ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১১
অবন্তিকা তৃপ্তি
~আই লাভ ইউ, কাব্য ভাই!’~
কাব্য আকাশের থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত পেছন ফিরে তাকালো! কুহু মিষ্টি হেসে ওর দিকে ফ্লাওয়ার বুকে বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে। কাব্য অবাক; চুড়ান্ত অবাক হয়ে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে নিজের জায়গাটায়! কি বলবে এখন ও? কি উত্তর দেওয়া যায় ওর প্রেমে পাগল মেয়েটাকে?
কাব্য বড়সড় একটা ঢোক গিলে; কুহুকে আপাদমস্তক দেখে; সঙ্গে অবাক হয়ে কুহুর সাজানো আশপাশটাও দেখে।কুহু একবুক আশা; কাজল মাখা ওই দুই-চোখটায় ভীষণ আবেগ জড়িয়ে ফ্লাওয়ার বুকে বাড়িয়ে আছে। কাব্য হা হয়ে কুহুর ফ্লাওয়ার বুকে একবার দেখছে তো আরেকবার কুহুর মিষ্টি হাসিমাখা মুখটা দেখছে।
আকাশ চিরে ঝুমঝুম; গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝরছিল তখন; ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ভালোবাসাপূর্ণ এই সুন্দর দৃশ্যকে!
কাব্য-কুহু দুজনেই দে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ভিজছে তখন! কাব্যের গায়ের লেদারসুট ভিজে একাকার; কুহুর রক্যিক; রক্তলাল গাউনটাও ভিজছে— শুধু মুখের সাজটুকু ওয়াটারপ্রুফ হওয়ায় তেমনি রয়ে গেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বৃষ্টির পানি যখন কুহুর গাল বেয়ে ঠোঁটে নেমে আসে; কুহু তখন সেই জলের বিন্দুকে মায়াহীন পিষে ম্লান কণ্ঠে বলা শুরু করে———‘হু; আমি আপনাকে ভালোবাসি কাব্য ভাই। যখন থেকে ভালোবাসা বুঝেছি; তখন থেকেই ভালোবাসি। আপনাকে দেখার পর আজ অব্দি অন্য কোনো পুরুষকে মনে ঠাঁই দেইনি; জানেন? আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছি শুধু এবং শুধুমাত্র আপনার জন্যে! বিশ্বাস করুন; ক্লাসের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলেটার প্রপোজাল ফিরিয়ে দিয়েছি আপনার জন্যেই।’
কাব্য তাকিয়ে রইল অপলক; ওর চোখের ভাষা তখনো বোঝা মুশকিল। কুহু বলতে বলতেই হালকা করে হাসল; তারপর লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে ফেললো!
কাব্য ভ্রু কুচকে কুহুর দিকে চেয়ে রইলো; দেখল পুরোটা লাজুক মুখের তরতর করে ঠোঁটের কাপুনি; সঙ্গে এই ছোট মেয়েটার প্রেমের বাণীটুকুও কানে একের পর এক বাজে।
কুহু লাজুক মুখটুকু নিয়ে আবার কাব্যের দিকে তাকালো! কাব্য অবাক চোখে তখনো কুহুর দিকে তাকিয়ে; ওর মুখে আজ কোনো ভাষা নেই।
শোনা গেল; কুহু আবার বলে যাচ্ছে ———‘চিন্তা করবেন না, আপনি আমাকে রিজেক্ট করতেই পারেন; আমি কিন্তু এটাতে প্রস্তুত আগে থেকেই। আমি প্রপোজটা করেছি শুধুমাত্র আমার মনের কথাটা আপনাকে জানাব বলে; ব্যাস আর কিছু না কিন্তু। আমি বলছি; আপনি অপেক্ষা করুন; ভাবুন, সময় নিন! আপনার যত বছর সময় দরকার নিন; আমি অপেক্ষা করব আপনি যত বছর চাইবেন ততবছরই অপেক্ষা করবো আমি। তবুও আমার আর্জি; আপনি আমাকে ভাবুন; আমার মনের অনুভূতি নিয়ে একবার হলেও ভাবুন। তারপর যদি মনে হয় আপনার এখনো কিছু সময় দরকার; নিন। আমার তাড়াহুড়ো নেই।’
কাব্য সব শোনে; তারপর কেমন কণ্ঠে যেন হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠে——-‘আর তারপরেও আমার যদি কোনো ফিলিং না আসে?তখন?’
