ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৯

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৯
অবন্তিকা তৃপ্তি

কাব্য ইউনিভার্সিটি যাবে বলে রেডি হচ্ছে। বিছানার উপর থেকে হাতে নিয়ে ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে, কাঁধে ব্যাগ নিলো। শেষবারের মতো পারফিউম স্প্রে করে একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই বের হয়ে ডাইনিং রুমে এসেছে। আজ ওর ভীষণ তাড়া!

কারণ হিসেবে হচ্ছে— আজ কুহুর সঙ্গে ও এক গাড়িতে করে যাবে। কুহুকে এডমিট করানোর দায়িত্ব মেঝো চাচ্চু ওর ঘাড়ে গছিয়ে দিয়েছেন। আর কাব্য এই সুযোগটাই কাজে লাগতে চাইছে। কুহুর মনে ওর প্রতি যেসব ভুল ধারণা জন্ম নিয়েছে— সব জানতে চাইবে আজ কাব্য। কুহু বলতে না চাইলে; জোর করবে, প্রয়োজনে একটা রামধমকও দিবে বলে ঠিক করে রেখেছে কাব্য— আজ আর কোনো ছাড় দেওয়া হবে না ওই বেয়াদব-অবুঝ-চূড়ান্ত জেদী মেয়েটাকে।
কাব্য খাবার টেবিলে বসতেই শামিমা রান্নাঘর থেকে ভেজে আনা পরোটার প্লেট রাখলেন ওর সামনে। কাব্য পরোটা দিয়ে আলু ভাজি খেতে খেতে ফোনটা চেক করছে একহাতে। শামিমা চুপচাপ ছেলের পাশে এসে বসে থাকলেন। কিছু একটা বলার জন্যে উসখুস করছেন ভীষণ -অথচ বলতে পারছেন না। কাব্যের ওদিকে মন নেই; ও খেতে খেতে ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একসময়, বুকে যথেষ্ট সাহস জুগিয়ে শামিমা ভীষণ আদুরে গলায় ডাকলেন——‘এই কাব্য; শোন না বাবা।’
কাব্য ফোনে ডুবে আছে, খেতে খেতে বলল——‘বলো, শুনছি আমি।’
শামিমার পছব্দ হলো না কাব্যের এই হেঁয়ালিপনার উত্তর। উনি কাব্যের দিকে চেয়ে কড়া গলায় বললেন——-‘ফোনটা রাখবি তুই?’
মায়ের গলার এই টোন ভালো করেই চেনে কাব্য। ও ফোন হাতেই শামিমার দিকে এইবার তাকাল; হাল ছেড়ে, হার মেনে বলল——‘ওকেহ ফাইন, এবার বলো!’
শামিমা কাব্যের এই হেরে যাওয়াতে মিষ্টি হাসলেন। তারপর কাব্যের দিকে এগিয়ে এসে; ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বললেন——‘তোকে একটা জিনিস দেখাই? তুই রাগ করবি না তো?’

কাব্য হালকা হেসে শামিমার হতে হাত রেখে চাপ দিয়ে বলল——‘বলো! কিন্তু তুমি এতো নারভাস হচ্ছো কেন?’
‘নার্ভাস হচ্ছি আমি? কোথায়?’ —— শামিমা কাব্যের কথাতে দ্রুত শাড়ির আঁচলে কপাল-নাকের ঘাম মুছতে মুছতে কাব্যের দিকে তাকালেন। কাব্য ভ্রু কুচকে উনার এই অদ্ভুত আচরণ দেখছিল তখন। শামিমা সেটা বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিলেন ঝটপট: শাড়ির আঁচল ছেড়ে হালকা হাসার চেষ্টা করে চুপচাপ দুটো ছবি বের করে কাব্যের সামনে টেবিলের উপর রাখলেন। কাব্য স্বভাবগত ভঙ্গিতে বাম ভ্রুটা নাচালো—-—‘কার ছব——‘
বলতে বলতে ছবিতে দুটো দিকে তাকালো ও। পরপর চোখের সামনে দুটো মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে কাব্যের বাকি কথা গলাতেই আটকে রইলো। মুহূর্তের মধ্যে ওর ফুরফুরে মেজাজে পানি পড়ে গেল, ভ্রু কুঁচকে গেল, হাসিহাসি মুখ হঠাৎ চুড়ান্ত গম্ভীর হয়ে উঠল!

