ডার্কসাইড পর্ব ৪৯

ডার্কসাইড পর্ব ৪৯
জাবিন ফোরকান

এক ঘন কালো আঁধার রাত্রি নেমেছে সমস্ত নগরজুড়ে।আজ এই ব্যাস্ততম নগরীও যেন ধারণ করেছে নিঃশব্দপুরীর প্রতিরূপ।প্রাণকেন্দ্র দোয়েল চত্বরের দগ*দগে ঘা যেন সবটুকু প্রফুল্লতা শুষে নিয়েছে।নগরবাসীর অন্তর পরিপূর্ণ হারানোর বেদনায়, ভীতির আতঙ্কে।শান্তির দেখা নেই কোথাও।আজকের সহিং*সতায় ঝরে গিয়েছে তিন তিনটি তাজা প্রাণ।যদি অনির্বাণ আহমেদের দূরদর্শীতাসম্পন্ন রিপোর্ট সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মজুড়ে প্রকাশিত না হতো তাহলে হয়ত এই আখ্যান অজানাই রয়ে যেতো সকলের।কেমন এক স্থবিরতা চারিদিকে।অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে সকলে। অভিভাবকগণ হারানোর ভয়ে পুনরায় তাদের সন্তানদের রাজপথে নামতে দিতে নারাজ।এই যেন আন্দোলনের সমাপ্তি।নিজেদের সত্যিকার রূপ প্রদর্শন করে ক্ষমতার দাপটে দমিত করার চেষ্টা চলছে এক নবজাগরণকে।এবং প্রতিপক্ষ অনেকাংশে সফল হয়েছে!

সরকার আজকের ঘটনার দায় বিরোধী দলের উপর চাপিয়ে উপযুক্ত তদন্তের আশ্বাস দিয়ে দায় সেরেছে।হতা*হতের পরিবারদের আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।কিন্তু অর্থ কি ফিরিয়ে আনবে মালিহাকে?চাকরিজীবী রাজিয়া খাতুনকে?কিংবা নাম না জানা পথশিশুটিকে?তাদের জীবনের দায়ভার কে নেবে?অর্থই কি সকল সমস্যার সমাধান?এই নগর আজ উত্তরহীন।ক্ষমতার প্রভাবে কুলুপ এঁটেছে প্রত্যেক মুখে,দুয়ার বন্ধ হয়েছে প্রত্যেক ঘরের।জোরপূর্বক সবকিছুকে স্বাভাবিক দেখানোর প্রচেষ্টা।এই নোংরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের যেন অমোঘ পরিণতি।সম্ভব নয় ন্যায়বিচার আদায়, হাল ছেড়ে দাও।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাত তিনটা বেজে বত্রিশ মিনিট।সম্পূর্ণ কক্ষজুড়ে শীতলতার আবহ।খোলা বারান্দা বেয়ে বয়ে চলা হিম প্রবাহ।শোষণ করে নিয়েছে যেন সবটুকু উৎফুল্লতা। ঘোর অমাবস্যার ঘুটঘুটে অমানিশায় আচ্ছাদিত ধরিত্রী,সামান্য রশ্মির উৎস নেই কোথাও।শূন্যতার অনুভব চারিদিকে।বিছানায় মুখোমুখি বসা দুই অস্তিত্ব, চাঁদ এবং তার জ্যোৎস্না।
আসমানের হাতের আঙুলের প্রান্তজুড়ে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিচ্ছে রোযা, অপর হাতে তার কাঁধের অংশে আলতো ছোঁয়ায় ঔষধের প্রলেপ দিতে ব্যাস্ত আসমান। একে অপরের ঘা*ত মোচনে সময় ব্যয়ে নারাজ উভয়ে। ব্যান্ডেজ সমাপ্ত হতেই অতর্কিতে ডুকরে কেঁদে উঠলো রোযা,নিঃশব্দে অশ্রুজল গড়ালো তার কপোল বেয়ে।আসমান তৎক্ষণাৎ তাকে টেনে নিলো আরো সন্নিকটে,কোলে তুলে আঁকড়ে ধরলো উভয় বাহুতে।সদ্য ব্যান্ডেজকৃত হাতটি বুলিয়ে নিলো পিঠে।নমনীয় কন্ঠে বললো,

– হুশ। কেঁদোনা জ্যোৎস্না,আমি আছি।
– মালিহা…. র*ক্ত…লাশ… আমি দায়ী!
ছন্নছাড়াভাবে উচ্চারণ করে গেলো রোযা।তাতে আসমানের ভ্রু কুঞ্চিত হলো, মুখাবয়বজুড়ে ব্যথিত অভিব্যক্তি প্রকাশ পেলো।আলিঙ্গনের জোর বাড়লো।
– তুমি দায়ী নও।
আসমানের কন্ঠ যেন গোত্তা খেয়ে ফিরে গেলো রোযার কর্ণগুহর থেকে।স্বাভাবিকভাবে চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা তার লোপ পেয়েছে যেন। অতল গহ্বরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।চারিপাশে শুধু লা*শ এবং লা*শ।এক বধ্যভূমি যেন।এর কেন্দ্রবিন্দুতে সে দন্ডায়মান,অসহায় এক অকার্যকর অস্তিত্ব।মুহুর্মুহু ভেসে আসা হাহাকার,আর্তনাদ,অভিসম্পাত।যেন এই দৃশ্যপটের কারিগর সে।কমতি হতে থাকলো রোযার সর্বাঙ্গ,সকল পলায়নের পথ যেন বন্ধ।এহেন আত্মগ্লানি থেকে কি পালানো আদও সম্ভব?

রোযার অবস্থা লক্ষ্য করে আসমানের ভ্রুজোড়ার কুঞ্চল বাড়লো।অন্তর সংকুচিত হয়ে এলো বেদনায়।নিজের শীতলতায় সে প্রশান্ত করতে অক্ষম তার জ্যোৎস্নাকে।গ্লানির ভার চেপে বসেছে তার অস্তিত্বজুড়েও।
– রোযা প্লীজ….
শুনলোনা অর্ধাঙ্গিনী,তার পিঠে আঁকড়ে বসলো আঙুলসমূহ।স্পষ্ট অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলো তীব্র যন্ত্রণার।আসমানের কৃষ্ণগহ্বর টলটলে হলো,তবুও জোরপূর্বক বাঁধ সাধলো অশ্রুর পথে।সে যদি ভেঙে পরে,তাহলে রোযার মনোবল গুঁড়িয়ে যাবে এক নিমেষে।হাত তুলে এবার প্রেয়সীর মাথায় ঠেকালো আসমান,আলতো চাপে নিজের মাঝে চেপে মৃদু কন্ঠে শুধালো,

– তোমার অশ্রুজলে আমায় আর কত বিদ্ধ করবে জ্যোৎস্না?
সামান্য থমকালো রোযা,আসমানের জন্য মুহূর্তটুকু যথেষ্ট।পুনরায় সে জানালো,
– তোমার যন্ত্রণা আমার পরাজয়,তোমার আত্মগ্লানি আমার ব্যর্থতা,তোমার অতৃপ্তি আমার অপূর্ণতা।আমায় এই গ্লানিতে জর্জরিত করোনা।
– আসমান…

