ডার্কসাইড পর্ব ৩১

ডার্কসাইড পর্ব ৩১
জাবিন ফোরকান

কতই না বিচিত্র ভালোবাসা,তাইনা?
একটা সময় যার অস্তিত্বে হৃদয় হিমশীতল আতঙ্কে জমে আসতো,বর্তমানে তারই অবয়ব হৃদয়কে অনুভূতির দোলাচলে আন্দোলিত করে তোলে। ধ্বংসক হয়েছে রক্ষক।তার অসহনীয় উপস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে।রহস্যময় দানবটির পরাবাস্তব পর্দার উন্মোচন ঘটেছে।অবমুক্ত হয়েছে তার বহু যত্নে বক্ষপিঞ্জরে লুকিয়ে রাখা হৃদয়ের সুপ্ত অনুভূতি।পিশাচটির অস্তিত্ব জুড়ে অমানিশার ঘন আবরণের বদলে দৃষ্টিতে পরিলক্ষিত হয় রঙ বেরঙের আবেগের উড়ন্ত দুরন্ত প্রজাপতিরা।শত কোটি টকটকে গোলাপের মাঝে একটিমাত্র কণ্টকাকীর্ণ কালো গোলাপ সে।সেই গোলাপের আঁধারেই বিলিয়েছে এই হৃদয়,মস্তিষ্ক তথাপি রোযার সমস্ত অস্তিত্ব।নতুনভাবে খুঁজে পেয়েছে এই ধরিত্রীর বুকে পুনরায় নব উদ্যমে বেঁচে থাকার কারণ।সেই কারণটির নাম—আসমান।

সকাল সকাল নিদ্রাভঙ্গ হওয়ার পর ফ্রেশ হয়ে হলরুমে আসতেই একটি অভাবনীয় দৃশ্য নজরে এলো রোযার।কিচেনের ডাইন ইন এরিয়ায় টেবিলে বসে আছেন বিলাল রেমান, চারুলতা এবং নিহাদ।সাধারণত সকালের নাস্তা কখনোই কারো একসঙ্গে খাওয়া হয়না।আসমান বা রোযার কেউ রান্না করলে সবার জন্যই বানায়,যার যখন ইচ্ছা খেয়ে নেয়।মাঝে মাঝে চারুলতা অনলাইনে খাবার অর্ডার করে।সত্যিকার অর্থে পরিবারের প্রত্যেকেই স্বাবলম্বী,নিজের নাস্তাটুকু অন্তত নিজেই তৈরী করে নিতে পারে।তাই তিনবেলা একসঙ্গে খেতে বসার প্রয়োজন কিংবা সুযোগ কোনোটিই হয়না।তাই আজ সকলকে একত্রে দেখে রোযা কিছুটা ভরকালো বৈকি।তাকে দেখে বিলাল রেমান ডাকলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আরে মামণি,আসো আসো বসো।
কিচেনে ঢুকে পাশে চাইতেই কাউন্টারে আসমানকে কাজ করতে লক্ষ্য করলো রোযা।খাবারের সুঘ্রাণে পেট মোচড় দিয়ে উঠলো তার।নিহাদ লোভাতুর দৃষ্টিতে রান্নার দিকে তাকাতে তাকাতে বললো,
– আসমান ভাই স্পেশাল ব্রেকফাস্ট।উফ…তাড়াতাড়ি করো না!পেটের ভেতর আস্ত গণ্ডার দৌড়াদৌড়ি করছে গো!
– গণ্ডারটা গিললে কিভাবে?
– যেমন করে শাকচুন্নিরা ব্যাটা মানুষের মাথা গিলে অমন করে।
চারুলতা আর নিহাদের ঝগড়ায় না পারতে ফিক করে হেসে উঠলো বাকিরা।রোযা বসতে বসতে টেবিলে হাজীর হলো আসমান।খাবারের পদের দিকে চেয়ে ক্ষুধা যেন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেলো সকলের।খিচুড়ি এবং মুরগী কষা।সঙ্গে মেয়োনিজে ড্রেসিং করা মিক্সড ভেজিটেবল সালাদ।সবার প্রথমে হামলে পড়তে গিয়ে চারুলতার হাতে একটা চাটি খেলো নিহাদ।ভ্রুকুটি করলো মেয়েটির পানে চেয়ে।