শামিমা কাব্যের মুখের অবিভ্যক্তি বদলাতে দেখে এইবার দ্রুত সাফাই গাওয়া শুরু করেন———‘তোর বামের মেয়েটা হচ্ছে কমিশনারের মেয়ে; ঢাকা ভার্সিটিতে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে পড়ছে। ভীষণ সুন্দর;দারুণ ব্রিলিয়ান্ট। একবার ভালো করে দেখলে তুই নিজেই বুঝবি আমি একটুও কিন্তু বাড়িয়ে বলছি না। আরডান পাশেরটা হচ্ছে তোর বাবার বন্ধু আরিফ ভাইয়ের মেয়ে; চিনিস তো তুই উনাকে। উনার মেয়েটাও এবার ইঞ্জিনিয়া—‘
বাকিটা বলার আগেই কাব্য হঠাৎ মুখটা থমথমে করে বলে উঠল——‘স্টপ আম্মু!’
শামিমা বাকি প্রশংসা কাব্যের আচমকা থামানোতে গিলে ফেললেন। কিছুটা আশঙ্কা নিয়েই কাব্যের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন—-‘কিরে, মেয়ে দুটো ভালো লাগেনি?’

কাব্য ছবি-দুটোর দিকে দ্বিতীয়বার তাকালোই না; আঙুলের সাহায্যে ছবিদুটো সেভাবেই আলগোছে ঠেলে দিল শামিমার দিকে! শামিমা ছবি-দুটোর দিকে একবার চেয়ে আবার কাব্যের মুখটার দিকে তাকালেন।
কাব্য রাগারাগী করলো না; চেচালো না। শুধুমাত্র ঠান্ডা গলায় বলল——‘আমি মেয়েদুটোকে দেখেইনি আম্মু, তাই ভালো না লাগার প্রশ্ন এখানে আসছে না। আসল কথা হচ্ছে-আমি এখন বিয়েই করবো না আম্মু; অ্যাই নিড প্রিপারেশন ফর দিস!’
শামিমা বিরক্ত কাব্যের এই প্রিপারেশনের কথাতে। সারাটাদিন কাব্য যদি শামিমার মতো একা একটা ঘরে পরে থাকত: সে ঠিকই বুঝতে পারত শামিমা কেন ছেলেকে এত দ্রুত বিয়ে দেবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছেন।
শামিমা হাল ছাড়েননা, এবার সাফাই গেয়ে গেয়ে বলতে থাকেন——‘একবার তো দেখা কর আব্বু মেয়েদুটোর সাথে: ভালো লাগলে না হয়—‘

‘প্লিজ আম্মু!’—- কাব্য হঠাৎ গলার স্বর উঁচু করে ফেলল! ওর হঠাৎ এসব বিয়ে; অজানা মেয়েদুটো সবাইকেই বিরক্ত লাগছে শুরু হয়েছে। শামিমার কানের কাছে এই বিয়ে-বিয়ে প্যাচাল অসহ্য শোনাচ্ছে।
কাব্যের উঁচু গলার স্বর শোনে শামিমার কথা আটকে গেলো; বাকি কথা বলার সাহস পেলেন না। চুপ করে মাথাটা নামিয়ে জগ থেকে পানি ঢালছেন গ্লাসে। শামিমাকে হঠাৎ চুপ হতে দেখে কাব্য এইবার মায়ের চোখ-দুটোর দিকে তাকাল! শামিমার হাত থেকে পানির গ্লাস টেনে নিয়ে সেটা টেবিলে রেখে দিয়ে, তারপর ভীষণ নরম গলায় বলল——-‘সময় হোক আম্মু; বিয়ের জন্যে প্রিপেয়ার হলে আমি নিজে বলবো তোমাকে। তার আগে এসব মেয়েদের ছবি আমাকে দেখিও না; আমার বিরক্ত লাগছে এসব!’

কাব্য শামিমাকে কিছু বলতে না দিয়েই ব্যাগ নিয়ে উঠে গেল। ফোন পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে শামিমার লটকে যাওয়া মুখ, মন খারাপ করা চোখ-দুটোও নজরে পড়লো। কাব্য চুপচাপ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে এগিয়ে এসে শামিমার গাল ধরে কপালে আলতো করে চুমু খেলো; শামিমা কাব্যের দিকে তাকালে কাব্য বিনিময়ে নরম কণ্ঠে বলল———-‘আসছি, মন খারাপ করো না এটার জন্যে! বিয়ে করবো আমি। সারাজীবন কুমার থাকার ইচ্ছেও আমার নেই, হু?’
শামিমা ছেলের ওইটুকু আদরে গলে গেলেন পুরোপুরী। ছেলের হাতের হাত রেখে বললেন——‘সাবধানে যাবি! গাড়ি আস্তে ড্রাইভ করবি; কুহুকে বকবি না একদম বলে দিচ্ছি!’

