চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫২ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন
রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফারাজ চিত্রার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। তাকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিতে গেলে চিত্রা বলে উঠল,
“সত্যি করে একটা কথা বলবেন?”
ফারাজের ক্লান্ত তীক্ষ্ণ জবাব, “মিথ্যা কিছু বলেছি কি?”
চিত্রা পুনরায় কাঠকাঠ প্রশ্ন করল, “আপনার রাজন ভাইয়ের চরিত্র খারাপ তা আপনি আগে জানতেন? উনার আগের বউগুলোকে উনি ছেড়েছিলেন নাকি হাজার বছর ধরে পরিষ্কার না করা টয়লেটের মতো নোংরা চরিত্র দেখে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে?”
ফারাজ সোজা হয়ে বসে পড়ল।” হঠাৎ এইসব?আর তুমি কি করে জানলে রাজন ভাই চরিত্রহীন?”
চিত্রার চোখে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। “স্বয়ং নিজের চোখে দেখেছি।”
“কোথায়?”
“সরাইখানায়।”
ফারাজের কণ্ঠে বিস্ময়ের বিস্ফোরণ,”হোয়াট?তুমি সরাইখানায় গিয়েছিলে নাকি?”
চিত্রা শান্ত গলায় উত্তর দেয়,”না গাড়ির মধ্যেই বসেছিলাম। হুট করে নজরে হলো। দেখলাম ভাই সরাইখানায় ঢুকছেন। বড় বলে সে অন্যায় করবে তা তো হয় না ফারাজ।”
ফারাজের চোখ লাল হয়ে ওঠে রাগে।”বজ্র তোমাকে ওই নোংরা জায়গা দিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাই না? আই জাস্ট কিল হিম।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চিত্রার কণ্ঠে স্থিরতা,”থামুন। উনার কোনো দোষ নেই। আমি নিজেই জোর করেছিলাম। জলদি বাড়ি আসার জন্য।”
ফারাজ চুলে হাত বুলিয়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে ধারালো। একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেই চিত্রা পেছন থেকে তার বুকটা আগলে ধরল। ছোট্ট চিত্রা ফারাজের নাগাল পায় না ঠিক মতো। তবুও স্বামীকে ধরার কত ইচ্ছে।
“সিগারেটের গন্ধ সহ্য করা, আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।”ধীরে বলল চিত্রা।
“কেনো সোহাগ সিগারেট টেনে ধোঁয়া কি তোমার মুখের ওপর ছাড়ত নাকি?”
“ফারাজ!”চিত্রার কণ্ঠটা কেঁপে উঠল।
“সরি বউ কথা ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছে। আমার দোষ নেই। চাইলে এই ঠোঁটে চুমু খেয়ে ঠোঁটকে শাস্তি দিতে পারো।”
চিত্রা অবাক। একটা মানুষ এত সিরিয়াস মুহুর্তেও এসব কথা কেমন করে বলতে পারে? এখন যদি চিত্রা রেগে বলে,”আপনার কি লজ্জা সরম নেই?” তখন চেঁচিয়ে বলবে,”ওইসব বউ ছোটলোকি কারবার।” তাই এই লোককে কিছু বলাও বিপজ্জনক।
“আপনি কিন্তু আমার জবাব দিলেন না।”
