ডার্কসাইড পর্ব ৫৯

ডার্কসাইড পর্ব ৫৯
জাবিন ফোরকান

পিনপতন নীরবতা।
ঘড়ির কাঁটা বয়ে চলার মৃদু টিকটিক আওয়াজ তাতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে প্রতিটি সেকেন্ডজুড়ে। মেঘতীর উদ্ভাসিত হয়েছে এক অনন্য দৃশ্যপটে।যেখানে সকলে আপন চিন্তায় এতটাই স্তব্ধ যে স্থান, কাল এবং সময়ের জ্ঞান লোপ পেয়েছে তাদের মস্তিষ্ক থেকে।

সোফায় বসে আছে নিহাদ।তার ঠিক বিপরীত প্রান্তে মুখোমুখি অবস্থান বিলাল এবং আসমানের। পুরুষত্রয়ের মাঝে নিদারুণ চিন্তার গভীরতা স্পষ্ট। রোযা সিঁড়ির ধাপের উপর বসে নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে তাদের উপর।অপরদিকে এত সুগম্ভীর পরিস্থিতির কারিগর ফুরফুরে মেজাজে কিচেনে শীষ বাজিয়ে বাজিয়ে কফি তৈরি করছে পরিবারের জন্য।তার চেহারায় এমন এক প্রশান্তি এবং প্রফুল্লতা যেন জীবনযুদ্ধে জয় সুনিশ্চিত হয়েছে তার।
নীরবতা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে সুদীর্ঘ হয়ে চলেছে।নিজের মাঝে বিলাল এবং আসমানের তীব্র নিরীক্ষণ দৃষ্টি অনুভব করতে করতে নিহাদের সর্বাঙ্গজুড়ে কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে।নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার মাঝেও কপাল এবং গ্রীবাজুড়ে ঘামের ফোঁটা জমতে আরম্ভ করেছে।আনমনে তর্জনী ঢুকিয়ে পরিধানের ফতুয়ার কলার থেকে দুটো বোতাম উন্মুক্ত করল নিহাদ। তাতেও লাভ হচ্ছেনা,হাত কাঁপছে।আর সহ্য করা সম্ভব হলোনা।কর্কশ কন্ঠে বান্দা বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– এত ওভারপজেজিভ বাপ ভাই হলে চলে?
নিহাদ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আসমানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রভাবে থতমত খেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে দিলো।বিলাল বুকের উপর দুবাহু ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করলেন,
– কি করো তুমি?
কন্ঠ পরিষ্কার করলো নিহাদ।আতঙ্ক কমাতে দুহাতের তালু ঘষতে ঘষতে জবাব দিলো,
– আম…আমার একটা বাইক রাইডিং অ্যাণ্ড ট্রেইনিং কোম্পানি আছে।
– হুম।বিজনেস মার্জিন?

খুট করে নিহাদের সহ্যসীমার অদৃশ্যমান দড়িখানি ছিঁড়ে গেল।সঙ্গে সঙ্গে তেঁতে উঠে বলে বসলো,
– আরে কাক্কু আমি তিন মাস ধরে অসুস্থ,দেউলিয়া হয়ে গেছে নাকি কোম্পানি তার ঠিক নেই আর আপনি আমাকে বিজনেস মার্জিন জিজ্ঞাসা করছেন?আর তুমি,আসমান ভাই।তুমি কেনো এমনভাবে দেখছ আমাকে যেন আমি তোমার বোনকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করে সোজা বাচ্চসমেত ফেরত এসেছি?এই গোটা রেমান গুষ্টির মাথায় ডিস্টার্ব!
সিঁড়ির উপর বসে থাকা রোযা বিনোদন পেয়ে হেসে ফেললো।নিহাদ তাতে তার দিকে চকিতে তাকিয়ে বললো,
– তুমি আবার ভ্যাকভ্যাক করে হাসছো কেনো?তুমিও এই রেমান গুষ্টিরই লোক,দালাল কোথাকার!তোমার মাথায়ও গুরুতর সমস্যা আছে,তাই আসমান ভাইয়ের মতন মানুষের সাথে ফেঁসেছ।
রোযার হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো,ফ্যালফ্যাল করে সে চেয়ে থাকলো।নিহাদ কারো কোনরকম পরোয়া না করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো,কোমরে দুহাত রেখে উচ্চশব্দে ব্যক্ত করলো,

– আর সবথেকে বড়ো রেমান পাগলা হচ্ছে ওই শাকচুন্নির ঘরের পেত্নী!ভেবেছে আমার পিছনে বাপভাই লেলিয়ে দেবে?ওকে পাবনায় পাঠান এক্ষুণি।নাহলে কয়েকদিন পর রাস্তার পাগলী হয়ে যাবে।দেখবেন তখন মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আল্লাহ গো,দুইটা ভিক্ষা দেন গো বলে চেঁচামেচি করছে।
বিলাল রেমান এতক্ষণ যাবৎ বহু কষ্টে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ধরে রাখলেও নিহাদের পাগলাটে স্বভাবের দরুণ তা সম্ভব হলোনা।ফিক করে হেসে উঠলেন তিনি।তাতে নিহাদ মাথায় হাত দিয়ে হাহাকার করে বললো,
– আরে দরবেশ কাক্কু আপনি হাসছেন কেনো?আপনার কলি*জার টু*করো মেয়েটা আহাম্মক হয়ে গিয়েছে।আপনার খুশি লাগছে তাতে?ধরুন ওটাকে এক্ষুণি, ধরেবেঁধে অক্সফোর্ডের প্রফেসরের সঙ্গে বিদায় করে দিন।এই বাড়িতে একটু শান্তি ফিরুক।
কিচেন থেকেই নিহাদের কথা শুনে ভেংচি কাটলো চারুলতা।তারপর কন্ঠস্বর উঁচু করে চেঁচিয়ে উঠলো,

– আমি এই চিংটা ছাড়া আর কারো জন্য কবুল বলবোনা,ড্যাড।
– রং লেগেছে মনে?রং?তোমার ঐ রংয়ে ছাই ফেলে দেবো ডাইনী কোথাকার!সিনিয়র হয়ে জুনিয়র বিয়ে করতে চাও,লজ্জা করেনা তোমার?
– আমি নির্লজ্য।
– এতদিনে একটা সত্যি কথা বলেছ।তুমি গর্ধবদের মহারাণী।আমেরিকান পিৎজার বক্সে “ডু নট ইট দ্যা বক্স” সতর্কবাণী তোমার মতন মানুষদের জন্যই উদ্ভাবন করা হয়েছিল,যারা পিৎজা না খেয়ে কাগজের বক্সে লোভ দেয়!মাথার মধ্যে এত্ত বড়ো গণ্ডগোল না থাকলে কেউ অক্সফোর্ডের প্রফেসর বাদ দিয়ে আজাইরা দিকে নজর দেয়?

– নিহাদ।
অতর্কিতে শান্ত কণ্ঠটি নিহাদকে থমকাতে বাধ্য করলো।সম্পূর্ণ উত্তেজিত পরিস্থিতি প্রশান্ত করতে একটি শব্দই যথেষ্ট ছিল তার। ঢোক গিলে ফিরে তাকালো নিহাদ,মুখোমুখি হলো আসমানের।ফরমাল প্যান্টের পকেটে দুহাত ভরে নিহাদের নিকটে সরে দাঁড়ালো আসমান,একনজর কিচেনের চারুলতার পানে দৃষ্টি ফেলে পরবর্তীতে শুধালো,
– বারবার অক্সফোর্ডের প্রফেসরের সঙ্গে তুলনা করে কি বোঝাতে চাইছো?তুমি তার তুলনায় নগণ্য কেউ?আর ইউ রিয়েলী আন্ডারেস্টিমেটিং ইওরসেল্ফ?
নিশ্চুপ নিহাদ।আসমানের সঙ্গে দৃষ্টি মেলানোর সাধ্যও তার নেই।মেঝের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।
– চারুলতা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।ওর নিজের জ্ঞানবুদ্ধি রয়েছে।নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।তোমার অধিকার নেই ওর সিদ্ধান্তকে হেয় প্রতিপন্ন করার।এমন শিক্ষা আমি তোমাকে কোনোদিন দেইনি নিহাদ।
– আসমান ভাই…

মুখ খুললেও আর কিছু বলা সম্ভবপর হলোনা নিহাদের পক্ষে।উভয় হাত তার মুষ্টিবদ্ধ হলো শক্তভাবে।বিলাল রেমান হাঁটুর উপর পা তুলে বসে সোফায় হেলান দিলেন।অতঃপর বললেন,
– আমার সন্তানদের কোনোকালেই কোনো ব্যাপারে বাঁধা দেইনি আমি।এবং অবশ্যই, এইবারেও দেবোনা।কারণ আমার ওদের উপর অগাধ বিশ্বাস রয়েছে।ওরা যা করে,জেনেবুঝে নিজের ভালোর জন্যই করে।তার মাঝেও যদি কোনোপ্রকার বিবেচনার অভাব থেকে থাকে তবে আমি ওদের সতর্ক করি।কিন্তু এক্ষেত্রে যদি আমার চারুলতা মনে করে সে তোমার সঙ্গে জীবনে ভালো থাকতে পারবে তবে আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।
হতবিহ্বল হয়ে নিহাদ বিলালের দিকে তাকালো।তিনি মুচকি হেসে জানালেন,

