ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৭

ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৭
জান্নাত চৌধুরী

ভোরের দিকে আবহাওয়া শীতল থাকে। স্নিগ্ধ এক পরিবেশ – গাছে গাছে পাখির ক্যাচক্যাচ , এসময় হাটলে মন ফুরফুরে লাগে রাইসার! ভোরে উঠেছে সে , ফজরের নামজ শেষে। কুরআন তিলাওয়াত করে উঠে বেরিয়েছে। আপা চলে যাওয়াতে এখন আর বেড়োনো হয় না তেমন –
ধানের ক্ষেতের আইল পেরিয়ে সামনের কাঁচামাটির বড় রাস্তা –
বড় রাস্তার পথ ধরে এগিয়ে গেলে তিন কিলোমিটার পেরিয়ে পাকা রাস্তার দেখা মেলে – রাইসা আনমনে হাটছে! থেকে থেকে আপার কথা ভীষণ মনে পড়ে তার।

কিছু দুর এগিয়ে যেতেই হঠাৎ চোখে পড়ে দুটো লাল রঙের কুকুর পথেই মারামারি করছে। রাইসা বরাবর কুকুর ভয় পেয়ে এসেছে, এগোনো সাহস হয়না। মুখ দিয়ে কুকুর তাড়ানোর এক শব্দ করছে। লাভ হয় না কুকুর সড়েনা –
হাল ছাড়ে রাইসা এদিক ওদিক চোখ মেলাতে গিয়ে , চোখে বাজে রাস্তার একধারে পড়ে থাকা এক শুকনো গাছের ডালের উপর। আগপাছ না ভেবেই ছুটে গিয়ে গাছে ডাল হাতে তুলে নেয়। কুকুর তাড়াতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে সে – তবে বেশি একটা লাভ হয় না। কুকুর উল্টো ঘুরেই তার দিকেই তেড়ে। রাইসা ভীত হয় উল্টো ঘুরে দক্ষিণে ছুট লাগায় । ঠিক তার পিছনে কুকুর দুটোও তেড়ে যায়। শুরু হয় এক দৌড় প্রতিযোগিতা কুকুর বনাম রাইসা।
দক্ষিণ দিক বরাবর কিছুটা এগিয়ে গেলেই এক ঘন জঙ্গল রয়েছে।‌ জঙ্গল পেরোলেই তার পরে- সিংপাড়া। ডাঙ্গাপাড়ার লোক হয়ে সিংপাড়ায় প্রবেশ মানেই , যেন জান হাতে নিয়ে যাওয়া। খন্দকার বাড়ির সাথে মীর বাড়ির শত্রুতায় দুই গ্রামে দুই দিকের ভাগ । ডাঙ্গাপাড়ার লোক খুব বেশি প্রয়োজন ব্যাতিত সে পাড়ায় পা রাখে না।
রাইসা দৌড়াতে দৌড়াতে ঠিক প্রায় জঙ্গলে কাছাকাছি চলে এসেছে। কুকুরের থামার নাম নেই উল্টো ঘুরে কুকুর দেখে দৌড়াতে গিয়েই খাম্বা জাতীয় কিছুর একটার সাথে উস্টা খেয়ে পড়ে বেচারি!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-আহ মাগো !
পেছনের ছুটে আসা কুকুর দুটো ও থেমে যায়। যেনো তারাও অবাক হয়ে গেছে। চারপাশ শান্ত, ঠিক তখনি ভেসে আসে এক পুরুষ কন্ঠ-
-দিনে দুপুরে ক‌ই থেকে কে এসে পড়লি রে বাল! আমার মাজার নিচে টান ধরছে –
রাইসা বড় বড় চোখ করে তাকায় হঠাৎ খাম্বা কে কথা বলতে শুনে ভরকে যায় সে- কোনো মতে নিজেকে সামলে সামনের দিকে তাকাতেই খেয়াল হয় খাম্বা রুপী মানুষের গায়ে উপর পড়ে আছে সে। রাইসাকে একধ্যানে তাকিয়ে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে ছেলেটি !

