ডার্কসাইড পর্ব ১১
জাবিন ফোরকান
রোযার বয়স তখন তিন।সবেমাত্র খড়ি হাতে স্লেটে আঁকিবুঁকি করতে শিখছে।বাবা মায়ের অতি আদরের একমাত্র সন্তান।একমাত্র অবশ্য আর বেশিদিনের জন্য বজায় থাকার কথা ছিলোনা, খুব দ্রুতই পরিবারটিতে যুক্ত হতে যাচ্ছিল এক নতুন সদস্য।
মর্মা*ন্তিক এক অ*গ্নিকান্ড।পার্শ্ববর্তী বিল্ডিংয়ের রেস্টুরেন্টের গ্যাস সিলিন্ডার বি*স্ফো*রণে উদ্ভুত আ*গুন দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের তিনটি স্থাপনায়। ফায়ার সার্ভিসের পঁচিশটি ইউনিট প্রায় বারো ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমের পর নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় অগ্নিদেবতাকে।কিন্তু ততক্ষণে প্রা*ণহানি পঞ্চাশোর্ধ।আহ*ত অজানা।প্রল*য়ংকারী সেই দুর্ঘটনায় নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দেয় রোযা। “পরিবার”—শব্দটির মর্মার্থ উপলব্ধির আগেই পরিবার হারিয়ে এতিম হয়ে পড়ে সে এই পৃথিবীর বুকে।
প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল রোযাকে।রক্ষকের ভূমিকায় যথারীতি আবির্ভূত হয়েছিলেন তার মা। মা – রা নিজের সন্তানের জন্য সবকিছু করতে সক্ষম তার এক নিদর্শন পৃথিবীর বুকে স্থাপন করে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কোলে তুলে বারান্দা থেকে ফায়ার সার্ভিস টিমের সেফটি নেটে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন রোযাকে।কিন্তু নিজেকে এবং স্বামীকে রক্ষা করতে পারেননি।ছড়িয়ে পড়া আ*গুনের উত্তাপ এবং ভয়ংকরী কালো ধোঁয়া বিষিয়ে তোলে তাদের শ্বাসনালী। গর্ভবতী মা এত ধকল সহ্য করতে পারেননি।ইহলোক ত্যাগ করেন নিজের স্বামীর বুকে মাথা রেখেই।স্ত্রীর মৃ*তদেহ আগলে নিয়ে পৃথিবীতে জীবিত থাকার সকল ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছিলেন স্বামী।যদিও নিজের একমাত্র সন্তানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু শ্বাসনালীর ৯০ শতাংশ পু*ড়ে যাওয়ায় নিজের ভালোবাসার স্ত্রী এবং অভূমিষ্ঠ সন্তানকেই অনুসরণ করেন তিনি।নিজের বাবা এবং সৃষ্টিকর্তার ভরসায় ইহলোকে রেখে যান নিজের যক্ষের ধনকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিজের বড়ো ছেলেকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েন ইউনূস রহমান।পিতৃমাতৃহীন রোযাকে আগলে নেন নিজের বুকে।নিজের মুমূর্ষু ছেলের হাত ছুঁয়ে ওয়াদা করেছিলেন তিনি, রোযাকে গড়ে তুলবেন, সুন্দর একটি জীবনদান করবেন।জীবনের সকল সঞ্চয় ব্যবহার করে কেনা ফ্ল্যাটে ছোট ছেলের সঙ্গে থাকতেন তিনি। রোযাকেও নিয়ে যান সেখানে।প্রথম কয়েক বছর বেশ ভালোই চলছিল সবকিছু।ছেলে তার এবং ভাতিজির বেশ খেয়াল রাখতো।নামিদামি একটি সরকারি স্কুলে ভর্তিও করিয়ে দিয়েছিল সে রোযাকে। স্নেহও করতো যথেষ্ট।কিন্তু বিপত্তি ঘটে ছেলেটার বিয়ের পরপরই।
এক ধনীর দুলালীর সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো তার।বেশ কাঠখড় পু*ড়িয়েই সেই সম্পর্কের পরিণতি দান করেন ইউনূস রহমান।খুব শখ করে বউ তুলে আনলেন নিজের বাড়িতে।ভালোই হবে, তার রোযা একজন মায়ের মতন মানুষকে জীবনে পাবে।কিন্তু তিনি কোনোদিন কল্পনাও করেননি তার সেই সিদ্ধান্ত তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে দাঁড়াবে।