– তোমাকে বিজনেস মার্জিন জিজ্ঞাসা করার কারণ, তুমি যেন নিজ প্রতিষ্ঠানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হও। রেমান পরিবারের জামাই হতে গেলে অর্থ সম্পত্তি এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাগবে এমন কথাবার্তা আমি বলবোনা কোনোদিন,এর কোনো মানে হয়না।ভালোবাসা কিংবা ভালো থাকা কখনোই এসবের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়না।তবুও বলবো,নিজের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হও যেন এই পরিবারের ছায়া তোমাকে আচ্ছাদিত না করে। রেমান পরিবারের জামাই হিসাবে নয়,লোকে যেন তোমাকে নিহাদ হিসাবেই চেনে।

আবেগের তাড়না অনুভব করলো নিহাদ প্রচণ্ড, টলটলে হয়ে উঠল নয়ন,তবুও শক্ত হৃদয়ে তা নিবারণ করলো।আসমান তার কাঁধে হাত রাখলো, ভরসাস্বরুপ।বিলাল নিজের বক্তব্য সমাপ্ত করলেন,
– পরিশেষে এটুকুই বলবো,জীবন তোমাদের এবং সিদ্ধান্তও তোমাদের।একসঙ্গে ঘর বাঁধবে তোমরা দুজন।প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়েছ,নিজেদের চাহিদা এবং ভালোমন্দ অবশ্যই বুঝবে।সময় নাও,নিজেদের অনুভূতি উপলব্ধি করো,তারপর আমাকে জানিও।আমি সবসময় থাকবো তোমাদের পাশে যেকোনো সিদ্ধান্তে।

– টেইক ইওর টাইম।নিজেকে অন্যের তুলনায় অযোগ্য ভেবোনা।তোমার তুলনা তুমিই।চারু বলেছে বলেই হ্যাঁ মত দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই।আবার নিজেকে তুচ্ছ ভেবে দূরে সরে যেতে হবে তারও প্রয়োজন নেই। ফাইন্ড ইওর ওয়ান্টস,কি চাও তুমি? হোয়াটএভার ইট ইয,তোমার আসমান ভাইকে সবসময় পাশে পাবে।
আর সম্ভব হলোনা।নিজেকে আসমানের আলিঙ্গনমাঝে বিসর্জন দিতে বাধ্য হলো নিহাদ।তাকে সযত্নে আগলে নিয়ে পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে দিলো আসমান।দৃশ্যটি সকলে প্রাণভরে অবলোকন করলো।কিচেন থেকে তক্ষুণি বেরোলো চারুলতা।হাতে ট্রে, তাতে পাঁচ মগ উষ্ম বাষ্প ওঠা কফি।ভ্রু কুঞ্চিত করে সুদর্শনা বললো,
– হ্যাঁ হ্যাঁ দাও দাও।তোমরা সবাই ওকে ভরসা দাও।আমি তো বানের জলে ভেসে এসেছি তাইনা?এমন ভাব করছে যেন আমি ওর কাছ থেকে একটা কি*ডনি চেয়েছি!

– হাহা,একদম না।তুমি তো আমার আদরের বেইবি। অ্যান্ড আ’ম প্রাউড অব ইউ,যে তুমি নিজের ইচ্ছা পোষণে পিছপা হওনি।
বিলাল বলতেই সামান্য লজ্জাবোধ কন্ঠ পরিষ্কার করলো চারুলতা।তারপর ট্রে টেবিলে রেখে এক মগ কফি তুলে রোযার উদ্দেশ্যে এগোলো।ঠিক তখনি আসমানের কন্ঠ ধ্বনিত হলো,
– ওকে কফি দিসনা।
সামান্য ভড়কে চারুলতা জিজ্ঞেস করলো,
– কেনো?
– কফি স্বাস্থ্যকর নয়।
– স্বাস্থ্যকর নয়?
সকলেই দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকালো।তারপর হঠাৎই চারুর দৃষ্টিজুড়ে এক উত্তেজনার ঝিলিক খেলে গেলো।বহু কষ্টে তা দমন করে বললো,

– ডু ইউ মিন….
– নতুন অতিথি আসছে?
প্রশ্নটি সম্পূর্ণ করলো নিহাদ।প্রত্যেকে অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে তাকালো,একবার আসমান অতঃপর রোযার উদ্দেশ্যে।আসমান সোফায় বসে থাকা বিলালের দিকে এগোলো,তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বিড়বিড় করলো,
– অভিশাপ আমার নিঃশেষ হয়েছে,বাবা।অবশেষে আমিও এই ডাকটা শোনার সৌভাগ্য লাভ করবো।
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকলেন বিলাল। দীর্ঘক্ষণ।তার চশমায় আবৃত নয়নজুড়ে টলটলে অনুভূতির রেখা স্পষ্ট হলো।ফ্রেমটি এক ঝটকায় খুললেন তিনি,সামনে ঝুঁকলেন।কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস নিয়ে শুধালেন,

– স….সত্যি?
– সত্যি,বাবা।
এক ফোঁটা অশ্রু বিলালের কপোল বেয়ে গড়িয়ে নামলো একেবারে চিবুক পর্যন্ত। সজোর টানে যক্ষের ধনকে বুকে আগলে নিয়ে তিনি অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করলেন,
– আলহামদুলিল্লাহ।
তাকে পাল্টা জড়িয়ে ধরলো অমানিশা।এতক্ষণ যাবৎ অন্তরের মাঝে দা*উদাউ প্রজ্জ্বলিত তাড়নার অগ্নি যেন প্রশান্ত হয়েছে পিতার আশ্রয়স্থলে।বিলাল একটি বাহু ছড়িয়ে ইশারা করলেন রোযাকে।বহু কষ্টে নিজেকে নিবারণ করে রাখা রোযার পক্ষে সম্ভব হলোনা আর। সিঁড়ি থেকে নেমে দ্রুত ছুটে এলো, পিতার বক্ষে আশ্রয় নিলো।উভয়কে শক্তভাবে নিজের প্রগাঢ় উষ্ণ আলিঙ্গনে আগলে নিয়ে বিলাল আবেগে কম্পিত কন্ঠে জানালেন,

– ধন্যবাদ….অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাদের।তোমরা আমাকে এতটা সুখ দিয়েছ আজ যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।আমার পরিবারটা পরিপূর্ণ করে দিয়েছ তোমরা আজ।
আর কিছু উচ্চারণ সম্ভব হলোনা।সকলেরই নয়ন অশ্রুসিক্ত,কন্ঠ অনুভূতির আগ্রাসনে স্তব্ধ।আনমনে চারুলতা সোফার দিকে সরে এলো,বসে থাকা নিহাদের কাঁধে হাত রাখলো। সামনের দৃশ্যপটে চেয়ে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– দৃশ্যটা সুন্দর,তাইনা?
তার হাতের উপর নিজের হাত স্থাপন করে নিহাদ ফিসফিসে স্বরে উত্তর দিলো,
– খুব সুন্দর।

সুউচ্চ ভবনের অ্যাপার্টমেন্টটি চারিপাশ থেকে কাঁচের দেয়ালে ঘেরা,যার অভ্যন্তর থেকে বাইরের নগরের দৃশ্য স্পষ্টত পরিলক্ষিত হয়।রং বেরংয়ের বাতির চলাচল আজ যেন সম্পূর্ণ নগরকে ছেয়েছে এক উন্মাদনায়।রাত্রির নৈঃশব্দ্য যত গাঢ় হচ্ছে,তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে অভিসারের প্রগাঢ়তা। ভিন্নদায়ক এক অনুভূতি,যন্ত্রণার মাঝে সুখের সঞ্চারণ,মাদকের চাইতেও আসক্তিকর।রাত্রির একদম অন্তিম প্রহর পর্যন্ত একে অপরের অস্তিত্বের আগ্রাসী লোপাটে লিপ্ত থাকলো দুটি সত্তা।তারপর আরামকেদারায় পরিশ্রান্ত এবং তৃপ্ত শরীর এলিয়ে নগরের দৃশ্য অবলোকন করতে করতে সিগারেট প্রজ্জ্বলিত করলো রমণী।

কোলের উপর রাখা পছন্দের ধূসর পৃথিবীর আচ্ছাদন, “চেইজিং ক্যামেলিয়া”।নিগূঢ় কালো মলাটে টকটকে লাল অক্ষরে লিখা টাইটেল যেন এক নিষিদ্ধ বাসনার পূর্ণতার ঘোষণা দেয়।তাতে আঙুল বুলিয়ে রমণী আপনমনে রোমন্থনের দুনিয়ায় হারালো।ঠিক কবে থেকে এমন ধারণায় আসক্ত হয়েছে সে?স্মরণে নেই।
শুধুমাত্র স্মরণে রয়েছে তার শরীরজুড়ে এলোমেলো বয়ে চলা পুরুষালী হাতের প্রবাহ।কত বয়স ছিল তার তখন?নয়?কিংবা দশ? হয়ত বা,কিংবা তার চাইতেও কম।পিতা ছেলে সন্তানে অত্যধিক আগ্রহী ছিলেন, যদিও কনিষ্ঠতম হওয়ায় আদরের কমতি ছিলোনা তার নিজের।তবুও, বড়ো চাচাকে অধিক ভালোবাসতো সে।প্রায়শই তার সাথে থাকা,খাওয়া, খেলা,পড়াশুনা সবই হতো।সেই সুযোগ বড়ো চাচা গ্রহণ করেছেন বেশ ভালোভাবেই।এখনো হৃদয় আবেশিত হয়ে পড়ে আঁধার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার বাহানায় কিভাবে গভীর থেকে গভীরতর স্পর্শ বুলিয়ে দিতো লোকটি তার সর্বাঙ্গজুড়ে।প্রশ্ন করতো সে শিশুসুলভ ভাষায়,এসব কেনো?উত্তর আসতো,এসব ভালোবাসার স্পর্শ এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক।তাকে যেই ভালোবাসবে সেই এভাবে স্পর্শ করবে।নিজের তৃষ্ণা মেটাতে অন্তরে এক বীজ পুঁতে দেয়া হয় শিশুটির, ধূসর অনুভূতির বীজ।কি সঠিক,কি বেঠিক?সে কোনোদিন সেই শিক্ষা লাভ করেনি পুস্তকের বাইরে।বাবা,চাচা,ভাই সকলের নারী লো*লুপতা এবং বেঠিককে জোর ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠার পর্বসমূহ উপলব্ধি করেই বড়ো হয়েছে সে।জগতের সকল বেঠিক তখন স্বীকৃতি পেয়েছে তার নিকট স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে।