– আমি লেগপিস ছাড়া খাবো না…
নিহাদ বলে শেষ করার আগেই দু দুটো লেগপিসের একটি নিজের পাতে এবং অপরটি রোযার প্লেটে ঠেসে চারুলতা বিজয়ীর হাসি হাসলো,
– নাও আরিয়া,এটা খেয়ে দেখো। লেগপিসের থেকে মজার আর কিছু হয়না।
ড্যাবড্যাব চোখে শুধু করুণ দৃষ্টিপাত ঘটালো নিহাদ, দৃশ্যমানভাবে টেনে ধরলো চারুর লম্বা চুলের গোছা।তাতে ভেংচি কেটে তার তলপেটে ঘুষি বসিয়ে নিজের খাবারে মনোযোগ দিলো চারুলতা।তাদের এই নীরব যু*দ্ধের মাঝে রোযার পাশের একমাত্র খালি চেয়ারটি টেনে বসলো আসমান।নীরবে খুলে নিলো মাস্ক।তাকে এর পূর্বে কোনোদিন পরিবারের সঙ্গে খেতে বসতে দেখা যায়নি। বিলাল নিজের হাতে প্লেটে খিচুড়ি এবং মাংস তুলে আসমানকে দিলেন।চুপচাপ চামচ তুলে খাওয়ায় মনোযোগী হলো সে।আশেপাশে দৃষ্টিপাত ঘটালোনা খুব একটা।তার চেহারার বিকৃতিতে কারোরই কোনোপ্রকার ভাবান্তর ঘটলোনা।যেন অতি স্বাভাবিক দৃশ্য তা।

– আজকে বিকালে পিকনিক আছে।আমার ইচ্ছা আমরা সকলে যাবো, নিহাদসমেত।
লেগপিসের শোকে পাখনায় কামড় দিতে দিতে নিঃশব্দ থাকলো নিহাদ।রোযা জিজ্ঞেস করলো,
– কিসের পিকনিক বাবা?
– মারবেল ভবনের সবাই মিলে ঠিক করেছে শীতের আগমন উপলক্ষ্যে একটি আর্লি উইন্টার বার্বিকিউ পার্টি করবে।আমি দ্বিমত করিনি।কথা দিয়েছি সবাই যাবো।
– মজা হবে।
চারুলতা আপনমনে হাসলো।অপরদিকে যথারীতি নিরুৎসাহিত আসমান,সে একমনে খাচ্ছে।বেশ দ্রুতই খায়,অর্ধেকের বেশি প্লেট খালি হয়ে এসেছে তার, এদিকে এখনো খাওয়াই শুরু করতে পারেনি রোযা।তড়িঘড়ি করে খেতে গিয়েই কি মনে করে একনজর নিহাদকে দেখলো,বেচারা উদাস হয়ে হাড় চিবুচ্ছে।নিজের লেগপিসটা নিঃশব্দে নিহাদের প্লেটে চালান করতেই ছেলেটার চোখ তারকার ন্যায় চকচক করে উঠলো।

– আমার বেশি বাছবিচার নেই,একটা কিছু হলেই হলো।
– তুমি নারী নও,তুমি পরী!তুমি যে পথ দিয়ে হাঁটো সেই পথ ফুলে ফুলে ভরে যাক,তুমি যা স্পর্শ করো তাই সোনা হয়ে যাক,তোমায় দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যাক,তোমার রূপে এই জগত দিওয়ানা হয়ে যাক, তোমার কন্ঠের মাধুর্যে কানে সুধা বর্ষণ হোক, তোমার….
– হয়েছে হয়েছে।আর গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।নাহলে যেটা দিয়েছি সেটাও কেড়ে নেবো!
বিব্রতবোধ করলো রোযা,উত্তেজিত হয়ে খাবারে হামলে পড়ে চোখ টিপে চারুলতাকে যেন ভৎসর্ণা করলো নিহাদ।এক চামচ খিচুড়ি মুখে দিতেই রোযার খালি প্লেটে চিকেনের পিস তুলে দিলো আসমান, অনেকটা আনমনেই।ব্যাপারটি খুব বেশি বড় কিছু নয়,কিন্তু তবুও, দারুণ ভালো লাগলো রোযার। হৃদয়জুড়ে মৃদু এক ঝংকার খেলে গেলো।নিজের অজান্তেই মৃদু কন্ঠে বললো,

