চেকমেট পর্ব ২৭

চেকমেট পর্ব ২৭
সারিকা হোসাইন

ঈদের দিন সকাল থেকেই সারফরাজ কে কসাই রূপে দেখার জন্য রূপকথার মনটা অকুলিবিকুলি করে উঠলো।অবশেষে নিজের মনের কৌতূহল দমাতে না পেরে শিউলি আর আমজাদ হায়দার কে ভুজুং ভাঁজুঙ বুঝিয়ে নেলিকে বগল দাবা করে ছুটলো সারফরাজ এর বাসায়।
রাস্তা ফাঁকা থাকায় বেশি সময় লাগলো না দুজনের।সারফরাজ এর বাড়ির আঙিনায় ঢুকতেই এক কোনে চোখে পড়লো কামাল,নজরুল আর সারফরাজ কে বিশাল এক গরু সমেত।
পাকা কসাই এর মতো শার্ট আর লুঙ্গি পরে রয়েছে সারফরাজ।হাত কুনুই অব্দি গুটানো।পরনের সাদা লুঙ্গিটা কুচিয়ে বাধা।হাতে ধারালো চাপাতি।সাদা লুঙ্গির বেশ খানিকটা রক্তের ছোপ ছোপ দাগে রঙিন হয়েছে।হাতের চাপাতি দিয়ে বেশ দক্ষ হাতে বিশাল গরুর পার্ট বাই পার্ট আলাদা করে কে টে নিচ্ছে সারফরাজ।মন্ত্রমুগ্ধের ন্যয় এই দৃশ্য উপভোগ করলো রূপকথা।সারফরাজ এর হলদেটে ফর্সা চিবুক বেয়ে উষ্ণ ঘর্ম বিন্দু গড়িয়ে পরছে সমানে।লালচে ঠোঁটের উপরেও জমেছে মুক্তা দানার ন্যয় চকচকে ঘাম।সারফরাজ এর চারপাশের বিষয়ে কোনো ধ্যান নেই।আপাতত গরু নিয়েই ব্যস্ত সে।ধীরে ধীরে গরুর বুকে ছাতি ফেড়ে বের করে নিয়ে এলো উষ্ণ টকটকে কলিজা।কলিজা হাতে নিয়ে সারফরাজ এর চোখ দুটো কেমন জ্বলে উঠলো।মনে হলো মানুষের কলিজা বের করে এনেছে সে।
কাজের এক পর্যায়ে সারফরাজ বলে উঠলো
“বিড়ি দাও নজরুল ভাই।গলা শুকিয়ে উঠছে।

লুঙ্গির কোচা থেকে একটা সিগারেট আর লাইটার বের করে এগিয়ে দিলো নজরুল।লুঙ্গিতে হাত মুছে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে ঠেসে আ গুন ধরালো।একটা টান দিয়ে সম্মুখে ধোয়া উড়াতেই রূপকথা আর নেলিকে নজরে পরলো।দ্রুত সেই সিগারেট ঠোঁট থেকে সরিয়ে সারফরাজ সম্মোহনী স্বরে ডাকলো
” রূপকথা!
সম্বিৎ ফিরে পেলো রূপকথা।ধ্যান ছেড়ে বেরিয়ে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে সামনে যেতেই নেলি টেনে ধরে ভয়ার্ত গলায় বললো
“আমি নিশ্চিত সে বিদেশে কসাই গিরি করে।হয় পশুর নয়তো মানুষের।
নেলির অদ্ভুত কথায় রূপকথা কপাল কুঁচকে মুখে চ সূচক শব্দ করে সামনে এগিয়ে গেলো।সারফরাজ চাপাতি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত মেলে ধরলো।কামালের সামনে রূপকথা সামান্য লজ্জা পেলো।কামাল ঘটনা বুঝতে পেরে নজরুল কে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।রূপকথা দৌড়ে গিয়ে সারফরাজ এর গলা জড়িয়ে ঝুলে গদগদ হয়ে শুধালো

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মানুষের কলিজা এভাবে বের করেছো কখনো?
রূপকথার প্রশ্নে নির্বিকার ভঙ্গিতে রূপকথার চোখের দিকে তাকিয়ে সারফরাজ ঠোঁট টিপে হেসে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে শুধালো
“সাপোজ আই সে ইয়েস,দ্যান হুয়াট?
সারফরাজ এর উত্তরে রূপকথা সারফরাজ এর গলা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে বলে উঠলো
“দেখতে চাই।
সারফরাজ রক্তাক্ত হাতে রূপকথার গাল স্লাইড করে উত্তর করলো
“সিউর।অ্যাজ ইউ উইশ ,মাই কুইন অব দ্যা এম্পায়ার
__________
“তোকে যদি একটা চুমু খাই তুই কি রাগ করবি রূপকথা?

