চেকমেট পর্ব ২৩

চেকমেট পর্ব ২৩
সারিকা হোসাইন

সারফরাজ এর পেশীবহুল হাতের উপর শূন্যে ঝুলে আছে রূপকথা।সারফরাজ এর বলা শেষ কথা গুলো যেনো কানে ভুল শুনলো সে।বার কয়েক পলক ঝাপটিয়ে সারফরাজ এর চোখে চোখ রাখতেই বড় বড় চোখ দুটো জলে টইটম্বুর হলো।তাদের লুকানোর বিন্দু পরিমাণ চেষ্টা করলো না রূপকথা।সারফরাজ এর ঘোলাটে আকাশি চোখ জোড়া গভীর ভাবে পরখ করলো রূপকথা।অদ্ভুত চোখ জোড়া আগের মতোই সুন্দর আর গভীর।যেনো স্বচ্ছ সমুদ্র।এতদিন বাদে সারফরাজ কে ফিরে পেয়ে রূপকথা হুহু করে কেঁদে উঠলো।দুই হাতের আজলায় সারফরাজ এর খোঁচা খোঁচা দাড়ি যুক্ত মুখশ্রী ভরে নিয়ে ব্যকুল হয়ে শুধালো

“কেমন আছো তুমি?অনেক বড় হয়ে গেছো।
রূপকথার প্রশ্নে কেমন কেঁপে উঠলো সারফরাজ এর প্রশস্ত বুক।সত্যিকারের অর্থে কেমন আছে সে?আদেও কি এর উত্তর বলা উচিত
“আমি ভালো আছি?আদেও আমি ভালো আছি?কই আমি তো ভালো নেই।এভাবে নিঃসঙ্গ একাকী কেউ ভালো থাকতে পারে?
মনের কথা মনেই মাটি চাপা দিলো সারফরাজ।মন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের দল কেও কঠিন ভাবে স্থির করলো এই নিষ্ঠুর মানব।গলার এডাম আ্যপল ক্রমাগত উঠানামা করছে।বিষাদেরা চিৎকার করে কন্ঠনালী ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।কিন্তু প্রশ্রয় দিলো না সারফরাজ।বিষিয়ে উঠা কম্পিত গলাকে স্বাভাবিক করে প্রত্যুত্তর করলো
“ভালো আছি রূপকথা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সারফরাজ এর চোখে রূপকথার দৃষ্টি এখনো নিবদ্ধ।লালচে ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে বলা ভালো আছি কথাটা মিথ্যে মনে হলো রূপকথার কাছে।চোখ জোড়া ভিন্ন কথা বলছে।কেমন অসহায়ত্বের ছাপ তাতে।কিন্তু ঘাটালো না রূপকথা।তপ্ত শ্বাস ফেলে নিচু হয়ে বিছানার নরম তোষকে রূপকথাকে বসালো সারফরাজ।এরপর নিজে বসলো রূপকথার পায়ের কাছের মেঝেতে।ঠিক বারো বছর আগে যেমনটি বসতো।সারফরাজ এর সেট করা ঝলমলে চুলে অল্প হাত বুলালো রূপকথা।আবেশে চোখ বুজে ফেললো সারফরাজ।পরক্ষণেই নিজের হাত গুটিয়ে রূপকথা কান্না মিশ্রিত হাসলো অল্প।এরপর বললো
“এতো গুলো বছরে একবারও আমায় দেখতে এলেনা?
“এসেছিলাম।যখন তোমার বয়স আট তখন।
“সামনে এলে না কেনো ?
“ভয়ে।
“কিসের ভয়?

“ছাড়তে চাইতে না।আর আমি চাইনি একজন খুনির ছায়া তোমার উপর পড়ুক।আমি বড্ড অশুভ আর অলুক্ষণে রূপকথা।
সারফরাজ এর এহেন নিষ্ঠুর কথা শুনতে চাইলো না রূপকথা।দুই হাতে নিজের কান দুটো চেপে ধরে বলে উঠলো
“চুপ করো।এসব শুনতে চাই না।
তাচ্ছিল্য হাসলো সারফরাজ।কিন্তু প্রত্যুত্তর করলো না।রূপকথা সারফরাজ এর হাত দুটো চেপে ধরে নিজের কপালে ছুঁইয়ে নীরবে কেঁদে উঠলো।উষ্ণ জল ধারা সারফরাজ এর হাত দুটো কেমন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।সেই সাথে পুড়ে খাক হচ্ছে নিষ্ঠুর হৃদয় টাও। এই যন্ত্রণা সয়ে নিতে পারছে না সারফরাজ।তাই সে হাত টেনে সরিয়ে নিতে চাইলো ।কিন্তু রূপকথা ছাড়লো না।
“পালাতে চাইছো?