– খিচুড়িটা খুব সুস্বাদু হয়েছে।
আসমান শুনলো,কিন্তু কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলোনা।নিজের প্লেটে মনোযোগ দিলো সে।এক চামচ সালাদ মুখে পুরে বিড়বিড় করলো,
– তোমরা যেও।আমি বাসায় থাকবো।
সে কিসের কথা বলছে বুঝতে কারোরই বাকি রইলোনা।বিলাল ভ্রু কুঁচকালেন।
– আমরা সবাই যাবো।
– ইচ্ছা করছেনা।
– সবাই যাবো, বেইবি।

আদুরে কন্ঠে উচ্চারণ করলেও বিলালের অভিব্যক্তিতে স্পষ্টত কঠোরতা টের পাওয়া গেলো।আসমান এক মুহুর্ত চেয়ে থাকলো।তারপর দ্রুত শেষ চামচ মুখে দিয়ে একটা ন্যাপকিন তুলে চলে গেলো, কিচেন থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলো নিজের রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। টেবিলজুড়ে হঠাৎ করেই এক জমাট বাঁধা কুয়াশা ভর করলো যেন।সকলেই উৎফুল্ল থেকে অতর্কিতে মুষড়ে পড়েছে আসমানের প্রস্থানে।একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করলেন বিলাল।প্লেটের খাবার নাড়তে নাড়তে রোযার দিকে চাইলেন,

– মামণি?
– জ.. জ্বি বাবা?
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তাকে মোকাবেলা করলো রোযা।
– আমি জানি,তোমার দাদু চলে যাওয়ার পর তুমি নিজেও মানসিক অস্থিরতা এবং অবসাদে ভুগছো।তবুও একটা অনুরোধ করবো?
– অবশ্যই বাবা,অনুরোধ নয় আদেশ করুন।
– প্লীজ টেইক কেয়ার অব মাই সন!
বিলালের দৃষ্টিতে অব্যক্ত এক অনুভূতির প্রকাশ ঘটলো, পিতৃ হৃদয়ের হাহাকার।রোযা নিজের উপর এক দায়িত্বের ভার অনুভব করলো যেন সহসাই।মাথা দুলিয়ে জানালো,
– আমি চেষ্টা করবো।
– থ্যাংক ইউ।

বিকালবেলা।
আয়নায় নিজেকে অন্তিমবারের ন্যায় পর্যবেক্ষণ করে সন্তুষ্টই হলো রোযা।প্যাস্টেল পিংক শাড়ির ভাঁজে আচ্ছাদিত তার অবয়ব এবং খোলা কেশরাশি বেশ মানিয়েছে।খুব বেশি সাজ এড়িয়ে শুধুমাত্র হালকা লিপস্টিক এবং গ্লসে অধর রাঙিয়ে কপোলে ছুঁয়েছে মৃদু ব্লাশ।এটুকুই।বহু বছর বাদে বোধ হয় এতটা যত্ন নিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে সে।কেনো?বিশেষ কেউ অবলোকন করবে বলে?হয়ত।প্রেমানুভূতি তার গোটা সংগ্রামী জীবনে এই প্রথম হৃদয়ে কড়া নেড়েছে।তাই প্রগাঢ় অনুভূতিতে অভ্যস্থ হতে সময় প্রয়োজন হবে।
হ্যান্ডব্যাগের ভেতর সেদিন ক্রয়কৃত ব্রেসলেটটি নিতে নিতে উত্তেজিত হয়ে উঠলো অন্তর।ঠিক কেমন হবে ব্যাপারটা?এটা আসমানকে দিয়ে কি বলবে সে?কিসের উপহার?তার অনুভূতি সম্পর্কে জানাবে কি?কিন্তু যদি কোনকিছু হিতে বিপরীত ঘটে?চিন্তার দোলাচলে অতিষ্ঠ হয়ে একটা সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শেষমেষ বেরিয়েই এলো বাইরে।যা হবে দেখা যাবে।

হলরুমে পৌঁছতেই অপেক্ষারত নিহাদকে নজরে পড়লো।সোফায় শরীর এলিয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে শীষ বাজিয়ে যাচ্ছিল।রোযা আসতেই ফিরে চেয়ে ভ্রু তুলে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো তার অবয়ব।লম্বা একটা শীষধ্বনি তুললো।অতঃপর বাঁকা হেসে নির্লজ্জ্বভাবেই বললো,
– সেক্সি লেইডি…
তৎক্ষণাৎ চোয়ালে রোযার মুষ্টিবদ্ধ হাতের ঘুষি খেয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকলো,চোয়াল ডলে বিড়বিড় করলো,
– যাক বাবা।মেয়েমানুষ আসলেই আস্ত একটা মুডের বস্তা,কখন কি চায় বোঝা দায়। মিথ্যা প্রশংসা করলেও দোষ, আবার সত্যি বললেও দোষ।
– তার মানে মাত্র তুমি মিথ্যা বললে?
– তো শাড়ী পরা চাঁদের বুড়ি বলে গালি খেতাম নাকি?
– নিহাদ!
– বলো ফুলটুশীইইই!
– তুমি একটা ভন্ড।
– ধন্যবাদ,আমি জানি আমি হ্যান্ডসাম।
– কানের ডাক্তার দেখাও, ভন্ড বলেছি।