ওয়েস্ট হলিউড,লস এঞ্জেলস
নিস্তব্ধ শীতল গা ছমছমে নিশুতি রাত।ঘড়িতে সময় রাত তিনটে বেজে কুড়ি মিনিট।আশ পাশে কোনো মানুষের নিশানা নেই।নিশাচর প্রাণী গুলোও বোধ হয় ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পরেছে।যতদূর দৃষ্টি যায় ততদুরের চারপাশ ধু ধু আর নীরবতার চাদরে আবৃত।
দিনের ঝলমলে রোশনাইয়ে যেই শহর আভিজাত্য আর ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকে রাতের আধার নামার সাথে সাথেই তা পাপের নগরী হয়ে উঠে।বেলেল্লাপনা, সম্ভোগ আর ভয়াবহ নেশায় ডুবে থাকে এই শহর।অপকর্মে লিপ্ত মানুষ গুলোর জন্য রাত টুকু যেনো স্বর্গীয় সুধা।

ওয়েস্ট হলিউড শহরে এক কোনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে “দ্যা ক্রীমসন সেলার বার”।বারটির ঝলমলে আলোকসজ্জা আর সরাবের নেশা ধরানো গন্ধে চোখ বুঝে আসে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।লস এঞ্জেলস এর বড় বড় পয়সা ওয়ালা মানুষ কারী কারী টাকা খরচ করে এখানে আসে ফুর্তি করতে আর রাত ভর দামি দামি মদ গেলতে।শুধু কি তাই? রাতের ঘনত্ব বাড়ার সাথে সাথে চুপি চুপি আদান-প্রদান হতে থাকে মদ ভর্তি কাঁচের গ্লাস সেই সাথে আঁকা হয় কারো সর্বনাশের নীল নক্সা নয়তো কারো প্রাণ নাশের রক্তিম মানচিত্র। এখানে জীবন চলে রাতের আলোয় আর মদের ঘোরে। এ শহরে কেউ কাউকে চেনে না, শুধু চিনে টাকা, নেশা আর প্রতারণা।বারে আসা প্রত্যেকে মানুষ রূপী পশু।মায়া মমতা দয়া এদের হৃদয়ে নেই।যা আছে তা কেবল ক্রুরতা আর হিংস্রতা।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই ওয়েস্ট হলিউড এর এই বারে সুট বুট পড়া ভদ্রলোক গুলো বুক ফুলিয়ে ভেতরে ঢুকে সাথে লাস্যময়ী লাল লিপস্টিক মাখা সফেদ সুন্দরী।আপাতত দৃষ্টিতে দেখলে নিত্য দিনের সাধারণ ঘটনা মনে হয়।কিন্তু গভীরে চোখ রাখলে নজর আটকায় প্রাণ খোয়ানোর নকশায়।

ওয়েস্ট হলিউড শহরের ক্রিমসন সেলার বার টি আজ ফাঁকা।অবশ্য এর কারণ হচ্ছে হীম শীতল আবহাওয়া।তাপমাত্রা সিক্স ডিগ্রি সেলসিয়াস।আকাশ জুড়ে ঝাপসা কুয়াশার ধুম্রজাল।বাতাসের হীম প্রবাহে মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই বরফ ঝরবে।হলোও তা।মুহূর্তেই টপটপ শব্দে বরফ কণা ঝরতে শুরু করলো।এবং ধীরে ধীরে তা ঝরঝরে আওয়াজে রূপ নিলো।আজকের এই অধিক শীতলতা যেনো শহরের হাড় জমিয়ে দিচ্ছে ঠান্ডা হাওয়ায়।বরফের স্তুপ,শো শো বাতাসের আওয়াজ আর পাতার নীরব খসে পড়ার শব্দ সব কেমন ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।মনে হচ্ছে কোথাও বড় কোনো অঘটন ঘটতে চলেছে।
এহেন ভয়ানক রাতের বরফ আর বাতাস চিড়ে বেরিয়ে এলো কালো হুডিতে আবৃত এক মানব।তার চেহারা মাথার কালো ক্যাপ আর মাস্কে ঢাকা।শরীরের অবয়বে তাগড়া যুবক।যুবকের পেশীবহুল দুই হাতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আর পেট্রোল এর গ্যালন।