কুহুর জবাব যেন ঠোঁটের আগায় ছিলো; কুহু হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলে উঠে——‘তখন আমরা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করে নেব নাহয়। একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসা হয়েই যাবে। বড় চাচ্চু-বড়মার তো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজই হয়েছিল; ওদের এখন কত ভালোবাসা দেখেন নি? আপনার-আমারও হয়ে যাবে।’
কুহু এইবার মৃদু হাসল কাব্যের দিকে চেয়ে। একসাথে সমস্ত কথাটা বলা শেষ করে কুহু ফ্লাওয়ার বুকে কাব্যের হাতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল——‘যদি রাজি হন; তবে বুকেটা নিতে পারেন আমার হাত থেকে; আমি আমার উত্তর বুঝে যাবো এল। জানেন? এখানে টোটাল ১৩ টা গোলাপ; ১৩ টা রজনীগন্ধা আর ১৩ টা কাঠগোলাপ আছে।’
কাব্য কুহুর কথায় নিশ্চুপে বুকেটায় জমানো ফুলগুলো একনজর দেখলো! কুহু ভীষণ মনোযোগ দিয়ে সবগুলো ফুল কাব্যের সামনেই গুণে দেখালো। তারপর একহাতে আলতো করে; যত্ন নিয়ে ফুলগুলো ছুয়ে দিতে দিতে বললো
———-‘১৩ টা করেই আছে সবটা। এখন নিশ্চয়ই আপনি ভাবছেন; আমি কেমন পাগল! সব ১৩টা করে এনেছি কেন? আসলে হচ্ছেটা কি— আমার যখন ১৩ বছর; তখন আপনাকে আমার মনে লেগেছিল। তখন থেকে ভেবে রেখেছি আপনাকে যেদিন আমার মনের কথা বলব তখন ১৩টা ফুল দিয়েই করব। এটার অর্থ কি জানেন? অর্থাৎ- আমার ভালোবাসা সেই চার বছর আগে যেমন ছিলো, আজও ঠিক তেমনি আছে! কুহেলিকা সিদ্দিক কুহু স্টিল লাভস হার কাব্য ভাই লাইক এ ইনসেইন!’
কুহুর কণ্ঠে পাগলামো তখন জোরালো; চোখে-মুখে দীপ্তি অদ্ভুত! কাব্য কুহুর ফ্লাওয়ার বুকের দিকে আরো একবার তাকিয়ে কুহুর দিকে তাকালো! কুহু একবুক আশা নিয়ে বসে আছে কাব্য ফ্লাওয়ার বুকেটা নিবে হাতে। অথচ কুহুকে অবাক করে দিয়ে কাব্য ফ্লাওয়ার বুকে নিলো না; বরং দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বুকেটার দিকে দিকে চেয়ে হঠাৎ যন্ত্রের মতো জবাব দিল———-‘এ..এটা হয়না। তুই…তুই আমার বোনের মতো কুহু!’
কোথাও যেন একটা বজ্রপাত হলো! কুহুর হাসিহাসি মুখটায় মুহূর্তের মধ্যেই ঘন কালো আধার নেমে এলো। ওর ঠোঁট টেনে হাসিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। কুহুও ভ্রু কুঁচকে কাব্যের দিকে তাকাল।
কাব্য বুঝতে পারলো; কুহু এই মুহূর্তে কেমন বোধ করতে পারে। ও ভীষণ অপ্রস্তুত হচ্ছে এই মুহূর্তে। কুহুর ভাঙা মনটা দেখে কাব্য চোখ উল্টে হতাশ শ্বাস ফেলল এইবার। কুহুকে কি বলে বোঝাবে ও এখন? এসব… এসব কখন ককবে হয়ে গেল! কুহু কবে থেকে ওকে এতটা… কিন্তু এসব কি করে সম্ভব? সে তো কোনোদিন আশকারা দেয়নি কুহুকে এই ব্যাপারও! তারপরেও কিভাবে?
পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে হয়ে গেছে যে কাব্য কুহুকে কি বলবে; কিভাবে বলবে বুঝতেই পারছে না।
কাব্য কিছু বলার আগে কুহু অস্থির গলায় এইবার কণ্ঠে উদ্বেগ নিয়ে বলল———-‘আমি….আমি তো বলেছি আপনি সময় নিন! আমা…আমার সত্যি কোনো সমস্যা নেই এতে।’
কাব্য কুহুর দিকে কাতর চোখে তাকাল এইবার। কুহুর বুকটা সেই তাকানোতে কেমন যেন মুচড়ে উঠল হঠাৎ! কানটা কি আজ বধির হয়ে গেলে পারত না? কাব্য ভাই এখন যা বলবেন তা কি কুহুর অবচেতন মনটা আন্দাজ করতে পারে গেছিল।
কাব্য কপালে অতিষ্ট ভঙ্গিতে দু-আঙুল চেপে ধরে কুহুর সামনে এদিক-ওদিক হেঁটে অস্থিরভাবে আবার কুহুর সামনে এসে দাঁড়ালো। কুহু দেখে গেল সবটা। কাব্য কোমরের একপাশটাই হাত রেখে কুহুকে বোঝানোর চেষ্টা করলো———-‘কুহু; লিসেন! তুই এখনো টিনেজ। আমার প্রতি তোর এই ফিলিংস জাস্ট কদিনের জন্যে। বড় হো; এসব ইনফ্যাচুয়েশন সব একদিন চলে যাবে। আজ আমি বলছি; তুই আমাকে না, আরও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করিস। ট্রাস্ট মি!’
কুহু ঢোক গিললো একটা: কাব্য ওর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে! কুহুকে কড়াভাবে মানা করতেও পারছে না মেয়েটা কষ্ট পাবে ভেবে; আবার শান্ত গলায় বোঝালে সেটাও কতটা বুঝবে বুঝতে পারছে না কাব্য।
কাব্যের এমন উত্তরে কুহুর চোখ টলমল হলো; গলাটা কেপে উঠল খানিক———-‘আমার ভালোবাসা কোনো ইনফ্যাচুয়েশন নয়; আমি সত্যিই…’
‘একটা দিব ধরে এখন!’ —— কাব্য এমন উত্তরে মেজাজের খেই হারিয়ে হঠাৎ ধমকে উঠে।
কুহু যা বলতে যাচ্ছিল; সেটুকু কথাও থেমে গেল আচমকা; কাব্য ধমক আরো দিয়েছে ওকে; কিন্তু আজকের মতো এতটাও হৃদয়ে আঘাত করেনি সেসব। এখন কেন মনে হচ্ছে; কুহুর হৃদয়ে কেউ বোধহয় ত-লোয়ার খোঁ-চাচ্ছে! শরীরের হালকা কাপুনি; আর নিজেকে গুটিয়ে নেবার প্রবণতা থেকে কাব্য বুঝল কুহু ভয় পাচ্ছে।
কাব্য কি করবে? মাথায় দুহাত শক্ত করে চেপে আবার চুপ হয়ে গেল! এটা হয়না..পরিস্থিতি এত বিধঘুটে কেন? কুহু কাব্যের ভয়ে সেটিয়ে গেছে একপ্রকার। কাব্য আগে যেমন ছোটবেলায় কুহুর হাত ধরে বোঝাত, এইবারেও এগিয়ে যাচ্ছিলো হাতটা ধরে বোঝানোর জন্যে। পরপর থেমে গেল ওর দুহাত; কুহু তাকিয়ে সেটাও দেখলো!
