ঠকেছি পর্ব ৬

ঠকেছি পর্ব ৬
সুমাইয়া আফরিন ঐশী

বেশ কিছুদিন পর নিজের শহরে ফিরছি আমরা। আমি আর মা বাসের এক সিটের পাশাপাশি, রিধান ভাই অন্য সিটে বসেছে। বাস চলছে। বাসের জানালার পাশের সিটটাতেই বসে আছি আমি। বাইরে সন্ধ্যার আলো-আঁধারি, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো আমাকে অবচেতনভাবে অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছে। আমার এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতটা অবহেলায় জানালার ধারে রেখে বাইরে তাকিয়ে আছি। শীতল হাওয়ার ঝাপটা মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি টের পেলাম আমার চোখে এক বিষন্নের স্থিরতা। ভেতরটাতেও কেমন দুমড়েমুচড়ে, মূ/র্ছা যাচ্ছে!

তবুও আমার মনের ভেতরটায় একপ্রকার মুক্তির স্বাদ, আবার গভীর এক শূন্যতা। সম্পর্কের জটিলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে আজ আমি একটু হালকা অনুভব করছি, কিন্তু সেই মুক্তি যেন আমার জীবনের অনেকটুকুই কেড়ে নিয়েছে। এটা কি সংসার হারানোর বিষাদ? জানি না আমি, কিচ্ছু জানি না!
বাসের ভিড়, কতো মানুষের কোলাহলও আমাকে ছুঁতে পারছে না। আমি ভাবছি—সব হারিয়েও কি কিছু পাওয়া যায়? হয়তো যায়। নিজেকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন আজ প্রথমবারের মতো আমার চোখে ভেসে উঠছে। জানালার কাচে আমার প্রতিচ্ছবি যেন আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুই পারবি, তনয়া। তুই একাই যথেষ্ট।”
বাস ধীরে ধীরে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আমার হৃদয়ের ভাঙা অংশগুলো নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আচমকা, ফোনের ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠলাম আমি। তন্নি কল করেছে। আমি অনাগ্রহের সাথে কল ধরলাম। ওপাশ থেকে ভেসে আসছে বড় খালার কণ্ঠ,
“হ্যালো, তনু?”
বড় খালাদের বাসাতেই এতোদিন থেকেছে, তন্নি। মা একা-একা এক ফ্লাটে রাখেনি ওকে। বড় খালাই তন্নির ফোন থেকে কল করেছে আমায়। খালার কণ্ঠ শুনে আমি আস্তেধীরে বললাম,
“হ্যা, বলো খালা?”
“কী ব্যাপার, কল ধরছিলি না কেন? আমার ফোনে ব্যালেন্স ছিলো না, তাই তন্নির ফোন থেকে কতগুলো কল করেছি তোকে…”
“শুনতে পাইনি খালা।”

আমার বিষন্ন, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠ শুনে খালা বিচলিত হলো আরো কয়েকগুণ।
“কি হয়েছে, তনু? তোকে এতো বিষন্ন লাগছে কেন?”
আমি ছলছল চোখে অল্পস্বল্প হাসলাম। বললাম,
“আমার বেনামি সংসারটা আজ ভেঙে গিয়েছে খালা। আজ আমি মুক্ত।”
আমার অদ্ভুত বাচনভঙ্গি শুনে খালা কথার খেল হারিয়ে ফেললো। তব্দা খেয়ে কিয়ৎক্ষণ স্থির রইলো। হয়তো উনি আমাকে বুঝার চেষ্টা করছে। এরমধ্যে, তন্নি ফোন নিলো। জিজ্ঞেস করলো,
“কতদূর এলি, আপু?”
“কাছাকাছি চলে এসেছি, একটু পরই পৌঁছে যাবো। ফোন রাখলাম, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন।”
“ঠিকাছে আপু, সাবধানে থাকিস। নিজের খেয়াল রাখিস।”
“আচ্ছা, রাখবো।”
তন্নি এরপরও কল কাটলো না। আমায় পুনরায় কণ্ঠে দরদ মিশিয়ে ডাকলো,
“আপু, শোনো?”
“কি?”