যুবক প্রথমে চারপাশ ভালো করে নজর বুলালো।এরপর ঘস ঘস করে বরফ মাড়িয়ে হেটে চললো বারের ভেতরে।
বারটির দরজায় বৃহৎ তালা ঝুলছে।ঝুবক সেই তালার পানে তাকিয়ে বাঁকা ক্রুর হাসলো।এরপর হাতের লক কাঁটার মেশিন দিয়ে বিনা পরিশ্রমে খোলে ফেললো বৃহৎ তালা খানা।এরপর এগিয়ে গেলো ড্রিংকস কর্নারে।
বিশাল আধুনিক রাজকীয় বারের চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে হেটে গেলো থরে থরে সাজিয়ে রাখা শত বর্ষীয় দামি এলকোহল কেবিনেট এর দিকে।এরপর বিড়বিড় করে আওড়ালো মদের বোতলের নাম-
শ্যাঁতো মারগো ১৯৮২,রোমানে-কঁতী ২০০৫,হেনেসি পারাদাইস

,গ্লেনফিডিচ রিজার্ভ ৫০ বছর
এরপর ভয়ানক শীতল গলায় বলে উঠলো
“আদেশ পালন করতে আমি সর্বদা আজ্ঞাবহ।
যুবকের মুখের হিংস্র অবয়ব মাস্ক ভেদ করে স্পষ্ট হলো না।কিন্তু তার বাদামি চোখ জুড়ে প্রতিশোধের নেশা সুস্পষ্ট।যুবক নিজের পেশীবহুল হাতের সাহায্যে এক এক করে টেনে ফেলে দিল সব গুলো নেশাদ্রব্য রাখার তাক। মার্বেল পাথর ওয়ালা শক্ত মেঝেতে পরে কাঁচের বোতল গুলো ঝনঝন ঝনঝন শব্দে উদ্বেলিত করলো চারপাশ।মুহূর্তেই সকল নিস্তব্ধতার পতন ঘটলো।
ভারী এলকোহলের হাজার হাজার ডলারের বোতল গুলো মেঝেতে বিলীন হয়ে টুকরো টুকরো কাচ ছড়িয়ে পড়লো মার্বেলের ওপর।
তারপর…

চুপচাপ পেট্রোলের বোতলের ক্যাপ খুলে ছিটিয়ে দিলো বারের প্রত্যেকটা কোনায় কোনায়।পেট্রোল এর উটকো গন্ধে স্পষ্ট তরল মৃত্যুর ছাপ।ভাঙা মদ আর কেরোসিন মিলেমিশে একাকার হতেই
একটা লাল লাইটার জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দিল বারটার মেঝের মাঝখানে।
এলকোহল আর পেট্রোল আগুনের স্পর্শ পেতেই কেমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো।এদিকে বরফের শীতলতা অন্যদিকে আগুনের উত্তপ্ত লেলিহান শিখা।সেই সাথে এলোমেলো দাপিয়ে বেড়ানো হীম শীতল বাতাস।
ছুটে আসা শীতের হাওয়া আর বরফের ভেতরও সেই আগুন থেমে থাকলো না।
আগুনের চূড়ান্ত উত্তাপে বারের দামি থাই জানালার কাচ ফুটে গেল, ছাদের কাঠামো চিৎকার করে চটচট শব্দে ভেঙে পড়লো বোধ হয়।সেই সাথে বাতাসে মিশলো পোড়া পদার্থের ঘ্রাণ।
কিন্তু এতো কিছুতেও ওই মানব থামলো না।সে বার থেকে বেরিয়ে বাইরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। জৌলুশ মাখা দামি বার এর ধ্বংসযজ্ঞ তাকে পরিতৃপ্ত করলো।

