ডার্কসাইড পর্ব ৪১

ডার্কসাইড পর্ব ৪১
জাবিন ফোরকান

নতুন এক সকাল।নতুন জীবনের সূচনা।দিবাকর আজ মিষ্টি রোদের প্রজ্জ্বলনে উদ্ভাসিত করেছে সমগ্র জগৎকে।তীব্র শীতের আবহ ভেদ করে যেন সামান্য একটু প্রশান্তি বিলানোর প্রচেষ্টা।ভারী কম্বলের অভ্যন্তরে উষ্ণতায় অস্তিত্ব মুড়িয়ে রয়েছে আসমানের। মধুর রোদের হাতছানি উঁকি দিয়ে চলেছে তার বদ্ধ চোখের পাতায়।আরমোড়া ভাঙলো,মিটমিট করে দৃষ্টি মেলে চাইলো।প্রথমটায় অনুভূত হলো যেন স্বর্গে রয়েছে সে।পাশে তাকালো, বিছানা শূণ্য,কেউই নেই।তবুও যেন মানুষটির অনুভব মিশে রয়েছে সম্পূর্ণ কক্ষ এবং এই বিছানার চাঁদরের পরতে পরতে। সে আর একলা নয়।তার জীবনে হাতে হাত রেখে চলার মতন একজন সঙ্গিনী রয়েছে,তার অর্ধাঙ্গিনী! অনুভবটি অনুভূতিহীন অধরেও কিঞ্চিৎ তৃপ্তির রেখা ফোটালো।

ঘড়ির রিডিং সময় জানান দিচ্ছে সকাল আটটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট।নিজেকে টেনে তুললো আসমান।গতকালের ক্লান্তির পর আজ বেশ তাজা লাগছে। ক্লোজেট থেকে লং স্লিভ ওভারসাইজড সোয়েটশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে গেলো।গোসল সেরে তোয়ালেতে চুল মুছতে মুছতে আপনমনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।আজ শরীরচর্চা করবার ইচ্ছা হচ্ছেনা।প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে,কিছু খাওয়া দরকার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সিঁড়ির ধারে পৌঁছাতেই সুঘ্রাণটি নাকে ঠেকলো।বিশুদ্ধ ঘিয়ে ভাজা পরোটার ছিমছিমে সুবাস। উঁকি দিতেই নিচতলার ডাইন ইন সেকশনের ব্যাস্ততা নজরে এলো।টেবিল ঘিরে বসেছে সবাই। থালা বাটির টুংটাং আওয়াজ ঘোষণা করছে যে আদতেই নাস্তার সময় এটি।টেবিলের উপর সাজানো পরোটা, ডিমপোচ এবং আলু মটরের ভাজী। বিলাল হাসিমুখে গল্প করতে করতে নিহাদ এবং চারুলতাকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন।কিছুক্ষণ পরেই কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো রোযা, হাতে একটি ট্রে, তাতে পায়েসের বাটি।আসমান নিজের জায়গায় থমকে পড়লো।সকলের ব্যাস্ততাপূর্ণ পারিবারিক দৃশ্যটি এতটাই সুন্দর যে নিজের দৃষ্টি হটানো দায়।কি সুন্দর গোছালো একটি পরিবার!যে পরিবার লাভের স্বপ্নে বিভোর ছিল আসমান আজীবন।

– আপনাকে একটু ভাজি দেই বাবা?
রোযার প্রশ্নে হেসে মাথা দোলালেন বিলাল,বললেন,
– অবশ্যই।আমার মামণি অতি সুস্বাদু রান্না করে।দাও দাও,আজ আমি কোনো বাঁধা মানছিনা।সপ্তম পরোটাটি সাবার করেই ছাড়বো।
– কোলেস্টেরল বেড়ে যাবে ড্যাড।
চারুলতার কন্ঠে বিলাল জানালেন,
– নো টেনশন বেইবি।তোমার ড্যাড এত দূর্বল নয় যে নেতিয়ে পড়বে।
– হ্যাঁ আংকেল তো দরবেশের বংশধর তুমি জানোনা?
নিহাদের বক্তব্যে রীতিমত উচ্চশব্দে হাসলেন বিলাল, অপরদিকে ভ্রুকুটি করলো চারু।রোযা হেসে আরেকটি পরোটা এবং ভাজি তুলে দিলো তার প্লেটে।

– এতদিনে যেন এই বাড়িটা বসবাসের উপযুক্ত হয়েছে।পরিপূর্ণতা অনুভূত হচ্ছে।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে সবটাই শুনলো আসমান।তাকে দেখেই পরোটা মুখে দিতে দিতে থমকালো নিহাদ। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো।তারপরই তার চেহারায় তীর্যক হাসির উদ্ভব ঘটলো।আসমানের চুল থেকে তখন টপটপ করে পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। তা লক্ষ্য করে শয়তানি দৃষ্টিতে নিহাদ প্রশ্ন করলো,
– গুড মর্নিং মিস্টার মিঙ্গেল,ঘুম ভাঙলো অবশেষে?
আসমান নির্বিকারভাবে চেয়ে থাকলো। কোনো উত্তর না করে চেয়ারে বসার পায়তায়া তার স্তব্ধ হলো নিহাদের পরবর্তী প্রশ্নে।

– সকাল সকাল গোসল করে কেমন বোধ করছ?
ভাজি মুখে পুরতে পুরতে থমকালেন বিলাল,হতভম্ব চারুলতা।অত্যন্ত নিষ্পাপ প্রশ্নটি তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চল করে দিয়েছে।তবুও বুঝতে পারলোনা আসমান, তোয়ালেটা সিঁড়ির রেলিংয়ে ঝুলিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো নিহাদের উদ্দেশ্যে।দ্বিগুণ হাসি অধরে মেখে দেবের ভক্ত বলে বসলো,
– তোমার নতুন বউ ভেজা চুলে কিচেনে কাজ করে, আর এখন তুমিও একেবারে ফ্রেশ আউট অব বাথ হয়ে নামলে……ভালো তো,ভালো না?
ঠাস!
সশব্দে হাতের জগটি টেবিলের উপর রাখলো রোযা। দৃষ্টিজুড়ে তার প্রকম্পন,মুখায়বে লালিমা।আসমান নিজেও বিব্রতবোধ করলো।খুকখুক করে কেশে উঠলেন বিলাল রেমান,রোযা দ্রুত তাকে পানি এগিয়ে দিলো। চারুলতা হাত বাড়িয়ে তার চুলের গোছা টেনে ধরলো,

– আই আই আহ্হঃ….
– নির্লজ্জ্ব গণ্ডার!এসব কোন ধরণের কথাবার্তা?
– বাহ্!ওরা করতে পারলে দোষ নেই আমি বললেই যত দোষ?
– কি করার কথা বলছো?
হুট করেই নিহাদের সামনের টেবিলে থাবা দিয়ে আসমান ঝুঁকলো,তার দৃষ্টি এতটাই শীতল যে তাতে শিউরে উঠলো নিহাদ।জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে জানালো,
– আরে আপনি এত উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কেনো?
– নো নো জাস্ট সে ইট….
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চেয়ে থাকলো নিহাদ, আসমানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মোকাবেলা করা দায়।
আরও একটু ঝুঁকে অমানিশা বললো,
– আই সেইড সে ইট!
– যাহ দুষ্টু!আমি কিভাবে ওইসব কথা মুখে আনতে পারি? আফটার অল আম স্টিল সিঙ্গেল।তোমরা গতকাল বাসর ঘরে কেমন রণ বাজা বাজে ঘন ঘন দ্রামা দিমি দিমি দমকি দমকি করেছ তা বললে এই দুনিয়া কি আমাকে মেনে নেবে?
চটাশ করে আসমানের চপাট পড়লো নিহাদের গালে।বাকিরা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে দৃশ্যপটে।

– একি রণ বাজা বাজে আবার কি হ্যাঁ? গান চেনো না তুমি?শুনতে পাওনি?নাটক করো আমার সাথে?
– গান?অবশ্যই অবশ্যই।অনেক সুন্দর,আমি শুনেছি।তুমি বাসরঘরে আর আমারে দিওনা জ্বালা,আর খেইলো না গো এমন করে প্রেমেরই খেলা…. আআআআ!
অভূতপূর্ব ব্যাপারটি ঘটলো তখনি।চিৎকার করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে পড়ে ছুটতে থাকলো নিহাদ, গুরুর চোখের বিপদসংকেত সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেনি। আসমানও পিছিয়ে রইলো না, অনুসরণ করলো।হাসতে হাসতে হলঘরের সোফায় উঠলো নিহাদ,আড়াল করতে চাইলো নিজেকে।দুহাত সামনে ঠেলে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বলে বসলো,

