ডার্কসাইড পর্ব ৩৩
জাবিন ফোরকান
দিবাকরের স্নিগ্ধ ছাও বিছিয়ে শহরে নেমেছে আরো এক মনোমুগ্ধকর বিকেল।শীতের আমেজে জমজমাট অনুভূতিতে পরিপূর্ণ আবহাওয়া।সড়কের মোড়ে মোড়ে বিক্রিত পিঠাপুলির ঘ্রাণ, ভিড় উষ্ণ পোশাকের দোকানজুড়ে। নগরবাসী ব্যাস্ত শীতকে আমন্ত্রণ জানানোয়। শিক্ষার্থীরা ছুটছে কোচিং সেন্টার থেকে টিউশন টিচারের বাড়িতে,বার্ষিক পরীক্ষার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণে।অক্টোবর এক দারুণ আবহ এবং ব্যাস্ততাপূর্ণ মাস।ছুটির অবকাশ নেই,তবুও শীতের আনন্দ বুকে, সামনের অবসরের দিনগুলোর কথা ভেবেই হৃদয় জুড়িয়ে আসে।
“ ক্যাফে লো-ফাই ”—জুড়ে ক্যাপুচিনো এবং এসপ্রেসোর সুস্বাদু সুতীব্র ঘ্রাণ,যার সঙ্গে জুড়েছে শীত উপলক্ষে পরিবেশনকৃত পাটিসাপটা, ভাঁপা, পুলির বহর।এক হাতে হট চকলেট অপর হাতে দুধপুলির ট্রে নিয়ে তরতর করে অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে রোযা।উইমেন্স জোনের তিন নম্বর টেবিলে তা পরিবেশন করে মিষ্টি হেসে সে কাস্টমারদের উদ্দেশ্যে জানালো,
– এনজয় ইওর অর্ডার ম্যাম।
– থ্যাংক ইউ।
হেসে স্বাগতম জানালো বান্ধবীদের দল।পুনরায় এগিয়ে গেলো রোযা।কিচেনের শেফের কাছ থেকে নতুন অর্ডার সংগ্রহ করে চললো অপর একটি টেবিলের দিকে।পঞ্চম টেবিলে বিল দেয়ার পর অভিজাত রমণী তার উদ্দেশ্যে একটি দুইশো টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– তোমার সার্ভিস আমাদের দারুণ লেগেছে।
– না না ম্যাম,এর কোনো প্রয়োজন নেই।
– প্রথম কাউকে দেখলাম যে টিপকে না করছে।
– সমস্যা নেই ম্যাম, আপনারা খুশি হয়েছেন এই অনেক।আবারো আসবেন নিশ্চয়ই,আপনাদের স্বাগতম জানানো হবে।
– ইউ আর ভেরি সুইট।
হাসলো রোযা। রমণীগণ টেবিল ছাড়তেই সে সবকিছু সুন্দর করে গুছিয়ে আবারো চললো কিচেনে, ঠিক তখনি পথিমধ্যে মুখোমুখি হলো গোলাপী বর্ণের উইমেন্স স্যুট পরিহিত তরুণীর।তার উপস্থিতি এক ভিন্ন ধরণের আভিজাত্য প্রকাশ করে।রোযা থমকালো, হেসে মাথা হেলিয়ে বলল,
– ওয়েলকাম বস।
– হুম, নিজেকে খুব ভালো মানিয়ে নিয়েছ দেখছি।
বুকে দুহাত ভাঁজ করে রোযার দিকে চেয়ে বললো ফারিয়া, চারুলতার বান্ধবী।অতঃপর আশেপাশে তাকালো, ক্যাফের চারিদিকে নজর বুলিয়ে এনে মৃদু হেসে দ্বিতীয় দফায় জানালো,
– একটা উপদেশ দেই,টিপকে কখনো না করোনা।
হালকা চোখ টিপে কৌতুক ভঙ্গী করে ফারিয়া রিসিপশনের দিকে এগোলো।রোযা কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে আপনমনে হাসলো,তারপর এগোলো নিজের কাজগুলো সমাপ্ত করতে।
ক্যাফের শিফট শেষ করতে করতে গোধূলী বেলা এলো।ইউনিফর্ম খুলে নিজের পোশাক বদলে রোযা যখন বাইরে বেরোলো তখন মৃদু কুয়াশায় আচ্ছন্ন হতে আরম্ভ করেছে চারিপাশ। ব্যাস্ত সড়কের একপাশ ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলো সে,নিজের আপন নীড়ের উদ্দেশ্যে। মস্তিষ্কজুড়ে অবাধ্য চিন্তারা ঘুরপাক খেয়ে চলেছে আনমনে।
পেরিয়েছে সপ্তাহ দুই।অক্টোবরের প্রথমাংশ শেষ অংশে এসে গড়িয়েছে।অদ্ভুত হলেও সত্যি এই কয়দিনে রোযার জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে।কি সেই পরিবর্তন?ধারণা নেয়া যাক।সর্বপ্রথম নিজেকে ওয়াদা করেছে রোযা,অতীত কখনো ভুলবে না।কিন্তু সেই অতীতের বিষাদও গায়ে মাখবেনা।বরং হাসবে।যতটা সম্ভব হাসবে,হাসিখুশি থাকবে,নিজের জন্য বাঁচবে,এগিয়ে যাবে,সব না পাওয়া পূরণ করবে।নিজের এই স্বাধীনতা উপভোগ করবে যতটা সম্ভব।রোযা কাঁদেনি,প্রত্যাখ্যান স্মরণ করেও নয়।বরং মারবেল ভবনের স্মৃতিগুলো তার খুশির খোরাক।নস্টালজিক এক অনুভূতির কারণ।
প্রথমে একটি গার্লস হোস্টেলের গণরুমে উঠেছিল সে, কয়েকদিনের জন্য।পকেটে ছিল মোটে ১৮৩০ টাকা।কোনমতেই সম্ভব ছিলোনা।১০ হাজার ধার নিয়েছিল নিহাদের থেকে, তা দিয়ে চলেছে তিনদিন।চার দিনের দিন চারুলতার বান্ধবী ফারিয়ার ক্যাফেতে তার কাজ হয়ে যায়।বেতন ১২ হাজার ধরা হয়েছে আপাতত।খুব বেশি নয়,তবুও রোযার জন্য মোটামুটি যথেষ্ট।হোস্টেল ছেড়ে একটি আলাদা বাসা নিয়েছে।বাড়িটি তার বাল্যকালের এক বন্ধুর,যে বর্তমানে সম্পূর্ণ পরিবারসহ আমেরিকায় সেটেলড।ঢাকার বাড়ি দেখাশোনার লোকের প্রয়োজন ছিলো।খানিক দৈবিকভাবেই রোযার সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার,বাড়িটি দেখাশোনার বিনিময়ে রোযার মাথা গোঁজার মতন একটি দুই রুমের ছোট্ট বাসার ব্যবস্থা হয়েছে। ভাড়া যদিও প্রচুর, তবুও তার কাজের বিনিময়ে কমিয়ে ধরা হয়েছে যা বহন করা সম্ভব।বাড়িটির বিভিন্ন সময়ের কাজ, ভাড়াটিয়াদের ভাড়া নেয়া,ইলেক্ট্রিসিটি গ্যাস বিল ইত্যাদি ইত্যাদি তাকে দেখাশোনা করতে হয়।
নতুন করে পড়াশুনা চালুর উদ্যোগও নিয়েছে রোযা। খুঁজেপেতে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বের করেছে যেখানে ৪ বছর পর্যন্ত স্টাডি গ্যাপ দিয়ে অনার্স ডিগ্রি অর্জন সম্ভব।রোযা গতকালই মাত্র দরখাস্ত জমা দিয়েছে,তার স্টাডি গ্যাপ পড়েছে তিন বছর,দাদুর অসুস্থতা এবং পারিবারিক অক্ষমতার কারণ দর্শিয়ে করা আবেদন গৃহীত হলে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে সেমিস্টার শুরু হবে তার।এখন থেকেই পড়ালেখার খরচ বহনের জন্য তাই অর্থ জমানো শুরু করেছে।কতটুকু সম্ভব হবে জানেনা,কিন্তু এটুকু জানে সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে,জীবনে কোনো আফসোস রাখবেনা। যদি ভাগ্যে নাও হয়,তার হৃদয় জানবে, শেষ পর্যন্ত চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল সে।