– ভালোবাসি জ্যোৎস্না,খুব ভালোবাসি তোমাকে!নিজের অজান্তেই এই পাথর হৃদয় আমার তোমার তরে অনুভূতির লিপিতে খচিত হয়েছে।এই ভালোবাসার ভগ্নতা বড়ই অসহনীয়।
স্তব্ধ রোযা।যে বাক্যটি শোনার জন্য তার সমস্ত অস্তিত্ব ব্যাকুল থেকেছে,একটিবার মাত্র অনুভব করার উদ্দেশ্যে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে গিয়েছে,আজ এমন এক লগ্নে সেই অমোঘ অনুভূতির ঘোষণা তার অভ্যন্তরের সবকিছুর যেন বিলীন ঘটালো মুহূর্তের জন্য।মুখ তুলে আসমানের দিকে তাকালো সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে,জ্বলজ্বল করছে তার অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়া,যেন স্বপ্নের দুনিয়ায় রয়েছে।

– কি বললে তুমি?
– ভালোবাসি।
নির্দ্বিধায় জবাব দিলো অমানিশা। ঢোক গিললো রোযা,এখনো যেন বিশ্বাস করা দুষ্কর।
– আবার বলো।
– ভালোবাসি রোযা।
– আ…আরেকবার…
– জ্যোৎস্নার অনুভূতির নিবেদনে সিক্ত হয়েছে এই কলঙ্কিত চাঁদ।বিনাশ ঘটেছে আমার আরো একবার।চাঁদ তার জ্যোৎস্নাকে ভালোবাসে…..অমানিশা ভালোবাসে দীপ্তিকে…..
অশ্রু গড়ালো রোযার,তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উদ্দেশ্যে।আসমান তার নিকটে গেলো,অতি আবেগ নিয়ে চাইলো,জানালো,

– আসমান ভালোবাসে তার রোযাকে,এতটা গভীরভাবে যে রোযার অন্তরের অনুভূতির আঁচড়ও সহ্য করা দায়।
– অবশেষে?
সামান্য হাসলো আসমান,মাথা দোলালো।
– অবশেষে।
সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের মায়াজাল ছিন্ন করে আসমান এগোলো,রোযা কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পূর্বেই তার অধর দখলে নিলো নিজের। বাঁধা দিলোনা প্রেয়সী, প্রিয়তমর কেশগুচ্ছ আঁকড়ে ধরলো আঙুলের মাঝে।সকল অনুভূতি আজ বাঁধ ভেঙেছে যেন।আসমানের স্বীকারোক্তি তাদের উপাখ্যানকে রূপ দিয়েছে ভালোবাসার রূপকথায়।রোযা একা নয় আর, একপাক্ষিক ভালোবাসা নয় এটি, আসমানও তাকে ভালোবাসে!সবথেকে অপ্রীতিকর একটি মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত এই স্বীকারোক্তি, রোযাকে তার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে নয় কি?কে জানে অমানিশার অন্তরের মতিগতি!
দীর্ঘ একটি মুহূর্ত চললো অনুভবের বিনিময়।যেন একে অপরের মাঝের বিষাদটুকু শোষণ করে নিচ্ছে উভয়ে, পরিপূর্ণ করছে অন্তরকে শুধুমাত্র ভালোবাসায়।অবশেষে থামলো আসমান,খানিকটা দূরে সরে তাকালো অর্ধাঙ্গিনীর দিকে।চোখ বুজে আছে রোযা, তিরতির করে কাপছে তার সদ্য ছোঁয়া অধর।যেন এখনো আবেশ থেকে মুক্ত হতে পারছেনা। বৃদ্ধাঙ্গুলে সেই অধর ছুঁয়ে দিলো আসমান, দুর্বোধ্য আঁকিবুঁকি কেটে গেলো।ধীরে ধীরে দৃষ্টি মেললো রোযা।অস্ফুট এক ক্ষীণ হাসির ধ্বনি ভেসে এলো আসমানের কন্ঠ থেকে।

– লবণাক্ত।
ভ্রু তুলে দ্বিধা নিয়ে তাকালো রোযা,এমন মন্তব্যের অর্থ বুঝতে পারেনি।আসমান তাতে যেন বিনোদিত হলো,মাথা কাত করে বললো,
– চোখের পানিতে ঠোঁট ভিজিয়ে ফেলেছ।লবণাক্ত তো লাগবেই।
বিব্রত হলো রোযা, লালিমায় ছেয়ে গেলো তার চেহারা।সহসাই দৃষ্টি ফিরিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো,
– তো…তো…তোমাকে কেউ বলেছে…আমাকে… এখন…. ই….ইয়ে করতে?
– ইয়ে কি?
– ইডিয়ট!
হাসলো আসমান,খানিকটা শব্দ করেই।বিব্রত রোযাকে টেনে নিলো আলিঙ্গনে।বাধ্য শিশুটির মতন তার কাঁধে মাথা গুঁজলো রোযাও।হৃদস্পন্দন তার স্পষ্ট অনুভব করলো আসমান,অত্যন্ত দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে।

– রোযা।তোমাকে যা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবে।কেমন?
হঠাৎ পরিবর্তন ঘটলো আসমানের কন্ঠে,পূর্বের দুষ্টুমি নেই। তা যেন শুধুমাত্র রোযার সত্তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিলো।গভীরতা ধারণ করেছে কন্ঠ বর্তমানে।নমনীয়,অথচ প্রভাবশালী।
– সাবধান করেছিলাম পূর্বেই।যে কণ্টকাকীর্ণ পথে নেমেছ তা তোমাকে পুষ্প মালায় বরণ করবেনা।এই নিঃস্বতা,হারানোর বেদনা,অসহায়ত্ব সবেমাত্র সূত্রপাত।যদি লক্ষ্য অর্জন করতেই চাও,তবে এই র*ক্তস্রোতে ভেসেই বিজয়তরীকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।অন্যথায় বিফলতা।সংগ্রাম অথবা জীবন।সিদ্ধান্ত তোমার।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোযা,উষ্ণতা ছেয়ে গেলো আসমানের কাঁধ।
– নিজেকে কূলহারা পথিকের মতন মনে হচ্ছে তাইনা?গন্তব্যহীন,উদ্দেশ্যহীন।অন্তরে দ্বিধাদ্বন্দ্ব।এগিয়ে যাবো নাকি পিছিয়ে আসবো?প্রচণ্ড পীড়া দিচ্ছে অপরাধবোধ।রোযা,লড়াই করো।এই চিন্তার পঙ্গপালের সঙ্গে যু*দ্ধে তোমাকে বিজয় হাসিল করতে হবে।এ তোমার অন্তর্দ্বন্দ্ব।কোনো বহির্শক্তির অধিকার নেই তাতে হস্তক্ষেপ করার।বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি?