– মেয়েমানুষ মুখে যা বলে তার উল্টোটাই বোঝায়। আই আন্ডারস্ট্যান্ড,আমার হ্যান্ডসামনেসে জ্বলেপুড়ে খাক হাজারো রমণীর মন,তুমি তো এক অবোধ বেচারী।
কলার ঝাঁকালো নিহাদ। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে রোযা কিছুক্ষণ।সত্যিকার অর্থে,যদিও নিজের প্রশংসা করাটা অস্বাভাবিক,তবে নিহাদ আদতেই সুদর্শন।বর্তমানে ডেনিম জ্যাকেট এবং জিন্সে তাকে বেশ লাগছে।চন্দন বর্ণের চেহারায় দারুণ দীপ্তি প্রকাশ পাচ্ছে। তীক্ষ্ণ চিবুকের উপরের কানে ছোট্ট একটি সিলভার পাথরের দুল নজর কাড়ছে।তবুও ব্যাপারটির প্রকাশ না ঘটিয়ে চোখেমুখে ঘৃণার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে হনহন করে বাইরের দিকে এগোলো রোযা।

– যত্তসব ডাস্টবিনের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করার মানে হয়না।
– ইউ মিন সেক্সি ডাস্টবিন ফুলটুশী?
– খবরদার আমাকে ফুলটুশী ডাকবেনা!
– তো কি ডাকবো? ভাবী?
থমকে পড়লো রোযা,অজান্তেই চট করে ঘুরে তাকালো পিছনে।ঠোঁটে তীর্যক হাসি ঝুলিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে নিহাদ।কিন্তু রোযার কপোলজুড়ে সৃষ্ট হওয়া লালিমার আভা তাকে দ্বিধান্বিত করে তুললো। ভ্রু উঁচু করে শুধালো,
– ভাবী ডাকটা পছন্দ হয়েছে মনে হচ্ছে?
– শাট আপ!
জোরপূর্বক নিজের অনুভূতি লুকিয়ে একপ্রকার হন্তদন্ত হয়েই এগোলো সে,পিছনে নিহাদ এক ঝাঁক কৌতুক এবং কৌতূহল নিয়ে তাকে অনুসরণ করলো।যতই কৌতুক করুক না কেনো,রোযার অভিব্যক্তির হঠাৎ পরিবর্তন তার দৃষ্টি এড়ায়নি।

মারবেল ভবনের পিছনের বাগানে আয়োজন করা হয়েছে বার্বিকিউ পার্টির।ইতোমধ্যেই ভবনের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা উপস্থিত হয়ে গিয়েছে।যারা দায়িত্বে রয়েছে,তাদের কয়লা এবং প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র সাজানোর কার্যক্রম চলছে। স্ন্যাকস এবং ফলমূলে সজ্জিত টেবিলে একটি স্পিকার বাজছে মৃদু শব্দে। গোধূলীর হিমেল হাওয়ার সঙ্গে ভালোই সঙ্গত হয়েছে সমস্ত আয়োজনের।রোযা পৌঁছতেই কয়েকজন পরিচিত মুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো।কুশল বাক্য বিনিময় করতে করতে তার উদগ্রীব নয়ন আশেপাশে খুঁজতে থাকলো, হৃদশাসককে।

