চেকমেট পর্ব ৩৮

চেকমেট পর্ব ৩৮
সারিকা হোসাইন

আকাশ জুড়ে অন্ধকার মেঘের চাদর। হঠাৎ করে কালো মেঘ গর্জে ওঠে, যেন আকাশই ফেটে যাচ্ছে। আজ যেনো আকাশ ফুঁড়ে আষাঢ়ে ঢল নেমেছে । ঝমঝমে বৃষ্টির শব্দ ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে মাঝেমধ্যে চারপাশ ঝলসে ওঠে আর ততক্ষণে দূরের গাছপালা ছায়ামূর্তির মতো কাঁপে। বাতাসে শিরশিরে একটা আতঙ্ক। মনে হচ্ছে আজ রাতের এই বর্ষণ শুধু জলের নয় ।আজ রাতের এই বর্ষণ ভয়ের, বিষাদের আর অজানা ব্যথার।

রূপকথার সামনে থেকে মায়া চৌধুরী কে নিষ্ঠুরের মতো তুলে নিয়ে গেলো রুদ্ররাজ।রূপকথা এই নির্মম দৃশ্য কিছুতেই ভুলতে পারছে না।এদিকে সোহানার অবস্থা ক্রমশ মুমূর্ষু হয়ে উঠেছে।এই বুঝি প্রাণ পাখী দেহ ছেড়ে বেড়িয়ে যায়।সোহানা কে নিজের কোলে আগলে নিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো রূপকথা।আজকের রাত টা তার জন্য এতো এতো বিভীষিকা বয়ে আনবে জানলে কোন মতেই আজ সে ঘর ছেড়ে বেরুতো না।ইশ সারফরাজ যদি আজ আসতো রূপকথাকে এগিয়ে দিতে তবে বোধ হয় সব চাইতে বড় মিরাকেল হতো।নিজের মা কে এক ঝলক দেখতে পেয়ে কি অনুভূতি হতো তার?আনন্দে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলতো?নাকি রুদ্ররাজ এর ঐদ্ধর্তে আকাশ জমিন এক করে ফেলতো?রুদ্ররাজ কি পারতো সারফরাজ এর বুক থেকে তার মাকে আর দ্বিতীয় বার কেড়ে নিতে?সারফরাজ যদি কখনো জানতে পারে তার মাকে এতোদিন ধরে রুদ্ররাজ আটকে রেখেছে তবে রুদ্ররাজ এই পরিণতি কেমন হতো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সোহানার গোঙানির শব্দে রূপকথার ভাবনায় ভাটা পড়লো।আশেপাশে নজর বুলিয়ে চিৎকার করে ডেকে উঠলো রূপকথা।
“কেউ আছেন?আমাদের একটু হেল্প করুন প্লিজ।
কিন্তু রূপকথার চিৎকার কেউ শুনলো না। রূপকথার মিহি ভঙ্গুর আওয়াজ হিংস্র প্রকৃতির মাঝে বিলীন হলো।সোহানা নিজের প্রানের আশা ছেড়ে দিয়ে সজল চোখে রূপকথার অসহায় মুখের পানে তাকালো।এরপর বহু কষ্টে আওড়ালো
“মায়া সারফরাজ কে আগলে ধরে বাঁচতে চায়।ওর ফাঁকা ভাষা হীন দৃষ্টিতে হাজারো রঙিন স্বপ্ন।
রূপকথা বুঝলো সোহানা কি বলতে চাচ্ছে।শুধু মায়া নয় সারফরাজ নিজেও তার মায়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মায়া চৌধুরী কে সারফরাজ না খুঁজেছে।শুধু সারফরাজ নয়।সুফিয়ান চৌধুরী নিজেও প্রত্যেকটা বিভাগে মায়ার খোঁজ চালিয়েছে দীর্ঘ কয়েক বছর।কিন্তু বার বার ব্যর্থ হয়ে ফিরেছে।কেউ যদি ইচ্ছে করে কাউকে লুকিয়ে রাখে তবে তাকে খোঁজে বের করবে কার সাধ্যি?
নিজের গলা থেকে কম্পিত হাতে মায়ার লকেট ওয়ালা চেইন খোলে রূপকথার হাতে দিয়ে শ্বাস ভারী টানে সোহানা বলে উঠলো