– হুম।বুঝতে পারছি আসমান।
মুখ তুললো রোযা,তার নয়নে বর্তমানে অশ্রু নেই, এক উষ্ম মনোভাব।
– যদি বিদ্রোহ করতেই চাও,তবে আত্মত্যাগের মনোভাব রাখতে হবে।তবে এই আত্মত্যাগের চাইতেও কঠিন আপনজনের ত্যাগ।
দৃষ্টি অদূরে ফেললো আসমান,বিড়বিড় করলো,

– আমি জানি রোযা,আমি সবটা বুঝি।নিজেকে ধ্বংস করার যন্ত্রণা অপরিসীম।আপন কষ্টে খেদ নেই,কিন্তু অপরের কষ্ট অসহনীয়।র*ক্ত যু*দ্ধের এই খেলায় গ্লানির কোনো স্থান নেই।যে চলে গিয়েছে,সে উৎসর্গ করেছে নিজেকে এক নতুন ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে।অন্য কাউকে গ্লানি বহন করার জন্য সে প্রাণ বিসর্জন দেয়নি রোযা।
এক মুহুর্ত নীরব থাকলো জ্যোৎস্না,অতঃপর মাথা দোলালো।

– ধন্যবাদ আসমান।আমাকে প্রেরণা দেয়ার জন্য।আমি উপলব্ধি করেছি,নিজের পথ এবং গন্তব্য দুটোই আমার কাছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার।আমি আর কাঁদবোনা।চিন্তা করোনা।তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করার জন্য দুঃখিত।
ঝুঁকে আসমানের কপালে চুম্বন এঁকে দিলো রোযা।সাদরে তা গ্রহণ করলো অমানিশা।তারপর রোযাকে বুকে টেনে বিছানায় শুয়ে পড়লো।কম্বল তুলে উষ্ণতায় মুড়িয়ে ফেলে বিড়বিড় করলো,
– বিশ্রাম নাও।একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।আমি আছি তোমার পাশে।
– ভালোবাসি আমার চাঁদ।
– ভালোবাসি আমার জ্যোৎস্না।
কিঞ্চিৎ হাসি মেখে নয়ন বুজলো রোযা,তার সর্বাঙ্গে স্বামীর প্রশান্তিদায়ক ছোঁয়া বইতে থাকলো।শুধুমাত্র প্রশান্তি নয়,তার এই আলিঙ্গন যেন নিরাপত্তার আশ্বাস।সামান্যতম আঁচ আসতে দেবেনা সে প্রিয়তমার উপর।

সময়টা বিকালের কাছাকাছি প্রায়।দিবাকর মাঝগগন থেকে যাত্রা করেছে পশ্চিমের উদ্দেশ্যে।শীতের আবহে আবহাওয়া গুমোট মাখা।আজকের দিনটি যেন অশুভ।গাঢ় কুয়াশার আচ্ছাদনে ঢাকা ছিল সমস্ত নগর।নগরবাসী অবশ্য বাধ্য হয়ে কর্মে লিপ্ত হয়েছে, তবুও তাদের অন্তর পরে রয়েছে রাজপথজুড়ে।যে সড়ক এখনো পর্যন্ত ফাঁকা।নেই কোনো কোলাহল, কোনো মিছিল,নেই স্লোগানের প্রতিধ্বনি।কেমন যেন খাঁ খাঁ মরুভূমি।তবে কি হেরে গেলো ন্যায়?শুধুমাত্র দীর্ঘশ্বাস উত্তর দেয়।ঠিকই তো।ক্ষমতা ন্যায়ের লড়াইয়ে ক্ষমতা বিত্তের জিৎ এক অলিখিত ইতিহাস।এই ইতিহাস বদলায় সাধ্য কার?

এমন দিনেও ক্লাবটির অভ্যন্তর ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন। বায়ুজুড়ে তামাকের ঘ্রাণ,সঙ্গে অ্যালকোহলিক বেভারেজে পরিপূর্ণ তাক।অতিথির কমতি নেই।অন্য সময় উপস্থিতি কম থাকলেও দেশের বর্তমান অস্থিতিশীল অবস্থায় সকলেরই আগ্রহ তুঙ্গে।সামান্যতম খবরও যেন হাতছাড়া করতে নারাজ।যেহেতু মিডিয়ায় শুদ্ধ খবর প্রকাশিত হয়না সেহেতু এই ক্লাবই যেন একমাত্র ভরসা।সরকারদলীয় এবং সমর্থক সব রাঘব বোয়ালদের মিলনমেলা এটি।বারের বিপরীত প্রান্তে নিগূঢ় খয়েরী বর্ণের সোফায় হাঁটু তুলে বসে আছে রাফা কায়সার।হাতে তার টকটকে ওয়াইনের গ্লাস,দুই আঙ্গুলের ফাঁকে ধরা আধখাওয়া বেনসন।বিপরীত প্রান্তে বসা সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং খাদ্য উভয় মন্ত্রী যে যথেষ্ট ক্লান্ত এবং তটস্থ তা তাদের চেহারায়ই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। রাফার উরুজুড়ে হাত বোলাতে থাকা দিমিত্রী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে উভয়কে।
দীর্ঘ অস্বস্তিকর মুহূর্তের পর অবশেষে মুখ খুললো রাফা।ওয়াইনের গ্লাসটি দিমিত্রীকে ধরিয়ে দিয়ে ওষ্ঠে সিগারেট ছুঁইয়ে বললো,

– সবকিছু তো পরিকল্পনামাফিকই যাচ্ছে।আপনাদের চেহারা এত মলিন কেনো মন্ত্রী সাহেব?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইকবাল আহসানের কপালে চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হলো।বিতৃষ্ণা খচিত দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন রাফার দিকে,
– কি বলতে চাইছো তুমি?
– আন্দোলনকে দমানোর পরিকল্পনার কথা বলছিলাম।
নির্বিকার জবাব দিলো রাফা, আরো একবার সিগারেটে মনোনিবেশ করলো।ইকবাল সাহেবের অভিব্যক্তি ঘৃণায় পরিপূর্ণ হলো, দাঁতে দাঁত চেপে থাকলেন।পাশে বসা খাদ্যমন্ত্রী জোবায়দা খাতুন শুধুমাত্র নীরব পর্যবেক্ষণ করছেন।বাঘা খেলোয়াড়দের মাঝে হস্তক্ষেপ করার মতন মহাবোকা নন তিনি।
– বিরোধী দলের উপর দোষ চাপিয়ে ইতোমধ্যে সরকার চাপে আছে।তার উপর জুটেছে এক উজবুক সাংবাদিক।দমানো যায়না।এর তাগড়া তাগড়া রিপোর্টে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষিত হচ্ছে।আর তুমি বলছো সব পরিকল্পনামাফিক চলছে?
হাসলো রাফা, দিমিত্রীর বাহুতে হেলান দিয়ে মাদকীয় কন্ঠে শুধালো,

– হোয়াই সো সিরিয়াস ম্যান?জাস্ট চিল।
– চিল করার সময় এটি নয়।আন্দোলন বন্ধ হয়েছে কিন্তু কি মূল্যে?
– ঠিক ততটাই নিশ্চয়ই যতটা আপনারা পরিশোধ করতে পারবেন।জাগতিক নিয়ম,কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়।
জোবায়দা অধরে অধর চেপে ধরলেন।এই রমণী এক ধোঁয়াটে চরিত্র,যার সঙ্গে কথপোকথন কিংবা লড়াই কোনোটাতেই যেন জিৎ হাসিল করা সম্ভব নয়।আপন জগতের মহারাণী সে।অপরের জগতে পদার্পণ করে রাজত্ব করার অশুভ ক্ষমতার বীজ বোনা তার অস্তিত্বে।ইকবাল সাহেব আনমনে কিছুক্ষণ ভাবলেন, হুইস্কির গ্লাস তুলে চুমুক দিয়ে বিড়বিড় করলেন,