“বেইমানরা তোমার জীবনের গল্পের একটি অধ্যায়, পুরো গল্প নয়। তাদের জন্য তুমি থেমে যেও না, মন খারাপ করো না। তারা তোমাকে ভেঙেচুরে দিয়ে আবারও শক্তিশালী হতে শিখিয়েছে। তুমি নিজেকে শক্ত রেখো, সামনে এগিয়ে যাও। সত্যিকার অর্থে যে মানুষগুলো তোমার, তারা তোমার নতুন পথচলার অপেক্ষা করছে!”
ওর কথা শুনে আমি আনমনেই হাসলাম। আমার ছোট বোনটা কি খুব বড় হয়েছে? কেমন ভারি ভারি কথা বলছে! মনে হচ্ছে, এইতো সেদিন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছিলো, তন্নি। এখন ইন্টারমিডিয়েটের শেষ পর্যায় চলে গেছে, সামনে ওর পরিক্ষা। সময় কীভাবে যে ফুরোয়!
হ্যা, আমাদের সেই ছোট তন্নিটা সত্যিই বড় হয়েছে। আমাদের বাবা নেই, মাথার উপর বড় ভাইদের কোনো ছায়া নেই। আমিই যে বড়, আমার মাথার উপর কত দায়িত্ব বেড়েছে। ওদের জন্য হলেও আমাকে ভালো থাকতেই হবে। আমি আনমনে হাসলাম আবারও। বললাম,

“তোরাই আমার শক্তি, তোরাই আমার বল, তোরাই আমার নতুন পথচলা।”
তন্নি আমাকে আবারও দৃঢ়ভাবে আশ্বাস দিয়ে বললো,
“আমরা সবাই তোমার সাথে আছি, আপু। তুমি পারবে, তুমি পারবে!”
আমি ভরসা পেলাম। কল কেটে দিয়েছি এরপর। আচমকা, ক্লান্তিতে ধরেছে শরীরে ও মন। আমি বিনা আমন্ত্রণে মায়ের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলাম। মা একটু মুচকি হাসলো, আমার ধরা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মায়ের আদর অনুভব করে কখন জানি চোখ লেগেছিল। আমি ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম বোধহয়। আমার তন্দ্রা ভাব কাটে রিধান ভাইয়ের ডাকে,

“তনু, এই তনু?”
আমি আচমকা ডাকে হকচকিয়ে গেলাম। বললাম,
“কি হয়েছে, কি হয়েছে?”
“পোঁছে গেছি আমরা।”
রিধান ভাই এতটুকু বলে ঝড়ের বেগে আবার কোথাও অদৃশ্য হলো। আমি আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম একবার। আমার মাথাটা এখনো মায়ের কাঁধে। মা নড়াচড়া না করেই সেভাবে বসে রয়েছে। পাছে, আমার যদি অসুবিধা হয়। মায়ের গভীর যত্নটুকু আমার মন ভালো হওয়ার কারণ। আমার বুকের ভারটা আচমকা সরে গিয়েছে। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরেই সেভাবে কতক্ষণ বসে রইলাম। যাত্রীরা ধস্তাধস্তি করে নামছে। অনেক ভীরের মধ্যে আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে গেলাম না। মা বারণ করেছে। আমরা মা-মেয়ে নামলাম সবার শেষে।

বাস স্টেশনে কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি, আমি আর মা। রিধান ভাইটা আবার কোথায় গেলো? নীরবে আমরা ওনাকে খুঁজছি। আচমকা, আমার চোখ আঁটকে গেলো পরিচিত একটা পুরুষালী মুখের উপর। ওই তো কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ লোক। যে লোকটা আমার বিয়েতে এসেছিলো মাহিমের বাবা হয়ে। যাকে আমি একসময় বাবা বলেও ডেকেছি! আজ সেসব ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে, প্রতারক লোকটার মুখ বরাবর থুথু ফেলতে। কী করে করতে পারলো উনি এমন কাজ? উনি আমার বাবা না হোক, পৃথিবীর কারো না কারোই তো বাবা। বাবারা কি করে প্রতারক হয়? কারণ কী? কারণটা জানতে হলেও, আমি একবার উনার খোঁজ করতাম। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ওই লোকটাকে আজই এখানে দেখবো ভাবিনি। আমি দেরি না করে উনার দিকে এগিয়ে গেলাম। ডাকলাম উঁচু কণ্ঠে,