“ভেবে ছিলাম সারফরাজ কে খোঁজে তার হাতে লকেট সমেত তার মাকে তুলে দেবো।কিন্তু পারলাম না।ঠিক ধরা পড়ে গেলাম।
এটা সারফরাজ কে দিও।
সোহানা আরো কিছু বলতে চাইলো।কিন্তু শরীর সায় দিলো না।
এমন সময় বৃষ্টি চিড়ে ধীর গতিতে এগিয়ে এলো এক সাদা রঙের প্রাইভেট কার।রূপকথা ভীত হলো।কোন দিকে কোন বিপদ ওঁৎ পেতে রয়েছে তা নিয়ে দ্বিধানিত হলো।সোহানা কে চেপে ধরে দ্বিগুন ভয়ে গুটিয়ে গেলো রূপকথা।কিন্তু গাড়ি থেকে নামলো এক ভদ্রলোক।রূপকথা আর সোহানার সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বিস্ফারিত চোখে ভয়ার্ত গলায় ডাকলেন

“সোহানা!
মানুষটার ভয়ার্ত মুখ আর চোখের টলমলে জল দেখে রূপকথা বুঝলো কাছের কেউ হয়তো।তাই কোন প্রকার বাক্য বিনিময় না করে ঝটপট সোহানাকে গাড়িতে তুলে ভদ্রলোক ইঞ্জিন স্টার্ট করে রূপকথাকে সহ নিয়ে ছুটলো হসপিটাল অভিমুখে।সোহানা এখনো জ্ঞান হারায় নি।কিন্তু কি লেখা আছে সোহানার ভাগ্যে রূপকথা জানে না।রূপকথা খুব করে চাচ্ছে সোহানা বেঁচে থাকুক।একমাত্র সোহানাই মায়া চৌধুরীর ব্যপারে তাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারবে।সোহানার থেকে বিশদে সব কিছু জানা ভীষন জরুরী।

ভোর রাতের দিকে অভিরূপের বাবার অবস্থা খুব খারাপ হলো।শ্বাস কষ্ট,বুকে ব্যথা আর নাক দিয়ে রক্ত গড়াতে লাগলো।বাবার এহেন অবস্থায় অভিরূপ দিশেহারা হলো।ডক্টর নার্স সব ডেকে আনলো।শক্ত সামর্থ্য ছেলেটি কেঁদে ভাসালো।সেজদায় বসে গেলেন অভিরূপের মা অরুণা রহমান।অবস্থা বেগতিক দেখে ডিউটি ডক্টর বড় ডক্টর কে কল করলেন।ডক্টর অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে ক্যালসিয়াম গ্লুকোনেট ইনজেকশন পুশ করার ওর্ডার দিলেন।কিন্তু ডিউটি ডক্টর এর মনে হলো ইনজেকশন এ কাজ হবে না।তবুও সে ডোজ অনুযায়ী ইঞ্জেকশন পুশ করলেন।এতে অভিরূপের বাবার অবস্থা আরো খারাপ হলো।ডিউটি ডক্টর পূর্বের সব রিপোর্ট ফেলে নতুন করে টেস্ট করার আদেশ দিলেন।শুরু হলো নার্সদের দৌড়াদৌড়ি।স্পেশাল ভাবে স্যাম্পল কালেক্ট করে ল্যাবে পাঠানো হলো।আল্ট্রা করার সময় ডক্টর এর চোখ কপালে।অভিরূপের বাবার একটা কিডনি নেই।আরেকটা প্রায় বিকল।ঘটে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু।অভিরূপ কে ইমারজেন্সি ডাকা হলো।নার্স মারফত ডাক পেয়ে ছুটে এলো অভিরূপ

“আপনার বাবার লাস্ট অপারেশন কোথায় হয়েছিলো?
“ডিএমসি তে।
অবিশ্বাস্য চোখে ডক্টর অভিরূপের পানে তাকিয়ে বলে উঠলো
“এটা কি করে সম্ভব?আপনারা কি উনার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করিয়েছিলেন?
কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর কথা শুনে অভিরূপ অবাক হলো সেই সাথে ভয় ও পেলো।সে ফাঁকা মস্তিষ্ক হাতড়ে উত্তর করলো
“ইউরেটারিক স্টোন সার্জারি হয়েছে উনার মাস দুয়েক আগে।দেশের বাইরে ছিলাম আমি।মা সব সামলেছে।এরপর থেকেই উনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যেতেন।আর আমরা উনাকে হসপিটালে নিয়ে যেতাম।দুই এক দিন হসপিটাল ট্রিটমেন্ট নিলেই উনি পুনরায় সুস্থ হয়ে যেতেন।
ডক্টর কপাল কুঁচকে অল্ট্রার মনিটর অভিরূপের সামনে ধরে বললো

