিনের অসহ্য গরম এখন উদাও। শান্তি লাগছে। রাত তখন শেষের দিকে। হুট করে দরজায় করাঘাত পেতেই আয়েশা উঠে দাঁড়ায়। তার ভয় করছে না। আয়েশা চুপচুপি উঠে দরজা খুলে দেয়। ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। আয়েশার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় সে। আয়েশা চারপাশে তাকিয়ে দুয়ার এঁটে দেয়। প্যাকেটে হাত বুলায়। ভেতরে অনেক কিছুই আছে। তবে খামে মোড়ানো সেই চিঠির ভাজ সে আগে খুলে। অন্ধকার ঘরের মধ্যে চিঠি পড়া যাবে না। সে প্যাকেটের সবকিছু ভরে লুকিয়ে ফেলে। দাদির দিকে একবার তাকায়। তা ঘুমিয়েই আছে। আয়েশা মুচকি হাসে। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে হাত কপালের ওপর রেখে গায়ে চাদর টেনে চোখ বন্ধ করে। আপাতত একটু ঘুমাতে হবে। সামনে আবার বিয়ে। কত কাজ!
দেখতে দেখতে সপ্তাহ খানিক কেটে গিয়েছে। কাল শুত্রুবার। অভ্র-আয়েশার বিয়ে। কোনো আয়োজন ছাড়া। কোনো গান-বাজনা ছাড়া। এটাই আয়েশার স্বপ্নের বিয়ে। মুরব্বিদের কাছে শুনেছে বিয়েতে যত খরচ কম ততই বরকত বেশি। আয়েশার দাদি কিছুদিন ধরে স্বাভাবিক আছেন। একমাত্র নানতির যে এত ভালো ছেলের সঙ্গে কথা হবে জানা ছিল না। তবে বিয়ে নিয়ে চিত্রা-ফারাজেরই যা আগ্রহ। বাকিদের কিছু যায় আসে না। এক সপ্তাহ কেটে গেল নিরুটাকে এত খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না। অভ্রটা আবদার করেছে আয়েশার গালে সে নিজে একটু হলুদ লাগাবে। খুব ইচ্ছে তার। পিয়াস আর নিশুও কাল বিয়ের পর নিজেদের বাড়ি ফিরে যাবে। তাদের মধ্যে এখন ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। চিত্রাকে ফারাজ জোর করে কলেজ পাঠিয়েছে।
জানালার দিকে কলম মুখে নিয়ে চিত্রা কামড়ে যাচ্ছে। ক্লাসের একেবারে শেষ মাথায় বসেছে সে। ইংরেজি স্যার লেকচার দিচ্ছে। এসব লেকচার মানুষ শুনে? চিত্রার পাশে যেই মেয়েটি বসে আছে তার নাম মরিয়ম। কলেজে আসার পর থেকে এই মেয়ের সাথেই টুকটাক কথা হয়েছে। বাকিগুলো তো সব এক একটা ন্যাকামির বস্তা। সবগুলো ক্লাসে আসে ছেলে পটাতে। সারাদিন ওয়াশরুমে বসে বসে সাজুগুজু করে। আচ্ছা তাদেরকে কে বুঝাবে নীল কলেজ ড্রেসের সঙ্গে লাল লিপস্টিক দেওয়াতে নায়িকা নয় বরং হারপিকের বোতল লাগে। চিত্রা খাতার ওপর আঁকিবুঁকি করে। ধ্যাত আর ভালো লাগছে না। কাল আয়েশার বিয়ে আর আজকে জোর করে ধরে বেঁধে ফারাজ তাকে কলেজ পাঠিয়েছে এসব কি মানা যায়? এখনও কত কি কেনাকাটা বাকি? এমন নাকি স্বামী হয়? চিত্রা মনে মনে ঠিক করেছে পরীক্ষায় বার বার ফেইল করবে। একসময় না একসময় ফারাজ বিরক্ত হয়ে তো তার পড়ালেখা বন্ধই করে দিবে। চিত্রার ব্যাগে একটা খাতা ছাড়া কিছুই নেই। সে ব্যাগ বোজাই করে হাবিজাবি খাবার নিয়ে আসে। শেষ বেঞ্চে বসে বসে ক্লাস আওয়ারে সব গিলে। ব্যাগ থেকে আলুজ বের করে বেঞ্চের নিচে প্যাকেট রেখে পাশে বসা সেই সাধাসিধা মরিয়ম নামক মেয়ে টিকে বলে,