ফারাজ নির্লিপ্ত চোখে চিত্রার দিকে ঘুরে তাকালো। বলল, “শুনো বিবিজান আমার পুরোটা জীবনই দেশের বাহিরে কেটেছে। রাজন ভাইয়ের একটা বিয়েতেও আমি আসতে পারি নি। সে কি করল না করল তাতেও আমার কিছু আসে যায় না। নদী ভাবীর তো কোনো অভিযোগ নেই। যেদিন সে নিজে এসে আমার কাছে বলবে সাহায্য করুন। আপনার ভাইয়ের চরিত্র ভালো না। সেদিন দেখা যাবে। দেখো চিত্রা আমি নিজের খেয়ে অন্যের ওকালতি করতে পারবো না। এসব আমার রক্তে নেই। এখন বলো নদী ভাবী তোমাকে কিছু বলেছে?আর রাজন ভাইয়েরা তো সবখানে মাছ ডেলিভারি দেয়। সরাইখানা খারাপ জায়গা হতে পারে কিন্তু ওইখানেও অনেক মানুষ, কাস্টমারের আনাগোনা। ব্যবসা ব্যবসায়ের জায়গায়। কাজের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। সরইখানায় কি কারনে গেল সেটা না জেনে একটা মানুষের বিষয়ে আরোপ করাও পাপ।”
চিত্রা এক মুহুর্তের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায়৷ আসলেই তো মাছের ব্যবসার কথা কেনো মাথায় এলো না? আর নদী ভাবীও তো সত্যি কোনো অভিযোগ করে নি। তাহলে কি শুধু শুধু রাজন ভাইকে নিয়ে ওইসব বলা ভুল হয়ে গিয়েছে? ইশরে এখন ফারাজটা কি মনে করছে? রাগ করেছে নিশ্চিত! চিত্রা কি করবে বুঝতে না পেরে ফারাজকে আবারও আঙুল দিয়ে খোঁচানো শুরু করল। ফারাজ তাকায় না। তবে ভেতরে ভেতরে একটা নিশ্বাস ছাড়ে। আপাততর জন্য বউয়ের মাইন্ডকে বদলাতে পেরেছে সে। কিন্তু আর কয়দিন? একদিন যখন সব সামনে চলে আসবে? চিত্রা আবারও খোঁচালো ফারাজকে। ঠোঁট উল্টে বলল,
“সিগারেটের স্বাদ কি বউয়ের ভালোবাসার থেকেও বেশি নাকি? দেন তো দারাজ এলাচী আমিও একটা টান মারি?”
চোখ কুঁচকে ফারাজ বলল, “বলেছি না এইসব উল্টাপাল্টা কথা বলবে না? আরেকবার বললে দোতালা থেকে একটা আছার মারবো। ভেটকিয়ে যাবে। তখন উপরে বসে বসে টান মারামারি করবা আবুলের নাতনি।”
“রাগ করবেন না। রাগলে আপনাকে সেই লাগে। তখন কিন্তু ভুলভাল কিছু করে ফেলতে পারি।”চিত্রা হেসে জবাব দিল।
“নট ইন্টারেস্টেড। সাইড প্লিজ লুচ্চি বউ। ফারাজ সরু চোখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল।
চিত্রার মুখটা ছোট্ট হয়ে যায়। ফারাজ তাকে বলছে নট ইন্টারেস্টেড? হুট করে তার এমন ভালো স্বামীটাকে কোন ভূতের মা ধরলো? ফারাজ সিগারেট ফেলে বিছানায় শুতে যায় এমন সময় চিত্রা আবার বলে, “আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি?” চমকে জিজ্ঞেস করল ফারাজ।
“জানতে হলে আগে খুলতে হবে তারপর পড়তে হবে।”
“কিহ! কি খুলবো? আগে বউ তোর ব্রেনটা খুলে ওয়াশ করে আয়। নিশ্চিত ব্রেনের স্টোরেজ ফুল হয়ে ডেমেজ হয়ে গিয়েছে।”ভুরু কুঁচকে বলল ফারাজ।
চিত্রা চোখ টিপে বলল, “তাহলে আপনি রিপেয়ার করে দেন না।”
ফারাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “আগে রিপেয়ারের স্পেলিং বলো।”
চিত্রার চোখের কোণে জল চলে আসে। স্বামী রাগ করেছে তার জন্য বরং তাকে ওই কঠিন ইংরেজি শব্দের বানানটা বলতে হবে সেই ভেবে কান্না পাচ্ছে তার। ফারাজ গম্ভীর গলায় বলল,
“এদিকে আসো। থাক তোমার কিছু বলতে হবে। আমার ময়না পাখি, লক্ষী বউ কাম।”
ফারাজ হাত বাড়িয়ে চিত্রাকে নিজের কাছে টেনে বসায়। চোখ মুছে দিতেই চিত্রা শয়তানি হাসি দেয়। তা দেখে ফারাজ বলে উঠে, “আয় খোদা মেয়ে মানুষের অভিনয়ের তুলনা হয় না। বউ তুমি তো একটা অস্কার ডিজার্ব করো। বাই দ্যা ওয়ে কি সারপ্রাইজ দিবে আমাকে?”