কাব্য অল্প হাসল, কুহুর কথা মাথায় আসতেই আবার তাড়া দেখিয়ে গাড়ির চাবি হাতে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
পার্কিং স্পট থেকে গাড়ি বের করতে করতে কাব্যের ফোনে কল এলো।কুহুর বাবা, মেঝো চাচ্চু কল দিচ্ছেন। কাব্য ফোনটা স্পিকারে দিয়ে ফোনটা সামনে রাখল; একহাতে গাড়ি পার্কিং স্পট থেকে বের করতে করতে কাব্য সালাম দিল সাদাতকে: সাদাত ভীষণ নিচু গলায় সালামের জবাব দিতেই কাব্য বলল——-‘কুহু রেডি হয়েছে চাচ্চু? আমি গাড়িতে আছি!’

সাদাত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ভীষণ অপরাধবোধ নিয়ে বললেন——-‘আসলে. . . রাগ করো না কাব্য। কু. . কুহু যাবে না তোমার সঙ্গে। ও স্কুটি করে চলে গেছে ভার্সিটি!’
‘হোয়াট? কেন?’—- কাব্য হঠাৎ গাড়ি চালানো থামিয়ে ফোনের দিকে চেয়ে উঁচু গলায় বলে উঠলো! !
সাদাত এখনো নিচু গলায় বললেন——-‘ওকে বোঝাতে পারিনি আমি। তুমি চলে যাও ভার্সিটি; কুহুর সঙ্গে ওইখানে তোমার দেখা হয়ে যাবে।’

কাব্য শুনলো; সাদাতকে পাল্টা প্রশ্ন করে লাভ নেই। কুহু নিশ্চয়ই উনাকেও আজব-সাজব বুঝিয়ে কাব্যের সঙ্গে যাবে না বলেই, স্কুটি নিয়ে আগেআগেই পালিয়েছে। কাব্য ছোট, ম্লান গলায় স্রেফ বলল——-‘হু! ঠিকাছে!’
সাদাত কল কাটলেন। কাব্য গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে চুপচাপ ওভাবেই বসে থাকল অনেকক্ষণ! পরপর হঠাৎ মেজাজ খুইয়ে আচমকা ঘুষি বসালো স্টিয়ারিং-এ!
রাগ উঠছে ওর হঠাৎ! কুহুকে সামনে পেলে এখন ..মাথায় তুলে একটা আছাড় মারতো কাব্য! কাব্য তো সুযোগ চাইছে; কথা বলতে কিসের জাত চলে যাবে এই বেয়াদব মেয়ের?

কাব্য বুঝেছে— কুহু ওকে পুরোদমে এড়িয়ে যাচ্ছে। আজ ভার্সিটি গেলে ওর একদিন কি ওই বেয়াদব-অতি বোঝা কুহুর একদিন করে ছাড়বে কাব্য! দিনদিন ওই মেয়ের ব্যবহার অসহ্য ঠেকছে।
অথচ একটা প্রশ্ন কাব্যের মাথায় কেন এলো না— কুহু যদি ওকে এড়িয়ে যায়; ওর কিসের এত মাথা-ব্যথা? ভালোই তো চলছে সব. কুহু মুভ অন করেছে, কাব্যের কথামতো নিজের লাইফে ফোকাস করছে! সব তো ঠিকঠাক চলছে। তাহলে কাব্য এসবে এতটা পুড়ছে কেন? কুহুর ভুল ভাঙানোর ওর হঠাৎ কিসের এত দায় পড়ল? ব্যাপারটা আসলেই অবাক করা প্রশ্ন! কিন্তু কাব্যের এই প্রশ্ন-গুলো মাথাতে আসেনা। ও তখনো উন্মাদের মতো কুহুর সঙ্গে একটিবার কথা বলার জন্যে মরিয়া হয়ে সুযোগ খুঁজে যাচ্ছিল।ব্যাপারটা হাস্যকর না?

