ডার্কসাইড পর্ব ৬০
জাবিন ফোরকান
ক্যামেরাস্ট্যান্ড গুছিয়ে রেখে মাইক্রোফোন এবং লেন্সগুলো সব বক্সে ভরলো অনির্বাণ। সবেমাত্র তার নতুন প্রজেক্টের একটি ভিডিও শ্যু*টিং সমাপ্ত করেছে।এডিটিং এবং বাকি টুকটাক কাজকর্ম সমাপ্ত করে আগামী পরশুনাগাদ আপলোড করবে,আপনমনে সিদ্ধান্ত নিলো। সেটাপ গুছিয়ে নিয়ে নিজের স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এলো সে। অ্যাপার্টমেন্টের কিচেনে এসে কফি মেশিনের প্লাগ ইনপুট করলো, কড়া এক মগ কফি দরকার শরীরকে সতেজ করবার জন্য। পানি গরম হতে হতে কাউন্টারে হেলান দিয়ে পকেটস্থ ফোনটি বের করে হাতে নিলো। লক স্ক্রীন খুলতেই ওয়ালপেপারে রমণীটির চেহারা ভেসে উঠলো।
তীক্ষ্ণ ধাঁচের চেহারা,তাতে অনুভূতিতে টইটুম্বুর ডাগর ডাগর নয়ন।সামান্যতম দূর্বলতা নেই দৃষ্টিতে,রয়েছে অপার দুঃসাহস। হাতে একটি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ, উচ্চ শিরে নয়নপাত তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে।চারিপাশে বায়ুতে দোদুল্যমান কালো এবং বাদামীর মিশেলে কেশরাশি অভূতপূর্ব ঠেকছে।চেয়ে থাকলো অনির্বাণ, অজান্তেই তার অধরে প্রস্ফুটিত হলো কোমল এক হাসির রেখা।ছবিটি আন্দোলনের সময়ে তোলা,রমণীর অগোচরে।ক্যামেরার ফিল্ম থেকে তা নিজের ওয়ালপেপারে স্থান পাবে এমনটা অনির্বাণের কল্পনাতীত ছিলো আজ থেকে কিছুদিন আগ পর্যন্তও।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রমণী সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা সাংবাদিক সাহেবের নিছক কম নয়।ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়,নিজের মিশনের প্রয়োজনে,সত্য উদঘাটনের প্রয়োজনে কিংবা নিছক বিনোদনের উদ্দেশ্যেও তার শেকড়হীন জীবনে বহু নারীর আনাগোনা ঘটেছে।অচিরেই ঝরে গিয়েছে তার মস্তিষ্ক থেকে সেইসব স্মৃতি,শুষ্ক শীতে ঝরে পড়া গাছের পাতার মতন;কোনোদিন হৃদয় অবধি পৌঁছাতে পারেনি।কিন্তু এই দৃপ্তনয়না, দোলা দিয়েছে অপ্রতিরোধ্য অন্তরে, ভীষণভাবে।
মেসেজ অ্যাপসে ঢুকে অনির্বাণ মেসেজ করলো,
প্লেবয়: হেই,জাস্ট ফিনিশড শ্যু*টিং।
প্লেবয়: আগামীকাল একসাথে ব্রাঞ্চ করি? ফ্রী আছো?
উত্তর এলোনা।এর পরিবর্তে একটি অচেনা নাম্বার থেকে কল এলো।সামান্য ভ্রু কুঁচকে রিসিভ করলো অনির্বাণ।তার ক্ষেত্রে এমন অচেনা স্থান থেকে ফোন নতুন কিছু নয়,সে যে কাজে লিপ্ত আছে তাতে প্রায়শই এমন হয়ে থাকে।প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত কিছু নাকি?নিশ্চিত হতে চাইলো অভিজ্ঞ সাংবাদিক।
– হ্যালো?
– মিস্টার অনির্বাণ আহমেদ?
– ইয়েস,অনির্বাণ স্পিকিং।আপনি কে বলছেন?
মিনিট দুয়েক চললো ফোনালাপ।অতঃপর যখন বিপবিপ শব্দ করে লাইন কেটে গেলো,তখন অনির্বাণের সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে। ফোনটা হাত থেকে ধপাস করে কাউন্টারে পড়লো,কফি মেশিন অতিরিক্ত উত্তাপে ঘড়ঘড় শব্দ করছে।কোনোদিকে খেয়াল নেই তার।উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি,হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁটু ভেঙে এলো, কাউন্টার ঘেঁষেই বসে পড়ল অনির্বাণ।জীবনের প্রথমবারের মতন একটি যন্ত্রণাদায়ক জঘণ্য অনুভূতি অনুভব করছে সে।
শেকড়ের টান!
মেঘতীর।
– কুভেড সিন্ড্রোম!হাহাহাহা….
পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে মেঝের কার্পেটের এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি কেটে চলেছে নিহাদ।তার কান্ডকারখানায় স্তব্ধ চারুলতা আনমনে শর্মা চিবুতে চিবুতে চেয়ে আছে।কিছুক্ষণ আগেই বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করেছিল সে।রোযা ভীষণ করে শর্মা খেতে চেয়েছিল,এবং তার স্বামীর হাতে নয়,তার দোকানেরটাই চাই।সকলের জন্যই তাই শর্মা এবং আমপান্না আনিয়েছে।তবে যার উদ্দেশ্যে তা আনা,সে নিজেই বর্তমানে গা গুলিয়ে ওঠার অনুভবে স্বাদের শর্মা না খেয়ে চুপটি করে বসে আছে।
অপরদিকে নিহাদের বিদ্রুপের নিশানা একদম স্থির ভঙ্গিতে,দৃষ্টিতে অশনী সংকেত ঝুলিয়ে ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার হাতেও শর্মার প্যাকেট, কিন্তু সেটি পাকস্থলীতে স্থান পাওয়ার বদলে মুষ্টিমাঝে ক্রমশ নির্যা*তিত হচ্ছে।
– মাই গুডনেস!আহা….হাহাহা…. মানে একটা পুরুষ কোন লেভেলে বউ আসক্ত হলো সে বউয়ের সাথে সাথে নিজেও প্রেগনেন্ট হয়ে যায়!হাহাহা….