চিত্রা জলদি ড্রয়ার থেকে একটা কাপড় বের করে ফারাজের সামনে ধরতেই ফারাজ চোখ বড় বড় করে বলে উঠল, “লুঙ্গী? আর ইউ সিরিয়াস?”
“হোয়াট দ্যা ফ…..” পুরোটা বলার আগেই চিত্রা ফারাজের বুলি থমকে দেয় তার বৈধ ঠোঁটের বাঁধ ভেঙে।
–
অভ্রর মুডটা অফ। রোজ এসেছে তার জীবনের সব ডোজ কেড়ে নিতে। লাইফে এমনিতেও কি ঝামেলার অভাব ছিল যে নতুন করে আরেকটা উদয় হতে হবে। বয়সে এই মেয়ের এত বড় হওয়ার পরেও অভ্রর একদম মনে আছে ছোটবেলায় প্যান্ট বদলানোর সময় শালী কাটা ওয়ালা নাগিন খালি তার রুমে উঁকি ঝুঁকি মারত। নিজের ব্যাক্তিগত সম্পদকে যে অভ্র কত কষ্টে নিরাপত্তা দিয়েছে তা কেবল সেই ভালো জানে।
“সরকার ভাই বাহিরে বৃষ্টি পড়বে মনে হচ্ছে। চলো না ছাদে ঘুরতে যাই।”আয়েশা হেসে বলল,
“রাত কয়টা বাজে কুদ্দুসের আম্মা?”অভ্র বিরক্ত গলায় বলল।
“যয়টা বাজে হয়টা বাজে।” আয়েশা উঠে বলে।
অভ্র বিরক্ত গলায় বলল,”ছিহ এসব কোন দেশের ভাষা? নিশ্চিত পাগলা ইংরেজি বুড়ির থেকে শিখেছো?”
আয়েশা চোখ টিপে বলল,”উঁহু আয়েশা শেখে না, শেখায়। আর এটা ভাষা না এটা হলো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কু্দ্দুসের আব্বা।”
অভ্র মুখ গম্ভীর করে বলল,”এখন কাছে আসো কুদ্দুস কেউ তো পৃথিবীর আলো দেখাতে হবে। বাবা হয়ে সন্তানকে বেশি অপেক্ষা করাতে পারব না। পাপ লাগবে। আর তার চেয়ে বড় কথা ফারাজ ভাইয়ের আগে কুদ্দুসকে ডাউনলোড করতে হবে। ভাই আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে এবার কুদ্দুসকে পয়দা করে তার মেয়েকে জ্বালাবো। মানে আমার কুদ্দুস জ্বালাবে। বাদলা নিবো।”
আয়েশা আলমারি থেকে একটা কাপুড়ের ব্যাগ বের করল। তাতে দুইটা লুঙ্গি রাখা। দুইটাই বের করে একটা লুঙ্গি খুলে অভ্রর সামনে ধরল আয়েশা। বলল, “তোমাকে কোনোদিন লুঙ্গি পড়তে দেখলাম না সরকার ভাই। আজ একটু পড়ো না।”
অভ্র থতমত খেয়ে বলল,”এখন?”
আয়েশা দৃঢ় গলায় বলল।”হ্যাঁ।”
অভ্র হাহাকার করে উঠল,”ফারাজ ভাই নিজেও লুঙ্গি পড়ে নি আর আমাকেও পড়তে দেয় নি। কি একটা ছাতার মাথা জীবন আমার।”
আয়েশা মায়া মিশিয়ে বলল,”আহারে আমার অবলা জামাইটা। থাক দুঃখ না করে আজকে পড়ে ফেলো। রাতে লুঙ্গি পড়ে ঘুমালে হাওয়া-বাতাস জায়গা মতো লাগে।”
অভ্র সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করল,” লাগে কোথায়?”
আয়েশা মুচকি হেসে উত্তর দিল।”তোমার মাথায়।”
আয়েশা লুঙ্গিটা মেলে তার নিচে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে টেনে ঢুকালো অভ্রকেও। অন্ধকার লুঙ্গির নিচটা তাদের আড়াল করে দিয়েছে।
“কি করছো ঘরনী?”
