চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৫
ইশরাত জাহান জেরিন
জমিদার বাড়ির আদলে গড়া দোতলা প্রাসাদোপম বাড়িটির সামনে রাতের নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে আছে এক সাদা পাঞ্জাবি পরা বয়ষ্ক লোক। চারদিকের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। বাতাসে হাওর অঞ্চলের কাঁচা-পঁচা গন্ধ আর মাটির ভেজা সুবাস।
লোকটি স্থির নয়নে চেয়ে আছে বাড়িটার দিকে। যেন এক বিস্মৃত আত্মীয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই বাড়ি, এই বাজিতপুর, এই হাওর অঞ্চল সবকিছুই তার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। তার শিকড় এই মৃতপ্রায় ইমারতের গাঁথুনিতেই গাঁথা। বাড়িটির সামনের প্রাচীন নামফলকটা বহু আগেই পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ চেহারায়। বাইরের দেওয়াল জুড়ে কালচে সবুজ শ্যাওলা, বৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে প্রতিটি ইটের গাঁথুনি। দরজাগুলো কাঁপা কাঁপা, গায়ে কাঠের ফাটল, কোথাও কোথাও লোহার কড়িকাঠে মরিচা ধরে রক্তচাপের মতো লালাভ দাগ। দোতলা ভবনের বিশাল বারান্দা আর পাকদণ্ডি ঘোর সিঁড়ি দেখেই বোঝায় কতটা রাজকীয় ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একসময়। দেয়ালের ক্যালেন্ডার হয়তো আজও আটকে আছে সেই দিনটাতে যেদিন সে শেষবার এই বাড়ির গন্ধ শুঁকে ফিরে গিয়েছিল দূরদেশে। দশ বছর পর আবার সেই ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। ফিরে এসেছে পূর্বপুরুষের ভিটায়, যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি জানালা, প্রতিটি শূন্যতা তাকে চেনে। লোকটি এগিয়ে যায়। সদর গেট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সেই তালাবদ্ধ বাড়ি অথচ বাড়িভর্তি মানুষ গুলো আজ বিচ্ছিন্ন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রথম তলায় বড়সড় বারান্দা। সেখান থেকে একজোড়া মোটা পিলার উঠে গেছে দোতলা পর্যন্ত। পিলারগুলো একসময় হয়তো সাদা রং করা ছিল, এখন কেবল ছোপ ছোপ ফাঙ্গাস আর ধুলোর আস্তরণ। জানালাগুলো লোহার গ্রিলে ঢাকা। কিছু ভেঙে গেছে, কিছু অর্ধেক খোলা পড়ে আছে। দোতলায় উঠার সিঁড়িটা বাইরের দিকে। পাকদণ্ডির মতো ঘুরে ঘুরে উঠেছে। ধাপে ধাপে জমে থাকা শেওলা আর ভেজা পাতার স্তূপে কেউ পা রাখলেই পা পিছলে যাবার ভয়। ছাদের কার্নিশ ভেঙে গেছে অনেকখানিই।
উপরের বারান্দায় উঠে সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ে দরজার সামনে। মোটা কাঠের দরজাটায় এখনো লেগে আছে একটি মরচে ধরা লোহার তালা বহু বছর কারো স্পর্শ পায়নি। সে পরে থাকা ইট দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করল। তালাটা প্রথমে একটু নড়ল। তারপর ধাতব একটা চিৎকারে ভেঙে পড়ে নিচে। দরজা খুলতেই ধূলির ঝাপটা নাকে মুখে এসে লাগল। লোকটির চোখের সামনে হারানো স্মৃতি, শৈশব ভেসে উঠল। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল জল। একটা নিশ্বাস নিয়ে সে বললেন, “অনেক হয়েছে এবার বাড়ির মালিক বাড়িতে ফিরবে। আর পালালে চলবে না। খুনের বদলা খুনের মাধ্যমেই নেওয়া হবে।” বলতে না বলতেই একটা কল আসে লোকটির ফোনে। ফোন তুললেই ওপাশ থেকে একটা পুরুষালী গম্ভীর গলা ভেসে আসল, “বাবা তুমি বাজিতপুর গিয়েছো?”