“খেয়ে দেখো মজা আছে। চিন্তা করবা না আমার ব্যাগে আরো অনেক আছে। স্টারশিপের জুসও আছে। তুমি একটা খাও আমি একটা খাই।”
মেয়েটার মুখটা সবসময় কেমন যেন বিষন্ন থাকে। সে কাঁপতে থাকা হাতে প্যাকেট থেকে একটা চিপস নিয়ে মুখে দেয়। তার এসব খাওয়া হয় না। সে টিফিনে ভাত আনে। সবাই তাকে নিয়ে মজা করে দেখে টিফিন টাইমে যখন সবাই ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যায় তখন এক কোণে বসে ভাত খায়। মেয়েটাকে কখনও চিত্রা গরম ভাত খেতে দেখে নি। কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজের সঙ্গে৷ সিদ্ধ আলু চটকে একটা ভর্তা নিয়ে আসে। পান্তা দিয়ে আলু সিদ্ধ খায়। চিত্রার খারাপ লাগে। চিত্রাকে ফারাজ রোজ এত এত মজার মজার খাবার কিনে দেয়। চিত্রা সেখান থেকে মরিয়মকে না দিয়ে খেলে আজ-কাল তার গলা দিয়ে খাবারই নামতে চায় না।
“তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তায় আছো?” মরিয়মকে জিজ্ঞেস করে চিত্রা।
“না।” জবাব দেয় মরিয়ম। তবে চেহেরা দেখে বুঝা যাচ্ছে কিছু না কিছু তো একটা হয়েছেই। চিত্রা জোর করে না। হুট করে স্যার চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে, “এই মেয়ে কি খাচ্ছো?” দাঁড়াও দাঁড়াও বলছি। তুমি সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকো। সবাই একটু দেখুক কত বড় সেলিব্রেটি তুমি।”
চিত্রা এটার আশায় ছিল না। এত ছোটোলোকি পানা সহ্য হয় না।তাকে দাঁড় করানো হচ্ছে? এই কলেজটা কাদের জমির ওপর তৈরি হয়েছে এই লোকের কি জানা আছে? মাসের পর মাস এই কলেজের উন্নতির জন্য কারা ডোনেশন করে তাও কি জানে? সবাই চিত্রাকে দেখে হাসছে। সে মুখ ভেংচি কেটে সামনে এসে দাঁড়ায়। তার সেলোয়ারে সে একটা পকেট বানিয়েছিল। ওইখানে বরইয়ের আচার আছে। বের করে খাবে নাকি? এই লোক তো এমনিতেই তাকে শাস্তি দিয়েছে। এখন আর খেলেই বা কি হবে? চিত্রা পকেট থেকে আচার বের করতে যাবে তার আগেই ক্লাসে দারোয়ান এসে বলে যায়। “স্যার পোলাপানরে চুপ কইরা ঠিকঠাক ভাবে জায়গায় বসতে বলেন। অধ্যক্ষ আসতাছে সঙ্গে গেস্টও আছে। ” ইংরেজি টিচার জলদি চিত্রাকে জায়গায় বসতে বলে। চিত্রার এসবে কিছু যায় আসে না। সে বরইয়ের আচার খেতে খেতে জায়গায় বসে। ওমনেই ক্লাসে অধ্যক্ষ তার প্রবেশ করে। তার সঙ্গে আজকে একজন স্পেশাল অতিথি আছেন। চিত্রা জায়গা থেকে কোনো মতো দাঁড়িয়ে ব্যাগের মধ্যে থেকে আরেকটা কিছু খাওয়ার জন্য বের করছিল তখন। কে আসলো গেলো তাতে কিছু যায় আসে না তার। তবে আশপাশ থেকে মেয়েদের গলার স্বর কানে আসে, “আরে আরে দেখ কত হ্যান্ডসাম ছেলেটা। উনি কি সিঙ্গেল? এই ভাই আমি ওনাকে না পেলে আজ থেকে আর ভাত খাবো না।”