‘ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (DIU)’
প্রথমবার ভার্সিটিতে এসেছে কুহেলিকা সিদ্দিক কুহু! কাব্যের মতে— এই ভার্সিটিতেই নাকি কুহু আবার প্রেমে পড়বে, ভালোবাসবে কাউকে। এখানে আসার পর কুহুর মন থেকে নাকি ওর টিনেজ জীবনের ভালোবাসা; এক তরফা প্রেম কাব্য ভাই মুছে যাবেন চিরতরে! কুহু মলিন হাসল; ভার্সিটির সকল ছেলের দিকে ও চোখ ঘুরিয়ে দেখল একবার, দুবার, কয়েকবার।

অদ্ভুত! কারোর মধ্যেই তো ওর কাব্য ভাইয়ের মতো সুদর্শন; স্মার্ট, পাগলকরা ম্যানলি এটিটিউড খুঁজে পেল না। কুহুর নিজের প্রতি হঠাৎ কেমন বিতৃষ্ণা হলো। কাব্য ভাইকে বলতে ইচ্ছে হলো—
‘আপনার মতো কেউ হয়না কাব্য ভাই! এ কুহুর মনে শুধুমাত্র আপনি একটা দাগ কেটেছিলেন; ভীষণ গভীর ছিলো সেই দাগটুকু! অথচ আজ এই দাগ, দাগই রয়ে গেল; প্রেমের ফুল হয়ে জন্মালো না দ্বিতীয়বার!’
কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্কুটি থেকে নেমে স্কুটার হেলমেট খুলে এলোমেলো চুল ঠিক করলো।

স্কুটি থেকে নেমে দাঁড়াতেই, কোথা থেকে তানিম কুহুকে দেখেই এগিয়ে এলো। কুহু তানিমকে দেখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না, চুপচাপ যেন দেখেইনি এমন একটা ভান করে কাঁধে টোটো ব্যাগ নিলো। কিন্তু তানিম ঠিকই কুহুকে দেখে উচ্চসিত হয়ে বলল——-‘আরে কুহু; তুমি? এখানেই এডমিট হচ্ছো নাকি?’
কুহু এইবার যেন দেখতে পেল তানিমকে, এমন একটা ভাব করে হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো——‘জি ভাইয়া!’
তানিম আশপাশে কাউকে না দেখে কুহুকে বললো-—-‘কাব্য আসেনি?’
কাব্যের নাম শুনেই চোখ-মুখ কুচকে এলো কুহুর, তেতো মুখে জবাব দিল——-‘আমি জানিনা ভাইয়া। আপনি খুঁজে দেখতে পারেন।’

বলে কুহু তানিমকে পাশ কাটিয়ে তেতো মুখে চলে এলো। তানিম কুহুকে ডাকতে গেল; তবে ডাকল না আর পেছন থেকে। কেননা তখন সিয়াম; যে কিনা পুরো ভার্সিটিতে কাব্যের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী
এসে তানিমের কাঁধে হাত দিয়ে থাপ্পড় বসালো! তানিম পেছন ঘুরে দেখেই খারাপ মেজাজ নিয়ে ঝটকা দিয়ে ওর হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে ফেলে বলল——-‘কি চাই তোর?’
সিয়াম চোখের ইশারায় চলে যাওয়া কুহুকে দেখিয়ে টিপ্পনি কেটে বলল——‘নিউ গার্লফ্রেন্ড নাকি রে?’
তানিমের মুখটুকু এ কথা শুনে রাগে লাল হয়ে গেল! ও থমথমে গলায় বলল——-‘কাব্যের বোন হয়; মুখ সামলে ওরে নিয়া কথা বলবি সিয়াম!’

‘কাব্যের বোন’ কথাটা যেন মাথায় রীতিমত ধাক্কা খেলো সিয়ামের। এটাতো সোনায় সোহাগা ব্যাপার হয়ে গেল মাইরি!
সিয়াম পরপর মুখটুকু উজ্জল করে, দুনিয়া জয় করে ফেলেছে এমন একটা ভাব করে বললো——-‘কি বলিস? সত্যি? ওটা কাব্যের বোন? দেখতে কিন্তু জোস মাইরি; আ’ম ক্রাশড!’
বলে তানিম পেছন ফিরে কুহুর যাওয়ার দিকে তাকাল। কুহু আজ কালো ঢিলেঢালা পাকিস্তানি কুর্তি-পাজামা পড়েছে, চুল কাঁধের কিছুটা নিচে সুন্দর একটা কাট দেওয়া; কাঁধে একটা ফ্লোরাল পিংক টোটো ব্যাগ! সিয়াম তানিমের কাঁধে ঝুঁকে দাড়িয়ে হা করে কুহুর দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো ওকে পেছন থেকে। তানিম কাব্যকে খুঁজছে তখন; এই সিয়ামের হাবভাব সুবিধার ঠেকছে না। ওমন করে কুহুকে দেখছে মানেই বিরাট কোনো মতলব করছে; ওটা নিশ্চয়ই দুনিয়ার সবচেয়ে বিশ্রী মতলবই হবে।