সিক্ত গলায় প্রশ্ন করলো রূপকথা।রূপকথার প্রশ্নে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সারফরাজ।আজ যেনো তার মুখের কথা গুলো কেউ বন্দি করে নিয়ে গেছে।চাইতেও একটা টু শব্দ করতে পারছে না।তার প্রতিনিয়ত মনে হচ্ছে গলার মধ্যখানে কেউ শক্ত হাতে চেপে ধরেছে।সেই কঠিন হাতের বাধন ফস্কে একটা শব্দ পর্যন্ত ঠোঁটের আগায় গড়াচ্ছে না।
সারফরাজ এর নীরবতায় রূপকথা আবারো বলে উঠলো
“কোথায় ছিলে এতদিন?
অস্ফুট গলায় সারফরাজ বললো
“রাশিয়া।
কথাটা পুরোটাই মিথ্যে।কিন্তু সে সত্যি চেপে গেলো।সারফরাজ এর হাত ছেড়ে দিয়ে দুই হাতের করপুটে চোখের জল মুছলো রূপকথা।এরপর মাথা নিচু করে ধীর গলায় বলতে লাগলো―
“পাপা ক্যালিফোর্নিয়ার সেই আংকেল এর থেকে অনেক খোঁজ করেছে তোমার।কিন্তু তোমাকে পায়নি।আমার প্রতিমুহূর্তে মনে হতো তুমি আমার খুব কাছে কুলে আছো।একদিন ঠিক ফিরে আসবে তুমি।অপেক্ষার ফল মিষ্টি তাই না?

সারফরাজ অল্প করে বললো
“হু।
“আবার ফিরে যাবে রাশিয়া?
“হুম
“কবে?
“খুব দ্রুত!
“আমাকেও সঙ্গে নেবে?
আকুলতা মিশ্রিত অনুরোধ করলো রূপকথা।অনুভূতি হীন বুকটা কেমন ভেঙে এলো এবার সারফরাজ এর।এই আবদারের উত্তর কি?কিছুক্ষণ নীরব থেকে সারফরাজ বললো
“ওখানে বড্ড অন্ধকার রূপকথা।অন্ধকারে মনস্টার থাকে।তুমি না অন্ধকারে ভয় পাও?
সারফরাজ এর বোকা উত্তরে কিঞ্চিৎ শুকনো হাসলো রূপকথা।এরপর শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জিভের অগ্রভাগে ভিজিয়ে বললো

“মনস্টার বলতে কিছুই নেই।আমি এখন বড় হয়ে গেছি সারফরাজ।আমার বয়স এখন আঠারো।ওসব ছেলে ভুলানো কথা বলে আর পালাতে পারবে না তুমি।
রূপকথার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে ঠোঁট টিপে হাসলো সারফরাজ।এরপর রূপকথার পানে তাকিয়ে বলল
“আমি তোমার জন্য ক্ষতিকারক রূপকথা।আমার সামনে এতো এসো না।পড়ে পস্তাবে।আমি মানুষরূপী শয়তান।আমার ভেতরে কোনো হৃদয় নেই।যা আছে সব অঙ্গার দগ্ধ কয়লা আর ছাই।
“ওই কয়লা আর ছাই আমি পরিস্কার করতে চাই।
“পারবে না।
বলেই উঠে দাঁড়ালো সারফরাজ।এরপর বেলকনি দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেললো।আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে।এলোমেলো বাতাসে জানালা দরজার কার্টেন গুলো হুড়োহুড়ি করে উড়ছে।গাছের ডাল পালা দুমড়ে মুচড়ে একাকার।অল্প কিছুক্ষণ এর মধ্যেই খুব ভারী বর্ষণ ঝরবে মনে হচ্ছে।বেলকনি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ভারী গলায় সারফরাজ বললো