– মুরুব্বী মুরুব্বী উহু উহু উহু….!
– তোমাকে আজ গুরু দেবের ক্যালমার ডোজ না দিয়ে ছাড়ছি না চিংটা নিহাদ!
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালালো নিহাদ,সোজা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাগানের পথ ধরলো। আসমানও ছুটলো পিছু পিছু,এই ছোটাছুটি খেলায় সে জিত হাসিল করেই ছাড়বে।
উভয় ঘূর্ণিঝড় স্থান ত্যাগ করতেই উপস্থিত সকলে নীরবতায় ছেয়ে গেলো।অদ্ভুত এক অস্বস্তি ঝুলছে পরিবেশে।কেউই যেন কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা।এতটাই স্তম্ভিত তারা।সর্বপ্রথম ঘোর কাটিয়ে খিলখিল ধ্বনি তুলে হাসলো চারুলতা,অতঃপর বিলালও।তাদের হাস্যরসে ডুবতে দেখে রোযাও নিজেকে গুটিয়ে রাখতে সক্ষম হলোনা,কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ মাখা নয়নে মৃদু হাসলো।

– এত আনন্দ আমার ভাগ্যে খোদা লিখে রেখেছেন কোনোদিন ভাবিনি।
অতর্কিতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন বিলাল,নিহাদের মজা করা এবং আসমানের তাকে অনুসরণ তার পিতৃ হৃদয়ে সন্তানের প্রতি আবেগ সৃষ্টি করেছে।বিশেষ করে সেই সন্তান যদি আসমানের মতন অনুভূতিহীন পাথরমানব হয়,সেক্ষেত্রে তার প্রফুল্লতার সামান্য উদগীরণও পিতার হৃদয়ে জোয়ার সৃষ্টি করতে যথেষ্ট।রোযা এবং চারুলতা উভয়ই তার কাঁধে হাত রাখলো।ঝুঁকে বাবার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে চারু জানালো,
– চিন্তা করোনা ড্যাড।আমাদের পরিবার এখন পূর্ণতা পেয়েছে।আমার বিশ্বাস এই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী নয়, চিরস্থায়ী।
নয়নে জমা অশ্রুফোঁটা সযত্নে মুছে নিয়ে মাথা দোলালেন বিলাল রেমান।ঠিক তখনি ভেতরে এলো আসমান। নাক এবং ভ্রু কুঁচকে আছে,যেন ভীষণ বিরক্ত হয়ে রয়েছে।নিহাদের চিহ্নটুকুও আশেপাশে নেই।হাতে হাত ঝাড়লো সে,বোঝা গেলো,বেশ একচোট ঠাটিয়েছে!বাকিদের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বোধ করলো,কন্ঠ পরিষ্কার করে চুপচাপ একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ল টেবিলে।

– আশ্চর্য্য!মানুষ এখন শান্তিমত গোসলও করতে পারবেনা!গতকাল অত ব্যাস্ত আর ক্লান্ত ছিলাম, তাতে সকালে গোসল করেছি তো কি এমন দোষ করে ফেলেছি?
– হাহা… আই আন্ডারস্ট্যান্ড বেইবি। মামণি ওকে খেতে দাও,নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে।
বিব্রতকর অবস্থা বুঝে বিলাল কথা ঘুরিয়ে ফেললেন।রোযা তাতে স্বস্তি পেয়ে মাথা দুলিয়ে আসমানের দিকে এগোলো।প্লেটে পরোটা এবং ভাজি সাজিয়ে দিলো।আসমান একদৃষ্টে চেয়ে রইলো।তবে তার দৃষ্টি খাবারের দিকে নয়,বরং খাবার বেড়ে দেয়া রমণীর উদ্দেশ্যে বিলীন।

আসমানী বর্ণের একটি নতুন শাড়ি পরিধানে রোযার।খোলা কেশরাশি ললাটের দুপাশে হালকা ভেজা অবস্থায় লেপ্টে রয়েছে।হাত দুখানায় বিয়ের উপহার হিসাবে বিলাল রহমান প্রদত্ত একজোড়া বালা।অনামিকায় স্বামীর দেয়া আধারখচিত আংটি।একজন নতুন বউ হিসাবে যথেষ্ট,খুব বেশি আহামরি কিছু নয়।তবুও কেন যেন তার মুখশ্রী ভিন্নভাবে নজরে পড়ছে।একজন পরিপূর্ণ নারীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে তার মাঝে,যা হৃদয়কে অব্যক্ত অনুভূতিতে আকর্ষণ করছে।এর আগে রোযাকে এমন অনুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিতে কোনোদিন পর্যবেক্ষণ করেছে কিনা আসমান ঠাওর করতে পারলোনা।করেছে হয়ত,অন্তরকে আশকারা দিয়েছে একবার দুইবার।কিন্তু আজকের দৃষ্টিপাতের সঙ্গে তার তুলনা হয়।এতকাল সে ছিল পরনারী,কিন্তু আজ থেকে—

আমার!শুধুমাত্র আমার!
না চাইতেও সমস্ত বক্ষজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে গেলো বাক্যগুলি।রোযা নিজের অবয়বে নিগূঢ় দৃষ্টিপাত অনুভব করলো,মাথা হেলিয়ে তাকাতেই আসমানের সঙ্গে দৃষ্টি মিললো তার।সহসাই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলো আসমান,তার শুভ্র ত্বকজুড়ে লালচে আভা স্পষ্ট।আসমান লজ্জা পাচ্ছে!বিষয়টি অভাবনীয় নয় কি?
অবশেষে দেখা মিললো নিহাদের,ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো সে।সামান্য খোড়াচ্ছে,কোমর চেপে ধরে রেখেছে এক হাতে।চেয়ারের কাছে এসেই আসমানের প্রতি তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুখ ভেংচে চেয়ারে বসে পড়লো।বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ হলোনা অমানিশার। নিহাদকে ঘাটানোর সুযোগ হাতছাড়া করলোনা চারুলতা। ভ্রু উঁচু করে লালচে ঠোঁটে প্রভাব ফুটিয়ে শুধালো,

– আহারে, ভাঙা কোমরে আর দেবের গানে ড্যান্স করা হয়ে উঠলোনা তোমার!
– কেনো?ফেভিকল দিয়ে জুড়ে নিলেই হলো।
বিলাল রেমানও কৌতুকে যুক্ত হলেন।তাতে পিতার সঙ্গে হাই ফাইভ করে খিলখিল হাসির ধ্বনি তুলে চারু বললো,
– তবুও ড্যাড,এই ছেলে কুকুরের লেজ। চোঙায় ভরে রাখলেও জীবনে সিধা হবেনা!
– আল্লাহর গজব পড়বে আপনারা যা শুরু করে দিয়েছেন!
নিহাদের ক্রোধান্বিত কণ্ঠস্বরে শুধুমাত্র পুনরায় হাসির প্রবাহে ভেসে উঠলো রেমান পরিবারের সকালের নাস্তার সময়টি।অবশেষে বুঝি আনন্দ ধরা দিলো আপন আপন যন্ত্রণার জগতে আবদ্ধ মানুষগুলোর জীবনে?

নাস্তা শেষে বড়সড় একটা লাগেজ টেনে রুমে এলো রোযা।কিছুক্ষণ আগেই মাত্র তার পুরনো বাসা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এসে পৌঁছেছে। ভারী লাগেজটি তুলে ঢুকতেই সোফায় বসে আসমানকে ল্যাপটপে মনোযোগী হতে দেখা গেলো।রোযা যতদূর জেনেছে তাকে রেমান কোম্পানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যার দরুণ ব্যস্ততা স্বাভাবিক।ব্যাপারটি রোযাকে আশ্বস্ত করেছে।আসমানের একটি সামাজিক ভিত্তির অর্থ তার স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ,সমাজে প্রতিষ্ঠা।যা খুব করে চায় সে।
রোযার উপস্থিতি টের পেয়ে আসমান ঘুরে তাকালো, ল্যাপটপ টেবিলে রেখে উঠে এলো।কিছু না বলে লাগেজটি নিজের হাতে নিয়ে হেঁটে গিয়ে বিছানায় রাখলো।

– থ্যাংক ইউ।
মৃদু হেসে এগিয়ে রোযা লাগেজ খুলে নিজের কাপড়চোপড় বের করতে থাকলো।আসমান কাজে ফিরবে ভাবলেও গেলো না,কেন যেন ইচ্ছা হলো রোযার কাজ দেখার।তাই চুপচাপ বিছানার একপাশে বসে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টে।ওই কৃষ্ণগহ্বরের দৃষ্টিতে ঈষৎ কম্পিত হলো রোযা।কাজে নজরপাত করেই শুধালো,
– কি দেখছো?
– তোমাকে।
– কেনো?
– ভালো লাগছে।
– আমার কাজ দেখতে ভালো লাগছে নাকি আমাকে দেখতে ভালো লাগছে?
– দুটোই।
অমানিশার উত্তরে কোনো খেদ নেই, সৎ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। শব্দগুলো হয়ত ছোট কিন্তু তাদের মাঝে লোকায়িত আবেদনটুকু তার অর্ধাঙ্গিনীর জন্য যথেষ্ট। সুখ শিহরণ অনুভূত হলো রোযার। অধরে প্রস্ফুটিত হলো হাসির ধারা।ঘুরে চেয়ে প্রশ্ন করলো,

– অনুভূতির প্রতি এতটা সৎ হলে কবে থেকে?
– চেষ্টা করছি।এই ভগ্ন অস্তিত্বকে গুছিয়ে নেয়ার।
অদ্ভুত এক টান অনুভব করলো রোযা বক্ষমাঝে, ইচ্ছা হলো আলিঙ্গন করে পুরুষটিকে।পরমুহুর্তে কি যেন ভাবলো, উল্টো ঘুরে হেঁটে ক্লোজেট থেকে একটি বক্স বের করলো।ফিরে এলো,বিছানায় বসা আসমানের সামনে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসলো।
– বাম হাতটা দাও।
প্রশ্ন করলোনা আসমান,এগিয়ে দিলো হাতখানা।বক্স খুলে রোযা বস্তুটি বের করলো,দৃষ্টি প্রসারিত হলো আসমানের।আবদ্ধ হলো প্রেয়সীর অনুভূতিখচিত জড়বস্তুটির পানে।সেই রেজিনের ব্রেসলেটখানি!

