ঠকেছি পর্ব ২

ঠকেছি পর্ব ২
সুমাইয়া আফরিন ঐশী

বাস স্টেশনের ফুটপাতে নিস্তেজ হয়ে বসে ছিলাম আমি। কতক্ষণ ধরে এভাবে বসে আছি, খেয়াল নেই। আচমকা হুঁশ ফিরলো এক ভিখারিনীর ডাকে। ভেবেছিলাম, টাকা-পয়সা চাইতে এসেছে। আগ্রহ দেখালাম না, বরং বিরক্ত হলাম। এই শহরের সবকিছুতেই এখন আমার বিরক্তি, এমনকি নিজের প্রতিও।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বৃদ্ধা বললেন,

“আমি ভিক্ষা চাইতে আসিনি, মা। এই পুরো স্টেশনটাই আমার বাড়ি। রাস্তার ওই পাশটাতেই থাকি আমি। কিন্তু তুমি কে? এই শহরে তো তোমাকে আগে দেখিনি। সেই দুপুর থেকে তোমাকে এখানে বসে থাকতে দেখছি। এখন তো সন্ধ্যা হয়ে এলো। অথচ তোমার মধ্যে কোনো যাওয়ার তাড়া নেই। তুমি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছো?”
হকচকিয়ে উঠলাম আমি। চারপাশে তাকালাম। গোধূলির লাল আভা শহরটাকে ইতোমধ্যে ঢেকে ফেলেছে। একটু পরেই সন্ধ্যার অন্ধকারে সব মিলিয়ে যাবে। হতবুদ্ধি হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
মাহিমদের বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দেওয়ার পর এলোমেলো পায়ে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। আমার যেন কোনো হুঁশ ছিল না। শুধু রাস্তার পথ ধরে হেঁটেছি। স্বামীর প্রতারণা আমার আস্ত আমিটাকে ভিতর থেকে একদম দুম/ড়ে-মুচ/ড়ে দিয়েছে! আমি যেন আজ নির্বোধ হয়ে গিয়েছি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই অচেনা শহরে আমি নতুন। পথঘাট কিচ্ছু চিনি না। সন্ধ্যা নামছে। কোথায় যাবো আমি? কী করবো? কেন বসে আছি এখানে?
আমার ভাবনার মধ্যে বৃদ্ধা আবারও কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কি অসুস্থ? কী হয়েছে তোমার? এমন বিষণ্ণ কেন লাগছে তোমাকে?”
আমি তাকালাম তার দিকে। আটপৌরে শাড়ি পরা এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। বয়সের ভারে কুঁচকে গিয়েছে চামড়া। অভাবের কষ্টে ম্লান সৌন্দর্যের মাঝেও তার মুখে এক ধরনের অদ্ভুত মায়া। কেন যেন এই মুহূর্তে এই মানুষটিকেই নিজের আপন কেউ মনে হলো।
রাস্তার ভিখারিদের সাধারণত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে দেখা যায় না। কিন্তু এই বৃদ্ধা স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলছেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি অবশেষে জিজ্ঞেস করলাম,

“খালা, কয়টা বাজে?”
বৃদ্ধা পান খাওয়া মুখে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন,
“আমার তো ঘড়ি নেই, মা। আমাদের সময় দেখার প্রয়োজনও হয় না। গাড়ির শব্দ আর পেটের ক্ষুধাই আমাদের সময়টা বুঝিয়ে দেয়।”
আমি আর কিছু বললাম না। খালা আমার বলার আশাও রাখলো না। সে আবারও বললো,
“ও মেয়ে, কোথায় যাবে তুমি? তোমায় দেখে তো মনে হচ্ছে, তুমি পো য়া তি। এই শরীরের এখানে বসে আর বেশী দেরী করো না। জায়গাটা খুব একটা ভালো না!”
“আমার যাওয়ার মতো আপাতত নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই, খালা।