বারের সব কিছু যখন ধীরে ধীরে মাটিতে বিলীন হলো তখন হুডি মানব নিজের ফোন খানা পকেট থেকে বের করলো।এরপর ঘস ঘস করে এক বার্তা লিখে পাঠিয়ে দিলো কাঙ্খিত নম্বরে ।
“Mission accomplished,I kept my word dad.I hope you are proud of me.”
বার্তা খানা পাঠিয়ে উত্তরের প্রতীক্ষায় স্ক্রিনে নজর নিবদ্ধ করলো শ্বেতাঙ্গ যুবক।মুহূর্তেই যুবকের গোলাপি ঠোঁটের কোণের হাসিটা প্রশস্ত হলো।ফিরতি জবাব এসেছে।
“you have earned a worthy reward as you wish dear Kai”
মেসেজ টা বার কয়েক বিড়বিড় করে পড়লো “কাই” নামক ফ্রান্সের বংশোদ্ভূত ছেলেটি।এরপর মুখের মাস্ক খুলে ঠোঁট কামড়ে ধরে লিখলো
“I’ll be your black hand.silent, loyal,deadly…

কয়েক পল গড়াতেই ফিরতি উত্তর এলো পুনরায়।উত্তরে কাই এর হাসি আরো প্রশস্ত হলো।নিজের খুশির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সে আগুনের আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে আগুনের জলন্ত শিখায় হাতের পেট্রোল সহ গ্যালন ছুড়ে ফেললো।পেট্রোলের স্পর্শে আগুন আরো ভয়াবহ রূপে জ্বলে উঠলো।সেই কমলা রঙা আগুনের পানে চকচকে চোখে তাকিয়ে চিৎকার করে উৎফুল্ল আওয়াজে কাই বলে উঠলো
“Do you know who I am today?I am the servent of the Jaguar king….and you!
বলেই হো হো শব্দে হাসলো।এরপর বিড়বিড় করে বলে উঠলো
“You are just a little flame trying to survive the storm.”
ধীরে ধীরে আগুনের শিখা নমনীয় হয়ে উঠলো।পোড়ানোর মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই হয়তো।কিছুখন পরেই ভোরের আলো ফুটবে।ধ্বংস বার আর বাইরের বরফ স্তুপ মিশ্রিত পরিবেশ দেখে যুবক তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো
“Not even coldest storms could stand against me.What a pitty!….

সূর্যের তেজ ধীরে ধীরে মিইয়ে যেতে শুরু করছে।অন্ধকার এসে ক্রমশ হাতছানি দিয়ে ডেকে চলছে।আকাশ জুড়ে বিচরণ করছে নীড়ে ফেরা বিহঙ্গের দল।এই বুঝি সূর্য খানি পাটে ডুবলো।।
বিরস মুখে সুফিয়ান চৌধুরী নিজের ঘরের এক কোনে ইজি চেয়ারে মাথা হেলিয়ে বসে আছেন চোখ বুজে।সব কিছু কেমন বিষন্ন আর দম বন্ধকর লাগছে।ভেতরের অসহনীয় অস্থিরতা আর দুশচিন্তা কারো কাছে প্রকাশ টুকু করা যাচ্ছে না।
অধিক চিন্তায় মাথাটা কেমন তীক্ষ্ণ ব্যথায় চিড়চিড় করে উঠলো।মাথার চুল টেনে ধরে সুফিয়ান মনে মনে ভাবতে লাগলেন
“যেই ভয়ে এতগুলো বছর মেয়েটাকে লুকিয়ে রাখলাম অবশেষে সেই ভয় সত্য রূপে প্রকট হলো?কিন্তু কেনো?এর থেকে পরিত্রাণ কি?

রূপকথার মায়াবী মুখশ্রী আর সারফরাজ এর পশু সম সত্ত্বা কোনো ভাবেই মানতে পারছেন না তিনি।বাবা হিসেবে মেয়ের এহেন বিপথে বাড়ানো পা কিভাবে রোধ করবেন তিনি?মেয়ে যদি জেনে বুঝে এমন অগ্নি পথে পা বাড়ায় তবে তাকে ঠেকানোর সাধ্য কার?
অন্ধকারে নিমজ্জিত কক্ষে নিঃশব্দে এসে আলো জ্বালিয়ে কক্ষ আলোকিত করলো রেখা।এরপর তপ্ত শ্বাস ফেলে সুফিয়ান এর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে ধীর লয়ে শুধালো
“কয়েকদিন ধরেই তোমাকে কেমন বিধ্বস্ত ঠেকছে।কি হয়েছে খোলে বলো তো!.
রেখার আকস্মিক স্বরে হকচকিয়ে উঠলো সুফিয়ান।এরপর নিজেকে ধাতস্থ করে আমতা আমতা করে বলে উঠলো
“ক ক খন এলে?
রেখা বিছানার এক কোনে বসে উত্তর করলেন
“এই মাত্র।