অবশেষে পেলো।আয়োজন থেকে কিছুটা দূরে,একটি জলপাই বৃক্ষের নিচে বেঞ্চের উপর বসা আসমান।একলা নয়,সঙ্গী ছোট্ট রুহি।তার কোলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।অদ্ভুত হলেও সত্য দৃশ্যটির পানে রোযার দৃষ্টি আঠার ন্যায় আবদ্ধ হয়ে পড়লো।আসমানের শুভ্রতা আজ হার মানিয়েছে সবকিছুকেই।অতিরিক্ত কোনো আড়ম্বর নেই।শুধুমাত্র একটি ঢোলা সাদা শার্ট এবং কালো ফরমাল প্যান্ট।মাস্কে আবৃত চেহারা।ললাটে লুটিয়ে পড়া কালো কেশগুচ্ছ।অনুভূত হচ্ছে এক দৈবিক অবয়বের মতন।পবিত্র,শুভ্র,স্নিগ্ধ এবং কোমল এক অস্তিত্ব।প্রেমে পড়লে কি সব মানুষ এমনি অনুভব করে?মনে মনে ভাবলো রোযা।তার দৃষ্টিতে আসমানের অবয়বের চারপাশ ঘিরে যেন ঘুরপাক খেয়ে চলেছে সহস্র প্রজাপতির দল,অনুভূতির হাওয়া পাখনা মেলে প্রবাহ খেলিয়ে দিচ্ছে নিটল অস্তিত্বজুড়ে, এক ভাসা ভাসা দীপ্তিস্নাত বর্ণে প্রতিফলিত হচ্ছে দৃশ্যপটে।কি অদ্ভুত সুন্দর!

– স্বামীতেই বিভোর হয়ে গেলে নাকি আরিয়া?
কর্ণপাতও হলোনা রোযার।তার প্রজ্জ্বলিত মুগ্ধ দৃষ্টি সম্মোহিত আসমানের পানে।কোলে ছোট্ট রুহিকে আগলে রেখেছে সে পরম যত্নে,ওই শীতল নয়নে কোমল অনুভূতির উদ্ভব ঘটেছে শিশুটির উদ্দেশ্যে।বিষাদ এবং মোহের এক মিশ্র অনুভূতি ছেয়ে গেলো রোযার অন্তরজুড়ে।
– আরিয়া…?
এক ঝটকায় বাস্তবতায় ফিরে চোখ পিটপিট করে তাকালো রোযা চারিপাশে।যেন নিজেকে হঠাৎ করেই পৃথিবীর বুকে আবিষ্কার করেছে।আশেপাশের ব্যক্তিগণ তাতে হাসলো,এক রমণী মুখে হাত চেপে মৃদু হেসে জানালো,

– হারিয়ে গিয়েছিলে বুঝি মিস্টার নীলের মাঝে?
লজ্জাবোধ করলো রোযা,দৃষ্টি নত করে নিলো।
– চিন্তা করোনা, তুমিই তাকে দেখবে সারাজীবন।এছাড়া আর কেউ কোনোদিন চোখ তুলেও তাকাতে সাহস করবেনা মিস্টার নীলের দিকে।
কথাটির মাঝে লোকায়িত আঁধার রোযার অনুভব করতে বেগ পোহাতে হলোনা।নয়ন তুলে চাইলো সে।মুখোমুখি হলো রমণীর,নির্ভিক হয়ে।
– আমার স্বামীকে আমি অবলোকন করছি,অন্য কেউ দেখলো কি না দেখলো,সাহস করলো কি না করলো ভেবে সময় নষ্ট করার প্রয়োজনবোধ করছিনা মিসেস কামাল।

– ওহ, আই ডিড নট ওয়ান্ট টু বি রুড বাট….
– পৃথিবীর অধিকাংশ সৃষ্টিরই বিপরীত রয়েছে।ভালো খারাপ, একলা দোকলা, যোগ বিয়োগ ইত্যাদি।সৌন্দর্য্য মানব হৃদয়ের আকর্ষণের পরিপূরক।তেমনি এর বিপরীত কদর্যতা আতঙ্ক জাগানিয়া।সকলের আপন আপন বৈশিষ্ট্য রয়েছে।ভালোবাসায় তা ছেদ ঘটাতে পারেনা।
রোযার দিকে চেয়ে থাকলো সকলে, নিঃশব্দে।
– এইযে উপরে উপরে ভদ্রতার পোশাক গায়ে চড়িয়ে ভালোমানুষ সেজে কথা বলা,সহানুভূতি পোষণ করা এবং অন্তরে একরাশ ঘৃণা রেখে বিরক্ত হওয়া, বিভ্রান্ত হওয়া,অপরকে বিচার করা….এসব বন্ধ করে যেদিন সৎভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে শিখবেন,সেদিনই প্রকৃত মানুষ হতে পারবেন।