কাব্যর পাগল-পাগল লাগছে নিজেকে! ও দূরে থেকেই; না ছুঁয়েই কুহুকে ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করলো আরেকবার————-‘দেখ কুহু! কাউকে ভালোবাসা ইজ ফাইন; কমপ্লিটলি ফাইন। তুই ভালোবাসতেই পারিস। কিন্তু সেটা আমি কেন? আমি তোর ভাই! একসাথে বড় হয়েছি আমরা; তোর আমার মধ্যে এসব হয়না; সম্ভব না। তুই এসব বলছি; এটা ভাবতেই আমার বিদঘুটে শোনাচ্ছে।’
কাব্যের কণ্ঠে পাগলামি অস্থিরতা; কুহুকে মানানোর চেষ্টা- তৎপরতা!
কুহু এইবার কথা বলে! একান্ত জেদী বাচ্চার ন্যায় বলে উঠে———‘আমি যদি ভালোবাসতে পারি; তাহলে সেটা আপনি কেন নয়? আপনার প্রতি আমি যে কতটা অবসেসড কাব্য ভাই! আপনি নিজেও সেটা জানেন না। আমার অনুভূতিকে উল্টাপাল্টা নাম কেন দিচ্ছেন আপনি?’
‘আমি উল্টাপাল্টা নাম দিচ্ছি? ওহ গড!’ —— কাব্য চোখের উপর দু-হাত চেপে ধরে; জোরে একটা শ্বাস ফেলল!
কাব্যের হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে; ও চমকে উঠে এইবার পয়েন্ট ক্যাচ করার মতো উজ্জল চোখ-মুখ দিয়ে আঙুল দেখিয়ে বলে——‘এটাই; এটাই! তুই মাত্র বললি অবসেশন! এক্সাক্টলি, আমি তোর অবসেশনই কুহু। তুই আমার প্রতি অবসেসড! নাথিং এলস! অবসেশন ইজ নট লাভ কুহু। দুটো আলাদা ব্যাপার! অবসেশন সময়ের সাথে কেটে যাবে কুহু। ভালোবাসাটা অবসেশন হতে পারে না।’
কাব্য যেটাকে বারবার ‘নাথিং এলস’ বলেছে; সে কি জানে? কুহু এই ‘নাথিং অনুভূতি’-টা চার-চারটি বছর কতটা আগলে রেখেছিল? হয়তো জানবেন না; বুঝবেন না কোনোদিন।
বুঝলে কি ওভাবে কুহুর অনুভূতিকে এতটা চেষ্টা করে; মেহনত করে উল্টাপাল্টা নাম দিয়ে এড়িয়ে যেতে পারতেন?
কুহু গলায় কান্না উথলে উঠতে চাইলো; কিছু একটা গলায় যেন দোলা পাকিয়ে পাথর-সমান হচ্ছে।
কুহু তখনো ওভাবেই যত্ন করে ধরে রেখেছে ফ্লাওয়ার বুকেটা; ভিজে যাচ্ছে যার ফুলগুলো! কুহু কাব্যের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল; ওর চকজের কোণ বেয়ে যখন এতকষ্ট করে আটকে রাখা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল; কাব্যের তখন অসহায় অনুভব করে।
কুহু একটা টিনেজ মেয়ে। বাবা-মায়ের অতি আদরের ঘরের দুলালি। সারাজীবন দুঃখ কি; মন ভাঙা কি সেসব দেখবে কি অনুভবই করেনি। যখন যা চেয়েছে, তুরি মেরে তাই হাজির করেছেন মেঝো চাচ্চু-মেঝো চাচী। তাই কুহুও হয়েছে জেদী; ন্যাকা, আর আদুরে! একজীবনে প্রথম কুহু কাউকে ভালবেসেছে; কত খুশির ব্যাপার হবে সেটা সবার জন্যে। কিন্তু …কিন্তু শালা সেটা মরার কাব্যই কেন হতে গেছে?