সুফিয়ান আলগোছে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।এরপর নামাজের তাগাদা দিয়ে বলে উঠলেন
“ঘুমিয়ে গেছিলাম।কখন আজান পড়েছে টের ই পাইনি।আজকাল শরীরটা খুব ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।প্রেসার টাও বেড়েছে খানিক।
সুফিয়ান এর উত্তরে রেখা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে সন্দিহান চোখে পুনরায় শুধালো
“তোমাকে কয়েকদিন ধরে মন মরা লাগছে।কি হয়েছে?শুধুই কি শরীর খারাপ নাকি অন্য কিছু?
সুফিয়ান রেখাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে উত্তর করলো
“মেয়েটার জন্য মন খারাপ লাগছে রেখা।এদিকে থানাতেও প্রচুর চাপ।ট্রান্সফার এও বেশ ঝামেলা হচ্ছে।
রেখা সুফিয়ান চৌধুরীর কথায় তাল মিলিয়ে বলে উঠলেন
“মেয়েটার জন্য আমারও খারাপ লাগছে।এতো গুলো দিন ওকে ছাড়া কখনো থাকিনি।
বলতে বলতেই রেখার গলা ধরে এলো।নিজেকে কোনো মতে সামলে আবদার করলো
“একবার গিয়ে দেখে আসলে কেমন হয়?
সুফিয়ান প্রত্যুত্তরে মাধুর্যহীন গলায় বলে উঠলো
“নামাজে যাও রেখা।সময় বয়ে যাচ্ছে।কদিন পর এমনিতেই ঢাকা যাচ্ছি।

পুরোটা দিন ঈদ আনন্দের ন্যয় কাটলো সারফরাজ এর।রুদ্ররাজ এর হাঁটুতে আঘাত করে মাটিতে মুড়িয়ে বসাতে পেরেছে ফাইনালি।যখন রুদ্ররাজ জানবে সারফরাজ তার পিঠ পিছে কতো বড় ছুড়ি বসিয়েছে তখন কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে?ক্রোধে ফুঁসে উঠবে ?কাঁদবে?নাকি পাল্টা আক্রমনের নকশা আঁকবে?পাল্টা আক্রমন কি ধরনের হতে পারে?যদিও এসব বিষয়ে সারফরাজ এর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।টাকা পয়সার সাময়িক ক্ষতি সে কোনো ক্ষতির কাতারে ধরে না।টাকা পয়সা দুই হাতের ময়লা।বুদ্ধি আর তাকত থাকলে টাকা কামানো পানির মতো সহজ।জীবনে সারফরাজ যেই টাকা কামিয়েছে তার সিকিভাগ রুদ্ররাজ চোখে দেখেছে কিনা সন্দেহ।
নিজের আভিজাত্য গাম্ভীর্য আর অহংকারে তাচ্ছিল্য হাসলো সারফরাজ।লালচে ঠোঁট জোড়ায় কেমন ক্রুর দেখালো সেই হাসি।

এরপর হাঁক ছেড়ে ডেকে বলে উঠলো
“লুইস…
ডাক শোনা মাত্র বাইরে থেকে ড্রয়িং রুমের ভেতরে এসে দাড়ালো ইয়ং আর লুইস।অবনত মস্তকে দুই হাত বুকে ভাঁজ করে দুজনেই উত্তর করলো
“ড্যাড…
দেহরক্ষী দুজনের মুখে ড্যাড সম্বোধন শুনে আজ একটুও ভালো লাগলো না সারফরাজ এর।কেমন বেখাপ্পা শোনালো চেনা পরিচিত সম্বোধন।ফর্সা কপালটাও কুঁচকে এলো।মুখে চ সূচক বিরক্তিকর শব্দ ফুটিয়ে পায়ের উপর পা তুলে নড়েচড়ে বসলো সারফরাজ।এরপর দুজনের পানে গভীর দৃষ্টি মেলে গম্ভীর গলায় বললো
“ফারদার ডোন্ট কল মি ড্যাড।জাস্ট স্যা বস।
সারফরাজ এর মুখে বস নাম শুনে লুইস আর ইয়ং কিছুটা অবাক হলো ।এতগুলো বছরে ড্যাড সম্বোধনে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।আজ বস শব্দটা কেমন অদ্ভুত লাগলো তাদের কাছে।ড্যাড শব্দ টা যেমন আন্তরিক আর ভালোবাসার, বস শব্দটা তার বিপরীত।সম্পূর্ণ নতুন এক শব্দ ।তবুও ইয়ং আর লুইস মাথা ঝাকিয়ে উত্তর করলো
“ওকে বস ।

