টেরিবেল পর্ব ২৩
অনুপ্রভা মেহেরিন
আন্দ্রিয়ার চোখে কোনে পানি জমে আছে মেয়েটা ঘুমের মাঝেই কাঁদছে।এডউইনের ঘাড় চেপে বসে আছে ম্যাকাও পাখিটি।সকালের ইতি জানিয়ে দুপুর এসেছে আন্দ্রিয়া এখনো ঘুমে।এডউইন আন্দ্রিয়াকে তুলতে এসে দেখতে পেল মেয়েটা কাঁদছে।কিন্তু কেন? স্বপ্নে কি খুব খারাপ কিছু দেখছে নাকি অন্য ব্যাপার-স্যাপার। এডউইন বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে মুছে দিল আন্দ্রিয়ার চোখের জল এডউইন তার পাশে বসে অথচ আন্দ্রিয়া অনুভব করছে শালোমী তার চোখের জল মুছে দিচ্ছে।আন্দ্রিয়া তার চিরপরিচিত বেলকোনির কোনায় বসে কাঁদছে তাকে দুঃখ দিয়েছে কে?
আন্দ্রিয়াকে দুঃখ দেওয়া মানুষের অভাব নেই কিন্তু ভালোবাসার মানুষের বড্ড অভাব।আন্দ্রিয়া যখন একা ছিল তাকে দেখতে যতটা হাসিখুশি ছটফটে ছিল অথচ তার ভেতরটা ততটাই বিষাদ বিষণ্ণতায় ঘেরা।বাবা মায়ের মৃত্যুতে আন্দ্রিয়াকে এই পর্যন্ত যতটা খোটা শুনতে হয়েছে মাঝে মাঝে তার মনে হয় আদৌ কি সে তার মা বাবাকে মেরেছে?ঈশ্বর যাকে নেওয়ার জন্য ডাক দিয়েছে সে চলে গেছে এখানে রক্তে মাংসে মানুষের কী হাত?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই যে এই দুঃখ যন্ত্রণা একাকিত্ব এসব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই আন্দ্রিয়ার মনে এক কাল্পনিক জগৎ গড়ে উঠে।
একটা সময় আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের সাথে নিজের বকবক করত মনে হতো সে কার সাথে যেন কথা বলছে।ধীরে ধীরে তার কল্পনার জগৎটার প্রসার বাড়ল
নিজের রাজ্য, হাজার পরীর মাঝে সবচেয়ে কাছের পরী শালোমীকে নিয়েই আন্দ্রিয়ার কাল্পনিক জীবনটা।এই কাল্পনিক জীবনের মূলত যাকে নিয়ে অপেক্ষায় ছিল সেই ব্যক্তি এসেছে – এডউইন উইলসন এসেছে।আন্দ্রিয়ার হাজার খানেক যন্ত্রণা আজ স্বপ্নের দেশে ধরা দিয়েছে। পুরোনো অতীত স্বপ্নে এসে ফালাফালা করে দিচ্ছে তার অন্তর।ঠিক সেই জন্যই মেয়েটা ঘুমের ঘোরেও কাঁদছে
এডউইন আন্দ্রিয়ার হাতে হাত রাখল মুহূর্তে আন্দ্রিয়া ঘুমন্ত অবস্থায় চেপে ধরল এডউইনের হাত।এডউইন ভারি অবাক হলো ঘুমের মাঝেই আন্দ্রিয়ার ঠোঁটের কোনে আচমকা হাসি ফুটে উঠল।এডউইন ঠিক বুঝতে পারছে না আন্দ্রিয়া মেরির ঘুমন্ত অবস্থায় হাবভাবের এত পরিবর্তন কেন হচ্ছে?
” কুইন?”
চমকে চোখ খুলে তাকাল আন্দ্রিয়া তার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়েছে এডউইনের পানে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুনরায় চোখের বন্ধ করল।
” কুইন তুমি ঠিক আছো?”