চিত্রা মাথা তুলে সামনে তাকাতেই তার চক্কর চলে আসে। দু’টো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকেই চেয়ে আছে। কারন স্পেশাল অতিথি আর কেউ নয় বরং তার স্বামী ফারাজ এলাহী। ফারাজ তার দিকে এক নজর চেয়ে অধ্যক্ষের ডাকে সারা দেয়। সে ভয়ে জলদি খাবার গুলো লুকিয়ে ফেলে। গোপন বিষয় ফাঁস হয়ে গেলো রে। রাতে লোকটার বিশেষ ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে কি? সে ওই ক্লাসই করতে চায়। এই ঘোড়ার ডিমের পড়ালেখা করে লাভ কি? কোন মাথামোটা যে এসব পড়ালেখা আবিষ্কার করছে? তাকে পেলে চুল নেড়া করে মাথায় তবলা বাজাতো সে।
“কেমন লেগেছে ফারাজ এলাহী? এটা কর্মাসের ক্লাস। আপনার ফ্যামেলি মেম্বার নিরু তো আর্সের ছাত্রী?”
“হুম তবে এই ক্লাসেও একজন আছে।”
“কি বলছেন? আমাকে বলবেন না? তাহলে আমি তার বিশেষ কেয়ারের ব্যবস্থা করতাম।”
ফারাজ চিত্রার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বলে,”মিসেস ফারাজ এলাহী আই মিন মিসেস চিত্রা আমার ওয়াইফ।”
অধ্যক্ষ নিজেও অবাক হন। এই কলেজ এলাহী বাড়ির সম্পত্তির মধ্যে পরে। এত বড় মানুষটার স্ত্রী এখানে বসে তা কি করে যে অজানা রয়ে গেলেন। ফারাজ এলাহীর সামনে লজ্জায় পড়তে হলো। এদিকে ক্লাসের ইংরেজি টিচার তো মনে মনে খোদার নাম জপে যাচ্ছেন। কলেজ যাদের তাদের বাড়ির বউকেই এখানে দাঁড় করিয়েছে রেখেছে? যদি ফারাজ এলাহীর কাছে নালিশ করে? আর তখন এলাহী তার চাকরি খেয়ে ফেলে?
চিত্রা উঠে দাঁড়ায়। সে সবগুলো আচার একেবারে মুখে ঢুকিয়েছে দেখে কথাও বলতে পারছে না। ক্লাসের মেয়েদের তো চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই খাদক মেয়ের এত সুন্দর স্বামী? কি করে সম্ভাব?
সেদিন বাড়ি ফেরার আগে চিত্রা কলেজে বিরাট একটা কান্ড করে এসেছে। যেই মেয়েটা তার স্বামীর দিকে নজর দিয়েছিল। তার পিঠে জামার সাথে পিন দিয়ে চোরের মত কাগজ লাগিয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে বড় বড় করে লেখা, “হারপিকের বোতল আরেকবার আমার হ্যান্ডসামের দিকে নজর দিলে চোখ তুলে শকুন কে খাওয়াবো। আমাকে ভালো করে চিনিস নি। আমি হলাম মিসেস ফারাজ এলাহী। ফারাজের আগুনে সুন্দরী।”
ফুটপাতের ধারে দাঁড়িয়ে আয়েশা আর চিত্রা ফুচকা খাচ্ছে। ফারাজ আগেই নিষেধ করেছিল, কিন্তু কে শোনে কার কথা? চিত্রা একে একে তিন প্লেট ফুচকা শেষ করে ফেলেছে। ফারাজ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে তার দিকে। এই ছোটখাটো মেয়েটার পেটে এত খাবার কোথায় যায়? ভেতরে বুঝি কোনো গুপ্তধনের গুহা আছে! আয়েশার বিয়ের শাড়িটা কিনা বাকি ছিল।লাল টুকটুকে বউ না সাজলে কেমন যেন অপূর্ণ লাগে। যদিও আয়েশা এইসবও চায় নি।
গাড়ির দরজার পাশ থেকে ফারাজ হঠাৎ বলে ওঠে, “এই অভ্র, তুই গাড়িতে উঠে বস। কথা আছে।”