বছর ঘুরতেই ধনী মেয়ের সত্যিকার রূপ বাহিরে আসতে শুরু করে।বৃদ্ধ শ্বশুর এবং এতিম ভাতিজির জন্য খাটতে সে ইচ্ছুক নয়।স্বামীর সঙ্গে আলাদা ঘর চায়।তাছাড়া তারও সন্তান আসতে চলেছে।এমন পরিবেশ নবজাতকের জন্য মোটেও উপযোগী নয়।আলাদা থাকতে হবে।কিন্তু কেনো থাকবে?ফ্ল্যাট তো আগেই ছেলের নামে লিখে দিয়েছিলেন ইউনূস রহমান।এই বাড়ি তার ছেলের।তিনি চলে গেলেই হয়।
ইউনূস রহমান হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন যখন দেখলেন নিজের ছেলেও আজ তার পক্ষ নিলোনা।অত্যন্ত আত্মমর্যাসম্পন ইউনূস কিছুদিনের মধ্যেই রোযার হাত ধরে বেরিয়ে আসেন সেই ফ্ল্যাট থেকে।মাথার উপরে খোদা আছেন।তিনিই রিজিকের ব্যবস্থা করবেন।ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস!ছেলের স্ত্রীর বিলাসিতার লাখ টাকার পামেরিয়ান কুকুরটির পর্যন্ত স্থান রয়েছে বাড়িতে, অথচ জলজ্যা*ন্ত শ্বশুর এবং ভাতিজিকে জায়গা দিতে কষ্ট হয়ে যায়। কৌতুকহাসি হেসেছিলেন ইউনূস।
অতঃপর রোযাকে নিয়ে এক নতুন জীবনযুদ্ধ শুরু হয় তার।একটি বেসরকারি ব্যাংকে গার্ডের চাকরি নেন।সকালে চাকরি করতেন, সন্ধ্যায় আশেপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়াতেন।তাই দিয়ে রোযার ভরণপোষণ থেকে আরম্ভ করে পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছিলেন।নাতনিও যেন তার কষ্ট বুঝতে শিখলো।দুর্দান্ত ফলাফল করতে লাগলো।কিন্তু যত উপরের ক্লাসে উঠলো, ততই ভালো পড়াশুনার চাহিদা বাড়লো। রোযার ইচ্ছা ছিল একজন ইঞ্জিনিয়ার হবে।নিজের প্রজেক্টে তৈরিকৃত বিল্ডিংয়ে ফ্ল্যাট কিনবে। সেই ফ্ল্যাটেই দাদুকে নিয়ে থাকবে।তাকে নিয়ে হজ্ব করতে যাবে মক্কায়। তারপর একদিন নিজের উপার্জনে কেনা গাড়িতে করে দাদুকে নিয়ে বেড়াতে যাবে চাচার বাসায়!
কতশত স্বপ্ন বোনা ছিল দাদু আর নাতনীর ছোট্ট সংসারে।কিন্তু কালবৈশাখীর ঝড়ের মতন সবকিছু এলোমেলো করে দেয় একটি দুর্বিষহ ঘটনা।ইউনূস রহমানের শরীরে বাসা বাঁধে মর*ণব্যাধি ক্যান্সার।এবং তারপর?আর কিছুই কোনোদিন ঠিক হয়নি।
বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন বিসর্জন দেয় রোযা। হন্যে হয়ে কাজ খুঁজতে শুরু করে নিজের দাদুর উন্নত চিকিৎসার আশায়। একে একে গ্রামের বাড়ির জমি, পুরাতন বাড়ি, একটিমাত্র পুকুর…. সবকিছুই হাতছাড়া হয়।চাচার কাছে হাতজোড় করেও লাভ হয়নি।চাচীর পায়ে ধরে কেঁদেছিল রোযা, ভিক্ষা চেয়েছিল দাদুর জন্য।যে মানুষটা তার প্রয়োজনে নিজের সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছে তার জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত ছিল রোযা।কিন্তু লাভ হয়নি।সম্পদের কালো চশমা তাদের বিবেকবুদ্ধি ঢেকে দিয়েছিল, মুছে দিয়েছিল সকল মানবিক মূল্যবোধ।রোযার আজও স্মরণ হলে কান্না পায়, তার চাচা দুইটি এক লাখ টাকার বান্ডিল তার গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল,
“ ভালোই তো শরীর বানিয়েছিস। ওটা বিক্রি করতে পারিস না?”
এমন কথার পর সেই টাকার বান্ডিলে হাত লাগানোর মতন পাপকার্য রোযা করেনি।
তারপরের কাহিনী?বর্ণনা করার মতন তেমন কিছুই নেই। তা শুধু হৃদয়ের অনুধাবনের ব্যাপার……..
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইউনূস রহমান।অতীতের রোমন্থনে তার সমস্ত হৃদয় কেমন চেপে আসছে বিষাদে।মাতৃহীন দুই ছেলেকে কোলেপিঠে করে বড়ো করেছিলেন তিনি।একজন হলো মানুষ, আরেকজন অমানুষ!এই ব্যর্থতার দায় কি আদও তার?