বস শব্দটি মনঃপুত লাগলো সারফরাজ এর।ড্যাড,বাবা অথবা পাপা ডাকবে তার ঔরসজাত সন্তান।কতো প্রশান্তিই না দেবে কানে শীতলতা জাগানো সেই ডাক।সারফরাজ মনে মনে ভাবল একদিন তার ঘর হবে সংসার হবে।একটা ভালবাসার বউ থাকবে।আর এক ঝাঁক বাচ্চাকাচ্চা।ঘরময় খলবলিয়ে বেড়াবে ছোট ছোট হাত পা আর মায়াবী মুখশ্রী।ক্লান্ত দেহে স্ত্রী নামক মানুষ টার কোলে ধপ করে মাথা রেখে নির্ঘুম চোখ দুটো বুজে নিজেকে পরিশ্রান্ত করবে সারফরাজ।কিন্তু কবে আসবে সেই সুদিন?আদেও কি সারফরাজ এসব ডিজার্ভ করে?বিধাতা কি রূপকথার সাথে এতো সুন্দর স্বপ্নের ঘর তাকে বাঁধতে দেবে?নাকি কোনো ঝড়ো হাওয়া এসে ভেঙে দেবে তাদের খড়কুটোয় মোড়ানো ভিত্তিহীন সম্পর্ক?

“না না এ কিছুতেই হতে পারে না।তবে আমি পুরো পৃথিবী জ্বালিয়ে দেবো।যেই স্বপ্ন আমার কঠিন হৃদয় দীর্ঘ অপেক্ষার পর দেখতে চলেছে তা পরিপূর্ণ না হয়ে কখনোই মাঝ পথে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে পারে না।এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না।রূপকথা আর আমার মধ্যে বাধা হয়ে যে আসবে তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবো আমি।হোক সে সুফিয়ান চৌধুরী অথবা রুদ্ররাজ।
কথা গুলো ভেবেই সারফরাজ এর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো সেই সাথে ফুলে উঠলো কপালের শিরা।চোখ দুটোতে নীলচে ক্রোধ।হাতে ধরে রাখা হুইস্কির ছোট গ্লাস টাকে আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সারফরাজ।ভেতরের ভয় মেশানো আশঙ্কা কেমন চেপে ধরলো হৃদপিণ্ড।সারফরাজ সহ্য করতে না পেরে আরো জোরে মুঠি পাকিয়ে চেপে ধরলো কাঁচের গ্লাস।পদার্থের তৈরি পাতলা গ্লাস সইতে পারলো না সারফরাজ এর বল।চুরচুর করে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলো হাতের শক্ত মুঠোয়।গ্লাস ভাঙার চিকন ঝনঝন শব্দে ইয়ং আর লুইস ডেকে উঠলো
“বস।

ধ্যান ছেড়ে বেরিয়ে হাতের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো সারফরাজ।ইতোমধ্যে হাত কেটে রক্ত ধারা প্রবাহিত হচ্ছে।হাতের তালুতে বিধে রয়েছে ছোট ছোট কাঁচের টুকরো।হাতের মুঠো খোলে সারফরাজ এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো সেই ক্ষতবিক্ষত হাতের পানে।ইয়ং এগিয়ে এসে হাত দেখতে চাইলো।কিন্তু অন্য হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে সারফরাজ বলে উঠলো
“নিজেকে সামলে নিতে জানি আমি।তোমরা রূপকথার দিকে নজর দাও।রুদ্র ওকে টার্গেট করেছে।
ইয়ং সম্মতি জানিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো।পেছন পেছন গেলো লুইস।দুজনের যাবার পানে তাকিয়ে তপ্ত কম্পিত শ্বাস ছাড়লো সারফরাজ।এরপর দরদ হীন ভাবে টেনে তুললো হাতে বিধে থাকা কাঁচ।এমন সময় সারফরাজ এর ফোন খানা ভোঁ ভো করে বেজে উঠলো।স্ক্রিনে রূপকথার নাম ঝলমল করছে।ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে তড়িৎ ফোন তুললো সারফরাজ।এরপর আদুরে গলায় বললো