এই শহরের এক পুরুষ আমাকে নির্ম/ম ভাবে ঠকিয়েছে।
তার সঙ্গে বেঁধে নেওয়া স্বপ্নগুলো আজ ভাঙা কাঁচের মতো ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
তাই কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো—তার কোনো উত্তর আমার কাছে নেই।”
খালা চলে গেলো কোনো কথাবার্তা ছাড়াই। হয়তো, এক দুঃখিনী আর এক দুঃখিনীর বোঝা নিজের ঘাড়ে সেধে চাপাতে চায় না। অথবা তার কোনো আপন দুঃখ মনে পড়ে গেলো। জানি না আমি! জানতেও চাই না।
খালা আমার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বসলো। নিজের রঙচটা ব্যাগটা থেকে হাতড়ে হাতড়ে কিছু খাবার বের করছে। আমি কেন জানি, সেদিকে উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছি।

ব্যস্ত শহরে মানুষ আসে-যায়। আমাদের দিকে একবার তাকায়, আবার নিজেদের জগতে মগ্ন হয়ে চলে যায়। চারপাশে এত কোলাহল, অথচ কারো চোখে কোনো খেয়াল নেই। এই যে আমি স্টেশনে এতক্ষণ বসে ছিলাম, কেউ আমাকে সেভাবে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। হয়তো কেউ না কেউ একবার ডেকে ছিলো, আমি খেয়াল করিনি।
এখানে সবাই শুধু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। এই নিঃসঙ্গ ভিড়ে আমি যেন আরও একা হয়ে গেলাম। নিজেকে প্রচন্ড দুর্বল লাগছে এখন। ক্ষুধায় পেটটা জ্ব-লে যাচ্ছে। সারাটাদিন একটু পানিও আমার পেটে জুটেনি। বড্ড তৃষ্ণা লেগেছে। আমি নিজের কাঁধের ব্যাগটা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু, ব্যাগটা আর পাচ্ছি না। কোলের মধ্যে অবহেলায় মোবাইলটা পড়ে আছে। কিন্তু, ব্যাগটা কোথায় গেলো? এখানে আর নেই। মনে হচ্ছিল, আমার পাশেই সাইড ব্যাগটা রাখা ছিলো। সেখানে বেশ কিছু টাকাও ছিলো। এখন আর সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না। কত লোক আসা যাওয়া করে, কেউ হয়তো সুযোগ বুঝে নিয়ে গেছে। নিজের চলার জন্য রাখা টাকা-পয়সাটাও হারিয়ে আমি আরো একবার হতাশ হলাম। অচেনা শহরে কিভাবে কী করবো?

আমি আবারও সব ভুলে, ভিখারিনী খালার শুকনো রুটি আর পানির দিকে তাকিয়ে আছি। খালা কি বুঝলো কিছু? হঠাৎ করেই, নিজের ভাগের খাবারটুকু আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“ও মেয়ে, তোমার ভিখারিনী খালার এই খাবার তুমি খাবে? খেতে পারবে এই খাবার? খেলে নেও।”
আমি তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিলাম না। তার দেওয়া খাবার গুলো, এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে খেতে লাগলাম। খালা মৃদু হেসে, এবার এসে বসলো আমার পাশের বেঞ্চিটাতে। আমার সেদিকে হুঁশ নেই। খালা খেলো কি-না জিজ্ঞেসও করলাম না। বরং তার দেওয়া শুকনো রুটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে সবটুকুই খেয়ে ফেললাম। ক্ষুধার মাঝে এই খাবারটাই এতো অমৃত মনে হলো আমার! এতো মজার খাবার বোধহয় আমি আর কখনো খাইনি।
এতটুকু পেটে পড়তেই নিজেকে একটু শান্ত অনুভব করলাম। আচমকাই খালার কথা মনে পড়লো। এই অসহায় মানুষটার সবটুকু খাবার আমি খেয়ে ফেললাম! উনি সারাদিনে খেলো কি-না জিজ্ঞেসও করলাম না। ছি! আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। নিজের হাতেও টাকা নেই, যে তাকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিবো। আমি অনুতপ্ত চোখে, আশেপাশে তাকিয়ে খালাকে খুঁজলাম। বললাম,