নিহাদের কন্ঠস্বর এবং হাসির দমক রেলিংয়ের সঙ্গে দাঁড়ানো আসমানের সর্বাঙ্গে ক্রোধতরঙ্গ খেলিয়ে দিলো।তীব্র দৃষ্টিতে সে তাকালো হারিকেনের মতন দেখতে কৃত্রিম লণ্ঠনের পাশে বালিশ এবং কুশনের মাঝে বসে থাকা রোযার উদ্দেশ্যে। তৎক্ষণাৎ মাথা দোলালো তার অর্ধাঙ্গিনী,
– বিশ্বাস করো আসমান।আমি কিছুই বলিনি ওকে!
– হাহাহা….এটা কোনো লুকানোর জিনিস হলো?ঢাকঢোল পিটিয়ে সারা নগরবাসীকে জানানো উচিত।এই ঐতিহাসিক কাহিনীর উপর সিনেমা তৈরি করবো, ডিরেক্টর কাম প্রডিউসার,নিহাদ ঝিংকু।সিনেমার নাম
” আসমানের প্রেম “। একেবারে ব্লকবাস্টার হিট।
আসমানের দৃষ্টি কিংবা বাকিদের নিস্তব্ধতা,কোনকিছুই নিহাদকে দমাতে সক্ষম হচ্ছেনা।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসমান চারুলতার উদ্দেশ্যে দৃষ্টি ফেরালো,সঙ্গে সঙ্গে খেঁকিয়ে উঠলো রমণী,
– তুই আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো?আমি কি চো*র?
– পাচারকারী।
– কিঃ?
– খবর পাচারকারী।
থতমত খেয়ে চুপ করে গেলো চারুলতা। আমপান্নার গ্লাসে চুমুক দিলো।আসমানের দোষারোপ মিথ্যা নয়।সেদিন বিলাল রেমানকে জানানোর সময় চারু আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিল।অবশ্যই তার পক্ষে নিহাদ নামক এক দস্যুর নিকট থেকে এই তথ্য গোপন রাখা সম্ভব হয়নি।ঠিকই তার জবানবন্দী আদায় করে ছেড়েছে ছেলেটি।সেটা কোন মাধ্যমে, তা আর ভাববার কিংবা কাউকে জানানোর প্রয়োজনবোধ নেই। অতর্কিতেই নিহাদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো তার, বিনিময়ে প্রেমিক পুরুষ তীর্যক হেসে চোখ টিপে দিলো সকলের অন্তরালে।
– আমি অন্ধ নই। সবই দেখতে পাচ্ছি।
আসমানের সাবধানবাণীতে চারুলতা লজ্জাবোধ করে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।ভাই তার বুকে দুবাহু স্থাপন করে পরিমিত চেয়ে বললো,
– লজ্জা করেনা তোর?ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াস?
– ইশ।তুমি যখন তোমার বউকে উম্মু উম্মু করতে গিয়ে ধরা খাও তখন কি আমি কিছু বলেছি?এখন আমি আমার বউ…. থুরি….হতে চলা বউকে একটু চোখ টিপ দিলেই দোষ?
কোমরে হাত রেখে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো নিহাদ।চেহারায় শয়তানি অভিব্যক্তি নিয়ে মুখোমুখি হলো আসমানের।গুরু তার স্থির চেয়ে রয়েছে।যদিও নিহাদ উচ্চতায় লম্বা,তবুও আসমানের কৃষ্ণগহ্বর দৃষ্টিসম্মুখে নিজেকে সহসাই ক্ষুদ্র অনুভূত হলো তার।
– পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।তোমার পিছনে বড়সড় দুটো ডানা দেখতে পাচ্ছি। ছেটে দেবো?
একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো নিহাদ।কৌতুক কি একটি বেশীই করে ফেলেছে নাকি?গুরু শিষ্যর কার্যক্রম অত্যন্ত মনোযোগী এবং উত্তেজিত ভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে ভাবী ননদ জুটি। ভয় ছমছম, কি হয় কি হয় টাইপ ব্যাপার।শুধুমাত্র থ্রি ডি চশমা এবং পপকর্নের অভাব, তা থাকলেই অ্যাবসুলেট সিনেমা!
আসমান মুখ ফিরিয়ে কার্পেটে এসে বসলো। হাপ ছেড়ে বাঁচলো যেন সকলে। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে নিহাদ।
– একদিন তুমিও বুঝবে নিহাদ।
আসমানের ছোট্ট বাক্যটিতে তেমন কিছুই ছিলোনা, আবার যেন অনেক কিছুই লুকায়িত ছিলো।নিজ অন্তরে তরঙ্গের উপস্থিতি টের পেলো শিষ্য তার।চুপটি করে পাশে বসে পড়লো।
– কার কার সস লাগবে?
পরিস্থিতির গাম্ভীর্য পরিবর্তন করতে রোযা বলে বসলো।আসমান সম্মতি জানিয়ে হাতে নিলো সসের প্যাকেট, রোযার দিকে চেয়ে কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার এখনো খারাপ লাগছে?
– ওহ।না,আমি ঠিক আছি।যতক্ষণ না তুমি কিছু খেতে জোর করো,হিহি।
– এই তোমার বাবুর নাম কি রাখবে গো?