কাব্যের এই মুহূর্তে মাথাটাই ধরে যাচ্ছে। কুহু এখন; এইজয়গায় এভাবে অন্য কোনো ছেলের জন্যে পাগলামি করলে কাব্য নিজে ওই ছেলেকে কুহুর কাছে ধরে-বেঁধে ৳হলেও এনে দিত! কিন্তু এখন..এটা স্বয়ং কাব্য নিজে। কাব্য নিজের মনকে এখন কি করে বাঁধবে?
কাব্য দুহাতে মুখ ঘষতে থাকে বারবার; তারপর আবার কুহুর চোখের জলটুকু! কি করবে আর? কাব্য আকাশের দিকে চেয়ে নিজের মনে যটুকু ধৈর্য্য বাকি ছিলো: সেটা টেনে আনল।
কুহুকে শেষবারের মতো চুড়ান্ত ধৈর্য্য নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো—-——‘দেখ কুহু;! তুই ভার্সিটি ভর্তি হবি কদিন পর; রাইট? সেখানে একবার যেয়েই দেখ না! আমার চেয়ে হাজার হাজার বেটার; হ্যান্ডসাম ছেলে পাবি তুই। তুই একবার প্রেমে পর কারোর; আমাকে জাস্ট নামটা বলবি; তাকে তোর কাছে যেকোনো মুল্যে আমি কাব্য এনে দিব; প্রমিজ! কিন্তু কুহু; আমি তোর টিনেজ বয়সের জাস্ট একটা টেম্পরারি ফিলিংস মাত্র। কদিন পর তোর দুনিয়া যখন আরো খুলবে চোখের সামনে; দেখবি আমি কাব্য আর এক্সিস্টই করছি না তোর সামনে। আমি কে; কাব্য নামের তুই কাউকে কখনও ভালবেসেছিস ভুলে——‘
কাব্য কথাটা শেষ করার আগেই কুহু আচমকা ভাঙা ভাঙা স্বরে জেদ নিয়েই বলল———‘আমাকে হাজার ছেলে সামনে এনে দিলেও আমার আপনাকেই চাই; সবসময়ই। আর কাউকে দরকার নেই আমা——‘
কুহু কথাটা শেষ করার আগেই; নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে কাব্য এইবার ঠাস করে থাপ্পড় বসালো কুহুর গালটায়। কুহু রীতিমত চমকে উঠে গালে হাত রাখল। গালে হাত দিয়ে ও হতবম্ব; চুড়ান্ত অবাক হয়ে কাব্যের দিকে তাকাল। কাব্য নিজেই অবাক, চড়..ও তো চড় মারতে চায়নি। কি করে করে ফেলল ও এইটা?
কুহু গালে হাত দিয়ে এখনো কাব্যকে দেখছে..বিশ্বাস হচ্ছে না কাব্য ভাই ওকে এখন; গালে থাপ্পড় মারলেন? কুহু মুখে রিজেকশনের জন্যে প্রস্তুত ছিলো.. কিন্তু এতটা; এতবড় অপমানের প্রস্তুতি তো ও নেয়নি!
কাব্য অপরাধবোধে ডুবে গেল এইবার। কুহুর রক্তিম; লাল গালটুকু দেখে আর সইতে না পেরে সঙ্গেসঙ্গে এগিয়েও গেল————‘আই এম সরি কুহু; রিয়েলি সরি! ব্যথা পেয়েছিস বেশি?’