– সামান্য ভেঙে গিয়েছিল,নতুনভাবে তৈরী করেছি।
তার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে জানালো রোযা।দৃষ্টি সরিয়ে নিলো আসমান অপরাধবোধে,ঈষৎ কাপতে থাকলো তার হাত।বিষয়টি খেয়াল করে দু হাতের মুঠোয় হাতটি পুরে উত্তোলন করলো রোযা, অনুভবের প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টি মেলে ব্যক্ত করলো,
– এইযে তোমাকে অনুভূতির বাঁধনে বাঁধলাম,আর কখনো ছিন্ন করোনা কেমন?
হাতের উল্টোপিঠে আপন অধর স্পর্শ করলো রোযা,
– আমি কিন্তু আর ফেলনা নই,তোমার অর্ধাঙ্গিনী।যন্ত্রণা দেয়ার আগে সহস্রবার ভাববে কার হৃদয় ভাঙছ তুমি!
কন্ঠ ধরে এলো,আবেগের জলোচ্ছ্বাস বইলো বক্ষজুড়ে।নয়ন তারকাখচিত আকাশের ন্যায় দ্যুতিতে আচ্ছন্ন হলো।রোযা থেমে নেই,অধরের কোমল স্পর্শ ছুঁয়ে দিচ্ছে হাতের তর্জনীতে,অতঃপর মধ্যমায়, তারপর অনামিকায়….. একে একে প্রত্যেকটিতে।আসমানের দৃষ্টি লুটায়িত হলো তার কর্মজুড়ে,ঘন ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হলো তাড়নায়।হাতের তালু নিজের কপোলে ঠেকালো রোযা, উদ্ভাসিত কৃষ্ণগহ্বরে আপন দৃষ্টি প্রতিফলন ঘটিয়ে যেন ঘোষণা করলো,

– তুমি আমার অধিকার, আসমান।
সহ্য করা দায় হলো।অতর্কিতে ঝুঁকলো অমানিশা, সন্নিকটে টেনে বিড়বিড় করলো,
– আমি দুঃখিত,আমায় ক্ষমা করো জ্যোৎস্না।
– করলাম ক্ষমা, চাঁদ।
উভয়ের ললাট মিলিত হলো,যেন একে অপরের ভাগ্য হতে শুষে নিলো অভিশাপটুকু, বিলিয়ে দিলো ভালোবাসা।এই বন্ধন তাদের চিরস্থায়ী।হয়ত আবারো অতর্কিতে আঁধারে ছেয়ে যাবে জীবন।তবুও তারা জানবে,তাদের একটি চাঁদ এবং সেই চাঁদের জ্যোৎস্না রয়েছে।একত্রে একে অপরের ঢাল তলোয়ার হয়ে ভাগ্যকে মোকাবেলায় সদা প্রস্তুত দুটি সত্তা।

মৃদু ধাঁচের সঙ্গীতের মূর্ছনায় উদ্ভাসিত প্রাঙ্গণ।মিটিমিটি করে লালচে হলদে বাতিগুলো আভা ছড়াচ্ছে মাদকীয়। চড়া শুল্কে আমদানীকৃত নিষিদ্ধ তরলের বাস বায়ুজুড়ে, মিশ্রিত তা ধোঁয়া ওঠা জিভে জল আনা দেশী বিদেশী খাবারের পদের সুঘ্রাণে। আপাতদৃষ্টিতে অবলোকনে মনে হবে অতি সাধারণ এক বার।কিন্তু এখানে আগত অতিথিগণ জানে এই স্থানের প্রকৃত মূল্য।দেশের আমলা মন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে ব্যবসায়ী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার মাথা…কমতি নেই দেশের ভি ভি আই পি ব্যক্তিগণের।এমন কোনো পরিকল্পনা বাদ নেই যা আলোচিত পর্যালোচিত হয়নি এখানে, যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে তোলপাড় সৃষ্টিকারী ঘটনাসমূহের জন্ম।এক কথায়,এটি একটি তথ্যভান্ডার।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইকবাল আহসান একপাশের একটি আরামদায়ক সোফায় এলিয়ে আজ কিছুটা বিরক্তই হচ্ছেন।যে উদ্দেশ্যে এখানে তার আগমন সেই উদ্দেশ্যের দেখা নেই।সরকারের সব সংগোপনীয় কাজে বারবার তাকে কেনো ঠেলে দেয়া হয় তিনি বুঝে উঠতে পারেন না।দলের অত্যন্ত বিশ্বস্ত সদস্য বলে কি?হতে পারে।হাতের হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে তাই ভেবে গেলেন ইকবাল সাহেব।সাংসারিক সকল ঝামেলার কথা স্মরণে আসছে তার।বউটাকে ডিভোর্স দেয়ার পরে ছেলেটা যেন উচ্ছন্নে গিয়েছে তার!বিখ্যাত এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও স্বভাব চরিত্রের ঠিকঠিকানা নেই।রাজনীতির দাপট দেখিয়ে যত ঝামেলায় নিজেকে জড়ায় সবটাই তাকে সামাল দিতে হয়।যদিও ক্ষমতার জোরে সবকিছুই তার হাতের নাগালে,তবুও।বারবার মস্তিষ্কে চাপ নিতে ভালো লাগেনা।তার উপর উদোর পিন্ডি চেপেছে বুধোর ঘাড়ে।এখন পি*ষ্ট হও মাঝখানে!দুশ্চিন্তা আর বিরক্তিতে বিকৃত হয়ে এলো তার চেহারা,অজান্তেই।

– এত দুশ্চিন্তা স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক মন্ত্রীসাহেব।
নেশাক্ত মেয়েলী কন্ঠস্বরটি তার চিন্তায় চড ঘটালো সহসাই।দৃষ্টি তুলে সামনে তাকাতেই নজরে এলো দৃশ্যটি।চকচকে একটি কালো শর্ট ড্রেসে মোড়ানো লাস্যময়ী অবয়ব, অধরজুড়ে টকটকে লাল লিপস্টিকের ছোঁয়া, নয়নজোড়া গাঢ় কাজলরেখায় বিধ্বংসী ঠেকছে।পুরুষের অন্তরমাত্র আকর্ষিত হতে বাধ্য।হাঁটুর বয়সী মেয়ের দিকে নির্লজ্জ্ব দৃষ্টিপাতে বিব্রত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে কন্ঠ পরিষ্কার করে নিলেন ইকবাল সাহেব।
– এহেম… রাফা কায়সার?
– ইয়েস আই অ্যাম!
তার বিপরীত প্রান্তের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ঝকঝকে দাঁতের হাসি উপস্থাপন করলো রমণী।
– তুমি খুবই সময়জ্ঞানী।
হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বিড়বিড় করলেন ইকবাল সাহেব।তাতে হাসিটি বিস্তৃত হলো রাফার।সামনে ঝুঁকে অপ্রয়োজনীয় ভাবে দাঁতে অধর চেপে জানালো,

– আ কুইন ইয নেভার লেইট।এভরিওয়ান এলস্ ইয সিম্পলি আর্লি।
চেয়ে থাকলেন মন্ত্রী,একদৃষ্টে।এই মেয়েটির মাঝে অদ্ভুত এক প্রভাবীয় শক্তি রয়েছে।ব্যাপারটা ঠিক সুখকর নয়,রীতিমত দম বন্ধকর।যেন অসুস্থ শরীরে সেবন করা তেঁতো ওষুধ।খেতে ইচ্ছা হয়না,তবুও সুস্থতার দোহাইয়ে বাধ্য শরীর।কিংবা কোনো ড্রা*গ, একবার গ্রহণে নিস্তার নেই আজীবনেও।
তার দিকে চেয়ে আপনমনে সোফায় হেলান দিলো রাফা, দুপা তুললো টেবিলে।লম্বাটে আংটিপরিহিত আঙুলের ভাঁজে উঠে এলো বেনসন,লাইটারে সেটি ধরিয়ে দীর্ঘ একটি সুখটান দিয়ে বায়ুতে ধোঁয়াটে বৃত্ত তৈরি করলো সে।সামনে একজন ক্ষমতাবান মন্ত্রী কিংবা গুরুজনতুল্য মানুষ বসে আছে তার পরোয়া রয়েছে বলে মনে হলোনা।কে বি গ্রুপ নিঃশেষ হয়েছে, কিন্তু রেখে গিয়েছে এই বীজকে।এখন এই বীজ নতুন উদ্ভিদের জন্ম দেবে নাকি ধ্বংস করবে আপনাকে তাই পরিলক্ষণের বিষয়।