“উনার একটা কিডনি নেই।আরেকটা প্রায় বিকল।কেউ ডোনেশন করেছে।এটাও উনার নিজের নয়।আর রিপোর্ট এ লিখাই আছে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে।
ডক্টর এর থেকে রিপোর্ট নিয়ে তাতে নজর বুলালো অভিরূপ।সে মেডিকেল রিপোর্টস এসব বুঝেনা।এসব নিয়ে কখনো ঘাটাঘাটি ও করেনি।কিন্তু ডক্টর এর কথা অভিরূপ এর মাথার উপর দিয়ে গেলো সব।নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে।অভিরূপ চোখের জল ছেড়ে শুধালো
“আমার বাবা বাঁচবে তো ডক্টর?
হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলে ডক্টর উত্তর করলেন

“আল্লাহ কে ডাকুন।আর যার আন্ডারে অপারেশন হয়েছে তার নামে থানায় কেইস ফাইল করুন।
অভিরূপ বুঝলো বিশাল বড় ভরাডুবি হয়েছে তাদের।তাদের চোখে পট্টি বেঁধে কেউ নিয়ে গেছে তার বাবার সুস্থ দুই কিডনি।কিন্তু কেনো?এই মাঝবয়সী মানুষটার দুর্বল অর্গান দিয়ে কি কাজ তাদের?
সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে দুনিয়া ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমালেন অভিরূপ এর বাবা।শুধু কিডনিই নয় আরো কিছু অর্গান মিসিং ছিলো তার দেহে।কবে কবে এসব হয়েছে তা ঠাহরই করতে পারেনি অভিরূপ এর পরিবার।পরিবার বলতে অভিরূপের মা আর ছোট বোন।বাবাকে হারিয়ে ধপ করে হসপিটাল এর মেঝেতে বসে গেলো অভিরূপ।অরুণা রহমান এর করুন হৃদয় বিদারক চিৎকারে ভারী হলো হসপিটালের এর প্রতিটি কোণা।সারফরাজ কে কোন মতে কল করে খবরটা জানালো অভিরূপ।খবর পেয়ে ছুটে এলো সারফরাজ।অভিরূপ কে সামলানোর ভাষা তার নেই।শুধু বুকে আগলে কষ্ট জর্জরিত গলায় বলে উঠলো

“তোকে আমাকেও একদিন যেতে হবে।পুরুষের মানুষের মন এতো নরম হলে চলে?
সারফরাজ এর বুকে হামলে পরে কাঁদলো অভিরূপ।রূপকথাকে লুইস কল করলো।কিন্তু ফোন বন্ধ।সারফরাজ অভিরূপ এর নম্বর থেকে নেলিকে জানালো এই করুন ঘটনা।ভোর বেলায় ই ছুটে এলো নেলি।সে অরুণা আর অভিরূপ এর বোন কে কোন মতে সামলে নেবার চেষ্টা করলো।
হসপিটালের ঝামেলা শেষ করে অভিরূপ এর বাবাকে ফ্রিজিং এম্বুলেন্স এ তোলে অভিরূপ কে আর তার পরিবারকে ইয়ং আর লুইস এর কাছে দিয়ে সেই পুরোনো রিপোর্ট নিয়ে ছুটলো সারফরাজ ডিএমসি তে।পুরো ঘটনা গলায় পাড়া দিয়ে উগলিয়ে বের করবে সে।