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্যাফে,বাসায় ফিরে নিচের তলার ক্লাস এইটে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর টিউশন, রাতে ফাউন্টেন পেনের গল্প লিখা এবং এডিটের কাজ সাথে হালকাপাতলা পড়াশুনা।এভাবেই কেটে যাচ্ছে রোযার জীবন।সত্যিকার অর্থে খুব একটা খারাপ নেই সে।নিজেকে ধীরে ধীরে গুছিয়ে এনেছে অনেকখানি, যা কিছুদিন আগেও তার কাছে ছিল অকল্পনীয়।অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা কমে এসেছে,ঘৃণ্য কাজ থেকে নিজেকে অবমুক্ত করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে,কম কি?ভালোই তো আছে সে এই একলা জীবনে।
আজ স্টুডেন্টের জ্বর উঠেছে,তাই টিউশন আরেকদিন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রোযা দুইতলায় নিজের বাসায় এলো। বাড়িওয়ালা নিজেরা থাকার জন্য বিশাল স্থানে তৈরি করেছিল,যার দুই তৃতীয়াংশজুড়ে তাদের দেশে ক্রয়কৃত বিভিন্ন মালপত্র বোঝাই।রোযার থাকার জন্য দুটো রুম,একটি কিচেন,বাথরুম এবং বিশেষ অনুরোধে বারান্দাটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তালা খুলে ভেতরে ঢুকে ব্যাগ রেখে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়ল রোযা।কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো চোখ বুজে।তারপর উঠলো।বাথরুমে গোসল সেরে ঘরের পোশাক পরে এলো।প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে,চাইলে ক্যাফেতে কিছু খাওয়া যেতো।কিন্তু বেশিরভাগই মিষ্টান্ন,ঝাল কিছু দরকার।সকালে রান্না করা ভাত রয়েছে। পিয়াঁজ মরিচ কেটে ভাজি করে নেয়া যায়। যেই ভাবা সেই কাজ।লেগে পড়লো কাজে। ভাঙারির দোকান থেকে অতি কম দামে ক্রয় করা আধভাঙা কড়াই চুলায় চড়িয়ে তাতে তেল ছিটিয়ে মশলাপাতি ঢেলে নাড়তে নাড়তে ভাবনার ভুবনে হারিয়ে গেলো রোযা।
দৃষ্টিতে অতর্কিতে ভেসে উঠলো পেন্টহাউজের কিচেন।যার কাউন্টারে অ্যাপ্রোন পরিহিত অবস্থায় দাঁড়ানো তার হৃদয়রাজ।দক্ষ হাতে চপিং বোর্ডের উপর কুচিকুচি করে নিচ্ছে সবজি, প্যানে তেল ছিটিয়ে তাতে একে একে সকল উপকরণ যুক্ত করছে।সুঘ্রাণে সম্পূর্ণ বায়ু এক লহমায় সুস্বাদু আবহে পরিপূর্ণ হয়েছে।চেয়ে আছে রোযা,একদৃষ্টে।ওই শুভ্রতা কাজে ব্যাস্ত,যে ব্যাস্ততার উপর হতে নজর ফেরানো দায়। আনমনে তুলেছে রোযা নিজের জীর্ণ ফোনখানা,নিঃশব্দে সংগ্রহ করে নিয়েছে একটি ছবি, স্মৃতি হিসাবে।অতঃপর যতবার এই ফোন হাতে উঠেছে, ততবার অবলোকন করেছে। লক স্ক্রিনের ওয়ালপেপারে দাদু,এবং অ্যাপসে ভাসমান ওয়ালপেপারে স্থান করে নিয়েছে আসমান।তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইজন মানুষ,সবচেয়ে ভালোবাসার দুই অস্তিত্ব।
পোড়া পোড়া গন্ধে চিন্তার জগতে ছেদ পড়লো।পিঁয়াজ কালচে হয়ে এসেছে।নিজের মাথা চাপড়ে রোযা আঁচ কমিয়ে দ্রুত ভাতটুকু ঢেলে দিয়ে নেড়েচেড়ে নিলো,ঠোঁটে ফুটলো এক অনবদ্য হাসির ধারা।সেদিন আসমানের রুমের বারান্দায়ই অন্তিম সাক্ষাৎ হয়েছিল তাদের।এরপর সাক্ষাৎ দূরে থাক সামান্যতম কথা কিংবা মেসেজের বিনিময় পর্যন্ত হয়নি।আসমানের নাম্বার নেই তার কাছে,থাকলেও কখনো কি যোগাযোগের চেষ্টা করতো?হয়ত।এই অন্তর যে বড়ই বেহায়া!নিহাদ এবং চারুলতা অবশ্য কয়েকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, এবং বিলাল রেমানের একটিমাত্র মেসেজ এসেছিলো তার ইনবক্সে।
“ এমনটা না করলেও পারতে মামণি।আমাকে একটিবার বললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?”
এটুকুই।যদিও নাম ছিলো না,তবুও বুঝতে বেগ পেতে হয়নি।রিপ্লাই করার দুঃসাহস হয়নি রোযার,অবাধ্য দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয়েছিল বক্ষ হতে।
খাবার তৈরী।প্লাস্টিকের টেবিলে বসে বাটিতে করে তা নিজেকেই নিজে পরিবেশন করলো।চেয়ার টেনে বসলো।কিন্তু গ্রাস মুখে তুলতে পারলোনা। হুট করেই কান্নার দমক উঠলো।একাকী সে,কেউ নেই তার সঙ্গে।এখানে যদি সে মৃ*ত্যুবরণও করে অতর্কিতে,দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার আগে কেউ টের পাবেনা।আগামীকাল সন্ধ্যায় টিউশনে না গেলে হয়ত স্টুডেন্ট খোঁজ নিতে আসবে,তখন আবিষ্কার করবে তার অবস্থা।এই পৃথিবীর বুকে সে সম্পূর্ণ একা।কেউ নেই!একলা পথের পথিক,অজানা যার গন্তব্য।
দ্রুত অশ্রু মুছে নিয়ে দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করলো।মাথা ঝাঁকালো সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে।মুষ্টিবদ্ধ করলো হাত।
“ রোযা!নিজেকে শক্ত কর।তুই না নিজেকে কথা দিয়েছিস আর কখনো কাদবি না?শুধু হাসবি, খুশি থাকবি।তুই মুক্ত স্বাধীন বিহঙ্গ।তোর স্বপ্ন, শখ তোর আয়ত্বে।পূরণ করবি সব একে একে। বিন্দু বিন্দু থেকে সৃষ্টি হবে সিন্ধুর।এই মুক্তি বিরহের নয়,আনন্দের।এবং তোর হৃদয়রাজের প্রত্যাখ্যান বিচ্ছেদ নয়,নতুন সূচনার অধ্যায়।”
মাথা চেপে ধরে নিজেকে স্থির করে খাবারে মনোযোগ দিলো সে।ইউটিউবে ডোরেমন দেখতে দেখতে অর্ধেক সমাপ্ত হয়েছে,এমন সময় অজানা এক নাম্বারের কলে উদ্ভাসিত হলো ফাটা স্ক্রিন। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে তারপর ফোন রিসিভ করলো রোযা,
– আসসালামু আলাইকুম।কে বলছেন?
নৈঃশব্দ্য।
– হ্যালো?
যথারীতি নীরবতা।রোযা ফোন ঝাঁকালো কয়েকবার, সমস্যা করছে নাকি?
– মিস্টার কিংবা মিসেস আপনি কি কথা বলতে ইচ্ছুক নাকি আমার কন্ঠস্বর শুনতে ফোন করেছেন?
এবারেও কোনো শব্দ নেই। ভীষণ বিরক্ত হলো রোযা।
– দেখুন এমনিতেও খাওয়ার মাঝখানে বাগড়া দিয়ে মেজাজ চড়িয়ে দিয়েছেন,এখন যদি বাক প্রতিবন্ধীর মতন নিশ্চুপ থাকেন আর আমি রাগে আছাড় দিয়ে এই ফোন ভাঙি তাহলে কিন্তু আপনার থেকে আইফোন সিক্সটিনের টাকা আদায় করে ছাড়বো বলে দিলাম!