– মন্ত্রী সাহেব…..
কণ্ঠের রসালো টানে ইকবাল সাহেবের শিরদাঁড়া বেয়ে তরঙ্গ খেলে গেলো যেন।শক্ত একটি ঢোক গলাধঃকরণ করলেন তিনি।সিগারেট দুই আঙুলে চেপে রাফা বললো,
– কে বি গ্রুপের পতন ঘটেছে।কি ভেবেছেন?মুক্তি পেয়ে গিয়েছে সরকার? ভুলে গিয়েছেন কত মিলিয়ন ডলার গচ্চা গিয়েছিল সরকারকে গদিতে তুলতে?
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন ইকবাল সাহেব,এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়া সম্ভবপর নয়।তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে হাসলো রাফা, ঝুঁকলো সামনে,
– বেঈমানের ঘরের বেঈমান!যেই প্রভুর ক্ষমতা লুটে গেলো অমনি পাগলা কুত্তাটা কা*মড় বসাতে ছুটে আসলো। মীর জাফরের তুলনাও অপমানজনক।
– দেখো কায়সার….

– হুশ! কায়সার যখন কথা বলে তখন সকলের শুধু শুনে যেতে হয়, পাল্টা উত্তরের সুযোগ নেই।
এক মেয়ের মাঝে এতটা গভীর প্রভাব থাকা সম্ভব ইকবাল সাহেব কল্পনা করেননি কোনোদিন।মেয়েমানুষ মাত্রই তার নিকট ভোগের বস্তু কিংবা সংসারের সৌন্দর্য্যবর্ধক উপাদান ব্যতিত ভিন্ন কিছু ছিলোনা।রাফা পুনরায় সোফায় হেলান দিলো, সিগারেটে দীর্ঘ টান দিয়ে জানালো,
– ভাববেন না কে বি গ্রুপের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বেঁচে গিয়েছেন।সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে এখন জানেন নিশ্চয়ই? রেমান গ্রুপ!
তীর্যক হাসিতে উদ্ভাসিত হলো টকটকে র*ক্তপিপাসু অধর।সিলিংয়ে চেয়ে বললো,

– রেমানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাবেন?অকালে ম*রবেন! রেমান গ্রুপ একেকটা পাথর তৈরীর কারখানা।ভাঙবে তবু মচকাবেনা।কি কি হয়েছিল ভুলে গিয়েছেন? রেমান ছাড় দেবে আপনাদের?
অজানা আতঙ্কে কম্পিত হলো শরীর।দৃষ্টিতে ভেসে এলো সেদিনের মহাপ্রলয়।কিভাবে দুর্বার ঘূর্ণিঝড় হয়ে তার দপ্তরে প্রবেশ করে তারই কলার চেপে ধরেছিল আসমান!সামান্যতম প্রতিরোধ সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। অর্থবিত্তের সম্মুখে যে ক্ষমতাও দাস!চাইলে নিরাপত্তা সদস্যদের অ*স্ত্রে ঝাঁ*ঝ*রা করে দেয়া যেতো আসমানের বু*ক,অতঃপর যে কেয়ামতটি সংঘটিত হতো তা রুখতো কে?কে বি গ্রুপ অস্তিত্বহীন, রেমান গ্রুপকে ঠেকানোর ক্ষমতা কারো নেই!এতটাই প্রভাবশালী এক মেশিনের জন্ম দিয়েছে এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বের খেলা।

– বিরোধী পক্ষের তাহমিদ হোসাইনকে স্মরণে আছে নিশ্চয়ই?
রাফার ইশারায় সবকিছুই স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো ইকবাল সাহেবের।তাহমিদ হোসাইন,বিরোধী দলীয় নেতা। পঁয়ত্রিশের ঘরে বয়স,অথচ এরই মাঝে জনগণের হৃদয় হরণ করে নিয়েছে আপন মহিমায়।তরুণ প্রজন্মের মাঝে দিনদিন তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।যার দরুণ বর্তমান সরকারও কিছুটা চিন্তিত।দলে ভেড়াতে বহু কাঠখড় পোড়ানো হয়েছে,কিন্তু আপন নীতিতে অটল এক অস্তিত্ব তাহমিদ হোসাইন।সহসাই চিন্তাটা মস্তিষ্কে এলো ইকবাল সাহেবের,
– তাহমিদকে হাতিয়ার বানিয়ে নির্বাচনী চাল চালবে রেমান?এটাই বলতে চাইছো কি?
– কই?আমি তো কিছু বলিনি।যা বোঝার আপনিই বুঝে নিয়েছেন মন্ত্রী সাহেব….
রহস্য করে হাসলো রাফা।তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও ঘামতে আরম্ভ করলেন ইকবাল।রুমাল বের করে মুছলেন কপাল।

– শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়।আপনার সরকারকে বুঝিয়ে দেবেন মিস্টার মিনিস্টার।আমাদের উদ্দেশ্য এক, রেমানের ধ্বংস!
উঠলো রাফা,তার নারীসুলভ অবয়বেও অশুভ এক আগ্রাসনের অনুভব লক্ষ্য করা গেলো।সিগারেটটি বেপরোয়াভাবে ছুঁড়ে ফেলে রাফা ধোঁয়াটে কন্ঠে যেন রীতিমত ঘোষণা করলো,
– এবার কোনো ছাড় নয়।সামান্য ভষ্মও অবশিষ্ট থাকবেনা,ফিনিক্স পাখির নবজাগরণের সাধ্য কি?
রূপকথায় বর্ণিত ডাকিনীদের সর্দার যেন,বর্তমানে শুনলে হাস্যকর ঠেকলেও ছেলেবেলায় যা ছিল চিত্ত হরণের কারণ।রাফা কায়সার তেমনি কেউ।বিধ্বংসী এক নারী।যে জানে শুধুমাত্র আদায় করতে,অন্যথায় ধ্বংস।

– আর ইউ ডান বেইবি?
আঁধারের চাঁদর ভেদ করে দৃশ্যমান হলো সুগঠিত শরীরের অধিকারী তেজস্বী এক পুরুষ।চেহারার ধাঁচেই বোঝা গেলো বিদেশী সে।চেয়ে থাকলেন ইকবাল সাহেব,নির্বাক হয়ে।চারিপাশের মানুষজনের কোনো পরোয়া না করেই রাফা পিছনে ঘুরল, পুরুষটিকে কাছে টেনে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। নির্লজ্জ্ব সায় জানালো পুরুষটিও,তার বলিষ্ঠ হাত চেপে ধরলো রাফার কাধ,যেন খুলে নিতে চাইছে বস্ত্রখানি।মৃদু হেসে নিজেকে সরিয়ে রাফা বিড়বিড় করলো,

– কন্ট্রোল হানি,কন্ট্রোল!
– আই কান্ট হোয়েন ইউ লুক দিস মাচ হট!
বিব্রত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন ইকবাল সাহেব।কিন্তু রাফার কন্ঠ তাকে পুনরায় দৃশ্যপটে ফিরতে বাধ্য করলো।
– তাহলে ওই কথাই রইলো মন্ত্রী সাহেব?চিন্তা কিসের?আমার ড্যাডি নেই তো কি হয়েছে?এর চেয়েও বড় হাতিয়ার আমার রয়েছে….
পুরুষটির গালে চুম্বন করে জানালো রাফা,গর্বিত হলো তার সঙ্গীর চেহারা।অতঃপর হেলেদুলে তার হাত ধরে বার ত্যাগ করলো কনিষ্ঠা কায়সার।তার যাওয়ার পথে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন ইকবাল সাহেব,পরক্ষণেই একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো তার বক্ষ হতে।ভীষণ রকম অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে তার গোটা পৃথিবী।

মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমি— লার্ন টু সার্ভ।
বহুতল আধুনিক ভবনজুড়ে সিলভার অক্ষরে খচিত নামটি জ্বলজ্বল করছে। প্রাঙ্গণজুড়ে শিক্ষার্থীদের ভিড়।জানুয়ারি মাসের পঞ্চম দিনে নতুন বর্ষের সঙ্গে আরম্ভ হওয়া নতুন সেমিস্টারের ক্লাসে যোগদান করতে সকলেই প্রস্তুত।নব্য সূচনার উৎসাহ তরুণ তরুণীদের মুখজুড়ে।শিক্ষাজীবন এক নতুন মোড় নিয়েছে তাদের।জীবনে সফলতার পথে আরো এক ধাপ অগ্রসর হওয়া।চারিপাশের প্রফুল্ল দৃশ্য অবলোকন করতে করতে করিডোর বেয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া রোযার।উচ্চশিক্ষার স্বপ্নটি অবশেষে পূরণ হতে চলেছে তার।দেই আনন্দ সমস্ত বক্ষজুড়ে বিদ্যমান।