কেবলই নিজস্ব চেম্বারে এসে গরম ধোয়া উঠা গ্রীন টি আর বাটার টোস্ট নিয়ে বসেছেন নেফ্রোলজিস্ট তারেক বাশার।চেম্বারের বাইরে শত শত রোগী অপেক্ষা করছে ।ব্রেকফাস্ট সেরেই শুরু হবে তাদের মস্তিষ্ক ওয়াশ।কোন রোগের কি অস্ত্রপচার হবে তা ডক্টর নিজেও জানেনা।ডিন ফারুক রেজা যা আদেশ করবে তাতেই তার সহমত।এসব অবলা মানুষ গুলোর অঙ্গহানি করে যদি নিজের পকেট ভারী করা যায় তবে ক্ষতি কি?আর এই জরাজীর্ণ ধরনীতে এতো বেঁচেই বা লাভ কি?
মুখে তৃপ্তির প্রশস্ত হাসি ঝুলিয়ে কাপে চুমুক বসানোর জন্য পেয়ালা মুখের সামনে তুলে ধরতেই খট করে খোলে গেলো চেম্বারের কাচের দরজা।দরজার লক আটকিয়ে হনহন পায়ে ডক্টর এর টেবিলের সামনে রিপোর্টস মেলে সারফরাজ ভারী স্বরে বললো

“এক্সপ্লেইন ইট।
রিপোর্টস দেখেই মুখের রঙ পাল্টে গেলো তারেক বাসার এর।সে তার এটেন্ডেন্স কে ডাকতে চাইলো সারফরাজ কে বের করে দেবার জন্য।কিন্তু সারফরাজ সেই সুযোগ তাকে না দিয়ে নিজের থাবা তুল্য হাত দিয়ে তাকের বাসার এর গলা টিপে ধরলো।অপর হাতে কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল তারেক এর কপালে লাগিয়ে হুংকার ছাড়লো
“পুরো কেচ্ছা শুনা।সময় খুব কম।
তারেক বাশার এর মিষ্টি সকাল মুহূর্তেই ভয়ংকরে রূপান্তরিত হলো।গলা শুকিয়ে কাঠ হলো।বুকে ধড়াস ধড়াস শব্দ হতে লাগলো।জমের হাতে পরে গিয়েছে বুঝতে পেরে মনে মনে ভাবল
“চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেলো যেনো।কারো কিছু তোয়াক্কা না করে তারেক বাসার এর কলার চেপে ধরে হসপিটাল ডিন ফারুক রেজার কক্ষের দিকে ছুটলো সারফরাজ।চয়ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার একজন কালো পোশাকধারী মানুষ একজন ডক্টর কে টেনে হিচড়ে কোথায় নিয়ে যাচ্চে সেই কৌতূহলে সকলের চোখ ছানা বড়া হলো।
ইতোমধ্যে হসপিটালের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে পুলিশের বহর।সারফরাজ নিজে সুফিয়ান চৌধুরী কে ফোন করে জানিয়েছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।প্রেস মিডিয়া,রিপোর্টারস এ কিলবিল করছে হসপিটাল প্রাঙ্গণ।নির্দেশ পাওয়া মাত্র শুরু হবে লাইভ টেলিকাস্ট।

ফারুক রেজার কক্ষের সামনে এসে দাড়ালো সারফরাজ।তার হাতে বন্দি এখনো তারেক বাশার।ঘটনা ইতোমধ্যে আঁচ করতে পেরে পালানোর পথ খোঁজে চলেছে চল্লিশোর্ধ্ব এই ডক্টর।
কিন্তু জাগুয়ার এর থাবা থেকে মুক্তি মেলা এতোই সহজ?
ফারুক রেজার কক্ষের দরজা লাথি দিয়ে খোলে তারেক বাসার কে সহ ভেতরে ঢুকলো সারফরাজ।আকস্মিক এমন ঘটনায় চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে দাড়ালেন ফারুক।সারফরাজ কে তিনি চেনেন।রুদ্ররাজ এর সাথে সারফরাজ এর বিষয়ে বহু বার আলাপ হয়েছে।কিন্তু সাক্ষাৎ হয়নি কখনো।কিন্তু ফার্স্ট মিটিং এমন ভয়ানক ভাবে হবে এটা যেনো ফারুক রেজার কল্পনাতীত।
ফারুক রেজার কক্ষে টিভি চলছিলো।সেই টিভিতে আকস্মিক নিউজ বুলেটিন শুরু হলো
“ডিএমসিএইচ হসপিটালের ডিন ফারুক রেজা এবং কয়েকজন বড় বড় ডক্টরস এর বিরুদ্ধে অর্গান পাচারের অভিযোগ।