অভ্র কিছু না বলেই উঠে বসে। যাওয়ার আগে সে আয়েশার দিকে চেয়ে বলে, “বৃষ্টি নামবে। জলদি খাওয়া শেষ করে গাড়িতে এসো। আর হ্যাঁ, তুমি কিন্তু ব্যাক সিটেই বসবে।”
চিত্রা তৎক্ষণাৎ গলা খাঁকারি দেয়। অভ্র লজ্জায় মাথা নিচু করে, আয়েশাও কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে। কিন্তু কী আর করা যায় আক্কাস আলীর মুখে লাগাম নেই। যখন যা মন চায় বলে ফেলে। অভ্র গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। পিছনে চিত্রা আর আয়েশা ফুচকা খাওয়া চালিয়ে যায়।
“মামা, এত কিপটে কেন আপনি?” চিত্রা ফুচকাওয়ালাকে ঘাড় ফিরিয়ে বলে, “মরিচটা একটু বাড়ান তো।”
ফুচকাওয়ালা কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়, “বেশি মরিচ খাইলে কিন্তু সকালে কষ্ট হইব বেশি।”
“আমার কষ্ট হলে আপনাকে কি? দেন, মরিচটা দেন।”
ফুচকাওয়ালা মাথা নাড়তে নাড়তে মরিচের গুড়ো ছিটিয়ে দেয় বাটিতে। চিত্রা বাটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ থমকে যায়। বুকের ভেতর একধরনের অচেনা হাহাকার নেমে আসে। আজ অনেকদিন পর ফুচকা খেতে এসেছে সে। সেই দিনটার পর এই প্রথম। সেই দিনের ভয় এখনও তার মনে অন্ধকার দাগ কেটে রেখেছে। শোক হয়তো ধীরে ধীরে কেটে গেছে কিন্তু সেই ছোট্ট ছেলেটার জন্য মন এখনও কেঁদে ওঠে। সেই রক্তাক্ত স্মৃতি, সেই আর্তনাদ কিছুই মুছে যায়নি। শুধু ছাপা হয়ে গেছে হৃদয়ের গহীনে। হত্যাকারী এখনো ধরা পড়েনি। মাঝে পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়, ‘নিখোঁজ’ ট্যাগে। কিন্তু কোনো হদিস নেই। কী আশ্চর্য দেশ! এখানে আইন নেই, বিচার নেই। শুধু আছে অবিচার আর পাপের কালো ছায়া।
চিত্রার ভাবনার ভিড়ে আয়েশার খাওয়া শেষ হয়ে যায়। চিত্রা বাটির শেষ ফুচকাটা তুলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করেই আকাশ ছেঁড়ে নামে বৃষ্টি। ফারাজ আগেই টাকাটা দিয়ে গিয়েছিল। শেষ ফুচকাটা মুখে পুড়ে আয়েশার হাত ধরে দৌড় দিতে যাবে পেছন থেকে ফুচকাওয়ালা বলে ওঠে,
“আপা, এত বড় নোটের তো ভাঙতি নাই আমার কাছে।”
চিত্রা তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “থাক, আপনার কাছেই থাক। বকশিস ধরে নিন।”
চিত্রা দৌড়ে গাড়ির দিকে ছুটতে যায়। রাস্তার ধারে জল জমতে শুরু করেছে। বাতাস বাড়ছে। গাড়ির ঠিক দু’পা দূরে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই হঠাৎ পেছন থেকে কেউ তার পা শক্ত করে চেপে ধরে। চিত্রার শরীর কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করে ওঠে। সে নিচের দিকে তাকায়, জলের ফোঁটায় চুল এবং জামা ভিজে গেছে। অন্ধকার আর বৃষ্টির ভেতরেও স্পষ্ট দেখতে পায় একটা কাদা মাখা, কাঁপতে থাকা হাত পা জড়িয়ে ধরেছে তার পায়ের গোড়ালি। চোখ বড় হয়ে যায় তার। অস্পষ্ট কণ্ঠে ফিসফিস করে সে বলে ওঠে,
“মরিয়ম…?”