– এক্সকিউজ মি?জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টটা কোনদিকে বলতে পারবেন?
থমকালো রোযার পদক্ষেপ।ফিরে চাইলো পিছনে।সালোয়ার কামিজ পরিধানকৃত এক অতি সাধারণ রমণী। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়াল থেকে ডাগর ডাগর নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। শ্যামলা বর্ণের ত্বক খানিকটা ঘর্মাক্ত, পরিচ্ছদেও কিঞ্চিৎ মলিনতা।বোঝাই যাচ্ছে লোকালে বহু সংগ্রাম করে সময়মত পৌঁছেছে।অপরদিকে রমণীর দৃষ্টিতে রোযাকে অভিজাত ঠেকলো।উরুর নিচ অবধি যাওয়া কুর্তিজুড়ে সূর্যমুখী ফুলের প্রতিচ্ছবি। অরগাঞ্জার ওড়না এবং হাতের ব্যাগটিও পরিপাটি।ধনী ঘরের মেয়ে হয়ত,ভাবলো রমণী মনে মনে।অবশ্য তাই হওয়ার কথা।দেশের অন্যতম বিখ্যাত এই বেসরকারি বিদ্যাপীঠে অধিকাংশই অভিজাত পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়ন করে অভ্যস্ত।মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তদের খুব কমই সুযোগ পায় বিশেষ বৃত্তির মাধ্যমে।
রমণীর উদ্দেশ্যে একগাল হাসলো রোযা।হাতের ব্যাগটি হাতবদল করে শুধালো,

– ফ্রেশার?
– জ… জ্বি।
– আমিও।
– ওহ, দুঃখিত।
– ব্যাপার নয়।আমি খোঁজখবর নিয়েই এসেছি।মূল ভবনের পঞ্চম তলায় আমাদের ডিপার্টমেন্ট। চলো।
– তুমিও জার্নালিজম?
সম্মতি জানালো রোযা,হাঁটতে আরম্ভ করতেই মেয়েটি তাকে অনুসরণ করলো।কিছুটা হতবিহ্বল ভাব তার চেহারাজুড়ে।অভিজাত কারো ব্যবহার এতটা কোমল হতে পারে সে পূর্বে ধারণা করেনি।ধনীদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা তার বরাবরই তিক্ত। রোযাকে আলাদাভাবে চোখে লেগেছে তাই।

পথিমধ্যে বিস্তর আলাপ হলো উভয় রমণীর মাঝে।মেয়েটির নাম অহনা।সুদূর পঞ্চগড়ের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে এই রাজধানীতে পাড়ি জমানো।একাই টিকে থেকেছে পাঁচ পাঁচটি বছর ইট পাথরের নগরে সংগ্রাম করে।সমস্ত পৃথিবীতে আপন মানুষ বলতে আছে শুধুমাত্র জন্মদাত্রী মা।এই মায়ের জীবন সুখে সুখে ভরিয়ে দিতেই তার সফলতার তীব্র বাসনা।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ হয়েছে,কিন্তু মনমতো বিষয় পায়নি।জার্নালিজমের প্রতি নিগূঢ় টান তার।৮০% বৃত্তিলাভে ভর্তি হয়েছে। অ্যাকাডেমির নিজস্ব হলে নামমাত্র ভাড়ায় মিলেছে কক্ষও।পার্ট টাইম দুটো চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা জারি রাখবে।ভাগ্য বুঝি এবার একটু মুখ তুলে চেয়েছে অহনার দিকে!

অহনার জীবনকাহিনী শুনতে শুনতে রোযা নিজের মাঝেই হারিয়ে গিয়েছিল যেন।এতদিন মনে হতো দুনিয়ায় সব দুঃখ কষ্ট বুঝি তার ভাগ্যেই তুলে রাখা হয়েছে।একই পথের পথিক হয়ে আরো কত মানুষ যে এখনো পর্যন্ত এই জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছে তা উপলব্ধি হলো সহসাই।আপনা আপনি প্রার্থনায় পূর্ণ হলো শুকরিয়া।খোদা তাকে এর তুলনায় খুব ভালো রেখেছেন।

ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুমে প্রবেশ করতেই রোযা এবং অহনা থমকে পড়লো।সুবিশাল কক্ষটি সারি সারি স্তম্ভে সজ্জিত।গ্যালারি ক্লাস।একদম নিচে একটি ধবধবে পোডিয়াম,যার উপরে প্রফেসরদের অবস্থানের ব্যবস্থা।পিছনের দেয়ালজুড়ে প্রজেক্টর স্ক্রিন।গ্যালারির অর্ধাংশ ইতোমধ্যেই ছাত্রছাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়েছে।তবে বিস্ময়কর ব্যাপারটি হলো পোডিয়ামে দাঁড়ানো একপাল ছেলেপেলের অবস্থান।পোশাক আশাকে কাউকেই একজন প্রফেসর হিসাবে মানানসই ঠেকছেনা।ছোট্ট দলটির দলপতির শকুনে নজর আপতিত হলো রোযা এবং অহনার পানে। কোনোপ্রকার রাখঢাক ব্যতিতই ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রোযাকে অবলোকন করলো আপাদমস্তক।ঘৃণায় বুক ভার হলো রোযার,তবুও প্রথম দিন অধরে অধর চেপে সহ্য করে গেলো।আঙুল তুলে এমনভাবে তাদের ইশারা করে ডাকলো ছেলেটি যেন নেড়ি কুকুরকে ডাকছে কাছে!পিনপতন নীরবতার মাঝে পায়ে পায়ে এগোলো রোযা এবং অহনা।
প্রথমে অহনার দিকে চাইলো সে। তীর্যক হেসে জিজ্ঞেস করলো,

– নাম কি?
– অহনা।
– বয়স?
– উনিশ।
– গান জানো?
একটি ঢোক গিললো অহনা,কিঞ্চিৎ অসহায়ত্বে তাকালো রোযার উদ্দেশ্যে।
– আরে ওকে কি দেখছ?ওর পালাও আসবে।আজকে প্রথম দিন,কোকিল কন্ঠে একটা গান শোনাও আমাদের।মাজাক্কালী মাজাক্কালী,সঙ্গে কিছুটা রসালো নাচ!
– আপনি কি এই দেশের প্রেসিডেন্ট যে আপনার সব কথা ওকে শুনতে হবে?
ছেলেটি বিরক্তি নিয়ে তাকালো রোযার দিকে।

– এই মেয়ে।বেশি দুঃসাহসী সাজতে এসো না।তুমি জানো আমি কে?আমি চাইলে এক তুড়িতে তোমাকে এই ডিপার্টমেন্ট থেকে বাইরে ফেলতে পারি!
সামান্য গুঞ্জন উঠলো ক্লাসজুড়ে।কিন্তু চোখ রাঙানিতে মুহূর্তেই নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো পরক্ষণেই।ছেলেটি আঙুল তুলে সামনের গ্যালারিতে বসা একজনকে দেখিয়ে বললো,
– ওকে কি করেছি জানো?টি শার্ট খুলে নেচেছে,কই?ও তো বারণ করেনি।তোমাকে তো কিছু খুলতেও বলিনি।মেয়েমানুষ ঢং দেখাও?
স্পষ্টত বিব্রতবোধ করলো গ্যালারিতে বসা ছেলেটি,মাথা নত করে নিলো।তার অবয়বজুড়ে হতাশা এবং তীব্র লজ্জাবোধ।ব্যাপারটি মোটেও সুখকর নয়,বরং দুশ্চিন্তার।আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন কিছু তরুণ তরুণীদের উপর অধিক প্রভাব ফেলে তা রোযার জ্ঞানের বাইরে নয়।

– মোটেও ঠিক করেননি।
গ্যালারির ছেলেটি দৃষ্টি তুলে তাকালো।রোযা পোডিয়ামের উদ্দেশ্যে এগোলো, নির্ভীকভাবে।সে জানে তাকে বাকিরা পর্যবেক্ষণ করছে।দুর্বলতা প্রদর্শনমাত্র তারা মুষড়ে পড়বে।মুখোমুখি হয়ে রোযা জানালো,
– আপনার যে হাবভাব তাতে মনে হচ্ছে আপনি একজন আলালের ঘরের দুলাল এবং আমাদের সিনিয়র ভাই।আত্মতৃপ্তির আশায় ফ্রেশারদের নিয়ে এমন বেপরোয়া বিনোদনের অধিকার আপনাকে কে দিলো?যদি কমপ্লেইন করি আপনার নামে তাহলে কি হবে ভেবেছেন?
হাসতে আরম্ভ করলো ছেলেটি,রোযার বক্তব্যে যেন ভীষণ বিনোদিত হয়েছে।
– তুমি আমাকে চেনো না মেয়ে।আমি জিশান আহসান।কি?এখন চেনা চেনা লাগছে?ঠিকই ধরেছ, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমার বাবা!আর এই পুরো ভার্সিটির নেতা কিন্তু আমিই!
সামান্য বিচলিত দেখালো রোযাকে,তবুও পিছু হটলোনা।জিশান তীর্যক হাসি ঝুলিয়ে ক্রমেই তার নিকটে এলো,হাত বাড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে দিতে চাইতেই দু পা পিছিয়ে গেলো রোযা।