-আহ ! বজ্জাত চেংরি ! উঠবি নাকি ধুলো মতো ঝাড়া মারবো ?
ধ্যানে মগ্ন হয়েছিলো রাইসা । রেজার ধমকে বলা শ্রবণ ইন্দ্রিয়তে প্রবেশ করতেই ধ্যানচুত্ত হয় সে! দ্রুততার সহিত রেজার উপর থেকে উঠতে নিয়েই আবার ধপ করে পড়ে রেজার বুকের উপর।
-আহহহ ! ওরেএএ এ কে রে ?মেয়ে মানুষের এতো ওজন কেমনে হয়‌। নারী দেহ এতো শক্ত বা কেমনে হয়।
রাইসা ভ্রু জুগল কুচকে নেয়। ক্ষিপ্ত বাঘিনীর চোখে তাকায় রেজার দিকে ! রেজার উচিত তাকে ভয় পাওয়া , তবে হয় ব্যতিক্রম রেজা ভয় পায় না। আরো জোড়ে এক ধমক দিয়ে বলল-
-এই মেয়ে এইখানেই কি সংসার পাতার চিন্তা করছো? নাকি ঘর বাড়ি বানাতে চাইছো?
রাইসা রাগ লাগে ভীষণ লোকটা তাকে বারবার মেয়ে মেয়ে করছে, এটা তার মোটেও পছন্দ নয়। সে কি ইচ্ছে করে পড়ছে নাকি ? রাইসা রাগান্বিত কন্ঠে বলল-
-“ আপনার গন্ধযুক্ত মুখ বন্ধ রাখুন ! ছিঃ কি বিশ্রী গন্ধ !
বিড়ি আর পানের দুটোর মিশ্রণ ইঁদুর মরা গন্ধ নির্গত হচ্ছে আপনার মুখ হতে! আর আমি ইচ্ছে করে আপনার বুকে পড়ি নি”!

-“কিহ আমার মুখে গন্ধ অসভ্য, ধরন্ধর মেয়ে আগে উঠো- বলছি।”
রাইসা জিহ্বা দিয়ে ভেংচি কাটলো। চোখ উল্টিয়ে খানিকা ভয়ংকর অঙ্গ ভঙ্গি করলো। রেজা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। রাইসা উঠে গিয়ে শরীরের ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল-
-ছিঃ ছিঃ শরীরের কি ভয়ংকর গন্ধ। খোদা জানে কত দিন সাবান দেয় না !
ধৈর্য্য হীন হয়ে পরে রেজা, হাতের মুঠোয় একমুঠ কাঁচা মাটির নিয়ে রাইসার মুখে লাগিয়ে দিয়ে বলল –
-আরেকবার মুখ খুললে গোবর মাখিয়ে দিবো ! খাচ্চর মেয়ে।
-আপনিইই! আপনি একটা ইতর , অসভ্য , খাটাস লোক।‌ দয়া-মায়া হৃদয়হীন আদম সন্তান
রেজা ঠোঁটের কোণে মুসকি হাসি টেনে বলল – “জ্বি ধন্যবাদ! তবুও আমার মতো লোকের উপরেই পড়তে হলো। চারপাশে তো এতো জায়গা ছিলো।
রাইসা চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় রেজার দিকে। শ্যামাঙ্গিণী মেয়ে রাগে লালচে হয়ে উঠেছে। রেজা শরীর ধুলো মেখে একাকার হয়েছিলো কোনোমতে ধুলো ঝেড়ে রাইসার দিকে তাকাতেই রাইসা চেঁচিয়ে ওঠে –