অতঃপর জীবনে এলো কৈশোরের আবেগময় অধ্যায়।এক শুভ্রতার মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে সম্পূর্ন।যেই তোমাকে ভালোবাসবে,সেই তোমাকে এইভাবে স্পর্শ করবে— বাক্যটি যথার্থতা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অস্তিত্বে।ভালোবাসা তবে স্পর্শ?গভীরতম স্পর্শ।হ্যাঁ,ভালোবাসা চাই তার,অর্থাৎ স্পর্শ চাই তার।ততদিনে বিকৃত বিনোদন এবং অতিরিক্ত মডার্ন বন্ধুবান্ধবের কল্যাণে চাহিদা বেড়েছে তার,সঙ্গে ধুরন্ধর বুদ্ধিও।শুভ্রতার নিকট থেকে ভাইসুলভ স্নেহের বদলে অতিরিক্ত কোনো আগ্রহ আদায় করতে ব্যার্থ হয়ে হৃদয় তার নিশপিশ করতে থাকে।ভাই?না না, এর থেকে অধিক কিছু চাই তার।ভাই তো ভালোবাসতে পারেনা,পারলে স্পর্শ কেনো করেনা?তবে শুভ্রতা তাকে ভালোবাসে না?তাকে চায়না?এই চিন্তা দিনের পর দিন তার নিদ্রা কেড়ে নেয়।আসক্ত হয়ে পরে অন্তর সম্পূর্ণ,ওই শুভ্রতার স্পর্শের চাহিদায়।একটিবার,অন্তত একটিবার হলেও তাকে নিজের মতন করে পাওয়া চাই।ঠিক যেমনটা দেখা যায় নীলচে দুনিয়ার পর্দায়,কিংবা ধূসর পৃষ্ঠার জগতে।

অতঃপর প্রচেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি সে ভালোবাসা আদায়ে।বিভিন্ন পুস্তক থেকে ধারণা নিয়ে তাতে নিজের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের বুদ্ধি মিশিয়ে একেকটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে সে।জিম থেকে শুভ্রতার ব্যবহৃত জিনিসপত্র চু*রি করে নিজের কাছে সংগ্রহ থেকে আরম্ভ করে অদৃশ্যমান পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত।কখন কার সাথে কতটুকু কথা বলেছে,কতটুকু অভিব্যক্তি তার চেহারায় ছড়িয়েছে,ট্রেনিংয়ের সময় কত অ্যাঙ্গেলে ঘুরপাক খেয়েছে, পুশ আপের সময় বাহুর মাংসপেশী কতটুকু প্রসারিত হয়েছে….. সবকিছু!শুভ্রতা আদতে তার সৎ ভাই হয়,বিষয়টা সে জেনেছিল একপ্রকার নাটকীয়ভাবেই।মূলত শুভ্রতার সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহ করতেই গিয়েই তা আবিষ্কার করা।আর কেউ জানতোনা পরিবারের পিতা ব্যতিত,সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলো।নিজেও কোনোদিন মুখফুটে কাউকে কিছুই জানায়নি।বিন্দুমাত্র আগ্রহ কমেনি তার শুভ্রতায়,বরং পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।কারণ ঠিক কি বেঠিক কি,এর সীমারেখার শিক্ষা কোনোদিন তার অন্তরে স্থাপিত হয়নি।ক্ষমতার জোরে সবকিছু আদায় করা সম্ভব,এই ছিল নিয়তি তার।কেনো পিছপা হটবে? শুভ্রতাকে চাই তার নিজের করে,যেভাবেই হোক!

বছর বছরের সেই আবেগ অনুভূতি আজ পর্যন্ত বিন্দুমাত্র লোপ পায়নি।বরং হৃদয়ের তৃষ্ণা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে।পরিস্থিতি যত জটিল হয়েছে,তত আনন্দিত হয়েছে চিত্ত মোকাবেলায়।বদল ঘটেছে রূপ, যৌবন, সৌন্দর্য্য,অভিজ্ঞতায়।কিন্তু শুভ্রতাকে নিজের করে পাওয়ার অভিলাষ তার আজও রয়ে গিয়েছে, অতৃপ্ত এক বাসনা হয়ে।স্পর্শ,স্পর্শ চাই তার।শুভ্রতা আপন ইচ্ছায় তাকে ছুঁয়ে দিক,এমন এক অমোঘ স্বপ্নের বীজ রোপণ করা হয়েছে তার মাঝে বহুকাল আগেই।
– উম…রাফা?

পুরুষালী জড়ানো কন্ঠস্বরটি রাফাকে আপন দুনিয়ার আসক্তি থেকে বাস্তবের প্রশান্তিতে টেনে আনলো।মাথা ঘুরিয়ে তাকালো কায়সারকন্যা।বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করলো স্বামীকে।রাশিয়ান বান্দা চেয়ে আছে তার দিকে এক প্রকার ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে।উন্মুক্ত বক্ষজুড়ে তার আগ্রাসী চিহ্নের ছড়াছড়ি,হাতের কব্জিতে ঝুলছে ধাতব হ্যান্ডকাফ। দৃশ্যটি বরাবরই আনন্দদায়ক রাফার জন্য।কিন্তু ঠিক,তৃপ্তিদায়ক নয়।আজও ব্যতিক্রম ঘটলোনা তার। আরামকেদারা ছেড়ে সযত্নে পুস্তকটি টেবিলে রেখে দিমিত্রীর দিকে এগোলো রাফা।বিছানায় বসে অধর থেকে সিগারেট সরিয়ে ইতোমধ্যে জর্জরিত স্বামীর অধরখানি দখলে নিলো সে। উহুম, আদরের প্রকাশ নয়,বরং যন্ত্রণার আধিক্য এই স্পর্শে।তাতে বিলীন হলো দিমিত্রী, রাফার স্বল্পবসনা কোমরজুড়ে জড়িয়ে গেলো তার শক্তিশালী হাত। ধা*রালো ন*খে আঁ*চড় কা*টলো বারংবার।নিজেকে ছাড়িয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে হাসলো রাফা, মাদকীয় কন্ঠে শুধালো,

– আমার জন্য কি করতে পারবে তুমি দিমি?
– হোয়াটএভার ইউ ওয়ান্ট,মাই কুইন। জাস্ট সে দ্যা ওয়ার্ড।
তীর্যক হাসি বিস্তৃত হলো রাফার, আরো একবার অধরে অধর ছুঁয়ে জানালো,
– যদি বলি অপর এক রমণীকে স্পর্শ করো,করবে কি?
এক মুহূর্তের জন্য থামলো দিমিত্রী। রাফার দৃপ্ত অশুভ দৃষ্টিমাঝে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– হোয়াট ডু ইউ মিন?

রাফা তার কপোলে ওষ্ঠ ছুঁয়ে উঠলো।বেডসাইড টেবিল থেকে ইলেকট্রনিক সিগারেট তুলে নিয়ে ঠোঁটে পুরলো,দীর্ঘ কয়েক টান গ্রহণ করলো। কাঁচের দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়ালো।দিগন্তে ভোরের রেখা, স্নিগ্ধ আভা তার লাস্যময়ী অবয়বের প্রতিটি খাঁজে খাঁজে প্রতিফলিত হয়ে চলেছে।স্বর্গীয় অপ্সরী?উহু, নরকের মহারাণীর ন্যায় প্রদর্শিত হচ্ছে তাকে। দিমিত্রী বিছানা ছেড়ে উঠতে বাধ্য হলো।মেঝে থেকে নাইটগাউন তুলে গায়ে জড়াতে জড়াতে রাশিয়ান টানে আবারো জিজ্ঞেস করলো,

– কাকোয়ে তোয়াইও যেলানিয়া?[তোমার ইচ্ছা কি?]
তীর্যক হাসলো রাফা কায়সার।দীর্ঘ সুখটানের ধোঁয়াটে বায়ু গুমোট আকৃতি ধারণ করলো।প্রতিধ্বনিত হলো এক অমোঘ ঘোষণা,
– ওই চন্দ্রকে গ্রাস করা আমার শ্রেষ্ঠতম অভিলাষ।
ধূসরিত দৃষ্টি তার আবদ্ধ রইলো দূর দিগন্তে,যেখানে চাঁদের আবছায়া অবয়ব এখনো স্পষ্ট।ক্রমশ উদিত হতে থাকা দিবাকরের তেজস্বী রশ্মিতে ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে চন্দ্রের অস্তিত্ব।বড়ই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য!