তার চড়ুইকে একটিবার দেখতে আজ বড্ড ইচ্ছা করছে।অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে কি এমন ইচ্ছা?খোদাই ভালো জানেন।রোযা রহমানের সঙ্গে খুব শখ করে নিজের প্রিয় চঞ্চল পাখিটির নাম যুক্ত করে দিয়েছিলেন, চড়ুই।একদম চড়ুইয়ের মতোই তার আশেপাশে সর্বক্ষণ কিচির মিচির করে বেড়াতো।মেয়েটির মায়াঝড়া মুখের দিকে তাকিয়ে যেন পাষাণের হৃদয়ও গলে যেতে বাধ্য।কিন্তু অমানুষদের হৃদয় তাতে ভোলে না।
ঘন্টাখানেক আগে দুইজন লোক কেবিনে এসেছিল।প্রথমে কিছুটা খটকা লেগেছিল তার। দেড় বছরে রোযা বাদে তার অন্য কোনো পরিবারের সদস্য তাকে দেখতে আসেনি।অবশ্য তাদের এখন নিজের পরিবার বলে গণ্যও করেননা তিনি।কিন্তু এরা কারা?নার্স জানায় তারা নাকি সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে আগত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ।রোগীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছেন।তারপর আর বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি ভাবেননি তিনি।ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।বর্তমানে জাগ্রত হয়ে অলস মুহূর্ত পার করছেন। নার্সও নেই কেবিনে।যান্ত্রিক শব্দ করে বাজতে থাকা হার্ট মনিটর ব্যাতিত সবকিছুই নীরবতার চাদরে আচ্ছাদিত।
হঠাৎই মৃদু ধ্বনি তুলে কেবিনের দরজাটি খুলে গেলো।ভেতরে প্রবেশ করলো কেবিনবয়ের পোশাক পরিহিত একজন লোক।কেবিনের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় প্রতিদিন একবার করে কেবিনবয় আসে।কিন্তু তাকে ইউনূস রহমান চেনেন।এই কেবিনবয় ভিন্ন কেউ।সার্জিক্যাল মাস্ক পড়ে থাকার দরুণ চেহারা দেখা না গেলেও শক্তিশালী দৈহিক অবকাঠামো ঢাকা সম্ভব নয়।
– তুমি কে? রুমি কোথায়?
গত প্রায় তিনমাস যাবৎ রুমি নামের একটি ছেলে তার কেবিনরুমে কাজ করে আসছে।সুখ দুঃখের আলাপে তার ছেলেটির সঙ্গে যথেষ্ট সক্ষতা গড়ে উঠেছিল।ইউনূস রহমানের প্রশ্নে নতুন কেবিনবয় হেসে বললো,
– রুমি একমাসের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছে।
– ওহ। তা এমন মুখ ঢেকে রেখেছ কেনো?আমি ক্যান্সারের রোগী,ছোঁয়াচে রোগের নই।
শুষ্ক কন্ঠে কিঞ্চিৎ হাসলেন ইউনূস।তাতে কেবিনবয় আস্তে করে নিজের মাস্ক নামিয়ে ঝকঝকে এক হাসি উপহার দিলো তাকে।ছেলেটির মুখপানে কয়েক মিনিট একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন তিনি,কারণ ছেলেটি সুদর্শন।এক বেসরকারি হাসপাতালের কেবিনবয় চরিত্রে যেন তাকে মানানসই লাগছেনা।বিশেষ করে ডান কানের লতিতে চকচকে বর্ণের একটি পাথরের দুল বেশ নজর কাড়ছে।
পুনরায় মাস্কটি মুখে চড়িয়ে সে এগোলো। বেডের পাশে বসে পড়ে বললো,
– আপনার এখন ঘুমানো দরকার।আপনি ঘুমান, আমি এখানে আছি।
কথাগুলো সাধারণত নার্স বলে থাকে।তবে ইউনূস রহমান খুব অবাক হলেন না।রুমি প্রায়ই রাতে তার কাছে বসে থাকতো, হয়ত এই ছেলেটিকেও যাওয়ার আগে বলে দিয়ে থাকতে পারে।তাই তিনি বেশি না ভেবে চোখ বুজলেন।
কিছুক্ষণ পর অনুভব করলেন কেবিনবয় ছেলেটি তার কপালে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
হন্তদন্ত হয়ে হোমকেয়ার হসপিটালের গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছে না চাইতেও রোযার শরীরে একটি শিরশিরে অনুভূতি খেলে গেলো।এর পূর্বে যতবার এসেছে রোগী এবং স্বজনদের আনাগোনায় পরিপূর্ণ থাকতো চারিপাশ।বর্তমানে রোগী তো দূরে থাক রিসেপশন ডেস্ক পর্যন্ত শূন্য পরে আছে। নাইটগার্ডদের নামগন্ধও নেই।ব্যাপার কি?এটা কোনো ফাঁদ নয়তো?
ভাবতে ভাবতেই রোযার ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। ডক্টর ওয়াসিমের নাম কলার আইডিতে ভেসে উঠতেই রোযা দ্রুত রিসিভ করলো।
– মিস রোযা।আপনি এসেছেন কি?
ডাক্তারের কণ্ঠস্বরে একটি অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লো।নিজের দাদুর ডাক্তারের সঙ্গে রোযা প্রায়শই আলাপ আলোচনা করে থাকে।জটিল থেকে জটিলতর সময়েও কখনো তার কন্ঠ কম্পিত হয়না।এমনকি কিছুক্ষণ আগে যখন তিনি ফোন করে রোযাকে অযাচিত আগন্তুকদের সম্পর্কে জানালেন তখনো তার কন্ঠ চাপা শোনালেও ভয়ার্ত লাগেনি।জবাব দিতে গিয়েও দিলোনা রোযা।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রইলো।
– মিস রোযা?
– আমি আসতে পারছিনা ডক্টর।আমার ভীষন ভয় হচ্ছে, যদি তারা দাদুর বদলে আমাকে ধরে ফেলে?