” এডউইন আপনি কখন এলেন?ইয়ে মানে আমি ঘামিয়ে গেছি ফ্যানটার স্প্রিড বাড়ান।”
এডউইন ফ্যানের স্প্রিড বাড়াল আন্দ্রিয়া ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা।অথচ তার উদাম শরীরে পাতলা কাঁথা।আজ ঝরঝরে বৃষ্টি নেমেছে বাইরে বইছে শনশন ঠান্ডা বাতাস এডউইন অবাক না হয়ে পারে না আন্দ্রিয়া এর মাঝেও ঘামছে!
” স্বপ্নে কী দেখেছো তুমি?”
আন্দ্রিয়া সচকিত হলো।বহুদিন পর সে স্বপ্ন দেখেছে।তবে স্বপ্নটা অনেক করুন স্বপ্ন। সেই বিষাদ স্বপ্নের মাঝে তার কিং এসে ছুঁয়ে দিয়েছে এর থেকে সুখের আর কি হতে পারে?আন্দ্রিয়া উঠে বসার চেষ্টা করল।এডউইনের কাধে ম্যাকাও পাখিটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” আমকে একটু ছুঁয়ে দিন এডউইন। আপনার ছোঁয়া আমার শান্তি ফিরিয়ে দেয়।”
এডউইন টেনে কাছে আনল আন্দ্রিয়াকে অতি আদরে জড়িয়ে ধরল শক্ত হাতের বন্ধনীতে।আন্দ্রিয়া এডউইনের ঘাড়ে মাথা রেখে চুপ করে রয় কি শান্তি কি সুখ!অচেনা অজানা হঠাৎ হৃদয়ে আসা এক সুখের সম্পর্কের নাম স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক।
” আন্দ্রিয়া কি হয়েছে আমাকে বলো।”
” কিছুই হয়নি এডউইন।আপনি আছেন না?আমার কী হবে?”
এডউইন বুঝতে পারল আন্দ্রিয়ার নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে নাকি খারাপ স্বপ্ন দেখেছে?এডউইন আন্দ্রিয়ার অতীত নিয়ে জানতে চায় না সে তো নিজের অতীত নিয়েই এখন ভুলার অবস্থায় সেখানে আন্দ্রিয়ার অতিত নিয়ে ভাবতে চায় না সে।আন্দ্রিয়া তার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে সুখী থাকুক এইটুকুই নিশ্চিত করতে চায় এডউইন।
আন্দ্রিয়ার মন ভালো নেই মেয়েটার মন ভালো করার দায়িত্ব নিয়েছে এডউইন তাই তাকে নিয়ে আজ বেরিয়ে পড়েছে জঙ্গলে।তারা কি একা?একদমি না সাথে চলছে এডউইনের ঘোড়া।জঙ্গলের ছোট ছোট কাঠবিড়ালগুলো এডউইনকে দেখে তার পিছু পিছু আসছে এডউইন শিষ বাজিয়ে কাছে ডাকছে এবং হাতে দিয়ে দিচ্ছে টুকরো করা গাজর।কয়েকটি বানর এই গাছ থেকে ওই গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে আন্দ্রিয়ার এসবে এখন আর ভয় করে না তবে ভয় করে সাপে।এই জগৎটা ভিন্ন অবাক করা আনন্দে ঘেরা জগৎ।এডউইন আন্দ্রিয়াকে কাছে টেনে কপালে চুমু খেল তার পরনে আজ সাদা ফ্রক চুলে লাগিয়েছে এডউইনের বানানো জঙলি ফুলের গাজরা জঙ্গলের মাটি কিছুটা স্যাঁতস্যাঁতে নাকে আসছে সোঁদা গন্ধ। যেহেতু রাতেই নেমেছিল বৃষ্টি তাই প্রকৃতি আজ সতেজ। এতক্ষণ রোদের দেখা পাওয়া গেলেও আচমকা আকাশে মেঘ জমেছে আকাশ ডাকছে।
আন্দ্রিয়া ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল মরা গাছের গুড়িতে।
“এডউইন অনেকটা চলে এসেছি এবার আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত।”
” ফিরে যাব?আরেকটু থাকি।”
” বৃষ্টি নামবে যে।”
” নামুক।”
এডউইন তাকিয়ে রয় আন্দ্রিয়ার পানে।সবুজে ঘেরা জঙ্গলে সাদা পরী রূপে ধরা দিয়েছে আন্দ্রিয়া মেরি মাঝে মাঝে ভয় হয় আন্দ্রিয়াকে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাবে না তো?এসব এডউইন ভাবতে পারে না তার দম বন্ধ লাগে জীবনের ভুল ভ্রান্তি আঁধার আলো সব থাকুক তবুও আন্দ্রিয়া মেরি এডউইনের জীবনে থাকুক।
” আন্দ্রিয়া মেরি মাই কুইন।”
আন্দ্রিয়া এডউইনের হাত টেনে গাছের গুড়িয়ে বসিয়ে বলে,
” বলুন জনাব।”
” যদি কখনো মনে হয় আমাকে ছেড়ে যাওয়া জরুরি তবে ছেড়ে যাবে?”