“করি নি তবে করবো।”
“কি করবে?”
“ওই যে ব্লাক কালারের পিরিতটা। প্রতিবার কেউ না কেউ আমাদের ভালোবাসায় বাঁধা দেয়। আর নয় সরকার ভাই। এবার লুঙ্গির নিচেই লুঙ্গি ভালোবাসা হবে। কেউ আমাদের দেখতেও পারবে না। সেই হবে দেখবে। আমি ফারাজ আব্বার জন্যেও একটা লুঙ্গি এনেছি। চিত্রা আপার হাতে দিয়েছে।”
অভ্র লুঙ্গির নিচ থেকে বের হয়ে একটা বড় নিশ্বাস নেয়। আরেকটু হলে দমবন্ধ হয়ে মরতো। আয়েশার দিকে একবার তাকায়। তার মনে মনে বলে উঠে, “মানুষ কক্সবাজার যায় কত কি আনতে আর এই মেয়ে ব্যাগ ভর্তি করে দেখছি লুঙ্গি এনেছে। এটা মেয়ে নাকি এটম বোমা?”
আয়েশা অভ্রর হাতে লুঙ্গি ধরিয়ে দিয়ে পুনরায় বলল, “আমি ফ্রিজ থেকে খাবার এনে সোজা ছাদে আসছি। তুমি লুঙ্গি পড়ে সোজা ছাদে চলে যেও। আজকে আমরা লুঙ্গি ভালোবাসা করব।”
আয়েশা নিচে আসতেই রান্নাঘরে রোজের সঙ্গে দেখা হয় তার। আয়েশাকে দেখে রোজ বলে উঠল, “সরকার বাড়ির বউ হয়ে কেমন লাগছে।”
আয়েশা চোখ টিপে জবাব দিল,”এক্কেবারে ঝাক্কাস।”
রোজ হালকা হাসল, তারপর বলল,”অভ্র কিন্তু ভালো ছেলে।”
“ওইটা দেখেই তো বিয়ে করেছি।”আয়েশা বলল গর্বের সুরে।
“তোমরা ঘুমাও নি যে?”
আয়েশা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”আপা কি যে বলেন। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে এখনি যদি ঘুমিয়ে পরি তাহলে সরকার বংশের পরবর্তী বংশধর আসবে কেমন করে?”
রোজের রিতীমত গলায় কাটা বিঁধে যাওয়ার মতো অবস্থা। সে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ফ্রিজ থেকে একটা কিসের যেন বোতল বের করে। তা থেকে পানীয় গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে পান করে একটা তৃপ্তি দায়ক হাসি দিয়ে বলে, ” অভ্র হচ্ছে বন্দুকের নলের মতো। যে কোনো সময়ে গুলি বের হয়ে যেতে পারে।”
আয়েশা নিরুত্তাপ চোখে তাকিয়ে থেকে হেসে উঠল,”ডোন্ট ওয়ারি কাটা ওয়ালা সাদা চামড়ার আপা অভ্র বন্দুকের নল হোক আর যাই হোক না কেনো টিগ্রার কিন্তু আমার হাতের মুঠোয়। বন্দুক যার হাতে গুলি কিন্তু তার হুকুমেই নল থেকে বের হয়।”
রোজ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর কিছু না বলে বিদায় জানিয়ে রান্নাঘর থেকে চলে যায়। আয়েশা তার যাওয়ার পর রোজের ফ্রিজে রাখা সেই বোতলটা বের করে বলল, “আমিও তো একটু দেখি আপায় এত স্বাদ করে কি খেয়েছে।”
বলেই আয়েশা বোতল বের করে গটগট করে পানীয় পান করে। প্রথমে একটু খারাপ লেগেছিল। মনে খালি তৃপ্তি আর তৃপ্তি। তৃপ্তি তো লাগবেই বিদেশি হুইস্কি বলে কথা। তবে আয়েশার ওই রোজকে ভালো লাগে না। তার অভ্রটার সঙ্গে টিকটিকর মতো লাগতে চায়। এই মেয়ের সঙ্গে আজকেই পরিচয় হয়েছে। কিন্তু দেখো কথা কেমন করে বলে?ম্যাম সাহেব দেখে কি যা মন চায় তাই বলবে? সে ম্যাম সাহেব হলে এই আয়েশাও পকেটমার স্পেশাল। এসব ভাঁওতাবাজি তার সঙ্গে চলবে না।