নিহাদ খানিক শিশুসুলভ ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো।তাতে রোযা এবং আসমান একে অপরের দিকে তাকালো। চারুলতা নিজের পান্নাটুকু সম্পন্ন করে দ্রুতকন্ঠে জানালো,
– ইউ আর রাইট।আমরা বেইবির নাম ঠিক করবো না?যত যাই হোক, রেমানদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম সদস্য বলে কথা।
– ছেলে হবে না মেয়ে হবে?নাকি টুইন্স?ট্রিপ্লেটস?হলে কিন্তু মন্দ হবেনা।তবে তার থেকেও বড় ব্যাপার হলো আমি মামা হবো,নাকি চাচা হবো?চিন্তার বিষয় তো।আমি তো বিয়েতে বরপক্ষ,কনেপক্ষ উভয় পক্ষেই ছিলাম।
– মামা চাচা মিলিয়ে মাচা।হিহি….
চারুলতা এবং নিহাদের খুনসুঁটির মাঝখানে একে অপরের মাঝে দৃষ্টি মিলিয়ে চেয়ে থাকলো রোযা এবং আসমান।উভয়ের নয়নেই অব্যক্ত অনুভূতিরা ফুটে উঠেছে।চিৎকার করে আপন অস্তিত্ব জাহির করতে চাইছে যেন।
– আসমান?
রোযার মৃদু,প্রশান্তিকর কন্ঠ সকলকে স্থির করলো।তাকিয়ে রইলো তার চাঁদ,তার বহিঃপ্রকাশের উদ্দেশ্যে।রোযা নিজের উদরে একটি হাত ঠেকালো।এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তার,সত্যিই তার মাঝে একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে।প্রথমবার মা হওয়ার অনুভূতি, কোনো ভাষাতেই ব্যক্ত করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।দীর্ঘক্ষণ ভাবার পর রোযা আবেদন করলো,
– আমাদের সন্তানের নাম,মেঘ রাখবে?
স্তব্ধ হলো সকলে।চেয়ে থাকলো নব্য মাতৃত্বের উপলব্ধি লাভ করতে চলা রমণীর উদ্দেশ্যে। বাক্যটি অতি সাধারণ।কিন্তু এখানে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষ জানে, এই বাক্যের পিছনে আড়ালকৃত শত সহস্র অনুভূতির মূল্য কতটুকু।স্থির চেয়ে থাকলো আসমান,বর্তমানে নিহাদ, চারুলতা এবং রোযা প্রত্যেকেই তার পানে তাকিয়ে আছে। তবে অশান্ত দেখালোনা তাকে মোটেও। চারুলতা একটি হাত বাড়িয়ে কাঁধ ছুঁয়ে দিলো আসমানের। বান্দা তা চেপে দিয়ে সামান্য হাসলো।অতঃপর স্ত্রীকে মোকাবেলা করলো।
– না।
ছোট্ট একটি শব্দ,অগণিত অনুভব খচিত।
– আমার জীবনে মেঘের অস্তিত্ব, একটিই থাকুক রোযা।ঠিক যেমনটা ছিলো তার জন্মদাত্রী চিত্রলেখা।
সম্মতিতে মাথা নুইয়ে নিলো রোযা।বিড়বিড় করলো,
– ওহ।দুঃখিত।হয়ত তোমার অনুভূতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি।
আসমান নিজের একটি হাত বাড়ালো,রোযার চিবুক স্পর্শ করে মাথা তুলে নিজের সঙ্গে দৃষ্টি মেলাতে বাধ্য করলো।অতঃপর জানালো,
– এই সংসার তোমার,রোযা।আমার অনুভূতির এতটাও চরম মূল্য দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।আমার অতীত আমার মাঝেই আছে,এক গোপন বাক্সে বন্দী।যাতে প্রবেশের স্বত্বাধিকার আমি ব্যতিত কারো নেই,তোমারও না।
সামান্য থামলো আসমান,পরবর্তীতে যুক্ত করলো,
– তার অর্থ এই নয় যে তোমাকে নিঃস্বার্থভাবে সবকিছুতে মানিয়ে নিতে হবে।আমি তোমাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছি রোযা,তার সঙ্গে এক নতুন জীবনকে।তুমি, তোমার গর্ভে বেড়ে ওঠা অস্তিত্ব,আমার অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছো। বর্তমানের ছায়া যেমন আমি অতীতে পড়তে দিতে চাইনা,ঠিক তেমনি চাইনা অতীতের মহিমা আমার বর্তমানকে তুচ্ছ প্রমাণ করুক।তুমি এবং আমার অংশ,আমার বর্তমান,আমার প্রেরণা এবং বেঁচে থাকার কারণ।তোমাদের আমি অন্য কোনো তুলনায় কোনোদিন দাঁড়িপাল্লায় তুলবোনা।
হৃদয়ে এক শীতল শান্তিময় আবেশ ছেয়ে গেলো রোযার।শুধুমাত্র তারই নয়,আসমানের প্রতিটা বক্তব্য নিহাদ এবং চারুলতাকেও বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।যেন বুঝিয়ে দিয়েছে,জীবনে কোথায়,কতটুকু পর্যন্ত গেলে কিভাবে সীমারেখা টানতে হয়।আসমান এবং রোযার সম্পর্ক যেন তাদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জীবনপাঠ পড়ায়।
অবশেষে হাসলো রোযা,আসমানের হাতটি নিজের কপোলে চেপে ধরে বললো,
– ধন্যবাদ,চাঁদ।
– এহেম….তাহলে কি নাম রাখা যায়?