মৃদু হাসির আওয়াজ,অতি মৃদু। অতর্কিতেই থেমে গেলো তা।এক মুহুর্ত কেন যেন স্তব্ধ হয়ে থাকলো রোযা।তারপর মাথা ঝেড়ে বললো,
– সে আপনি চুপ থাকলে আমার কি?আপনি কল করেছেন আপনারই পয়সা যাচ্ছে। কলরেট হাতির মতন মোটা এবং সিগন্যাল জিরাফের গলার মতন সরু।আপনার বাপ দাদার পয়সার অভাব নেই মনে হচ্ছে। তা বলছিলাম এই নাম্বারে কল না দিয়ে কিছুটা পয়সা পাঠিয়ে সারপ্রাইজ দিলেও তো পারতেন।
ওপাশ থেকে খুব সম্ভবত মিউট করে দেয়া হয়েছে, সামান্যতম ধ্বনিও শ্রবণ হচ্ছেনা।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোযা চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো,
– টাকার কথা উঠতেই গায়েব, হাহ।যাক গে, আপনার যদি রাত বিরাতে মেয়েমানুষকে ফোন দিয়ে প্রেম পিরিতের আলাপ করার শখ হয়ে থাকে তাহলে জানিয়ে দিচ্ছি আমি বিবাহিতা।আমার স্বামী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের অফিসার আসমানুর রেমান।আপনার এই নাম্বার পেলে এক চুটকিতে পুরো দাদা নানা চোদ্দ চোদ্দ আটাশ গুষ্টির বায়োডাটা বের করে ফেলবে।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা পিছে লাগুক না চাইলে ব্লক দেয়ার পরেও ভিন্ন নাম্বার থেকে কল বা মেসেজ করবেন না।ধন্যবাদ।
কেটে দিলো রোযা ফোন।একটি নিঃশ্বাস ফেললো। হুট করেই তার হাসি আসছে।বেশ মজা নিয়েছে ওপাশের ব্যক্তির সঙ্গে।মাথা ঝেড়ে নিজের খাবারে মনোযোগ দিলো আবার।
মারবেল ভবন।
বিপ বিপ শব্দে ফোন কেটে যেতেই ফ্যালফ্যাল করে ৬.৭ ইঞ্চির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলো আসমান।কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে গেলো নীরবতায়।ধীরে ধীরে সেলাইয়ের দাগ সংলগ্ন অধরে প্রস্ফুটন ঘটলো বিস্তৃত হাসির কুঞ্চনের।
– আসমানুর রেমান…
আপনমনে বিড়বিড় করে মাথা নাড়লো,পরক্ষণেই সম্পূর্ণ স্থির হয়ে পড়লো। ঘন ভ্রুজোড়া ধারণ করলো বাঁকানো প্রতিক্রিয়া।যেন নিজেকেই নিজে ধিক্কার জানাচ্ছে।ভিন্ন একটি নাম্বার ডায়াল করলো দ্রুতই।উত্তর এলো তৃতীয় রিং পড়বার পর।
– ক্যাফে থেকে সাবধানেই ফিরেছে।এখন বাসায়।আর কিছু জানার আছে?না মানে একেবারে বাসায় ঢুকে যাই?জিজ্ঞেস করে দেখি ঠিক আছে কিনা। দেখবো?
– নিহাদ, বরফ নিয়ে এসো, ধোলাইয়ের পর ঘষতে কাজে লাগবে।
– ওম্মারেম্মা হন মুসিবতে ফরিলাম!ইতেরা থাহে টেকনাফ এদ্দে তেঁতুলিয়া, মাঝদ্দি ফরি আঁর কুয়ালত দুক বেগ্গিন!মশা ইন মশা নয় বাজি, জলোস্তির বাইচ্চা। হঅরাইয়েরে ডেঙ্গু ধরাই দিবু!আজাইরা![আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেলো তো!দূরে দূরে থাকে এরা আর মাঝখান দিয়ে মার খাই আমি!মশা একেকটা জলহস্তীর বাচ্চা,কামড়ে ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া বাঁধিয়ে ছাড়বে! যত্তসব!]
একটি নিঃশ্বাস ফেললো আসমান।নিহাদ এবং তার হঠাৎ হঠাৎ পিনিক দেয়া চাটগাঁ ভাষা।এই সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
– একটি ঠিকানা মেসেজ করছি চলে আসো।
– অবাজি থিয়্যা, আইয়্যির। আঁরে তোর বাফর দিইন্না হামের বেডি ফাইয়ুস দে না![দাড়াও বাবা, আসছি। বাপের দাসী বান্দি তো আমি!]
গজগজ করতে করতে জবাব এলো। আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হচ্ছিল ওপাশের বান্দা তবে সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে পকেটে ভরলো আসমান।ধূসর শার্ট পড়ে তৈরীই সে।শুধু শীতল আবহাওয়ার কারণে কালো ব্লেজারটা চড়িয়ে নিলো উপরে।নতুন মাস্ক বের করতে ক্লোজেটের ড্রয়ার খুলতেই প্যাকেটটা নজরে এলো।আনমনে হাতে তুলে নিলো, ঝাঁকি দিতেই ভেতরের বস্তুটি প্রশস্ত তালুতে এসে পড়লো।একদৃষ্টে পর্যবেক্ষণ করলো আসমান।
রেজিনের তৈরী ব্রেসলেট।স্বচ্ছতার মাঝে এক টুকরো স্নিগ্ধ প্রকৃতির সবুজলতা।তার ফাঁকে ফোকরে উঁকি দেয়া আসমানী বর্ণের পুষ্পরাজি যেন ওই অসীমতার গগনের সাক্ষী।ঠিক নিচে সংযুক্ত বিডে আধ টুকরো চাঁদ, যার শুভ আচ্ছাদনে কালচে কলঙ্কের দাগ।তবুও চমৎকার তার সৌন্দর্য্য,মনোমুগ্ধকর আবাহন।চেয়ে থাকলো আসমান,দীর্ঘক্ষণ জুড়ে।পুনরায় তা প্যাকেটে ভরতে গেলো,কিন্তু অন্তিম মুহূর্তে থমকালো।কেমন যেন অনুভূত হলো অন্তরে।ঈষৎ কম্পিত হাতে ব্রেসলেটটি ছোঁয়ালো কব্জিতে,ইতস্তত করলো বারকয়েক। অন্তিমবার মাথা ঝেড়ে হৃদয়কে বোঝালো,
– সামান্য একটা ব্রেসলেটই তো….জড়বস্তু।
মস্তিষ্ক সতর্ক সংকেত ইন্দ্রিয়জুড়ে প্রেরণ করার আগেই হৃদয়ের দ্রুততায় তা সংযুক্ত করে নিলো নিজের কব্জিতে।চিন্তা চেতনার সুযোগ এড়িয়ে মাস্ক তুলে মুখে পড়লো।উল্টো ঘুরে হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
সিঁড়ি বেয়ে নামতেই মুখোমুখি হতে হলো বিলাল রেমানের। কাউচে বসে একাকী কফির স্বাদ আস্বাদনে মগ্ন তিনি।আসমানের উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন।এক নজর তাকালেও কোনকিছু উচ্চারণ না করে আসমান এগোচ্ছিল,ঠিক ওই মুহূর্তে বিলালের নমনীয় অথচ অভিমানী কন্ঠস্বর ধ্বনিত হলো।
– মেয়েটার সঙ্গে এমন করা উচিত হয়নি।
থমকালো পদক্ষেপ,মুষ্টিবদ্ধ হলো হাতজোড়া।তবুও ফিরে তাকালোনা।নিশ্চল দন্ডায়মান হিমালয়।
– শুরুতে সন্দেহ হয়েছিল,কিন্তু পরে কেন যেন বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম। হয়ত আরো একবার সাহস করে নিজেকে বাঁধনে জড়িয়েছ।কেনো করেছিলাম বিশ্বাস?মেয়েটিকে দেখে,তার উৎফুল্লতা উপলব্ধি করে, নাকি তোমার সঙ্গে তার অব্যক্ত এক মানানসই অনুভূতি বিনিময় দেখে জানিনা।
কফির মগ সরিয়ে রাখতে রাখতে বলে চললেন বিলাল।আসমান তখনো দাঁড়ানো,পাথরের ভাস্কর্য হয়ে, সামান্যতম নড়চড় নেই।
– নতুন আশায় বুক বেঁধেছিলাম।নিজের সন্তানকে একটু সুখে দেখবো হয়ত এবার।কিন্তু….