লোকটি চোখ না সরিয়েই উত্তর দেয়,
“হুম।”
“তোমাকে বলেছি না এখানে এখন আসার দরকার নেই? আমি আছি তো!”
সে ঠান্ডা গলায় বলে,”তোমাকে একজনকে আগলে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই দায়িত্ব না হয় পালন করো। বাড়ির মানুষ আমার বাড়িতে যেন সুস্থ ভাবে ফিরত আসে।”
“কিন্তু বাবা…”
“কোনো কিন্তু নয়। এবার আমরা খেলবো ওরা খেলনা হবে। আমার লাশ চাই, লাশ। এই ঝামেলা জলদি শেষ হলে তোমার বিয়ে হবে। এই বাড়িতেই। সেই মতো তৈরি রেখো।” বলেই লোকটি ফোন কেটে দিল। সরু চোখ নিয়ে অন্ধকার ঘরে আবারও কিছু ফেলে রাখা জটলা খোলার চেষ্টা করল আনমনে। ফোনের টর্চটা ইচ্ছে করছে বন্ধ করে দিতে। তবে করল না। ধ্যান ধরে চেয়ে রইল সেভাবেই।
নিশুতি রাত। বাতাসে ছড়িয়ে থাকা মাছ আর মাটির ঘ্রাণকে চাপা দিয়ে কালো নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে কুকুরের মতো একটা নির্বিকার নৈঃশব্দ্য।
লঞ্চ তখন চরের কিনারা ঘেঁষে যাচ্ছে। দূরের কুয়াশায় ঢাকা গাছপালার ফাঁক দিয়ে জোনাকিরা ভেসে বেড়াচ্ছে। কারন তাই হলো আঁধারের চেনা পাহারাদার। লঞ্চের নিচতলায় গুদামঘর। নিঃসাড়, বদ্ধ, ঘামে-তেল-মাছে গন্ধ মেশানো নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়া জায়গা। ধাতব জং ধরা দরজার ওপারে কেরোসিনের আলো টিমটিম করছে। সেই আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে দুটো নিথর দেহ। তাদোর কাপড়চোপড় রক্তে ভেজা। থমকে যাওয়া দুটো জীবন কংক্রিটের মেঝেতে পড়ে আছে।লাশ দু’টোর পেট কেটে নদীর কালো জলে ফেলে দেওয়া হবে। সোহানদের এখানে নতুন কিছু ছেলেপেলে নেওয়া হয়েছে। কাজগুলো তাদেরকেই করতে দেওয়া হয়েছে।
সিফাত যদিও দেখিয়ে দেওয়ার জন্য আছেই। মুইন নামক সেই ছেলেটিকে আজ বিশেষ ভাবে কাজ করতে বলা হয়েছে। সিফাতের মাঝে মাঝে এই মুইনকে দেখলে গা জ্বলে। ঠিক সহ্য হয় না। কারন আছে যদিও। এই যে মুইন নামক ছেলেটা এখানে আসার পর সোহান তাকে তেমন কোনো কাজও করায় নি। আসলে ওইযে শুনেছে মুইনের ছোট্ট একটা বোন আছে। ঠিক যেমন সোহানকে ওই বেঁধে মেয়ে ভাই বলে ডাকে ঠিক তেমন করেই তো ছোট্ট মেয়েটা মুইনকে ভাই বলে ডাকে। আর কোনো না কোনোভাবে সোহান নিজের একটা অসহায় প্রতিচ্ছবি হয়তো মুইনের ভেতর দেখতে পায়। তাই বোধ হয় অন্যদের থেকে মুইনের প্রতি তার এত কদর। মুইন এখনও শক্তপোক্ত হয় নি। রক্ত দেখলেই তার বমি আসে। তাই সোহান তাকে নিহান শেখের সঙ্গে জাহাজের কাজে পাঠিয়েছিল। তবে মাঝে মুইনের বাবার