ছায়ার মুখোশ পর্ব ৫
তাজরীন খন্দকার
ভাবি আপনে তো কাল রাইতে ভাইয়ের রুমে আছিলেন। রুমে আইছেন কয়টায়?
এটা শুনতেই আরিদার শাশুড়ীর চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেলো। আরিদা শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে ফাইজার দিকে তাকালো। নিজেকে সংযত রাখলো, আর বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
‘ কি জানি কয়ডা জানে বাজে তহন! ওদের লগে চোখ লাইগা গেছিলো, সজাগ পাওয়ার লগে লগেই চইলা আইছিলাম। ক্যান? কিছু হইছে?
ফাইজা রুটি চিবাতে চিবাতে বললো,
‘ অহ না, শেষ রাতে ভাই আইছিলো বাড়িত। আপনে মনে হয় এর আগে আইয়া পড়ছেন।
আরিদা মাথা নেড়ে বললো,
‘অঅ।
এতে হ্যাঁ না কিছুই স্পষ্ট হলোনা। ফাইজাও কথা বাড়ালোনা।
তবে তার বিয়ে করা স্বামীর সাথে তার সাক্ষাৎ হওয়া নিয়ে তাদের এতো মাথাব্যথা কেন আরিদা বুঝতে পারলোনা। স্বামীর সাথে থাকতেই যদি না দিবে টাকা দিয়ে কাজের লোক আনলেই পারতো৷ বিয়ে করানোর কি ছিলো? এদের সাথে থাকতে থাকতে আরিদার সরল মন ভেতরে ভেতরে বিষাক্ত হয়ে উঠা শুরু করছে,কবে জানি মুখের উপর জবাব দিতে শুরু করে ঠিক নেই।
১৫ দিন পর।
বিকেলে আরিদা রাইসার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে, বিছানায় বসে রাহাদ খেলছে আর রাফি রাফান বাইরে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। জানালায় তাকালেই আরিদা তাদেরকে দেখছে। তাই এখানে বসে আছে৷ ওরা গ্রামের বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে মিশতে পারেনা, মার খেয়ে খেয়ে আসে বলে একা একাই খেলে। রাশেদ তার আগের বউকে নিয়ে শহরে থাকতো বলে বাচ্চারাও গ্রামের বাচ্চাদের চেয়ে একটু আলাদাই। তবে কথাবার্তা শহরের বাচ্চাদের মতো নয়। পরিবারের মতোই কথা বলে ওরা৷ হয়তো ওদের শুদ্ধ শেখায়নি।
আরিদা একটু অন্য রকম করে যত্ন নিয়ে চুল বেঁধে দিচ্ছে রাইসাকে, এদিকে রাহাদ আরিদার পেছনে ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সোজা হওয়ার আগেই পড়ে যাচ্ছে।
আরিদার বেশ ভালো লাগছে সময়গুলো। রাশেদ ওইরাতের পর আর বাড়ি আসেনি।
রাশেদ আশেপাশে না থাকলে তারা শাশুড়ী ননদও তার সাথে আপত্তিকর আচরণ করেনা। বাচ্চাদের নিয়ে আরিদা এতটাই ব্যস্ত হয়ে গেছে যে তার স্বামী আছে এটা তার মনেই নেই, অবশ্য মনে রাখার মতো তাদের মধ্যে কোনো স্মৃতিও নেই। সন্তান নিজের না হলেও ওদেরকে নিজের মতো মানুষ করে আরিদা মনে হয় দিব্যি জীবন পার করে দিতে পারবে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চুল বাঁধা শেষ হতেই রাইসা দৌঁড়ে তার ভাইদের কাছে চলে গেলো। আরিদাও রাহাদকে কোলে নিয়ে গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাহাদ আরিদার চুল মুঠোয় নিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে, আরিদা ব্যথা পাচ্ছে তবুও তার সাথে সাথে হাসছে। এর মধ্যেই বাইরে বড়সড় একটা হাসির হিরিক উঠলো। তাকিয়ে দেখলো হাতে অসংখ্য ব্যাগ নিয়ে বিদেশ ফেরত মানুষের মতো রাশেদ উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে, আর বাচ্চারা তাকে ঘিরে ধরে ঝাঁপাঝাপি করছে। আরিদা দ্রুত এলোমেলো চুলগুলো গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, রাহাদ চুল টেনেটুনে একদম পাগলের মতো বানিয়ে ফেলেছে তাকে। কোনোরকম ঘোমটা টেনে নিলো। রাশেদ সবার হাতে খাবার দাবারের প্যাকেটগুলো দিলো।
তারপর মুখে মুচকি হাসি টেনে রাশেদ আস্তে আস্তে গেইটের সামনে আসলো, কোমল স্বরে প্রশ্ন করলো,
‘ কেমন আছো?