“বাড়ি ফিরে যাও রূপকথা।
সারফরাজ এর কথাটা কেমন কঠিন শোনালো।এভাবে তাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে সারফরাজ?কিন্তু কেনো?.
রূপকথাকে নির্ভার দেখে সারফরাজ আবারো বললো
“বৃষ্টি আসবে।বাড়ি ফিরে যাও।
“তাড়িয়ে দিচ্ছ?
ভঙ্গুর গলায় শুধালো রূপকথা।সারফরাজ উত্তর দিলো না।শুধু ফাঁকা দৃষ্টিতে রূপকথার পানে তাকিয়ে রইলো।রূপকথা জেদি মেয়ের মতো বললো
“তোমার থেকে কোত্থাও যাবো না আমি।
“কেনো থাকবে আমার কাছে?এভাবে চাইলেই একটা ছেলে আর একটা মেয়ে থাকতে পারে?মানুস কি ভাববে?
“যাই ভাবুক আমি যাবো না।

বলেই খাটের উপর শক্ত আসনে বসলো রূপকথা।রূপকথার এহেন পাগলামো কান্ডে বাঁকা হাসলো সারফরাজ।
“তুমি আর ছোট টি নও রূপকথা।বাড়ি ফিরে যাও।
“তবে তুলে এনে ছিলে কেনো রাস্তা থেকে?ওখানেই ফেলে চলে যেতে।বাবা মায়ের সাথে সাথে আমিও মরে যেতাম।কেন দিলে নতুন করে জীবন?আমি বলেছিলাম আমাকে বাঁচাতে?
চিৎকার করে কথা গুলো বলে দুই হাতে মুখ ঢেকে আবার কেঁদে উঠলো রূপকথা।সারফরাজ যেনো মহা মুশকিলে পরলো।এবার উপায় কি তবে?এই মেয়ে তো কিছুই বুঝতে চাইছে না।বড় হয়ে এমন মাথা মোটা হলো কি করে এই মেয়ে?আদৌ এটা রূপকথাই তো নাকি?
মনের ভাবনা ফেলে সারফরাজ রূপকথার মাথায় মমতার পরশ বুলিয়ে বলে উঠলো
“বাড়ি ফিরে যাও রূপকথা।আমার কাছে তুমি আর আগের মতো নিরাপদ নও।সর্বনাশ হয়ে যাবে তোমার।
“কি সর্বনাশ?

কাঁদতে কাঁদতে শুধালো রূপকথা।রূপকথার প্রশ্নে ইতিউতি তাকালো সারফরাজ।ভেতরে কেমন যেনো অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে।খুবই খারাপ একটা অনুভূতি।এই বয়সে এই অনুভূতি আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়।কিন্তু রূপকথা কে জড়িয়ে এমন অনুভূতির শিকার হতে চায় না সে।
হাতের করপুটে একবার নিজের মুখ মুছে নিলো সারফরাজ।এমন শীতল দিনেও কেমন ঘেমে উঠছে সে।শরীরে যেনো চারশত চল্লিশ ভোল্টের ঝটকা লাগছে।এই বুঝি ব্লাস্ট হলো সে।কিন্তু এই বোকা মেয়ে বুঝছে না কেনো কিছু?
“সুফিয়ান চৌধুরী কে উচিত শিক্ষা দেবো আমি।মেয়েটাকে এমন মাথা মোটা গর্দভ বানাতে রেখে গেছিলাম?এতো বড় মেয়ে এমন বোকা হলে মানা যায়?ওহ গড।এই মেয়ে যায় না কেনো?
সারফরাজ এর উত্তপ্ত চিন্তা ভাবনার মাঝে এক বালতি পানি ঢেলে ঝমঝমিয়ে বর্ষণ শুরু হলো।সেই বর্ষনের পানে তাকিয়ে অসহায় এর ন্যয় সারফরাজ বলে উঠলো
“তবে কি দেশে ফিরে ফেঁসে গেলাম?