শরীর বেশি খারাপ হয়ে যায় বিধায় ফিরতে হয় তাকে। সোহান তাকে ফিরে আসতে বলে। সিফাত দাঁড়িয়ে সিগারেটের ছাই ঝাড়ে। ঠোঁটে অম্লান বিদ্রুপ, “এইবারও পেট কাটতে পারবি না? তোরে ভাইজান হুদাই টাকা দেয়। তাও এত্তগুলা। তুই কোনো কামের না। খালি করোস ভুল। অপেক্ষায় আছি তোর গায়ে কাফন পড়ানোর। যেইহারে ভুল করতাছিসরে বেশি দিন আর বাঁচবি না।”
মুইন কিছু বলে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। কেরোসিন বাতির আলোয় তার মুখে ভয়ের ছাপ। হাতে কাঁপতে থাকা চেহারায় মানুষজনের জন্য বেঁচে থাকা একটা মানবিক লজ্জা। একজন মানুষের পেট কেটে ভেতরের নাড়িভুঁড়ি বের করে নদীতে ফেলা, এই কাজ তার মনোজগতে এখনও দুঃস্বপ্ন। তবু চাপাতিটা তুলে নেয়।
“কিরে শুরু কর।” সিফাত গম্ভীর গলায় বলে। সিফাতের কন্ঠ অনেকটা ভারী। হুট করে কেউ গলার শব্দ শুনলে মুগ্ধতায় ভুগবে। শ্যামবর্নের লম্বামতো পুরুষ। তার এলোমেলো চুলগুলো দুর্দমনীয়। তীক্ষ্ণ চোখে সামনের মানুষকে বিভ্রান্ত করার বিশেষ ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। চোয়ালের গঠন দৃঢ়। হাসলে গালের কোনায় মৃদু ভাঁজ পড়ে। বুকখোলা শার্টের মধ্যখানে ভেসে ওঠা বুকের লোমশ পশমগুলো বেশ আকর্ষিত। জিন্স প্যান্টের প্যাকেটে টাকার থেকেও সিগারেট আর লাইটার বেশি পাওয়া যায়।
মুইন একবার চোখ বন্ধ করে। বুক ঠেলেই ঢোক গিলে। চাপাতির হ্যান্ডেলে তার আঙুল শক্ত করে চেপে ধরে। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মারিয়ার শরীরের কাছাকাছি নিয়ে আসে ধারালো ধাতব সেই অস্ত্রটি। কিন্তু ঠিক তখনই সিফাতের ফোন বেজে ওঠে। সিফাত বিরক্ত মুখে ফোনটা কানে তোলে। ওপার থেকে কেউ কিছু একটা বলে, আর তার চোখের রঙ মুহূর্তে বদলে যায়। সিফাত এক লাফে বলে উঠে,
“থাম!”
মুইনের হাত ঝাঁকি খায়। চাপাতির ধার ঠিক মারিয়ার পেটের উপরে থেমে যায়। এক চুল নিচে নামেনি।সিফাত ঘেমে ওঠে। দেরি না করে গুদামঘর থেকে বেরিয়ে সোজা দৌড়ে ওঠে ওপরে, লঞ্চের ক্যাবিনের দিকে। তখন গভীর রাত। চারদিকে নীরবতা। নদীর ক্ষীণ ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া কিছু নেই। সোহান ক্যাবিনে। গায়ে গামছা মুছে লুঙ্গি পরে শুতে যাবে বলে প্রস্তুত হচ্ছিল। দরজায় তীব্র ধাক্কা পড়ে। সে বিরক্ত হয়ে দরজা খোলে।
“তোরে কইছিলাম, আজ কেউ বিরক্ত করবি না। ভালো লাগতাছে না আমার, আজ ঘুম দিমু।”
সিফাত এক দমে বলে, “ভাই… খবর আছে। খুব জরুরি।”
সোহানের চোখ সরু হয়ে যায়। “কি?”
