ডার্কসাইড পর্ব ৫১
জাবিন ফোরকান
ব্যাটার তৈরি করে উপরে বেশ কতক চকলেট চিপস ছিটিয়ে দিলো আসমান।তারপর ওভেনে ট্রে সমেত রেখে ত্রিশ মিনিটের টাইমার সেট করলো।কিচেন কাউন্টারে হেলান দিয়ে রোযা অত্যন্ত মনোযোগী দৃষ্টিতে তার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।কিন্তু সেই মনোযোগে বারংবার ব্যাঘাত ঘটছে পাশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গত আধ ঘণ্টা যাবৎ তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হয়ে থাকা নিহাদ এবং চারুলতার উচ্চবাচ্যতে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ।এখন সব আমার দোষ তাইনা?কে বলেছিল উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে?সোজা ঢুকে গেলেই হতো।
চারুর বক্তব্যে নিহাদ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো,
– আস্ত একটা পেত্নী।তোমার গরুর মতন শরীর নিয়ে আমার উপর ভর দিতে গেলে কেনো?
– কি বললে?আমি গরু?
– ভুল বলেছি।তুমি একটা গাভী।
মুষ্টিবদ্ধ হলো চারুলতার হাত,সটান সে নিহাদের চোয়াল বরাবর ঘু*ষি হাঁকালো। তা অতি সত্ত্বর পাকড়াও করলো নিহাদ,এক ঝটকায় কাউন্টারে ঠেকালো চারুকে,দুহাতের কব্জি আঁকড়ে নিলো নিজের দুহাতে।চারু অবশ্য ভড়কালোনা।উল্টো হাঁটু তুলে নিহাদের তলপেট বরাবর গুতো দিলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– আউচ!
– আমার সঙ্গে পাঙ্গা নেয়ার পরিণাম ভালো হয়না কখনোই।
– শাকচুন্নি তো। ঘা*ড় ম*টকে খা*ওয়ারই তো স্বভাব।
– তোমার মতন নির্লজ্য তো নই যে মানুষের ব্যক্তিগত মুহূর্তে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দেই!
ভ্রু কুঁচকে নিহাদ জানালো,
– ইশ!মানুষ খোলা ছাদে টাইটানিক মুভির মতন রঙ্গলীলা করতে পারে,আর আমি দেখতে গেলেই দোষ?বাসর করার শখ থাকলে দরজা আটকে দিলেই হতো!
– মানুষ কি আর জানে নাকি তোমার মতন একটা চিংটা নিজের লেঙ্গুর তুলে নেংটি ইদুরের মতন হানা দেবে?
নিহাদ হাত তুললো,চারুর মুখের সামনে ধরে দৃপ্ত কন্ঠে জানালো,
– মজা তুমিও পেয়েছ আমিও পেয়েছি ঠিক আছে?নাহলে তুমি আরো ভালোমতন দেখার জন্য আমার পিঠের উপর উঁকি দিলে কেনো?এখন এসব দোষারোপ বন্ধ করো।দুইজন সমান সমান।
– কিসের সমান সমান?কেক কি আমি নষ্ট করেছি?
– উঠতে গিয়েই তো ঠেলা লাগলো,তাতেই তো কেককে আ*ত্মা*হুতি দিতে হলো।বেচারা,ব্ল্যাক ফরেস্টের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।এক পেত্নীর ঝটকায় তাকে পরপারের যাত্রী হতে হলো।
– তো উঠবোনা?তোমার বুকে শুয়ে থাকবো নাকি?
– কেনো?আমার বুক এতটাই ঠুনকো লেগেছে তোমার কাছে যে কিছু মুহূর্তের স্পর্শও সহ্য করতে পারোনি?
পাল্টা জবাব দিতে গিয়েও থমকে গেলো চারুলতা। তিরতির করে কাপলো তার অধর।নিহাদ কোন অর্থে কথাটা বলেছে জানা নেই,কিন্তু তার মাঝে অদ্ভুত অনুভুতির দোলাচল উদগিরিত হয়েছে। শব্দগুচ্ছ কন্ঠে দলা পাকিয়ে গিয়েছে।দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে।তাতে বিজয়ীর হাসি হাসলো নিহাদ,
– আমার মতন হ্যান্ডসাম ছেলে এই দুনিয়ায় আর কয়টা আছে বলো?এই বুকে ঠাঁই পেয়েছ কয়েক সেকেন্ডের জন্য এ তোমার সাত পুরুষের ভাগ্য!