আকস্মিক বৃষ্টিতে টনক নড়লো নেলির।বোকার মতো বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো সে।হুট করে বৃষ্টি এসে তাকে কেমন ভিজিয়ে দিলো।বৃষ্টির জল একদম সহ্য হয়না তার।মাথায় লাগলেই নিউমোনিয়া ধরে যায়।জন্মের পর থেকেই এই সমস্যা।এবার কি হবে তবে?
উপায়ন্তর না পেয়ে দৌড়ে বাগানের কর্নারে ছাউনি ওয়ালা বেঞ্চের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো নেলি।ইতোমধ্যে বেশ খানিক ভিজে গেছে সে।নির্ঘাত জ্বরের চিন্তায় ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো তার।জ্বর এলে সব কিছু তিতকুটে লাগে।কিচ্ছু খাওয়া যায়না।কিন্তু সেতো খেতে ভালোবাসে।এভাবে না খেয়ে বিছানায় পরে থাকলে কেমন হবে?
আগাম চিন্তায় কেমন অস্থির হলো নেলি।দূর থেকে পুরো বিষয় খেয়াল করলো অভিরূপ।কামালের থেকে একটা ছাতা নিয়ে দৌড়ে এলো নেলির কাছে।এরপর বিনয়ের স্বরে বললো
“ভেতরে চলো।

এবার আর কোনো প্রকার ত্যাড়ামো করলো না সে।বাধ্য মেয়ের মতো অভিরূপ এর ছাতার নীচে এসে দাড়ালো।অভিরূপ এক হাতে ছাতা আরেক হাতে নেলিকে আগলে ঘরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলো।সোফায় বসতে বসতে নেলি অভিরূপ এর উদ্দেশ্যে বললো
“একটা টাওয়েল পাওয়া যাবে?আসলে আমার বৃষ্টির পানিতে সমস্যা আছে।
অভিরূপ মাথা নাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেলো দুতলায়।সারফরাজ এর ঘরের দুয়ার বন্ধ দেখে আর কড়া নাড়লো না।এরপর কামাল কে ডেকে একটা গামছার ব্যাবস্থা করে নিজেই হাত লাগিয়ে নেলির মাথা মুছে দিলো।এই প্রথম নেলির মনে হলো ছেলেটাকে যেমনটি ভেবেছে সে আসলে ছেলেটা তেমন নয়।অভিরূপ এর সিরিয়াস মুখ পানে তাকিয়ে গভীর ভাবে অভিরুপ কে পর্যবেক্ষণ করলো নেলি।কুচকুচে কালো মনির চোখ দুটো বড্ড অমায়িক।তাতে কেমন মায়া খেলা করছে।শ্যাম বর্ণের শরীর টা বড্ড আকর্ষণীয়।লম্বা চওড়া যথেষ্ট।ক্লিন সেভ গালের শক্ত চোয়ালে কেমন গাম্ভীর্য ভাব হুংকার ছাড়ছে।চেপে রাখা লাল ঠোঁট দুটোও যথেষ্ট মোহনীয়।অবশ্যই কোন ভদ্র ঘরের সন্তান হবে।