সিফাত দম আটকে আসা গলায় বলে, “মাহাদী আর মারিয়া… চিত্রার ভাই-ভাবী।”
“কিহ!”
রোশান আর ফারাজ পাশাপাশি বসে আছে। মাঝরাতে রাস্তার পাশের বটতলায়৷ একটা ছেলে এসে দুইকাপ চা এনে দিয়ে গিয়েছে। ফারাজ সিগারেট ধরিয়ে রোশানকে বলল, “দিবেন নাকি একটা টান?”
রোশান সিগারেটটা হাতে নিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়ল। ফারাজ একবার গাড়ির দিকে তাকালো। ফুলি সেথায় ঘুমিয়ে আছে। অনেক কান্না করছিল মেয়েটি। রোজ অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছে। যাক এই মেয়ে ভালো মা হতে পারবে হয়তো। তবে ফারাজের এখনও মনে আছে এই রোজ একবার সেই শিশু বয়সে ফারাজের গায়ে পটি করে দিয়েছিল। আসলে বিষয়টা এমন বললেও ভুল হবে। মেইড তখন রোজের ড্রায়পার বদলাবে। এরই মাঝে অভ্র এসে ছোট্ট রোজকে চিমটি মেরে দেয় এক দৌড়। রোজ কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ লাল হয়ে উঠে। ফারাজের বড্ড মায়া হয়। তবে সেই মায়া হওয়াটাই কাল হয়েছিল জীবনের। কোলে নিতেই ওই ধবলরোগী কিনা ফারাজের গায়ে পটি করে দিলো। সেই দিনের কথা ভাবলেই গায়ে কাটা দেয়। তারপর থেকে ফারাজ রোজকে কেন? ইহো জগতের আর কোনো বাচ্চাকেই ড্রায়পার ছাড়া কোলে নেয় নি।
রোশান একটু গম্ভীর গলায়। চায়ের কাপের ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ফারাজকে জিজ্ঞেস করে, “ফারাজ তোর বউও যদি তোরে না ভালোবাইসা তার দেবররে ভালোবাসত? তাহলে তুই কি করতি?”
ফারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর ব্যঙ্গভরে হেসে বলে,”কাকে জোহান শালাকে? কি আর করতাম বলেন? জাস্ট ছবিতে গাদা ফুলের মালা চড়িয়ে দিতাম। তবে তাই বলে এই ভেবে আমার ছবিতে যেন আপনার মালা পড়ানোর শখ না জাগে। ওইসব কিন্তু ছোটলোকি কারবার ভাই।”
রোশান গলা নিচে নামিয়ে বলে,”মোহনা কেন আমারে ভালোবাসলো না?”
