ছায়ার মুখোশ পর্ব ৩
তাজরীন খন্দকার
সতীনের চুড়ি এভাবে হাতে পড়ে থাকতে একদমই ভালো লাগছেনা৷ পটাপট চুড়িজোড়া খুলে ফাইজার হাতে দিলো আরিদা।
ফাইজা হাতে নিয়ে আরিদার মলিন মুখটার দিকে তাকালো,তারপর ফিরিয়ে দিতে চেয়ে বললো,
‘ আমি কি করুম এইগুলা দিয়া? আপনার মন চাইলে পইড়া রাখেন।
আরিদা আস্তে করে বললো,
‘ রাইখা দেও,পরে নিমুনে। চা বওয়াইয়া আইছি, রাহাদকে নিয়া যাই, তুমি ঘুমাইলে একটু ঘুমাও।
ফাইজা কিছু বললোনা,চুড়িগুলো তার হাতেই রইলো। ফাইজা যে শিরিনের জিনিস আরিদার কাছে দেখতে চায়না সেই বিষয়ে ভালোই ধারণা পেয়ে গেছে আরিদা। নাহলে এমন ব্যবহার কে করতো? তাকে এটা সম্পর্কে না বললেও খুব ক্ষতি হতো না! তারা মা বেটি কি আগের বউয়ের জায়গা কাউকে দিবেনা বলে এমন করছে? এটা তো করলে করার ছিলো তার স্বামীর, অনেক বছরের সংসারে মায়াটান থেকে করতেই পারতো, কিন্তু বেচারা তো তার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। এদিকে তারা তাদেরকে সামনাসামনিই হতে দিচ্ছেনা!
আরিদা রাহাদকে নিয়ে গিয়ে ফ্লোরে খেলনা দিয়ে বসিয়ে চা ঢাললো, ট্রে-তে করে দ্রুত তার শাশুড়ীর রুমে গেলো, রাহাদকে একা রাখা যাবেনা ব্যথা পেতে পারে, আবার এক হাতে ট্রে আর অন্য হাতে রাহাদকেও নেওয়া যাবেনা, ব্যপারটা রিস্কি!
রুমে গিয়ে চা দেওয়ার পর তার শাশুড়ী বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ ওয়্যারড্রবের উপরে থেইকা বিস্কুটের বয়ামটা দেও।
আরিদা চা দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলো এর মধ্যে আবার! বিষয় না, সময় লাগবেনা এই চিন্তায় সে দ্রুততার সহিত বয়ামটা এনে শাশুড়ীর হাতে দিলো, তার শাশুড়ী হাতে নিয়েই বললো,
‘ দাঁড়াও আবার নিয়া রাইখা দিও৷
আরিদা দাঁত চেপে আছে,অস্থির লাগছে! রাহাদ ওদিকে কি করছে কে জানে? চলে যাবে কিনা বুঝতে পারছেনা, রাহাদকে রেখে এসেছে বলবে কি বলবেনা? কিন্তু এইতো শেষ, চলে যেতে পারবে। বিস্কিট রাখার পর আরিদা এক প্রকার টান দিয়ে বয়ামটা নিয়ে ওয়্যারড্রবের উপর রাখতে যাবে তখনি শুনলো রাহাদ জোরে চিৎকার করে উঠেছে। যা ভয় পেয়েছিলো তাই হয়েছে। আরিদা দৌঁড়ে বের হয়ে গেলো, ওপাশ থেকে আরো একজন ছুটে এসেছে, আরিদা কোলে নেওয়ার আগেই বিশালদেহী একজন রাহাদকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ‘ বাবা কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু হয়নি বলে জপ করছে।
আরিদা তাকিয়ে আছে! কাঁচাপাকা মিলিয়ে চুল, হালকা ভাঁজ পড়ে যাওয়া চোখ মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, ৪০+ বয়সী কোনো পুরুষও এতো সুদর্শন হয়? এটা তার স্বামী? চিন্তা করতেই রোমাঞ্চকর অনূভুতি হলো। তবে মূহুর্তেই সেই রোমাঞ্চকর অনূভুতি রূপ নিলো তিক্ত ঝাঁঝালো অনূভুতিতে কারণ তার শাশুড়ীর পেছন থেকে বলছে,
‘ কেমন আত্মাডা তোমার,নয়া নয়া বওন শিখছে ওরে একলা রাইখা কেমনে গেলাগা?