“এই, এই শুনুন?”
বৃদ্ধ লোকটা আচমকা আমাকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লো। তার চোখে-মুখে গাঢ় বিস্ময়ের রেশ! উনি আনমনেই বলে উঠলেন,
“তনু, তুমি?”
আমি এরমধ্যে বড়বড় পা ফেলে, উনার কাছে পৌঁছে গিয়েছি। আমার পিছনে পিছনে মা-ও এলো। আমি একবার আলগোছে বৃদ্ধ লোকটার আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। আগের সেই পোশাক-আশাকের সঙ্গে এখন উনার মিল নেই। পড়নে সস্তায় কেনা একটা মলিন শার্ট ও লুঙ্গি, পায়ে একজোড়া চটিজুতো, হাতে আধখালি একটা ব্যাগ। সবটাই লক্ষ্য করে আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
“কী ব্যাপার, আজকাল টাকা-পয়সা পেতে সমস্যা হচ্ছে না-কি আপনার? আগের মতো ঠকবা/জি করার জায়গা পাচ্ছেন না বুঝি!”
লোকটা হঠাৎ মাথা নিচু করে নিলো। আগেপিছে কিছু না ভেবে, দ্রুত আমার থেকে উল্টো রাস্তা ধরে হাঁটা দিলো। আমি বুঝলাম, লোকটা আমার থেকে পালাতে চাইছে। আমি তাকে যেতে দিলাম না, আঁটকে দিলাম। বাঁধা দিয়ে বললাম,

“দাঁড়ান।”
লোকটার পা-জোড়া অমনি থেমে গেলো। তবে, উনি আমার দিকে তাকালো না। আমি সেসবে মাথাও ঘামালাম না। বরং মনের সবটুকু রাগ উগলে দিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“জানেন,আমার সংসারটা আজ ভেঙে গেছে!”
লোকটা একটুও চমকালো না এতে। বরং হেলদোলহীন ভাবে বললো,
“যাওয়ারই ছিলো।”
এতে কী যে রাগ লাগলো আমার! উনি এমন ভাব করলো, যেন এতে উনি অনেক খুশী হয়েছে। লোকটার মুখোমুখি হয়ে আমি আগের থেকেও দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বললাম,
“কীভাবে পারলেন? কীভাবে পারলেন, আপনি এই কাজ করতে? আপনার বিবেকে একটুও বাঁধলো না? সবটা যেনেও কেন একটা মেয়ে’কে অনিশ্চিত সংসার গড়তে সাহায্য করলেন? আপনি না বাবা, তবুও কেন একটা মেয়েকে সবাই মিলে ঠকালেন?”

“পেটের দায়ে। পেটে খুদার যন্ত্রণার থাকলে, মাথায় বিবেকের তাড়না থাকে না।”
“মানে? তাই বলে এমন একটা কাজ করবেন?”
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে আমার কথার জবাব দিলো না। আমি আগ্রহ নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি, আমার সঙ্গে মা-ও। কীরকম অদ্ভুত লাগছে লোকটাকে। দূরের ল্যাম্পপোস্টের ফিনফিনে আলোতে তার কুচকুচে যাওয়া চোখ জোড়া চিকচিক করছে। বোধহয় লোকটা কাঁদছে! কিসের এতো দুঃখ উনার? আমার ভাবনার মাঝেই লোকটা বললো,
“আমি আর আমার স্ত্রী টাকার জন্য তোমাদের সঙ্গে অভিনয় করেছি, মা। সেদিন আমাদের হাতে আর কোনো উপায় ছিলো না। আমরা এই কাজ না করলে, মাহিম আমাদের ওতোগুলো টাকা দিতো না, আর আমার অসুস্থ ছেলেটাকেও বাঁচানো হতো না।”

