ছায়ার মুখোশ পর্ব ১৫
তাজরীন খন্দকার
অজ্ঞাত মহিলার পরিচয় নিয়ে প্রথমে আরিদার কোনো মাথা ব্যথা না থাকলেও রাশেদের আচরণে তার খটকা লাগছে। সে কেন একটা মহিলা মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করবে?
পরিচয়টা রাশেদের আগে সেই মহিলাই দিতে যাচ্ছিলো তখনি তার শাশুড়ী কোথা থেকে যেন পরিশ্রান্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো। ঢুকেই হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,
‘ মানতাসা তুমি এই বাড়িত ক্যান আইলা? যাও চইলা যাও এক্ষনি।
আঙুল দিয়ে ইশারা করে বের হওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে।
আরিদা তার শাশুড়ীর এমন কান্ডে মারাত্মক চমকপ্রদ হলো। সে মেয়েটার রহস্যময় হাসিতে ঠাসা চেহেরাটার দিকে তাকালো। কি হচ্ছে? তার শাশুড়ীও দেখি তাকে চিনে!
অন্যদিকে রাশেদের চোখমুখ লাল হয়ে আছে, দাঁতে দাঁত চেপে আছে। মানতাসা এগিয়ে গিয়ে রাশেদের মায়ের কাঁধে আলতো ছুঁয়ে বললো,
‘ রিলেক্স আন্টি, আমি তো আপনাদের কাছের মানুষ, আমি আসার খবর পেয়ে এতো নার্ভাস হয়ে ছুটে আসার কিছু নেই! বসুন কথা বলি।
আরিদার শাশুড়ী কাঁধটা হাতের জায়গা থেকে সরিয়ে নিলো। আর বললো,
‘ সরো।
মেয়েটা অদ্ভুতভাবে হেসে হাত গুটিয়ে নিয়ে বললো,
‘ আপনার ছেলে আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করছেনা, ভাবলাম দেখে আসি কি অবস্থা তার। কিন্তু এসে দেখি সে বিয়ে করে নিয়েছে। হোয়াট এ্য সারপ্রাইজ! আমাকে দাওয়াতও দিলোনা হাহাহাহ।
রাশেদ হাতের মুষ্টি শক্ত করে বললো,
‘ চলে যাও মানতাসা। আমাকে রাগালে খারাপ হবে!
‘ কেন? ভয় পাচ্ছো? ভয়ই যদি পাও তাহলে আমার সাথে এ বিচ্ছেদ উঠিয়ে নাও প্লিজ, একদম আগের মতো হয়ে যাও। আমি তোমার বউকে কিচ্ছু বলবোনা প্রমিজ!
আরিদার হাত থেকে বালতিটা নিচে পড়ে গেলো। রাশেদ গর্জন করে বলে উঠলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ বলেই দিয়ে আবার বলবিনা বলছিস?কখনোই আগের মতো হবোনা? কি করবি তুই হ্যাঁ?বাকি সব বলে দিবি? দে দে সবই বলে দে। শুরু যখন করেছিস শেষও করতে হবে।
আরিদার সারা শরীর কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট কাঁপছে। আরিদার শাশুড়ী আস্তে আস্তে গিয়ে আরিদার হাতটা ধরলো, আরিদা কাঁদতে কাঁদতে ভঙ্গুর স্বরে বলে উঠলো,
‘ আম্মা এই মহিলা কে? কি বলতাছে এইগুলা? আমি কিচ্ছু বুঝতাছিনা, আমারে আপনি কন এইসব কি?
মানতাসা গুটিগুটি পায়ে আরিদার কাছে এলো। মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
‘ তোমার স্বামীর প্রথম প্রেম আমি, অবশ্য আমারও প্রথম প্রেমই ছিলো। সেই ১৮ বছর আগে ১৭ বছর বয়সী আমি আর ২২ বছর বয়সী রাশেদ আহা, কি প্রেম! চিঠি লিখে লিখে আমাদের কতো ভালোবাসা বিনিময় হতো! তাইনা রাশেদ? কিন্তু তারপর…
রাশেদ পেছন থেকে এসে মানতাসার পিঠে জোরে একটা ধাক্কা মারলো, আর বললো,
‘ এক্ষুনি বের হবি নয়তো তোর লাশ পড়বে। যাহ, বের হ!
আচমকা ধাক্কায় মানতাসা পড়তে পড়তে কোনোরকম বেঁচে গেলো। সোজা হয়ে চুল ঠিক করতে লাগলো। তার হাসিখুশি মুখটা এবার বিদঘুটে রূপ নিলো। চোখগুলো ঘোলাটে লাগছে, স্বরের মধুরতা কেটে গেছে, এবার সে কর্কশ গলায় বলছে,
‘ মিস্টার রাশেদ! আপনার এই মুখোশটা আর কতদিন পরে রাখবেন? নিজের এই দুঃসহ ছায়া কতদিন আলোর দূরত্বে রাখবেন? মনের গোপন দ্বন্দ্ব আর দ্বৈত পরিচয়টা থেকে বের হোন। আপনি যা সবাইকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন আপনি তা না।
আপনার ছায়াকে মুখোশ পরিয়ে ভালো হওয়ার নাটক দয়া করে বন্ধ করুন, অন্যায় হচ্ছে।
তারপর মানতাসা হাত বাড়িয়ে থমকে থাকা আরিদার হাতে একটা কার্ড দিয়ে বললো,
‘ কোনো কিছু জানার দরকার হলে যোগাযোগ করো। আমি যাই এখন!