ফারাজ এক ঢোকে পুরোটা চা শেষ করে বলল,”কারন ওই মাতারির নজর আমার মতো আলাভোলা মানুষের দিকে ছিল। মহিলা মানুষ পুরুষ মানুষের দিকে এমন ভাবে নজর দেয় যেমন ভাবে নজর দিলে ডাইরিয়া, আমাশয়ও ফেইল।”
রোশান চোখ সরু করে। ঠোঁট চেপে ধরে বলে, “মজা নিস না। মেজাজ এমনিতেই ধাক্কা খেয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে।”
“আপনি চাইলে আমি আরেক ধাক্কা দিয়ে মেজাজকে নিচে নামিয়ে আনতে পারি।”
রোশান জবাব দিল না। তার জীবনের প্রথম ভালো লাগা,প্রথম ভালোবাসা ছিল ওই মোহনা নামক মেয়েটি। তবে কে জানত সেই মোহনা রোশানকে জীবনের মোহনায় এসে ছুঁড়ে ফেলবে? ঘরের স্বামীকে রেখে আঁড়চোখে যখন ফারাজকে দেখত তখনই এই হৃদয় ভেঙেচুর মার হয়ে যেত। জীবনে কখনও কোনো মেয়ের সংস্পর্শে যায় নি রোশান। যাকে মনে ধরবে তাকে নিয়ে জীবন বেঁধে স্পর্শ করবে বলে। কিন্তু হায় নিয়তি! কতবার মোহনার কাছে ভিক্ষা চেয়েছে প্রেম। নিজেকে ছোট করেও ভালোবাসা পাওয়া হলো না রোশানের। তবুও বেহায়ার মতো সেই প্রেমের আশায় আজও সে পথ চেয়ে রয়েছে। একদিন মোহনা সব ভুলে তাকে ভালোবাসবে।
তাকে বুঝবে,তার ভালোবাসা উপলব্ধি করবে। মরনের আগে হলেও একবার মোহনার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে চায় সে। ইশরে পৃথিবী কত নিষ্ঠুর। যেই ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে জীবন গুছাবে বলে কত স্বপ্ন বুকে লালন করবে করে রেখেছিল, সেই ভালোবাসাই তাকে পাপের দিকে ধাবিত করল। কই রোশানের মনে পরে না তো তার অতীতে সে কোনো পাপের সাথে জড়িয়ে ছিল। এলাহী বাড়িতে নেহাৎ ভদ্রলোকদের বসবাস নয়। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ এক একটি রহস্যের জট। বছরের পর বছর ধরে এই জট তৈরি হয়ে আসছে। এই বাড়িতে ভালো মানুষ এলেও হৃদয় পাপে ছেয়ে যায়। তবুও কেউ একজন জীবনে আসবে, তাকে ভালোরাখার জন্য হলেও জীবনে ভালো থাকতে হবে এই ভেবে কখনও রোশান কোনো পাপেই জড়ায়নি। রাজনের নারীদোষ সেই কম বয়স থেকেই। দশম শ্রেনীতে উঠেই মেয়ে মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।
তবে ইন্টারে ওঠার পর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়। তারপর সবটা নেশায় বদলে যায়। খারাপের এই দুনিয়ায় রোশান ভালো ছিল কিন্তু ভালোবাসা তাকে ভালো থাকতে দিল না। যেই জীবনসঙ্গীর জন্য পাপে জড়ায়নি সেই জীবনসঙ্গীই তাকে বাধ্য করেছে পাপের দুনিয়ায় যাওয়ার জন্য। তবুও আজও রোশানের এই মন অন্য নারী আকর্ষিত করতে পারে নি। এই চোখের সামনে যদি বিশ্বের সবচেয়ে অপরূপা নারীটিও উলঙ্গ হয়ে বসে থাকে তবুও রোশানের চোখ তার দিকে যাবে না। কারন মন জুড়ে যে মোহনা বিচরণ করছে। কি অশেষ ক্ষমতা সেই মহারানীর। তাকে ভুলার জন্যই তো রোশান নরকে নিজেকে ছুঁড়ে ফেলেছে তবুও মন থেকে মুছতে পারে নি। তবুও রোশান পাপী। ভয়ানক রকমের পাপী। মোহনার বাচ্চা অনেক পছন্দ।