– কাউকে অনুমতিবিহীন স্পর্শের এখতিয়ার এই দেশের কোনো নাগরিক রাখেনা।
– আমাকে আইন শেখাচ্ছ?কোন ঘরের দুলালী তুমি শুনি?তোমার বাপকে আমি তিন তোলায় কিনে ফেলতে পারি!
এবার সামান্য হাসলো রোযাও।বুকে দুহাত ভাঁজ করে প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে জানালো,
– রোযা রেমান।পিতা মরহুম,তবে শ্বশুড় রয়েছেন।কিনতে পারবেন তাকে তিন তোলায়?তাহলে প্রশ্ন আসতেই হচ্ছে এক লাখ টাকা বেতনভোগী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির প্রতি এমন ভ্রুক্ষেপহীন আবেদন করার ক্ষমতা কোথায় পায়?উৎস কি তার সম্পদের?
এমন বেফাঁস প্রশ্ন উত্থাপনে জিশান এবার সত্যিই বিব্রত হলো।আশেপাশে তাকালো যেন সাহায্যের আশায়।কিন্তু প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী বর্তমানে তার পরিবর্তে রোযার উপর মনোযোগী।শুধুমাত্র “রেমান” নামটিই তার প্রতি আগ্রহী হতে যথেষ্ট ছিল।এই নামের যথার্থ স্ফুলিঙ্গ যেন খচিত তার অবয়বজুড়ে।
উপায়ন্তর না পেয়ে অহনার দিকে ফিরে ধমকে উঠলো মন্ত্রীর ছেলে।

– এই মেয়ে!তুমি এমন বেআক্কলের মতন দাঁড়িয়ে আছো কেনো?সামান্য গান নাচই তো করতে বলেছি।আমার বিছানা গরম করতে তো বলিনি!তোর আমার বিছানায় যাওয়ার যোগ্যতাও নেই বে***!
এবার ব্যাপারটি অহনারও আত্মসম্মানে আ*ঘাত হানলো।দৃপ্ত পদক্ষেপে এগোলো সে সামনে।এক মুহুর্ত দ্বিধান্বিত হলো,কিন্তু পরক্ষণেই দ্বিধার জাল ছিন্ন করে সকলের সম্মুখে ডান হাতটি তুলে সজোরে চ*ড় দিলো জিশানের গালে!স্তব্ধ হয়ে গেলো সমস্ত ক্লাসরুম, কয়েকজন অতি উত্তেজনা এবং আতঙ্কে দন্ডায়মান হয়ে পড়লো।ঘুরে তাকালো জিশান,দৃষ্টিতে তার হিংস্রতা।মুষ্টিবদ্ধ হাত থরথর করে কাপছে,এই বুঝি অহনাকে পাল্টা আঘা*ত করে বসে!তবে অহনা টলবার পাত্রী নয়। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,

– অসুন্দর হতে পারি,গরীব হতে পারি,ক্ষমতাহীন নারী হতে পারি….কিন্তু আপনার মতন চরিত্রহীন লম্পট নই!ভরা সমাজে একটা মেয়েকে যে এইভাবে অপমান করতে সক্ষম সে আর যাই হোক প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ হতে পারেনা!
কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।তারপর অতর্কিতে হাত বাড়ালো জিশান।উদ্দেশ্য অহনাকে পাকড়াও করা।
– খুব দেমাগ না তোর?কি ভেবেছিস তোর এই উড়নচণ্ডী বান্ধবী তোকে বাঁচাবে?
কিন্তু পৌঁছতে সক্ষম হলোনা সে,তার বন্ধুরা তাকে ধরে ফেললো।নতুন শিক্ষার্থীদের কয়েকজনও সাহস নিয়ে সামনে এসেছে।ঝামেলা নিরসনে সজাগ প্রত্যেকে। জিশানকে তিনজন মিলে ধরে রাখতেও যেন কষ্ট হচ্ছে।অদ্ভুত এক অমানুষিকতা ছেয়ে গিয়েছে তার চোখেমুখে।সে আক্রোশের সম্পূর্ণটা জুড়ে রয়েছে রোযা এবং অহনা।তাকে এক প্রকার জোরপূর্বকই ক্লাসরুম থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো।উপস্থিত প্রত্যেকে তখন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিনেই এমন এক অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী তাদের হতে হবে কেউই ভাবেনি।একটি নিঃশ্বাস ফেলে অহনার দিকে চাইলো রোযা,হাত বাড়িয়ে তার কাধ স্পর্শ করে শুধালো,

– ঠিক আছো তুমি?
হৃদয়ের আতঙ্ক মুছে হাসলো মেয়েটি,অমায়িক ঠেকলো তা।জানালো,
– চিন্তা করোনা রোযা আপু।আমি একদম ঠিক আছি।
– আমি সত্যিই দুঃখিত।কিন্তু মনে হয়না ওই ছেলেকে রাগান্বিত করে দেয়া উচিৎ হয়েছে।আমার ভয় নেই।কিন্তু তুমি তো….
রোযার হাতটি চেপে পুনরায় হাসলো অহনা।

– আমার তাহলে কি করা উচিৎ ছিল আপু?সব শুনেও চুপ করে থাকা?তোমার যেমন ভয় নেই আমারও তেমন হারানোর কিছু নেই আম্মাকে ছাড়া।কিন্তু তাই বলে অন্যায় সয়ে যাবো?উহু,কোনোদিন নয়।মানুষ হয়ে যদি অন্যায়কে অন্যায় বলে প্রতিবাদ না করি তাহলে আশরাফুল মাখলুকাতের যোগ্যতা কোথায়?
অহনার কন্ঠজুড়ে অদ্ভুত এক প্রভাবের উদগীরণ ছিল, যা প্রত্যেকের চিত্ত নাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।এতক্ষণ যাবৎ এখানে বহু ক্ষমতাবান ব্যক্তির আদরের দুলাল উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও উচ্চ ক্ষমতার ভয়ে প্রতিবাদের টু শব্দটি কেউ উচ্চারণ করেনি।কিন্তু কোথাকার কোন এক গ্রামের মেয়ে এসে তাদের যেন নতুনভাবে জীবনপাঠ পড়িয়ে দিলো।অহনার প্রতি শ্রদ্ধা এবং মুগ্ধতার দৃষ্টিপাত না ঘটিয়ে পারলোনা কেউই।

নিজের পোর্শের দরজায় হেলান দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রয়েছে আসমান। ক্ষণে ক্ষণে দৃষ্টি তুলে আশেপাশে চাইছে।দুই ঘণ্টা করে দুটো লেকচার শেষ হতে দুপুর ২ টা বাজবার কথা।বর্তমানে ২ টা ১০ বেজেছে।কিছু কিছু শিক্ষার্থীরা ভবনের বাইরে বেরোতে আরম্ভ করেছে।চারিপাশ জুড়ে কর্মব্যস্ততা।প্রাইভেট কারগুলো সার দিয়ে অপেক্ষা করছে।কেউ কেউ দ্রুত উঠে পড়তেই বেরিয়ে যাচ্ছে পার্কিং লট ছেড়ে।পুনরায় ব্রিগেট হাতঘড়ির দিকে তাকালো আসমান, ২ টা বেজে সতেরো মিনিট।এবার সামনে তাকাতেই দৃশ্যপট নজরে এলো। সূর্যমুখীখচিত কুর্তি পরিহিত রোযার হাস্যোজ্জ্বল অবয়ব এগিয়ে আসছে, গল্পে ব্যাস্ত তার আশেপাশে হাঁটতে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে।রোযা এতটা সামাজিক হতে পারে আসমান পূর্বে অনুধাবন করেনি। প্রথমদিনেই এতগুলো বন্ধু বান্ধবী পাতিয়ে ফেলেছে?বেশ ভালোই।

নিজের সঙ্গীদের বিদায় জানিয়ে ফিরে তাকাতেই আসমানকে নজরে এলো রোযার। ডান হাত তুলে হালকা নাড়লো আসমান, প্রসারিত দৃষ্টি মেলে দ্রুতপায়ে হেঁটে তার সন্নিকটে পৌঁছলো রোযা।আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো হৃদয়রাজকে।শুভ্র শার্ট এবং খয়েরী ক্রপস্যুট পরিধানে। কোটটি খুলে রেখেছে কোথাও।
– তুমি?তুমি এখানে কি করছো?তোমার না অফিসে থাকার কথা?
– আমার স্ত্রীকে বাসায় নিয়ে যেতে এসেছি,ভুল করেছি কি?
রোযার হাতের ব্যাগটি নিজে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে রাখলো আসমান।চেয়ে রইলো রোযা,মুগ্ধ দৃষ্টিতে।
– বাহ্ বাহ্, এত উন্নতি? চাঁদ স্বয়ং এসেছে জ্যোৎস্নার দুয়ারে?
জবাব না দিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করলো আসমান।তাতে বিস্তর হেসে রোযা প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসলো।ড্রাইভিং সিটে বসে ইঞ্জিন চালু করে স্টিয়ারিং ধরতেই বাইরের সড়কপথে নেমে এলো গাড়ি।