আরিদা আস্তে করে হাতে নিলো কিন্তু দেখলোনা। রাশেদ আরিদার তাকিয়ে আছে, আর আরিদা তাকিয়ে আছে মানতাসার চলে যাওয়ার দিকে। মানতাসা দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলো।
নিস্তব্ধ পরিবেশ! কিছুক্ষণ সবাই বরফে মতো স্ট্যাটু হয়ে আছে,নড়াচড়া নেই৷ হঠাৎ রাশেদ ছুটে এসে আরিদার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। আর শব্দ করে কাঁদতে লাগলো! আরিদাও এবার ফুঁপিয়ে কাঁদছে! আরিদা ভালোমতো কিছুই শুনেনি, কিন্তু যা শুনেছে তাতেই তার কলিজা ফেটে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পায়ের নিচে মাটি অনূভব করতে পারছেনা। আরিদার শাশুড়ী পাশে চেয়ারটায় মাথায় দিয়ে বসে আছে।
রাশেদ মাথা নিচু করে হাত করজোড় করে বললো,
‘ আমারে মাফ কইরা দাও!
রাশেদের কান্নায় আরিদার হৃদয় ব্যকুল হচ্ছে! পুরুষ মানুষের কান্না নারীদের সহ্য করার ক্ষমতা কমই হয়। সে মাফ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মাথায় হাত রাখতেই যাবে তখন কি যেন মনে হতে সে আবার পিছিয়ে গেলো। আর বলে উঠলো,
‘ কিসের লাইগা মাফ চাইতাছেন? আমি তো খালি আপনার ২২ বছর বয়সের প্রেমের কথাই জানছি, এইটার লাইগা মাফ চাইবেন ক্যান? এইটা কোনো মাফ চাওনের বিষয় না। আগে মাফ চাওয়ার সঠিক কারণ কন!
আর কতো পালায়া বেড়াইবেন। আমিও এর পিছে ছুটতে ছুটতে পাগল হইয়া গেছি। মুক্তি দেন দয়া কইরা।
রাশেদ মাথা উঁচু করে আরিদার দিকে তাকিয়ে বললো ,
‘ বলতে পারুম না আমি! আমারে কোনোদিনও মাফ করবানা তাইলে। কিছু জানতে চাওয়োনা দোহাই!
আরিদা এবার হাতের কার্ডটার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আপনি কইতে না পারলে মানতাসার কাছ থেইকাই শুনুম। উঠেন!
রাশেদ উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। আর বললো,
‘ না! আমিই কমু। ওই মহিলার সাথে কথা কইবানা কোনোদিন।
আরিদার শাশুড়ী চেয়ার থেকে উঠে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। মনে হচ্ছে রাশেদ যা বলবে তা তিনি আগে থেকেই জানেন। রাহাদ ঘুমাচ্ছে আর বাচ্চারা এখনো স্কুল থেকে আসেনি। কথা বলার এটাই সুযোগ!
আরিদা চাতক পাখির মতো তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ তাহলে কি? সত্যিটা কন!
রাশেদ আরিদাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে টেবিলে বসে পড়লো। তারপর টেবিলের উপরে থাকা জগটা হাতে নিলো,গ্লাসে না ঢেলেই ঢকঢক করে আধা জগ পানি খেয়ে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিলো। তারপর ডান হাতটা টেবিলের উপরে আওয়াজ করে রেখে বলতে লাগলো,
‘ তখন আমি ডিগ্রীতে ভর্তি হইছি। ভালা ছাত্র ছিলাম না বইলা গ্রামের ডিগ্রি কলেজই আমার ভরসা আছিলো। সেইবার গ্রীষ্মকালে সরদার বাড়ির আমজাদ আলী সরদার ঢাকা থেইকা পরিবার নিয়া গেরামে ছুটি কাটাইতে আইছে। তারা অনেক টাকা পয়সার মালিক, গেরামেই তাদের রাজকীয় বাড়ি। কিন্তু আমি হইলাম হযবরল এক আকাইম্মা পোলা। বাপের কৃষিতেও সাহায্য করতাম না, পড়ালেখাও করতাম না। খালি গায়ে বাতাস লাগাইয়া ঘুরতাম, আর এমনেই দেখা হইছিলো মানতাসার সাথে, আম পাড়ার লাইগা গাছের নিচে দাঁড়ায়া আছিলো, আমি এক দেখাতেই কাবু হইয়া গেলাম। আর পরেরদিনই একটা অসম্ভব কাজ কইরা ফেললাম, আমজাদ আলী সরদারের মাইরারে প্রেমের প্রস্তাব দিলাম, যা কারোর সাহসে কূলায় না ।
শহরের স্মার্ট সুন্দরী মাইয়া, সবার নজরেই আছিলো, কিন্তু কপাল খুলছিলো আমার। কেমনে জানি সেও আমারে ভালোবাইসা ফালাইলো। সেইবার ১০-১৫ দিন অনেক লুকোচুরি কইরা দেখা করছি, কখনো রাস্তায়, কখনো সে বাড়ির জানালায় আর আমি পথের মধ্যে দাঁড়ায়া ইশারায় কথা কইছি। তারপর ছুটি শেষ হইয়া গেলো, সেও চইলা গেলো ঢাকায়। কতো ছটফট করছি দেখা হয়না বইলা!