এক কথায় বাচ্চার প্রতি তার বিশেষ ভালোবাসা রয়েছে বলা চলে। তাই তো মোহনা যতবার গর্ভবতী হয়েছে রোশান নিজ থেকে সেই বাচ্চা নষ্ট করে দিয়েছে। যদি রোশানের থেকে মোহনা সেই বাচ্চাকে বেশি ভালোবাসে? দেখতে দেখতে এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে মোহনার কোনো ভালোলাগার জিনিস রোশান সহ্য করতে পারত না। সে যাকেই ভালোবাসত তাকেই রোশান তার জীবন থেকে কেড়ে নিত। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এইসব করে সে মোহনার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আরো বেশি অযোগ্য হয়ে উঠেছে। তবে মোহনা সবচেয়ে বেশি যেই মানুষটিকে ভালোবাসত রোশান তাকে মারতে পারেনি। রোশান জানে ফারাজ তাকে পছন্দ করে না আবার অপছন্দও করে না। শৈশব জিনিসটা আসলেই সুন্দর। জীবনটা শৈশবেই ভালো ছিল। তবে হুট করে সব এলোমেলো হয়ে গেল একটা ঝড়েই। হায়রে ফারহাদ এলাহী তোমার তৈরি করা খেলার থেকে আজও এলাহী বাড়ির কেউ বের হতে পারল না।
এই রাতের বেলা চিত্রা পরপর চারটি কল করল ফারাজকে। রিং হয়েছে কিন্তু রিসিভ হয়নি। এই লোকের এমন হুটহাট বাইরে চলে যাওয়া,তাও রাতের বেলা আজকাল কেমন জানি লাগছে। এমন নয় যে চিত্রা সন্দেহ করছে কিন্তু তবুও। চিত্রা চুলে খোঁপা করে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। খিদে পেয়েছে তার। ওইযে আয়েশাকে বলল ঘনঘন খিদে পায়। আগে তো কোনোদিন এমন হয়নি? একগাদা খেলেও মনে হয় কিচ্ছু খায়নি। নিচতলায় জুনায়েদ এলাহীর রুম। ইদানীং জুনায়েদ এলাহীকে কোথায় দেখা যায় না। রান্নাঘরে যাওয়ার পথে তাকালেই কোণে তার রুমটা। চিত্রা পাত্তা না দিয়ে ফ্রিজের যত খাবার আছে সব বের করে। একবারে এসব রুমে কিছুতেই নিতে পারবে না। চিত্রার রুমে মিনি ফ্রিজ আছে। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ফারাজের এটা খেতে মন চায় ওটা খেতে মন চায়। তবে তার আর কি খাওয়া? বিদেশি বাবুর ঘাস-লতাপাতা খাওয়া। এখন চিত্রা তো আর মুখের ওপর বলে দিতে পারে না,”ওমন বিদেশে কাটানো ভ্যাদা মানুষগুলো যা খায় আমাদের দেশে সেইসব অবলা ছাগলছানারা খায়।” চিত্রা পেটের সঙ্গে বাজিয়ে যতটুকু জিনিসপত্র নেওয়া যায় একবারে সবটা নিয়ে নেয়। বের হতে যাবে হুট করে কিছু একটার শব্দে থমকে যায় তার পা। মাঝরাতে এত বড় বাড়িতে সাহস দেখিয়ে রাতের বেলায় রুম থেকে সে বের হয়েছে। ওইদিন জমেলা বুড়ি বলেছে এই বাড়িতে নাকি ভূত আছে। ভূতকে সে বাগানের দোলনায় দেখেছে। পুরুষ ভূত। সে আবার লুঙ্গি পরে। জমেলা করুণ চোখে চিত্রাকে বলে,