“ওই মাইয়ারে খুইজা বাহির কর জোহান। বেক্কলের মতো কাম করস ক্যান? তোর চেহারা কেমনে দেইখা ফেলল মাইয়া?”চিৎকার করে বলল রাজন।
“ভাই, ওই সময় কেউ পুরান ঘাটে থাকে না। আমি কেমনে জানমু, মাইয়া ঝোপের আড়াল থেইকা সব কিছু দেখছে?”
“এত কিছু জানি না। মাইয়া আমার চাই। ওই মাইয়ারে আমি চাই।”
“মাইয়া দিয়া কি করবেন? বান্দির লাশ আনলেই তো হইব।”
“না, জিন্দা চাই। আমার দেখতে হইব, কোন মাইয়ার এত সাহস হয়? শালির চোখ দিয়া বহু খারাপ জিনিস দেইখা ফেলছে। ওরে তো আমার দেখন লাগবোই। ভালা হইছে যে তুই অন্তত চেহারাটা দেখছিস। এখন জলদি ওই মাইয়ারে খুইজা আইনা দে।”
রাজন ফোন কেটে দেয়। জোহান ফোন পকেটে ভরে ফেলে। সে বৃষ্টির ভেতর পাগলের মতো ঘুরছে। ঝোপ, গলি, পুরান ঘাট সব খুঁজে দেখছে। একটা ভুলে সে এত বছরের ব্যবসা শেষ হতে দিবে না। একজন সাক্ষী বেঁচে থাকা মানে পুরো পাপের দুনিয়া শেষ হয়ে যাওয়া।
আয়েশা ধীরে ধীরে মরিয়মের পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছে। মেয়েটা এখনও কাঁপছে। ভয়ের ছায়া চোখে-মুখে লেগে আছে। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। চিত্রা তার পাশেই বসে আছে। সে নির্বাক। দুপুরেই তো ক্লাসে মরিয়ম একেবারে সুস্থ ছিল। ঠিক তখনই বজ্র এসে পৌঁছায়। দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকে। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। সারাদিন হাসপাতালে ছিল সে। একজন ক্রিটিকাল রোগীর সার্জারির দায়িত্বে। আসলে ওকে বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল ইন্টার্নদের হাতে-কলমে শেখানোর জন্য। আর কয়েকটা ক্লাস করলেই তার কাজ শেষ। বজ্র সোজা গিয়ে ঢুকে পড়ে গেস্ট রুমে। সেখানেই মরিয়ম, চিত্রা ও আয়েশা। সে ঝুঁকে পড়ে চেকআপ করে। এক মুহূর্তের নীরবতার পর বলে ওঠে। গলায় অভিজ্ঞতার আশ্বস্তির সুর। সে নরম ও স্থির গলায় বলে,“তেমন কিছু হয়নি। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। বিশ্রাম করলেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে রাতটা কেউ পাশে থাকলে ভালো হয়। যদি আবার ভয় পায়… সমস্যা হতে পারে।”
চিত্রা চুপ করে যায়। মনে একগাদা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কি হয়েছিল মরিয়মের সঙ্গে? এত ভয় পেল কেন? তাকে কেউ তাড়া করেছিল? কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তো অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল সে। তাই তো চিত্রা এখনো কিছু জানতে পারেনি।
চিত্রা গভীর নিচু স্বরে আয়েশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আয়েশা, তুই পারবি থাকতে ওর সঙ্গে?”