– জিশানের মাথায় এমন পরিকল্পনা আসার কথা নয়।নিজের ছেলেকে আমি চিনবোনা?এর মূল কারিগর কি….
– রাফা কায়সার।
বজ্রকণ্ঠটি এক নিমেষে যেন ধর থেকে প্রাণপাখি টেনে নিয়ে আবার ছেড়ে দিলো।সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে সামনে তাকালেন ইকবাল।শুধুমাত্র তিনিই নয়,বরং উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তিত্ব হতবিহ্বল এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে আগন্তুকের উদ্দেশ্যে।
মুখোমুখি আসনের ডান পাশের ফাঁকা সোফায় বসলো অতর্কিত অপ্রত্যাশিত আগন্তুক।পরিধানে ক্যাপুচিনো বর্ণের শার্ট এবং কার্ডিগান,ফরমাল প্যান্টে স্বর্ণালী নেকড়ের মুখচ্ছবি সংলগ্ন বাকলের বেল্ট।পায়ের বুটজোড়ার ভারী এবং উঁচু সোলের অধিকারী।মুখে যথারীতি মাস্ক, দৃষ্টিজুড়ে শোষণীয় কৃষ্ণগহ্বর।পায়ের উপর পা তুলে সে সোফায় শরীর এলিয়ে রাজকীয় এক ভঙ্গিতে বসলো। হাতলে কনুই ঠেকিয়ে তর্জনী কপালে ছুঁয়ে এমন অভিব্যক্তি নিয়ে বাকি সকলের উদ্দেশ্যে তাকালো যেন পরাশক্তিদের মহারাজ তার তুচ্ছ প্রজাদের দেখছে এমন হাসছে আপনমনে,চাইলেই এক তুড়িতে যাদের বিনাশ ঘটাতে সক্ষম সে।

– আস….মান!
এতটা ক্ষীণভাবে উচ্চারণ করলেন ইকবাল যে নিজের কন্ঠ নিজেরই কর্ণগোচর হলোনা।জোবায়দা বান্দাকে ঠিক চিনতে পারেননি,তাই তাকালেন ইকবালের দিকে, ভয়ার্ত এক মুখাবয়ব তাকেও আতঙ্কিত করে তুললো।কে এমন এই যুবক?যার অস্তিত্ব এতটা অসহনীয়?
– বাহ্।তোমার কন্ঠে আমার নামটা দারুণ শোনায়। মধুর চাইতেও সুমিষ্ট।
রাফার কন্ঠ সকলের এক সতর্ক এবং অস্বস্তিকর অবস্থায় ছেদ ঘটালো।খানিকটা বেমানান ঠেকলো তা এমন গম্ভীর পরিস্থিতিতে।মেয়েটির কথায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালো আসমান, বললো,
– কি দুর্ভাগ্য আমার!

রাফা বিব্রত না হয়ে তীর্যক হেসে কিছু উচ্চারণ করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার হাত থেকে অতর্কিতে ওয়াইনের গ্লাসটি উধাও হলো।ঝট করে উপরে চেয়ে এক সুউচ্চ বান্দাকে দেখা গেলো।ডেনিম জিন্স জ্যাকেটে আচ্ছাদিত সর্বাঙ্গ,কানে ঝুলন্ত লম্বাটে একটি ছোট পালক সম্বলিত দুল,সুদর্শন তীক্ষ্ণ চেহারায় জড়ানো কৌতুকপূর্ণ মনোভাব।
– আজকাল সাপের কাছেও বিষ ব্যতীত কিছু মধুমিষ্টি লাগছে দেখছি!
রাফার ওয়াইনের গ্লাসটিতে চুমুক দিলো নিহাদ, তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে থু করে ফেললো সবটা পুনরায় গ্লাসেই।
– হুম… হোয়াট আ পার্ফেক্ট ভেনোমাস স্নেক ইউ আর… ম্যাম!
বিস্তৃত এক হাসি নিয়ে রাফাকে গ্লাসটি ফিরিয়ে দিলো নিহাদ,যেন কিছুই হয়নি।বিতৃষ্ণায় সেটি স্পর্শও করলোনা রাফা,শুধু মুষ্টিবদ্ধ হলো তার হাত। দিমিত্রী ব্যাপারটা খেয়াল করে সহসাই চেপে ধরলো নিহাদের হাতখানি।ইংরেজিতে বলে বসলো,

– হাউ ডেয়ার ইউ টু বিহেইভ লাইক দ্যাট উইথ মাই উইম্যান?
ভ্রু কপালে তুলে নিহাদ মিটিমিটি হাসলো,
– বাঙালিদের অশিক্ষিত মনে করেন নাকি রাশিয়ান ভাইজান?ব্রিটিশ তাড়িয়েছি বলে কি ইতিহাস ভুলে গিয়েছি? মাই কারেইজ নোস নো বাউন্ড…. মিস্টার ভলকভ!
নিজের হাত অত্যন্ত জোরের সহিত ছাড়িয়ে নিলো নিহাদ,তারপর ঘুরে গিয়ে দাঁড়ালো আসমানের সোফার গায়ে হেলান দিয়ে।বুকে দুবাহু ভাঁজ করে রেখে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ চালালো স্থানজুড়ে।ইকবাল সাহেব সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করছেন সবকিছু।

– তুম…তুমি এখানে?
অবশেষে আসমানকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।তাতে অমানিশা তার দিকে মনোনিবেশ করল,মাস্কের অন্তরালে তার কপোলজোড়া সামান্য কুঞ্চিত হতে দেখা গেলো।আসমান কি হাসছে?অসম্ভব!
– কি করবো বলুন?কিছু দাম্ভিক বন্য পশু গদি দখল করে বসে আছে।টেনে হিঁচড়ে না নামানো পর্যন্ত শান্তি দিচ্ছেনা।
স্পষ্টত একটি ঢোক গিললেন ইকবাল।সোজা হয়ে শিরদাঁড়া টানটান করে মন্ত্রী সাহেবের মুখোমুখি হলো আসমান।
– আপনার প্রভুরা বোধ হয় ভুলে গিয়েছে কার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাকে ধ্বং*সের নিশ্চিত ব্যর্থ সাধনায় মেতেছে তারা।
এক নজর রাফার উপর দৃষ্টি স্থাপিত হলো আসমানের, তা সরিয়ে নিয়ে মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলো,

– স্বয়ং ধ্বংসাধিপতিকে ধ্বংস করা যায়না মিস্টার হোম মিনিস্টার,জানিয়ে দেবেন আপনার সরকারকে।
কোনো উচ্চবাচ্য করা সম্ভবপর হলোনা।নিঃশব্দ দৃষ্টি বিনিময়।আসমানের প্রভাবশালী উপস্থিতি সকলের অস্তিত্বে অদ্ভুত এক অশুভের আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছে।যদিও কিছুই করছেনা সে,শুধুমাত্র বসে আছে।কিন্তু তার তীব্র অমানিশার অভিব্যক্তিই যথেষ্ট।একমাত্র রাফা কায়সার নির্বিকার।ক্ষমতার চাইতেও ক্ষমতাবান এই নিটল হিমালয়ের প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত সে।হোক সে তার বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে,তবুও তার এমন শিহরণ জাগানিয়া প্রদর্শন রমণীর অন্তরে দোলা দিলো।গর্ববোধ করলো সে,বিনা কারণেই।হেলান দিয়ে একদৃষ্টে পলকহীন চেয়ে থাকলো অমানিশার দিকে।
নিহাদ নিজের বেল্টে গুঁজে রাখা একটি নোটপ্যাড অতি অবহেলায় ছুঁড়ে দিলো সামনের টেবিলে।তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো চারিদিকে।কিছু ফটোকার্ড, ছবি,সংবাদপত্রের কাটিং এমনকি ছোট মেমোরি কার্ড পর্যন্ত।ব্যাপারটিতে দ্বিধান্বিত হলেন ইকবাল সাহেব।জোবায়দা ঝুঁকে তা পর্যবেক্ষণ করেই সম্পূর্ণ স্থির হয়ে গেলেন।