– স্টপ ইট!
অতর্কিতে একটি সিলভার চামচ ছুটে এলো নিহাদের উদ্দেশ্যে,টাং করে তার মাথায় নিশা*নাভেদ করলো।তাতে ভড়কে গিয়ে মাথা ঘষতে ঘষতে পাশ ফিরে আসমানকে নির্বিকার চেয়ে থাকতে লক্ষ্য করলো।কাউন্টারে দুহাত ঠেকিয়ে শীতল দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে দুজনকে।
– এটা রঙ্গ করার জায়গা?
– না।রান্না করার জায়গা।
নিহাদের প্রতি উত্তরে আসমান দৃষ্টি বুজে একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করলো।অতঃপর যখন নয়নপল্লব মেললো তখন তার কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণন নিহাদের সমস্ত শরীর প্রকম্পিত করে দিলো।
– হেহেহে…বদ্দা….আমি তো একটু মজা করছিলাম… এতে এত রাগ করে নাকি কেউ?
ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে চাইলো নিহাদ,কিন্তু চারুলতার সঙ্গে ধাক্কা খেলো।মেয়েটি কিচেনের দরজার প্রান্তে দুহাত পিছনে বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে পলায়ন করতে দিতে নারাজ।
– তোমার ব্যবস্থা আমি আগামীকাল করবো নিহাদ।
আসমানের ঘোষণায় একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করে নিহাদ ভিক্ষার দৃষ্টিতে চাইলো রোযার দিকে।একপাশে দাঁড়িয়ে অতি উৎসাহী হয়ে নাটক পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলো সে এতক্ষণ।নিহাদ তাকাতেই তীর্যক হেসে চোখ টিপ দিলো সে,বেচারার সমস্ত আশা যেন এক লহমায় গুঁড়িয়ে গেলো।
– বেঈমানদের মাঝে বসবাস আমার!
মিছিমিছি কান্নার ভান ধরলো নিহাদ,তাতে রোযা হেসে আসমানের দিকে এগোলো। কাঁধে হাত রেখে মৃদু কন্ঠে বললো,
– হয়েছে আসমান।বাদ দাও।বেচারা বুঝতে পারেনি।
– বেচারা?কাকে বেচারা বলছো তুমি?ছাব্বিশ বছরের এক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বেচারা কি করে হয়?
– ছাব্বিশ?
চারুলতা মনে মনে উচ্চারণ করতে চাইলেও খানিক জোর পরে গেলো,সকলে অতর্কিতে তাকালো তার দিকে।দ্রুতই কন্ঠ পরিষ্কার করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে।
– আজ শুভদিন বলে কিছু বলছিনা।মুখে লাগাম দাও।অন্যথায় ভুলে যাবো শুভদিনের কথা,আগে তোমাকে সাইজ করবো।অনেকদিন পোলিও খাওয়া হয়না তোমার, দুই ডোজ পেটে পড়লেই সব রঙ্গতামাশা বেরিয়ে যাবে।
উল্টো ঘুরে হাতে গ্লাভস পরিধান করে ওভেনের দিকে এগোলো আসমান।ঝুঁকে দেখলো তার অতি দ্রুততম সময়ে বানানো কেকখানি ঠিকমত হচ্ছে কিনা। রোযাও কৌতূহলী হয়ে তার পাশে দাঁড়ালো।অপরদিকে নিহাদ এক স্বস্তির নিঃশ্বাস গোপন করে মাথা ঝাঁকালো।কপালে তার কি আছে খোদাই ভালো জানেন।
– আমাকে আপু বলে ডাকবে।
মৃদু কণ্ঠস্বরটি কানে যেতেই কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে নিহাদ পাশে ফিরে তাকালো। চারুলতা এসে দাঁড়িয়েছে নিকটে,মিটিমিটি হাসছে।
– আমি আটাশ, গুরুজন তোমার।আসতে যেতে সালাম দিয়ে চলবে,জুনিয়র মুরগী!