“আপনি কি খেয়েছিলেন, খালা?”
“আমার ক্ষুধা নেই, মা। ক্ষুধার যাতনা সহ্য করবার ক্ষমতা আমার আছে।”
খালা আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই ওখান থেকে চলে গেলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে। আমি কিয়ৎ ক্ষণ সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। বুকের ভেতরের ভারী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“একজন ভিখারিও আমার দুঃখ বুঝলো, বুকের তীব্র দহন অনুভব করলো।
অথচ তুমি! যাকে আমি এতটা আপন ভেবেছি, এতটা কাছে রেখেছি—সেই তুমি-ই আমাকে বুঝলে না। আমার ভাঙা মনের শব্দগুলোও তোমার কাছে নিস্তব্ধ রইল।”
আমি আর তাকে নিয়ে ভাবতে পারলাম না।
হাতে সময় নেই খুব একটা। তবে তার এই ঋণের ভাগীদার রয়েই গেলাম আমি।

এই শহর থেকে আমি আজ আর নিজের শহরে গেলাম না। যে মানুষটাকে আমার সাথে এতবড় প্রতারণা করলো, তার শেষ দেখেই ফিরবো আমি। না না, তার প্রতি আমার আর কোনো টান নেই, ভালোবাসাও নেই! রয়েছে ঘৃণা আর ঘৃণা!
আমি নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালাম। ত্রস্ত ফোনটা হাতে নিলাম। এতক্ষণ ফোন বন্ধ অবস্থাতেই পড়ে ছিলো। আমি ফোন অন করলাম। মা জানে না, আমি এখানে এসেছি। ওদের কাউকে কিছু না বলেই আমি এখানে এসেছিলাম তার খোঁজে। আমার মা-বোন নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন। এমনিতে অসুস্থ শরীর নিয়ে ওরা আমায় ছাড়তো না।
এসব ভাবনার মাঝেই কল দিলাম মা’কে। কিন্তু, ফোন ধরলো আমার ছোট বোন, তন্নি। আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই সে কেঁদে ফেললো। বললো ভাঙা কণ্ঠে,

“তুই কোথায় আছিস, আপু? তোর ফোন বন্ধ ছিলো কেন? কী হয়েছে তোর? আমাদের কাউকে কিছু না বলে তুই হঠাৎ কোথায় উধাও হলি? ভাইয়ার খোঁজ পেয়েছিস বুঝি?”
“পেয়েছি।”
“একি, আপু তোর কণ্ঠ এমন লাগছে কেন? ঠিক আছিস তুই? কী হয়েছে?”
আমি মৃদু হাসলাম। বোনটা আমাকে না দেখেই, ওর আপুর গলার স্বর শুনে ধরে ফেলেছে, আমি ঠিক নেই। আমি নিজেকে যথাযথ সামলিয়ে বললাম,
“আমি ঠিক আছিই। মা কোথায়? মায়ের কাছে ফোনটা দে।”
তন্নি চেঁচিয়ে উঠলো। মা’কে ডাকলো অনবরত। মা যেন আমার কলের অপেক্ষাতেই ছিলেন। টেনশনে এতক্ষণে প্রেশার বাড়িয়ে ফেলছেন। তন্নির থেকে ফোন নিয়েই মা কথাবার্তা ছাড়াই কেঁদে উঠলেন। এরপর ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললেন,

“তনু, তুই কোথায় আছিস? তুই ঠিক আছিস?”
“মা, মাহিমকে খুঁজে পেয়েছি।”
“কি বলিস? জামাই কেমন আছে? কী হয়েছিল ওর? হঠাৎ, জামাই আমাদের সঙ্গে এরকম করলো কেন? ও ঠিক আছে?”
“কিছু ঠিক নেই, মা। কিছু ঠিক নেই।”
আমি আর নিজেকে মায়ের কাছে সামলাতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম অসহায় কণ্ঠে। মা অস্থির হলো। জানতে চাইলো,
“কি হয়েছে, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
আমি এবার মা’কে ভে/ঙেচু/রে সবটা বললাম। সবটা শুনে আমার মা ছিলেন বাক্যহারা। এরপর আচমকা বুক ভরা আক্ষেপ নিয়ে শুধালো,