অভিনয় শুরু করলো রোযা। অপর পাশ থেকে কয়েক মুহূর্ত সব নীরব।এরপর ডক্টর ওয়াসিমের কন্ঠস্বর জানালো,
– কি বলছেন মিস রোযা?আপনার দাদুর কিছু হয়ে গেলে?
– হোক!
– আপনি আসুন….আমি দেখছি।কোনো…সমস্যা হবেনা। আমি আপনাকে….গ্যারেজের দিক দিয়ে নিয়ে আসবো….
অসঙ্গতি! ডক্টর ওয়াসিম আহমেদ কখনোই কথা বলার সময়ে শব্দের মাঝখানে বিরতি প্রদান করেননা।সময় ক্ষেপণের অর্থ, তাকে কেউ কথাগুলো শিখিয়ে দিচ্ছে! তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে দিলো রোযা। সিমকার্ড বের করে দুই আঙ্গুলে চাপ দিয়ে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলল দেয়ালে।তার হৃদপিন্ড ধুকধুক করছে।সে আশা করছে এখনো পর্যন্ত তার ফোন ট্র্যাক করা হয়নি।কিন্তু যদি হয়ে থাকে তাহলে?সুইচড অফ করে ফোন ব্যাগে ভরে ফেলল রোযা। এখন কি করবে সে?
দীর্ঘ প্রশ্বাস টেনে রোযা সাবধানে এগোলো সামনের লিফটের দিকে।হয়ত ডক্টর ওয়াসিম যে তাকে জানিয়ে দিয়েছিল তাদের আগমনের ব্যাপারে,বিষয়টা তারা টের পেয়ে যায়।অতঃপর তাকে কব্জায় নিয়ে রোযাকে পাকড়াও করে ফাঁদ পাতে।তাই চারিপাশ এত খোলামেলা নির্জন,ঝামেলামুক্ত।কিন্তু এতদূর পৌঁছে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।দাদুকে সে কিছুতেই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারবেনা। মানুষটা তার জীবনের সবকিছু, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।তার জন্য যদি নিজের প্রাণও আজ বিসর্জন দিতে হয় তাতেও রোযা প্রস্তুত!
লিফটের ফ্লোর চতুর্থ তলা দেখাচ্ছে।নিচের দিকে নামছে তীরচিহ্ন। ব্যাগ থেকে মরিচের কৌটোটা বের করে হাতে শক্তভাবে ধরলো রোযা।পাশের সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগলো কে আসছে দেখার জন্য।ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় ডিং শব্দ করে খুলে গেলো লিফটের দরজা।ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দুইজন লোক।একজনের কোমরের বেল্টে গোঁজা পি*স্তলের ম্যাগাজিন দৃষ্টি এড়ালোনা সতর্ক রোযার।
– ব্যাপার কি?মজিদ যে বললো সিসিটিভিতে দেখেছে মেয়েটা এখানেই?
বলতে বলতেই একজনের ফোন বেজে উঠলো।
– মজিদই ফোন করেছে। হ্যালো মজিদ?
– পিছনে!
আর্ত কণ্ঠটি শোনার সাথে সাথে দুইজনই পিছনে ঘুরে তাকালো।পাউডার জাতীয় কিছু একটা ছুটে এলো উভয়ের মুখ বরাবর!
– আহ!
হাহাকার করে উঠে নিজেদের চোখ চেপে ধরলো তারা।
অর্ধেক মরিচের কৌটো শেষ করেছে রোযা।উভয়ই জ্বলুনিতে কাতরাতে কাতরাতে মেঝেতে বসে পড়তেই সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে নামলো সে।লিফট পুনরায় উপরে উঠতে আরম্ভ করেছে।খুব সম্ভবত সিসিটিভি রুমে থাকা সেই মজিদ বাকিদের জানিয়েছে, তারা আসছে।দ্রুত ভাবতে থাকলো রোযা।কি করবে সে?দাদুর কেবিনে যাবে কি?তারা যদি ওখানে পৌঁছে থাকে তাহলে তো সর্বনাশ! সিঁড়ি বেয়েই ছুটলো রোযা।কিন্তু অতর্কিতে মেঝে থেকে উঠে একজন তার পা চেপে ধরলো।একটা জোরালো হ্যাঁচকা টানে হিড়হিড় করে নামিয়ে আনলো শক্ত টাইলসের মেঝেতে।হাতের ব্যাগ আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলেও তা ছিটকে গেলো কিছুটা দূরে, সঙ্গে গড়িয়ে গেলো মরিচের কৌটোও।
– হারা*মজাদী!