জমেলার আজকে বউ সাজতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বউ সেজে লাভ কি? কালুর বাপ তো আর তাকে চায় না। এই মাঝ রাতে জমেলা আর না পেরে লাল রঙের একটা শাড়ি পড়ে বাগানের দোলনায় গিয়ে বসে। ঠোঁটে কড়া করে লাল লিপস্টিক ঘষেছে। চোখের নিচে ওপরে সবখানে কাজল দিয়েছে। মুখে একগাদা তিব্বত ঘামাচির পাউডার মেখে সে তো বিশ্ববান্দরী বউ হয়ে গিয়েছে। কচি পাতার মতো জোয়ান ছেলেরা বুড়ির এমন সুন্দর লুক দেখলে নিশ্চিত মোমবাতির ওপরে বসে মরে যাই গ্রহে পারি জমাবে। জমেলা দোলনায় বসতেই তার পেটে ঘুরঘুর শব্দ শুরু হয়। ক্ষুধা পেয়েছে। সে মনে মনে বলে উঠল,” ওইদিন আয়েশা কেঁচোর মতোন দেখতে কি যেন একটা গিলছিল? কিসের বাঁশির কঞ্চি দিয়ে ধরে ধরে আবার খাচ্ছিল। ও মনে পড়ছে। লাংমেন। ওই লাংমেন খাইবার মন চাচ্ছেরে। সঙ্গে পিছা থাকলেও সেইরাম হইত।”
সুলেমান এলাহীর ঘুম আসছে না। কালকে বড় একটা কাজ আছে তাঁর। ইদানীং রাতে ঘুম হয়। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে বাগানে চলে আসে। দু’জন লোককে আসতে বলেছে সে। তাঁদের জন্য সুলেমান এলাহী গিয়ে বাগানে অপেক্ষা করে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাজা পিঠ সমান সমান হয়ে গিয়েছে। শেষে না পেরে সুলেমান অন্ধকারের মধ্যে দোলনায় গিয়ে বসতেই কেউ একজন, “ও জামাইগো” বলে চিৎকার করে উঠে। ভয়ে সুলেমান এলাহীর লুঙ্গি খুলে যাওয়ার উপক্রম হয়। সে ভয়ে আর সামনে এগোনোর সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু তার ভয় পাওয়া একদমই উচিত নয়। মানুষ জবাই করতে তার বুক কাপে না সে কিনা শেষে ছ্যামড়ি ভূতের ভয়ে কাবু হবে?চ্যাহ! সুলেমান এলাহী চেঁচিয়ে উঠে, “কেডারে? কোন বান্দির ঘরের বান্দির কাঁন্ধে রাতবিরেতে শয়তান ভর করছে?”
চারিদিক নিশ্চুপ হয়ে উঠল। এতক্ষণে এলাহী আন্দাজ করে ফেলেছে ওই শব্দ তার মনের ভুল ছিল। তবুও সে আর বসল না। উল্টো ঘরে যাওয়ার আগেই হুট করে তার লুঙ্গি কিছু একটার সঙ্গে বেঁধে গেলো। মেজাজ চটে গেল আবার। লুঙ্গি ছোটাতে যাবে তার আগেই হুট করে কেউ একজন বলে উঠল, “ইয়াং বেডা আই বাসর ইউ। লুক মাই দিকে। আই লুকিং ইউর বউ। চলো বেডা টুগেদার লাংমেন খাই।”
সুলেমান এলাহীর এক মুহুর্ত বুঝতে দেরি হলো না এটা যে ওই তাড় ছিঁড়া মহিলাটা। তার মতো জোয়ান ছেলেকে দেখে মানছে সবার পাগল হয়েই যাওয়ার কথা। কিন্তু তাই বলে এই মহিলার প্রতিবার লুঙ্গি ধরে টানাটানি বড় বিপদজনক। তার ওপর লুঙ্গির নিচে কিছু নেই। এইবার যদি খুলে যায় তাহলে ঝামেলা লেগে যাবে। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, “আরে ছাড় মহিলা। তোর লগে বাসর করমু না। ঘরে কি তোর জামাই নাই? খালি মাইনষের ইয়ে…লুঙ্গি ধরে টানাটানি মারাও। ছাড় বু্ড়ি ছাড়।”