-“আআ যদি পারতাম মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যেতাম।”
-“ আহা ! তুমি মেয়ে ওতটাও রূপবতী ন‌ও যে ! মাটি তোমাকে বুকে নিয়ে পরাণ জুরাবে! বরং মাটির তোমার বাঁদরামিতে বিরক্ত বোধ করবে।
“আমি রূপবতী ন‌ই আমি জানি। তবে আপনিও যে রূপের ফ্যাক্টরি খুলে আছেন এমন নয়।”
রেজা জানে তর্কে সে পারবে না। এই মেয়েকে সে যতবার দেখেছে ততবার অকারণেই ঝগড়া বেঁধেছে। হাফ ছাড়ে –
সারারাত ঘুম জেগে গান শুনছে ..!! এলাকায় কাওয়ালি গানের দল বসেছিলো। সেখান থেকেই ফিরছে –
হঠাৎ রাইসা বলে ওঠে –
“ঘুরে দাড়ান পিঠের কাপড় ময়লা লেগে আছে !”
রেজা মস্তিষ্ক স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। সে কি ভুল শুনেছে ?
এই মেয়ে কি কিছু বলেছে। এসব ভেবেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে। রাইসা তার চাহনি অগ্রাহ্য করে কিছুটা সরে গিয়ে নিজ দায়িত্বে ধুলো ঝেড়ে দেয়।
রেজা অবাকের চরমে পৌঁছে গিয়েছে-

“যাক যতটা উরন্তি ভেবেছি ততটা গেছো মেয়ে না । সভ্যতা রয়েছে।”
অনমনে বলল রেজা। তবে রাইসার শ্রবণ ইন্দ্রিয় জাগ্রত সে ঠিক শুনে ফেলেছে কথাটা।রাইসা মুসকি হাসল – শেষের এক থাপ্পড় জোড়ে দিয়েই নিজের হাত জামায় মুছে বলল-
“আমার আপায় একটা কথা ক‌ইতো : আশ-শাইতান ইয়ারিফুশ-শাইতান, ওয়াল-খিনজির ইয়ারিফুল-কুলকাস।”
এই কথার অর্থ হলো – শয়তান শয়তানকেই চিনে – আর শুয়োর চিনে কচুকে ।
-“ তুমি কি কোনো ভাবে আমাকে শয়তান বললে?
রাইসা ঠোঁটে খেলে যায় এক চমৎকার হাসি- সে চুলের জুটিটে হাত বুলিয়ে বলল “ জুতো কি ফিট হয়েছে পায়ে। যদি হয়ে থাকে তাহলে ওটা আপনার।”

-“এই মে…
রেজা কিছু বলবে তখনি রাইসা উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে বলল
-“মুখে ভীষণ দুর্গন্ধ। ছাই না হয় কয়লায় দাঁত মেঝে ভালো করে গারগিল করবেন। গন্ধ দূর করে পরে আসবেন। তখন শুনবো- আজ আসি ?
রেজা চরম বিরক্ত! রাইস সে দিকে পাত্তা দেয় না কুকুর পালিয়েছে আরো অনেক ক্ষণ। তবুও আশে পাশে একবার তাকিয়ে নিশ্চত হয় সে। উল্টো দিকে ফিরে একবার রেজার রাগি মুখ দেখে জিহ্বা দিয়ে ভেংচি কাটে। রেজা তেড়ে আসতে নিলেই এক ছুট দেয় মেয়েটা।