– এ…এসব…
– সরকার এক সময়কার কি*লিং মেশিনকে ব্যবহার করে যত যত নেতা,কূটনীতিক এমনকি বিদেশী সরকারবিরোধী শক্তিদের হটিয়েছে তার রেকর্ডের এক ঝলকমাত্র।সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রিলিজ পায়,এই ক্ষমতার গদির কি হতে পারে বলুন তো?
আসমানের বজ্রকন্ঠ যেন কাপন ধরিয়ে দিলো অন্তরে।সামান্য নড়চড় সম্ভব হলোনা। রাফা ভীষণ উপভোগ করছে বিষয়টিকে।অতি উৎসাহে মুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করতে করতে সিগারেট ফুঁকে চলেছে সে।ইকবাল সাহেব টেবিলের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– তুমি কি আমাদের ব্ল্যাকমেইল করছো?
– মেইবি…. অওর মেইবি নট?খেলাটা আপনারাই শুরু করেছেন,আমি তো শুধুমাত্র আমার পাল্টা চাল দিলাম হোম মিনিস্টার!
ঢোক গিললেন ইকবাল,নয়ন তুলে তাকালেন আসমানের দিকে।শক্ত কন্ঠে শুধালেন,

– তোমার স্ত্রী নেতৃত্ব দিচ্ছে আন্দোলনের।এসব কি তারই জন্য?
দৃশ্যমানভাবে থমকালো আসমান।অতঃপর অতর্কিতে ঘটলো ঘটনাটি। ক্ষীপ্র গতিতে এগোলো নিহাদ,যেন ওৎ পেতে থাকা কোনো লিওপার্ড। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কন্ঠতালুতে ঠেকলো ধা*রালো ব্লে*ডের ফলা,ধাতব স্পর্শে শিউরে উঠলেন তিনি।বাকি সকলে হতভম্ব। রাফাও প্রথমবারের মতন খানিকটা বিচলিত হলো।এই ক্লাব এতটাই সুরক্ষিত যে অ*স্ত্র নিয়ে প্রবেশ এক প্রকার দুরূহ।অথচ নিহাদ তা সম্ভব করে দেখিয়েছে।কিভাবে?
গোলযোগের মাঝে একদম প্রশান্ত আসমান।স্থির চেয়ে আছে সে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে।নিহাদের সুচারু দৃষ্টি মন্ত্রীর ভয়ার্ত চেহারায় আবদ্ধ।এক হুকুমে সে বিনাশ ঘটাতে প্রস্তুত।তথাপি সেই হুকুম এলোনা, এলো এক হু*মকি।আসমানের কন্ঠস্বর যেন পরাশক্তিদের আমন্ত্রণে ধারণ করলো তীব্র ব্যাপ্তি।

– রাজপথে যদি আর এক বিন্দু র*ক্তপাত হয়,আমলা মন্ত্রীদের দপ্তর বধ্যভূমিতে পরিণত করবে নেমেসিস।সাবধানবাণী স্মরণে রাখবেন।
উঠে দাঁড়ালো আসমান,পরিধানের কার্ডিগান টেনে ঠিকঠাক করে নিলো। নিহাদও ব্লে*ড সরিয়ে পিছপা হলো,নিকটে গেলো আসমানের।একদম বরফের ন্যায় বাকরুদ্ধ চেয়ে সকলে।সম্মোহনী এক প্রভাব থেকে যেন নিজেদের কিছুতেই মুক্ত করা সম্ভবপর হচ্ছেনা।

– তুমি নেমেসিস?
রাফার কন্ঠে ধ্বনিত হলো প্রশ্নটি,কিছুটা বিস্ময় এবং মুগ্ধতার ব্যাকুল অনুভূতি মেশানো তাতে।মাথা কাত করে তাকালো আসমান,জবাব দিলোনা। রাফা দন্ডায়মান হলো,ধীরপায়ে এগোলো তার উদ্দেশ্যে।মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,

– তুমি কি এই আন্দোলনের পক্ষে?কই?আগে তো কখনো অন্যের প্রতি এতটা দরদী হতে দেখিনি।কোথায় সেই পুরাতন অনুভূতিহীন মেশিন?তার জায়গায় এক ন্যায়ের অবতারকে কেনো দেখতে পাচ্ছি?
– পক্ষ কিংবা বিপক্ষ….আমি কোনো প্রান্তেই নই।কিন্তু খোলা ময়দানে নিরস্ত্রের বিপরীতে ব*ন্দু*ক উঠলে তার প্রতিক্রিয়ায় কা*মান দাগবো আমি,আমার স্বভাব এবং বৈশিষ্ট্য আগের মতই আছে ম্যাম!
বুকের মাঝে এক শিহরণের উপস্থিতি টের পেলো রাফা।এই আসমান তার চেনা হয়েও যেন বড্ড অচেনা।অনুভূতিহীন ছিল, নির্বিকারতা এবং শূন্যতা খচিত অস্তিত্ব।বর্তমানে?যেন ধ্বংসেরও অতীত।কোন সময়ে কোন রূপ ধারণ করবে তা বোঝা মুশকিল।সময় ব্যয় করলোনা আসমান, রাফাকে পাশ কাটিয়ে এগোলো বেরোবার উদ্দেশ্যে।ঠিক তখনি রাফার কন্ঠ তাকে পুনরায় থমকালো।

– এসবকিছু কি ওই মেয়েটার জন্য?তোমার এতটা তাণ্ডবের যোগ্য ও?আমার সামনে ওই মেয়ে একটা কীটপতঙ্গ,যাকে চাইলেই দু আঙ্গুলে টি*পে নিঃশেষ করতে….
রাফা বুঝেও উঠতে পারলোনা কি হচ্ছে। দ্রুতিসম্পন্ন আসমানের হাত পেঁচিয়ে গেলো তার গ্রীবায়,কন্ঠরোধ করে ফেললো সম্পূর্ণ।উত্তেজিত হয়ে ছুটে আসা দিমিত্রীর পথরোধ করলো হিমালয়ের শিষ্য পর্বতসম অটল নিহাদ। বিপদসংকেত ঝুলন্ত তার সুদর্শন চেহারায়। মুহূর্তের গাঢ়ত্বে হতবাক সকলে।বারের কর্মচারীগণ একপাশে সরে গিয়ে কাপতে কাপতে দৃশ্যপট পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।এর পূর্বে এই স্থানে এতটা ঔদ্ধত্য কাউকে প্রকাশ করতে উপলব্ধি করেনি তারা।ঠিক কতটুকু দুঃসাহসী কিংবা ক্ষমতাবান এই ব্যক্তি?বোধগম্য হলোনা তাদের।