কয়েক মুহূর্ত সময় প্রয়োজন হলো নিহাদের বিষয়টি হজম করে নিতে।পরক্ষণেই তীর্যক হাসিতে উদ্ভাসিত হলো তার সুদর্শন চেহারা।সামনে ঝুঁকলো,একেবারে চারুলতার কানের নিকট ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে জানালো,
– ডোন্ট ওয়ারি, আই লাইক ওল্ডার উইমেন!
স্পষ্টত শিহরিত হলো চারুলতার সর্বাঙ্গ,সামান্য সরে হাসির ঝলক প্রদর্শন করে নিহাদ কাউন্টারের বাস্কেট থেকে একটি আঙ্গুরের থোকা তুলে নিয়ে কয়েকটি মুখে পুরলো,চারুর দিকে এগিয়ে দিয়ে শুধালো,
– ওয়ান্ট সাম?
নিহাদকে বিহ্বল করে দিয়ে চারুলতা পাল্টা কোনোপ্রকার জবাব দিলোনা। উল্টো ঘুরে হনহন করে হেঁটে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলো।অদূর থেকে তার চলার পথে তাকিয়ে থাকলো নিহাদ, সদা নিয়ন্ত্রিত মেয়েটির সুদর্শনা অবয়বে লালিমার আবরণ তার দৃষ্টি এড়ায়নি। নিজের হৃদমাঝারে এক তড়িৎ অনুভব করলো নিহাদ,দৃষ্টি সরিয়ে নিলো দ্রুতই।
“ নিয়ন্ত্রণ কর নিজেকে, গ্রহাণুর সাধ্য কি নিজেকে নক্ষত্রের সঙ্গে তুলনা করে?”—
ধ্বনিত হলো তার অন্তরজুড়ে।
পরদিন।
যদিও গতকাল রাত্রিতে বেশ দেরী করেই ঘুমানো হয়েছিল আয়োজন সমাপ্তের পর,তবুও আজ বেশ ভোরেই উঠে পড়লো রোযা।
নতুন দিনের দিবাকর আপন রশ্নির চাদর বিছিয়ে দিয়েছে ধরিত্রীর বুকজুড়ে।স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল চুঁইয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে স্নিগ্ধতা মাখানো দীপ্তি।আলোকোজ্জ্বল কক্ষটি যেন স্বর্গের প্রতিরূপ।নড়চড় করতে গিয়েই রোযা অনুভব করলো আসমানের বাহুডোরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে সে।নয়ন মেলে মৃদু হাসলো সে,ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখাবয়বখানি তার তন্দ্রার জগতকে ভাসিয়ে তুললো অনুভবের জোয়ারে।সন্নিকটে গেলো রোযা,হাত তুলে ছুঁয়ে দিলো কপোল আলতো করে।মৃদু গুঙিয়ে উঠে তার স্পর্শের মায়ায় হারালো আসমান,তার নিদ্রাভঙ্গ হয়নি।ভাবছে বুঝি এক রূপকথার ন্যায় সুন্দর স্বপ্ন।তার নাকে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে রোযা সন্তপর্নে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।কম্বল টেনে সম্পূর্ণ ঢেকে উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে।হাতমুখ ধুয়ে নিজেকে তৈরি করতে আয়নার সামনে বসতেই নজরে পড়ল বিষয়টি।