সিয়াম কুহুর হাঁটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তানিমকে শুনিয়ে শুনিয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলতে থাকে——-‘ধুর, পাকিস্তানি জামা পরে আজকাল মেয়েদের ফিগার-ই বোঝা যাচ্ছে না। বাট তোর কাব্যের বোন আসলেই হেব্বি দেখতে; হাঁটার স্টাইল দেখ, একদম ফাটাফাটি!’
সিয়াম হা হয়ে কুহুকে তখনো তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখতে ব্যস্ত! বাকি কথা বলার আগেই তানিম রেগে ওর হাত নিজের কাঁধ থেকে ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিল। সিয়াম তাকাল তানিমের দিকে হেসেহেসে ভীষণ মজা নিয়ে, তানিমের রাগটুকু ওর ভেতরের পুরুষত্ব আরো জাগিয়ে দিচ্ছে। পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে তানিমকে রাগতে দেখে। কাব্যও নিশ্চয়ই কুহুর সম্বন্ধে সিয়ামের এমন কমেন্টস শুনলে রাগবে; মারতেও আসবে। অনেকদিন ধরে সিয়াম-কাব্যের মারামারি হচ্ছে না; ভীষণ মিস করছে সিয়াম কাব্যের হাতের মাইর! কাব্য একটা দিবে; সিয়াম একটা দিবে; দুজনের তুমুল মার শেষে প্রিন্সিপালের রুমে যাবে; সরি বলবে প্রিন্সিপালের সামনে; তারপর কদিন ভালো যাবে: — তারপর আবার যে-সে অবস্থা রিপিট হবে।

ইউনিভার্সিটিতে এসব ঝামেলা টুকটাক না হলে মজা আসেনা ঠিকঠাক!
সিয়াম দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে দেখলো রাগান্বিত তানিমকে। তানিম দাতে দাঁত পিষে বললো——-‘কাব্য শুনতে পেলে তোর কপালে দুঃখ আছে সিয়াম! শুধরে যা সময় থাকতে থাকতে।’
সিয়াম শুনে গা ছাড়া ভাবে জবাবে হেসেই হেসেই বলল——‘বলে দিস তোর কাব্যকে; ওর বোনটাকে আমার লাগবে। ও দিলে দিবে; নাহলে আমি ওর চোখের সামনে ওর বোনকে খোপ করে ধরে ফট করে নিজের বাইকে বসিয়ে ফুরুত হয়ে যাব, শাশাশা!’

সিয়াম মুখ দিয়ে অদ্ভুত গাড়ির শব্দ করলো। তানিম তেলেবেগুনে ক্ষেপে উঠলো——-‘খবরদা—-‘
বাকিটা বলার আগেই সিয়াম চোখে সানগ্লাস পরে শিস বাজাতে বাজাতে ওর দলবলের দিকে এগিয়ে গেল। তানিম মেজাজ খারাপ নিয়ে সিয়ামের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল——‘সন অব এ বিচ! জীবনেও শোধরালো না।’
তানিম কথা শেষ করতে করতে কাব্যের গাড়ি ঠিক তানিমের চোখের সামনে এসেই থামল! তানিম কাব্যকে দেখে থামল; এগিয়ে গেল। কাব্য গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েই তানিমকে সবার আগেই জিজ্ঞেস করল——‘কুহুকে দেখেছিস?’
তানিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মলিন হেসে জবাবে বললো—–‘হু; দেখলাম।’
কাব্য গাড়ির চাবি পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে ব্যস্ত গলায় বলল—-‘কোথায় গেছে জানিস? আমাকে না বলে চলে এসেছে একা একাই।’