আরিদার পাল্টা জবাব দেওয়ার ইচ্ছে করছে,উনি এতো ফরমাশ না দিলে তো এটা হতোনা, সে তো কতটুকু সময়ের মধ্যে তার ফিরে আসা উচিত তা স্থির করেই গিয়েছিলো, উনিই তো বাড়াবাড়ি করেছেন। কিন্তু কিছু বললোনা ভেতরেই সব হজম করলো। তবে রাশেদ হাসিমুখে বললো,
‘ থাইমা গেছে আম্মা, অল্প ব্যথা পাইছে, এই সময় বাচ্চারা একটু আকটু ব্যথা পাইয়াই থাকে।
গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন,
‘ হুম, তাও সাবধানে থাকতে অইবো, রান্নাবাড়ায় ঝামেলা অইলে আমি করুম কিন্তু বাচ্চাগুলির অযত্ন যেন না অয় ।
আরিদা মাথা নাড়লো। নিশ্চুপ আরিদার দিকে রাশেদ অনেক্ষণ ধরেই তাকিয়ে আছে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মার কথাকে কেন্দ্র করে আরিদাকে এই মনে হয় প্রথম বউ হিসেবে ভালো করে দেখছে! আরিদা তার আগের বউ শিরিনের মতো ফর্সা নয়, সে শ্যাম বর্ণের সাদামাটা একটা মেয়ে। ভ্রু দুইটা একটা আরেকটার সাথে লেগে আছে,জোড়াভ্রু যাকে বলে। গালের দুপাশে হালকা পশম বিছিয়ে আছে, ২৮ বছর বয়সী একজন বিধবা মহিলাকে রাশেদের কাছে ১৬ বছর বয়সের দুরন্ত প্রেমিকাসুলভ মনে হচ্ছে, ক্লাস নাইনে এমন শ্যাম বর্ণের এক মেয়ের প্রেম পড়েছিলো রাশেদ! তাই মনে হয় এমন লাগছে। চিকনাচাকনা আরিদা স্কুল ড্রেস পরলে তাকেও ঠিক স্কুল পড়োয়া ছাত্রী মনে হতে পারে!
কি যেন ভাবছে সে আবোলতাবোল! যখন খেয়ালে এলো দেখলো সামনে কেউই নেই তার মা আর বউ দুজনেই ইতোমধ্যে চলে গেছে। কখন চলে গেলো টেরই পেলোনা। স্কুলের সেই মেয়ের পেছনে পেছনে গিয়ে মেয়ের ভাইয়ের হাতে মার খেয়েছিলো, এখন তার বউয়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে মার কাছে নাস্তানাবুদ হচ্ছে, শ্যামলা মেয়েদেরকে কি সহজে পাওয়া যায়না নাকি?
রাহাদকে কোলে নিয়ে ঘরে গেলো। তিনজন এখনো ঘুমুচ্ছে। রাশেদ রাহাদকে বিছানায় বসিয়ে তিনজনের মাথায় একে একে হাত বুলিয়ে দিলো।
রাত এগারোটা । আরিদা রাহাদকে ঘুম পাড়িয়ে চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে বসে রইলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে জানে রাশেদের কাছে চাবি আছে, বাসায় ঢুকতে পারবে। তবে কেন জানি তার ইচ্ছে করছে অপেক্ষা করতে। রাতে খাক না খাক, প্রশ্নটুকু অন্তত করতে পারবে খাবে কিনা?