রোযার কন্ঠজুড়ে জড়িয়ে আছে একটি স্বর্ণের তৈরি লকেট।বহুকাল আগের কাজ,যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা হলেও জৌলুস হারিয়েছে।এটি আসমানের তরফ থেকে তার জন্মদিনের উপহার।মূল্যহীন এই বস্তু রেমান পরিবারের আভিজাত্যের বিপরীতে।তবুও রোযার সবটুকু আবেগ কেড়ে নিয়েছে ছোট্ট অথচ অর্থপূর্ণ এই উপহার।কারণ,আসমান এটি তার কণ্ঠে পরিয়ে দিয়ে বলেছিল,
“ এটা আমার আম্মুর।যত্নে রেখো, জ্যোৎস্না।”
অতিরিক্ত কোনো ব্যাক্ষা আসমান প্রদান করেনি।তার একটি বাক্যই রোযার নিকট এই বস্তুর গুরুত্ব উপলব্ধিতে যথেষ্ট ছিল।নিজের চারিপাশের দেয়াল হটিয়ে দিয়েছে আসমান,হাত বাড়িয়েছে রোযার ভালোবাসার অনুভবের প্রতি সম্পূর্ণভাবে।নিজেকে উৎসর্গ করেছে আরো একবার।তাই হয়ত এই লকেটের যোগ্য হকদার মনে করেছে সে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে।
আসমানের মা—রোযার নিকট এক মমতাময়ী ধোঁয়াশার অস্তিত্ব সে।যার সম্পর্কে কোনোদিন কোনো বাক্য শ্রবণের সৌভাগ্য হয়নি তার।অতীতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি।আসমান বাদশাহ কায়সারের পুত্র হলে তিনি নিশ্চয়ই তার স্ত্রী ছিলেন।তাহলে বিলাল রেমান?তিনি যে চিরকুমার তাতে সন্দেহ নেই,আসমান,চারুলতা কিংবা চিত্রলেখা কেউই তার নিজের সন্তান নয়।তবে এহেন দুর্বলতার কারণ?আসমানের প্রতি তার পিতৃত্ববোধ যেন জগতের সকল ঔদার্যকেও হার মানায়।এর পিছনে কি কোনোভাবে আসমানের মা দায়ী?কি ঘটেছিল অতীতে?কিভাবে আসমান পৌঁছেছিল বাদশাহ কায়সারের হাতের মুঠোয়? রহস্যের ভেদে রোযার অন্তরমাঝে আকুলিবিকুলি ঢেউ উঠলো।রাফা কায়সারকে অবহেলা করা অসম্ভব,তাকে পূর্ণ শক্তিতে মোকাবেলা করতে হবে।তার জন্য আসমানের সম্পূর্ণ অতীত জানা প্রয়োজন।আসমানকে জিজ্ঞেস করবে?কিন্তু সে নিজেও কি আদতে সবকিছু সম্পর্কে অবহিত?
একনজর ঘুমন্ত আসমানের উদ্দেশ্যে তাকালো রোযা।রাফা কায়সারের সঙ্গে তার সম্পর্ক,বাদশাহ কায়সার তার বাবা এই ধরণের বিষয়গুলো ছেলেটি তার কাছে পরিষ্কার করেনি।কিন্তু তাতে কি অভিমান করা সম্ভব তার উপর?নিশ্চয়ই আসমানের নিজস্ব কোনো ভাবনা ছিল। রোযাকে সম্পর্কের এই কদর্যতা উপলব্ধি করতে দিতে চায়নি সে,দূরে রেখেছে সকল কলুষিত সত্য থেকে।এটা হয়ত তার আপন নিরাপত্তার পদ্ধতি।তাই অভিমান হলোনা রোযার,বরং দারুন বিষন্নতা অনুভূত হলো।কত কিছু সহ্য করতে হয়েছে এই অভিশপ্ত অস্তিত্বকে যা তাকে মানুষ থেকে মেশিনে রূপান্তরিত হতে বাধ্য করেছিল?