বিলাল রেমানের দীর্ঘশ্বাসধ্বনি ভেসে এলো।তিনি উঠে দাঁড়ালেন।মাথা হেলিয়ে বললেন,
– আমি সরি।তোমার জীবন তোমার সিদ্ধান্ত। তবুও একটিবার ভেবে দেখলে হতো।মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছে।স্নিগ্ধ, দায়িত্ববান।
– আমাদের সামনের মিশনে মনোযোগ দেয়া উচিৎ বাবা।
বজ্রকণ্ঠের বিপরীতে আর কিছু উচ্চারণ করলেন না বিলাল।উল্টো ঘুরে সিঁড়ির পথ ধরলেন। আসমানও বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে রইলোনা।দ্রুত বেরিয়ে এলো বাইরে।গ্যারেজ থেকে নিজের পোর্শে বের করে বাইরের সড়কে নামার পর অনুধাবন হলো নিজের লক্ষ্যের অন্তিম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সে।সামান্যতম ভুল করারও অবকাশ নেই কোথাও।স্টিয়ারিং ঘোরাতে গিয়ে নজর আবদ্ধ হলো বাম হাতের কব্জির ব্রেসলেটে,অসম্ভব এক ভার অনুভূত হচ্ছে যেন।তবুও হতবিহ্বল হয়ে আবিষ্কার করলো এই ভার বহন করতে কুণ্ঠাবোধ হচ্ছেনা।
অতঃপর দোলাচলের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে নিলো দ্রুতই। তীক্ষ্ণ নজর সড়কে বিছিয়ে মাঝারি গতিতে এগোলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
ক্যাফে লো-ফাই।
নভেম্বরের তৃতীয় দিন।পঞ্চম ঋতুর রবি ভর দুপুরের মুহূর্তেও স্নিগ্ধ।শৈত্যপ্রবাহ আসন্ন।অতর্কিতে জেঁকে বসা হিম প্রবাহে উষ্ণ জলবায়ুতে অভ্যস্থ নগরবাসীদের খেই হারানোর জোগাড়।উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত মানুষগুলো তাও আয়েশে কিংবা পর্যাপ্ত আয়োজনে শান্তিতে রয়েছে।কিন্তু নিম্নবিত্ত বানভাসী মানুষগুলোর রাত্রি পার হয় পাতলা ছেড়া চাদরের অন্তরালে ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুমিয়েও থরথর করে কেঁপে।নগরের একদিকে পিঠাপুলি,উৎসব,তাজা শাকসবজির আনন্দ;অপরদিকে হিমশীতল দীর্ঘশ্বাস।
লাঞ্চ ব্রেক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের। ক্যাফের কর্মচারীদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করে বিরতির সময় আলাদা করে দেয়া হয়েছে,এক দল বিশ্রামের সময় অন্য দল কার্যক্রম সামলায়। দারুণ কার্যকরী এক ব্যবস্থা।দুপুরের দিকে সাধারণত অভিজাত ক্যাফেতে খুব একটা ভিড় থাকে না,নেহায়েত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের বন্ধুদল ব্যতীত।মূল ক্যাফেতে তাদেরই কলরব ভাসছে।পাশের কর্মচারীদের রুমে তেমন ব্যস্ততা নেই।
মাঝখানের দিকের একটি টেবিলে বসে দ্রুত খাবার গিলছে রোযা।টিফিন বক্স আজ বাসা থেকেই তৈরি করে এনেছে।কাজের ফাঁকে ভারী খাবার খেতে ইচ্ছা হয়না।তাই পাউরুটি জ্যাম এবং আলুর পুরের ঝালপুলি এনেছে। জ্যামে আবদ্ধ দুটি পাউরুটির স্যান্ডউইচের অর্ধেকটা ছিঁড়ে সম্পূর্ণ মুখে ভরে গাল ফুলিয়ে চিবুতে চিবুতে বিপরীত প্রান্তে বসে থাকা মানুষটির দিকে তাকালো।একটি মিন্ট লেমনেডে পাইপ ডুবিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে,পাইপের প্রান্ত ঠোঁটে সংযুক্ত।
রোযার দিকে চেয়ে নিহাদের অধরে হাসি ফুটলো, কানের দুলজোড়া ঝাঁকিয়ে মাথা হেলিয়ে তাকালো সে,
– পটকা মাছ চেনো?
– উম?
মুখভর্তি খাবার থাকায় স্পষ্ট জবাব দেয়া সম্ভব হলোনা রোযার পক্ষে।নিহাদ হাত বাড়ালো,তার ফোলা দুগালে চাপ দিয়ে তীর্যক হাসি নিয়ে জানালো,
– তোমাকে একদম পটকা মাছের মতন লাগছে ফুলটুশী।
– ইহ!
ঝটকা দিয়ে নিহাদের হাত সরিয়ে নিজের হল ঘষে বাকি অর্ধেক মুখে দিলো,এবারও সম্পূর্ণ একসঙ্গে, পটকা মাছের তকমার পরোয়া করলোনা।
– আরে চিল চিল।আমি তোমার খাবার টেনে নিয়ে যাবো না ওকে?যদি না সুস্বাদু হয়ে থাকে…দেখি দেখি…
রোযা খামচে ধরার আগেই টিফিন বক্স থেকে একটা ঝালপুলি তুলে মুখে পুরে ফেললো নিহাদ,চিবুতে চিবুতে ভ্রু দুলিয়ে বললো,
– নট ব্যাড,খানিকটা চিকেন কিংবা বিফ দিলে ভালো লাগতো বেশি।
– হ্যাঁ, মুরগী ১৯০ আর গরু ৮০০ টাকা কেজি।তোমার মতন রাজযোগী তো আমি!আলু দিয়েছি এই বেশি, কয়েকদিন পরে শুধু আটার দলা পাবে,তারপর চিপসের প্যাকেটের মতন বাতাস!
– তুমি থাকতে গরুর কি দরকার ফুলটুশী?আয়নায় তাকিও,পুরো হৃষ্টপুষ্ট একটি গাভী!
– আর তুমি একটা থলথলে মহিষ!
সঙ্গে সঙ্গে একটি চাটি খেলো নিহাদ কাধ বরাবর।খিলখিল করে হাসতে থাকলো।রোযা কিছুক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরে সোজা হয়ে বসলো।বোতল থেকে খানিকটা পানি পান করে তারপর নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটি খাম বের করলো।নিহাদের দিকে এগিয়ে দিলো,
– এই নাও।এখানে পাঁচ হাজার আছে।বাকি পাঁচ আগামী মাসে দেবো।খবরদার ইন্টারেস্ট চাইলে ঠুসা দিয়ে চেহারার মানচিত্র পাল্টে দেবো!
– এইজন্য এত জরুরী তলব বুঝি?খুব স্বাধীনচেতা মেয়েমানুষ হয়ে গেছ এখন না?
– স্বাধীনচেতা হয়েছি কিনা জানিনা,তবে দায়িত্ব পালন করতে শিখেছি, বাঁচতে শিখেছি নতুনভাবে।
খানিক হেসেই জবাব দিলো রোযা। খামটি পকেটে চালান করলো নিহাদ,জানে অস্বীকার করে লাভ নেই, কিছুতেই তার ধার শোধ না করে ছাড়বেনা।
– এই লেমনেডের বিলটাও তাহলে নিজের ট্যাক থেকে ঢেলে প্রমাণ করে দাও তুমিই নারী, তুমিই কালনাগিনী!
– তোমার কাছ থেকে এই ড্রিঙ্কসের দ্বিগুণ দাম নেবো, আমার টিপসহ!
হাসলো নিহাদ,সুরুৎ করে চুমুক দিলো পাইপে।কয়েক মুহূর্ত প্রশান্তিকর নীরবতা।আশেপাশে শুধুমাত্র গুটিকয়েক কর্মচারীদের উপস্থিতি,আলাপ আলোচনার মৃদু ধ্বনি।অতঃপর রোযার কিঞ্চিৎ গভীর কণ্ঠস্বরে নিহাদের হৃদয়মাঝে বিষাদ ছেয়ে গেলো।
– আসমান কেমন আছে?
দাঁতে ওষ্ঠ চেপে ধরে নিজের অভিব্যক্তি অপরিবর্তিত রাখলো নিহাদ।জানালো,
– আছে।যেমন থাকার তেমনি।
– তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
– হুম।দুইবার।
– কে বি গ্রুপের খবর?