গম্ভীরতা দূর করে চারুলতা প্রশ্ন করলো উত্তেজনায়।রোযা মাথা হেলিয়ে জানালো,
– হুম।সেক্ষেত্রে ভাবতে হবে।ভাবছি বাবাকে বলতে হবে, উনি অনেক সুন্দর নাম রাখতে জানেন।
– ইয়েস! ড্যাড অনেক ভালো এক্ষেত্রে।আমি বরাবর প্রশংসা পেয়েছি আমার নামের জন্য।
– পূর্ণিমা…
অতর্কিতে উচ্চারণ করলো আসমান।রোযা বিহ্বল হয়ে তাকাতেই মৃদু হেসে ব্যক্ত করলো,
– আমি ভেবেছি।মেয়ে হলে নাম রাখবো পূর্ণিমা।
– চাঁদ জ্যোৎস্নার…..পূর্ণিমা….
আপনমনে বিড়বিড় করলো রোযা,আবেগে কম্পিত হলো তার অন্তর।ইচ্ছা হলো হৃদয়রাজের আলিঙ্গনে নিজেকে লুটিয়ে দিতে,কিন্তু আশেপাশে মানুষের অস্তিত্ব তাকে নিবারণ করলো।আসমানের উদ্দেশ্যে চেয়ে সে যেই না কিছু উচ্চারণ করতে যাবে,অমনি,
– ছেলে হলে কি তাহলে নাম অমাবস্যা রাখবে?
নিহাদের বক্তব্য বিশ্রীভাবে হস্তক্ষেপ ঘটালো আবেগময় পরিবেশে। তেঁতে উঠলো আসমান,ভ্রু কুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো শিষ্যর দিকে।শিহরণ অনুভব করলো নিহাদ, আমতা আমতা করে বললো,
– চাঁদ, জ্যোৎস্না, সূর্য,পৃথিবী,পূর্ণিমা….এটা সংসার নাকি বিজ্ঞান বইয়ের “আমাদের মহাবিশ্ব” অধ্যায়?
ফিক করে হেসে উঠলো রমণীগণ।মুষ্টিবদ্ধ হলো আসমানের হাত,চেহারায় এমন এক অভিব্যক্তি প্রকাশিত হলো যেন জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ হতাশ সে।নিহাদের সঙ্গে তর্কের কোনো অর্থই হয়না।প্যাকেট খুলে সস ঢেলে দ্রুতই শর্মাতে মনোযোগ দিলো।তখনি ঘটলো বিপত্তি।কয়েক গ্রাস শেষ করতেই মাথা নুইয়ে খানিক কেশে উঠলো, কন্ঠতালু বেয়ে ঝাঁঝালো এক অনুভূতির কারণে।পাশে বসা নিহাদ তৎক্ষণাৎ মেঝে থেকে ট্রে তুলে তার সামনে ধরলো,তীর্যক হেসে মিছিমিছি দুশ্চিন্তা দেখিয়ে বললো,
– বমি করবে,আসমান ভাই?
নিজের কপালে নিজেই চাটি দিলো চারুলতা।শেষ!নিহাদ অবশেষে নিজের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠু*কেছে! দৃশ্যমানভাবে যেন আসমানের ধৈর্য্যের সুতাখানি টস করে ছিঁড়ে যেতে দেখা গেলো,পাশে কেঁচি হাতে হাসতে হাসতে দাঁড়িয়ে থাকা এর একমাত্র কারিগর, নিহাদ।পিনপতন,রুদ্ধশ্বাস এক নীরবতা।
– আসমান ভাইইইই….!
নিহাদের ঘাড়ে চেপে বসলো আসমানের বলিষ্ঠ হাত,এক সজোর টানে বসা থেকে সোজা দাঁড় করিয়ে ফেললো সে বান্দাকে।অতঃপর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললো রেলিংয়ের ধারে।ঠিক যেন অবাধ্য বিড়ালছানাকে জোরপূর্বক ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
– উন…না না আসমান ভাই…আমি তো শুধু চিন্তা করছিলাম হিহি… আফটার অল তুমি কুভেড…আহহ!
এক ধাক্কায় রেলিংয়ে ঠেকলো নিহাদ।বেসামাল হয়ে তার অর্ধেকাংশ ঝুঁকে গেলো একেবারে বাইরে,শুধুমাত্র আসমানের একটি হাত পাকড়াও করে রাখলো তার বাহু।হৃদযন্ত্র ছলকে উঠলো তার। করুণ দৃষ্টিতে চাইলো,
– ভাই… বদ্দা…প্লীজ…তুমি পুরুষ হয়ে পুরুষ নির্যা*তন করতে পারোনা।এ গুরুতর অন্যায়।
– আসমান!
রোযা এবং চারুলতাও ছুটে এলো তাকে রোখার উদ্দেশ্যে।কিন্তু দুই রমণীর চেষ্টায়ও সামান্যতম টললোনা হিমালয়।ঐভাবে সে হুমকিস্বরূপ নিহাদকে ধরে রাখলো, এই বুঝি ছাদ থেকে ফে*লে দেয়।
– মাফ চাও গলগণ্ড কোথাকার!মাফ চাও!
চারুলতার গোটা কতক চপাটে নিহাদ কাদোকাদো হয়ে আবেদন জানালো,
– ভাইইই….তুমি আমার জান,তুমি আমার প্রাণ,তুমি আমার আসমান।এটা করতে পারোনা তুমি।আমার মতন একটা বাচ্চাকে এভাবে শাসাতে বুক কাঁপছে না?
– না।
– হেহ….এমন সহজ জবাব কেউ দেয়?নিষ্ঠুর,নির্দয় লোক একটা।আহহহ…
আসমান আরো একটু পিছনে ঠেলতেই তার বাহুখানি আঁকড়ে ধরে ফেললো নিহাদ।এবার সত্যিই কন্ঠ থেকে বেরোলো,
– স…সরি।এই কান ধরছি,পা ধরছি,তোমার কানও ধরছি।আমার সোনামোনা,লাল্টু ফুল্টু,আমি তো একটু মজা করছিলাম।মাফ করে দাও এইবারের মতন।আল্লাহ তোমার অনেক ভালো করবে,এই গরীবের উপর দয়া করো।
– তুমি একটুও দুঃখিত নও নিহাদ।
– আমি দুই পৃথিবীতে দেব গুরুর মা*রা যাওয়া দেখে যতটা না দুঃখ পেয়েছি তার থেকেও বেশি দুঃখিত।বিশ্বাস করো, জ্যাক ব্যাটা রোজকে ছেড়ে ডু*বে যাওয়ার সময়ও এত দুঃখ পাইনি আমি!
নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকালো আসমান,তীর্যক হেসে বিড়বিড় করলো,
– গুডবাই,নিহাদ।
– এই…নাআআআআআ!
– নিহাদ!
রমণীযুগলের চিৎকার এবং বান্দার অসহায় আর্তনাদ।সবকিছুই উপেক্ষিত হলো আজ।আসমানের একটি ধাক্কায় ছিটকে গেলো নিহাদ রেলিং থেকে,অনুভব করলো সে পরে যাচ্ছে ক্রমশ নিচের দিকে। উপরে তার ঘা*তক,তীর্যক হেসে চেয়ে আছে।চারুলতার দিকে নজর পড়লো,এই কি সমাপ্তি?যেন বিদায় জানালো নিহাদ প্রেয়সীকে,এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে।কিন্তু অন্তিম মুহূর্তে চারুলতার বিশ্রী ভেংচিতে তার আবেগ অনুভূতি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।উপলব্ধি করলো নরম গদির মতন কিছুর উপর ধপাস করে পড়েছে সে।সামান্যতম ব্যথাও অনুভূত হলোনা।কি হলো ব্যাপারটা?
নিজেকে নিহাদ আবিষ্কার করলো বেশ কতক তুলো এবং কুশনের বিস্তৃত ম্যাটের উপর।এসব মাত্রই এখানে এনে রাখা হয়েছে। মেঘতীরের বেশকিছু আসবাব এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের কাজের জন্য আজ আনা হয়েছে তা।তুলোর আস্তরণের উপর কনুইয়ে ভর দিয়ে আশেপাশে তাকালো নিহাদ দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে।কয়েকজন কারিগর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।ভাবছে,খোদার কুদরতে কোত্থেকে উড়ন্ত মানুষ এসে পড়েছে এখানে।
– কি দেখছিস?কাজে যা!
খেঁকিয়ে উঠলো নিহাদ।তাতে কারিগরগণ চম্পট দিলো সহসাই। বিরস মুখে উঠে দাঁড়িয়ে উপরে তাকাতেই ছাদে কারো অস্তিত্ব দেখতে পেলোনা।কয়েক মুহূর্ত ভীষণ ক্রোধ হলো,পরমুহুর্তেই হাসির দমকে কম্পিত হলো সর্বাঙ্গ।এক মুহূর্তের জন্য তাকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব,ভীতির অনুভূতির রোলারকোস্টারে ঘুরিয়ে এনেছে আসমান।এজন্যই সে তার গুরু।হাসতে হাসতে সামনে চাইতেও দ্রুত পদক্ষেপ মেঘতীর থেকে চারুলতাকে বেরিয়ে আসতে দেখলো সে।রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আছে প্রিয়তমা তার।নিজেকে প্রস্তুত করলো বান্দা,আরেক দফা লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে।
সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে আসছে আসমান।তার বাহুতে বসে আছে রোযা,ভারসাম্য রক্ষায় ঘাড় জড়িয়ে রেখেছে,তাকে বক্ষমাঝে আগলে নিয়ে অতি সন্তপর্নে সিঁড়ির একেকটি ধাপ অতিক্রম করছে অমানিশা।রোযা তার কাঁধে মাথা গুঁজে মিটমিট করে হাসছে।
– নিহাদ বেচারার সঙ্গে এমনটা না করলেও পারতে।এক সেকেন্ডের জন্য আমিও ভেবেছিলাম তুমি পাগল হয়ে গিয়েছ।
– ভালোই অভিনয় জানি তবে বলো?
উত্তরে হাসলো রোযা, আলিঙ্গনের জোর বাড়িয়ে বললো,
– তা মিস্টার আমাকে এভাবে কোলে তুলে নিয়ে আসার অর্থ?আমি হাঁটতে জানি।
কোনো জবাব নেই।অন্তিম ধাপের নিকট পৌঁছে গিয়েছে আসমান।
– এখনি এমন হম্বিতম্বি করছো।অবস্থা আরো পরিবর্তিত হবে।সত্যিই নড়াচড়া হাঁটাচলায় সমস্যা হবে।তখন কি করবে?
– এর চেয়ে শতগুণ করবো।
সোজাসাপ্টা জবাব স্বামীর।তাতে অদ্ভুত সুখ অনুভব করলো অর্ধাঙ্গিনী।মুখ গুঁজে দিলো কাঁধে।আসমান তাকে নিয়ে গিয়ে কিচেনের কাউন্টারে সাবধানে বসালো।উদরে স্নেহের স্পর্শ ঠেকিয়ে বিড়বিড় করলো,
– তুমি আজ একদমই কিছু খেতে পারছোনা রোযা।এভাবে করলে হবেনা।তুমি একা নও,তোমার অভ্যন্তরে আমাদের অংশ বেড়ে উঠছে।
– কি করবো?শরীর তো সয়না।
রোযার কপোলে হয়ে ছুঁয়ে আসমান তার অধরে আলতো চুমু খেয়ে বললো,
– আমি খানিকটা স্যুপ বানিয়ে দেই।
সম্মতি জানালো রোযা।আসমান তাতে মৃদু হেসে কাজে লেগে পড়লো। কিচেন অ্যাপ্রোন গায়ে জড়িয়ে হাত ধুয়ে সবজি বের করে নিলো।একটি সিরামিকের পাত্রে কিছুটা পানি ফুটতে দিয়ে চপিং বোর্ডে সবজি কে*টে নিলো খানিকটা।চিকেনের পিস সিদ্ধ করে নিয়ে পানিতে মিশিয়ে সবজি ঢেলে একেবারে হালকা লবণ এবং সামান্য মশলা দিলো।কিছুটা সুইটকর্নও মেলালো। টোস্টারে পাউরুটি টোস্ট করে একটি প্লেটে রাখলো, সঙ্গে নিলো কিছু শুকনো ক্র্যাকার। স্যুপ প্রায় হয়ে এসেছে,চামচ দিয়ে স্বাদ পরীক্ষা করলো।অতঃপর সন্তুষ্ট হয়ে আঁচ কমানোর উদ্যোগ নিলো।সম্পূর্ণ সময়টা একমনে তাকে পর্যবেক্ষণ করে গেলো রোযা।সম্মোহিত করেছে যেন তাকে এই পুরুষটি,যার উপর থেকে দৃষ্টি ফেরানো দায়।এতটাই মনোমুগ্ধকর তার চলন এবং অবয়ব।
ট্রেতে সবটা সাজিয়ে নিয়ে আসমান রোযার দিকে এগিয়ে দিলো।
– চিকেন স্যুপটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে।স্মুদি করে দেবো সঙ্গে কিছুটা?