” এসব বলবেন না আমি আপনাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত ভাবতে পারিনা সেখানে আপনাকে ছেড়ে যাব?”
” যদি যাও?”
” যদি কখনো যাই আপনি আমাকে এই প্যালেসেই বন্দি করবেন।অবশ্য আপনার অদৃশ্য শেকলে আমি ইতোমধ্যে বন্দি হয়ে গেছি।”
আন্দ্রিয়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মেয়েটা কি এডউইনের কথা সিরিয়াস ভাবে নিল না?হয়ত না কিন্তু এডউইন তো সিরিয়াস।
আন্দ্রিয়া উঠে দাঁড়াল তার হাতে এসে বসেছে ছোট্ট একটা কাঠবিড়ালের বাচ্চা ঝির ঝির বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে আন্দ্রিয়া কাঠবিড়ালির বাচ্চাটা নিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হয় এডউইন ঘোড়াটাকে দেখছিল তার গায়ে হাত বুলিয়ে আপন মনে কত কথা বলছে ভেবেছিল আন্দ্রিয়া আশেপাশেই আছে কিন্তু বোকা আন্দ্রিয়া কাঠবিড়ালিকে নিয়ে বেশ অনেকটা দূরেই চলে গেছে।
হঠাৎ এডউইনের কানে আসল আন্দ্রিয়ার চিৎকার পেছনে ঘুরে তাকাতে দেখতে পেল আন্দ্রিয়ার উপর শেয়াল আক্রমণ করেছে।শেয়ালটা হয়তো কাঠবিড়ালি নিতে এসেছিল নাকি আন্দ্রিয়াকে দেখেই আক্রমণাত্নক হয়ে হঠেছে কে জানে।ইদানীং বনের পাগলা শেয়ালের আনাগোনা বেড়েছে এডউইনের বুক কেঁপে উঠল সেই সাথে বেরিয়ে এলো তার হিংস্র রূপ।
এডউইনের কোমড়ে গোজা ছুরিটা বের করে ছুটে এসে হামলে পড়ল শেয়ালের উপর।আন্দ্রিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই এডউইন হাতের ছুরিটা দিয়ে একেরপর এক কোপ বসাতে থাকল শেয়ালের গায়ে।রক্তের ছিটা চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে আন্দ্রিয়ার মুখ হাত পা সাদা ফ্রক কোন অংশে রক্তের ছিটার অভাব নেই।অপরদিকে এডউইন রক্তে রঞ্জিত।সে নিজের অলক্ষে শেয়ালটাকে কুপিয়ে ক্ষান্ত হয়নি।শেয়ালের চোখে সে একেরপর এক কোপ বসিয়েছে তার এত রাগে কি প্রকাশ পায়?নিশ্চয়ই বোঝাতে চায় আমার কুইনের দিকে তাকানোর সাহস কোথায় পেলি?যে চোখে তুই শিকার ধরেছিস সেই চোখ আমি রাখব না।এডউইনের আচরণ বড্ড অস্বাভাবিক লাগল আন্দ্রিয়ার কাছে সে শেয়ালটাকে টেনে ছিড়ে ফেলছে হাতের সাহায্যে।
শেয়াল নাকি বুদ্ধিমান প্রাণি?তাহলে এই বুদ্ধিমান প্রাণিটা কি আজ বোকার মতো কাজ করল?এডউইনের শিকারে নজর দেওয়াই তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।এডউইন জন্তুর ন্যায় কেমন গর্জন করছে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে শেয়াল টাকে ছিড়ে ফেলছে।শেয়ালটার দেহ, মাথা, হাত পা সব ছিন্ন ভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