তানিম এবার আসল কথা; আসল বো-ম ঠিক কাব্যের মুখের সামনেই বা র্স্ট করে বলে উঠলো——‘যেদিকেই যাক; সিয়ামের নজরে অলরেডি পরে গেছে তোমার বোওওওন কুহু!’
তানিম কাব্যকে ক্ষেপানোর জন্যেই ‘ বোন’ শব্দটা একটু টেনেটেনেই বলল। সিয়ামের কথা শোনামাত্রই মাথা তুলে তানিমের দিকে তাকাল কাব্য, ভ্রু কুচকে বলল—‘মানে? কুহুর সঙ্গে ওর দেখা হয়েছে?’
তানিম বলল———‘সিয়াম ওর সঙ্গেই দেখা করবে বলে ক্যান্টিনের ওদিকে গেছে মনা!’
তানিম মজা নিচ্ছে এইবার। ও আসলে দেখতে চাইছে— কাব্য আসলে আউহুর ব্যাপারটা এখন কেমন করে দেখছে। ভালো যদি বেসে থাকে, তবে তো মামা জেলাসিতে পুড়বেই পুড়বে!
তানিমের ভাবনাই ঠিক! কাব্য ভ্রু কুচকে ফেলল সঙ্গেসঙ্গে; চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ঐপাশটায়। সিয়াম তার দলবল নিয়ে এগুচ্ছে! কাব্য ভ্রু কুচকে সিয়ামের দিকে কড়া চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে ঠান্ডা স্বরে স্রেফ কটা কথা বলল——‘ওর চোখ-দুটো নিয়ে আমি আজকে ক্যাম্পাসে লাটিম খেলবো, কোনদিকে চোখ যায় ওই শালার? চল তুই আমার সাথে!’

কাব্য তানিমকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ওইদিকে। তানিম বাকা হেসে কাব্যের রাগান্বিত মুখ; ঘনঘন ফুসতে থাকা শ্বাস-প্রশ্বাস, ওর ব্যাকুল জেলাসিতে পুড়তে থাকা হৃদয়ের আনচান দেখতে দেখতে পা মেলাল।
কাব্যের বড্ড দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে! কুহুর সঙ্গে ক্যান্টিনে বসে সিয়াম আরাম করে কোল্ড কফি খেতে খেতে গল্প করছে। কুহুকে সিয়াম পরিচয় দিয়েছে— ও এখানকার বেস্ট স্টুডেন্ট; যেকোনো নোটস পেতে ওর সঙ্গে একবার যোগাযোগ করলেই হবে; কুহুকে সব নোটস- যেকোনো প্রকার সাহায্য একমাত্র করতে পারবে সিয়ামই!
কুহুকে সিয়াম ওর এসএসসি; এইচএসসি মার্ক জিজ্ঞেস করছিল। সেটাই বলছে কুহু এখন। আর ঠিক তখুনি কাব্য এসে দেখে নিয়েছে ওদের দুজনকে।

কুহু হালকা হেসে মাথা দুলাচ্ছে সিয়ামের কথাতে; সিয়ামও হা করে কুহুকে দেখে যাচ্ছে। সিয়ামের মনের অনুভূতি কুহু না জানলেও; কাব্য ওই শালার নষ্ট চোখের দিকে চেয়েই বুঝে ফেলেছে— ওর আসলে কি চাই কুহুর থেকে।
তানিম কাব্যকে খুচিয়ে খুঁচিয়ে বলল——‘কুহু সবার সঙ্গে কত সুন্দর মিশে যায়: মেয়েটার এত গুণ দেখতেও ভালো লাগছে।’

কাব্য তানিমের এমন একটা আহাম্মক কথাতে চুড়ান্ত বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠল——-‘জাস্ট শাট আপ!’
তানিম কাব্যের ধমক খেয়েও হাসছে তবুও; ওভাবেই ঠোঁটে আঙুল চেপে কুহুকে দেখছে তো আরেকবার রাগে ফুসতে থাকা কাব্যকে দেখছে;ভালোই বিনোদন পাচ্ছে ও এইমুহূর্তে।
কাব্য আবার সিয়াম-কুহুর দিকে তাকাল।সিয়াম যখন কথা বলতে বলতে কুহুর বুকের দিকে তাকালো, কাব্যের মেজাজ মুহূর্তের মধ্যে পাগলাটে; ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো হয়ে গেল। কাব্য রেগেমেগে এগিয়ে যেতে চাইলেই: তানিম দ্রুত ওর হাত চেপে ধরল——-‘কই যাচ্ছিস?’