– প্রথম দিন কেমন কাটলো ভার্সিটিতে?
আসমানের প্রশ্নে রোযা কিঞ্চিৎ ভাবুক হয়ে পড়লো।প্রথম দিনেই অস্বস্তিদায়ক এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বিষয়টি খোলাসা করবে কি?যদি বেশি দুশ্চিন্তা করে?এখনো পর্যন্ত অবশ্য অতিরিক্ত চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি জিশানের ব্যাপারটি।তাই এড়িয়ে গিয়ে রোযা জানালো,
– ভালো।প্রফেসরদের ক্লাস খুব ভালো লেগেছে।অনেক নতুন কিছু শিখতে পেরেছি। ক্লাসমেটরাও খুব মিশুক।অহনা,সীমা,আরিয়ান,অভিষেক,মালিহা… অনেকগুলো নতুন বন্ধু বান্ধবী হয়েছে।
– বন্ধু?আচ্ছা।
যদিও আসমানের দৃষ্টি গাড়ির গতিপথে আবদ্ধ, তথাপি তার কণ্ঠের অবনমিত ভাব উপলব্ধিতে বেগ পেলোনা রোযা।আপনমনে মৃদু হাসলো।

– হ্যাঁ,বন্ধু! একটার চেয়ে একটা হ্যান্ডসাম দেখতে!কাকে রেখে কাকে দেখবো?একজন প্রফেসর আছে, উনিও যে সুন্দর!ক্লাসে ওনার দিকেই চেয়েছিলাম আধঘন্টা।পুরো ভার্সিটির ক্রাশ যাকে বলে।শুনেছি উনি এখনো অবিবাহিত।
জবাব এলোনা আসমানের তরফ থেকে,শুধু স্টিয়ারিংয়ে তার আঙ্গুলসমূহ জোরালোভাবে চেপে বসলো।অত্যন্ত জোরে বাক কেটে অপর সড়কে প্রবেশ করলো গাড়ি, ভ্রু জোড়ার মাঝে ধারণ করলো কুঞ্চন।তাকে বিরক্ত করে বেশ গদগদ রোযা।অনুভূতিহীন পাথরে সামান্যতম ঈর্ষাও যদি প্রস্ফুটিত হয় ক্ষতি কি?
– জানো?ওই প্রফেসরের একটা প্রাইভেট ব্যাচ আছে।ভাবছি আমিও ভর্তি হই।সি জি পি এর জন্য ভালো শিক্ষাও তো প্রয়োজন বলো?অবশ্য ওনাকে দেখলে আর পড়াশোনার হুশ থাকেনা…আহ!
চাকার কর্কশ আর্তনাদ তুলে থমকে গেলো গাড়ি।প্রতিক্রিয়া বেগের দরুণ রোযা সামনে ছিটকে গেলো, পরক্ষণেই বাঁধা পড়লো সিটবেল্টের কারণে।ধুকধুক করতে থাকা বুকে হাত চেপে ফিরে তাকালো আসমানের উদ্দেশ্যে। দৃষ্টিজুড়ে যার নিগূঢ় অমানিশা।

– ঈর্ষান্বিত করতে চাইছো আমাকে?
একটি শক্ত ঢোক রোযার কন্ঠ হতে উদরে নেমে গেলো। কন্ঠস্বরটি কিঞ্চিৎ গুরুগম্ভীর ঠেকছে।অজান্তেই কি ক্রোধান্বিত করে ফেললো আসমানকে?নিজেকে নিজের সজোরে চপাট দিতে ইচ্ছা হচ্ছে তার।কি দরকার ছিল এমন কাল্পনিক প্রফেসরের কাহিনী বোনার?স্টিয়ারিং থেকে হাত হটিয়ে রোযার সন্নিকটে ঝুঁকলো আসমান,মাস্কের উপরে তার জ্বলন্ত দৃষ্টি যেন হৃদয়ে আগ্রাসন চালাচ্ছে।
– অনুভূতি অপ্রয়োজনীয়।আমার কোনোপ্রকার অনুভূতিই হতোনা, ভুলে গিয়েছ কি?
– দু…দুঃখিত।

সম্ভব হলোনা ওই সম্মোহনী দৃষ্টিমাঝে দৃষ্টিপাত।মাথা ঘুরিয়ে নিলো রোযা,তাকালো ভিন্নপাশে। কোলের উপর রাখা আঙুলগুলো একে অপরের ফাঁকে ঢুকে চেপে বসেছে চিন্তায়।কিঞ্চিৎ বিষাদও অনুভূত হচ্ছে।আসমান তার তরে ঈর্ষান্বিত হবে?তপ্ত মরুর বুকে মরীচিকার পানে ছুটে চলাও যেন তার চাইতে অধিক গ্রহণযোগ্য।কিন্তু রোযা ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিল ভাগ্য কতটা বৈচিত্র্যপূর্ণ।সবথেকে অসম্ভব জিনিসটিও সম্ভব করে তুলে সে মরীচিকার মাঝেও সন্ধান দিতে পারে সুপেয় জলের।

অতর্কিতে রোযার চিবুকে ঠেকলো আসমানের বলিষ্ঠ তর্জনী এবং বৃদ্ধা।এক ঝটকায় ঘুরিয়ে ফেললো।দৃষ্টি মেলে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল রোযা। সিটবেল্টের বাঁধা এড়িয়ে তার এতটা সন্নিকটে এসে পড়েছে আসমানের চেহারা যে উষ্ণ নিঃশ্বাসের আবহ ছুঁয়ে দিচ্ছে মুখাবয়ব।ওই কৃষ্ণগহ্বর যেন শুষে নিলো রোযার অস্তিত্ব এক লহমায়।
– অনুভূতির অপ্রয়োজনীয়তা আমার অদূর অতীত, নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ আমার মধুর বর্তমান।
তিরতির করে কাপলো রোযার অধর,উচ্চারণ করতে চাইলো শব্দ,তবুও সক্ষম হলোনা। আরো একটু ঝুঁকে এলো আসমান,তার মাস্কে ঠেকলো কোমল অধর।শিউরে উঠলো রোযা,যদি মাস্কের বাঁধা মাঝখানে না থাকতো তবে কি….!

– আমি ঈর্ষান্বিত জ্যোৎস্না,সত্যিই ঈর্ষান্বিত।আমায় আর ঈর্ষান্বিত করোনা।
নিজের শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করে উঠতে বেগ পোহাতে হলো রোযাকে।সুতীব্র বাসনা জাগলো অন্তরে, ওই অপ্রয়োজনীয় মাস্কটি হটিয়ে বাঁধা দূর করার।উত্তোলন করলো নিজের হাত, কাপলো তা উত্তেজনায়।কিন্তু মাস্ক স্পর্শের পূর্বেই আসমানের হাত পাকড়াও করলো তাকে,মুষ্টিবদ্ধ করে চাপ প্রয়োগ করলো হালকা।
– উন্মুক্ত করতে দাও ওই শৃঙ্খলকে।
রোযার কথার উত্তরে মাথা নাড়লো আসমান।
– কলঙ্ক দূর থেকেই অবলোকন শ্রেয়।নিকটে টানলে শুধুমাত্র আতঙ্ক।
– কে বলেছে তোমাকে?বারংবার কেনো কলঙ্কের দোহাই দাও?
– কারণ আমি জানি,এই কলঙ্ক স্পর্শ যতটা মধুর,এর সন্নিকটতা ততটাই রোমহর্ষক!দানবকে হয়ত অনুভব করা যায় কিন্তু উপভোগ করা যায়না রোযা।

দরুণ এক স্পৃহায় কম্পিত হলো রোযা।অনুধাবন করতে পারছে সে আসমানের নিজেকে গুটিয়ে রাখার কারণ।হয়ত সে নিজেও কাছে আসতে চায়।কিন্তু চাঁদের শরীরের ওই কলঙ্কের চিহ্ন তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।অন্তরে জন্ম দিয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব।হয়ত তার অর্ধাঙ্গিনী ভয় পাবে,কামনা করতে চাইবেনা ওই পৈশাচিক রূপ।অমানিশার এই ভ্রান্ত মতবাদ গুঁড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন অতি সত্বর।
– তোমার ধারণা ভুল আসমান!