– স…সরি মিসেস রেমান।
রমণী দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।লজ্জাবোধ স্পষ্ট তার মাঝে।
– আপনি রাগ করবেন না আরিয়া,মিস্টার নীল অবশ্যই সুন্দর,নিজের অনন্য বৈশিষ্ট্যে তিনি সুন্দর কিন্তু…
– যদি কিন্তু বলে কিছু নেই এখানে।আমার স্বামী সুন্দর কি সুন্দর না সেই নিয়ে আলোচনায় ইচ্ছুক নই আমি।আপনাদের তাকে বীভৎস লাগতেই পারে, অন্তরমাত্রই সৌন্দর্যের দাস। এতে দোষের কিছু নেই।শুধু দোষটা তখনি হয় যখন কথার ভাঁজে আকারে ইঙ্গিতে আপনারা কারো অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চান জোরপূর্বক যে সে জীবনে ভুল করেছে, সৌন্দর্য্য লাভ করতে পারেনি।
নৈঃশব্দ্য।কেউই রোযার মোকাবেলা করার মতন যুক্তি কিংবা শক্তি খুঁজে পাচ্ছে না।এক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকলো রোযা।অন্তিম বারের মতন জানালো,

– আর রইলো বাকি আমার কাছে নীলের রূপের গ্রহণযোগ্যতা…. ও আমার চাঁদ।
চোখ তুলে তাকালো সবাই।
– জীবনে চাঁদকে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই।আপনারাও অহেতুক আফসোস করে নিজেদের আবেগ খরচ করবেন না।

এটুকুই।উল্টো ঘুরল রোযা। শাড়ির আঁচল টেনে চলে গেলো টেবিলের কাছে,যেখানে বিলাল রেমান দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
কিছুক্ষণ পরেই রোযাকে চিকেন ম্যারিনেটের কাজে লাগিয়ে দিলো চারুলতা।হ্যান্ড গ্লাভস পড়ে সুন্দরমত সবকিছু মাখিয়ে নিতে নিতে হালকা কন্ঠে অন্যদের সঙ্গে গল্পে লিপ্ত হলো সে।তার এবং চারুলতার বয়সী কয়েকজন মেয়ে আছে এখানে, ভালোই জমেছে আড্ডার আসর।ঘনিয়ে আসা সান্ধ্য বায়ুতে ক্ষণে ক্ষণে রোযার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।হাত কাজে আবদ্ধ থাকায় বাহু ব্যবহার করে তা সামলিয়েছে সে।কিন্তু ক্রমান্বয়ে অসহ্য হয়ে উঠলো।কাজের সময় ঢং না দেখিয়ে আসলে চুলগুলো বেঁধে নেয়া দরকার ছিলো।নিজের উপরই ক্রোধান্বিত হয়ে রোযা মশলা মাখা গ্লাভসেই কপাল ডলতে যাচ্ছিল ঠিক ওই মুহূর্তেই নিজের পিছনের শূন্যতার শীতলতা হঠাৎ করেই উষ্ণতায় পরিবর্তিত হতে অনুভব করলো।

আসমান!ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে।
চট করে ঘুরতে গেলেও পারলোনা রোযা।এর পূর্বেই আসমানের একটি হাত জড়িয়ে গেলো তার চুলে।লম্বাটে আঙুল বুলিয়ে চললো একেবারে গোড়া পর্যন্ত, চিরুনীর ন্যায়।সম্পূর্ণ স্থির হয়ে পড়ল রোযা।শিরশিরে আবেশে পরিপূর্ণ হলো তার সর্বাঙ্গ।আসমান নিঃশব্দে তার চুলগুলো গুছিয়ে নিলো।অতঃপর খোঁপা পাকিয়ে শিক কাবাবের জন্য আনা কাঠির বান্ডিল থেকে একটি টেনে নিয়ে গুজলো চুলে।শক্তভাবে আটকে দিলো খোঁপা,যেন না খুলে যায় সহজেই।আচমকাই পিছনে ফিরল রোযা,দৃষ্টিতে তার একঝাঁক তারকা।

– ধ…ধন্যবাদ।
– হুম।
উল্টো ঘুরলো আসমান,প্রস্থান করলো।পুনরায় কাজে ফিরলো রোযা,অনুভব করলো তার হৃদয়ে দুর্বার সুনামির প্লাবন উঠেছে।
– ওহো!আমাদের দুলাভাই দেখছি হেব্বি রোম্যান্টিক! খোঁপাও বেঁধে দেয় বউয়ের!
– এমন জামাই না পেলে আমি সারাজীবন কুমারী থাকবো!
মেয়েরা হাসাহাসিতে মাতলো,অপরদিকে লজ্জার পাশাপাশি ভালো লাগার তীব্র আবেশ ঘিরে ধরলো রোযাকে।আসমান কাজটা কেনো করেছে জানা নেই।সত্যি বলতে তার নিকটে এমন কিছু আশা করাও দুরূহ।তবুও কার্যক্রমটি রোযার অবাধ্য অন্তরে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে ক্ষীণ।