রোযাকে কিছু না জানানোর উপর কোনোপ্রকার নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি।সূচনা থেকেই সে যুক্ত ছিলো এই মহাসফরে,আসমানের খেলার গুটি হয়ে।তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার মতন কিছুই নেই।
– এই মহাযাত্রার অন্তিম ধাপে পৌঁছেছি আমরা। সাইফ হুসেইনের সমস্ত তথ্য হাতে রয়েছে।আগামীকাল রাতে ভাগ্য নির্ধারণ হবে,কে বি গ্রুপ নাকি তাদের তৈরি কি*লিং মেশিন।
নিহাদের গুরুগম্ভীর বক্তব্য রোযার অন্তরজুড়ে দুশ্চিন্তার ঝড় তুললো।তবুও নিজেকে নির্ভার প্রদর্শনের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় অতিরিক্ত কিছুই জিজ্ঞেস করলোনা।মাথা নুইয়ে বিড়বিড় করলো,
– যাই হয়ে যাক না কেনো,আসমানের খেয়াল রেখো নিহাদ।
– হাহা,চিন্তা করোনা।আসমান ভাই নিজের খেয়াল নিজে রাখতে জানে।আর আমি নিশ্চিত,সে সফল হবেই,তাকে হতেই হবে!নাহলে এই পৃথিবীর অমানুষগুলো জিতে যাবে।
– খোদা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না নিহাদ।যেকোনো উছিলায় পাপীরা ধ্বং*স হবেই,সেই উছিলা হলো আসমান।
সম্মতি জানালো নিহাদ,নিঃশব্দে।উঠলো,লেমনেড খতম হয়েছে।ওয়ালেট বের করতে গিয়েও রোযার চাহুনিতে করলোনা। অধরে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– আমি তাহলে আসলাম।
– হুম,আমারও বিরতি শেষ।কাজে ফিরতে হবে।
– সাবধানে থেকো।ভালো থেকো।
– তুমিও।
অন্তিম মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে হুট করে রোযার টিফিন বক্স থেকে এক খাবলায় তিনটি পুলি তুলে ফিকফিক করে হাসতে হাসতে নিহাদ ভেংচি কাটলো,
– গাভীদের এত খেতে হয়না,কিছুটা দান খয়রাতও করতে হয়।
– মহিষ কোথাকার!এটা দান খয়রাত হলো নাকি ছিনতাই?
জবাব না দিয়ে চোখ টিপে নিহাদ একটি পুলি মুখে ঢুকিয়ে চিবুতে চিবুতে ক্যাফের বাইরে চললো।রোযা তার চলার পথে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলো,পরক্ষণেই তার বুক চি*রে নির্গত হলো দীর্ঘশ্বাস।আজ কালের মধ্যেই হয়ত কিছু ঘটতে চলেছে,যদি নিহাদের কথা সত্যি হয়ে থাকে।তার মনটা কেমন কু ডাকছে।ইচ্ছা হচ্ছে সবকিছু ভুলে ছুটে গিয়ে একটিবার ওই মেশিনকে আলিঙ্গন করতে,তাকে জানাতে যে যাই হয়ে যাক না কেনো রোযা তার পাশে থাকবে, সবসময়।কিন্তু মানুষ কি আর চাইলেই নিজের সকল ইচ্ছা পূরণ করতে পারে?রোযাও পারলোনা।জোরপূর্বক অবাধ্য অন্তরকে শান্তনা জানিয়ে টিফিন বক্স গুছিয়ে উঠলো,কাজে লাগা প্রয়োজন।
ক্যাফের বাইরে বেরিয়ে সড়কের ধার বেয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলো নিহাদ।তৃতীয় মোড় নিতেই মূল সড়কের পাশে অপেক্ষারত বি এম ডব্লিউটি নজরে পড়লো।এগিয়ে গিয়ে প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে চেপে বসলো।তখনো চিবুচ্ছে পুলি।ড্রাইভিং সিটের মাস্ক পরিহিত নির্বিকার অস্তিত্ব তার পানে একবার চাইলো।তারপর ইগনিশনে চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিয়ে গ্যাস পেডাল চেপে ধরলো।ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন তুলে গাড়ি এগোলো ব্যাস্ত সড়ক বেয়ে।ক্যাফে লো-ফাই এর সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেলো,জানালা দিয়ে কাচের দেয়ালে ঘেরা স্থাপনার অভ্যন্তরের কার্যক্রম স্পষ্ট লক্ষণীয়। রোযাকে চোখে পড়লো রিসিপশনের কাছে,কারো সঙ্গে কথা বলছে হয়ত।নিহাদ তাকালেও ড্রাইভারের ভ্রুক্ষেপ নেই।সে নজর বিছিয়ে রেখেছে সম্মুখে।
মিনিটখানেক পর প্রশ্ন এলো,
– এই লড়াই তোমার নয়।তবুও কেনো সাহায্য করছো আমাকে?
স্তব্ধ হয়ে গেলো নিহাদ।হাতের ঝালপুলির দিকে চেয়ে থাকলো একদৃষ্টে।
– এখনো সময় আছে।ভেবে দেখো।দূরে চলে যাও।নিজের মতন জীবন সাজাও।কথা দিচ্ছি আমি বেঁচে থাকতে তুমি অবধি কেউ পৌঁছাতে পারবেনা।
অধর কুঞ্চিত হলো পরিতৃপ্তির এক হাসিতে।
– এই অঙ্গীকার প্রদান করেই প্রমাণ করে দিলে আমি কেনো তোমায় সাহায্য করছি আসমান ভাই।
নিঃশব্দ রইলো আসমান,নির্বিকার দৃষ্টি তখনো মনোযোগী ড্রাইভিংয়ে।মাথা নাড়লো নিহাদ।
– উহু,আমি তোমাকে ঠিক সাহায্য করছিনা।নিজের লড়াই লড়ছি।এই প্রতিশোধ শুধু তোমার নয়, আমারও।
এক পলক বিহ্বল দৃষ্টি স্থাপিত হলো প্যাসেঞ্জার সিটে।পিছনে কিঞ্চিৎ হেলান দিয়ে মাথা হেলিয়ে নিহাদের অসম্ভব আবেগপূর্ণ কন্ঠস্বর ধ্বনিত হলো,
– ভেবেছিলাম তোমাকে বুঝি সত্যিই হারিয়ে ফেলেছি।জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে ছিলাম এই ধরিত্রীতে।বাদশাহ এবং নাবিল কায়সারের হাতের পুতুল হয়ে।আন্দাজ করেছিল এই মস্তিষ্ক, তবুও ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস করেনি।কি হবে?আমার যা হারানোর আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম ইতোমধ্যে।
কয়েক সেকেন্ড নৈঃশব্দ্য,অতঃপর একটি দীর্ঘশ্বাস।
– সেদিন রোযাকে ধরতে গিয়ে যখন তোমাকে দেখেছিলাম,আমি বোঝাতে পারবোনা অন্তরে কেমন অনুভূতি হয়েছিল।মেনে নিয়েছিলাম পরাজয়,তবুও কোথাও যেন এক টুকরো আশা ছিল,তুমি আসবে, ফিরে আসবে নতুন উদ্যমে।আমার সেই আশা সত্যি প্রমাণিত হয়েছিল।হয়ত শান্ত দেখিয়েছিল আমাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিলাম সম্পূর্ণ।খুব অভিমান হয়েছিল তোমার উপর,প্রায় তিনটি বছরে একটিবারও যোগাযোগ করোনি বলে।ভেবেছিলাম আমি বুঝি পর হয়েছিলাম তোমার।
মৃদু হাসির শব্দ।তাকালো নিহাদ ড্রাইভিং সিটে বসা আসমানের দিকে।
– আমার সেই অভিমান ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে গেলো শুধুমাত্র তোমার একটিমাত্র ফোনকলে।সব ক্রোধ ছুঁড়ে ফেলে ছুটে গিয়েছিলাম তোমার দুয়ারে।কারণ কি জানো?আমার একটিমাত্র তুমিই আছো এই পৃথিবীতে আসমান ভাই।
চাকার কর্কশ আর্তনাদ তুলে গাড়ি সহসাই থেমে গেলো।হালকা ঝাঁকি অনুভূত হলো শরীরে।আসমানের দৃষ্টি কিছুটা বিভ্রান্ত, ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে ফেলতে চেয়ে আছে লুকিং গ্লাসের দিকে।স্টিয়ারিংয়ে চেপে বসেছে হাতের আঙ্গুলসমূহ।হাত বাড়িয়ে আসমানের গিয়ারের উপর রাখা হাতটি মুঠোয় মুড়িয়ে নিলো নিহাদ।দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করলো,
– এই লড়াই আমার প্রতিশোধের লড়াই।আমার কাছ থেকে আমার আসমান ভাইকে কেড়ে নিয়েছে ওই পাষণ্ডের দল।নিজের থেকেও যে জীবনের মূল্য আমার কাছে সবচেয়ে বেশি,সেই জীবনকেই তছনছ করে দিয়েছে ওই মানুষরূপী পিশাচগুলো।আন্দাজ করা সত্ত্বেও আমি কাপুরুষের মতন তাদের গোলামী করে গিয়েছি।যেদিন তারা আমাকে তোমার মৃ*ত্যুসংবাদ দিলো,সেদিনই পি*স্ত*লটা কায়সার অধিপতির কপালে ঠেকানো উচিত ছিল আমার, পারিনি।কিন্তু আর নয়।আমি নিজের স্বার্থে তোমার সঙ্গে আছি,আমার আপন প্রতিশোধ বাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে।
স্টিয়ারিংয়ে মাথা রাখলো আসমান।নিহাদ অনুভব করলো মুঠোর মাঝে তার হাত শক্তভাবে চেপে বসেছে।এটাই আসমানের নীরব অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।হাসলো নিহাদ,হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে প্রিয় মানুষটির চুলে আদর বুলিয়ে দিলো পরম যত্নে।
– একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ভাই?