আমার কাছে আবারও সবকিছু পরিষ্কার হলো। লোকটা মিথ্যা বলছে না, তার চিকচিক করা অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া তার সাক্ষী। আমি কিছুক্ষণের জন্য ভাষাহীন, বিতৃষ্ণা চোখে তাকিয়ে আছি সামনের দিকটাতে। এরমধ্যে, মা বললো,
“যতোই হোক, তাই বলে মানুষ ঠকানো কোনো ভালো কাজ নয়। আপনি যেকোনো উপায়ে, আমাদের একবার জানাতে পারতেন সবটা। সেদিন যদি আপনি আমাদের কিছু একটা আঁচ দিতেন, আজ আমার মেয়েটার সংসারটা ভাঙতো না, আমার ফুলের গায়ে এতো আঁচড় লাগতো না। সেদিনই কাঁটা থেকে রেহাই পেতো আমার ফুলটা। আমার মেয়েটা আজ যা যা হারিয়েছে, যে যন্ত্রণা সহ্য করেছে, ওর এক একটা দীর্ঘশ্বাসের পিছনে আপনিও কোনো না কোনো ভাবে দায়ী! নিজের সন্তানের কথা ভেবে আপনি সেদিন আরেকজনের সন্তানকে ঠকিয়েছেন না! আপনি দেইখেন, আল্লাহ এর বিচার নিজেই করবেন। আজ না হয় কাল, ওর রুহের অভিশা/প আপনার সন্তানের উপরও পড়বে।”
লোকটা অদ্ভুত স্বরে হাসলো কিয়ৎক্ষণ। এরপর প্রাণহীন গলায় শুধালো,

“সে অভিশা/পের আর দরকার হবে না, আপা। প্রকৃতি ভোলে না কারো ঋণ! সেদিন আমি আমার সন্তানকে বাঁচালেও, তার পা দু’টো আমি আর বাঁচাতে পারিনি। হঠাৎ এক দুর্ঘ/টনায় আমার ছেলেটার পা দু’টো চিরতরে হারিয়ে গেলো। একমাত্র মেয়েটার সংসারটাও ভেঙে গেলো কারণ ছাড়া। ওই যে পাপ, পাপের পিছুটান!”
লোকটা আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না। নির্জীব ভঙ্গিতে চলে গেলো। আমরা মা-মেয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। মানুষটাকে আমাদের আর শাস্তি দেওয়ার দরকার হলো না। ওই যে, লোকটার ভেতরের অপরাধবোধটাই হলো তার আ/ত্মার শা স্তি! আ/ত্মায় যদি অসুখ থাকে, মানুষ কীভাবে ভালো থাকে?
তাকে নিয়ে আমাদের আর বেশিক্ষণ ভাবা হলো না। আমাদের কি আর এতো সময় আছে? আমরা যে নিজনিজ জগতে ব্যস্ত। তান্মধ্যে, রিধান ভাই এলে কোত্থেকে যেন রিকশা নিয়ে। সঙ্গে এনেছে দু’টো কা টা ডাব। আমার হাতে একটা দিলো, মায়ের হাতে একটা দিলো। আমার এতক্ষণ বড়োই জলতেষ্টা লেগেছিল। লোকটা বুঝি খেয়াল করছিল? এতো রাতে ডাব পেলো কই?

আমি এতোশত না ভেবেই, ডাবের পানিটা তৃপ্তি করে খেয়ে নিলাম। রিধান ভাইকে আর একটু আগের ব্যাপারে জানালাম না। গল্পের আসল লেখিকা, সুমাইয়া আফরিন ঐশী। লোকটা বড়ই ঘাড়ত্যাড়া! উনাকে চিনলে, ঝামেলা করবে। অতৃপ্ত মানুষটাকে আমি আর অশান্তি পোহাতে দিলাম না। তার প্রতি আমার আর কোনো রাগ-অনুরাগ নেই। আমার পাওনা যে আমার রব নিজেই আগে আগে পুষিয়ে দিয়েছে। নিশ্চয়ই, রব সর্বশেষ্ঠ বিচারক! রবের নিকট সকল কাজের ন্যায় বিচার পাওয়া যায়। আমিও পাবো! এই ভেবেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেছে আমার।
এরপর, আর সময় নষ্ট করলাম না আমরা। রিকশায় চড়ে বাসায় এলাম। আমাদের সঙ্গে ব্যাগ-পত্র নিয়ে রিধান ভাইও এসেছে। উনি থাকবে না যদিও, একটু পরই বোধহয় চলে যাবে নিজ বাসাতে।

বাসায় আমি ফুরফুরে মেজাজে এলেও, আমার মেজাজের রদবদল হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমাদের উপস্থিত টের পেয়েই মানুষজনের হা ম লা শুরু হলো। আশেপাশের ফ্ল্যাটের ভাবি এলো, চাচিরা এলো। ওরা আমায় কেউ কেউ দেখলো বাঁকা চোখে। কেউ বা আমার জন্য দুঃখ পেলো। আমি যদিও ওসব দেখছি না, ভাবছিও না। কিন্তু, পাশের বাসার ভাবি দরদ দেখিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে যেন। উনি এলো আমার রুমে। পাশে বসে বললো,
“ডিভোর্সটা তবে হয়েই গেলো তোর?”