রাত্রি নেমেছে চারিদিকে।বার্বিকিউ পার্টির সমাপ্তি ঘটেছে বেশ ভালোভাবেই।এই মুহূর্তে গানের আসর জমিয়েছে ছেলে মেয়েরা।গুরুজনেরা আলাদাভাবে বসে নিজেদের ব্যবসা কিংবা রাজনীতি নিয়ে গুরুগম্ভীর আলাপে মেতেছেন।চারু নিহাদ উভয়ই গানের দলের সঙ্গী।বেশ উপভোগই করছে তারা সময়টাকে।সবাই রয়েছে,একমাত্র আসমান ব্যতীত।সে যেন এখানে থেকেও নেই।এমনি এক ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন তার অবয়ব।রোযা নিজেকে দূরে সরিয়ে খোঁজ লাগালো তাকে খুঁজতে।খুঁজে পেলোও, সেই পুরোনো জায়গাতেই।জলপাই গাছের নিচের বেঞ্চে।তবে এবার সাথে রুহি নেই,একলাই বসমান।
নীরবে এগিয়ে বেঞ্চে তার পাশের স্থানটি দখল করলো রোযা।আসমান একবার ফিরে চাইলো,কিন্তু কিছুই বললোনা।পুনরায় দৃষ্টিপাত ঘটালো সুদূর দিগন্তের দিকে,যেখানে উদীয়মান একফালি চাঁদ।তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো রোযা।

– চাঁদ কি সুন্দর না?
– হুম।
– ঠিক তোমার মতন।
দৃশ্যমানভাবে চমকালো আসমান,তবে ফিরে তাকালোনা।শীতের কারণে নিজের অজান্তেই তার আরেকটু নিকটে ঘেঁষে বসলো রোযা,উষ্ণতার আশায়।ইচ্ছা হলো ছুঁয়ে দিতে ওই অবয়বকে,তবুও দিলোনা।
– একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
– হুম?
– তুমি তো আমাকে আর কোনো কাজে যুক্ত করলে না?তোমার পরবর্তী কোনো পরিকল্পনা নেই?
এবার রোযার দিকে তাকাতে একপ্রকার বাধ্য হলো আসমান।নির্বিকার দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো,

– তুমি নিজেকে ব্যবহার করতে বড্ড উদগ্রীব মনে হচ্ছে?
– উম…আমি সেটা বলিনি।শুধুমাত্র জানতে চাইছিলাম আরকি।নিশ্চয়ই তোমার উদ্দেশ্য এখনো পর্যন্ত সফল হয়নি।তবে কি বিরতি দিয়েছো?
– সব জেনেও না জানার ভান কেনো করছো?
– কি জানি আমি?
– ঐযে বললাম…সব!
একটি ঢোক গলাধঃকরণ করলো রোযা।আসমানের কন্ঠ ক্রমেই কঠোর হতে কঠোরতর হয়ে উঠছে।কিভাবে তার সঙ্গে বাক্য বিনিময় করবে তা বোধগম্য হচ্ছে না।এই পুরুষটির প্রতি নিহিত অনুভূতি নিশ্চিত হওয়ার পর আরো অধিক বিহ্বল লাগছে নিজেকে।একটি চাপা আতঙ্ক কাজ করছে হৃদয়জুড়ে।

– তোমাকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে রোযা।তারপরও…
– ওহ মনে পড়েছে!
চিন্তাযুক্ত বাক্যগুলো এড়াতে রোযা দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে ব্রেসলেটের প্যাকেটটা বের করলো।হৃদযন্ত্র তার ছুটছে দ্রুত অশ্বের গতিতে।শীতল হাওয়ায়ও কপালে জমাকৃত হয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।খানিক কম্পিত হাতেই আসমানের দিকে বাড়িয়ে দিলো সে উপহার।
– ওই…সেদিন মলে দেখেছিলাম…ভালো লেগেছিল তাই ভাবলাম… তোমার হাতে সুন্দর লাগবে।
প্যাকেটটা নিলো আসমান,সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে নিয়ে অধীর হয়ে অপেক্ষমান রইলো রোযা।প্যাকেট খুলে ভেতরের ব্রেসলেটটি হাতে নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো আসমানের নিগূঢ় দৃষ্টি,ক্রমেই কুঞ্চিত হয়ে উঠল তার ভ্রুজোড়া।কি ভাবছে তা বোঝা সম্ভব হলোনা।দ্বিতীয় ঢোক গিলে রোযা বিড়বিড় করে শুধালো,