কাব্য কুহুর গাল থেকে কুহুর হাত সরিয়ে নিজে দেখল! ফর্সা গালটা লাল হয়ে গেছে কুহুর। কুহু চোখে এখন আর জল নেই; যেন কাঁদতেই ভুলে গেছে; হা করে কাব্যকে দেখে যাচ্ছে ও।
কাব্যের এইবার নিজেকে দিশেহারা মনে হতে লাগলো। এইমাত্র এটা ও কি করে ফেলল? যে কুহু জীবনে; আজ অব্দি একটা বকা অব্দি খায়নি কারোর; চাচ্চু-চাচী যাকে ননির পুতুলের ন্যায় বড় করেছেন; তাকে ও কাব্য কিনা এমন একটা অবস্থায় থা-প্পড় মেরে বসলো?
কাব্যের হাতটা কুহুর গালটা তখনো ধরে ছিলো। কুহুর কি হলো যেন…ও চুপচাপ মাথাটা নিচু করে pichiyet গেল দু কদম। ঠিক তখন কাব্যের হাতটা আপনা আপনি কুহুর গাল থেকে নেমে গেল! কাব্য একবার নিজের হাতের দিকে চেয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে রইল, অস্ফুটে বলার চেষ্টা করলো ——-‘স..সরিরি কুহু! আমি কিভাবে—-‘
কুহু কিছু বলছে না আর, চুপ করে রইল পুরোটসময়। কাব্যের ধৈর্য্যের মাত্রা এবার আকাশ ছুঁলো! কেমন যেন নিজেই নিজের উপর রাগ জন্মালো। ও পকেট থেকে ফোন বের করল। বৃষ্টির মধ্যেই ফোন ভিজিয়ে দিতে দিতে, ও হিডেন ফোল্ডার থেকে একটা ছবি বের করে কুহুর দিকে বাড়িয়ে ধরল!
কাব্য ভাই-ঊর্মি আপুর ছবি; একসাথে; কাঁধে কাঁধ ছুয়ে! কুহুর মধ্যে তখন আর কেমন যেন আর অনুভূতিই কাজ করছিল না; শুধুমাত্র ওর হাত থেকে ফ্লাওয়ার বুকেটাও একসময় গড়িয়ে কাদামাখা মাটিতে পরে গেল!
ও নীরবে; টলমল চোখে শুধু নিশ্চুপ দেখে গেল কাব্য-ঊর্মির অন্তরঙ্গ ছবি। যেখানে কাব্য উর্মির কাঁধটা ধরে ওকে নিজের সঙ্গে চেপে ধরেছে; ঊর্মি কাব্যের দিকে চেয়ে হাসছে; কাব্যও ঊর্মির দিকে চেয়ে রয়েছে— কাব্যের পরনে কুহুর অতি পছন্দের ডেনিম জ্যাকেটটা; যেটা কুহু চুরি করেছে বছর দুয়েক আগে।
কাব্য ছবিটা দেখিয়ে একইসাথে বলা শুরু করল——-‘ঊর্মি, আমার ব্যাচমেট। চিনিস তুই ওকে। আমাদের ৪ বছরের রিলেশনশিপ। আমি ওকে ভালোবাসি; আমরা কমিটেক্স একে অন্যের কাছে। আমি এটা এখনই কাউকে জানাতে চাইছিলাম না; জানলে হয়তো আরও কয়েক বছর পর সবাইকে জানাতাম। শুধুমাত্র তোর জন্যেই; আমি আজ ছবিটা দেখিয়েছি। এখন বল— এরপরেও কি তুই আমাকে ভালোবাসতে চাইবি?’