নিউজ বুলেটিন শুনে ফারুক রেজার মাথা ঘুরে উঠলো।কঠিন ভাবে ফেঁসে গিয়েছে বুঝতে পেরে নিজের ড্রয়ার থেকে লাইসেন্স বিহীন বন্দুক বের করে শুট করতে চাইলো সারফরাজ কে।কিন্তু সারফরাজ যেনো এসব নাটকের ট্রেইলার আগে থেকেই জানতো।সে কোনো বাছবিচার না করেই ফারুক রেজার হাঁটুতে শুট করে দিলো।সহসাই চিৎকার করে মেঝেতে বসে পড়লেন ফারুক রেজা। নান্দনিক সাউন্ড প্রুফ কক্ষ ভেদ করে ফারুক রেজার কর্কশ চিৎকার বাইরে বেরুলো না।ফারুক রেজার অবস্থা দেখে কেঁপে উঠলো তারেক বাসার।উপায় না পেয়ে সারফরাজ এর পায়ে পরে কেঁদে উঠলো সে।

“বিশ্বাস করুন আমি কিছু করিনি।যা করেছে এই ফারুক রেজা করেছে।আমাকে মারবেন না প্লিজ।আমি সব সত্যি বলে দেবো।কে কে আছে এই চক্রে আমি সবার নাম বলে দেবো।
সারফরাজ তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠলো
“প্রানের বদলে প্রাণ।রক্তের বদলে রক্ত।
তারেক বাসার এবার হাউমাউ করে কাঁদলো।তারেক বাসার এর চোখে মুখে কয়েক ঘাঁ বসিয়ে সারফরাজ বললো
“মিডিয়ার সামনে সমস্ত সত্য উগলাবি?
তড়িৎ মাথা ঝাকিয়ে তারেক বাসার উত্তর করলো
“হ হ হ্যা সব বলবো,সব।

সুফিয়ান চৌধুরী দুজন পুলিশ অফিসার আর কয়েকজন কনস্টেবল নিয়ে প্রবেশ করলো ফারুক রেজার কক্ষে।আহত ফারুক রেজা আর তারেক বাশার কে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে শেল্টার ব্যাতিত ছুটলেন সুফিয়ান চৌধুরী।উত্তেজিত জনতা ইতোমধ্যে জেনে গেছে পুরো ঘটনা।কেউ কপাল চাপড়াচ্ছেন তো কেউ তেড়ে মারতে আসছেন।জনগণের হালকা পাতলা কিল চড় লাথি খেয়ে তারেক আর ফারুক এর চেহারার নকশা বদলে গেলো।
পুলিশের হাতে পরে মিডিয়ার সামনে নিজেদের দোষ স্বীকার করে ফট করে বলে দিলো রুদ্রের নাম।সেই সাথে রুদ্র কি কি ক্রাইমে জড়িত সেটাও বলে দিলো গড়গড় করে।
মুহূর্তেই রুদ্রের ছবি সহ নিউজ হলো
“ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল।
উপর মহল থেকে ওর্ডার এলো রুদ্রকে যত দ্রুত সম্ভব এরেস্ট করতে।পালানোর চেষ্টা করলেই ক্রস ফায়ার।কিন্তু কোথায় রুদ্ররাজ?

পেরিয়ে গিয়েছে এক সপ্তাহ।এই এক সপ্তাহে ঘটে গিয়েছে বেশ কিছু ঘটনা।কোর্টে চালানের পথেই তারেক বাশার আর ফারুক রেজাকে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে নৃশংস মৃত্যু দিয়েছে।পুলিশ জবানবন্দি দিয়েছে ক্রুদ্ধ জনতা এমন করেছে।কিন্তু ঘটনা পুরোটাই মিথ্যে।সুফিয়ান চৌধুরী জানেন কে করেছে এসব।কিন্তু কোন এক অজানা টানে তাকে দোষ মুক্ত করতে মরিয়া তিনি।তারেক বাসার আর ফারুক রেজা ছাড়াও আরো তিন জন ডক্টর এর খন্ডিত দেহ পাওয়া গিয়েছে।তাতে নেই চোখ,দাঁত, নখ জিভ বা হাত পা।প্রত্যেকটি লাশের রক্ত দিয়ে লিখা হয়েছে”কিলড বাই জাগুয়ার”।কিন্তু পাওয়া যায়নি কোনো প্রমাণ।সমস্ত প্রমান যেনো সূক্ষ ভাবে লোপাট করা হয়েছে।এখনো চলছে সেই নিষ্ঠুর খুনিকে ধরার নিরন্তর চেষ্টা।কিন্তু ডিপার্টমেন্ট সফল হবে তো?