“ইয়েস….
ওপাশ থেকে রূপকথার লাজুকতা মিশ্রিত আবদার এলো
“তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
রূপকথার আবদারে ধুকপুক করে উঠলো সারফরাজ এর অনুভূতি হীন বক্ষ।রক্ত ভেজা হাতে বুক চেপে ধরে সারফরাজ ধীর লয়ে বললো
“তুমি কিন্তু ভুল করছো।
রূপকথা মিষ্টি হেসে উত্তর করলো
“ভুলটাই সঠিক লাগছে আমার কাছে।তুমি আসবে কি না বলো।না হলে আমিই আসছি।
সারফরাজ স্বাভাবিক গলায় শুধালো
‘এসো না রূপকথা।সামনের পথ কন্টকাবৃত।
রূপকথা ব্যাথিত গলায় শুধালো
“ভয় পাচ্ছ ?
“আমি হারানোর ভয় পাচ্ছি।এরপর আর আমার আকড়ে ধরার মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।আমি ধুকে ধুকে মরবো।রূহ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে সেই হারানোর ব্যাথায়।আমি সইতে পারবো না রূপকথা।
কথা গুলো বলতে বলতে গলার স্বর মোটা হয়ে এলো সারফরাজ এর।সেই সাথে শব্দ গুলো হলো ভাঙা ভাঙা।রূপকথা সারফরাজ এর অপ্রকাশিত অনুভূতি টের পেয়ে বলে উঠলো

“আমি হারাতে আসি নি সারফরাজ।তবে এতো দ্বিধা কেনো?
“তোমার বাবা কখনোই মানবে না এই সম্পর্ক।তারা কষ্ট পাবে।
“আমি পাপাকে বোঝাবো।মনের উপর কারো বিধি নিষেধ চলে বলো?
সারফরাজ রূপকথার প্রশ্নের উত্তর দিলো না।সে মনে মনে বললো
“সত্যিই মনটা বড্ড অবুঝ।এর উপর কারো নজরদারি, দখলদারিত্ব চলে না।সে তার মতোই চলতে চায়।মুক্ত স্বাধীন, বাধা হীন।
“সারাদিন দেখিনি তোমাকে সারফরাজ।আমার দিনটা শেষ হয়েছে তোমার আইস ব্লু চোখ জোড়া না দেখে আমি শান্তি পাচ্ছি না।আমার রাতের ঘুম হবে না।ইভেন পড়াতেও মন বসাতে পারছি না।প্লিজ এক পলক দেখতে চাই।বলো আসবে?
রূপকথার আবদার এবার ফেরাতে পারলো না সারফরাজ।ফট করে উত্তর করলো
“অলরাইট,আ উইল কাম ফর ইউ।
সারফরাজ এর উত্তরে প্রশস্ত হেসে রূপকথা বলে উঠলো
“একটা সারপ্রাইজ দেবো আজ তোমাকে।
সারফরাজ ছোট করে বললো
“কি?

“উহু এখন মোটেও বলবো না।এলে নিজ চোখে দেখবে।আর তাড়াতাড়ি আসবে।আমি অপেক্ষায় থাকবো।
বলেই ফোন কেটে দিলো রূপকথা।সারফরাজ বুক চেপে এখনো ওভাবেই বসে আছে।
“কি রে এমন স্ট্যাচু হয়ে বসে আছিস কেনো?
হঠাৎ অভিরূপের গলার স্বর শুনে হুসে ফিরলো সারফরাজ।এরপর নড়েচড়ে গলা খাকরি দিয়ে বলে উঠলো
“চল ফুপু শাশুড়ির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
সারফরাজ এর এহেন তামাশা মূলক মস্করা শুনে আঙ্গুল দিয়ে কান চুলকে সারফরাজ এর পানে এগিয়ে এলো অভিরূপ।এরপর সারফরাজ এর বুকে হাত রেখে অবিশ্বাস্য গলায় শুধালো
“টেল মি অনেস্টলি,ডিড ইউর হার্ট একচুয়ালি বিট ফর হার?
সারফরাজ অল্প মাথা দোলাতেই অভিরূপ লাফিয়ে বলে উঠলো
“ওহ মাই গড,মরা গাছে ফুল ফুটেছে ফাইনালি উঃ হু….
অভিরূপের বেশ উচ্ছাস কাজ করলো।ছোট বাচ্চার মতো নাচতে ইচ্ছে করলো।কিন্তু বয়সের মাপকাঠির হিসেবে পারলো না বাচ্ছামো করতে।তবুও কোমর দুলিয়ে অল্প নেচে বলে উঠলো
“ক্যালিফোর্নিয়া ফিরে পার্টি দেবো সবাইকে নিয়ে।আপাতত চল যাই ভাবি দেখে আসি।
অভিরূপ এর মুখে ভাবি সম্বোধন শুনে কিছুটা লাজুক হাসলো সারফরাজ।এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো
“জাস্ট এ মিনিট।আ উইল বি ব্যাক।

