ছায়ার মুখোশ পর্ব ১২
তাজরীন খন্দকার
আম্মা তোমারে নিয়া গিয়া এতক্ষণ ধইরা কি কইলো? ফাইজার পালায়া যাওয়ার ব্যপারে তাইলে তুমি কিছু জানো?
আরিদা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে, রাশেদের কথায় ঝাড়ু থামিয়ে উত্তর দিলো,
‘ জানলে কি হইছে?
‘ আমারে কও ফাইজা কই যাইতে পারে? ওরে খুঁইজা আনতে হইবোনা?
‘ কেউ তুইলা নিয়া গেলে খুঁইজা আনা লাগে, কিন্তু কেউ নিজে নিজে চইলা গেলে তারে ত্যাগ দিতে হয়। এইটাও জানেন না?
রাশেদ কথাটায় একটু ক্ষুব্ধ হলো, গড়গড় করে বললো,
‘ আমার বইনরে ত্যাগ দিয়া দিতে কও? তুমি ফাইজার যাওতাতে খুব খুশি দেখতাছি।
আরিদা কিছু বলতেই যাচ্ছিলো তখনি আরিদার শাশুড়ী ঘরে ঢুকলো। রাশেদ থতমত করে বললো,
‘ আম্মা আইলেন যে? কোনো কাজ আছে?
‘ তুই কি বাইর হবি?
‘ জ্বী আম্মা, আমার অনেক কাজ পইড়া আছে৷ আর অনেক ঝামেলা লাইগা আছে হিসাবনিকাশে। সমাধান করতে হইবো। তবে বেশিক্ষণ থাকুম না, ফাইজারে খুঁজতে হইবো।
‘ কই খুঁজবি ফাইজারে?
‘ আশেপাশে সব জায়গায় গিয়া খোঁজ নিমু, পুলিশসাহায্য নিমু। কিন্তু দিনটা দেখি ফিরা আইয়ে কিনা। কোনো কাজে গিয়া থাকলে আইয়া পড়বো।
‘ আচ্ছা তাইলে যা।
রাশেদ তার মার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আম্মা এখন না, আমি ঘণ্টাখানেক পরে যামু।
রাশেদের মা সাথে সাথে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ ঘণ্টাখানেক পরে ক্যান? তাড়াতাড়ি যা, কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হইবো। আর তুই তাড়াতাড়ি ফিরা আইবি। আমার ফাইজার লাইগা টেনশন হইতাছে।
‘ আচ্ছা তাইলে বাইরে নাস্তা কইরা নিমুনে আজ। আরিদা আমার মোজাগুলি একটু বাইর কইরা দেও।
আরিদা তার শাশুড়ীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রাশেদকে মোজা দিতে গেলো।
রাশেদ দুই মিনিটে শার্ট প্যান্ট আর মোজা পরে বের হয়ে গেলো। জুতা বাইরেই রাখা। রাশেদ যেতে না যেতেই আরিদার শাশুড়ী বলে উঠলো,
‘ আমি বাচ্চা তিনটারে শম্পার কাছে দিয়া আইতাছি। রাহাদরে লগে লইয়া যামু, এইডিরে নিলে পরে বাপের কাছে সব কইয়া দিবো।
শম্পা রাশেদের চাচাতো বোন, সে বাচ্চাদের ভালোই খেয়াল টেয়াল রাখে।
আরিদা রাহাদকে অল্প খিচুড়ি খাওয়ায়ে আধঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে গেলো। তার শাশুড়ী আরো ২৫ মিনিট আগেই রেডি হয়ে বসে আছে, আর তার পেছন পেছন ঘুরছে। আরিদা বিশ্বাসই করতে পারছেনা এটা তার শাশুড়ী তাও আবার এমন শাশুড়ী যে কিনা নিজের ছেলের সাথে তাকে সহ্য করতে পারেনা। এখন সে-ই নিজের স্বার্থে তার ব্যবহার আকাশ থেকে পাতালে নামিয়ে ফেলেছে।
ঘর থেকে বের হতে হতে আরিদা বললো,
‘ আম্মা আব্বার যদি কিছু লাগে?
‘ ওইটা আমি সামাল দিয়া আইছি। চিন্তা কইরোনা, তাড়াতাড়ি পা চালাও।
‘ কই যামু আম্মা?
‘ ফয়সালদের বাড়ি।
‘ ওরা কি ওইখানে থাকবো?
‘ আগে যাই? ফয়সালরে না পাইলে তো বুঝাই যাইবো ঘটনা কি। পরে এর ব্যবস্থা নিমু।
আরিদা আর কথা বললোনা। রাহাদ তার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে হাতের আঙুল মুখে দিয়ে রেখেছে। তারা রাস্তায় গিয়ে গাড়িতে উঠলো, আর শাশুড়ী জায়গার নাম বলে ন্যায্য ভাড়া থেকে দ্বিগুণ দিবে বলে যেতে বললো।
আরিদা রাহাদকে বুকের সাথে লেপ্টে ধরে বসে আছে, কোনো কথা নেই। তার শাশুড়ী এক দুইবার তাকে এমনি দেখলো। অনেক্ষণ পরে বললো,
‘ তুমি আমারে ভালা পাওনা না?