“জানো মাইয়া, এমনিতে তো আমি মেলা সুন্দর মানুষ। আম্মায় কইছে আমি যখন তার পেটে ছিলাম তখন নাকি এক বয়স্ক মহিলা আম্মার পেট দেইখাই বুঝছে আমি পরির লাহান ঢকের হমু। ওই বুড়ি তো আমি পেটে থাকতেই তার ব্যাটার বউ বানাইতে চাইছে আমারে। তারপর আর কী! হইলাম আমি। হওয়ার পর থেকেই বিয়ার প্রস্তাব আর বিয়ার প্রস্তাব। শেষে আম্মায় আমার মুখে রোজ আলকাতরা মাখাইয়া রাখতো। যাতে কেউ পছন্দ না করে,বিরক্তও না করে। কিন্তু শাক দিয়া কি মাছ ডাকোন যায়? মানুষরে না হয় বোকা বানান যায় কিন্তু জিনেগোরে? জানো জিনের সর্দার আমার ওপর ৩৪৪ ধারায় ফিদা হইয়া গেছিল। তাও সব ছাইড়া কালুর বাপরেই বিয়া করলাম। বুঝোনা ভেরি মাচ লাভিং করি। কিন্তু ওইদিন রাতে বাগানে গিয়া বুঝতে পারলামরে চিত্রা, ওই জিনের সর্দার আমার ওপর এখনও মরি মরি যায়। রাতে একা পাইয়া আমারে ইজ্জর হরণ করতে আইছিল। এক্কেরে লুঙ্গি পাইরা ফিটফাট হইয়া আইছিল। দিছি লুঙ্গি ধইরা টান। খালি ইজ্জত বাঁচাইয়া দৌড়ের ওপর পোলাইছে।” বলেই জমেলা মিটিমিটি করে হাসল শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে। চিত্রা মেকি হেসে বলল, “সেই আলকাতরা মনে হয় এখনও দেন তাই না? মুখ দেখলেই বোঝা যায় কতবড় সৌন্দর্য এখনও লুকিয়ে রেখেছেন।”
“মাইয়ার ইউর মাথায় মার্কামারা বুদ্ধি দেহি। যাই হোক আসলে নটি বয়েরা ডুস্টাব করে তো তাই মুই আমার আসল সৌন্দর্য লুকাইয়া চলি। ইউ কিন্তু আমারে ইউর মতো কালা ভাইব না। সময় কইরা আইসো দুধের লাহান ধলা হওয়ার হারবাল দিমু নি। বুজাই না ব্যাডা মানুষ আবার কড়া জিনিস পছন্দ করে। নইলে সংসার টিকোন মুশকিল।”
চিত্রা কোনোমতে হাসি চেপে সেদিন কেটে পড়েছিল। কিন্তু আজ তো মনে হচ্ছে সেই ভূতের বিষয় এক্কেবারে সত্যি। চিত্রার কানে একটা শব্দ আসছে। কেমন শব্দ সে ধরতে পারছে না। হুট করে একটা মেয়েলি গলার চিৎকার কানে এলো। কেবল একটাই। তারপর আর নয়। কিন্তু ওই মেয়েলি গলা জুনায়েদ এলাহীর ঘর থেকে কেন আসল? চিত্রা খাবার সঙ্গে নিয়েই জুনায়েদ এলাহীর রুমের দিকে এগোতে যাবে তার আগেই হুট করে এক পলকেই কেউ একজন তার স্টারশিপের ম্যাংগো জুস নিতেই চিত্রা হুট করে বলে উঠল, “কোন ম্যাংগোরভাই আমার জুসের হাত দেয় সে।”
পাশ থেকে মৃদু হাসিতে কেউ একজন বলল,”ওয়াও সুন্দরী ভাবির মুখের গালিও দোয়ার মতো শুনতে লাগে। তবে গালি এত ঘুরিয়ে দেওয়ার কি আছে? দেশের কোনো আইন আছে নাকি? যে সহজ গালিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে? স্বাধীন মানুষ স্বাধীন ভাবে গালি দিবেন। যাতে আপনার গালি ওরফে দোয়া গুলো শুনে মানুষ হাঁটতে হাঁটতে স্বর্গে চলে যেতে পারে।”
চিত্রা এবার ভালো করে তাকিয়ে বলল,”আরে জোহান ভাই! আপনি? আমি আরো ভাবলাম কে না কে?”
“কেন অন্য কাউকে আশা করেছিলেন নাকি? কারো আসার কথা ছিল বুঝি?
চিত্রা আরো একবার জুনায়েদ এলাহীর রুমের দরজায় তাকায়। তারপর না ভেবেই জোহানকে বলে, “আমি রুমে গেলাম ভাই।”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৪ (২)
“চলুন ভাবী আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি জাহান্নামে” মনে মনে কথাটা বলেও জোহান মুচকি হেসে বলল, ” এত জিনিস! একা পারবেন না। মে আই হেল্প ইউ মাই ডিয়ার ভাবী?”