সন্তপর্নে উঠলো রোযা,আসমানের ঘুমন্ত চেহারা অবলোকন করে গেলো একদৃষ্টিতে।আজ আন্দোলনে বিরতি।ঠিক বিরতি নয়,বিকালে মিটিং রয়েছে।তাই সকালটুকু সে সম্পূর্ণ মুক্ত।তাছাড়া আজ তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আজ আসমান নিজের হাতে সকলের জন্য দুপুরের খাবার তৈরী করার কথা দিয়েছে,নিজের পরিবারকে সময় দিতে হবে কিছুটা হলেও।হঠাৎ স্বচ্ছ দেয়াল বেয়ে বাইরে দৃষ্টি গেলো রোযার,বাগানের পথে জগিং করতে লক্ষ্য করা গেলো বিলালকে।এই বয়সেও তার শারীরিক যত্নে কোনোপ্রকার আপোষ নেই। রেমানদের প্রত্যেকেই স্বাস্থ্য সচেতন।বর্তমানে রোযারও শারীরিক কসরত এবং ট্রেনিংয়ের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।সময় পেলেই আসমান তাকে জিমে আত্মরক্ষার কৌশল চর্চা করায়। বিলালকে বাহিরে দেখে চকিতে এক বুদ্ধি খেলে গেলো রোযার মস্তিষ্কে। মেঘতীর বর্তমানে ঘুমন্তপুরী।জাগ্রত হওয়ার তাড়া নেই কারো।একান্তে কথোপকথনের এই সুযোগ।
যেমন ভাবা তেমন কাজ পরিকল্পনা করে রোযা দ্রুত নিচে নেমে এলো।কিচেনে গিয়ে সহজ হাতে অ্যাভোকাডো টোস্ট, অমলেট এবং ফলের রস তৈরি করলো।ট্রেতে দুইজনের অনুপাতে সাজিয়ে হেঁটে চললো বিলাল রেমানের কক্ষের দিকে।রোযা নাস্তা তৈরি করতে করতে জগিং সেরে ফিরে এসেছেন তিনি।কক্ষ তার নিচতলায়ই।রাজকীয় ধাঁচের দরজার নিকট পৌঁছে রোযা থামলো।মৃদু আঁচে কড়া নাড়লো।
– বাবা।আমি রোযা,আসবো?
– মামণি?অফকোর্স,কাম ইন।
অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো রোযা।বিলাল রেমানের কক্ষটি বনেদী ধাঁচে তৈরি।আধুনিকতার ছোঁয়া নেহায়েত কম।তবে আভিজাত্যের কমতি নেই কোথাও।এই কক্ষটি রেমান পরিবারের প্রধানদের কর্তৃক ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।যদিও বাধ্যবাধকতা নেই নীতি পালনের,কিন্তু বিলাল রেওয়াজ মেনেই চলেছেন।
রোযাকে নাস্তার ট্রে হাতে লক্ষ্য করে বিছানার কিনারে বসে ঘাড় মুছতে থাকা বিলাল হাসলেন।সোফায় বসার ইশারা করলেন।রোযা আজ্ঞা পালন করতে করতে তিনি জগিংয়ের পোশাক পরিবর্তন করে টি শার্ট গায়ে চড়িয়ে এলেন।অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি তাতে তাকে রীতিমত যুবক ধাঁচের কেউই দেখালো।শক্ত সামর্থ্য শারীরিক গঠন,প্রশস্ত বুক,সুদর্শন মুখশ্রী এবং তার সঙ্গে মানানসই হালকা ফ্রেমের চশমা।অধরের উপরে পাতলা গোঁফের চারিপাশে খোঁচা খোঁচা আধপাকা দাড়ি তার বয়সের আধিক্য নয় বরং অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছে যেন।রোযার বিপরীতে বসলেন তিনি।
– গুড মর্নিং।
– গুড মর্নিং বাবা।
– বাহ্,আমার মামণি আজ নিজ হাতে নাস্তা তৈরি করে এনেছে?উপলক্ষ বিশেষ কিছু বটে।
বিস্তৃত হাসলেন তিনি।অতর্কিতে ট্রাউজারের পকেটে হাত ভরলেন।সেটি বের করতেই তার হাতের তালুতে দেখা গেলো গোলাকৃতির একটি বাক্স।ঢাকনা খুলতেই ভেতরে জ্বলজ্বলে নীলচে এক রত্ন দ্যুতি ছড়াতে আরম্ভ করলো।
– নীলকান্তমণির টায়রা। রেমান পরিবারের পৈতৃক সম্পত্তি।আজ থেকে এর হকদার তুমি মামণি।শুভ জন্মদিন।
রোযার হাত কাপলো জিনিসটি গ্রহণ করতে গিয়ে।বিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– বা…বাবা আপনি নিশ্চিত এই জিনিস আমার প্রাপ্য?