আয়েশা দৃঢ় কণ্ঠে আশ্বাস দিয়ে বলে,“সমস্যা নাই। আমি তো আছি।”
চিত্রা হেসে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, “পাশের রুমেই তো অভ্র আছে। লাফাইতে লাফাইতে সেখানে চলে যাইস না বইন।”
আয়েশা নাক কুঁচকে জবাব দেয়,“আসতাগফিরুল্লাহ আপা! আমি অনেক ভালো মেয়ে।”
চিত্রা হেসে, আদুরে গলায় বলে,“সে তো জানিই।”
বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফারাজ ফিসফিস করে কথা বলছে অভ্রর সঙ্গে। তার কণ্ঠে অস্থিরতা, অনুশোচনা।
ফারাজ নিচু গলায় দূরে তাকিয়ে বলে, “এই বউ নিয়ে কই যাবো অভ্র? যাকে-তাকে বাড়ি নিয়ে চলে আসে। এটা কি বাড়ি নাকি আশ্রয় কেন্দ্র? কি করব? বউয়ের চেহারা দেখলে না করতে পারি না। মায়া লাগে খুব।”
অভ্র সংক্ষেপে নির্লিপ্ত স্বরে বলে, “আপনারই তো বউ।”
ফারাজ হালকা হেসে জবাব দেয়, “তুই বেশি খুশি হইস না চান্দু। কাল তোরও বিয়ে হবে। তখন মজা বুঝবি।”
অভ্র মাথা চুলকে বলে, “ভাই, ভয় দেখাইয়েন না।”
ঠিক তখনই ফারাজের ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে একটি গোলাপের সাইট। অভ্রর সেথায় চোখ পড়তেই সে চোখ সরু করে গম্ভীর স্বরে বলল,“আমাকে দেন, আমি কথা বলি ।”
ফারাজ ঠাণ্ডা গলায় অন্যমনস্কভাবে বলে,“তোর সাথে কথা বলতে চাইলে তো তোকেই কল দিত।”
সে কোনো দ্বিধা না করে কল কেটে দেয়। সিগারেটের ধোঁয়ার ধারা ছেড়ে দেয়।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বলে, “এই মেয়েটা অনেক বেশি জেদী হয়ে গেছে।”
অভ্র চোখ সরু করে কটাক্ষ করে,“আপনার হাতে গড়া বুঝতে হবে না?”
ফারাজ চোখ নামিয়ে বলে,“ইদানীং বেশি জ্বালায়।”
“ভাবী সন্দেহ করে?”
“না করে না। কিন্তু করতে কতক্ষণ? আমার ফোনে কল এলে সে ধরে না। তবে ওইদিন নজরে পরেছিল। কোনে রকমে বাঁচলাম।”
অভ্র গম্ভীর স্বরে বলল,“আপনি হুট করে বদলে গিয়েছেন ভাই। সব ভুলে গিয়েছেন। এখানে আসার পেছনে কিন্তু আপনার আলাদা উদ্দেশ্য ছিল। কই ভাই, মানুষ খুন করতে তো আপনার বুক কাঁপে না। তাহলে আপনি এখনও উদ্দেশ্য পূরণ করছেন না কেন? এত মায়া বাড়িয়ে লাভ কি?”
“বুক কাঁপবে কেন? অভ্যাস হয়ে গিয়েছে রক্তে হাত রাঙানো।”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৭
“সেটাই তো বলছি বুক কেন কাঁপছে? আসলে ভালোবাসায় মোজে গেছেন আপনি। এখন আপনাকে বেছে নিতে হবে যে কোনো একটি। হয় এই দুনিয়া, না হয় দুনিয়া। ভাবী থাকবে, না পাপ?”
ফারাজ কাঁপা গলায় সুধায়,“চিত্রাকে মৃত্যু ছাড়া ছাড়তে পারবোনা। সে যে আমার রক্তে মিশে গেছে।”
অভ্র হাসে,“মৃত্যু ছাড়া ছাড়তে পারবেন না? তাহলে মৃত্যুকেই ডাকুন ? তবে আপনার মৃত্যু নয়।”বলেই হাসে অভ্র। “ভাবীর জন্য সব ছাড়তে পারবেন?”
“মরতেও পারবো, মারতেও পারবো কিন্তু ওকে ছাড়তে পারবো না।”