ঘোষণা করলো যেন রোযা।অতঃপর সহসাই ঘটলো ঘটনাটি। সিটবেল্টের বাঁধন খুলে সে গিয়ার পেরিয়ে পৌঁছলো অপরপাশে।আসমানের দৃষ্টিতে মহাবিস্ময় ফুটিয়ে উরুর উপর বসলো তার অর্ধাঙ্গিনী।অজান্তেই ভারসাম্য রক্ষায় কোমরে জড়িয়ে গেলো আসমানের বাহুজোড়া। দ্রুতগতিতে আশেপাশে তাকালো তার নয়ন।ওয়ান ওয়ে মিরর সম্বলিত গ্লাসের কারণে গাড়ির ভেতরের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ প্রায় অসম্ভব, সড়কপথও এই শীতের দুপুরে প্রায় নির্জন।অদূরে শুধুমাত্র কয়েকটি যানবাহন নজরে পড়ছে।
রোযা এক টানে তার মাস্কটি খুললো,ছুঁড়ে ফেললো পিছনের সিটে যেন আসমান চাইলেও নাগাল না পায়।

– কি করছ তুমি রো….
– হুশ!
অধরে তর্জনী ছুঁয়ে দিলো রোযা,তাতে দৃশ্যমানভাবে প্রভাবিত হলো আসমান। কোমর আঁকড়ে ধরা হাতগুলো অতিরিক্ত চাপে চেপে বসলো,স্পষ্ট অনুভব করলো রোযা, ঝুঁকলো অমানিশার তরে।
– আসমান। তুমি শুধু আমার চাঁদ নও,সেই চাঁদের কলঙ্কও। কলঙ্কবিহীন যেমন চাঁদ হয়না তেমনি অমানিশাবিহীন দীপ্তি হয়না।
চেয়ে থাকল আসমান,একদৃষ্টে। অনুভব করলে তার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন উদগীরণ ঘটছে আবেগের। সন্নিকটতা অসহ্যকর ঠেকছে।বাসনা হচ্ছে সামান্যতম দূরত্বও ঘুচিয়ে ফেলার।রোযার দুহাত চাপলো তার মুখায়বে।

– আলোর গুরুত্ব কেউ কোনোদিন উপলব্ধি করবেনা যদি সে আঁধার অনুভব না করে।
আরও একটু ঝুঁকলো দীপ্তি,তার শিশিরভেজা ঘাসের ন্যায় অধরের মাঝে সম্মোহিত হয়ে গেলো অমানিশা।
– তাই আমি তোমাকে কোনোদিন বদলাতে চাইনি।আমিও হয়ত বলতে পারতাম,ছেড়ে দাও,ফিরে আসো আমার তরে,আমার হাত ধরে বাঁচো আমার দুনিয়ায়।কিন্তু বলিনি,কেনো জানো?কারণ আমি অবহিত,যে গ্লানির স্রোতে তুমি সিক্ত হয়েছ তার মোচন অসম্ভব।সেই মোচনের ধৃষ্টতা তুমি দেখিয়েছিলে একবার,কিন্তু ভাগ্য নির্মমভাবে তোমায় তার শা*স্তি দিয়েছে।এই গ্লানি অস্তিত্বে চেপেই তোমায় বাঁচতে হবে,প্রতিটা মুহূর্তে অতীতের শক্তিরা তোমায় তাড়া করবে।মোকাবেলা,সংগ্রাম,প্রতিশোধ,টিকে থাকা,এই তোমার জীবনচক্র।আমি সবকিছু জেনেই আবদ্ধ হয়েছি তোমার বন্ধনে।
জ্বলজ্বল করে উঠলো রোযার নয়নজোড়া,অব্যক্ত অনুভূতির ফোঁটায়।

– তুমি যেমন আমি তেমনি তোমায় ভালোবেসেছি আসমান। তা হোক তোমার নমনীয়তা,হোক তোমার নিষ্ঠুর ভাগ্য,কিংবা হোক তোমার পৈশাচিকতা।তোমার ভালো মন্দের গুরুত্ব আমার কাছে সমান,প্রিয়।
কাপলো হৃদয়, বক্ষে উঠলো দুর্বার ঝড়।এক বিধ্বংসী অনুভূতির প্রবাহ উৎলে উঠে দুমড়ে মুচড়ে দিলো যেন কঠোরতার খোলসকে।ঝুঁকে এলো রোযা,নিকটের আবাহনে তেজস্বী অশ্বের গতিকেও হার মানালো আসমানের শীতলতোম হৃদযন্ত্র।

– আমি ভালোবাসি কলঙ্ককে, ভালোবাসি এই কলঙ্কের অধিপতি চন্দ্রকে।
বিড়বিড় করলো রোযা।সন্তপর্নে ছুঁয়ে দিলো আপন অধর,ঠিক আসমানের ঠোঁটের পাশে দাগে উদ্ভাসিত ত্বকে।কোমল স্পর্শ তার বয়ে চললো সেই কলঙ্কের দাগজুড়ে।যেন শোষণ করে নিলো তার মাঝ থেকে সবটুকু গ্লানি,পরিপূর্ণ করলো ভালোবাসায়।আবেশে চোখ বুজে এলো আসমানের, ভ্রুজোড়া ধারণ করলো তীব্র কুঞ্চন।বাম কপোল হতে রোযা ডান কপোলে ভিড়তেই তার অ্যাডামস অ্যাপেলে ঢেউ খেলিয়ে উত্তেজনা প্রবাহ বয়ে গেলো নিম্নে।দৃষ্টি মেললো, কোমরে রাখা হাত দুটো স্থির রাখা সম্ভবপর হলোনা।বেহায়া অন্তরের আস্কারায় তা বয়ে চললো, পিঠের মাঝে,কখনো বা নিচে। ক্ষণে ক্ষণে ভূকম্পন খেলে গেলো শরীরে,অনুভূতির গাঢ়ত্বে।একদম কানের নিকট পর্যন্ত দাগে অধর বুলিয়ে রোযা থামলো,দুর্বার হৃদযন্ত্র তার এই দুঃসাহসিক পদক্ষেপে রীতিমত বি*স্ফো*রিত হয়েছে যেন।মুখ তুলে তাকালো, কৃষ্ণগহ্বরের মাঝে বেজায় ধোঁয়াশা।তীব্র আকর্ষণের আকাঙ্ক্ষা।পুষ্ট অধরে তাকালো রোযা,একই সময়ে তার ওষ্ঠেও মোহময় দৃষ্টিপাত ঘটলো আসমানের।

উভয়েই আপন হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে।নীরবে যেন অনুমতির বিনিময় ঘটলো। ঝুঁকলো রোযা, সায় জানিয়ে মাথা তুললো আসমানও। দৃষ্টিজোড়া বুজে এলো রোযার অজানাকে আলিঙ্গনের আবেশে,কিন্তু ওই অধরের স্পর্শ অনুভব করার পূর্বেই অতর্কিতে তার ঘাড়ে চেপে বসলো আসমানের হাত।
এক প্রচন্ড ঝটকা!
আসমানের বুকে আছড়ে পড়লো রোযা।হতবিহ্বল হয়ে সামান্য মাথা হেলিয়ে তাকালো ভিন্নদিকে। মাত্রই অনুভব করেছে যেন কিছু একটা তার কানের পাশ দিয়ে শীষ বাজিয়ে গিয়েছে।তাকাতেই স্পষ্ট হলো ব্যাপারটি। গাড়ির জানালার কাঁচ ফাটলে পূর্ণ, মধ্যিখানে একটি ফুটো। ঝট করে আবার বিপরীত দিকে ফিরলো,জানালার ঠিক নিচের দিকে দরজার অংশে গেঁ*থে আছে…. বু*লে*ট!

ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া স্বরুপ রোযা উঠতে গেলো, কিন্তু আসমানের জোর প্রয়োগে সম্ভব হলোনা।নিজের বক্ষমাঝে সে আড়াল করে ফেললো রোযাকে, সুরক্ষিত বাহুডোরে চেপে মাথা নুইয়ে শুয়ে পড়ল সিটের উপরেই।সজাগ দৃষ্টি তার জানালার দিকে।সম্পূর্ণ বরফের মতন তাকিয়ে রইলো রোযা। সদা প্রস্তুত আসমানের হাত ক্ষীপ্র গতিতে গাড়ির বক্স থেকে বের করলো জিনিসটি,একটি সুইস না*ইফ।রোযার দিকে তাকালো চকিতে,
– হেড ডাউন।ওকে?
সম্মতি জানালো রোযা কিঞ্চিৎ বিহ্বল দৃষ্টিতে।আসমান ঝুঁকলো,তার কপালে প্রগাঢ় চুম্বন মেখে বিড়বিড় করলো,
– আমি আছি।

ডার্কসাইড পর্ব ৪০

এটুকুই।হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ীর বিপরীত প্রান্তের দরজা খুলে আসমান মাথা নুইয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।দরজা আটকে যেন সুরক্ষিত দেয়ালে আবদ্ধ করে গেলো প্রিয়তমাকে। সিটের উপর এলিয়ে দুহাতে মাথা চেপে একদম স্থির হয়ে থাকলো রোযা।অদ্ভুত হলেও সত্য তার ঠিক ভয় অনুভূত হচ্ছেনা।আসমান আছে, তার ভয় কিসের?
উহুম,শুধুমাত্র আসমান নয়,সে নিজেও আছে আসমানের পাশে।মোকাবেলা করবে একসঙ্গে।

ডার্কসাইড পর্ব ৪২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here