রোযার উপর চড়াও হলো সে।এক নিমিষে চেপে ধরলো তার গ্রীবাদেশ।মরিচের কারণে তার চোখজোড়া লাল হয়ে উঠেছে, পানি গড়াচ্ছে অনবরত।নিঃশ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো রোযার, বুকে জেঁকে বসলো অদ্ভুত এক চাপ।শরীর খুব দ্রুত অক্সিজেন হারাচ্ছে।জলদি কিছু করতে হবে নাহলে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে জ্ঞান হারাবে সে।
দাঁতে দাঁত চেপে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে হাঁটু উঁচু করে সে আ*ঘাত হান*লো তার উপর চড়াও হওয়া লোকটার দুর্বল জায়গা বরাবর। ‘ কৎ ‘— করে একটা অদ্ভুত ধ্বনি নির্গত করে সে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।দুই হাতে ক্ষতস্থান চেপে ধরে বাইন মাছের মতন গড়াগড়ি দিতে আরম্ভ করলো মেঝেতে।
দ্রুত উঠতে চাইলো রোযা।কিন্তু এবার তাকে আঁকড়ে ধরলো অপরজন।সে পি*স্ত*ল বের করতে করতে রোযা উভয় হাত বাড়িয়ে দূরে পরে থাকা নিজের ব্যাগটা টেনে আনলো নিজের দিকে।ছু*রিটা বের করে নিলো ক্ষীপ্র গতিতে।অপরদিকে লোকটি নিজের পি*স্তলে ম্যাগাজিন ভরছে,মাত্রই আবিষ্কার করেছে আগের ম্যাগাজিনে বু*লে*ট ছিলোনা। বিরক্তি এবং ক্ষোভে তার চেহারা কুঞ্চিত হয়ে রয়েছে।মিনমিন করে অশ্রাব্য শব্দে কিসব গালমন্দও করে চলেছে নিজে নিজে।রোযা এক মুহুর্ত নিজের হাতের ছু*রি এবং অতঃপর লোকটার দ্রুত হাতের দিকে তাকালো।পি*স্তল প্রস্তুত প্রায়!
জীবনে কোনোদিন কাউকে গু*রুতর আঘা*ত করেনি রোযা।তার হাত কাপতে থাকলো।একজন মানুষ হয়ে অপর একজন মানুষকে কিভাবে আক্র*মণ করবে সে?এতটা নিষ্ঠুর হওয়া কি সম্ভব তার পক্ষে?
সম্ভব রোযা!নিষ্ঠুর হও!নিজের আপনজনকে রক্ষায় নিষ্ঠুর হও!—
বাক্যটি ধ্বনিত হলো তার হৃদয়ে।কোনো উপায় নেই তার নিকট।আত্মরক্ষার্থে সে বাধ্য।কি লাভ এই মনুষ্যত্ববোধ হৃদয়ে পুষে যদি তা তারই সর্বস্ব লুটে নেয়?তাছাড়া এরা মানুষ নয়, জানোয়ার!জানোয়ারকে খতম করতে যদি জানোয়ার হওয়ার প্রয়োজন হয় তাই নাহয় হলো সে!কতদিন থাকবে লুকিয়ে?অন্য কারো উপর নির্ভর করে?প্রতিরোধ তাকে করতেই হবে।
ছু*রির হাতলে চেপে বসলো রোযার আঙুল।দৃঢ় চেতনায় তার চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।লোকটি সেফটি লক খুলেছে।বর্তমানে শুধু….অস্ফুট শব্দ করে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে রোযার হাতের ছু*রি*টি গেঁ*থে গেলো তার কাঁধ বরাবর!ছিটকে উঠলো র*ক্ত।একবারে থামলোনা রোযা, শক্তি প্রয়োগ করে দ্বিতীয়বার ছু*রি চালালো তার পে*ট বরাবর।মুহূর্তেই র*ক্ত ফি*নকি দিয়ে উঠে রোযার হাত রাঙিয়ে তুললো।গেঁ*থে যাওয়া ছু*রি*টা এবার আর টেনে বের করতে পারলোনা রোযা। দৃশ্যটি তার শরীরকে নাড়িয়ে দিয়েছে যেন।গুলিয়ে উঠছে গা,চক্কর দিচ্ছে মাথা।
লোকটি মেঝেতে লুটিয়ে পড়তেই হাতের ভরে পিছনে সরে গেলো রোযা।নিজের হৃদস্পন্দন সে আর অনুভবে সক্ষম নয়।দৃষ্টির সামনের সবকিছু তার এক ভয়াল দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে।কিন্তু এটি দুঃস্বপ্নের সময় নয়। উঠতে চাইলো রোযা, শক্তি হারিয়ে পরপর দুইবার পুনরায় বসে পড়ল মেঝেতে।তবুও হাল ছাড়লোনা।উঠে সিঁড়ির দিকে ছুটলো পুনরায়।ঠিক তখনি একেবারে তার মাথার কাছে কানের পাশ দিয়ে সাই করে কিছু একটা ছুটে গেলো।একটি শীষ বাজানোর মতন শব্দ শুনলো রোযা।পরক্ষণেই লক্ষ্য করলো দেয়াল ফুটো করে গেঁ*থে রয়েছে…. বু*লেট!
এক ঝটকায় পিছনে চাইলো সে।ঠিক প্রবেশপথের কাচের দরজার সামনে কালো পোশাক পরিহিত পাঁচজনের একটি দল।সকলেই সশ*স্ত্র।একজনের উত্তোলিত হাতের লম্বাটে নল সম্বলিত রিভ*লভার থেকে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। অপর একজন তার হাতটি নামিয়ে দিয়ে কঠোর কন্ঠে জানালো,
– উই নিড হার অ্যালাইভ!
নিজের জায়গায় জমে গেলো রোযা।এতগুলো পুরুষমানুষের সঙ্গে সে কিছুতেই পেরে উঠবেনা। কিন্তু বর্তমানে মোকাবেলা ব্যাতিত কি ভিন্ন কোনো উপায় রয়েছে?