কাব্য তানিমের দিকে রক্তলাল চোখে তাকাল। রাগে ওর সম্পূর্ণ গা কাঁপছে; ও ফুসতে ফুসতে বললো———‘ট্রাস্ট মি তানিম: আমি ওর চোখ আজকে ছিড়ে ফেলব। কই তাকাচ্ছে ও? কুহুর বু.. ‘
কাব্য থেমে গেল বাকিটা বলার আগে। পরপর চোখ বুজে লম্বা শ্বাস ছেড়ে হিসহিসিয়ে বললো স্রেফ———‘ওরে বোঝানো লাগবে: ও যেই মেয়েরে ট্র্যাপ ফেলানোর চেষ্টা করছে ওইটা আমার বোন হয়। ও তো আমার হাতেই আজকে মরবে ফর শিউর! ওরে তো আমি আজ—-‘
বলে কাব্য তানিমের চেপে রাখা হাত সরিয়ে দিয়ে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল কুহু আর ওই নষ্ট সিয়ামের দিকে।

তানিম এইবার, অনেকক্ষণ পর পেছনে থেকে একটা চেয়ার টেনে আরাম করে সেটাতে বসল; গা নড়েচড়ে; দুহাত মুড়িয়ে সিনেমা দেখার মতো বসে বলল——‘এখন শুরু হবে পূর্ণদৈর্য বাংলা ছায়াছবি—নাম প্রেমের আছে কয় ধাপ! চলছে সিন নাম্বার ওয়ান- দ্য জেলাসি!’
কাব্য বড়বড় পা ফেলে সোজা গিয়ে দাঁড়াল ঠিক কুহুর সামনে। টেবিলে একটা ঠাস করে থাপ্পড় বসাতেই কুহু চমকে উঠে কাব্যের দিকে তাকাল। কাব্য সিয়ামের দিকে একবার চেয়ে আবার কুহুর দিকে তাকালো;
চিবিয়ে চিবিয়ে বলল——-‘ক্যাম্পাসে এসেই ছেলেদের সঙ্গে হাহাহিহি করা শুরু করে দিয়েছিস? গেট আপ; অ্যাই সে জাস্ট গেট আপ!’

কুহু অবাক হয়ে এই রাগে রক্তিম কাব্যকে দেখছিল।কুহুকে ওভাবে ধমকাতে দেখে সিয়াম কাব্যের দিকে চেয়ে কুহুর প্রতি কুমিরের মিথ্যা সহমর্মিতা দেখিয়ে বলল——-‘কি হয়েছে কাব্য? ওকে বকছিস কেন?’
সিয়ামের এই কথা কাব্যের কাটা গায়ে যেন নুনের ছিটের মতো লাগলো। ও চোখ ঘুরিয়ে সিয়ামের দিকে তাকালো; সামান্য হিংস্র হাসি দিয়ে বলল——-‘এটা আমাকে জিজ্ঞেস করছিস তুই? জাস্ট স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম হার: সিয়াম। একবার ওয়ার্ন করছি; বারবার কিন্তু করব না আমি। নেক্সট টাইম মুখের নকশাই বদলে দিব, মাইন্ড ইট!’
কুহু কাব্যের এমন হুমকি-ধমকি শুনে বিরক্ত হয়ে বলল——‘উনার সঙ্গে আমি জাস্ট কথা বলছিলাম; আপনি এমন করে উনাকে হুমকি দিচ্ছেন কেন? এটা কেমন ব্যবহার?’

ব্যাস: কাব্যের যা ভালো মেজাজ বেচে ছিলো; খুইয়ে গেল! কাব্য কুহুর দিকে এমন করে তাকাল— এক্ষুনি যেন এই মেয়েকে কাব্য কাচাই খেয়ে ফেলবে; খেয়ে ঢেকুর অব্দি তুলবে না। কাব্য এইবার আর একটাও কথা খরচ করার ধৈর্য দেখালো না। হাত দিয়ে কুহুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে চেয়ার থেকে টেনে উঠিয়ে নিলো। কুহু অবাক হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকাল; যা কাব্য চেপে রেখেছে এইমুহূর্তে!
কাব্য কুহুকে নিয়ে যাওয়ার আগে আরও একবার সিয়ামের দিকে চেয়ে শাসিয়ে উঠল—‘আবার বলছি সিয়াম; জাস্ট স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম হার! ভালো জায়গায় তুই হাত দিসনি এইবার!’
কথাটা বলে কাব্য টেনে নিয়ে যেতে লাগলো কুহুকে। কুহুর হাতে ব্যথা পাচ্ছে; ও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো—-‘আমার বিল বাকি। ছাড়ুন কাব্য ভাই: ব্যথা পাচ্ছি আমি। এটা কেমন অসভ্যতা, হাতটা ছাড়ুন বলছি!’