– অবশ্যই।রোযা রেমান তুমি,এই সম্পদের যথাযথ অধিকারী।
– কি…কিন্তু এটা অনেক মূল্যবান নিশ্চয়ই।আমি কিভাবে…
– এই সংসার জুড়ে রাখার দায়িত্ব বর্তমানে তোমারই মামণি।আমি আর কতদিন?খোদার ডাক আসলে পরপারের যাত্রী হতে সময় লাগবেনা।এই পরিবারের একটি ভিত্তি দরকার।তুমি আমার আসমানের যোগ্য সঙ্গিনী হবে আমি জানি,ওর পাশে থাকবে আজীবন।
আপ্লুত হলো রোযা।মাথা দুলিয়ে সায় জানালো।
– শুভ উপলক্ষের আয়োজনে রেমান পরিবারের বউদের এই টায়রা পরিধানের রেওয়াজ ছিল। আশা রাখছি তুমি পালন করবে তা।তারপর যখন তোমার ছেলের বউকে বরণ করে নেবে,তখন তাকে দেবে।
– আমার ছেলের বউ?
স্পষ্টত লজ্জাবোধ করলো রোযা।বিলাল তাতে বিস্তৃত হাসলেন।
– অবশ্যই।বিয়ে তো হলো,এবার নাতি নাতনীর মুখদর্শনের পালা আমার,তাইনা?একজন প্রিন্সেস কিংবা প্রিন্স সমগ্র বাড়িতে দাপিয়ে বেড়াবে,আমি তার ব্যক্তিগত ঘোড়া হয়ে পিঠে তুলে নেবো।তাই দেখো কত কসরত করে শরীর বানাচ্ছি!
হাসতে বাধ্য হলো রোযাও। বিলাল রেমান অতি স্নিগ্ধ এক মানুষ। আপন ভরসার ছায়ায় তিনি আগলে রাখেন সকলকে।তার সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা চোখে পড়লেও অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখা বেদনাটুকু হয়ত কেউ কোনোদিন উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়।অতি যত্নে তিনি নিজেকে বিষাদটুকু আড়াল করে রাখেন সন্তানদের থেকে।
– আপনি এখনো যথেষ্ট হ্যান্ডসাম বাবা।চাইলেই যে কেউ এক বাক্যে আপনাকে বিয়ে করতে রাজী হবে।
– তাই বুঝি? অস্বীকার করলাম না।যুবক বয়সে আমিও যথেষ্ট….কি যেন বলে তোমাদের ভাষায়? হট অ্যাণ্ড সেক্সী ছিলাম!
চোখ টিপে দিলেন তিনি।হাতে তুলে নিলেন টোস্ট, একটি ঢোক গলাধঃকরণ করে রোযা অবশেষে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি কোনোদিন বিয়ে করেননি কেনো বাবা?চারুলতা এবং চিত্রলেখার একজন মায়ের দরকার ছিল নিশ্চয়ই?
দৃশ্যমানভাবে থমকালেন বিলাল।দৃষ্টি তার যথারীতি প্রফুল্ল,কি ভাবছেন বোঝা দায়। টোস্টে কামড় না দিয়ে তিনি পুনরায় রেখে দিলেন সেটি প্লেটে।রোযা মেঝের দিকে তাকালো,
– এমন ব্যক্তিগত প্রশ্নের জন্য দুঃখিত বাবা।কিন্তু হয়ত ব্যাপারটা আমার জানা প্রয়োজন।আসমানের মা, আসমানের বাবা…. এই সমস্ত অতীতের রহস্য আমায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
নিঃশব্দ থাকলেন বিলাল,তারপর অতর্কিতে বিড়বিড় করলেন,
– যদি বলি একজনকে লাভ করার আশায় আমি আমার সমস্ত জীবন পার করে দিয়েছি তাহলে কি বিশ্বাস করবে, মামণি?
চোখ তুললো রোযা,মৃদু কন্ঠে শুধালো,
– আসমানের মা?