নেলির ভাবনার মাঝেই অভিরূপ স্বাভাবিক নরম গলায় বলে উঠলো
“চা খাবে?
দেয়ালে থাকা ঘড়িতে নজর বুলালো নেলি।দুপুর প্রায় দুটোর কাছাকাছি।খিদেয় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।প্লেট ভর্তি করে আলুভর্তা আর গরুর মাংস দিয়ে গরম গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।অবশ্য এমন বৃষ্টির দিনে গরম গরম ভুনা খিচুড়ি হলেও মন্দ হয় না।কিন্তু এই লোক ভাত অফার না করে চা অফার করছে কেনো?খালি পেটে কেউ চা খায়?
নেলির উত্তরের আশায় অভিরূপ ভ্রু উঁচিয়ে নেলির পানে তাকিয়ে রইলো।কিন্তু নেলি উত্তর করবার আগেই পেটের মধ্যে কেমন গড়গড় শব্দ হলো।বাইরে থেকে সেই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলো অভিরূপ।নেলি লজ্জায় পেট চেপে ধরে বোকার ন্যায় হাসতে হাসতে বলে উঠলো
“রূপকথার অত্যাচারে সকালে সেভাবে খেতে পারিনি।গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম করছে।
অভিরূপ এবার হাসলো না।সিরিয়াস দেখালো তাকে।দৌড়ে কিচেনে গিয়ে কামাল কে জিজ্ঞেস করলো
“দুপুরের মেনু কি আজকে?
বৃদ্ধ কামাল ইতস্তত করে বললো
“সারফরাজ তো বাসায় খায় না।তাই সেভাবে কিছু রান্না হয় না।
কামালের উত্তরে অভিরূপ কিছুটা হতাশ হলো।আর দেরি না করে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে গেলো সে।যাবার আগে নেলিকে বলে গেলো
“একটু পরেই ফিরছি।অপেক্ষা করো হু?
নেলি প্রত্যুত্তর করার সময় পেল না।নিজের বাইক হাঁকিয়ে বেরিয়ে গেলো অভি।একা ড্রয়িং রুমে চুপটি করে বসে নেলি ভাবতে লাগলো
“ওই ড্যাঞ্জারাস ছেলের সাথে এতো সময় রূপকথা কি করছে?

বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির বেগ আরো কয়েক গুণ বাড়লো।আকাশের ঘন মেঘ আর বিদ্যুৎ চমকানো দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যার আগে এই বৃষ্টি থামবে না।তপ্ত শ্বাস ফেলে বিদেশ থেকে আনা একটা চকলেট রূপকথার দিকে এগিয়ে সারফরাজ বললো
“নাও,চকলেট খাও।
সারফরাজ এর হাত থেকে চকলেট নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো রূপকথা।খেলো না ।এটা দেখে সারফরাজ বললো
“খাচ্ছ না কেন?
রূপকথা অভিমান এর স্বরে বললো
“আগে বলো কোথায় কোথায় ঘুরলে এতগুলো বছর।
রূপকথার প্রশ্নে কপালে চাপড় মারলো সারফরাজ।এরপর অনেক গুলো দেশের নাম বললো ।সেগুলো মন্ত্রমুগ্ধের ন্যয় শুনলো রূপকথা।সারফরাজ এর মুখে এতগুলো দেশ ভ্রমনের নাম শুনে ছোট বাচ্চার ন্যয় রূপকথা গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করলো

“আমার জন্য কি এনেছো ওই সব দেশ থেকে?
সুফিয়ান চৌধুরীর কাছে পাঠানো প্রত্যেকটা গিফট এর কথা চেপে গেলো সারফরাজ।সুফিয়ান চৌধুরী নিজে থেকেই স্বেচ্ছায় যে রূপকথার থেকে সারফরাজ এর বিষয় গোপন করেছে এটা সারফরাজ খুব করে টের পেয়েছে।যদিও সুফিয়ান চৌধুরীর এহেন নিষ্ঠুর আচরণে মনে বেশ করে কষ্ট পেয়েছে সারফরাজ।তবুও রূপকথার সামনে সুফিয়ান কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় না সে।
সারফরাজ কে নিশ্চুপ কিছু ভাবতে দেখে রূপকথা বলে উঠলো
“একটা প্রশ্ন করেছি।
রূপকথার চিকন স্বরে নিজেকে ধাতস্থ করলো সারফরাজ।এরপর ইতস্তত করে বলে উঠলো
“ট ট টাকা ছিলো না রূপকথা।
“কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ পয়সাওয়ালা মানুষ তুমি।
এবার দমে গেলো সারফরাজ।মিন মিন করে কিছু একটা বলতে চাইলো সে।কিন্তু তার আগেই দরজায় নেলি কড়া নেড়ে ডেকে উঠলো

“রূপকথা!
নেলির ডাকে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল রূপকথা।এরপর শুধালো
“কি চাই?
নেলি একবার ভীত চোখে সারফরাজ কে দেখে নিয়ে বলে উঠলো
“আম্মু ফোন করে জানতে চাইছে কখন ফিরবো।
নেলির কথায় চট করে রূপকথা বলে উঠলো
“বল আজ ফিরবো না।
নেলি বিস্ফারিত চোখে উত্তেজিত গলায় বলল
“কিহ?