কুহু মাথাটা নিচু করে ফেলল; কথা বললো না আর। কাব্য ফোনটা কুহুর চোখের সামনে থেকে সরিয়ে আবার পকেটে ঢুকিয়ে দিল। কুহুর দিকে চেয়ে এইবার কাব্য শান্ত স্বরে বলার চেষ্টা করে———-‘আমি তোকে অনেক পছন্দ করি কুহু; তুই মেয়েটা অনেক আদরের আমার কাছে, আমাদের সবার কাছে। কিন্তু সেটা বোন হিসেবে। আমি তোকে কখনো ওই চোখে দেখিনি; যেমনটা তুই দেখিস। নিজেকে সময় দে; নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় এখন তোর। কদিন যাক; ক বছর যাক— দেখবি আমি তোর কোথাও নেই; জাস্ট একটা বিরক্তিকর অধ্যায় হবো তোর…যা তুই মনেও রাখবি না। বয়সটাই দোষের তোর; এই বয়স কেটে গেলে এই কাব্যও তোর মন থেকে কেটে যাবে।’
কুহু স্রেফ মাথা দুলাল শুধু দুদিকে। কুহু মেনেছে; কাব্যকে যেন এইবার; এতক্ষণে স্বস্তি পেতে দেখা গেল। কাব্য বড় করে শ্বাস ছেড়ে এতক্ষণে বলল——‘এইতো গুড গার্ল! বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগছে না?রিসোর্টে যাবি চল।’
কাব্য কুহুর দিকে এগিয়ে আসতে গেলে; কুহু হাতের ইশারায় কাব্যকে থামিয়ে মুখে ভাঙা গলায় স্রেফ বলল—-‘আ..আ..আমি একা যেতে পার..পারবো!’
কাব্য ভ্রু কুচকে কুহুকে দেখল———-‘শিউর?’
‘হ্যাঁ! ‘—— কুহু কোনোরকমে কথাটা বলে কাব্যকে ছেড়েই আগে আগে হাটা ধরেছে। কাব্যও মানা করলো না। কুহুর ওর সামনে এখন না থাকাই শ্রেয়! মুভ অন করিয়ে ইজি হবে।
‘এক সেকেন্ড কুহু!’—- কাব্য পেছন থেকে কুহুকে থামাল ডেকে। কুহু দাঁড়াল ঠিকই; কিন্তু কাব্যের দিকে তাকালো না। কাব্য দৌড়ে এসে ওর গা থেকে লেদার জ্যাকেট খুলে কুহুর শরীরের উপর মেলে দিল। কুহু শুধু নিশ্চুপে চেয়ে দেখল।
কাব্য অস্বস্তি নিয়েই বলল———-‘এবার যা। আর কান্না করিস না, ওকে?’
কুহু কিছু বলল না। পিঠের উপর মেলে দেওয়া কাব্যের পরিয়ে দেওয়া জ্যাকেটটা মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখে; পরপর কাব্যকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কাব্য পেছনে দাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুহুর সাজানো ছাওনিটার দিকে দেখল— যার মোমবাতিগুলি ততক্ষণে পানির ছিটায় নিভে গেছে।
কুহু দুহাতে কাব্যের পরিয়া দেওয়া জ্যাকেটটা খামচে ধরে একা-একা আনমনে হাঁটছে রাস্তার পাশ ধরে! চোখে জল নেই আর কেন যেন, রোবটের মতো হেঁটে যাচ্ছে শুধু। মনে হচ্ছে— কোনো পুতুল হাঁটছে; কোনো নড়চড় নেই; হাঁটার তালে হেলদুল নেই, রাস্তার দিকে তাকিয়ে একমনে হাঁটছে শুধু।
একসময় কুহু হাটতে হাটতে রাস্তার খোলা একপাশে এসে দাঁড়াল। কাব্যের গায়ের জ্যাকেটটা থেকে অসম্ভব সুন্দর পারফিউমের ঘ্রাণ ভাসছে কুহুর নাকে। কুহু অবচেতন মনে আগের সব কেমন ভুলে গিয়ে, নাক ভরে ঘ্রাণ নিতে নিতেই হঠাৎ দমকা হাওয়ার ন্যায় মাথায় বাড়ি খেতে লাগলো একের পর এক কাব্যের কথা; তারপর একটা থাপ্পড়! মনে পড়ে গেল— একটু আগে কি নিষ্ঠুর-করুন ভাবেই না ওর মনটা ভেঙে গেছে।