পেরিয়েছে একটি সপ্তাহ।
এই কয়েকটি দিন রোযার জন্য অতিবাহিত হয়েছে অভূতপূর্বভাবে।জীবনে প্রথমবার মা হতে যাওয়ার প্রচণ্ড অনুভূতির সঙ্গে বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের উৎসাহী এবং সতর্কতাসম্পন্ন আচরণ যেন মিলেমিশে একাকার।রোযার মনে হচ্ছে সে হঠাৎ করেই প্রাপ্তবয়ষ্ক থেকে একদম বাচ্চাটি হয়ে গিয়েছে,যাকে ঘিরে সকলের হম্বিতম্বি।আসমান তাতে অগ্রগণ্য অবশ্যই।এমন একটি দিন যায়নি যাতে সে রোযার জন্য কিছুই করেনি।প্রায় সকালে গা গুলিয়ে ঘুম ভেঙে গেলে আসমানও উঠে পরে তার সঙ্গে। খাওয়ার রুচি ধীরে ধীরে কমে আসছে।যখনি তাই খেতে ইচ্ছা হোক না কেনো,মাঝরাত কিংবা ভরদুপুর,আসমান তাকে তার পছন্দের খাবার বানিয়ে দেয়।কোম্পানির কাজগুলো বর্তমানে সে বেশিরভাগ বাড়ির অফিসে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে যেন রোযাকে সময় দেয়া সম্ভব হয়।অপরদিকে চারুলতা,বিলাল এমনকি নিহাদ পর্যন্ত।যে যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে,যতটুকু পারছে রোযার আশেপাশেই থাকছে সর্বদা।তার যত্ন আত্তিতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই।এত এত ভালোবাসায় রোযা আপ্লুত।ইদানিং তার আবেগও বৃদ্ধি পেয়েছে ভীষণভাবে যা নিয়ন্ত্রণে খানিক বেগ পোহাতে হয়।

আজ শুক্রবার।সাপ্তাহিক ছুটির দিন।এই মুহূর্তে হলঘরের সোফায় বসে আছে রোযা। সামনের টি টেবিলে তার একবাটি ফল সাজানো।আঙুর,আপেল, কমলালেবু।বিপরীত প্রান্তে বসে চারুলতা চপিং বোর্ডে আপেল স্লাইস করে করে রাখছে।ভ্রুকুটি করলো সে রোযাকে,
– কি হলো? খাচ্ছোনা কেনো? ডক্টর কি বলেছে ভুলে গেছো?
গুঙিয়ে উঠলো রোযা।
– বিশ্বাস করো।একদম জায়গা নেই পেটে।একটু আগেই আসমান জোর করে স্যুপ খাইয়েছে।
– ইশ।অতটুকু বাটির স্যুপ তো নিহাদের পেটের এক কোণায় পরে থাকে।

সিঁড়িতে বসে ফিট ম্যাসাজ করতে থাকা নিহাদ কটমট করে তাকালো নিজের সম্বোধন শুনে।
– এসবের মাঝে আমাকে টানছ কেনো?আমি কি প্রেগনেন্ট নাকি? একটু বেশি খাই বলে এমন অপমান?
– আমার বলার উদ্দেশ্য হলো রোযা,অল্প অল্প করে বারবার খেতে হবে।কিছুটা খাও।বাকিটুকু পরে দেবো নাহয়।
নাক কুঁচকে খানিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোযা আপেলের টুকরো তুলে নিয়ে মুখে পুরলো।সিঁড়ির উপর থেকে নেমে এলো আসমান।নিহাদকে পাশ কাটিয়ে মেঝেতে দাঁড়িয়ে সে খানিকটা স্ট্রেচিং করলো।গত ঘণ্টা তিন যাবৎ একটানা সে অফিসরুমে প্রজেক্টের কাজ এবং জরুরী একটি অনলাইন মিটিং সেরেছে।স্ট্রেচিং সেরে দৃশ্যপট পর্যবেক্ষণ করে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সে, সোফায় রোযার পাশে বসলো।একটি হাত উদরে স্পর্শ করে স্নেহ বুলিয়ে বললো,

– এখন কেমন লাগছে?
– ভালো।তোমার কাজ শেষ?
– হুম।আর কিছু খেতে চাও?কিংবা কিছু করতে চাও?
– না না,আমি ঠিক আছি একদম।
চারুলতা মাথা হেলিয়ে আসমানকে প্রশ্ন করলো,
– তোর ক্ষুধা লেগেছে?খাবি কিছু?সকাল থেকে কিছুই তো খাসনি।বউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছিস নাকি?
কিঞ্চিৎ হাসলো আসমান,মাথা দোলালো।
– কিউকাম্বার স্যান্ডউইচ করেছিলাম,দেবো?
– দে।

চারুলতা কিচেন থেকে একটা প্লেটে দুটো স্যান্ডউইচ এবং টমেটো সস নিয়ে এলো।আসমানকে দিলো। তা সাদরে গ্রহণ করে কামড় বসালো অমানিশা।চারু নিহাদের দিকে তীর্যক তাকিয়ে শুধালো,
– তোমাকেও দেবো নাকি?মুখ বেয়ে তো পানি গড়াচ্ছে!
– আমাকে কি গোপাল ভাঁড় মনে হয়?
– হ্যাঁ,যাকে কিছুটা খাবার দান খয়রাত করা যায়।
– তোমার খয়রাত গ্রহণের মতন দুর্দিন আমার আসেনি হুহ!
মুখ ফিরিয়ে নিলো নিহাদ।কিন্তু চারুলতা একটি স্যান্ডউইচ এগিয়ে দিতেই এক ছোবলে তা পাকড়াও করে মুখে ঢোকালো।

– এটা কি হলো?
– কেউ যেচে যেচে দিতে এলে তাকে মানা করতে নেই।একটামাত্র কাদায় কালো মন তোমার,তাকে খানখান করে দিতে বাঁধছে।
চাটি খেলো নিহাদ বিপরীতে,খিলখিল করে হেসে উঠলো।অপরদিকে আসমান একদম স্থবির হয়ে গিয়েছে, না খেয়ে একদৃষ্টে আধখাওয়া স্যান্ডউইচের দিকে চেয়ে আছে সে।ব্যাপারটি খেয়াল করে রোযা জিজ্ঞেস করলো,
– কি ব্যাপার?কোনো সমস্যা?
জবাব এলোনা।আসমান নিঃশব্দে বাকিটুকু রেখে দিলো প্লেটে।দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো।বিষয়টি নিহাদ এবং চারুলতাও খেয়াল করেছে।হাহাকার করে নিহাদ বলল,
– প্লীজ বলো না এই পেত্নী আমাদের বাসি স্যান্ডউইচ খাওয়াচ্ছে!এই ডাইনী,কি মিশিয়েছ এতে যে আসমান ভাইয়ের মতন মানুষ এমন প্রতিক্রিয়া করে?
– আম..আমি…আমি তো কিছু করিনি।
ভড়কে গেলো চারু।সে সত্যিই বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে।রোযা উদ্বিগ্ন হয়ে আসমানের কাধ স্পর্শ করলো,
– এই আসমান!কি হয়েছে তোমার?

এবারেও কোনো জবাব এলোনা।খানিকটা ঘেমে গিয়েছে আসমান,তার শরীর ম্রিয়মাণভাবে কাঁপছে।চেহারা থেকে হাত সরালো,মুষ্টিবদ্ধ করলো তা।তারপর সকলকে হতভম্ব করে দিয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। একছুটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো দুইতলায়।বাকিরা অনুসরণ করলো তাকে।সবার সামনে চারু, তারপর রোযা এবং সবশেষে নিহাদ।কক্ষে আসতেই বাথরুমের দরজা খোলা পাওয়া গেলো। উঁকি দিতেই দেখা গেলো সিংকে দুহাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে আছে আসমান,চেহারা তার কুঁচকে আছে যন্ত্রণায়।
– সরো সরো।
মেয়েদের পিছনে ঠেলে নিহাদ প্রবেশ করলো, আসমানকে ধরলো পিছন থেকে। চারুলতা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,

– আমার স্যান্ডউইচ এতটাই বাজে হয়েছে যে ভাইয়া এভাবে বমি করছে?মাই হোল লাইফ ওয়ায আ লাই?
– ধুর।স্যান্ডউইচ সমস্যা নয়। নিহাদও খেয়েছে,ও তো ঠিকই আছে।
রোযা বিচলিত কন্ঠে জানালো।নিহাদ আসমানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
– আরে তুমিও বউয়ের মতন প্রেগনেন্ট হয়ে গেলে নাকি আসমান ভাই?
এই গুরুতর মুহূর্তেও নিহাদের বাক্যটি এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিলো যে হেসে ফেললো চারু এবং রোযা, পরবর্তীতেই জোরপূর্বক নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করলো।কি করছে কি তারা?আসমানের দিকে মনোযোগ দেয়া উচিৎ।কিন্তু কি হলো ছেলেটার হঠাৎ করে?