আরিদা এমন প্রশ্নে হঠাৎ স্তম্ভিত হলো। নেকাবের ভেতর দিয়ে ঢোলঢোল চোখ তাকিয়ে বললো,
‘ ভালা পামুনা ক্যান?
‘ এই যে আমি তোমারে রাশেদের থেইকা দূরে রাখবার চাই।
‘ হ্যাঁ এইটা ক্যান চান?
‘ কারণ আমি এই সময় তোমার কোলে বাচ্চা চাইনা, না চাওয়ার দুইটা সম্ভা কারণ। একটা হইতে পারে, বাচ্চা হইলে তোমার আর চাইরটা বাচ্চা তোমার চোখে আলাদা হইয়া যাইবো, আরেকটা হইতে পারে তা হইলো তুমি এদের সন্তানের মতো আগলাইয়া রাইখা আবার তোমারটারে সামলাইতে গিয়া শিরিনের মতন অবস্থায় পড়বা,আর আমি চাইনা তোমারও লগে খারাপ হোক। আমি আমার পোলারে আর বিয়া করাইতে চাইনা।
আরিদা বিষয়টাকে সহজভাবে নিলোনা, একটু ধাঁচের সাথে বললো,
‘ সেইটা অন্যভাবেও কওন যাইতো। বিস্তারিত জানি তখন নাই কইতেন, শুধু কইতে পারতেন বাচ্চা নেওনের লাইগা সময় নিতে।
‘ কইতে পারতাম, কিন্তু কইতে পারি নাই। কি ভাব্বা সেইটা ভাইবা।
‘ কিন্তু বিয়ার পরে পোলার লগে থাকতে দেন না, সেটা নিয়া যা ভাবছি তার থেইকা ওইটা ভাবা তো হাজারগুণ ভালা আছিলো।
আরিদার শাশুড়ী বোরকার আড়ালেও যে বড় করে একটা দম নিয়ে ঢুক গিলেছে যা আরিদা স্পষ্ট টের পেয়েছে। তখন তার শাশুড়ী সামনে আঙুল দিয়ে বললো,
‘ ওই যে বাউন্ডারি দেখতাছো ওইটা শিরিনের ফুফুর বাড়ি। আর ৫ মিনিট পরেই আমরা পৌঁছাই যামু।
আরিদা তার শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে ভাবছে,কীভাবে এরা প্রসঙ্গ পাল্টায়! এমন করে পাল্টায় যে এরপর সেটা নিয়ে প্রশ্নও করা যায়না।
ওরা নেমে গেলো। নেমে আরিদার শাশুড়ী ভাড়া দিয়ে আরিদার হাত ধরে টেনে তাকে পেছনে থাকতে বলে নিজে আগে আগে গেলো। বাড়ির উঠানে পা রাখতেই আনুমানিক ১৫-১৬ বছর বয়সী একটা মেয়ে জোরে হাঁক ছেড়ে উঠলো,
‘ আম্মাগো মাঐ আইছে, আমরার রাহাদও আইছে।
বলেই দৌঁড় এসে আরিদার হাত থেকে রাহাদকে ছিনিয়ে নিয়ে দুইগালে ইচ্ছেমতো চুমু খেতে লাগলো। আরিদা কিছু বলতে গিয়েও বললোনা। আজ যদি রাহাদের মা বেঁচে থাকতো আর এই জায়গায় এভাবে আসতো ঠিক এমন মূহুর্তই তৈরি হতো।
কোথা থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে হাতে তরকারি নাড়ার কাঠি নিয়ে ছুটে এলো এক মহিলা। এসেই অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগলো,আর বলতে লাগলো…
‘ আমার মাইয়াডারে শেষ কইরা এই পাপী চেহেরা নিয়া কেমনে আইলেন আপনারা? মাইয়াডা মরার পরে আমার নাতিগুলারেও একটা নজর দেখতে দিলেন না, এই কেউ আছেনি এরারে জিগা আজকা আমরার কাছে কি চায়?
মহিলার আহাজারিতে আরিদার বুক কাঁপছে! শত হোক মানুষটা রাফি, রাফান, রাইসা, রাহাদের নানী। তার নাতি নাতনির জন্য তার আলাদা মায়া আছে, যদি শিরিন মরার পরে সত্যিই ওদেরকে দেখতে না দিয়ে থাকে অবশ্যই এটা খারাপ করেছে। আরিদার শাশুড়ী কতক্ষণ বিলাপ শুনলো, এরপর সে তার আজকে আসার উদ্দেশ্য জোরে জোরে বলতে লাগলো,
‘ আপনার পোলারে আগে জিগান আমার মাইয়া কই? এতোবড় কইলজা হের কি কইরা হইলো যে আমার মাইয়ারে উডায়া নিয়া আসে।
‘ হয়রে! আমার পোলার খাইয়া আর কাম নাই খুনির বাড়ির মাইয়ারে উডায়া আনবো, গিয়া দেখেন কোন বেডার লগে গেছেগা।
আরিদার শাশুড়ী সেই মাপিক আবার পাল্টা উত্তর দিচ্ছে, উনিও বলছেন। এভাবে একটা হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেছে, মানুষজন জড়ো হয়ে তাদের এই তামাশা দেখছে। আরিদা খেয়াল করলো রাহাদ এসবে ভয় পাচ্ছে। সে এগিয়ে গিয়ে রাহাদকে কোলে নিতে নিতে বললো,
‘ তোমার নাম কি?