কুহু হাটা থামালো! দুহাতে জ্যাকেট খামচে ধরে আকাশের দিকে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ; অনেকক্ষণ! অশ্রু চোখের কোন বেয়ে শুধু গড়াচ্ছে; শব্দ নেই সেই কান্নার।
তারপর হঠাৎ…একদম আচমকা আকাশ-বাতাস কাপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। চুল খামচে ধরে; হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল! আকাশে বৃষ্টিও বেড়ে গেল তখন; আচমকা ঝড় শুরু হয়ে গেল। কুহু সেই ঝড়েই মাটিতে হাঁটু ভেঙে লুটিয়ে পরে চিৎকার করে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো।
একহাতে পাগলের ন্যায় একবার মাটি খামচে ধরার চেষ্টা করে: ও আরেকবার নিজেই নিজেই চুল খামচে ধরে টেনে ছিঁড়বার চেষ্টা করে। একসময় রাগে-দুঃখে কাব্যের জ্যাকেটটা গা থেকে টেনে-হিচড়ে খুলে ছুড়ে ফেলে দিল অন্যপাশে।
তারপর ভেজা চোখে কাব্যের জ্যাকেটের দিকে একমনে চেয়ে রইল! হাতের মুঠোয়ে তখন ওর একমুষ্টি কাদামাখা মাটি চেপে ধরা। সেভাবেই চেয়ে থাকতে থাকেই মনে পড়ে গেল— ঊর্মি-কাব্যের ওই বিভৎস্য; যন্ত্রণাদায়ক ছবিটা। কাব্য ভাই কি করে পারলেন; কুহুর মনের মানুষকে কারোর সাথে শেয়ার করে দিতে। কাব্য ভাইও প্রেমে পড়লেন; অথচ ওই মেয়েটা কুহু ছিলো না। কুহু নয়; কাব্য ভাই অন্য কাউকে ছোঁন, অন্য কাউকে ভালোবাসেন; সেই অন্য কারোর মনের অনুভূতি কাব্য ভাই বয়সের দোষ বলে, টেম্পরারি ফিলিংস বলে পিষে ফেলতে পারেন না। কাব্য ভাইয়ের কাছে ওই অন্য মেয়ের অনুভূতির দাম আছে; নেই একমাত্র কুহুর অনুভূতির দাম— ওটা শুধু নাকি কুহুর বয়সের দোষ; মিথ্যে অবসেশন.!
কুহু দুহাতে মাটি খামচে ধরে আকাশের দিকে চেয়ে এইবার চিৎকার করে বলে উঠে ——‘আমি ভালোবেসেছিলাম; ওটা আমার ভালোবাসাই ছিলো; আপনার বলা কোনো টেম্পরারি ফিলিংস ছিলো না। আপনি বুঝলেন না কাব্য ভাই; ঠিক কতটা নিষ্ঠুর ভাবে আজ আপনি আমার মনটা ভাঙলেন। আমি এখন বেচে থাকব কার জন্যে; কাকে ভেবে বাঁচব, বলুন না? আমি..আমি কেন আপনার বোন হলাম কাব্য ভাই? কেন? আপনার বোন হওয়া আজ আমার জন্যে বি ষ মনে হচ্ছে। শুনছেন আপনি কাব্য ভাই? আপনার বোন হওয়া এই কুহুর কাছে আজ থেকে বি ষের মতো!
আপনার বোন ওই ঊর্মি আপু হলো না কেন; আমি কেন হয়ে গেলাম? আজ আমি কেন উর্মি আপুর জায়গায় থাকলাম না! কেন..কেন..কেন? এই কেনগুলোর উত্তর আমি কোথায় পাব এখন..কোথায় পাব?’
কুহু মাথায় নিচু করে অনবরত কেদে যায় শুধু! আশপাশে বোধহয় কোনও টঙ্গের দোকান থেকে তখন গান বাজাল কেউ——
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১০
‘হায় যায়না ভোলা তবু তাকে
চাই যেন সে সুখে থাকে,
সইবে হিয়া একাই ব্যথা রে।
ও বন্ধুরে, বন্ধুরে, ও বন্ধু রে ..~~