– না না।এতকিছুর দরকার নেই।এমনিতেও খেতে পারবো নাকি বুঝতে পারছিনা।
– অল্প অল্প খাবে। স্যুপ আরো আছে,সবটা দেইনি।একসঙ্গে খেলে খারাপ লাগবে,তাই এক দুই ঘণ্টা পরপর খাওয়াটা ভালো।তার আগে ক্র্যাকার খাও কিছুটা,গা গুলোবেনা আর।
রোযা আসমানের মুখপানে চেয়ে বিস্তৃত হাসলো।
– তোমার অভিজ্ঞতার তুলনা হয়না।
আসমান একটি স্টুল টেনে এনে রোযার বিপরীতে বসলো। ক্র্যাকার তার হাতে দিয়ে স্যুপের বাটিতে চামচ নাড়তে নাড়তে বললো,
– হয়েছে।এবার খাও।
– খাইয়ে দেবে তুমি?
– হুম।
অতি উৎসাহে আসমানের হাত থেকে খেতে আরম্ভ করলো রোযা।তার উৎফুল্ল অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে আপনমনে হাসলো আসমান।জীবনের এতটা সুখ তার কপালে সইবে তো?এই রমণী,যে তার অমানিশায় ঘেরা জীবন দীপ্তিতে পরিপূর্ণ করেছে তাকে অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত রক্ষা করতে পারবে তো?আসমানের মুখভঙ্গিতে পরিবর্তন নজর এড়ালোনা রোযার।দুহাত বাড়িয়ে আলতোভাবে সে ছুঁয়ে দিলো হৃদয়রাজকে।
– কি হয়েছে আমার চাঁদের?কি ভাবছে সে?
স্যুপের বাটি নামিয়ে রেখে আসমান একটি নিঃশ্বাস ফেললো।নিশ্চুপ থাকলো।তাতে চিন্তিত হয়ে রোযা আদর বুলিয়ে নমনীয় কন্ঠে শুধালো,
– বলো আমায় চাঁদ।কোন চিন্তা তোমায় এভাবে পীড়া দিচ্ছে?
– জ্যোৎস্না….
মুখ তুলে তাকালো আসমান,রোযার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো।টলটলে এক অনুভব তাতে ভাসমান।একটি শক্ত ঢোক গিললো আসমান।বিড়বিড় করলো,
– যদি আমার অংশ আমাকে দেখে ভয় পায়?
প্রশ্নটি তীক্ষ্ণ ফ*লার মতন বি*দ্ধ হলো রোযার অন্তরে। আবেগের জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিলো হৃদয়ঙ্গন।স্থির চাইলো সে আসমানের মুখপানে। অধরের দুপাশজুড়ে অমানবিক বিভীষিকার দাগ,দগদগে স্থায়ী চিহ্ন বর্ব*রতার।সাধারণ মানুষমাত্রই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার মতন অশুভতা যার কলঙ্কজুড়ে।আসমান মাথা কাত করলো।এক শিশুতুল্য দ্বিধাদ্বন্দ্ব তার নয়নজুড়ে।
– ভয়?
অবশেষে উচ্চারণ করলো রোযা।ছুঁয়ে দিলো চাঁদের কলঙ্ককে।অতি যত্নে।প্রতিটা স্পর্শ তার রোমকূপজুড়ে শিহরণ খেলিয়ে দিলো আসমানের।ভগ্ন কন্ঠে ব্যক্ত করলো,
– আকুল এই পিতৃহৃদয়।যদি আমায় দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয় অংশ, তবে সেদিনই মৃ*ত্যু ঘটবে এই জর্জরিত অস্তিত্বের।
– নিজের অংশকে এতটাই ঠুনকো মনে হয় তোমার?
তেজস্বী অর্ধাঙ্গিনীর বক্তব্য,সামান্যতম দূর্বলতার ছাপ নেই তাতে।আসমানের দুহাত সে নিজের উদরে চাপলো।আত্মবিশ্বাসী সুরে জানালো,
– যে আসছে সে আমার সন্তান আসমান! তুমিই বলেছিলে না,স্বয়ং পরাশক্তিধরকে বশ করেছি আমি?তবে আমার সন্তান কেনো পারবেনা বাস্তবতাকে মোকাবেলা করবার মতন ক্ষমতাশালী হতে?