– ওর নাম আয়েশা।বড়ই মধুর এক স্মৃতি।তোমার কন্ঠে ওর লকেটটি দারুণ মানিয়েছে মামণি।খানিকটা আয়েশার মতোই লাগছে।
নিস্তব্ধ রইলো রোযা,বিলাল রেমান স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছেন।কিন্তু তার নয়নজুড়ে আবেগের টলটলে অশ্রু ভিন্ন কিছু ঘোষণা করছে।
– বাবা….আমি দুঃখিত।কোনো দরকার নেই আপনি…
– উহুম।আমারও কিছুটা ভারমুক্ত হওয়া দরকার।একলা স্মৃতিচারণের যন্ত্রণা বড্ড পীড়াদায়ক।
এটুকু বলেই উঠে গেলেন বিলাল।ক্লোজেট খুলে সিন্দুক থেকে বের করে আনলেন একটি ছোট্ট পকেট অ্যালবাম।রোযার দিকে এগিয়ে দিলেন।সেটি খুলতেই মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন থমকালো রোযার। অ্যালবামের পাতাজুড়ে খচিত এক চিত্রপট। যাতে তরুণ বয়সী এক ছেলেকে নজরে পড়ছে।রীতিমত আশির দশকের মডেলদের ন্যায় ভঙ্গি তার,মেঝেতে দুপা ছড়িয়ে বসেছে,ঠোঁটে ঝুলন্ত একটি কাঠির মতন।সিগারেট কিংবা অন্যকিছু হতে পারে।তবে ব্যাপার সেটি নয়,তার উদ্দেশ্যে ঝুঁকে থাকা অপ্সরীতুল্য এক রমণী যেন সবটুকুর কেন্দ্রবিন্দু।হাতে একটি ডায়েরি, যাতে আনমনে কিছু লিখে চলেছে।তরুণের দৃষ্টি তার মুখজুড়ে।আগেকার যুগের সিনেমার পোস্টার বলে চালিয়ে দেয়া যাবে ছবিটিকে অনায়াসে।
– এটা আপনি বাবা?
সামান্য হাসলেন বিলাল, সায় জানালেন।রমণী কে তা বুঝতে রোযাকে বেগ পেতে হলোনা।সোফায় হেলান দিয়ে জুসের গ্লাস তুলে নিলেন বিলাল, চুমুক দিয়ে জানালেন,
– সে আজ থেকে প্রায় তেত্রিশ বছর আগেকার কথা।আমি তখন ইতালি থেকে দেশে ফিরেছি বাংলাদেশে ব্যবসা বিস্তৃতির উদ্দেশ্যে।ইতালিতেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।যার দরুণ বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে খুব একটা পরিচিত ছিলাম না।বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন,কায়সার পরিবারকে মোকাবেলায় এবং যথার্থ ভিত্তি স্থাপনে আমার গাইডের দরকার ছিল।একজন অ্যাসিস্টেন্ট।কখনোই কারো সামনে নতজানু হওয়ার প্রবণতা ছিল না আমার মাঝে,সবসময় পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই ভালোবাসতাম।কারো হুকুম কিংবা উপদেশের ধারকাছ দিয়েও হাঁটতাম না।যতদিন না আমার অ্যাসিস্টেন্ট সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে……
নিজেকে বিলাল রেমানের অতীতের রোমন্থনে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললো রোযা।
তেত্রিশ বছর অতীত।
মেঘতীর ভবন।
“ শেরি শেরি লেইডি
গোয়িন থ্রু আ মোশন
লাভ ইয হোয়্যার ইউ ফাইন্ড ইট
লিসেন টু ইওর হার্ট ” ~