কাব্য ওসব শুনেও না। ও তানিমের সামনে এসে একবার পা থামালো; কুহু তখনো কাব্যের মারাত্মক শক্ত হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত! কাব্য ওদিকে পাত্তা অব্দি দিল না, চেয়ারে বিষে বিনোদন দেখতে থাকা তানিমের দিকে চেয়ে স্রেফ বলল——‘বিলটা পে করে দিস ম্যাডামের!’
বলে কুহুর দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে আবার টেনে নিয়ে যেতে লাগল ওকে। কুহু বারবার চেচালো, হাত ছাড়ার জন্যে ধমকালো; রাগ দেখালো প্রচুর। কাব্য আজ ওসব কিছুর ধার ধারল না। ওর মাথাটা আজ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মাথাজুড়ে শুধু থেকে গেছে—- সিয়াম কুহুকে নষ্ট নজরে চেকআউট করছিল, কুহু সিয়ামের ট্র্যাপে পা দিয়েছিলো; কেন দিল? কাব্যের উপর জেদ দেখিয়ে?

জেলাসির আগুনে পুড়ে রীতিমত ঝলসে গেছে কাব্য আজ। ওর হিতাহিতজ্ঞান কাজ করছে না আজে একটুও। অথচ বোকা কাব্য তখনো বুঝে উঠতে পারেনি— যে বিশ্রী অনুভূতিতে ও পুড়ছে; ওটাকে জেলাসি বলে; প্রেম বলে; ভালোবাসাই বলে!
কাব্য সেভাবেই কুহুকে টেনে এনে একটা খালি রুমে ছুড়ে ফেলল। কুহু ছাড়া পেতেই হাতের দিকে তাকাল; ওর হাতে রক্ত জমাট বেধে গেছে এতক্ষণে। সেটা দেখামাত্রই কুহু ভীষণ রেগে তাকাল কাব্যের দিকে।
কাব্য একটু দূরে দাড়িয়ে মাথা নিচু করে নিজের রাগ সামলাতে ব্যস্ত। কুহুকে ও আঘাত করতে চাইছে না; তাই বহু কষ্টে নিজের রাগ কন্ট্রোল করছে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে বারবার নাকের নীচটুকু ঘষছে; কপাল ঘষছে; আর বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে; ভুলেও কুহুর দিকে তাকাচ্ছে না।

কাব্যের এমন আচরণে কুহু মেজাজ হারিয়ে এবার চেঁচিয়ে উঠলো; রাগ দেখিয়ে বলতে লাগল—-‘আপনি আমার হাতে রক্ত জমাট বাঁধিয়ে ফেলেছেন। কিসের এত জেদ আপনার? আমি এখন শান্তিতে আছি আপনার কি সেটাও সহ‍্য হচ্ছে না? নাকি আপনার পেছনে কেউ ঘুরঘুর করছে না কুকুরের মতো,সেটা দেখ নিজের পুরুষ মনের আনন্দ পাচ্ছেন না? কোনটা? উত্তর দি—-‘
বাকিটা বলার আগেই কাব্য বড়বড় পায়ে তেড়ে এসে কুহুর দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে ওকে নিজের দিকে টেনে আনল।

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৮

কুহু আচমকা এমন ঘনিষ্ট হওয়াতে চমকে বড়বড় চোখে তাকালো কাব্যের ঠিক রাগী; রক্তিম মুখের দিকে!
কাব্য এইবার নিজের মেজাজ হারিয়ে নিজেও কুহুর সাথে জোরে চেঁচিয়ে কথা বলতে লাগলো————‘একদম চুপ! আজ আমি না; তুই আমাকে উত্তর দিবি! সবকিছুর; ইচ এন্ড ইভরি কোয়েসশনের উত্তর তুই আজকে আমায় দিবি! আজ তুই বলবি আমাকে তোর এক্সাক্ট সমস্যাটা কি। টেল মি কুহু; আমার হাতের আজ প্রচুর সময়। সব শুনব আমি তোর: সব উত্তর। আমাকে বল তোর এক্সাক্ট সমস্যা কি? কি জন্যে তুই এমন করছিস আমার সাথে? তোকে রিজেক্ট করেছি শুধুমাত্র এইজন্যে তুই ঢ্যাংঢ্যাং করে একটা খারাপ ছেলের সঙ্গে হাহাহিহি করছিলি? উত্তর দে কুহু; মুখে কুলুপ এটে থাকলে আমার হাতে আজ তুই থাপ্পড় খাবি।’

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২০