আরিদা লজ্জামাখা স্বরে জবাব দিলো,
‘ ভালা আছি।
উল্টো তাকে প্রশ্ন করার আগেই রাশেদ ব্যাগগুলো আরিদার হাতে দিয়ে বললো,
‘ এইগুলা নিয়া রাহাদকে আমার কাছে দাও,কতদিন আমার বাপটারে দেখিনা৷
আরিদা ব্যাগ হাতে নিতে নিতে বললো,
‘ এমন ঘটা কইরা আইলেন যে? পুলিশ আইলে?
রাশেদ হেসে বললো,
‘ কইছিলাম না আমি নিরপরাধ, মামলা খালাস হইয়া গেছে। কোনো পুলিশ আইবোনা আর। যাও আম্মা আর ফাইজারে ডাকো।
আরিদার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে সবগুলো ব্যাগ হাত নিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখলো। তার শাশুড়ী তার নিজের রুমে, ফাইজাও রুমে, সারাদিন একমনে কার সাথে যেন চ্যাট করে। জিজ্ঞাসা করলে বলে বন্ধুদের সাথে গ্রুপ মেসেঞ্জারে একসাথে আড্ডা দেয়। এগুলো জানার কোনো আগ্রহও আরিদার নেই। কিন্তু এই মূহুর্তে ফাইজাকে গিয়ে ডিস্টার্ব করার দরকার আছে। তাই ডেকে বললো,
‘ফাইজা তোমার ভাই আইছে।
তার শাশুড়ীকে গিয়ে ডাকার আগেই হনহনিয়ে আসলো। এসেই বললো,
‘ কই আমার পুত?
সব বাচ্চাদেরকে নিয়ে রাশেদ হইহই করে ঘরে প্রবেশ করলো৷ ফাইজা ফোন রেখে গম্ভীর চেহেরা নিয়ে এসে দাঁড়ালো, তারপর টেবিলে চোখ যেতেই উৎসুক হয়ে বললো,
‘ ভাই কি মার্কেট কইরা নিয়া আইছে?
রাশেদ হেসে বললো,
‘ হ দেখ,তোদের সবার জন্য নিয়া আইছি।
আরিদার শাশুড়ী এবার টেবিলে তাকালো, এতগুলো ব্যাগ দেখে একটু অবাকই হলেন। রাশেদ ইশারা করে দেখালো,
‘ এগুলো আমার পোলাপাইনের। আর এই দুটো আম্মা আব্বার, দিয়ে দে।
এরপর চারটা চারটা ব্যাগ আলাদা করে বললো,
‘ এইগুলো তোর, আর এইগুলো তোর ভাবির।
ফাইজা নিজেরগুলো সাইডে রেখে আরিদারটা খুলতে শুরু করলো। প্রথমেই একটাতে দেখলো শাড়ী, বেশ দামী একটা শাড়ী। আরেকটা খুলে দেখলো সেটাতে দুইটা থ্রিপিস একসাথে রাখা, আরেকটাতে একজোড়া জুতো, আরেকটাতে একটা বোরকাসেট।
এবার ফাইজা নিজেরটা খুলে দেখলো তারও বোরকা জুতা জামা সব আছে, তবে শাড়ি নেই।
রাশেদ বললো,
‘ তোর লাইগা শাড়ি আনি নাই, বাকিসব তোর ভাবির সমান সমান আনছি, তুই তো আবিয়াত্তা মেয়ে,বিয়েসাদী হইলে পরে শাড়ী পরিস।
ফাইজা শাড়ীর উপর হাত রেখে বললো,
‘ বিয়া ছাড়াও শাড়ী পরন যায়৷ আমার কলেজে কতো অনুষ্ঠানে মাইয়ারা শাড়ী পইরা আইয়ে।
রাশেদ হেসে বললো,
‘ সবাই অন্যজনের শাড়ী পইরা যায়, তুইও তোর ভাবির থেইকা নিয়া পরবি, সমস্যা কি?