“নট আমি বাসর করিং মানে করিং।”
“তোর বাসরের নানির গুষ্টি লাড়ি।”
চিত্রা ফারাজকে লুঙ্গি পড়ায়। তাও অনেক জোরজবরদস্তি করে। শেষে ফারাজ এক প্রকার বাধ্য হয়ে এই রাতের বেলা লুঙ্গি পরে। কি একটা অবস্থা। যেখানে পুরো বাড়ির মানুষ এখন ঘুমাচ্ছে সেখানে এই রাতের বেলায় তার বউ তার ওপর জুলুম করছে। মনে মনে একটা গান ধরে চিত্রাকে বলতে ইচ্ছে করছে, ❝জানলে আগে এমন মাইয়া করতাম না বিয়া। সর্বনাশ কইরাছি পায়ে কুড়াল মারিয়া। সুখে কত আদরে,রাখি ভাত কাপরে। আমার সাথে টেক্কা মারে আমারি ঘরে।❞
চোখ কুঁচকে চিত্রাকে জিজ্ঞেস করল,”এই বউ এই লুঙ্গি আবার খুলে যাবে না তো?”
চিত্রা হেসে গালে মৃদু ছুঁয়ে বলল,”যাবে না গো। ভালো করে গিট দিয়েছি। খোলার চান্স ০০ %।”
ফারাজ বিরক্ত গলায় বলল,”হয়েছে? এবার খুলে ফেলি?”
চিত্রা গম্ভীর মুখে বলল,”এই না। ইশরে পুরোই এখন জমিদার জমিদার লাগছে। জমিদার বাড়ির ছেলে হয়ে সেজে থাকেন ইংরেজি চেংড়াদের মতোন। ঢং দেখলে বাঁচি না।”
ফারাজ হেসে বলল,”তাহলে মরে যাও।”
চিত্রা ফারাজকে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। ইশরে চোখ ফেরানো দায়। পৃথিবীর মানুষ নারীর সৌন্দর্যের কথা বলে অথচ খোদা পুরুষকে এতটা নিখুঁতভাবে তৈরি করেছে সেই কথা কোথাও কেউ বলে না কেনো? চরম অন্যায় এটা।
চিত্রা হঠাৎ পেছন থেকে বলে উঠল,”বাহিরে বৃষ্টি আসবে ফারাজ। অনেকদিন ধরে ছাদে যাওয়া হয় না। চলুন আজকে যাই।”
চোখের কোনে একরাশ আবদার মেখে থাকা সেই কণ্ঠস্বরের অবমাননা ফারাজের পক্ষে সম্ভব হলো না। মুচকি হেসে চিত্রার হাত ধরে ছাদের দিকে পা বাড়াল। ছাদের দরজা খুলতেই বাইরে ঝড়ের পূর্বাভাস। বাতাস থমথমে, আকাশ জড়ো করে রেখেছে অগণিত বৃষ্টি। ফারাজ ছাদে পা রাখতেই হঠাৎ করেই বৃষ্টি ঝেঁপে নামল। হাওয়ার ঝাপটায় তার গা ভিজে গেল। সে দু’হাত মেলে প্রাণভরে এক নিশ্বাস নিলো। তারপর চিত্রার দিকে না তাকিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো, বৃষ্টিবিলাশে মাতোয়ারা হই!”
চিত্রা বহুক্ষণ ফারাজকে জড়িয়ে ধরে রাখল। কিছু কিছু শান্তি হয়তো ক্ষুদ্রতায় নিহিত। আমরা মানুষ সামান্য খুশীর জন্য মাইলের পর মাইল অতিক্রম করি। অথচ আসল খুশী তো আমাদের চোখের সামনেই থেকে যায়। চিত্রার ঠান্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে। তবুও সে জড়িয়ে আছে ফারাজের আষ্টেপৃষ্ঠে।
চিত্রার কাঁপুনি অনুভব করে ফারাজ ধীরে বলল,”আগুন সুন্দরী?”