গ্রামোফোনের সুরের আবহে উদ্ভাসিত সমস্ত কক্ষ।ওয়াইনের মিষ্টি সুবাসে ভরপুর প্রত্যেক প্রান্ত।যার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে বাথরুম থেকে ভেসে আসা পানির কলকলে ধারার শব্দ।একটা মুহূর্তে সেই প্রবাহ বন্ধ হলো, হাট করে খুলে গেলো দরজা। সিক্ত পায়েই মেঝেতে পদার্পণ করলো তাগড়া তরুণ ছেলেটি।শুধুমাত্র একটি তোয়ালে জড়ানো কোমরের চারিপাশে।অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ।তাতে প্রতিফলিত হওয়া ল্যাম্পের স্বর্ণালী আভা।বুকের বামপাশাজুড়ে তার এক নেকড়ের ট্যাটু অঙ্কিত।সোনালী প্রজ্জ্বলনে যা একইসঙ্গে মনোমুগ্ধকর এবং ভয়ংকর ঠেকছে।
মেঝে সিক্ত করার পরোয়া না করেই সে কক্ষজুড়ে দুবাহু মেলে ঘুরতে আরম্ভ করলো, গ্রামোফোনের তালে তাল মেলালো তার কন্ঠস্বর।
“ শেরি শেরি লেইডি
লিভিন ইন ডিভোশোন
ইটস অলওয়েজ লাইক দ্যা ফার্স্ট টাইম
লেম্মি টেইক আ পার্ট ”~
ওয়াল্টজের তালে ঘুরে যেতেই কক্ষের একদম কোণায় একটি আরামকেদারায় নজর আবদ্ধ হলো তার।অজ্ঞাত এক রমণী।পরিধানে ধবধবে শুভ্র বর্ণের শাড়ী,দীঘল কালো কেশরাশি তার মাঝখানে সিঁথি তুলে দুপাশে ছড়ানো।একদৃষ্টে চেয়ে আছে তরুণের দিকে, নয়নজুড়ে মায়াবিনীর এক প্রগাঢ় কৃষ্ণগহ্বর।থমকালো তরুণ,আপন অন্তরে এক মৃদু খটখটানি অনুভব করলো।এমন অবস্থায় এক রমণীর সামনে তার বিব্রত হওয়া উচিত।কিন্তু সে তাতে বিন্দুমাত্র নারাজ,কিসের শঙ্কা তার?কিসের লজ্জাবোধ? বিলাল রেমান সে,যার কাঁধে বিরাট এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তরের অস্তিত্ব।
রমণীর মাঝেও বিন্দুমাত্র বিব্রতবোধ নেই, চেয়ে আছে সে একদৃষ্টে।যেন তার দৃষ্টি দিয়েই মেপে নিচ্ছে প্রতিপক্ষের তেজ।এগোলো বিলাল, আরামকেদারার সন্নিকটে।হিং*স্র শিকারীর দৃষ্টি তার গভীর নয়নে, অধরজুড়ে সন্তুষ্টির তীর্যক হাসি। আরামকেদারার দুপাশের হাতলে হাত রেখে সে ঝুঁকলো, তীক্ষ্ণ চিবুক গড়িয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো রমণীর কোলে। তা লক্ষ্য করে মাদকীয় ভঙ্গিতে হাসলো বিলাল,রমণীর দৃষ্টি তার মুখশ্রী অতিক্রম করে বুকের ট্যাটুর উপর গেড়ে বসেছে।
– ডু ইউ লাইক হোয়াট ইউ সি?
তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো রমণী,বিব্রত হয়ে নয়, বরং কিঞ্চিৎ ক্রোধে।হাঁটুর উপর পা তুলে শক্ত ভঙ্গিতে মোকাবেলা করলো শিকারীকে।
ডার্কসাইড পর্ব ৫০
– সম্পূর্ণ পাশ্চাত্যের গাঁধা দেখছি।আপনাকে বাঙালী সুপুরুষে পরিণত করতে বেশ কাঠখড় ব্যয় করতে হবে।
এক মুহুর্ত থমকালো বিলাল,অতঃপর হাসিটি তার বিস্তৃত হলো। আরও একটু ঝুঁকলো রমণীর নিকট, অজ্ঞাত রমণী তৎক্ষণাৎ পাশের একটি মোটা মলাটের পুস্তক টেনে উভয়ের মাঝে সীমারেখা স্থাপন করলো যেন।তাতে বিনোদিত হয়ে বিলাল বইয়ের প্রান্ত চেপে ধরে বিড়বিড় করলো,
– আর ইউ লস্ট ইন ডেভিলস ডেন….মিস অ্যাঞ্জেল?