এডউইনের গর্জনে গাছে বসে থাকা মুক্তপাখিরা মুহূর্তে ডানা ঝাপটে পালিয়ে গেছে।এই গহিন জঙ্গলে ঝিরঝির বৃষ্টির মাঝে হয়ত এক ভৌতিক অধ্যায়ের সূচনা ঘটল।আন্দ্রিয়ার ভয়ে দম খিঁচে এসেছে গা গুলিয়ে দু’একবার বুমির ঢেকুর তুলেছে।সে যেমন নিজেও রক্তে রাঙা হয়েছে তেমনি এডউইন।
মেয়েটার আর শরীর চলে না এডউইনের এই রূপটা তার হজম হচ্ছে না এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে অচেনা কোন দুষ্টু দৈত্য তার সামনে বসে।এই তো আর একটু জোরে সে নিশ্বাস নিলে চেপে ধরবে তার টুঁটি।নিজের ভয় কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে কোন মতে আন্দ্রিয়া ডাকল,
” এডউইন?”
এডউইনের সাড়া শব্দ নেই।সে কি যেন বিড়বিড় করছে হাতের ছুরিটা দিয়ে শেয়ালের মাংস ফালিফালি করতে ব্যস্ত।আন্দ্রিয়া পুনরায় ডাকল,
” এডউইন?”
না সাড়া শব্দ নেই বৃষ্টির গতি বেড়েছে আকাশটা কেমন দ্রিমদ্রিম শব্দ তুলছে আন্দ্রিয়া এবার এডউইনের পিঠে হাত রেখে বলে,
” এডউইন থামুন।”
এডউইনের হাত থেমে গেল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আন্দ্রিয়ার পানে।রক্তাক্ত মুখের এডউইনকে দেখে যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ভয়ে খিঁচে যাবে আর আন্দ্রিয়ার কথা তো না বললেই নয়।নিজের মহান কিং এর এই রূপটা তার কেমন যেন সহ্য হলো না।শেয়ালটাকে প্রহার করে সরিয়ে দিলেও তো পারতো মারা কি খুব দরকার ছিল?এটা কি বাড়াবাড়ি নয়?এডউইন রক্তাক্ত হাতে ছুঁয়ে দিল আন্দ্রিয়ার গাল,
” কি হয়েছে কুইন?”
” এ..এসব আপনি কি করছেন?”
” খুশি হওনি?”
” খুশি!এডউইন দয়া করে স্বাভাবিক হন আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”
এডউইন কুটিলচিত্তে হাসল।আন্দ্রিয়াকে টেনে এনে জড়িয়ে ধরল তার বুকের সাথে আন্দ্রিয়া ভয় পেয়ে ছাড়তে চাইল এডউইনকে
অথচ এডউইন তাকে ছাড়ল না।রক্তাক্ত হাতে চেপে ধরল আন্দ্রিয়ার গাল এবং দাম্ভিক কণ্ঠে বলল,
টেরিবেল পর্ব ২২
” এডউইনের কুইনকে যে আঘাত করবে তাকে ধ্বংস হতেই হবে।সহ্য করে নাও কুইন,তোমার চোখে এসব তো মাত্র শুরু এর শেষ নেই-শেষ হবেও না।”
এডউইনের ভয়ংকর কণ্ঠে আন্দ্রিয়া কেঁপে উঠল।তার যত্নে গড়া ভালোবাসার প্রজাপতিদের এডউইন যেন মুহূর্তে হাতের মুঠোয় নিয়ে চেপে ধরে হত্যা করল।