রাফার শরীর মেঝে হতে রীতিমত শূন্যে তুলে ফেললো আসমান ইঞ্চি দুয়েক, তীর্যক হাসি নিয়ে চেয়ে থাকলো রমণী।এই ধ্বংসের খেলা যেন ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার।আসমানের কৃষ্ণগহ্বর প্রজ্জ্বলিত হলো অশুভ অগ্নিতে, রাফার অধরের হাসি মুছে দিয়ে ধ্বনিত হলো অমিত কন্ঠস্বর।

– অতীতের জন্য যদি আমি নিজেকে ধ্বংস করতে পারি,তবে বর্তমানের জন্য আমি এই পৃথিবী ধ্বংস করতে প্রস্তুত!মাইন্ড ইট…. কায়সার!
সহসাই রাফাকে ছেড়ে দিলো আসমান,রমণীর শরীর ভারসাম্য হারিয়ে ধপাস করে পড়লো মেঝেতে। পরোয়াও করলোনা।কারো প্রতি সামান্য দৃষ্টিপাত না করে হনহন করে এগোলো আসমান,অপরদিকে সকলের পানে এক নজর ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকে অনুসরণ করলো নিহাদ।তারা বেরিয়ে যেতেই অদ্ভুত এক শূন্যতা ভর করলো সেখানে,ক্ষমতার শূন্যতা। দিমিত্রী দৌঁড়ে গেলো রাফার উদ্দেশ্যে,কিন্তু নিজেকে স্পর্শ করতে দিলোনা রমণী।সোজা হয়ে বসলো মেঝেতেই,তারপর অধরজুড়ে হাসি ফুটলো তার। খিলখিলে হাসির ধ্বনিতে পরিপূর্ণ হলো চারিপাশ।অদ্ভুতুড়ে সেই দৃশ্যের দিকে অবাক নয়নে চেয়ে থাকল সকলে।

দোয়েল চত্বর।
গোধূলী লগ্ন।দিবাকর ঢলে পড়েছে পশ্চিম প্রান্তে।সোনালী আভায় উদ্ভাসিত করে ধরিত্রীকে,যেন আহ্বান জানাচ্ছে অশুভ আঁধারকে।কেমন আবদ্ধ পরিবেশ।হিমের ছোঁয়ায় কুয়াশাচ্ছন্ন চারিপাশ।আলোর বড়ই অভাব যেন।এর মাঝেই ব্যারিকেডের ওপাশে অলস সময় যাপন করছে পুলিশ বাহিনী।গতকালের দক্ষযজ্ঞের রেশ এখনো কাটেনি। প্ল্যাকার্ড, শুষ্ক র*ক্ত ছড়ানো রাস্তাজুড়ে। ইট পাথর, ভাঙা জিনিসপত্র,ছিন্ন বস্ত্র,অভাব নেই কোনকিছুর।দৃশ্যপটে তাকিয়ে হাই তুলছে একজন পুলিশ। অপর সদস্য বলে বসলো,

– ধুর।শুধুশুধু আমাদের সারাটা দিন অপেক্ষা করালো।সবগুলো পালিয়েছে।ভুলেও রাস্তায় নামবে না।
– আরে কর্মসূচি আছে না কি?আলোর মিছিল?হাহা… অন্ধকার হয়ে গেলো ওদের আলোর দেখা নেই।
– কেন যে করতে যায় এসব।মা বাবার বুক খালি করে দরকার কি?
– সেটাই।মানুষ আমাদের জানো*য়ার ভাবে,কিন্তু আমাদেরও তো হাত পা বাঁধা।আমার মেয়ে এমন করলে একটা থা*প্পড় দিয়ে ঘরে আটকে রাখতাম।
– আপনার হাত পা বাঁধা না,আপনি কাপুরুষ।
কটমট করে তাকালো উভয়ে,অপেক্ষাকৃত কমবয়সী পুলিশ সদস্য নির্বিকার দন্ডায়মান।দৃষ্টি তার সুদূরে, দিগন্তের পানে।

– খুব পাখনা গজিয়েছে না?সিনিয়র আমি তোমার!একটা কমপ্লেইন করলে….
– করুন।আমি এমনিতেই আগামীকাল চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।দরকার হয় মান সম্মান নিয়ে জিনিস ফেরি করে সংসার চালাবো,তবুও কারো গোলামী করবোনা।
– ন্যায় ফুটাও?বেশি তেজ না শরীরে?করো ফেরি, এরপর যখন বাচ্চার মুখে দুই লোকমা ভাত দিতে হিমশিম খাবে তখন বুঝবে।শা*লা!
হাসলো সে।মাথা কাত করে বললো,
– এট লিস্ট আমার বাচ্চাকে মানুষ বলবে ফেরিওয়ালার সন্তান,গোলামের সন্তান না!
পাল্টা প্রতি উত্তর সম্ভব হলোনা।এর পূর্বেই অদূরে একটি দৃশ্য সকলের নজর কেড়ে নিলো।
ঠিক বিপরীত প্রান্ত ধরে হেঁটে আসছে এক ললনা।শুভ্র শাড়ি তার সর্বাঙ্গে জড়ানো।দুহাত সামনে মেলে ধরা, তাতে শোভা পাচ্ছে একটি প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা। শিখাকে ঘিরে মাধুর্যের বিচরণ,কারুকার্যের খাচের ভাঁজে ভাঁজে উদ্দীপ্ত মনোভাব জড়ানো।একমাত্র একাকী সে।নেই কেউ অনুসরণে।

– এটা…ওই মেয়েটা না?
– রোযা রেমান!এই মেয়ের এখনো শিক্ষা হয়নি?
– কেউ আসেনি দেখছি,একাই।একলা মানুষ কি আর মিছিল করতে পারে?
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সকলে একমাত্র যুবক ছাড়া।তার দৃষ্টি আবদ্ধ,চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে ক্রমশ।সে নিশ্চিত,ঐক্য কখনো একা থাকেনা।এ যেন ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস।

অত্যন্ত ধীরপায়ে এগোচ্ছে রোযা।তার মাঝে কোনোপ্রকার তাড়া নেই।নয়ন তার সুদূর ব্যারিকেডের দিকে। ভাঙা সম্ভব নয় তার একলার পক্ষে।তবুও অগ্রসর হচ্ছে সে দৃঢ়চিত্তে।সাবিহা,অভিষেক এবং আন্দোলনকারীদের সকলের উপর প্রচণ্ড পারিবারিক বাঁধা এসেছে।তাদের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত।অভিভাবকদের দোষ দেয়া যায়না।সন্তানদের নিরাপত্তা তাদের মোক্ষম চিন্তা।কিন্তু তাই বলে কি রোযা থেমে যেতো?উহু,আজ যদি এই কর্মসূচি সফল না হয়,যদি ওই দুর্বোধ্য ব্যারিকেড বিদ্রোহের তোড়ে গুঁড়িয়ে না যায় তবে এখানেই সমাপ্তি।ন্যায় মুখ থুবড়ে পড়বে ক্ষমতার সম্মুখে।যা হতে দেয়া অসম্ভব। প্রয়োজনে যদি একলা লড়াই চালাতে হয়,রোযা তাতেও রাজী।গতকাল রাতে আসমানের বক্তব্য তার মাঝে আত্মবিশ্বাস পরিপূর্ণ করেছে।যে উপাখ্যানের সূচনা সে ঘটিয়েছে তা মাঝপথে ছাড়ার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়না,এর সমাপ্তি টেনে তবেই ক্ষান্ত হবে তার অতৃপ্ত অন্তর।আজ যদি সে হেরে যায়,তাহলে হেরে যাবে সব অহনারা,মালিহারা।