– হুম?
– সত্যি করে বলো তো।আমি যেদিন রোযাকে তুলে আনতে গিয়েছিলাম সেদিন তুমি ওখানে কি করছিলে?
দৃশ্যমানভাবে চমকালো আসমান।পরমুহুর্তেই আবার শীতলতায় ছেয়ে গেল। সিটে হেলান দিয়ে নিজের মাস্কটা খুললো,কেমন হাসফাঁস লাগছে।অদূরে দৃষ্টি ফেলে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বিড়বিড় করলো,
– খবর পেয়েছিলাম।কে বি গ্রুপ মেয়েটাকে খুঁজছে।চাইনি আমার কারণে আরো কারো জীবন হু*মকির মুখে পড়ুক।
– আমাকে দেখে চলে আসছিলে?
– হুম।
– আমাকে আটকে রেখেছে এই খবর কিভাবে পেয়েছিলে?
– আসাদ উদ্দিন।
নামটি উচ্চারণ করলো আসমান।সবটা বুঝে মাথা দোলালো নিহাদ।তারপর একটি নিঃশ্বাস ফেলে আপনমনে বিড়বিড় করলো,খানিকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই।
– রোযা তোমাকে পছন্দ করে।
দীর্ঘ নীরবতা।পরক্ষণে ইঞ্জিনের গর্জন উঠলো পুনরায়।সড়কে নেমে এলো গাড়ি পুনরায়,নিহাদ ভেবেছিল এই প্রসঙ্গে কোনো উত্তর আসবেনা।কিন্তু এলো, অতর্কিতেই।
– এই জীবনে পুনরায় কাউকে জড়িয়ে তাকে ধ্বংস করার কোনো অর্থ হয়না।
অবশিষ্ট একটিমাত্র ঝালপুলিতে কামড় দিয়ে শুনলো নিহাদ,হাসির ফোয়ারা ফুটিয়ে বললো,
– তাই বুঝি আড়াল থেকে দেখে রাখো?
– রাখবো,কে বি গ্রুপের পতন পর্যন্ত।কথা দিয়েছিলাম।উপেক্ষা করতে পারিনা।
মাথা নেড়ে প্রসঙ্গ বাদ দিলো নিহাদ, অর্ধেকখানি পুলি আসমানের দিকে বাড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
– খাবে?
খানিক অবিশ্বাস্যভাবেই নীরবে ঝুঁকলো আসমান, তার মুখে পুলি পুরে দিলো নিহাদ।পুনরায় সামনে ফিরলো,মনোযোগ দিলো সড়কে।
– মজা না?
– হুম।
– তোমার হাতের ব্রেসলেটটা সুন্দর।
এবার আর কোনোপ্রকার জবাব এলোনা। নিহাদও কিছু জিজ্ঞেস করলোনা।জানালা দিয়ে বাইরে মুখ বাড়ালো।
নভেম্বরের চতুর্থ দিনের সন্ধ্যা।লিফট থেকে বেরিয়ে গ্রাউন্ডফ্লোরে এলো চারুলতা।কিছুক্ষণ আগেই তাকে ফোন দিয়ে জানানো হয়েছে কারা যেন তার সঙ্গে দেখা করতে চায়।ভবনের সামনে অপেক্ষারত একটি সাদা বর্ণের ঝকঝকে গাড়ি। ধীরপায়ে হেঁটে এগোলো সে।গাড়ির সামনে দাঁড়ানো এক যুবক এবং এক মধ্যবয়স্ক লোক।পরিধানে ভেস্ট, যাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখিত,
“ডিবি।”
– মিস আফসানা রেমান চারুলতা?
– জ্বি।
যুবক চারুলতার মুখোমুখি হলো,মাথার ক্যাপ ঝুঁকিয়ে স্থির কন্ঠে জানালো,
– আপনার এক্ষুনি আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
– কি উপলক্ষে? ডিবি কার্যালয়ে আপনার বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে বুঝি?
বিব্রত হলো যুবক,এগোলো মধ্যবয়স্ক লোক।
– দেখুন মিস।আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একটি মিশন পরিচালনা করছি।আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।
– ওয়ারেন্ট কোথায়?
– গাড়িতে উঠুন, দেখাচ্ছি।
তীর্যক হাসলো চারুলতা।বুকের উপর দুবাহু ভাঁজ করে ভ্রু কুঁচকে চাইলো,
– নাটক ভালোই সাজিয়েছেন কিন্তু অভিনয় একদমই বাজে। দশে দুই দিলাম আপনাকে।
রীতিমত বিদ্যুৎ খেলে গেলো উভয়ের শরীরে।তড়িৎ ইশারায় যুবক অগ্রসর হলো,চারুলতার মুখে সহসাই চেপে ধরলো একটি রুমাল।তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালো সে,তবুও সম্ভব হলোনা।কোমরে ঠেকলো শীতল একটি অ*স্ত্র।
– একটু এদিক সেদিক করলে সোজা উপরে পাঠিয়ে দেবো।
থমকাতে বাধ্য হলো চারু,তার শরীর অজানা আবেশে অবশ হয়ে আসছে ক্রমশ।এক মিনিটের মতন সময় অতিবাহিত হলো,তার নিস্তেজ শরীরটাকে তোলা হলো গাড়িতে।এমনভাবে সিটে স্থাপন করে চোখে সানগ্লাস পরিয়ে দেয়া হলো যে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে যে সত্যিই সে বসে আছে নিজের মতন।ভেতরের ড্রাইভার গাড়ি চালু করলো দ্রুতই।সিটি ইউফোরিয়ার মূল প্রবেশপথ পেরোতে সমস্যা হলোনা খুব একটা। ডিবির পরিচয়পত্র এবং ভেস্ট সকলকে বোকা বানাতে খুব কাজে দিয়েছে।
সিটি ইউফোরিয়া থেকে বেরিয়ে যখন নগরের মূল সড়কে এসে পড়লো গাড়ি,তখন যুবক নিজের কানের এয়ারপিস অন করে বিড়বিড় করলো,
– টার্গেট ওয়ান ডাউন।
– টার্গেট টু অলসো সিকিউরড।
– বেইজমেন্ট কে ফোর।
– অন ইট।
হোটেল ফ্লোরা – র দুইশো আট নম্বর কেবিনের সামনের করিডোর।একটি কার্ট ঠেলে ঠেলে এগিয়ে আসছে একজন পুরুষ স্টাফ।শুভ্র সাদা শার্ট, কালো ক্রপ স্যুট, হাতে রাবার গ্লাভস এবং পায়ে চেলসি বুট। আধারখচিত মাস্কে আবৃত চেহারা।শুধুমাত্র নিগূঢ় বাদামী দৃষ্টি অবলোকন সম্ভব।হোটেলের দুইজন স্টাফ এগিয়ে যেতে যেতে কার্ট ঠেলে অগ্রসর হওয়া স্টাফকে জিজ্ঞেস করলো,
– এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
– পার্কিং লটে।দুইশো আটের স্যার বেরোবেন, গাড়িতে মালপত্রগুলো তুলে দিতে হবে।
একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করলো উভয় স্টাফ।এই ছেলেটির কন্ঠস্বর তাদের নিকট বিনা কারণেই খানিক প্রভাবশালী ঠেকেছে।অজানা এক শিহরণ অনুভূত হয় হৃদয়ে ওই ধ্বনি শ্রবণ হলে।শুভ্রতার আড়ালে যেন এক পরাবাস্তব ছায়া ঘিরে রয়েছে ছেলেটির সমস্ত অবয়ব।অসহনীয় লাগছে ওই নিগূঢ় দৃষ্টিও।বেশিক্ষণ তাই দাঁড়ালোনা স্টাফ দুইজন।দ্রুতই নিজেদের কাজে গেলো।কত অদ্ভুত অদ্ভুত মানুষকেই না চাকরি দিচ্ছে আজকাল হোটেল কর্তৃপক্ষ!