“আমার নিস্পাপ বাচ্চাটা কি দোষ করেছিল?ওকে কেনো মা*রলি?”
কোনো জবাব নেই।প্রশ্নটি শুধুমাত্র বেগবান হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গোত্তা খাচ্ছে অমানবিকতার দেয়ালে দেয়ালে।গহ্বর, অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে অন্তর।ছটফট করছে সর্বাঙ্গ।সামান্যতম দীপ্তি নেই,কোথাও নেই।হাত বাড়িয়ে অদৃশ্যমান আশাকে স্পর্শ করতে চাইলো আসমান,কিন্তু কোথাও অস্তিত্ব নেই কোনোকিছুর।একঝাঁক শূণ্যতা,না পাওয়ার বেদনা।অপূর্ণতার মহাকাব্য। নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে।সম্ভব হচ্ছেনা নিজেকে রক্ষা করা এই প্রগাঢ় লাঞ্ছনার সম্মুখে।
মেঘ…..আমার মেঘ…
একটি দৃশ্য ঝাপসা হয়ে ভেসে উঠলো নয়নপটে।

– মেঘ….মামণি আমার….
পুতুল যেন।বিন্দুমাত্র নড়চড় নেই।ঝাঁকির সঙ্গে ছোট ছোট হাত দুখানা দুলছে এদিক সেদিক।মাথাটা বাকা হয়ে ঝুলছে নিচের দিকে।অসহায় চেয়ে আছে আসমান।
এক আসমান, অপর এক আসমানকে প্রত্যক্ষ করছে অসহায়ত্বের চূড়ান্ত সীমান্তে।কিছুই করার নেই।ছোঁয়া সম্ভব নয় ওই অসাধ্যকে।কিছুতেই পরিবর্তন আনা যায়না।চিনচিন করে উঠলো বুকের ভেতরটা।নিজেকে উপেক্ষিত মনে হচ্ছে।চিরকালের ন্যায় হারিয়ে যাচ্ছে অস্তিত্ব।
হাহাকার করে উঠলো পিতৃহৃদয়।
না….মেঘ!যেওনা….
– মেঘ!
– আসমান?এই আসমান!

ঝাঁকি অনুভব করতেই আসমান ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো।সমস্ত শরীর তার ঘেমে উঠেছে, হৃদস্পন্দন হার মানিয়েছে তেজস্বী অশ্বকেও।সর্বাঙ্গ কাঁপছে কিঞ্চিৎ,অনুভূতির তাড়নায়।উদ্ভ্রান্তের ন্যায় চারিপাশে তাকালো অমানিশা,বিছানায় তার পাশেই বসে থাকা উদ্বিগ্ন রোযাকে নজরে এলো।
– কি ব্যাপার?দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?
উত্তর করলোনা আসমান।বরং দুবাহু বাড়িয়ে রোযাকে শক্তভাবে নিজের আলিঙ্গনে বেঁধে ফেললো। কাঁধে মাথা গুঁজে নিজেকে প্রশান্ত করতে চাইলো।বিহ্বল অর্ধাঙ্গিনী তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।পাল্টা নিজ উষ্ণতা বিলিয়ে যেন স্থির করতে চাইলো তার অশান্ত সত্ত্বাকে।দীর্ঘক্ষণ ওই অবস্থায়ই থাকলো দুইজন।আসমানের হৃদয় শান্ত হয়েছে অনুভব করে রোযা সন্তপর্নে প্রশ্ন করলো,

– মেঘের কথা মনে পড়েছে বুঝি?
জবাব হিসাবে রোযাকে দ্বিগুণ শক্তিতে নিজের আলিঙ্গনে আঁকড়ে ফেললো আসমান।তাতে সামান্য চাপ অনুভূত হলেও রোযা স্থির থাকলো।যতটা সম্ভব নিজের উপস্থিতির প্রেরণায় প্রিয়তমকে একটুখানি হলেও শান্তি প্রদান করতে চাইলো।আসমানের মনের অবস্থা সে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।আবারো পিতা হচ্ছে তার চাঁদ।পিতা হওয়ার অনুভূতি যেকোনো পুরুষের নিকটই সর্বদা বিশেষ কিছু।কিন্তু আসমানের ক্ষেত্রে তা একটু অধিক অর্থবহ।কারণটা তার দুর্বিষহ অতীত।সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে সে।যার বিরহে নিজের সবকিছু উৎসর্গ করেছে,আজ নতুন করে তেমন এক অস্তিত্বের আগমন তার চিত্তে বিশেষ প্রভাব ফেলারই কথা।রোযার ভীতিকে সত্যি প্রমাণিত করে আসমানের ভগ্ন কন্ঠস্বর ধ্বনিত হলো,

– আমি কি আমার অংশকে রক্ষা করতে পারবো জ্যোৎস্না?
প্রশ্নটি এতটা ভারী অর্থবহ যে তা বহনের দুঃসাধ্য রোযা করে উঠতে পারছেনা।বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো তার।বলে বসলো,
– কেনো আসমান?সেদিন কেনো ওদের অরক্ষিত রেখে চলে গিয়েছিলে?কেনো চলে আসবে বলেও আর ফিরে যাওনি?
থমকালো আসমান,সহসাই রোযাকে ছেড়ে দিলো।হাতের ভরে পিছিয়ে গিয়ে দূরে সরে বসলো।দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকিয়ে রইলো দেয়ালের বাইরের দিকে।উন্মুক্ত গগনজুড়ে কালচে ধূসর মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, প্রতিফলিত হচ্ছে সেই দৃশ্য কাচে। রোযা নাছোড়বান্দার মতন জিজ্ঞেস করলো,
– কি ব্যাপার?জবাব দিচ্ছনা কেনো?এতই যখন ব্যর্থতার গ্লানি,তখন কেনো প্রস্তুতি নাওনি?আফসোস করে কি প্রমাণ করতে চাও?

আসমানের উভয় হাত ক্রমশ মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো, এতটা শক্তভাবে যে আঙুলের খাঁজে খাঁজে শুভ্রতা তার লালচে আভায় রূপান্তরিত হলো।তবুও থামলোনা রোযা।আজ যদি সে পিছিয়ে যায়,তবে তার চাঁদের ভীতি কোনোদিনও দূরীভূত হবেনা।নিকটে সরলো সে, বললো,
– জবাব দাও আসমান।আর কতদিন অতীতের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হবে?প্রতি রাতে এইভাবে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠবে?হতাশায় নিমজ্জিত হবে?অনুভূতির দোলাচলে ভুগবে?যদি এতই যন্ত্রণা পাওয়ার ছিল তবে কেনো সেইদিন তুমি একটুখানি দ্রুত সেখানে পৌঁছালে না?
– কারণ ওদের বিশ্বাস করেছিলাম!
অমানিশার শক্তিশালী বজ্রকন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হলো দেয়ালে দেয়ালে। অর্ধাঙ্গিনীর মুখোমুখি সে।আক্রোশ এবং অনুশোচনায় প্রকম্পিত হয়ে চলেছে সর্বাঙ্গ তার।ভ্রু কুঞ্চন ধারণ করেছে তীব্র।পুষ্ট অধরজোড়া কিশলয়ের মতন কাঁপছে।

– জন্মদাতাকে বিশ্বাস করেছিলাম!ভাইকে বিশ্বাস করেছিলাম!বোনকে বিশ্বাস করেছিলাম!ভেবেছিলাম আর যাই হোক,তার র*ক্ত আমি!এত বড় বেঈমানি করবেনা!
চেয়ে থাকল রোযা,একদৃষ্টে।আসমানকে নিজের অভ্যন্তরের সবটা উগড়ে দিতে সুযোগ দিলো।
– বিশ্বাস এতটা ঠুনকো হবে কে জানতো?যা মনোমালিন্য ছিলো আমার সঙ্গে,কাজ ছেড়েছি আমি।কিন্তু আমার স্ত্রী সন্তান,তাদের মুখ একটিবার দেখতে চেয়েছিলো।যত যাই হোক জন্ম দিয়েছে, জীবনদান করেছে।একটিবার বিশ্বাস করে তার মূল্য পরিশোধ করতে চেয়েছিলাম।এই বিশ্বাসের মাশুল আমার সুখের সংসারের ধ্বং*স দিয়ে গুণতে হয়েছে!

আসমানের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে।হাঁটু আঁকড়ে ধরে মাথায় একটি হাত ঠেকালো সে।নিজেকে দমাতে চাইলো।চিৎকার করতে চাইছেনা আর।রোযা সময় দিলো তাকে।নিঃশব্দে বসে থাকলো, ওই একই ভঙ্গিতে।দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত বাদে আসমান তার দিকে তাকালো,একটি ঢোক গিলে বললো,
– তুমি একটুও অবাক হওনি।সবটা জানো তাইনা?
সম্মতিসূচক মাথা দোলালো রোযা।আসমান একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই বললো,
– তোমার স্বীকারোক্তির অপেক্ষা করছিলাম।
– আজ সেটি আদায় করে ছেড়েছ।
– কষ্ট পেয়েছ?দুঃখিত।
উত্তরের দরজায় যেন আবারো তালা পড়লো।কোনো জবাব নেই।রোযা একটি হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে আসমানের বাহু ছুঁয়ে দিলো।

– যা হয়েছে তাতে তোমার ব্যর্থতা কতটুকু কিংবা বিশ্বাসঘা*তকের অপরাধ কতটুকু তা হিসাব করবোনা, বিচারও করবোনা।লাভ নেই কোনো।আবার এটাও বলবোনা যে অতীত ভুলে যাও।সেটা কোনোদিন সম্ভব নয় তাও জানি।ভাবছো,তবে কি করবে তুমি?
আসমানের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতে চাইলো রোযা,কিন্তু খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলোনা।মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে চাঁদ, যেন অভিমান করেছে।তাই রোযা কিঞ্চিৎ হেসে বললো,
– আফসোস এবং আতঙ্ক কোনকিছুর সমাধান হতে পারেনা।তোমার অংশকে রক্ষা করতে পারবে কি?এমন দুশ্চিন্তায় ভুগছো,লজ্জা করেনা তোমার?
এবার আসমানের মনোযোগ আকর্ষিত হলো।সামান্য মাথা হেলিয়ে আলগোছে চাইলো সে রোযার দিকে।লোকায়িত দৃষ্টি স্পষ্ট অনুভব করলো অর্ধাঙ্গিনী তার।দৃপ্ত কণ্ঠে ব্যক্ত করলো,

– কে তুমি?দ্যা কি*লিং মেশিন আসমান।কে তুমি? পরাশক্তিধর অমানিশা,যার হুকুমে পরাবাস্তবও করজোড়ে নমিত হয়।কে তুমি?রেমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির কর্ণধার,রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক ক্ষমতাশালী নীলাদ্রি রেমান নীল।নিজের সম্পর্কে একবিন্দু সন্দেহ পোষণের পূর্বে কোথায় তোমার অবস্থান ভাবা উচিত।বলছো তোমার অংশকে রক্ষা করতে পারবেনা?উহু।তোমার হিমশীতল অটল হিমালয়ের র*ক্তপিপাসু দৃষ্টি মোকাবেলা করে কোনো অশুভ তোমার অংশের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও দুঃসাহস করবেনা!এমনি এক কিংবদন্তী নেমেসিস তুমি!
রোযার প্রতিটা বাক্য যেন আসমানের হৃদয়ে কড়াঘাত করলো দারুণভাবে।ঐন্দ্রজালিক অস্তিত্বের উপলব্ধিতে নিজেকে বেসামাল অনুভূত হচ্ছে।নিজেকে সন্দেহ করছিলো সে আদতেই।কিন্তু কেনো?ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে সে,প্রতিষ্ঠিত করেছে আপন রাজত্বের প্রভাব,প্রতিজ্ঞা নিয়েছে ঢাল হয়ে রক্ষা করার পরিবারকে।তবে এই দোলাচল কেনো?