দলটি এগিয়ে আসতে আরম্ভ করলো।রোযা তখনো নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।তার মস্তিষ্কে বইছে চিন্তার ঝড়।সে দৌড়ানোর চেষ্টা করলে নির্ঘাত পায়ে গু*লি করবে।তাই বর্তমানে নড়াচড়া হতে বিরত থাকলো সে।দলটির নেতাগোছের মানুষটি এগিয়ে এসেই রোযার বাহু ধরে ফেললো শক্ত করে।টেনে তাকে নামিয়ে আনলো সিঁড়ি থেকে।তারপর ঠেলে দিলো সামনে।
– চুপচাপ সামনে হাঁট।
একজন রোযার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে দিলো।মেঝেতে পড়ে থাকা দুইজনকে বাকিরা তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে।রোযা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, তার গতি কমে আসলেই পিছন থেকে ধাক্কা খেতে হচ্ছে।এক মুহুর্ত ভাবলো রোযা।উভয় হাতের মুঠো শক্ত করে যেন শক্তি সঞ্চয় করলো নিজের হৃদয়ে।তারপর অতর্কিতে ঘুরে গিয়ে তাকে ধাক্কা দেয়া লোকটার তলপেট বরাবর লা*থি হাঁকিয়ে দিলো।হাত বাঁধা থাকায় সামনে ঝুঁকে প্রচণ্ড শক্তিতে আছড়ে পড়লো তার উপর। উভয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে। উবু হয়ে রোযা উঠার চেষ্টা করলেই ছুটে এলো দুইজন।একজন তার চুলের গোছা টেনে ধরলো সহসাই।
– আক!
য*ন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলো রোযা।মুহূর্তেই তাকে সে আ*ছড়ে ফেলল দেয়ালে।কপাল ঠু*কে তৎক্ষণাৎ উষ্ম র*ক্ত গড়াতে থাকলো রোযার মাথা বেয়ে গাল পর্যন্ত।
– শালীর তেজ কম না!
সমস্ত শরীরে ঝনঝনে ব্যথা সহ্য করতে না করতেই পুনরায় একজন তার ঘাড় চেপে ধরলো।সজোরে চে*পে ধরলো দেয়ালে।জিহ্বায় র*ক্তের স্বাদ টের পেলো রোযা, ঠোঁটের অবস্থা বেগতিক।নিঃশ্বাস নেয়া অসম্ভব। দৃষ্টিশক্তিও হয়ে এসেছে ঝাপসা।জ্ঞান লোপ পাচ্ছে, বুঝতে পারলো রোযা।কিন্তু কিছুই করার নেই।শরীর ছেড়ে আসতেই দেয়াল বেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে রইলো তার শরীর।শুধু চোখের পাতা আধখোলা রইলো।অস্বচ্ছ দৃশ্য ভাসছে সম্মুখে।
– মে*রে ফেললি নাকি?
– আর নাহ, বেঁচে আছে।মাইয়া মানুষ এত সহজে ম*রেনা, কই মাছের জান ওগো!
লোকগুলো একত্রিত হয়ে এক মুহুর্ত কি যেনো আলাপ করলো।শ্রবণ ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় কিছুই শুনতে সক্ষম হলোনা রোযা।তার কানে শুধু একটি অদ্ভুতুড়ে সঙ্গীত বেজে চলেছে।
সবাইকে নিজের দিকে এগোতে লক্ষ্য করলো সে। এই বুঝি সমাপ্তি?চোখের পাতা বুজে আসতে চাইলেও জোরপূর্বক তা খোলা রাখলো রোযা।র*ক্তে মাখামাখি অবয়বে চেয়ে থাকলো নিজের ঘাত*কদের উদ্দেশ্যে।
– এক্ষুণি একে….
একজন কিছু উচ্চারণ করতে যাচ্ছিল।কিন্তু অতর্কিতে হাওয়ায় ভাসমান অবস্থায় বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে কিছু একটা দ্রুতগতিতে ছুটে এলো। এসেই সজোরে আ*ঘাত হা*নলো তার মাথা বরাবর।
মাথা চেপে ধরে মুহূর্তেই মেঝেতে বসে পড়ল সে।বাকি সকলে হতচকিত হয়ে পড়লো।বিস্মিত হয়ে খেয়াল করলো মেঝেতে পড়ে থাকা ধাতব জিনিসটি। একজোড়া লোহার নলের মতন অংশ সিলভার শিকল দ্বারা সংযুক্ত।র*ক্তের দাগ লেগে রয়েছে ধাতব অংশে।
নানচাক্স!