বেলা ১১টা –
বেলা এগোরটা তীব্র হচ্ছে রোদ্র তাপ। ধীরে সূর্য তার র‌ঙ ফুটিয়ে তুছে- সকাল সকাল ওঠে প্রয়োজনীয় সকল কাজ সেরেই। খাটে বসে আছে ইফরাহ। অপেক্ষার প্রহর গুনছে – আরাধ্য বেড়িয়েছে। লোকটা হুটহাট কেমন যেন নাই হয়ে যায়। এই যে আজ ফরজের ওঠেও লোকটার হদিস মিলে নি কখন বেড়িয়েছে কে জানে। রান্না ঘরে গিয়েছিলো। অরুনিমা যখন জিজ্ঞেস করেছিলো ফাইয়াজ উঠেনি। তখন ইফরাহ দায় এড়াতে মুসকি হেসেছিলো-
আরাধ্য কে বুঝতে চেয়েও পারেনা ইফরাহ।‌তাকে নিয়ে গভীর গবেষণা করলেও ধোঁয়াসা কাটিয়ে তোলা সম্ভয় না –
ইফরাহ নীরবতায় ভাবছে কিছু।
আরাধ্য ফিরলো হাতে একটা নীল শাড়ি। আজো এক বেলির গাজরা এনেছে। ইফরাহ ভাবলো- এই বেলিফুল কি লোকটা পছন্দের? হবে হয়তো !
আরাধ্য শাড়ি হাত ধরিয়ে দিয়ে বললো –
-আজ একটু সাজো তোহ !
ইফরাহ অবাক হলো না! হাতের শাড়ির দিকে কিছু সময় চেয়ে থেকে প্রশ্ন করলো –

-নীল আপনার পছন্দ ?
-উহু পছন্দ ঠিক নয় তবে ! তবে মন বলছে ভালো মানাবে -?
শান্ত চোখে আরাধ্যের মুখ পানে তাকলো ইফরাহ ! এতো কেনো অচেনা লাগে তাকে। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে সে বলল-
-নিজে কখনো পড়েছেন নীল?
-“বললাম নাহ পছন্দ ন‌য় ! পড়ে নাও আমি বাহিরে আছি”!
আরাধ্য চলে যেতে উদ্যত হলো। দরজার দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই ইফরাহর বলা বাক্যে থামে তার পা।
-“শুনছেন!
আরাধ্য থমকে গেলো তবে ঘুরলোনা। ডাকটা মায়া লাগলো, আরো একবার শুনতে চায় এই সম্বোধন। উল্টো ঘুরেই দাঁড়িয়ে র‌ইলো! ইফরাহ আবার ডাকলো –
-শুনছেন ; বলছিলাম – আপনি এমন হুটহাট কোথায় নাই হয়ে যান ?
আরাধ্য ঘুরে তাকলো – “চিন্তিত বোধ করছো বুঝি?

-“ উহু জানতে চাইছি!
আরাধ্য হাসলো -“বড্ড মায়া করে কথা বলছো!”
পোড়াতে চাইছো?
ইফরাহ নিশ্চুপ থাকে। আরাধ্য কিছুসময় চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ইফরাহর মুখ পানে। ছোট ছোট চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে উঠছে। নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আরাধ্য কিছুটা ঝুঁকে এসে আস্তে করে বলে –
-একটা চুমু খাই রক্তকমলিনী।
ইফরাহ পড়নের শাড়ির হাতি মুষ্ঠিতে চেপে র‌ইলো। অনুমতি দিতে চায় না। আবার নিষেধ করার ক্ষমতা ও নেই- এই লোকটা তার স্বামী। আরাধ্য ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বুঝেই , চোখ খিচে নেয় ইফরাহ!
আরাধ্য আরো কিছুটা ঝুঁকে এলো, একদম ইফরাহ মুখ স‌ই, স‌ই হয়ে খানিক সময় তাকিয়ে দেখলো ইফরাহর ভীত মুখটা! তারপর আস্তে করে চোখের পাপড়িতে ফুঁ দিলো।
ইফরাহ চোখ পিটপিট করে র‌ইলো। আরাধ্য মুখে হাসি টেনে বলল-

ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৬

-“আমারে নাহয় একটু খানি কম ভালোবাসো ! তবুও বাসো ।
এমন ভাবে ভালোবাসো যেন , যেনো ষাট উর্ধ্বে বছর পেরিয়ে গেলেও মনে হবে। সেদিন তো এলে জীবনে –
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আরাধ্য। কিছু সময় বাদে চোখ খুলে ইফরাহ। হাতের থাকা শাড়ি আদুরে হয়ে মুখের কাছে এনে ঘ্রাণ শুকে গালে ছোঁয়ায় সে।

ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here