কার্ট ঠেলে আপনমনে লিফটে চাপলো ছেলেটি।গ্রাউন্ড ফ্লোরের পার্কিং লটে থামলো তা।দরজা খুলে যেতেই তীক্ষ্ণ সতর্ক নজর বোলালো চারিপাশে। মাঠ পরিষ্কার।দ্রুত এগোলো,কার্ট ঠেলে নিলো কালো পোর্শের কাছে।পকেট থেকে চাবি বের করে বাটন চাপতেই দরজা খুললো গাড়িটির। কার্টের কায়দা করে রাখা মালপত্র গুটিয়ে একদম নিচে কাপড়ে আবৃত পুরুষালী শরীরটি টেনে গাড়ির পিছনের সিটে চালান করলো। কার্ট ঠেলে দূরে সরিয়ে দ্রুত উঠলো গাড়িতে।এই বস্তুটির আর কোনো প্রয়োজন নেই।ড্রাইভিং সিটে বসেই শার্ট খুললো,অভ্যন্তরের কালো টি শার্ট,তার উপর চড়ালো লেদার জ্যাকেট। মাস্কটি ঠিকঠাক করে কর্মচারীদের স্টাইলে জেল দিয়ে সেট করা চুলে আঙুল চালালো। লুকিং গ্লাসে চেয়ে এলোমেলো করে নিলো খানিক।দ্রুত হাতে চোখ থেকে নীলচে লেন্সদুটো খুলে রাখলো বক্সে।পুনরায় দৃষ্টির মাঝে গভীর শোষণীয় কৃষ্ণগহ্বর ফিরে এলো আসমানের!
পিছনের সিটে অচেতন সাইফ হুসেইন।তার শেষ টার্গেট!
পোর্শে চালু করলো।হোটেলের গেটে গার্ড আটকাতেই শুধুমাত্র নিজের পাশের জানালার কাঁচ নামালো।পকেট থেকে আইডি এবং হোটেলের গেস্ট লিভিং পাস বের করে দেখাতেই গার্ড বিনা বাক্য ব্যয়ে তাকে স্যালুট ঠুকে সরে দাঁড়ালো।উন্মুক্ত করল পথ।সময় ব্যয় ব্যতীত সড়কে নামলো আসমানের গাড়ি।প্রথম কয়েক মিনিট চললো বেশ সাবধানে,পরবর্তীতে মহাসড়কে এসে পড়তেই পোর্শের রেসিং মডেলের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম হলোনা দ্রুতগতির কোনো যানবাহন।দুর্বার দুর্বোধ্য হয়ে ছুটে চললো একের পর এক গাড়ি ওভারটেক করে।গন্তব্য শহরের এক প্রান্ত সংলগ্ন পরিত্যক্ত কারখানা।
এক ঘণ্টার মতন সময় প্রয়োজন হলো।নির্জন প্রান্তরে থামলো আসমানের পোর্শে।গাড়ির দরজা খুলে সে বেরোলো।হাতে জড়িয়ে নিলো ফিঙ্গারলেস গ্লাভস, যার প্রান্তে সংযুক্ত ধারালো নাকেলস। পোর্শের পিছনে এগোলো,বের করলো সাইফের অচেতন শরীরটাকে।পা দিয়ে ঠেলে দরজা আটকে শরীরটা মাটিতে টেনে হিঁচড়ে চললো ভেতরে।মাটির ঘর্ষণে বারংবার ক্ষ*ত বিক্ষ*ত হলো,ধুলোয় মাখামাখি হলো তবুও পরোয়াহীন আসমান।একটি হাত টেনে চলেছে সে অভ্যন্তরে।
পরিত্যক্ত কারখানাটি বিভিন্ন রকম দৈত্যাকার ধাতব যন্ত্রপাতি এবং পেঁচানো সিঁড়িতে পরিপূর্ণ।ধুলোয় ধূসরিত প্রত্যেকটি প্রান্ত যেন এক পরাশক্তির প্রভাব ঘোষণা করে চলেছে।গুমোট বাঁধা আধারের মাঝে শুধু উঁচু সিলিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত কয়েকটি মাত্র টিমটিমে বাতি প্রজ্জ্বলিত।যার আভা এই অমানিশা দূর তো করছেই না,বরং তাকে আরো অশুভ করে তুলছে।এই আঁধারকে অনুভব করার জন্যই যেন সামান্যতম আভার ব্যবস্থা,যার ঠিক নিচেই একটি চেয়ার। যার দুই হাতলজুড়ে রয়েছে লোহার বেড়ি।সেই চেয়ারের দিকেই এগোলো আসমান।তার ভারী পদশব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে আবদ্ধ দেয়ালজুড়ে।তার সঙ্গে ঘর্ষণের ধ্বনি।নজর পড়ল পাশে রক্ষিত স্ট্রেচারে।যার উপর রক্ষিত টুলবক্সটি।সবকিছু প্রস্তুত।এবার শুধু এই নরক রচনার পালা।
সাইফের শরীর চেয়ারের উপর রীতিমতো ছুঁড়ে রাখলো আসমান।ভারসাম্য রক্ষা হলোনা,হড়বড় করে গড়িয়ে পড়ল তার পায়ের সম্মুখে।মাথা একবার ডানে অতঃপর বামে কাত করে আসমান ঝুকলো।একটি হাত বাড়ালো,ঠিক তখনি নড়েচড়ে উঠলো নিথর দে*হটি।কিঞ্চিৎ বিহ্বল হয়ে পরেও দ্রুত নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিলো আসমান।তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জাগ্রত হয়েছে। মস্তিষ্কজুড়ে বেজে চলেছে বিপদসংকেত।ক্ষিপ্র নজর সমস্ত কারখানাজুড়ে ঘুরিয়ে আনলো সে, তড়িৎ গতিতে হাত এগোলো কোমরে গুঁজে রাখা রিভল*ভারের দিকে।কিন্তু তার পূর্বেই….
তীব্র এক বি*দ্যুৎ খেলে গেলো তার সমস্ত শরীর জুড়ে। কর্ণগুহরে প্রচণ্ড উচ্চশব্দে ঝনঝনে ধ্বনির জোয়ার উঠলো।কেঁপে উঠলো সর্বাঙ্গ। হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে পড়তে বাধ্য হলো আসমান,দুহাতে চেপে ধরলো নিজের কান।তথাপি সজাগ তার নিউরন।
স্টানগা*ন!
কিন্তু কে ব্যবহার করেছে?এখানে সে এবং সাইফ ব্যতীত তৃতীয় ব্যক্তি কে?
দৃষ্টিগোচর হলো সহসাই। নিচতলার দৈত্যাকার যন্ত্রপাতির আড়াল হতে বেরিয়ে এলো কালো পোশাকধারী ছায়ামূর্তি।প্রত্যেকের হাতে শোভা পাচ্ছে অ*স্ত্র। রিভ*লভার,হকিস্টিক,ধাতব রড….বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ।আসমানের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে রয়েছে তবুও সে ওঠার প্রচেষ্টা চালালো।সতর্কবাণী জোরালো হয়েছে।প্রকম্পিত আবেদনে জানাচ্ছে,ফাঁদে পড়ে গেছে সে!
নিজের রিভল*ভার টানলো আসমান,ট্রি*গারে আঙুল রেখে এলোপাথাড়ি ছুঁড়তে শুরু করলো বু*লেট। স্টানগা*নের প্রভাবে এখনো তার শরীর স্বাভাবিক হতে পারেনি,নিশা*না করা অসম্ভব। ছুটে এলো দল ক্ষীপ্রগতিতে,চারিপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হলো তাকে। রডের আ*ঘাত হা*নলো তার ঘা*ড় বরাবর,দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় ঘাড় এড়ালেও তা পড়লো মাথার পিছনে। যন্ত্রণায় সর্বাঙ্গ কুঁকড়ে গেলো,না চাইতেও বেদনাধ্বনি নির্গত হলো অধর হতে।মাথার পিছনে হাত দিলো আসমান, অনুভব করলো উষ্ম অনুভূত হচ্ছে, তার সঙ্গে চটচটে অনুভব।হাত সামনে আনতেই নজরে এলো র*ক্ত!