একদৃষ্টে চেয়ে থাকলো আসমান।তার কপোলজুড়ে নির্ভরতার স্পর্শ ছেয়ে গেলো রোযার।
– ও তোমার সন্তান।তুমি,কি*লিং মেশিন,ক্ষমতাকে টেক্কা দেয়ার মতন দুঃসাহসী চিত্তের অধিকারীর সন্তান। তোমার মুখশ্রী তার ভীতি নয়,অহংবোধের কারণ হবে, জন্মদাত্রী হিসাবে সুনিশ্চিত আমি।
আসমানের কপালে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা কেশগুচ্ছ সরিয়ে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিলো রোযা।বিড়বিড় করলো,
– তোমার আমার সন্তানকে এমন অপমান করোনা।যে শুধুমাত্র আগমনের বার্তায়ই তোমার ভাগ্যের অভিশাপকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে,সে নিজের জন্মদাতার অসম্পূর্ণতায় কোনোদিন মাথা নোয়াবে না।প্রথম দর্শনে সে নিজের দৃষ্টি ফেরাতে পারবেনা কোনোদিন,এতটাই অতুলনীয় তার পিতা।
– রো…রোযা….
– আর কোনোদিন এমন কথা মুখেও আনবেনা আসমান।ভুলে যেওনা,তোমার অংশ তোমার মহিমায় মহিমান্বিত।
সম্ভব হলোনা আসমানের পক্ষে।উঠে দাঁড়িয়ে রোযাকে আলিঙ্গন করলো নিজের মাঝে। রোযাও নিজের বিলীন ঘটালো,সুখের প্রশান্তিতে ছেয়ে দিলো অমানিশাকে।
– সবসময় আমার পাশে থাকার জন্য,আমার ভীতিগুলোকে ঢাল হয়ে মোকাবেলার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, জ্যোৎস্না।
– যতবার নিজেকে হারিয়ে ফেলবে,ততবার তোমার অস্তিত্বকে টেনে তুলবো আমি চূড়ান্ত শিখরে।
– ভালোবাসি রোযা,ভালোবাসি আমার জ্যোৎস্না।
– ভালোবাসি আসমান,ভালোবাসি আমার চাঁদ।
মুখ তুলে অর্ধাঙ্গিনীর অধরে অধর মেশালো আসমান।অনুভূতির বিনিময়ে ক্রমশ সুখের আবেশে ছেয়ে গেলো তাদের অস্তিত্ব।আসমানের কাঁধে দুহাত জড়িয়ে নিকটে টেনে নিলো রোযা,অপরদিকে তার উদরজুড়ে রক্ষিত ভঙ্গিতে স্থাপিত হলো অমানিশার দুহাত।
রক্ষা করবে সে, কিছুতেই হারাবেনা।হৃদয়টা বড্ড কু ডাকছে আজকাল।নিজেকে হারানো চলবেনা কিছুতেই। লড়তে হবে।নিজের সুখের তরে,নিজের পরিবারের তরে তাকে লড়াই করে যেতে হবে।রক্ষক সে তার জ্যোৎস্না এবং অংশের।
পরদিন।
মেরিডিয়ান ভার্সিটি।
– ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত এবং বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মিডিয়ার অবদান ব্যাপক….বাস!
যতিচিহ্ন দাড়ি ব্যবহার করে বাক্যটি সমাপ্ত করেই চেয়ারে হেলান দিলো রোযা।দুবাহু শূন্যে তুলে স্ট্রেচিং করলো খানিক।অতঃপর পরীক্ষার খাতা খানিক নেড়েচেড়ে সব ঠিকঠাক রয়েছে নিশ্চিত করে জমা দিলো।অতঃপর ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ার দিকে এগোলো।অভ্যন্তরে ঢুকতেই চেনা পরিচিত মুখগুলো তাকে সালাম দিলো একে একে।এমনকি এমনও শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের সে ব্যক্তিগতভাবে চেনেনা,তবুও তাদের অভ্যর্থনায় কমতি নেই।ক্যাফেটেরিয়ার স্টাফরাও তার সঙ্গে সম্মানজনক ব্যবহার করে।আন্দোলনের পর ভার্সিটিতে রোযার অবস্থান একজন শিক্ষার্থী নেতৃত্ব হিসাবে বেশ পাকাপোক্ত হয়েছে।
ক্যাফেটেরিয়ার এক পাশের টেবিলে অভিষেক এবং আরিয়ানকে নজরে পড়লো।তার কিছুক্ষণ আগেই পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছে তারা।বর্তমানে ল্যাপটপে ঝুঁকে কিছু দেখছে। রোযাকে লক্ষ্য করেই বিস্তর হাসলো আরিয়ান,হাত নেড়ে বললো,
– আরে রোযা আপু,আসো আসো বসো।
উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার টেনে দিলো অভিষেক।রোযার গর্ভধারণ সম্পর্কে তারা অবহিত,শুধুমাত্র তারা এবং সাবিহা,এই তিনজন।প্রত্যেককেই এই উপলক্ষে ট্রিট দিতে হয়েছে রোযাকে।সে বসতে বসতেই কফি এবং বার্গার পরিবেশন করা হলো।নিজের প্লেটটি রোযার দিকে এগিয়ে দিলো আরিয়ান,
– তোমার ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই?এটা খাও,আমি আরেকটা অর্ডার করি।
– বাইরের খাবার এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাই।তুমি খাও, সমস্যা নেই।আমি বাসায় ফিরে খাবো।
– ওহ হ্যাঁ,তাইতো।এটা স্বাস্থ্যকর নয়। সরি সরি।
আরিয়ান প্লেট নিজের দিকে টেনে নিলে রোযা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
– ভালোই। সিজিপিএ ঠিক থাকলেই হয় এখন।
অভিষেক জবাব দিলো।রোযা মাথা কাত করে কৌতুকের স্বরে জানালো,
– না হলেও সমস্যা নেই।তোমাদের বিয়ের জন্য পাত্রীর অভাব হবেনা। জাতীয় বীর তোমরা,হিহি!