ঢাকায় আসার সময় গুনে গুনে ছয় টা শাড়ি এনেছে রূপকথা।একটা একদম কালো সাথে কালো সুতার কাজ আর দামি স্টোন লাগানো,আরেকটা মাল্টি কালার বাকি গুলো বিভিন্ন কালার এর।একেক্টার ম্যাটেরিয়্যালস একেক রকম।খুঁজে খুঁজে কালো রঙের পাতলা জর্জেট শাড়িটা হাতে তুলে নিলো রূপকথা।এরপর ম্যাচিং পেটিকোট আর ব্লাউজ।
দক্ষ হাতে কালো শাড়ি খানা মোমের ন্যয় ফর্সা দেহে জড়িয়ে আয়নার সামনে বসলো রূপকথা।ফর্সা মোহনীয় মুখে হালকা মেকআপ টাচ দিয়ে ঠোঁটে মেরুন রঙের একটা লিপস্টিক মাখালো।চোখের কুল ঘেষে মোটা করে কাজল লেপ্টে চোখ টা স্মোকি শ্যাডো প্লেটারে সাজালো।চুল গুলো কাঁধের দুই পাশে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে নিজেকে বেশ কয়েকবার পরখ করলো।

সাজ কমপ্লিট হতেই ঘড়িতে সময় দেখলো রূপকথা।রাত প্রায় বারো টার কাছাকাছি।
আমজাদ হায়দার আর শিউলি অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে।মানুষ দুটো বড়ই স্বাস্থ্য সচেতন আর ঘুম কাতুরে।পৃথিবী ধ্বসে যাবে তবুও এদের ঘুম ভাঙবে না।নেলি পড়তে পড়তে পড়ার টেবিলেই ঘুমিয়েছে।ঘুম নেই শুধু রূপকথার চোখে।সারফরাজ কে দেখার তৃষ্ণায় তার চোখ জোড়া তৃষিত।
রিডিং টেবিলে বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে রূপকথা।সারফরাজ এখনো আসেনি।মনের অস্থিরতা কমাতে না পেরে সারফরাজ এর ফোনে কল করলো রূপকথা।কিন্তু সংযোগ বন্ধ।
ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে সময়।কিন্তু সারফরাজ এর দেখা নেই।পুনরায় কল করলো রূপকথা এবারও নম্বর বন্ধ।অপেক্ষার প্রহর গুলো এখন বিষাক্ত হয়ে উঠলো তার কাছে।মন আকাশে অভিমান এর মেঘ জমলো।এই বুঝি চোখের দুকূল ছাপিয়ে অশ্রু বর্ষণ উপচে গড়ায়।

চেকমেট পর্ব ২৬

অভিমান আর কষ্টে ফুঁপিয়ে উঠলো রূপকথা।সারফরাজ জানতেও পারলো না বোধ হয় তা।হয়তো জানার চেষ্টাই করছে না।
ঘড়িতে দীর্ঘ সময় পর আবার নজর বুলালো রূপকথা।রাত দুটো বেজে পনেরো মিনিট।
রূপকথা বুঝলো সারফরাজ আসবে না।মানুষটা বড্ড নির্দয় আর বেখেয়ালে।প্রতিশ্রুতি টাও বোধ হয় মিথ্যে।কিন্তু রূপকথা তো তাকে সত্য রূপে মনে প্রানে চায়।তবে সারফরাজ চায় না কেনো?

চেকমেট পর্ব ২৮