– আমি কি আমার অংশকে রক্ষা করতে পারবো?কথাটি এমন নয়,বরং এমন হওয়া উচিত যে হ্যাঁ আমি পারবো!আমি আমার অংশকে আপন ধ্বংসাধিপতির পঙ্কিলতা থেকেও রক্ষা করার ক্ষমতা রাখি!
সম্পূর্ণ রোযার দিকে ফিরলো আসমান,তাকিয়ে রইলো বরাবর,প্রজ্জ্বলিত তারকাখচিত ওই নয়নমাঝে।
– এহেন আত্মবিশ্বাস আমার উপর?
– এই আত্মবিশ্বাস আমার আপন পূর্ণতার উপর, তুমিই যে সেই পূর্ণতা চাঁদ।
সন্নিকটে সরে দ্বিতীয় দফায় রোযাকে আলিঙ্গনে বাঁধলো আসমান।এবার প্রশান্তির আশায় নয়,প্রগাঢ় আবেগে।তাকে পাল্টা আলিঙ্গন করে রোযা জানালো,

– ভয় পেওনা চাঁদ।তোমার সঙ্গে বিনাশ মানায়, ভীতি নয়।আগে তো তুমি একা ছিলে।একক বিনাশক হয়ে ধ্বংস রচেছ বিশ্বাসঘা*তকের।এবার?আমি আছি।চারুলতার মতন বোন,নিহাদের মতন ভাই এবং বিলাল রেমানের মতন একজন বটগাছ সমতুল্য আশ্রয়স্থল রয়েছে তোমার।সঙ্গে তোমার আমার ভালোবাসার পরিণয়।গোটা একটি পরিবার আছে তোমার সঙ্গে।ভয় কিসের?ঐক্য কখনো হারেনা।
– আমার ভাগ্য আদতে অভিশপ্ত নাকি উদার সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কোনোদিন কাটবেনা আমার।এই ভাগ্য যদি একটি মুদ্রা হয়,তবে তার এক পিঠে অভিশাপ এবং অপর পিঠে তুমি।
হাসলো রোযা সামান্য।

– কথা দিয়েছিলাম,তোমার অভিশপ্ত ভাগ্যকে মোকাবেলা করবো আমি।এই প্রতিজ্ঞা আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বহমান থাকবে।
মুখ তুলে রোযাকে নিকটে টানলো আসমান,এক লহমায় অধরে অধর যুক্ত করলো।কোনো কোমলতা নেই।ভালোবাসার তীব্র আস্বাদন।অর্ধাঙ্গিনীও সাড়া দিলো তার একই অনুভূতিতে।ক্রমশ নিম্নপানে ঝুঁকলো আসমান,উদরে পৌঁছে তাতে প্রগাঢ় চুম্বন স্থাপন করলো।
– অংশ আমার,নিজেকে নিয়ে সন্দেহ পোষণে আমি দুঃখিত।তোমার অপেক্ষায় আছে এই পিতার অন্তর।অবসান করো এই অশুভতার।প্রতিজ্ঞা করছি,রক্ষা করবো তোমায়,তোমার জন্মদাত্রীকে,নিজের শরীরে প্রবাহমান অন্তিম র*ক্তবিন্দু পর্যন্ত।
আসমানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো রোযা সযত্নে।তার দিকে চেয়ে অমানিশা বললো,

– ধন্যবাদ জানানো হয়নি তোমাকে।
– কিসের ধন্যবাদ?
– আমাকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার প্রদানের জন্য ধন্যবাদ।
– সেটা কি তোমার অংশের আগমন সংবাদ?
– জ্যোৎস্না ও জ্যোৎস্নার অংশ।দুটোই।
একে অপরের দৃষ্টিমাঝে বিলীন ঘটলো চাঁদ এবং জ্যোৎস্নার।হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে শক্তভাবে চেপে গেলো তাদের আঙুলসমূহ।জানান দিলো ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের। যাই হয়ে যাক না কেনো, মোকাবেলায় পিছপা হটবেনা অস্তিত্ব তাদের।

মেঘতীর ভবনের পাশের বাগানজুড়ে পোড়ামাটির ইটের তৈরি পথ রয়েছে।মসৃণ নয়,একেবারে বন্ধুরও নয়।দুপাশের ফুলের গাছের মাঝ দিয়ে চলাচলের ব্যবস্থাটুকু নজরকাড়া বটে।তবে আজ সেই পথধরে এলোমেলোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে একটি গিয়ারযুক্ত বাইসাইকেল।পরিধানে হেলমেট,দুহাতে ফিঙ্গারলেস গ্লাভস এবং সুদর্শন চেহারার দৃষ্টিজুড়ে কঠোর মনোযোগ।নিজের ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে নিহাদ।যেভাবেই হোক সফল হতেই হবে তাকে।
দুপায়ে প্যাডেল চাপতে সামান্য কষ্টই হচ্ছে,তবুও নাছোড়বান্দা সে।বক্রভাবে হলেও এখনো পর্যন্ত নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।পিছনে সতর্কিত দৃষ্টি রেখে হেঁটে আসছে চারুলতা।সপ্তম চক্কর পূর্ণ হতেই অতি উত্তেজনায় এক হাত তুলে নিহাদ ঝংকার তুললো,

– ইয়াহু! এবার আমার বাইক চালানো ঠেকায় কে?
– অতি উত্তেজিত হয়োনা।
চারুলতার প্রতিক্রিয়ায় মুখ ভেংচালো নিহাদ,জিভ বের করে বললো,
– হিংসা হয়?
– আফসোস হয়।তোমার মতন একটা মাথামোটার পাল্লায় পরেছি বলে।
– আমি পরতে বলেছি?কেউ যেচে যেচে হাড়িকাঠে মাথা দিতে চাইলে আমি এতটাও ভদ্র নই যে ফিরিয়ে দেবো।
– সাইকেল থামাও।অনেক হয়েছে।
– কেনো?তোমার জ্বলে?
– খুব জ্বলে।
– কি জ্বলে?
– পরান জ্বলে,জবাবের আশায়।আজ পর্যন্ত তো এলোনা।
– ওটা গ্যাস্ট্রিকের জ্বলুনি।ঔষধ খাও।
সাইকেল ঘুরিয়ে তীর্যক হাসলো নিহাদ।তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো তাতে চারুলতা।ধমকে বলে উঠলো,

– এই ছেলে এই!কি পেয়েছ কি আমাকে?তোমার দাসী?নাকি গৃহপালিত পশু?যে সবসময় আশেপাশে লেজ নাড়িয়ে ঘুরঘুর করে বেড়াবো?কতদিন ঘোরাতে চাও আমাকে?
– তোমার লেজও আছে?কই দেখি!
নিহাদের মিছিমিছি বিস্ময় প্রকাশে বিনা কারণেই চারুলতার কপোল লালিমায় আচ্ছাদিত হলো।পাল্টা প্রতিবাদ করতে চাইলেও করলোনা।দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে উল্টো ঘুরে হনহনিয়ে চলে যেতে যেতে বললো,
– দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা কেউই বুঝতে পারেনা।
– ইশ।শখ কত!আমার চেহারা দেখেছ?হলিউডের কিলিয়ান মারফি ফেইল।লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ব্যাটা আগে জন্মে ভাগ্য করে টাইটানিকে সুযোগ পেয়েছে।নাহলে রোজের বিপরীতে আমি থাকতাম, হুহ!আর তুমি দুইদিনের বৈরাগী মেয়েমানুষ,পাবনার পাগলী পামেলা হয়ে লম্বা লম্বা ডায়লগ ঝাড়ো?

– ইশ!কিলিয়ান মারফি? ঢপ দেয়ার আর জায়গা পাওনা?চট্টলার চাপাবাজ চাকলাদার!
উত্তেজনায় গতি বৃদ্ধি করতে গিয়েও যেন ফাঁদে পড়লো নিহাদ।
– কি বললে তুমি….এই….. আহ…. আ….
খাল কে*টে কুমির না আসলে নিজ দায়িত্বে কুমিরভর্তি খালে ঝাঁ*প দেয়ার স্বভাবের অধিকারী নিহাদ এক লহমায় ভারসাম্য হারালো।
– আ….বাঁচাও…. পেত্নীইইই….
– নিহাদ!