হাসির কলরলে কুরুক্ষেত্র উদ্ভাসিত হলো এক লহমায়।ঝট করে পিছনে ফিরে তাকালো।এতক্ষণ মাটিতে হুমড়ি খেয়ে থাকা সাইফ বর্তমানে বসে আছে, উভয় হাঁটুতে হাত ঠেকিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ে আছে যার উদ্দেশ্যে।অধর উদ্ভাসিত এক অশরীরী হাসির কুঞ্চনে।
– সারপ্রাইজ!
ক্রোধে সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জুড়ে শিহরণ খেলে গেলো আসমানের।এক ছুটে এগোতে গেলো সাইফের দিকে, পারলোনা।পা বরাবর হকিস্টিকের আ*ঘাতে হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। ঠু*কে গেলো কপাল।তবুও মুষ্টিবদ্ধ হাত চেপে নিজেকে উত্তোলন করতে যেতেই একে একে পাঁচ পাঁচটি পদক্ষেপ তাকে ঠেসে ধরলো মেঝেতে।নড়াচড়ার সুযোগ আপাতত বন্ধ।মুখ তুলে তাকালো সামনে।তখনো একই ভঙ্গিতে বসে হাসছে সাইফ।আসমানের তীব্র দৃষ্টি অনুভূত হতেই নিজের কানের লতিতে সংযুক্ত ছোট্ট দুলটি খুলে ছুড়ে ফেললো সামনে, তা গড়িয়ে এসে থামলো মেঝেতে।বরাবর মাঝখানে।
– ন্যানো ট্র্যাকার খুবই কাজের জিনিস তাইনা?
সামান্যতম বেগ পেতে হলোনা আসমানের সম্পূর্ণ বিষয়টি উপলব্ধিতে।সাইফ জানতো তার উপর আক্র*মণ হবে,সে আসমানকে সুযোগ করে দিয়েছে নিজের কাছে পৌঁছানোর। ন্যানো ট্র্যাকার ব্যবহার করেছে,যার জিপিএস লোকেশন দেখে তার পূর্ব হতে প্রস্তুতকৃত দল এই স্থান পর্যন্ত পৌঁছেছে।সবকিছুই পূর্ব পরিকল্পনা।
আসমানের পাতা ফাঁদেই তাকে মাত দিয়েছে সাইফ!ঠিক দাবার বোর্ডের চেকমেটের মতন!
ক্ষোভ,ক্রোধ এবং অনুশোচনার মিশ্র অনুভূতি অনুভব করলো আসমান।অন্তিম মুহূর্তে এসে সে তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। তারই মাশুল গুণতে হচ্ছে এখন।
আসমানের ঘাড় ধরে তাকে সোজা করে বসানো হলো।উভয় হাঁটু ভাঁজ হয়ে রইলো,সামান্যতম নড়চড় করবার সুযোগ নেই।মাথায় চারিপাশ হতে পাঁচ পাঁচটি পি*স্ত*ল তাক করা।সাইফ বসে আছে তার বিপরীত প্রান্তে,বিজয়ীর বেশে।
– নাইস ট্রাই।
কাপড় ঝেড়ে উঠলো সাইফ,তার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকলো আসমান।
– তোমাকে মাত করা আরেকটু কঠিন হবে ভেবেছিলাম।কিন্তু এ তো আমার কল্পনার চাইতেও সহজ ছিলো।বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতায়ও ধূসর আবরণ পড়েছে।
ঝটকা দিয়ে উঠতে গেলো আসমান,কিন্তু পারলোনা।আবদ্ধ হয়ে স্থির চেয়ে রইলো সামনে।একটি বাক্যও উচ্চারণ করলোনা।ইশারা করলো সাইফ,তার এক লোক এগিয়ে একটি আসমানের কাছ থেকেই কেড়ে নেয়া রিভ*লভারটি তুলে দিলো সাইফের হাতে।চেয়ারটিতে হাঁটুর উপর পা তুলে বসে অলস দৃষ্টিপাত ঘটালো সে সম্মুখে।একটি হাত ঠেকালো কপালে,যেন মহারাজ নিজের প্রজার পানে চেয়ে রয়েছেন।
– আসমান। হোয়াট আ সুইট নেইম!সুবিস্তৃত আকাশ, মায়াবী আবহ এবং…..
– আপনার অভিধান পরিবর্তন করুন।আসমান অর্থ মর্মস্পর্শী আকাশ নয়, আসমান হলো অমানিশার বিনাশক।
না চাইতেও ওই বজ্রকন্ঠস্বর সাইফসহ উপস্থিত সকলকে কয়েক মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল করে তুললো।র*ক্তা*ক্ত ললাট, ধূলায় ধূসরিত অবয়ব, ভগ্নপ্রায় শরীর।তবুও নিটল হিমালয়,আপন হিমশীতলতায় সে অটল।
সন্তুষ্ট না হয়ে পারলোনা সাইফ।সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে, তীর্যক হাসি ফুটিয়ে বিড়বিড় করলো,
– নট ব্যাড।কিন্তু এই বিনাশক যে বর্তমানে আমার হাতে বন্দী!ভুল মানুষের সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে ফেলেছে সে।
– মানুষ! নাকি নরপিশাচ?
তাচ্ছিল্যের আভাসে উদ্ভাসিত হলো আসমানের অভিব্যক্তি।সাইফ উঠে দাঁড়ালো, রিভল*ভারে একটিমাত্র বু*লেট অবশিষ্ট রয়েছে।সেটা পরীক্ষা করে ট্রিগারে আঙুল চেপে সামনে তাকিয়ে জানালো,
– তোমার মৃ*ত্যুদূত।
– যে মৃ*ত তার আবার মৃ*ত্যুদূতের ভয়?
সাইফের ঠোঁটের কোণ উঁচু হলো।রিভ*লভার তা*ক করলো সে আসমানের বুক বরাবর।
– ওহ রিয়েলি? লেটস্ সি দ্যান।
এক পলক চোখ বুজে অতঃপর খুললো আসমান, সামান্যতম অনুভূতি হচ্ছেনা তার।সবকিছু শূণ্য।বরং এই পরিণতি যেন তার আত্মার মুক্তির পথ উন্মুক্ত করতে চলেছে।এক অদ্ভুত প্রশান্তি চেয়েও গেলো তার অভিব্যক্তিতে।
– কি*লিং মেশিন আসমান….
এক মুহুর্ত থামলো সাইফ।মাথা কাত করে ওই শোষণীয় কৃষ্ণগহ্বরে দৃষ্টি মিলিয়ে শুধালো,
– অওর শুড আই সে…. আসমান কায়সার?
থপ!
অত্যন্ত মৃদু একটি শব্দ হলো সাইলেন্সারে।অদৃশ্যমান আলোক গতিতে ছুটে এলো বু*লে*ট বি*দ্ধ হলো বক্ষ বরাবর।একটি ঝটকা খেলো সমস্ত দে*হ, কৃষ্ণগহ্বরে ফুটলো পরাশক্তি,প্রসারিত নয়নজুড়ে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা খচিত।বিস্তৃত হলো সাইফের অধর, পরিতৃপ্তির হাসিতে।অপরদিকে উপস্থিত সকলকে ছেয়ে গেল স্তব্ধতার আবহ।
নুয়ে এলো শরীর, প্রকম্পন তুলে আরো একটি বু*লে*ট বিধ*লো একেবারে হৃদয*ন্ত্রে,বুকের বাম পাশে।কম্পিত দেহ টিকলো এক সেকেন্ড,পরমুহুর্তেই মুখ থুবড়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।তখনো আধখোলা দৃষ্টি,যা জুড়ে রয়েছে শুধুমাত্র অব্যক্ত ধোঁয়াশা।
ডার্কসাইড পর্ব ৩২
সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লো সকলে।একমাত্র অটল দন্ডায়মান সাইফ।এক পদক্ষেপ এগোলো সামনে, দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে ঘোষণা করলো মৃ*ত্যু পরোয়ানা।
– গুডবাই…. আসমান কায়সার!
এক মুহূর্তের জন্য নিথর নয়নে প্রজ্জ্বলিত হলো প্রদীপ্ত আলোকশিখা….মৃ*ত্যুর পূর্বে সবচেয়ে ঘৃণিত এই নামটি শ্রবণ হয়ত ভাগ্যের সেই ভয়াল অভিশাপ।