রাহাদকে কোলে নেওয়া মেয়েটা বললো,
‘ আইরিন।
‘ হাই স্কুলে পড়ো?
‘ জ্বী টেনে পড়ি।
‘ ফয়সাল তোমার কি লাগে?
‘ আমার ভাই
‘ তুমি তাইলে তাদের বইন? আইচ্ছা তোমার ভাই কই জানো?
‘ ভাই তো হের কামে কামে বাইরে থাকে।
‘ নাম্বার মুখস্থ আছে?
‘ আছে।
শুনেই আরিদা পুলকিত হলো। এক হাতে রাহাদ আর আরেক হাতে হাতব্যাগ থেকে নিজের মোবাইল খুলে বললো,
‘ কও তো নাম্বারডা?
‘ 01*********
সাথে সাথেই আরিদা ফোন লাগালো। ওইদিকে দুই প্রাক্তন বেয়াইনের কথার লড়াই চলছে, কেউ কাউকে ছাড়ছেনা।
প্রথমবার রিং বেজে কেটে গেলো, ধরলোনা। আরিদা আবারও ফোন দিলো। বাজতে বাজতে প্রায় কেটে যাওয়ার পথে ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ কে?
আরিদা হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে উত্তর দিলো,
‘ আমি রাফিদের নতুন আম্মা।
‘ আমারে ফোন দিছেন ক্যান? নাম্বার পাইলেন কই?
‘ পাইছি যেইখান থেইকাই হোক। ফাইজারে নিয়া কই আছো কও।
‘ ফাইজারে আমি নিতে যামু ক্যান?
‘ মিথ্যা কইবানা ফয়সাল। আমি সবই জানি।
‘ কি জানেন জানিনা, কিন্তু আমি ফাইজারে নিয়া কোথাও যাই নাই। আর কথা না থাকলে রাখেন..
বলার সময়ই ফাইজার ক্ষীণ গলার স্বর কানে এলো, ফাইজা বলছে,
‘ আমি তো রেডি, আইয়ো।
আরিদা জোরে বলে উঠলো,
‘ এই এই ফাইজা আপনার কাছে, আমি কথা শুননছি।
এই এই আপনারা ঝগড়া থামান, ফাইজারে পাওয়া গেছে, ফয়সালের লগে ফাইজা। (জোরে সবাইকে ডাকলো আরিদা)
এটা শুনেই সবাই সব থামিয়ে দিয়ে ছুটে আরিদার কাছে এলো।
ফয়সাল এখনো ফোন কাটেনি, সে কথা বলছেনা কিন্তু ফাইজা ওদিকে প্রশ্ন করতেছে,
‘ কি কার লগে কথা কও, যাইবানা কাজী অফিসে?
‘ হ যামু, অফিসেত্তে কল দিয়া গান শুনাইতেছে আমারে।
আরিদা লাউড স্পিকার দিয়ে রাখছে, সবাই এসব কথা আর কাজী অফিস কথাটা শুনে হড্ডগোল শুরু করে দিয়েছে, এদিকে সবকিছু ফয়সাল কানে দিয়ে শুনছে,কিন্তু ফাইজার সামনে এমন ভাব করছে যেন আসলেই অফিসের ফোন।
আরিদা এদিকে বারবার ডাকছে, কোথায় আছে জানাতে বলতেছে কিন্তু কোনো জবাব নেই।
হঠাৎ ফয়সাল বলে উঠলো,
‘ ফাইজা যাও, আমি দরজা লাগাইয়া আইতাছি।
ছায়ার মুখোশ পর্ব ১১
২০ সেকেন্ড পর ফয়সাল ফোনে আরিদার প্রতিত্তোর দিলো, মারাত্মক আক্রোশের সাথে বললো,
‘ তোর জামাই যেমনে আমার বইনরে একটার পর একটা, একটার পর একটা বাচ্চা দিয়া পাগল বানাইয়া মারছে, আমিও তোর জামাইয়ের বইনরে আস্তে আস্তে ওইরকম কইরাই মারুম। বিয়া করতে যাইতাছি,সবাইরে কইয়া দে দোয়া করতো।
বলেই ফোন কেটে দিলো। আরিদা ফোন কান থেকে নামাতে নামাতে দেখলো সবাই তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
একটার পর একটা বাচ্চা দিয়ে প্রতিশোধ? হাসবে নাকি দুঃখ পাবে বুঝতে পারছেনা।