ছুটে এলো চারুলতা। বাইসাইকেল এঁকেবেঁকে খেই হারিয়ে ছুটছে ঝোঁপের দিকে।শক্ত হাতে পিছনের অংশ চারু আঁকড়ে ধরলেও শেষরক্ষা করতে পারলোনা। সাইকেলসমেত আছড়ে পড়লো নিহাদ, একেবারে ঝোপঝাড়ের মাঝে।বেচারা চারুলতা পায়ে গোত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে নিলো।তবে অন্তিম মুহূর্ত শক্তিশালী একজোড়া বাহু জড়িয়ে গেলো তার চারিপাশে।সজোর টানে পাথরসম কঠিন বক্ষমাঝে লুটিয়ে পড়লো সে।সাইলেকটি পতিত হলো ঠিক পাশেই।
অতঃপর পিনপতন নীরবতা।

শুধুমাত্র ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ক্রিয়া অনুভূত হলো।বেশ কিছু মুহূর্তের জন্য কিছুই বোধগম্য হলোনা চারুলতার।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে দ্রুতই মাথা তুলে তাকালো সে।তারপরই একদম স্থবির হয়ে পড়লো।ঠিক নিচেই রয়েছে নিহাদ।তাকে বুকের মাঝে টেনে নিয়েছিল অন্তিম লগ্নে,তাতে খুব বেশি ব্যথা লাগেনি চারুর।কিন্তু নিহাদ নিজে?তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছেনা কোনরকম যন্ত্রণা পেয়েছে।ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে চারুলতার নয়নমাঝে।এতটা সন্নিকট থেকে এই প্রথম নিহাদের কপোল এবং কানে লালিমা প্রস্ফুটিত হতে লক্ষ্য করলো চারু।দৃষ্টি এবং অভিব্যক্তি উভয়জুড়ে বিব্রতবোধ স্পষ্ট সুদর্শনের।
নিহাদ লজ্জা পাচ্ছে!অবিশ্বাস্য!
চারুলতার ইচ্ছা হলোনা মুহূর্তটি অবসান করার।কিন্তু অন্তর অদ্ভুত দোলাচলে আন্দোলিত হয়ে চলেছে।যদি দূরে না সরে যায় তবে কি হবে তা আন্দাজ করাও কঠিন।

– তুম…তুমি ঠিক আছো?
তৎক্ষণাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে এতক্ষণ যাবত বেহায়ার মতন চারুলতার দিকে তাকিয়ে থাকা নিহাদ মাথা ঘুরিয়ে ফেললো,পাশে তাকিয়ে জানালো।
– ঠি…ঠিক আছি।
– নিজেও ম*রবে,সাথে আমাকেও মা*রবে।চিংটা চাকলাদার কোথাকার!

অত্যন্ত দ্রুত উঠে পড়তে গেলো চারুলতা।কিন্তু তার দীঘল কেশরাশির গুচ্ছ নিহাদের বুকে সংযুক্ত ট্রেইনিং বেল্টের খাঁজে আটকে গিয়েছে। তা লক্ষ্য করে হাত এগোতেই পরাজিত হতে হলো তাকে।এর পূর্বেই নিহাদের আঙুল পাকড়াও করেছে সেই গুচ্ছকে।সযত্নে ছাড়িয়ে আনলো কেশসমূহ সুদর্শন,অতঃপর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটি কাণ্ড ঘটালো।নিজের অধরে ছুঁয়ে দিলো তা।সরাসরি স্পর্শ নয়,তবুও এই পরোক্ষ আবেদনে শিউরে উঠলো চারুলতা।নিহাদের দৃষ্টি আবদ্ধ তার চেহারার গাঁথুনিতে।যেন কোনো ভাস্কর অতি মুগ্ধতায় অবলোকন করছে এক নিখুঁত ভাস্কর্যের সৃষ্টি সৌন্দর্য্য।

– তুমি সুন্দর চারুলতা,খুব সুন্দর।
অস্ফুট স্বরে প্রশংসাটুকু ভেসে এলো।হৃদস্পন্দন থমকে পড়লো রমণীর।কেমন হাসফাঁস করে উঠলো অন্তর।এ কেমন অনুভূতি?কারো সামান্য একটি কথায় কিভাবে এতটা প্রভাবিত হতে পারে সে?কেমন এক ভীতি অনুভূত হলো।তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ল চারুলতা।নিহাদের থেকে নিজের কেশ ছাড়িয়ে শক্তভাবে খোঁপা বাঁধলো খোলা চুলের সৌন্দর্য হটিয়ে।
দ্রুতই প্রস্থান করতে চাইলো।কিন্তু সম্ভব হলোনা।তার কব্জি শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলো নিহাদ।উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

– চারুলতা?
– হাত ছাড়ো আমার।কোন অধিকারে ধরেছ এই হাত?
– অধিকার?শুরুটা তুমি করেছ,আমি নই।তখন সেটা অধিকার হরণ হয়নি?
সামান্য ক্রোধ প্রকাশ করলো নিহাদ।তাতে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে চারু তার দৃষ্টির মোকাবেলা করলো।
– জবাব না দাও,অন্তত আশা দিওনা।
পূর্বের কথার রেশ ধরে নিহাদ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু চারুলতার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে পড়লো।টলটলে আবহ ফুটেছে রমণীর দৃপ্ত টানা নয়নজুড়ে।বুকের বাম পাশে হাত চাপলো সে, আঁকড়ে ধরে জানালো,
– এই হৃদয় কত শত সহস্র টুকরোয় খ*ন্ডিত বিখ*ন্ডিত সেই সম্পর্কে তোমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।আর একটিমাত্র খন্ড,আমার অস্তিত্বের অবসান।যদি এই ভগ্ন সত্তাকে নাই চাও তবে তাই জেনে বাঁচবো আমি।তবুও ওই নিষ্পাপতায় ঘেরা দৃষ্টি এবং নিগূঢ় ছোঁয়ায় আমায় আশান্বিত করোনা। আশার ভঙ্গুরতা বড়ই অসহনীয়।
উল্টো ঘুরল চারু,হাঁটু উঁচু করে উঠে দাঁড়াতে চাইলো, ঠিক তখনি ভেসে এলো এক ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠস্বর।

– জবাব চাও তুমি?
পিছনে ফিরে তাকালো রমণী।সর্বদা শিশুসুলভ উচ্ছলতায় ঘেরা দুরন্ত বাউন্ডুলে সত্তাটিকে বর্তমানে প্রদর্শিত হচ্ছে স্থির প্রশান্ত সমুদ্রের ন্যায়। অভিব্যক্তিজুড়ে দৃঢ়তা,ভঙ্গিমায় আত্মবিশ্বাস। ডান হাতটি উত্তোলন করে এক টানে চারুলতার সদ্য করা খোঁপাটি খুললো নিহাদ। কাঁধ ভাসিয়ে একেবারে কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল মসৃণ কেশপ্রবাহ। ভাঁজে ভাঁজে তার লোকায়িত খয়েরী আভা।সম্মোহিতের ন্যায় সেই কেশের মাঝে আঙুল চালিয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে নিহাদ বিড়বিড় করলো,

– এই আমার অধিকার….
বিহ্বল চারুলতার কপোলে ঠেকলো তার বাম হাতখানি।যুক্ত করলো,
– …..আর এই তোমার জবাব।
দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিলীন হলো।অধরের মিলন ঘটলো।প্রগাঢ় আবেশে ছেয়ে গেলো সম্পূর্ণ জগৎ যেন।রমণীর নয়নে টলটলে হয়ে আবদ্ধ আবেগখানি অশ্রুফোটা হয়ে কপোল বেয়ে গড়িয়ে নামলো,অতঃপর দৃষ্টি বুজে এলো অনুভূতির অনুভবে।নিহাদের অধরের ক্রমাগত স্পর্শে কম্পিত হলো সর্বাঙ্গ। আঁকড়ে গেলো আঙুলসমূহ,প্রিয়র কাঁধজুড়ে। ফিঙ্গারলেস গ্লাভস পরিহিত বলিষ্ঠ হাতদুটো পিঠ বেয়ে নেমে এলো কোমরে,স্পর্শ বোলালো,যেন অধিকার ফলিয়ে দেখালো নিজের।

দীর্ঘ এক গভীর মুহুর্ত বাদে চারুলতাকে মুক্ত করলো নিহাদ।অজান্তেই কপালে কপাল ঠেকলো দুজনের, প্রশ্বাস গ্রহণ করলো বুকভরে।তাকালো দৃষ্টিমাঝে। নয়নপাঁপড়ি মেলে সুদর্শনা তাকাতেই নিহাদের ওষ্ঠজুড়ে তীর্যক হাসির উদ্ভব ঘটলো।বৃদ্ধাঙ্গুলি তার স্থাপিত হলো চারুলতার সদ্য আস্বাদিত অধরপল্লবে।নিজের কর্মে সন্তুষ্ট এমন ভঙ্গিতে আবেগ জড়ানো কন্ঠে শুধালো,
– এর চাইতেও স্পষ্ট জবাব প্রয়োজন?