চিত্রা চোখ কুঁচকে তাকায়,”কি?”
ফারাজ দম চেপে বলে,”চলো রুমে যাই। এমনিতেও লুঙ্গিকে দিয়ে ভরসা নেই আমার। কখন না জানি আবার খুলে যায়। ঝড়ের কবলে তো প্রায় লুঙ্গি উড়ে যাওয়ার দশা হয়েছিল। ভাগ্যিস নিচে সুরক্ষাবস্ত্র ছিল।”
চিত্রা হেসে বলে,”চিন্তা নেই সেইফটিপিন লাগিয়ে দিয়েছি তো। কিচ্ছু হবে না। আর এখন জলে ভিজে গিয়েছে। উড়ে যাওয়ার ভয় নেই।”
ফারাজ হালকা দম নিয়ে জিজ্ঞেস করে,”তাও ঠিক কিন্তু লুঙ্গির নিরাপত্তা দিতে সেইফটিপিন লাগিয়েছো টা কিসের সঙ্গে? তা তো খেয়াল করা হলো না।”
চিত্রা একটু মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ টিপে বলে,”ওই যে আপনার সুরক্ষাবস্ত্রের সঙ্গে।” বলেই চিত্রা হেঁসে উঠে। হাসছে সে আর লাগছে ফারাজের। কেমন কেমন জানি লাগছে। যদিও লজ্জা মোটেও লাগছে না। কারন ওইসব ছোটোলোকদের লাগে। আর এমনিতেও পাপিরা লজ্জাহীন জীব। ফারাজ অন্ধকারের মধ্যে একবার লুঙ্গির দিকে তাকায়। মনে মনে বলে,” এই বউয়ের চক্করে পড়ে তার মতো বিদেশ কাঁপিয়ে আসা পুরুষ মানুষকে নাকি এখানে এসে সেইফটিপিন দিয়ে লুঙ্গি পড়তে হচ্ছে?”
হঠাৎ ফারাজের ফোন বেজে ওঠে। রিংটোনের আওয়াজে চিত্রা একটু চমকে ওঠে।
“তুমি যাও, আমি একটু দাঁড়াই,” বলে ছাদের কিনারে এগিয়ে যায়।
ফারাজ ছাদের দরজার দিকে যায় কল ধরার জন্য। ঠিক তখনই সে অনুভব করে। কেউ পেছন থেকে তার লুঙ্গিতে টান দিয়েছে।
“এই… কে রে?!”চোখ বড় হয়ে যায় তার।
কিন্তু কিছু বোঝার আগেই সে টের পায় লুঙ্গি তার শরীর থেকে খুলে বেরিয়ে গেছে! একটা হাওয়ায় উড়ন্ত কাপড়ের মৃদু শোঁ শোঁ শব্দ… আর সাথেই তার পুরুষত্বে শেষ ভরসা হিসেবে থাকা নিচের সুরক্ষাবস্ত্র
নিরাপত্তায় নিজেকে কিছুটা সান্ত্বনা দেয়। ফারাজ ফোনের টর্চ অন করে পেছনে তাকায়। ফারাজ ফোনের লাইট অন করতেই দেখে দরজার পেছনে বসে আছে লুঙ্গি পড়া অভ্র। ফারাজ চাইতেই অভ্র ঢোক গিলে বলে, “সরি ভাই এখানে আমার বউ আসার কথা ছিল। বউকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য চিপায় বসেছিলাম। ভুল করে তার শাড়ি ভেবে আপনারটা টান দিয়ে ফেলেছি।”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫২
ফারাজ একধাক্কায় এগিয়ে আসে,”আয় এবার তোরটা খুলি শালা।”
ফারাজ এগিয়ে আসতেই অভ্র মুখে হাত দিয়ে বলে উঠল, “ভাই আগে লুঙ্গিটা তো পড়েন।”
ফারাজ একহাতে নিজের সুরক্ষাবস্ত্রসামলাতে সামলাতে বলল, “ব্যাটা নিজেরটার দিকে তাকা। আমারটার দিকে এত নজর কিসের? আমি এমনেই থাকবো। তুই ওদিক ঘুর।”
“হিহি ভাই দেখে ফেলছি আইমিন কিচ্ছু না।”