এদিকে এই একটি সপ্তাহে রূপকথা একবারের জন্যও যোগাযোগ করেনি সারফরাজ এর সাথে।দেশের এহেন অবস্থায় রুদ্ররাজ সারফরাজ এর উপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে সেটা রূপকথা ভালো করেই জানে।এদিকে সারফরাজ এর কন্ঠ শুনতে না পেয়ে রূপকথার প্রাণ যায় যায় অবস্থা।অন্যদিকে মায়ার চিন্তায় তার বুক ভেঙে কান্না পায়।সারফরাজ নিজেও বেশ কয়েকবার কল করেছে দেখা করতে চেয়েছে কিন্তু এড়িয়ে গেছে রূপকথা।অভিরূপ কে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সেভাবে জোর করেনি সারফরাজ।

নিজের ফোনের ওয়ালপেপার এ দৃষ্টি স্থির করে ছটফট করে উঠলো রূপকথা।সারফরাজ কে স্বচক্ষে দেখার তৃষ্ণায় প্রাণ উড়ে গেলো।রুদ্র নিজেই চাপে আছে ,রূপকথার উপর কি নজর রাখবে?ভেবে সারফরাজ কে চোখের দেখা দেখার জন্য সারফরাজ এর বাড়ির উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো রূপকথা।ড্রয়িং রুমে বাজারের লিস্ট করছেন রেখা।রূপকথাকে এক নজর দেখলেন তিনি।মেয়েটা কেমন যেনো শুকিয়ে যাচ্ছে।খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করছে না।মেজাজ খিটখিটে থাকছে সব সময়।সমস্ত চঞ্চলতা যেনো মিইয়ে গেছে।সারাক্ষন নিজেকে গুটিয়ে রাখছে বদ্ধ ঘরে।রূপকথাকে একান্তে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেও মিলেনি উত্তর।
“কোথাও যাচ্ছিস?
রেখার প্রশ্নে মাথা নাড়ালো রূপকথা।বললো―

“অভিরূপ দের বাড়ি যাবো।ছেলেটার বাবা মারা গিয়েছে ,অথচ আমি এক বারো যাইনি।দৃষ্টি কটু দেখাচ্ছে।”
রেখা ছোট করে “ও” বললেন।এরপর বললেন
“একটু দাঁড়া আমি বাজারে যাবো।এক সঙ্গেই বেরোই।

রূপকথা দাঁড়ালো।ব্যগ নিয়ে হাসি মুখে বেরিয়ে এলো রেখা।সুপার শপে রেখাকে নামিয়ে বাস স্ট্যান্ডে হেটে গেলো রূপকথা।রূপকথার মনে হলো কেউ তাকে দেখে চলেছে।কিন্তু আশেপাশে নজর বুলিয়ে সেরকম সন্দেহ জনক কিছুই পাওয়া গেলো না।মনের ভ্রম ভেবে রামপুরার বাসে উঠলো রূপকথা।রাস্তায় জ্যম না থাকায় দ্রুতই পৌঁছে গেলো।গাড়ি থেকে নেমে হাটতে হাটতে একবার সারফরাজ কে কল করলো।কিন্তু কল তুললো না সারফরাজ।চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে সারফরাজ দের প্রকান্ড বাগান বাড়ির সামনে দাঁড়ালো রূপকথা।

চেকমেট পর্ব ৩৭

এরপর তপ্ত ভয়ার্ত শ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।সারফরাজ এর ড্রয়িং রুম থেকে কারো চিৎকার ভেসে আসছে।সেই সাথে সারফরাজ এর ভয়ংকর গর্জন।এক প্রকার দৌড়েই ভেতরে প্রবেশ করলো রূপকথা।কিন্তু সহসাই থেমে গেলো পা জোড়া।সারফরাজ এর বন্দুকে ঝরে গেলো একটি তাজা প্রাণ।ধপ করে রূপকথার উপর পড়ে গেলো সেই উষ্ণ রক্তিম দেহ।রূপকথার সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হলো।মুহূর্তেই কেঁপে উঠলো ফোন।এলো ভয়ানক বার্তা।
” শর্ত ভাঙার অপরাধে তোমার মায়ের নিথর দেহটা যদি মাঝ রাস্তায় পড়ে থাকে তবে কেমন মজা হবে বলোতো?

চেকমেট পর্ব ৩৯