– মা!
অতর্কিতে থমকালো রোযার পদক্ষেপ।আপন চিন্তা এবং লক্ষ্যে এতটাই মনোযোগী ছিল সে একপাশ থেকে এগিয়ে আসা ব্যক্তিবর্গকে তার নজরেই পড়েনি।ডাক শুনে তাকাতেই তার দৃষ্টি প্রসারিত হলো।এক বৃদ্ধা,এবং তার সঙ্গী এক যুবতী মেয়ে।উভয়ের হাতে একটি করে মোমবাতি,যা এখনো জ্বালানো হয়নি।
অহনার মা!
উপলব্ধিটি রোযার সর্বাঙ্গে শিহরণ খেলিয়ে দিলো।তাকে দূর থেকে একবার বিলাপ করতে দেখেছে সে, ওইটুকুই যথেষ্ট ছিল প্রেরণায়।তার এমন সরাসরি উপস্থিতি কাম্য করেনি সে,এই মানুষটাকে সংগ্রামে টেনে বিপদে ফেলতে ইচ্ছুক ছিলনা।তিনি এগিয়ে এলেন,রোযার মুখোমুখি দাঁড়ালেন।একটি হাত বাড়িয়ে মাথায় স্নেহ বুলিয়ে হাসলেন,

– আমার আম্মাজানের লাইগ্যা তোমরা জীবন দিসো মা,তোমাগো সাথ আইজ থাইকা আমিও দিমু।আমার আম্মাজান দেখবো… ওর লাইগ্যা কত্ত বড়ো মিছিল বাইর হইসে শহরে!
টলটলে করে উঠলো তার দৃষ্টি, রোযা নিজের নয়ন শুষ্ক রাখতে সক্ষম হলোনা।যুবতী মেয়ে এগিয়ে অহনার মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
– উনি আমাদের বাসায় কাজ করতেন।এখন আমাদের সাথেই থাকেন।এতদিন চুপচাপ সবকিছু দেখেছি।কিন্তু এখনো চুপ করে থাকা অসম্ভব।একজন নারী হিসাবে নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবোনা নিজেকে তাহলে।আমি তৈরি হয়ে আসার সময় উনিও খুব করে আসতে চাইলেন।আপনাকে দেখার প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল তার।

– ধন্যবাদ।
– আপনি একা নন,আমরাও আছি আপনার সাথে এই আলোর মিছিলে।অহনা দেখুক,তার তরে কতজন অহনা আজ রাস্তায় নেমেছে।
রোযা এতটাই আপ্লুত যে আর কিছু উচ্চারণ সম্ভব হলোনা তার পক্ষে।তার পূর্বেই একটি পুরুষালী কন্ঠস্বর শোনা গেলো।
– রোযা?
পিছনে ফিরে দ্বিতীয় দফায় বিস্মিত হতে হলো রোযাকে।মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমির প্রফেসর জাহিদ দন্ডায়মান সামনে,তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী।উভয়ের হাতেই প্রদীপ।বিস্তর হেসে এগোলেন জাহিদ,
– আমার স্টুডেন্ট গতকাল রাজপথে প্রাণ দিলো।এরপরও যদি আমার চিত্ত না নড়ে,তবে আমি শিক্ষক নামের কলংক!আমি, আর আমার বোনটি তোমার পাশে আছে রোযা।তুমি একা নও।

– স্যার….!
ভেঙে এলো রোযার কন্ঠস্বর।জাহিদ মৃদু হেসে তার কাঁধ চাপড়ে দিলেন।বহু কষ্টে অশ্রু দমন করলো রোযা।এখনো সবটা স্বপ্ন লাগছে।একাকী থেকে সে বর্তমানে পাঁচজনে পরিণত হয়ে গিয়েছে।সৃষ্টিকর্তার কি লীলাখেলা!
– আরে।আমরা কি একটু দেরী করে ফেললাম নাকি?বলেছিলাম এত ঝিংকু সাজার দরকার নেই।দিলে তো দেরী করিয়ে!
নিহাদের মাথায় এটা চাটি দিলো চারুলতা। উভয়ে ঠেলাঠেলি করতে করতে এগিয়ে আসছে।সবাই কিছুটা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকলো।নিহাদ রোযার সামনে এসে থেমে এক ঝলক হাসি উপহার দিয়ে জানালো,
– আরে ফুলটুশী! ভাবলে কি করে তোমাকে একলা ছেড়ে দেবো? আফটার অল…
নিজের নাকেলস পরিহিত হাতে চুমু খেয়ে নিহাদ দূরে ব্যারিকেডের দিকে চেয়ে তীর্যক হাসলো।

– আই লাভ ক্যাওস!
– অ্যাণ্ড আই লাভ টু কিক অ্যা*সেস!
নিজের শার্টের লম্বাটে হাতা গোটাতে গোটাতে ঘোষণা করলো চারুলতা।এই দুই মারকাটারি চরিত্রকে লক্ষ্য করে বাকিরা একইসঙ্গে বিনোদন এবং দুঃসাহস অনুভব করলো।
– চলো খেলা শুরু করা যাক!
নিহাদের কথার বিপরীতে একটি বাইক এসে থামলো চাকার কর্কশ আর্তনাদ তুলে।বাইকারোহী তৎক্ষণাৎ নিহাদের ঈর্ষার কারণ হলো।হেলমেট খুলে লাফিয়ে নামলো সাবিহা,আরোহী অনির্বাণ।
– সাবিহা তুমি?
হতবাক রোযা।সাবিহা দুহাত মেলে দৌঁড়ে এলো।

– আরে চার দেয়াল আমাকে আটকে রাখতে পারে নাকি?সুযোগ পেতেই টাটা গুড বাই সি ইউ নট ফর মাইন্ড নোট লিখে পালিয়েছি বাসা থেকে।
– হ্যাঁ।এরপর তালতলায় দাঁড়িয়ে আমাকে ফোন দিয়েছে। আমি ফ্রী কামলা তো তাই মহারাণীকে লিফট দিয়ে নিয়ে আসলাম।
ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে ঠিকঠাক করতে করতে জানালো অনির্বাণ।বিনিময়ে সাবিহা শুধু তীব্রভাবে তাকালো,কিছুই বললোনা।রোযার বর্তমানে রীতিমত বিহ্বল লাগছে।এত এত মানুষ!
– আরে আপু আমাদেরকে রেখে শুরু করোনা প্লীজ!
পাশের গলির ভেতর থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো অভিষেক,সঙ্গী আরিয়ান।ছেলেটার হাতে এখনো কব্জি পর্যন্ত ব্যান্ডেজ জড়ানো,সেই হাতেই ধরে রেখেছে মোমবাতির প্যাকেট।দুইজনই দৌঁড়ে এলো।

– তোমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়লো কবে?
সাবিহার উত্তরে হাসলো আরিয়ান।
– আমার বাবার হাসপাতালে আমার ক্ষমতা চলে ইউ নো!
– আর আমার ভাগ্য। মা আমার পিছু ছাড়েনি, আসছে পিছন পিছন।
অভিষেক বলতেই সত্যি সত্যি নীল শাড়ি পরিহিত অবস্থায় এক রমণীকে দেখা গেলো,সিঁথিতে হালকা সিদুর এবং দুহাত জুড়ে শাখা পলার অস্তিত্ব।একটি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ তার তালুতে।সকলকে দেখে তিনি মৃদু হাসলেন,এগিয়ে এসে যুক্ত হলেন সন্তানের দলে।

অতঃপর? কোথা থেকে কি হলো রোযা বলতেও পারবেনা।সম্পূর্ণ ফাঁকা সড়ক পরিপূর্ণ হতে থাকলো মানুষের ভিড়ে।বাকিদের সে ব্যক্তিগতভাবে চেনেও না।চত্বরের চারিপাশের রাস্তা বেয়ে একে একে যুক্ত হচ্ছে তারা মিছিলে।প্রত্যেকের হাতে প্রদীপ,মোমবাতি,লণ্ঠন, হ্যারিকেন,দেশলাই,লাইটার….যেকোনো প্রকার আলোর উৎস।সন্ধ্যার অন্ধকার যখন ধীরে ধীরে ধরাকে গ্রাস করতে আরম্ভ করলো,তখন অগণিত আলোর ধারা সেই আঁধারকে যেন দলিত মথিত করে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে দিলো সমগ্র ধরিত্রীতে।আশেপাশের বিভিন্ন ভবন থেকে অনেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো। সড়কজুড়ে শুধুমাত্র জ্বলজ্বলে স্বর্ণালী তারকা যেন।এক অহনার তরে আজ প্রজ্জ্বলিত হয়েছে শত সহস্র শিখা।
নিজের অশ্রুপাত ধরে রাখা এমন মুহূর্তে সত্যিই কষ্টকর হলো রোযার পক্ষে।তার পদক্ষেপ প্রায় ভেঙে এলো।কিন্তু পাশে থাকা মানুষগুলোর ঐক্যের হাত তাকে দন্ডায়মান রাখলো।

– আমরা আর একা নই আপু।চলো আরম্ভ করি এই মহাযাত্রা।
সাবিহার আহ্বানে শুধু মাথা নাড়তে সক্ষম হলো রোযা।দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করলো চোখ বুজে।অতঃপর যখন দৃষ্টি মেললো,তখন তার নয়নজুড়ে প্রতিফলিত হলো উদগিরিত অগ্নিশিখা।অহনার মাকে একপাশে কাছে টেনে নিলো, অপর পাশে অভিষেকের মা।মাঝখানে রোযা।তাদের আশপাশজুড়ে যুবতী,নিহাদ, চারুলতা,জাহিদ স্যার,তার কিশোরী বোন,সাবিহা, অনির্বাণ,নাম না জানা পিতা এবং তার কোলে থাকা দুই বছর বয়সী কন্যা,এক মা এবং তার হাত ধরে চলা এক কিশোরী,সড়কের ধারে বসবাস করা পথশিশু, দিনমজুর,রিক্সাওয়ালা,শ্রমিক…. আরও অগণিত মানুষ।অভাব নেই কারো।
এই বিদ্রোহ কারো একার নয়,এই বিদ্রোহ সবার।

“ আমরা সবাই বিদ্রোহী”—
বারংবার ধ্বনিত হলো রোযার অন্তরে।দৃপ্ত পদক্ষেপে অগ্রসর হলো সে।অনুসরণে ঐক্যবদ্ধ জনতা।আলোর মিছিলের আলো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল চারিপাশে।তাতে আকৃষ্ট হয়ে মৌপোকার দলের মতন ছুটে আসতে থাকলো মানুষ,শ্রেনী বিভেদ,বয়স….পার্থক্য নেই কোনকিছুতে।সকলের একমাত্র পরিচয়,তারা মানুষ।
যত অগ্রসর হলো মিছিল,তত দ্বিগুণ হলো ব্যারিকেডের স্তর দ্বিগুণ হলো।পুলিশ বাহিনী ব্যাকআপ ডেকেছে। উল্টোপাশ থেকে একে একে গাড়িবহর এসে পৌঁছাচ্ছে।সকলেই তটস্থ।ব*ন্দু*ক নিয়ে তৈরি,তবে অর্ডারের অভাবে এখনো কিছু করছেনা।প্রতিপক্ষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে।
অতি সন্নিকটে পৌঁছে গেলো মিছিল।ব*ন্দু*ক উদ্যত দেখেও থামলোনা কারো পদক্ষেপ।
– আপনারা পিছিয়ে যান!শেষ ওয়ার্নিং দেয়া হচ্ছে, দয়া করে পিছিয়ে যান অন্যথায় আমরা অ্যাকশন নিতে বাধ্য হবো!
– না!

গণসমুদ্রের গর্জন ভেসে এলো বিপরীতে।কারো মাঝে সামান্যতম পেছানোর মনোভাব নেই। উল্টো দ্বিগুণ দুঃসাহসী হয়ে এগোচ্ছে তারা। থামলোনা রোযা। ঘোষণারত পুলিশের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে অতিশয় বাঘিনীর ন্যায় এগোলো।পরিধানের শাড়ীর আঁচল তার হিম বায়ুতে নব দিনের নিশানের ন্যায় উড়তে থাকলো।হাতের শিখা দীপ্তির জোরে কাঁপতে থাকলো।বিভ্রান্ত পুলিশ একে অপরের সঙ্গে কি যেন আলোচনা করলো।অতঃপর ব*ন্দু*ক তুললো একজন।অপরজনের হাতে টিয়ারশেল।

অতর্কিতে ঘটলো ঘটনাটি।অন্তিম গলির ভেতর থেকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেরিয়ে এলো দুজন মানুষ।কারো পদক্ষেপ থামলোনা ঠিকই,কিন্তু সকলে বিস্মিত হলো।এগিয়ে এলেন বিলাল রেমান, চারুলতার পাশে যোগ দিলেন মিছিলের সম্মুখ সারিতে,নিঃশব্দে।রোযা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে আবিষ্কার করলো আসমানকে।দুহাত পকেটে ভরে যে নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করলো সম্পূর্ণ মিছিল।তারপর উল্টো ঘুরল।পরিমিত অথচ শক্তিশালী পদক্ষেপে এগোলো, মিছিল পেরিয়ে সবার সামনে পৌঁছলো।হাঁটতে থাকলো ব্যারিকেড লক্ষ্য করে।তার দৃষ্টিজুড়ে প্রদর্শিত অমানিশা যেন শত্রুদলের মাঝে কা*পন ধরিয়ে দিলো।পুলিশের ব*ন্দু*কের ন*লের দিকে এক নজর তাকালো সে,তারপর শিরদাঁড়া টানটান করে তর্জনী তুলে অবোধ্য এক ইশারা করলো।

ডার্কসাইড পর্ব ৪৮

ইশারার অর্থ—অ*স্ত্র হটাও….অন্যথায়…..
না চাইতেও দ্বিধা নিয়ে পিছিয়ে পড়লো পুলিশ বাহিনী।হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকলো সম্মুখের সৈন্যবাহিনীর পানে।
উহু,বিদ্রোহী বাহিনী।কোন ক্ষমতার ব্যারিকেডের সাধ্য এই বিদ্রোহকে ঠেকায়?

ডার্কসাইড পর্ব ৫০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here