আমি ঠান্ডা স্বরেই প্রত্যুত্তরে বলললাম, “শুনেছো যখন, আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?”
এতটুকুই যেন আমার দোষ হয়ে গেলো। ভাবি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। খ্যাঁক করে উঠলো,
“ও জিজ্ঞেস করাতেই বুঝি আমার দোষ হয়ে গেছে?”
আমি তার কথাতে পাত্তা দিলাম না। না শোনার মতো ফোন হাতে নিয়ে বসে রইলাম। এতে ভাবির কথাতে সুবিধা হলো না। অধৈর্য হয়ে ডিভোর্সের প্রথম দিনই ভাবি আমায় খোঁটা দিলো,
“ডিভোর্সি মা-গীর তেজ কতো! এই তেজের কারণেই স্বামীর ঘর ছাড়া হতে হয়েছে।”

কথাটা ভাবী বিড়বিড় করে বললেও আমি শুনে নিয়েছি। আমি তাকে তারপরও কিছু বললাম না। কিছু-কিছু সময় চুপচাপ থাকাই ভালো। ভাঙা মানুষের দুর্বল পয়েন্ট ধরে অনেকেই পুনরায় ভাঙতে আসে, আসবে। আর তখন যদি তারা অপর মানুষটার কাছে সুবিধা পেয়ে বসে, তাহলে আর তার রক্ষা নেই। এক জীবন অতিষ্ঠ করে, মানুষ আর তাকে বাঁচতে দিবে না। কিন্তু, আমি তো বাঁচতে চাই। বাঁচাতে চাই, আমার পেটে বেড়ে ওঠা সন্তানকে। তাই চুপ রইলাম। যার-তার কথা কানে তুলতে নেই । এতে ওরা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভেবে বসবে। কিন্তু, আমি তো ওদের গুরুত্ব দিচ্ছি না।
দীর্ঘ জার্নিতে শরীর ক্লান্ত লাগছে আমার। আমি কোনো কথাবার্তা ছাড়াই, রুমের লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। ভাবী অমনি সুড়সুড় করে চলে গেলো, যুতসই জায়গা না পেয়ে। আমি হাসলাম, তার অপমানিত হওয়া ভোঁতা মুখটা দেখে। রাজ্যের ক্লান্তীতে চোখ বন্ধ করে আমি ভাবতে লাগলাম, এই জায়গাটা আমার ছেড়ে দেওয়া উচিত। মানুষের মগজ বুঝে চলা ভালো। চলার পথে কিছু বি/কৃত মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানোও উচিত। এতে মানসিক শান্তি অক্ষ/ত থাকে!

ঠকেছি পর্ব ৫

এই সমাজের কাছে আমি এখন ডিভোর্সি। ওদের কাছে আমি বড়ই ঠুনকো, আমার দাম নেই কানাকড়িও। ওরা সুযোগ পেলেই আমাকে বারবার ভাঙতে আসবে। আমিও বারবার মনোবলের খেই হারিয়ে ফেলবো। আমাকে আমার অতীত পিছুডাক দিবে। নিজের সম্মান, নিজের দাম রক্ষার্থে হলেও এই শহরের জায়গাটা আমার পাল্টে ফেলা উচিত। আমাকে আর বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। বসার ঘর থেকে শুনতে পেলাম রিধান ভাই মা’কে বলছে,
“এই বাসাটা পাল্টে ফেলিও, খালা। আমি তোমাদের জন্য নতুন ফ্ল্যাট দেখবো।”
মা-ও তার সঙ্গে সহমত হলো, অমত করলো না। রিধান ভাই বিচক্ষণ মানুষ, এক প্রহরেই বুঝে গিয়েছে, এই বাসাটা এখন আর আমার জন্য শান্তির জায়গা নয়।

ঠকেছি শেষ পর্ব