– তোমার পছন্দ হয়নি?
উত্তরে ব্রেসলেটটি পুনরায় প্যাকেটে ভরে বেঞ্চে উভয়ের মাঝে রাখলো আসমান।অনুভূতিহীন কন্ঠে জানালো,
– আমি ব্রেসলেট পছন্দ করিনা।
রোযার মনে হলো কেউ যেন তার হৃদয়টাকে এক লহমায় নিংড়ে সকল অনুভূতি শুষে নিয়েছে।মাথা ঝুলে পড়লো তার।হতাশা দৃশ্যমান হলো সম্পূর্ণ চোখেমুখে।
– ওহ।
এটুকুই উচ্চারণ করা সম্ভব হলো।কেন যেন আসমানের পাশে বসে থাকাও বর্তমানে অসহনীয় ঠেকছে।ইচ্ছা হলো ব্রেসলেটের প্যাকেট ছিনিয়ে একটি ছুট দিয়ে পলায়ন করে।কিন্তু সেটি সম্ভব হলোনা।হিম পবনের প্রবাহ এড়িয়ে উঠে পড়লো সে বেঞ্চ থেকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো,উদ্দেশ্য অধিক বিরক্তির জন্ম না দেয়া।

– রোযা….
ওই বজ্রসম কন্ঠে নিজের নামটি শ্রবণ হতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে থমকে পড়লো পদক্ষেপ।না চাইতেও ফিরে তাকাতে বাধ্য করলো বেহায়া অন্তর।দৃষ্টি মেলালো এক সুগভীর গহ্বরের আঁধারমাঝে।বরাবর তার নয়নে তাকিয়ে রয়েছে আসমান।দীর্ঘ এক মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়।অতঃপর ধ্বনিত হলো,
– ডু ইউ লাইক মি?
ব*জ্রাহত হলো রোযা, শাড়ির আঁচলে আঙুল চেপে তাকিয়ে থাকলো,সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালালেও আসমানের অভিজ্ঞ নজর এড়ালোনা তার তরে বিছানো সহস্র অনুভূতিমালা।
মাথা নিচু হলো আসমানের,উভয় হাতে চেপে ধরে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।দৃশ্যটি অবলোকনের সাহস হারিয়ে উল্টো ঘুরে খানিক ছুটেই নিজেকে আড়াল করলো রোযা।ধিক্কার জানালো নিজের অস্তিত্বকে।

নিজের সর্বপ্রথম প্রেমানুভূতিকে রোযা ঘৃণা করতে আরম্ভ করলো ঠিক পরদিনই।যখন পেন্টহাউজের কিচেনে সে আবারও মুখোমুখি হলো অনুভূতিহীন মেশিন আসমানের।সকাল সকাল মাথাব্যথার উপশমে এক কাপ চায়ের দ্বারস্থ হয়েছিল। চুমুক দিতেই আসমানের কণ্ঠে চমকে উঠতে বাধ্য হলো।
– নিহাদ আগামীকাল চলে যাচ্ছে।
লাফিয়ে কাউন্টার থেকে নেমে পিছনে তাকাতেই দ্বিতীয় দফায় তাকে শুনতে হলো,
– তুমিও ওর সাথে যাবে।
জমে গেলো রোযা সম্পূর্ণ।অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকলো সামনে।ভ্রুক্ষেপ নেই আসমানের, এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে একটি জুসের বোতল বের করলো।বহু কষ্টে কম্পিত কন্ঠে রোযা শুধালো,

ডার্কসাইড পর্ব ৩০

– ম…মানে?
তার মুখোমুখি হলো হিমশীতল হিমালয়।নির্বিকার কন্ঠে ঘোষণা করলো,
– আমাদের চুক্তি এখানেই সমাপ্ত….রোযা।
তীরের ফলায় ক্ষ*ত বিক্ষ*ত হৃদয়ে র*ক্তক্ষরণ ঘটিয়ে পুনর্বার ধ্বনিত হলো,
– আমার জীবনে তোমার আর কোনো প্রয়োজন নেই।

ডার্কসাইড পর্ব ৩২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here