তার কথা শুনে খুকখুক করে কেশে উঠলো আরিয়ান।রোযা মিথ্যা কিছুই বলছেনা।ভার্সিটির বেশ জনপ্রিয় দুজন ছাত্রে পরিণত হয়েছে আরিয়ান এবং অভিষেক।আরিয়ানের শিশুসুলভ এক সুদর্শন চেহারা,এবং প্রায় ছয় ফুট লম্বাটে অবয়ব রমণীদের নিকট আকর্ষণীয়ও বটে।এইসব ব্যাপার নিয়েই অভিষেক এবং রোযার ছেলেটাকে নিত্য খোঁচা দেয়া।গল্পগুজব হাসিঠাট্টার মাঝেই বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হলো।তারপর রোযার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীনে নামটি লক্ষ্য করে রিসিভ করলো সে।
– হ্যালো,অনির্বাণ?বলুন।
– রোযা….
এক মুহুর্ত বিরতি।তারপর অনির্বাণ আহমেদের কন্ঠ জানালো,
– একটা বিষয়ে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলার ছিলো।
– ওহ।কোন বিষয়?
– কিছু নতুন ও পুরাতন প্রজেক্টের ব্যাপারে।আপনার মতামত জানতে পারলে আমার জন্য সুবিধা হতো।সময় হবে কি?
– আচ্ছা।ক্যাফে লো ফাইতে আসুন।
– উহু।আমি এই মুহূর্তে হোটেল ইনফ্রা – রে তে রয়েছি।আমি কেবিন নম্বর আর ডিটেইলস পাঠিয়ে দিচ্ছি,আপনি আসুন।
– ঠিক আছে।
ফোন কেটে আরিয়ান এবং অভিষেককে বিদায় জানিয়ে উঠলো রোযা।বাইরে এসে গাড়িতে চেপে বসলো।হাবিব তাকে নিয়ে গেলো হোটেলটিতে।পথিমধ্যে অনির্বাণের অতর্কিত তলব সম্পর্কে ভাবলো রোযা।খুব একটা অবাক হয়নি।কারণ আন্দোলনের পর থেকে এমন বিভিন্ন বিষয়ে অনির্বাণ আহমেদের সঙ্গে তার আলাপচারিতা হয়েছে।মিডিয়ার টকশোগুলোতে একসাথে অংশ নিয়েছিল তারা।পার্কিং লটে গাড়ি থামতেই বাইরে বেরিয়ে হোটেলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো রোযা।সুউচ্চ পাঁচ তারকা হোটেল এটি।অনির্বাণের কথা বলতেই তাকে পথ বলে দেয়া হলো। এলিভেটরে চেপে রোযা কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো।সাধারণত পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর সার্ভিস অত্যন্ত ভালো হওয়ার কথা, কারো না কারো তাকে কেবিন পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াই স্বাভাবিক ছিল।পরবর্তীতে ভাবলো, অনেক হোটেল অতিথিদের প্রাইভেসি ভঙ্গ করেনা।তেমন কিছুও হতে পারে।ভাবতে ভাবতে সে পনেরো তলায় পৌঁছলো।রুম নম্বর, পনেরো শূণ্য দুই এর সামনে এসে থামলো।কলিং বেলের ব্যবস্থা রয়েছে।সেটা চাপলো।
বিনা কারণেই হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেলো রোযার। এখনো মনে হচ্ছে কোথাও যেন একটা কিন্তু রয়ে গিয়েছে।কিন্তু সেটা কি?ভীষণ অস্থির লাগছে।স্মরণেই আনতে পারছেনা।সম্পূর্ণ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সময় প্রয়োজন তার।ঠিক তখনি খুট করে দরজা খুলে গেলো।অনির্বাণের স্বাভাবিক চেহারা নজরে।
– প্লীজ কাম ইন।
কন্ঠটা অত্যন্ত নিষ্প্রাণ শোনালো,ফোনের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন।
– আপনি ঠিক আছেন,অনির্বাণ?
জবাব এলোনা।দরজা ছেড়ে দিয়ে রোযাকে প্রবেশের সুযোগ দিলো সাংবাদিক।ভেতরে ঢুকলো রোযা,সহসাই এক উপলব্ধি গ্রাস করলো তাকে। হোটেল ইনফ্রা রে – র সম্পর্কে কিছুদিন আগেই একটি তদন্তভিত্তিক ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছিল অনির্বাণ।মালিকপক্ষের ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া,এবং অবৈধ স্থান দখল করে নিষিদ্ধ গ্যা*ম্বলিংয়ের চর্চা সম্পর্কে। ইনফ্রা – রে তে তার থাকার প্রশ্নই আসেনা! এক লহমায় উল্টো ঘুরল রোযা, ছুটলো প্রাণপনে, বেরোবার উদ্দেশ্যে।হাতে আঁকড়ে ধরলো ফোন, উদ্দেশ্য ইমার্জেন্সী ডায়াল নাম্বারে আসমান এবং হাবিবকে ফোন।কিন্তু সামান্য দেরী হয়ে গেলো উপলব্ধিতে,দরজা আটকে দিয়ে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে অনির্বাণ।শান্ত তার অভিব্যক্তি,রোযার পানে ঘুরে সে বিড়বিড় করলো,
ডার্কসাইড পর্ব ৫৯
– আই অ্যাম সরি,রোযা।
– ওহো,মাউস গট কট ইন দ্যা ট্র্যাপ?
স্থবির রোযা মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই তার সম্মুখে থমকে গেলো সবকিছু।কক্ষের অভ্যন্তরে,দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক রাশিয়ান ব্যক্তি।উজ্জ্বল ফর্সা ত্বকজুড়ে তার কালচে কণ্টকাকীর্ণ গোলাপের ট্যাটু।
দিমিত্রী ভলকভ।রাফা কায়সারের স্বামী।