প্রত্যেকের দৃষ্টি মুহূর্তেই ঘুরে গেলো পাশে। রোযাও অনুসরণ করলো তাদের দৃষ্টি।চোখের সামনের দৃশ্য সে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারলোনা।
হাসপাতালে প্রবেশের কাচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আসমান! যথারীতি কালো ওভারসাইজ টি শার্ট এবং প্যান্ট বুটে আবৃত তার সম্পূর্ণ অবয়ব।মাথায় একটি ক্যাপ,মুখে মাস্ক। ফিঙ্গারলেস গ্লাভস পরিহিত হাতে ঝুলছে অপর একটি নানচাক্স।যেটার অপর প্রান্ত মেঝেতে গিয়ে ঠেকেছে।নয়নজোড়া অশুভ এক দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করছে।
হিং*স্র পশুর ন্যায় ধীরগতিতে অগ্রসর হলো আসমান।কোনো তাড়া নেই, নেই কোনো পরোয়া।এতজন সশ*স্ত্র ব্যক্তিও তার নিটল অস্তিত্বে চির ধরাতে ব্যর্থ।এগিয়ে আসছে সে, মৃ*ত্যুদূত হয়ে। নানচাক্সের ধাতব প্রান্তটি মেঝেতে ঘর্ষণের শব্দ তুলছে,পিনপতন নীরবতায় তা ছড়িয়ে দিচ্ছে অশরীরী এক আতঙ্ক।
উপস্থিত সকলে দৃশ্যপটে অপর এক শিকারী সত্তার আগমনে হতবিহ্বল হয়ে রয়েছে। নিজেদের জায়গায় নড়তেই ভীতি অনুভূত হচ্ছে।যেন সম্মুখে বর্বর জন্তু অবস্থান করছে,সামান্যতম নড়চড় করলেই ঝাপিয়ে পড়বে।এমনি এক পরাবাস্তব আতঙ্ক শৃঙ্খলের মতন আবদ্ধ করে ফেলেছে তাদের।যার দরুণ অ*স্ত্র থাকা সত্ত্বেও তারা স্থির হয়ে পড়েছে।
আসমান এগিয়ে কিছুক্ষণ আগে ছুঁড়ে দেয়া দ্বিতীয় নানচাক্সটি তুলে নিলো।তার দুই হাতে বর্তমানে দুইটি নানচাক্স।শিকারী দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে লোকগুলোর দিকে।পরক্ষণেই নজর নামিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা ক্ষতপূর্ণ রোযার দিকে এক পলক চাইলো সে।
– উঠুন।
আসমানের কন্ঠে ধ্বনিত হলো আদেশ।উপেক্ষা করতে পারলোনা রোযা।ধীরে ধীরে নিজেকে টেনে তুললো।হেলান দিলো দেয়ালে,অতঃপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে তাকালো আসমানের দিকে।
– কে তুই?
এতক্ষণে যেন হুশ ফিরেছে ঘা*তক দলটির।প্রশ্নের উত্তর করার কোনো লক্ষণ প্রদর্শন করলোনা আসমান।তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রোযার অবয়বে।রিভ*লভার উত্তোলন করলো একজন তাকে লক্ষ্য করে।ফিরেও চাইলোনা আসমান।রোযা অস্পষ্ট দৃষ্টিতেও খেয়াল করলো ফিঙ্গারলেস গ্লাভসের আড়ালে তার আঙ্গুলগুলো নানচাক্সে চেপে বসেছে।
পরবর্তী ঘটনাসমূহ এত দ্রুত ঘটলো যে রোযা আহ*ত শরীরে ঠিক মিলিয়ে উঠতে পারলোনা সকলকিছু।
আসমানের নানচাক্সের আ*ঘা*তে ছিটকে গেলো রিভ*লভার। ভারী বুটের লা*থিতে কয়েক ইঞ্চি ভেসে দূরে মেঝেতে আছড়ে পড়লো একজন। অপর একজন নিজের অ*স্ত্র প্রয়োগ করার পূর্বেই নানচাক্সের শিকল জড়িয়ে গেলো তার কণ্ঠে।হ্যাঁচকা টানে লুটিয়ে পড়ল সে।হাঁটুতে সজোরে আ*ঘাতে কটকট শব্দ হলো।ভেঙেই গিয়েছে হা*ড়গোড়!