স্পষ্টত ঢোক গিললো চারুলতা।আর সহ্য করা সম্ভবপর নয়।এক ধাক্কায় নিহাদকে নিকট থেকে সরিয়ে উঠে পড়ল,ছুটলো বাড়ির অভ্যন্তরে ঊর্ধ্বশ্বাসে।একবারও আর পিছন ফিরে তাকালোনা।অপরদিকে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে তখনো ঝোঁপের মাঝে বসে থাকা নিহাদ তার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকলো।দীর্ঘক্ষণ।শেষ দৃশ্যে রমণীর অধরে প্রস্ফুটিত লাজমাখা হাসিখানি তার নজর এড়ায়নি।সেই হাসি সংক্রমিত হলো নিহাদের মাঝেও।দুহাত মাথার পিছনে গুঁজে সে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ঘাসে আচ্ছাদিত ভূমিতে।দৃষ্টি সুদূর গগনপানে।অন্তরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে তার,সঙ্গে সুতীব্র সুখের অনুভুতি।

চিকিৎসকের চেম্বারে টেবিলের বিপরীতপ্রান্তে বসে আছে আসমান এবং রোযা।সাপ্তাহিক চেকআপের জন্য এসেছে তারা।চেয়ারে শিরদাঁড়া টানটান করে বসে মধ্যবয়স্ক মহিলা চিকিৎসক নোটপ্যাডের পৃষ্ঠাজুড়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে কিছু লিখে চলেছেন। তা লক্ষ্য করে বিনা কারণেই অস্বস্তি বোধ করছে আসমান।সেদিনের সেই ঘটনাটি রোযা চিকিৎসক পর্যন্ত টেনে ছেড়েছে।ওইদিন ঐভাবে বমি হওয়ার পর আসমানেরও খাবার দাবার নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।গা গোলানো ভাব এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি যেন নিত্যসঙ্গী।প্রথমবার ফুড পয়*জনিং ধরে ব্যাপারটা উপেক্ষা করা গেলেও আর সম্ভব নয়।সকলের জোরাজুরিতে চিকিৎসককে জানাতে বাধ্য হয়েছে।সে এবং রোযা উভয়ে বর্তমানে খানিক উদ্বিগ্ন হয়ে মন্তব্যের অপেক্ষা করছে।
অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চিকিৎসক মাথা তুলে তাকালেন।তার আঙুলের ফাঁকে ঝুলন্ত কলম, চেহারাজুড়ে বিস্তৃত হাসি।

– দুশ্চিন্তার কোনো বিষয় নেই মিস্টার নীল।আপনি প্রেগন্যান্সি সিন্ড্রোমে ভুগছেন।
– হোয়াট?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো আসমান, দৃষ্টিজুড়ে তার অবিশ্বাস।এ কেমন করে সম্ভব?তবে কি নিহাদ সত্যি বলছিলো?সে কি প্রেগ…তওবা তওবা! তা কি করে হয়?এমন তাজ্জব কথা কল্পনাযোগ্যও নয়। রোযার দিকে তাকালো সে, বেচারী নিজেও বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।তাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে চিকিৎসক শব্দ করে হাসলেন।

– হাহা,এত চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই বললাম তো।এটা আপনারা যেমন ভাবছেন তেমন বিষয় নয়।মেডিকেলের ভাষায় একে বলা হয়,কুভেড সিনড্রোম। এটি একটি মানসিক এবং শারীরিক প্রতিক্রিয়া, যেখানে একজন পুরুষ, বিশেষ করে যিনি শীঘ্রই পিতা হতে চলেছেন, তার সঙ্গীর গর্ভাবস্থার সাথে সম্পর্কিত কিছু উপসর্গ অনুভব করতে পারেন।
তবুও বোধগম্য হলোনা দম্পতির।আসমান মাথা কাত করে জিজ্ঞেস করলো,

– আমি কি তাহলে মানসিকভাবে অসুস্থ?
– অবশ্যই নয়, আপনি কুভেড সিন্ড্রোম অনুভব করছেন।এর কারণ আপনি আপনার সঙ্গীর সঙ্গে মানসিকভাবে এতটাই সংযুক্ত যে তার অভিজ্ঞতা অবচেতনভাবে অনুভব করতে শুরু করেছেন।
বিব্রতবোধ করলো আসমান বিনা কারণেই,সংকুচিত হয়ে বসলো চেয়ারে।সে কি শেষ পর্যন্ত এতটা বউপাগল প্রমাণিত হলো?আড়চোখে পাশের রোযার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলো সে,অর্ধাঙ্গিনী তার মিটিমিটি হাসছে।তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে কন্ঠ পরিষ্কার করলো।চিকিৎসক লিখতে লিখতে বললেন,
– সঙ্গীর সঙ্গে প্রগাঢ় সংযুক্ততা, হরমোনাল পরিবর্তন এবং পিতৃত্বের স্ট্রেস থেকে ব্যাপারটি ঘটতে পারে।সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস এবং শেষ তিন মাসের দিকে এরকম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে কারণ মুহূর্তগুলো পিতামাতা উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।মিসেস রোযার যেহেতু প্রায় আড়াই মাসের মতন চলছে সেহেতু আপনার সঙ্গে এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

– ওহ আচ্ছা।
ছোট্ট করে জবাব দিলো আসমান।রোযার দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে বারংবার। রোযা আপনমনে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
– এখন তাহলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে কি করতে হবে ডক্টর?
– তেমন কিছুই নয়।আপনার গর্ভাবস্থার সঙ্গে উনি অভ্যস্থ হয়ে আসলে এমনিতেও উপসর্গ কমে যাবে।আর স্ট্রেস বিষয়টা থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে।তাহলেই ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে আশা করছি।তবে এরপরও যদি সমস্যা হয় আমাকে জানাবেন।

– ধন্যবাদ ডক্টর।
মিনিট পনেরো বাদে চেম্বার থেকে বেরোলো রোযা এবং আসমান।বাইরের উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকলো দুইজনই।আসমান যথারীতি একপাশে তাকিয়ে আছে, কিছুতেই রোযার মোকাবেলা করতে চায়না।অপরদিকে রোযা মুখ টিপে হেসে তৎক্ষণাৎ বলে বসলো,

– হিহি…. কুভেড সিন্ড্রোম…!
– শ.. শাট…আপ!এটা হাসির কিছু হলো?
– হাহাহা…তবে তুমি এত লজ্জা পাচ্ছো কেনো?
– আম…আমি…কই…আমি কেনো লজ্জা পেতে যাবো?
– তোমার কানদুটো টকটকে হয়ে আছে আসমান!
সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে কান চেপে ধরে হাঁটার গতি বাড়ালো আসমান।দ্রুত পৌঁছালো পার্কিং লটে রাখা পোর্শের কাছে।প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলতে গেলেই রোযা তার হাত স্পর্শ করলো,মৃদু হেসে বললো,
– এতে লজ্জার কিছু নেই চাঁদ।আমি তোমার মজা নিচ্ছি না, বরং প্রচণ্ড খুশি অনুভব করছি।
কিছুটা বিস্ময় নিয়ে ফিরে তাকালো আসমান।রোযা সন্নিকটে সরে উভয় হাতে তার মুখ স্পর্শ করলো, দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বললো,

– আমাদের অংশকে আমি নিজের মাঝে ধারণের সময় যা যা অনুভব করছি,তাই তাই তুমিও অনুভব করতে পারছো।এর অর্থ কি জানো?এর অর্থ তুমি আমাকে এতটাই ভালোবাসো যে তোমার অবচেতন হৃদয় আমার অনুভবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে।
দৃষ্টি নমনীয় হলো আসমানের,মুগ্ধতা নিয়ে সে তাকালো রোযার দিকে।কপালে কপাল স্পর্শ করলো,
– যদি আসলেই ঘটনাটি হয়ে থাকে তবে আমার কোনো খেদ নেই।তোমাকে অনুভব করতে পারছি, তা সুখ হোক বা যন্ত্রণা।আমাদের মধ্যকার এই সংযুক্তি অসামান্য,অতুলনীয়।

– হ্যাঁ চাঁদ।আমাদের ভালোবাসা ঠুনকো নয়।আমাকে এতটা প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করতে পারার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
অমানিশার কপালে আদর ছুঁইয়ে দিলো রোযা। তা শিশুটি হয়ে গ্রহণ করে নিলো সে।সাবধানে অর্ধাঙ্গিনীকে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে উঠলো।স্টিয়ারিং ধরে নিরাপদ এবং আরামদায়ক গতিতে গাড়ি চালানো আরম্ভ করে খানিক ভেবে জানালো,
– এহেম…রোযা?
– হুম?
– যা হয়েছে তা বাড়িতে কাউকে বলার দরকার নেই।বিশেষ করে নিহাদকে।
– হিহি…ভয় পাচ্ছো নাকি?ক্ষেপাবে তোমাকে ভীষণ!
– ওটা একটা পাগলা কুকুর।ভয় পাবোনা?

আসমানের স্বীকারোক্তিতে খিলখিল করে হাসতে থাকলো রোযা।লুকিং গ্লাসে প্রতিফলিত হওয়া সেই হাসির মাঝে অপলক চেয়ে রইলো আসমান।এত সুখের অনুভূতি, এত উচ্ছ্বাস এবং এই পরিপূর্ণতা।কোনো দমকা হাওয়ায় সবকিছু আবার এলোমেলো হয়ে যাবেনা তো?
কোনোদিন না।সে হতে দেবেনা!

ডার্কসাইড পর্ব ৫৮

নিজেকে শাসালো অমানিশা।ভাগ্যের চোখে চোখ রেখে মোকাবেলা করবে সে নিজের সুখের জন্য।এবার কোনোপ্রকার ছাড় দেবেনা কাউকে।সে যেই হোক না কেনো।উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ শক্তভাবে স্টিয়ারিংয়ে চেপে বসলো আসমানের আঙুলসমূহ।
অবচেতন মন টের পাচ্ছে যেন,ঝড় আসন্ন।

ডার্কসাইড পর্ব ৬০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here