চকলেট এর প্যাকেট ছিড়ে চকলেট খেতে রূপকথা কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলে উঠলো
“যা শুনেছিস তাই ঠিক।আজ সারফরাজ দের বাড়িতে আমরা থাকবো।
রূপকথার উত্তরে চোখ মুখ কুঁচকে ফিসফিস করে নেলি বললো
“তুই কি দুই বছরের ছোট বাচ্চা?এমন মেয়ে মানুষ হীন বাড়িতে এতবড় দামড়া লোকের সাথে রাত কাটাবি? চল বাড়ি চল।আমার খিদে পেয়েছে।
রূপকথা দরজা ছেড়ে রুমে এসে সারফরাজ এর থেকে দুটো চকলেট নিয়ে নেলির হাতে গুঁজে দিয়ে বলে উঠলো
“এটা খেতে খেতে বাইরে অপেক্ষা কর।পরে তোর সাথে দেখা করছি।
নেলি কিছু বলার আগেই ঠাস করে দরজা আটকে দিলো রূপকথা।এরপর পুনরায় সারফরাজ এর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে সারফরাজ এর চোখে চোখ রেখে শুধালো

“হাবেলীতে গেছিলে?
“হু
“নিজের ঘরে?
“হু
“দেয়ালে কিছু লিখা দেখতে পেয়েছিলে?
“না।
“আমি গেছিলাম হাবেলীতে।তোমার খুঁজে।তোমার ট্রাংক খুলে পুরোনো কাপড় আর তোমার বাবা মায়ের ছবি আমি নিয়ে এসেছি।একটা মসৃন দেয়ালে নিজের ঠিকানা আর তোমার জন্য একটা মেসেজ ও লিখে এসেছিলাম বড় বড় করে।কিচ্ছুটি দেখতে পাও নি?
রূপকথার কথায় সারফরাজ এর কপালে সূক্ষ ভাঁজ পড়লো।রূপকথা কে কিছু বুঝতে না দিয়েই নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো

“কালো কালি দিয়ে কি রূপকথার মেসেজ আর ঠিকানা মুছে দেয়া হয়েছিলো?কে করেছে এসব?
মনের ভাবনা প্রকাশ না করলো না সারফরাজ।এরপর হঠাতই রূপকথার স্বপ্নে বলা কোনো ছেলের কথা মনে পড়লো সারফরাজ এর।তাই অধীর হয়ে সারফরাজ শুধালো
“আচ্ছা আমার মতো দেখতে বা আমার চোখের মতো চোখ ওয়ালা কোনো ছেলের সাথে রিসেন্টলি তোমার দেখা হয়েছে?
সারফরাজ এর প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলো রূপকথা।এরপর বললো
“কেনো বলতো?
“এমনি জানতে ইচ্ছে হলো।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে রূপকথা বললো
“হুম।
“কেমন দেখতে সে?
“তোমার মতো চোখ।কিন্তু তোমার থেকে একটু গাঢ়।আর ছেলেটা না একটু অদ্ভুত!
“মানে?

চেকমেট পর্ব ২২

“ছেলেটা আমার সাথে ঢাকায় এসেছে।পাপা নিজে কেবিনের সিট কেটেছে আমার জন্য।কিন্তু হঠাতই সেই ছেলে কেবিনে হুড়মুড়িয়ে উঠে বলে এটা তার সিট।আর সবচাইতে অবাক করা বিষয় তাকে ঢাকা বিমান বন্দর স্টেশন থেকে কালো পোশাকধারী কিছু মানুষ বেশ সম্মানের সাথে প্রটেক্ট করে নিয়ে যাচ্ছিলো।আমার মনে হয় সে বিশেষ কেউ।তাকে দ্বিতীয় বার আমার মেডিকেল কলেজে দেখেছি আমি।
রূপকথার উত্তরে সারফরাজ একটু চিন্তিত হলো।এরপর বললো
“আবার দেখা হলে ছবি তুলে রাখবে ।আমি তাকে দেখতে চাই।
“কেনো বলোতো?তুমি কি তাকে চিনো?
“মনে হয়।

চেকমেট পর্ব ২৪