“স্বামী ছাড়া এ পৃথিবীতে, বিধবা হয়ে বেঁচে থাকা আমাদের জন্য বড্ড কঠিন রে মা। আজ যদি তোদের বাবা বেঁচে থাকতো, মাথার উপর তোদের বড় একটা ভাইয়ের ছায়া থাকতো, আমাদের আর ঠকতে হতো না। ওরা ঠিকই, বিয়ের সময় ছেলের বাড়ি-ঘরের খোঁজ-খবর নিতো।
আমরা আবারও হেরে গেলাম বিশ্বাসের কাছে, মানুষের প্রতারণার কাছে। আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ওরা আমাদের ঠকালো, নষ্ট করলো আমার ফুলের মতো মেয়েটার জীবনটা। হায় আফসোস, আমি কেন একটিবার নিজে গিয়ে ছেলেটার খোঁজ-খবর নিলাম না! কেন ওর মধুর মধুর কথাতে গলে গেলাম! আহারে, তোর এই দুঃখ আমি কীভাবে ঘুচাবো মা!”

মা কাঁদছে, তন্নিও কাঁদছে। কিন্তু, আমার কান্না থেমে গেছে। কাঁদতে ইচ্ছে করে না আর। আমি যেন হৃদয়হীনা হয়ে উঠেছি! এ পৃথিবীতে আবারও আরো একবার মনে করিয়ে দিলো, “আমার বাবা নেই, আমার ভাই নেই!”
আমি আবারও বিরক্তিকর শ্বাস টানলাম। মা’কে বললাম,
“আমাকে বিকাশে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেও তো, মা। চলার মতো টাকা নেই। ব্যাগটাও হারিয়ে গেছে।”
মা আশ্বাস দিলো আমায়। পরবর্তীতে কী করবো, জানতে চাইলো। আমি জানালাম সবটা। মা-ও মেনে নিলো বিনাবাক্যে। শুধু বললো,
“আমিও আসতেছি। সাবধানে থাকিস, মা।”
আমি কিছু বললাম না। কল কেটে দিয়ে স্টেশন থেকে বাইরে বের হলাম। এ পৃথিবী আমার জন্য এখন বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অচেনা শহরেও আমি হাল ছাড়লাম না। নিজেকে সামলে নিলাম। মনে জোর রাখলাম। ওখান থেকে মানুষজনের ভেতরে এগোলাম।
মা বিকাশে টাকা পাঠিয়েছে। আমি কিছু টাকা তুলে হাতে নিলাম। অচেনা আমাকে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে এখানে দেখেই যাচ্ছিল লোকজন। তারা কৌতূহল হয়ে এবার জানতে চাইলো,
“কে আপনি?”

আমি আর চুপ করে থাকলাম না। মানুষজনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম,
“আমি মাহিমের, দ্বিতীয় স্ত্রী! ও আমাকে ঠকিয়েছে। আমি আজ সবকিছু যখন জানলাম, ওরা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।”

ঠকেছি পর্ব ১

মুহূর্তেই পরিবেশ বদলে গেলো। লোকজনের কানাকানি শুরু হলো। আমাকে কিছু লোক ঘিরে ধরলো। ওদের আগ্রহ দেখে বুঝলাম, গ্রামের ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে ঘুরছে এই লোক। আমি আর নিজেকে ধমিয়ে রাখলাম না। সবার সামনে, টেনে-হিঁচড়ে খুলে দিবো ওর মুখোশ। মানুষ জানুক, এই শহরে একটা নিকৃষ্ট জীব রয়েছে, যে দুজন নারীকে নিখুঁতভাবে ঠকিয়েছে। না না, এরপর আমি আর তার সঙ্গে সংসার করতে চাচ্ছি না। শুধু আয়োজন করে আমি একটা পশুকে সমাজ থেকে চিহ্নিত করবো, আমি আমার প্রাপ্ত অধিকার বুঝে নেবো। এসবে আর তাকে এতটুকুও ছাড় দেওয়া হবে না। আমাকে দুঃখের মাঝে রেখে, তুমি শুধু সুখটাই বেছে নিবে? উঁহু, তা তো হচ্ছে না। একটু তো হেনস্তা তুমিও হও। এই সমাজের মেয়েরা আমাকে দেখুক, শিখুক নির্মম বাস্তবতাকে!

ঠকেছি পর্ব ৩