গাল দুটো ফুলিয়ে ফাইজা হাত সরিয়ে ফেললো। আরিদার শাশুড়ী বিষয়টা দেখছে কিন্তু কথা বলছেনা। রাশেদ এবার তার মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ আম্মা আপনে কন, ওর রাগ করন কি মানায়? রাগ করবো বইলা সবকিছু সমান আনছি। তবুও যদি…
বলেই রাশেদ থেমে গেলো,তার মা বললো,
‘ এই মাইয়া তো এমনই, নিয়া আইতি শাড়ীও ।
আরিদা এবার মুখ খুললো, শাড়ীটা হাতে দিয়ে বললো,
‘ তুমি নিয়া যাও। আমি তো শাড়ী পরিনা, রাইখা দেও।
রাশেদ আরিদার দিকে তাকিয়ে আছে। ফাইজা আর কিছুর অপেক্ষা না করে সব নিয়ে রুমে চলে গেলো। আরিদার শাশুড়ীও তার ব্যাগদুটো নিয়ে রুমে গেলো তার স্বামীকে দেখাবে বলে। এদিকে রাশেদ আরিদার দিকে তাকিয়ে আছে। আরিদা আলতো করে তাকাতেই বলে উঠলো,
‘ মন খারাপ কইরোনা, আমি কালকাই তোমার লাইগা ৫ টা শাড়ী নিয়া আসুম।
আরিদা হেসে বললো,
‘ কি যে কন! আমার মন খারাপ হইবো ক্যান? শাড়ীই লাগবোনা, আমার থ্রিপিস পরতেই আরাম লাগে।
রাশেদ কিছু না বলে তার উৎসুক বাচ্চাদের একে একে তাদের কাপড় দেখাতে লাগলো। আরিদা তারগুলো নিয়ে ফাইজার রুমে গেলো। গিয়ে দেখলো ফাইজা তার সবগুলো জিনিসের ছবি তুলছে,হয়তো কাউকে পাঠাবে। আরিদা সেদিকে লক্ষ্য না করে তার কাপড়ের সাথে রেখে দিলো। ফাইজা ছবি তোলা শেষ হলে আরিদার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ ভাই আগেও শিরিন ভাবির লাইগা যা আনতো আমার লাইগাও তা আনতো।
আরিদা মাথা ঘুরিয়ে বললো,
‘ শাড়ীও আনতো?
ফাইজা আমতা আমতা করে বললো,
‘ তা আনতোনা! তহন তো ছোড আছিলাম। অহন ত্য বড় হইছি, আনন লাগবোই।
বলেই ফোনে আবার মনোযোগ দিলো, টাইপ করছে আর মিটমিট করে হাসছে। শাড়ী নেওয়াতে আরিদার একটুও খারাপ লাগছেনা, বোনদের প্রতি ভাইদের তীব্র ভালোবাসা না থাকলে এমনটা কেউ করতে পারেনা। ছোট মানুষ, নিক।
শুধু খারাপ লাগছে তার নিজের ভাইদের কথা ভেবে। গত চার বছরে তার ভাইরা তাকে ঈদেও একটা কাপড় দেয়নি, তার মা হাঁস মুরগির ডিম বেঁচা টাকা দিয়া জামাকাপড় কিনে দিছে। ফাইজার কপালটা বড্ড ভালো, এমন ভাই পাইছে!
এদিকে রাশেদ রুমে গিয়ে সবাইকে একে একে জিজ্ঞাসা করছে নতুন মাকে তাদের কেমন লাগছে,আদর করে কিনা?
রাফান রাইসা খুব ভালো লাগে বলে উত্তর দিলেও রাফি কিছুই বলবোনা। রাশেদ রাফিকে আলাদা করে আবার প্রশ্ন করলো,
‘ নতুন মারে ভালো লাগছেনা বাবা?
রাফি মন খারাপ করে উত্তর দিলো,
‘আম্মার মতো কেউ হইবোনা।
ছায়ার মুখোশ পর্ব ৪
রাশেদ রাফির মাথাটায় ধরে টান দিয়ে কাছে টেনে নিলো। তার বুকটা মুচড় দিয়ে উঠলো, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো, শিরিনের কথা মনে হলেই তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। বুকের উপর কেউ চেপে বসে অনবরত বুকে ছুড়িঘাত করতে থাকে। এতো তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হয় যে মনে হয় কেউ সত্যিকার অর্থেই ছুড়ি বসিয়ে দিলে এর চেয়ে কম যন্ত্রণা হবে। রাশেদ নড়াচড়া না করেও কেমন ছটফট করতে থাকে, নিরব কণ্ঠস্বরে নিঃশব্দে উচ্চারিত হতে থাকে, আহ!শিরিন।