কিন্তু আমাদের কথা হইতো, চিঠি পাঠাইতাম আর এক সপ্তাহ উত্তরের অপেক্ষায় বইসা থাকতাম।দুইজনেই দুইজনের লাইগা পাগল হইয়া গেলাম। দেখতে দেখতে তারা আবার আইলো শীতে। তখনই কপালে জম লাগলো! বাড়ির পেছনে দেখা করতে গিয়া ধরা খাইছিলাম। আমজাদ আলী আমারে তাএ প্যান্টের বেল্ট খুইলা ইইচ্ছামতো মারছিলো। শরীর ফাইটা রক্ত বাইয়া মাটিতে পড়ছিলো। কিন্তু আমি আমার ভালোবাসার কথা বুক টান কইরা কইছিলাম! সে তখন কইছে আমার মতোন ছোটলোকের বাচ্চার সাহস কি কইরা হইছে চান্দের দিকে হাত বাড়ানোর। আর একটা কথা কইছে যা এখনো আমার কানে বাজে ‘ তোর মতো ফকিন্নিরে আমার বাড়ির কাজের লোকও বানাইনা। সেই যোগ্যতাও তোর নাই, আবার আমার মেয়ের দিকে নজর দেস”৷
এরপর আর আমার মানতাসার সাথে কোনো যোগাযোগ হয় নাই, কইছিলো যোগাযোগ করলে আব্বারে ন্যাড়া কইরা একমাইল রাস্তা নাকে খত দেওয়াবে। আমি আব্বার মুখের দিকে তাকাইয়া কোনোদিন আর ওই ঠিকানায় চিঠি দেইনাই। ওরা গেরামে আইলেও ঘর থেইকা বাইর হই নাই। কিন্তু আমার মইধ্যে একটা জিদ কাজ করছিলো, একদিন হের থেইকা বেশি ধনী হওয়ার জিদ। লাইগা পড়ছিলাম জীবনযুদ্ধে। আমারে এত টাকা কামাইতে হইবো যে, যে টাকা দিয়া আমি আমজাদের কাছ থেইকা মানতাসারে কিইনা নিতে পারুম। তখন শুধু জিগামু,কতকোটি লাগবো?
কিন্তু টাকা কামানো কি অত সোজা?, মানতাসার আমেরিকায় বসবাসকারী একজনের লগে বিয়া হইয়া গেলো। আমি সব আশা ছাইড়া হতাশানি হইয়া এদিক ওদিক ঘুরতাম, পরে আম্মা আমারেও বিয়া করাইয়া দিলো।
শিরিনরে পাইয়া আমি আমার নিজেরে আবার খুঁইজা পাইলাম। সেই শূন্য পকেটে মানুষটা আমার পাশে ছায়া হইয়া আইছিলো, এরপর আমার সফলতার একক সঙ্গী হইলো। ভাগ্য আমার সহায় হইলো, আমার ছোট্ট ব্যবসা বড় হইতে হইতে বিশাল ডালপালা ছড়াইলো। আমার ব্যাংকে প্রতিদিন বড় বড় অংকের টাকা ঢুকতে লাগলো, যা আমি গণনাও করতে পারিনা। কিন্তু আমি টাকা দিয়া আয়েস করিনাই, জমাইতেছিলাম। ওই যে আমার এক তাড়না বুকে জইমা আছে! একদিন আমি আমজাদরে টাকার বিনিময়ে কিইনা নিমু! হইতে হইতে তা এতো হইয়া গেলো যে তারপর চাইলে আমি আমজাদরে একবার না অসংখ্যবার কেনার সামর্থ্য রাখি।
ছায়ার মুখোশ পর্ব ১৪
রাশেদ আবারও পানির জগ উপুড় করে পানি খেতে লাগলো,আরিদা পেছন থেকে প্রশ্ন করলো,
‘ আপনি কি তার কাছে গেছিলেন?
‘ না যাই নাই, গিয়া কি হইবো? আমার আলাদা পথ হয়েছে, মানতাসা তো আরো আগেই অন্য পথের পথিক।
আরিদা ঢুক গিলে বললো,
‘ তাইলে কি হইলো যে সে আপনারে এইভাবে উল্লেখ কইরা গেলো? আপনি কি কইরা মুখোশ পইরা আছেন?