এবার এক এক করে নয়,বরং সকলে একত্রে এগোলো আসমানকে উদ্দেশ্য করে।রোযা নিজের কান চেপে ধরে শুধু চেয়ে রইলো।তার সামনেই সৃষ্টি হলো কুরুক্ষেত্র।নানচাক্স আল্টিমেট ফিগার এইট টেকনিক প্রয়োগ করলো আসমান।তার শরীর নমনীয় হয়ে হাওয়ার মাঝেই ভেসে চললো।হাতের উভয় নানচাক্স এতত্রিত করে ঘূর্ণির ন্যায় ঘোরাতে ঘোরাতে সেকেন্ডের মাঝে অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকলো আসমান।ব্যাপারটা কাজ করলো অনেকটা ধারা*লো ব্লে*ডের মত।যেই তার আশেপাশে ঘেষার চেষ্টা করলো সেই নানচাক্সে ধরাশায়ী হতে বাধ্য হলো।
মুহূর্তের মধ্যেই পি*স্ত*ল কিংবা ছু*রি এমন ধরণের অ*স্ত্র ছাড়াই হাসপাতালের সম্পূর্ণ মেঝে র*ক্তসমুদ্রে রাঙিয়ে তুললো আসমান।যেন কোনো নৃত্যশিল্পী রক্তিম বর্ণের আবহে ফুটিয়ে তুলছে আপন কারুকার্য। রিভ*লভার ব্যবহারের সুযোগই পাচ্ছেনা শত্রুপক্ষ।তাদের এতটাই বিক্ষিপ্ত এবং বিহ্বল করে তুলেছে আসমান যে ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে সকলে।রোযা শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখলো।আসমানের হিসাবী পদক্ষেপ এবং জোরালো আঘা*ত লক্ষ্য করে উপলব্ধি করা সম্ভব যে সে এক্ষেত্রে যথাযথ প্রশিক্ষিত।শত প্রচেষ্টার পরেও তার দ্রুতগতির সঙ্গে পেরে উঠলোনা কেউই। একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকলো নানচাক্সের আঘা*তে ক্ষ*ত বিক্ষ*ত শরীরে।কেউ কেউ মেঝেতে, কেউ রিসিপশন ডেস্কের উপর, কেউ বা ওয়েটিং চেয়ারের উপর।
মেঝেতে পড়ে কাতরাতে থাকা একজনকে রিভল*ভার তুলতে খেয়াল করলো রোযা।আসমান দুইজনের সঙ্গে ব্যাস্ত।পিছনে নজর দেয়ার অবকাশ নেই।শরীর হেলিয়ে হাঁটু ব্যবহার করে এগোলো রোযা।হাত বাঁধা থাকায় চিন্তাভাবনা না করে নিজের পা দিয়েই রোযা আঘা*ত করলো লোকটার মাথা বরাবর।মুহূর্তেই নিষ্ক্রিয় হয়ে এলো তার শরীর, বন্ধ হয়ে এলো চোখের পাতা,ঝুলে পড়লো রিভল*ভার উত্তোলিত হাত।
আসমান পিছনে তাকিয়ে দৃশ্যটি খেয়াল করলো।তারপর একজনের রিভল*ভার কেড়ে নিয়ে একে একে লুটিয়ে থাকা প্রত্যেকের কপাল লক্ষ্য করে ছুঁড়তে লাগলো একেকটি বু*লেট।মৃ*ত্যু নিশ্চিতকরণ।সাইলেন্সার যুক্ত থাকায় গু*লির শব্দ হলোনা।শুধু ফি*নকি দিয়ে ছুটলো র*ক্তে*র বন্যা।বর্বর দৃশ্যটি উপলব্ধি করতে না পেরে শক্তভাবে চোখ বুজে থাকলো রোযা।
দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর যখন রোযা চোখ মেলে তাকালো তখন এতক্ষণ ধরে চলা তাণ্ডবলীলার পরবর্তী অবস্থা ভেসে উঠলো তার সামনে।
সম্পূর্ণ গ্রাউন্ড ফ্লোর যেন ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাওয়া কোনো অভাগী স্থান।চেয়ার উল্টে পড়ে আছে,ডেস্ক তছনছ, দেয়ালে দেয়ালে র*ক্তচিত্র।মেঝের কথা আর বলার প্রয়োজন নেই।রক্তিম প্রবাহে ভাসমান প্রা*ণহীন নিথর দে*হসমূহ।যেন হিং*স্র হায়েনার দল আক্র*মণ করে নিঃশেষ করে দিয়ে গিয়েছে গোটা একটি গ্রাম। নৃ*শংস দৃশ্যের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না, বুকটা কেমন ধরে আসে।
এই বিভীষিকার একমাত্র কারিগর মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে।এই প্রথম আসমানকে কিছুটা ক্লান্ত হতে খেয়াল করলো রোযা।চুলে হাত চালিয়ে নিজেকে প্রশান্ত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত সে।তার হাতের র*ক্তস্নাত মা*রণা*স্ত্র নানচাক্স দুটি বর্তমানে তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
নিঃশব্দ রইলো রোযা।বুঝতে পারলোনা কিছু বলবে কিংবা করবে কিনা।আসমান তার জীবন রক্ষা করেছে।গোটা সাতেক প্রাণের বিনিময়ে!রোযা অনুধাবন করতে ব্যার্থ সে ঠিক স্বস্তিবোধ করবে নাকি বিষাদ অনুভব করবে।
অবশেষে আসমানের দৃষ্টি আপতিত হলো রোযার উপর।এগিয়ে এলো সে।বিনা কারণেই সংকুচিত হয়ে গেলো রোযা।নিকটে পৌঁছে আসমান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো বরাবর তার চোখের দিকে।না চাইতেও রোযা শিউরে উঠলো।আসমানের দৃষ্টি যেন তার অন্তর পর্যন্ত ভেদ করে যাচ্ছে।বাকরুদ্ধ হয়ে রোযা অপেক্ষা করলো আসমানের বক্তব্যের আশায়।কি বলতে পারে সে?
ডার্কসাইড পর্ব ১০
“ আপনি ঠিক আছেন?বেশি ব্যথা লেগেছে?”
এসব বলবে নিশ্চয়ই?ব্যথা তো বেশ লেগেছে!এখনো ঝিমঝিম করছে শরীর।সত্যি জবাব দেবে কি রোযা?
তার সমস্ত আশা ভরসায় জল ঢেলে দিয়ে আসমানের কঠোর কন্ঠস্বর শুধালো,
– আমার হুডি পড়েছেন কেনো?
মূর্খের মতো আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকলো রোযা।তার ঠোঁট ফাঁক হলেও কিছুই উচ্চারণ করা সম্ভব হলোনা।
 