ঘুমে ঢুলছে আরিদা তবুও বসে আছে। পায়ে মশা কামড়াচ্ছে, তবুও রুমে যাচ্ছেনা। বারোটা বেজে গেছে এখনো আসেনি। ১১ টার দিকেই তো আসে। হয়তো রাস্তায় দেরি হচ্ছে, আরিদা বসেই আছে। ঘুমে সে তলিয়ে যাচ্ছে যাচ্ছে আবার উঠছে। এমন করতে করতে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়লো। হঠাৎ রাহাদের কান্নায় আরিদা ধড়ফড়িয়ে উঠলো, দৌঁড়ে রুমে গেলো। গিয়ে দেখলো ফাইজা উঠে দুধ বানাচ্ছে৷ আরিদাকে বাইরে থেকে আসতে দেখে বললো,
‘ ভাইয়ের লাইগা অপেক্ষা করছিলেন? ভাইয়ে তো আইবোনা।
আরিদা থতমত করে বললো,
‘ অপেক্ষা না, আসলে, অই..আচ্ছা আইবোনা ক্যান?
ফাইজা না শোনার ভান করে রাহাদকে দুধ খাওয়াতে লাগলো। আরিদা আবারও প্রশ্ন করলো,
‘ আজকে কাজ বেশি নাকি?
ফাইজা আরিদার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘ জানিনাতো!
ফাইজা বিরক্ত হচ্ছে। কেন হচ্ছে? আরিদা তার স্বামীকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারেনা নাকি? এরা এমন অদ্ভুত কেন?
মনটা খারাপ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো।
পরেরদিন আরিদার দুইভাই আসছে আরিদাকে নিতে। আরিদার শাশুড়ী তাদেরকে বুঝাচ্ছে তার পরিবারে আরিদা এখন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একদিনের জন্যও যেতে দেওয়া যাবেনা। সময় সুযোগ করে তার ছেলে নিয়ে যাবে। তারাও তাতে হ্যাঁ সম্মতি দিলো । তারাও চায়না তাদের বোন বেশি বেশি যাক, চার বছরে তাদের বউদের ঘ্যানঘ্যানিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো, এখন তাদের মার অনুরোধে সামাজিকতা রক্ষার্থে কেবল দেখতে এসেছে৷ আরিদা আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। সবাইই তার মানুষ অথচ তাদের কাছে তার স্থান অবহেলার শীর্ষে। ভেবেছিলো কোনো রকম বিয়ে হয়ে গেলে বোধহয় একটু এস্বস্তি পাবে,কিন্তু এখানেও স্বস্তির স নেই! এমন মন্দ কপাল না হলেও পারতো!
রাত নয়টা, আরিদা রাইসাকে মুখে ভাত তুলে খাওয়াচ্ছে। তখন দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো কেউ। আরিদা ভাবলো মনে হয় রাশেদ এসেছে, দরজা খোলার মতো এখানে সে-ই আছে, তাই মুখে মুচকি হাসি টেনে তাড়াতাড়ি করে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অপরিচিত একজন লোক হাতে কাগজপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
‘ চাচী কোথায়?
আরিদা গিয়ে তার শাশুড়ীকে ডাকলো,
‘ আম্মা আপনারে কে যেন খুঁজতাছে৷
আরিদার শাশুড়ী কিছুটা শঙ্কিত হয়ে বললো,
‘ রফিকে নাকি?
আরিদা আস্তে করে উত্তর দিলো,
‘ আমি তো চিনিনা।
তিনি দ্রুত বের হয়ে লোকটাকে দেখেই কেমন যেন থমকে গেলেন। আরিদার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে লোকটাকে কি যেন ইশারা করতে চাইলেন। কিন্তু ততক্ষণে লোকটা বলে উঠলো,
ছায়ার মুখোশ পর্ব ২
‘ মামলা উডানোর কোনো উপায় হয় নাই চাচী, ভাইরে আপাদত পলাইয়াই থাকতে অইবো।
আরিদা চমকে উঠলো! মামলা? কিসের মামলা? কিসের জন্য রাশেদ পালিয়ে বেড়াচ্ছে? এই পরিবারে কোনো ঝামেলা আছে সে আঁচ করতে পারছিলো কিন্তু ঝামেলাটার আকারটা ঠিক কতটা বৃহৎ তা ধারণা করতে পারছিলোনা,এখনো পারছেনা।